عَنْ أَنَسٍ ، قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : مَنْهُومَانِ لاَ يَشْبَعَانِ : مَنْهُومٌ فِي عِلْمٍ لاَ يَشْبَعُ ، وَمَنْهُومٌ فِي دُنْيَا لاَ يَشْبَعُ
অনুবাদ
হযরত আনাস রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সা. বলেছেন, দু’জন লোভী কখনো তৃপ্ত হয় না; ১. জ্ঞানলোভী যে জ্ঞানার্জনে কখনো তৃপ্ত হয় না। ২. দুনিয়ালোভী, যে ধন-সম্পদ অর্জনে কখনো তৃপ্ত হয় না।
(মুসতাদরাক হাকেম-৩১২, বায়হাকি ফি শুয়াবুল ঈমান-১০২৭৯)
রাবী পরিচিতি
নাম ও বংশ পরিচয় : আনাস ইবনে মালিক ইবনে নাদর আল আনসারী রা. হিজরাতের দশ বছর পূর্বে ৬১২ খ্রিষ্টাব্দে মদিনার বিখ্যাত খাযরাজ গোত্রের বনু নাজ্জার শাখায় জন্মগ্রহণ করেন। আনাসের বয়স যখন আট-নয় বছর তখন তাঁর মা রুমাইসা বিনতে মিলহান বা উম্মে সুলাইম বিনতে মিলহান ইসলাম গ্রহণ করেন। এ কারণে তাঁর পিতা মালিক ক্ষোভে-ঘৃণায় শামে চলে যায় এবং সেখানে কুফরি অবস্থায় মারা যায়। মা রুমাইসা বিনতে মিলহান পরবর্তীতে আবু তালহাকে বিবাহ করেন।
রাসূল সা. মদিনায় আগমন করা মাত্রই আনাস রা.-এর মা রুমাইসা বিনতে মিলহান ছেলেসহ উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আনসারদের নারী-পুরুষ প্রত্যেকেই আপনাকে কিছু না কিছু হাদিয়া দিয়েছেন; আমি তো কিছুই দিতে পারিনি, আমার আছে এই ছেলে, সে লিখতে জানে; আপনার খিদমতের জন্য একে কবুল করুন।’ রাসূলে করিম সা. আনন্দ প্রকাশ করে নিজ মোবারক হাত তার মাথায় বুলিয়ে দিলেন, আর নিজের কোমল আঙুল দিয়ে তার জুলফি স্পর্শ করলেন এবং তাকে পরিবারভুক্ত করলেন।
রাসূল সা.-এর খেদমতে : হযরত আনাস রাসূলুল্লাহর সা. জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত প্রায় দশ বছর খেদমতের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সব সময় রাসূলুল্লাহ সা.-এর সঙ্গে থাকতেন। আবাস-প্রবাসে, ভিতরে-বাহিরে কোনো বিশেষ স্থান বা সময় তাঁর জন্য নির্ধারিত ছিল না। পর্দার আয়াত নাজিল হওয়ার পূর্বে তিনি স্বাধীনভাবে রাসূলুল্লাহর সা. গৃহে যাতায়াত করতেন। আনাস রা. বলেন, একদিন আমি অন্দরে প্রবেশ করতে যাবো, এমন সময় রাসূল সা. ডেকে বললেন, আনাস! পিছিয়ে এসো, হিজাবের আয়াত নাজিল হয়ে গেছে।
হাদিস বর্ণনা : হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবিদের মধ্যে যারা মূল ভিত্তি বলে বিবেচিত, হযরত আনাস ছিলেন এই দলেরই একজন। রাসূল সা.-এর আচার-আচরণ, চেহারা-সুরত, ব্যক্তিগত অভ্যাস ও দৈনন্দিন জীবনের কার্যাবলি সংবলিত হাদিসগুলো প্রায় সবই আনাস রা. বর্ণনা করেছেন। ফিকাহশাস্ত্রেও হযরত আনাসের পা-িত্য ছিল। ফকিহ সাহাবিদেরকে তিনটি স্তরে ভাগ করা হয়। আনাস ছিলেন দ্বিতীয় স্তরে।
সন্তান-সন্ততি : রাসূল সা.-এর বিশেষ দোয়ার বরকতে আনসারদের মধ্যে হযরত আনাসের সন্তান-সন্ততির সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি। মৃত্যুকালে তিনি ৮২ জন ছেলেমেয়ে রেখে যান, তাদের মধ্যে ৮০ জন ছেলে এবং হাফসা ও উম্মু আমর নামে দুই মেয়ে।
মৃত্যু : সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মতে হিজরি ৯৩ সনে হযরত আনাস রা.
