কালিমায়ে তাইয়্যেবা কিংবা কালিমায়ে শাহাদাত আপনার জীবনে মেনে নিয়েছেন তো ? এর উত্তর যদি হ্যাঁ হয় তাহলে আমার লেখাটি পড়ে উপকৃত হবেন ইনশাআল্লাহ। আমরা যে কালিমা পড়ে মুসলমান হয়েছি সেই কালিমার কথাগুলো কতটুকু বুঝি- তা ভালোভাবে যাচাই করা দরকার। আমরা কি কখনো কালিমার কথাগুলো সঠিকভাবে পবিত্র কুরআনের আয়নায় মিলিয়ে নিজের জীবনের করণীয় নির্ধারণ করতে পেরেছি? যদি পেওে থাকেন, তাহলে আপনি যাই মনে করুন না কেন, দ্বীন কায়েমের ফরজিয়াত গুরুত্বকে উপহাস করে একে নিছক ‘রাজনীতি’ বলতে পারেন না। দ্বীন কায়েমের প্রচেষ্টায় নিয়োজিত থাকা ও গুরুত্বের সাথে এই দায়িত্ব পালন করা মুসলিম হিসেবে আপনার ওপর ফরজ। নিজেদের জীবনে কালিমার স্বরূপ নিরূপণ করা মানুষ কখনো দ্বীন কায়েমের কাফেলাকে অবজ্ঞা করতে পারেন না। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় দেখা যায়, জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েও জনপ্রতিনিধিদেরকে সরকারিভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির কাছে গিয়ে আনুষ্ঠানিক শপথ বাক্য পাঠ করতে হয়। কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা সামাজিক সংগঠনে যোগ দিলেও একজন ব্যক্তিকে ঐ দলের বিধি মোতাবেক আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে হয়। তাই বাস্তব জীবনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বিধান হচ্ছে, মুসলমান হতে হলে আল্লাহর পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত নবীকে মেনে নিয়ে কালিমা পাঠের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে আনুগত্যর ঘোষণা দিতে হবে। মৌখিক কালিমা পাঠের পর রাসূল সা.-এর আনুগত্য এবং অনুসরণের মাধ্যমে মানুষ কীভাবে ঈমানদার হয়, এর এক সুন্দর উপমা দিয়েছেন মহান আল্লাহ নিজেই -
اَلَمۡ تَرَ کَیۡفَ ضَرَبَ اللّٰهُ مَثَلًا کَلِمَۃً طَیِّبَۃً کَشَجَرَۃٍ طَیِّبَۃٍ اَصۡلُهَا ثَابِتٌ وَّ فَرۡعُهَا فِی السَّمَآءِ ﴿ۙ۲۴﴾ تُؤۡتِیۡۤ اُکُلَهَا کُلَّ حِیۡنٍۭ بِاِذۡنِ رَبِّهَا ؕ وَ یَضۡرِبُ اللّٰهُ الۡاَمۡثَالَ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمۡ یَتَذَکَّرُوۡنَ ﴿۲۵﴾ وَ مَثَلُ کَلِمَۃٍ خَبِیۡثَۃٍ کَشَجَرَۃٍ خَبِیۡثَۃِۣ اجۡتُثَّتۡ مِنۡ فَوۡقِ الۡاَرۡضِ مَا لَهَا مِنۡ قَرَارٍ ﴿۲۶﴾ یُثَبِّتُ اللّٰهُ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا بِالۡقَوۡلِ الثَّابِتِ فِی الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا وَ فِی الۡاٰخِرَۃِ ۚ وَ یُضِلُّ اللّٰهُ الظّٰلِمِیۡنَ ۟ۙ وَ یَفۡعَلُ اللّٰهُ مَا یَشَآءُ ﴿۲۷﴾
“তোমরা কি দেখ না যে, আল্লাহ তায়ালা কোন জিনিসের সাথে কালিমা তাইয়্যেবার তুলনা করেছেন। এটার দৃষ্টান্ত হলো, যেন একটি ভালো জাতের গাছ যার শিকড় মাটির গভীরে দৃঢ় নিবদ্ধ হয়ে আছে এবং শাখাগুলো আকাশ পর্যন্ত পৌঁছেছে, যা প্রত্যেক মৌসুমে তার ফল দান করে তার প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। এসব উদাহরণ আল্লাহ এই জন্য দিয়েছেন যেন মানুষ এটা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। আর নাপাক কালিমার উদাহরণ হচ্ছে, একটি খারাপ জাতের গাছ, যা মাটির উপরিভাগ থেকে উপড়ে ফেলা যায়, এর কোনো দৃঢ়তা নেই। যারা প্রতিষ্ঠিত প্রমাণিত বাক্যে বিশ্বাসী আল্লাহ তাদের দুনিয়া ও আখিরাত-দুই জায়গাতেই প্রতিষ্ঠা দান করবেন। আল্লাহ যা ইচ্ছা তা করেন।” (সূরা ইবরাহীম : ২৪-২৭) আমরা