মৃত্যুবরণ করেন, তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ১০০ বছরের ঊর্ধ্বে। হযরত আনাস ছিলেন দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণকারী বসরার শেষ সাহাবী। সম্ভবত আবু তুফাইল রা. ছাড়া তখন পৃথিবীতে দ্বিতীয় কোনো সাহাবি জীবিত ছিলেন না।
হাদিসের ব্যাখ্যা
উক্ত হাদিসে দু’টি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে, ১. যারা জ্ঞানী তাদের জ্ঞান লাভের তৃষ্ণা কখনো মিটবে না, ২. যারা দুনিয়া উপার্জনকারী তাদের দুনিয়ার ধন-সম্পদ উপার্জনের তৃষ্ণাও জীবনে মিটবে না। নি¤েœ এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
مَنْهُومٌ فِي عِلْمٍ لاَ يَشْبَعُ
“জ্ঞানলোভী যে জ্ঞানার্জনে কখনো তৃপ্ত হয় না।”
উক্ত হাদিসের প্রথমাংশে রাসূল সা. বলেছেন, দ্বীনের ইলম অর্জনকারী জ্ঞান অন্বেষণ করতে করতে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছবে কিন্তু জ্ঞানার্জনে সে তৃপ্ত হবে না, অর্থাৎ জ্ঞানার্জনের পিপাসা তার মিটবে না। ইল্ম এমন একটি দু®প্রাপ্য সম্পদ যা আল্লাহর একান্ত অনুগ্রহ ছাড়া পাওয়া সম্ভব হয় না। আল্লাহ যাকে চান তাকে দ্বীনের বিশেষ পা-িত্য দান করেন। এ সম্পর্কে আল-হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
مَنْ يُرِدِ اللَّهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِي الدِّينِ
“আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকে দ্বীনের জ্ঞান দান করেন।”
(বুখারি)
আল্লাহ যাদেরকে দ্বীনের ব্যাপারে বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করবেন তারা সব সময় কুরআন-হাদিস ও ইসলাম সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হবে, তাদের এই আগ্রহ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ফুরাবে না। কারণ জ্ঞান অন্বেষণকারী জানে এই পথেই রয়েছে জান্নাতের ঠিকানা। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
وَمَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَطْلُبُ بِهِ عِلْمًا سَهَّلَ اللهُ لَهُ طَرِيقًا إِلَى الْجَنَّةِ وَقَالَ جَلَّ ذِكْرُهُ [إِنَّمَا يَخْشَى اللهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ] وَقَالَ [وَمَا يَعْقِلُهَا إِلَّا الْعَالِمُونَ] [وَقَالُوا لَوْ كُنَّا نَسْمَعُ أَوْ نَعْقِلُ مَا كُنَّا فِي أَصْحَابِ السَّعِيرِ] وَقَالَ [هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ]
“আর যে ব্যক্তি ‘ইলম’ অর্জনের জন্য পথ চলে, আল্লাহ্ তার জন্য জান্নাতের পথ সুগম করে দেন। আল্লাহ্ বলেন, আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে আলিমগণই তাঁকে ভয় করে।’-সূরা ফাতির : ২৮। আল্লাহ্ আরো বলেন, আলিমগণ ব্যতীত তা কেউ অনুধাবন করে না।’’-সূরা আনকাবুত : ৩৪। আল্লাহ বলেন, ‘তারা সেদিন বলবে, আমরা যদি শুনতাম অথবা উপলব্ধি করতাম, তাহলে আমরা জাহান্নামবাসী হতাম না।’-সূরা মুল্ক : ১০। আল্লাহ বলেন, ‘বল, যারা জানে আর যারা জানে না, তারা কি সমান হতে পারে?”- সূরা যুমার : ৯ (বুখারি)