জানি মানুষকে ইসলামের সীমানায় প্রবেশ করতে হলে কালিমায়ে তাইয়্যেবা পাঠ করেই আসতে হয়। এই কালিমা তেমন লম্বা কিংবা বড় কোনো বাক্য নয়; لا اله الإ الله محمد رسول الله ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’- এ কয়টি শব্দ। যে শব্দগুলো মুখে উচ্চারণ করলেই মানুষ বদলে যায়। একজন অস্বীকারকারী পড়লে সে মুসলমান হয়ে যায়। যে মানুষ একটু আগেই নাপাক ছিল, সে এখন পবিত্র। আগে যে জাহান্নামের যোগ্য ছিল, এখন জান্নাতের উপযুক্ত। এই কালিমায় বিশ^াসীরা এক উম্মাত আর অস্বীকারকারীরা আলাদা আলাদা জাতির অন্তরর্ভুক্ত। বাবা কালিমা পড়লে আর সন্তান অস্বীকার করলে সে বাবা আর বাবা থাকে না, সন্তান আর সন্তান বলে গণ্য হয় না। সুতরাং এই কালিমা এমন জিনিস যা পর লোককে আপন করে আর আপন লোককে পর করে পরস্পরের সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয়। এই কালিমার অর্থ জেনে এবং বুঝে নিজের দায়িত্বটা আবিষ্কার করলে দেখবেন কালিমা পড়ে আমরা আল্লাহর সামনে কত বড় কথা স্বীকার করে নিয়েছি। একটু চিন্তা করলেই আমরা বুঝতে পারবো আমাদের সমস্ত জীবনের ওপর এই কালিমার পূর্ণ আধিপত্য স্থাপিত হয়ে গেছে। ফলে কালিমা বিরোধী কোনো কথা আমাদের মন-মগজে একটুও স্থান পেতে পারে না। জীবনের সমস্ত কার্যকলাপে এই কালিমাই হবে একমাত্র হুকুমদাতা। এই কালিমা বুকে ধারণ করে কুরআন খুলে দেখবেন, যেখানে আল্লাহ ঘোষণা করছেন-
وَ مَنۡ لَّمۡ یَحۡکُمۡ بِمَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰهُ فَاُولٰٓئِکَ هُمُ الۡکٰفِرُوۡنَ ﴿۴۴﴾
“আর আল্লাহ যা নাজিল করেছেন, তার মাধ্যমে যারা ফয়সালা করে না, তারাই কাফির।” (সূরা মায়িদা : ৪৪)
وَ مَنۡ لَّمۡ یَحۡکُمۡ بِمَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰهُ فَاُولٰٓئِکَ هُمُ الظّٰلِمُوۡنَ ﴿۴۵﴾
“আর আল্লাহ যা নাজিল করেছেন, তার মাধ্যমে যারা ফয়সালা করবে না, তারাই জালিম।” (সূরা মায়িদা : ৪৫) এখানে আল্লাহর নাজিল করা বিধান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বিচারালয়ে কায়েম করার কথাই তো দ্ব্যর্থহীনভাবে বুঝানো হচ্ছে। যার সহজ কথা হচ্ছে ইকামাতে দ্বীন। আর এ দ্বীনকে যারা অস্বীকার করবে তারা মূলত রাসূল সা.-এর রিসালাতের সবচেয়ে বড় দায়িত্বকে অস্বীকারকারী; এরা কালিমার হক কথাগুলোর গোপনকারী। কালিমার হক কথা হচ্ছে ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো আইন দাতা নে; বিধান দাতা নেই’-
اِنِ الۡحُکۡمُ اِلَّا لِلّٰهِ ؕ یَقُصُّ الۡحَقَّ وَ هُوَ خَیۡرُ الۡفٰصِلِیۡنَ ﴿۵۷﴾
“হুকুম বা কর্তৃত্বের মালিকানা আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে নেই। তিনিই সত্যকথা বর্ণনা করেন, আর তিনিই সর্বোত্তম ফায়সালাকারী।” (সূরা আনআম : ৫৭)
اَلَا لَهُ الۡخَلۡقُ وَالۡاَمۡرُؕ
“সৃষ্টি যার আইন চলবে তাঁর।” (সূরা আরাফ : ৫৪)
কালিমা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়- আল্লাহর জমিনে আইন চলবে আল্লাহর, সার্বভৌমত্ব চলবে আল্লাহর। সমাজ ও রাষ্ট্রকে সংশোধনের জন্যই নবীদের আগমন। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করাই নবীদের কাজ। সমাজের অর্থনীতি, রাজনীতিসহ সকল বিষয়ে ইসলামী সমাধান প্রদান করেছেন আল্লাহ তায়ালা নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে। বিভ্রান্ত মানবতাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্যই নবীদের প্রেরণ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন-