ইল্ম অর্জনকারী বা একজন ছাত্র যতক্ষণ ইলম অর্জনের জন্য চেষ্টা করে ততক্ষণ সে আল্লাহর পথেই থাকে। এ সম্পর্কে রাসূল সা. বলেছেন,
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- مَنْ خَرَجَ فِى طَلَبِ الْعِلْمِ فَهُوَ فِى سَبِيلِ اللَّهِ حَتَّى يَرْجِعَ
“আনাস রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জন করার জন্য (ঘর থেকে) বের হলো, সে ফেরত আসা পর্যন্ত আল্লাহর পথেই থাকল।’’
(তিরমিজি)
ইল্ম অর্জনের জন্য আলেম সবসময় ব্যস্ত থাকে, কারণ সে জানে এই রাস্তাটা অনেক মর্যাদা ও সম্মানের। কারণ কুরআন অধ্যয়নকারী এবং প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশগ্রহণকারীকে প্রতিদান হিসেবে আল্লাহ জান্নাত প্রদান করবেন। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ عَلِيِّ بْنِ أَبِي طَالِبٍ ، قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : مَنْ قَرَأَ الْقُرْآنَ وَاسْتَظْهَرَهُ ، فَأَحَلَّ حَلاَلَهُ ، وَحَرَّمَ حَرَامَهُ أَدْخَلَهُ اللَّهُ بِهِ الجَنَّةَ وَشَفَّعَهُ فِي عَشَرَةٍ مِنْ أَهْلِ بَيْتِهِ كُلُّهُمْ قَدْ وَجَبَتْ لَهُ النَّارُ.
“আলী ইবনে আবু তালিব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি কুরআন পড়েছে এবং তা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেছে, এর হালালকে হালাল বলে মেনেছে এবং হারামকে হারাম বলে গ্রহণ করেছে, আল্লাহ্ তায়ালা এর কারণে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন এবং সে তার পরিবারের এমন দশ জনকে সুপারিশ করতে পারবে যাদের প্রত্যেকের ওপর জাহান্নাম অবশ্যম্ভাবী।” (তিরমিজি)
আলেমগণ নবীদের ওয়ারিশ, নবী-রাসূলগণ যে কারণে দুনিয়াতে এসেছিলেন সেই একই কাজের আঞ্জাম দেওয়াই আলেমদের দায়িত্ব। আর নবী-রাসূলগণের কাজ ছিলো জ্ঞানের আলো সমাজে ছড়িয়ে দিয়ে সকল প্রকার কলুষতা থেকে জাতিকে পবিত্র করা। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
كَمَا أَرْسَلْنَا فِيكُمْ رَسُولًا مِنْكُمْ يَتْلُو عَلَيْكُمْ آيَاتِنَا وَيُزَكِّيكُمْ وَيُعَلِّمُكُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُعَلِّمُكُمْ مَا لَمْ تَكُونُوا تَعْلَمُونَ
“যেভাবে আমি তোমাদের মধ্যে একজন রাসূল প্রেরণ করেছি তোমাদের মধ্য থেকে, যে তোমাদের কাছে আমার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে, তোমাদেরকে পবিত্র করে এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয়। আর তোমাদেরকে শিক্ষা দেয় এমন কিছু যা তোমরা জানতে না।” (সূরা বাকারা : ১৫১)
আপনার মন্তব্য লিখুন