هُوَ الَّذِىۡۤ اَرۡسَلَ رَسُوۡلَهٗ بِالۡهُدٰى وَدِيۡنِ الۡحَقِّ لِيُظۡهِرَهٗ عَلَى الدِّيۡنِ كُلِّهٖؕ وَكَفٰى بِاللّٰهِ شَهِيۡدًاؕ
“তিনিই ঐ সত্তা যিনি তাঁর রাসূলকে হিদায়াত ও দ্বীনে হকসহ পাঠিয়েছেন, যাতে আর সব দ্বীনের উপর একে (দ্বীনে হককে) বিজয়ী করে তুলেন। এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালাই সাক্ষী হিসেবে যথেষ্ট।” (সূরা ফাতহ : ২৮)
هُوَ الَّذِىۡۤ اَرۡسَلَ رَسُوۡلَهٗ بِالۡهُدٰى وَدِيۡنِ الۡحَقِّ لِيُظۡهِرَهٗ عَلَى الدِّيۡنِ كُلِّهٖۙ وَلَوۡ كَرِهَ الۡمُشۡرِكُوۡنَ
“আল্লাহই তাঁর রাসূলকে পথনির্দেশ ও সত্য দ্বীন সহকারে পাঠিয়েছেন যাতে তিনি একে সকল প্রকার দ্বীনের ওপর বিজয়ী করেন, মুশরিকরা একে যতই অপছন্দ করুক না কেন।” (সূরা তওবা : ৩৩)
لَقَدۡ اَرۡسَلۡنَا رُسُلَنَا بِالۡبَيِّنٰتِ وَاَنۡزَلۡنَا مَعَهُمُ الۡكِتٰبَ وَالۡمِيۡزَانَ لِيَقُوۡمَ النَّاسُ بِالۡقِسۡطِۚ
“আমি আমার রাসূলদের সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ এবং হিদায়াত দিয়ে পাঠিয়েছি। তাদের সাথে কিতাব ও মিজান নাজিল করেছি যাতে মানুষ ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।” (সূরা হাদিদ : ২৫)
اِنَّاۤ اَنۡزَلۡنَاۤ اِلَيۡكَ الۡكِتٰبَ بِالۡحَقِّ لِتَحۡكُمَ بَيۡنَ النَّاسِ بِمَاۤ اَرٰٮكَ اللّٰهُؕ وَلَا تَكُنۡ لِّلۡخَآٮِٕنِيۡنَ خَصِيۡمًاۙ
“হে নবী! আমি সত্য সহকারে এই কিতাব আপনার প্রতি নাজিল করেছি, যেখানে আল্লাহ আপনাকে সঠিক পথ দেখিয়েছেন সেই অনুযায়ী (রাষ্ট্র পরিচালনা করে) লোকদের মধ্যে সুবিচার করতে পারেন। আপনি খেয়ানতকারী ও বিশ্বাস ভঙ্গকারীদের পক্ষ থেকে বিতর্ককারী হবেন না।” (সূরা নিসা : ১০৫)
রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর জিন্দেগীর সমস্ত সময়টুকু যেভাবে কাটিয়েছেন সেই জীবনের পুরো অংশকেই অনুসরণ করতে হবে। শুধুমাত্র ব্যক্তিজীবন ও পারিবারিক জীবন অনুসরণ করলেই চলবে না। ব্যক্তিজীবন ও পারিবারিক জীবন যেমন অনুসরণ করতে হবে তেমনি সমাজ জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবনও অনুসরণ করতে হবে। রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর ১৭ বছর বয়স থেকে নিজের চারিত্রিক মাধুর্য দিয়ে চেষ্টা করেছিলেন সমাজকে পরিবর্তনের। হিলফুল ফুজুল নামক সংগঠন তৈরি করেছেন সমাজ থেকে সুদ, ঘুষ, মদ, জিনা, জুয়া, চুরি, ডাকাতি, খুন, ধর্ষন, রাহাজানী, মুর্তিপুজা, শিরক, বিদয়াত বন্ধ করার জন্য; কিন্তু এসব অপরাধ বন্ধ হয়নি। ৪০ বছর পর যখন তিনি নবুওয়াতপ্রাপ্ত হলেন এরপরেও দীর্ঘ ১৩ বছর তিনি চেষ্টা করেছেন, এই প্রচেষ্টা করতে গিয়ে আপন আত্মীয় এবং অন্যান্য গোষ্ঠীর কাফেরদের অসহনীয় জুলুম নির্যাতন সহ্য করেছেন। কিন্তু তখনও ইসলামী হুকুমত পুরোপুরি কায়েম হয়নি। তিনি মক্কা থেকে মদিনায় যাওয়ার পর আল্লাহর কুরআনকে রাষ্ট্রীয়ভাবে যখন প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং সংসদে কুরআনের আইন চালু করেছেন ঠিক তখনই সমাজের আমূল পরিবর্তন সাধিত হলো। সমাজ থেকে ইসলাম বিরোধী সকল অপকর্ম বন্ধ হয়ে গেলো। এই বিষয়টাকেই আমরা বলি- ‘আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন কায়েম করা’ আর তথাকথিত বুদ্ধিজীবিরা ‘নিছক রাজনীতি’ ট্যাগ লাগিয়ে দেয়। তাদের সাথে তাল মিলিয়ে কিছু আলেম এবং মুসলমানও দ্বীন কায়েমের কাফেলার কাজকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে থাকেন। তারা বুঝতে চেষ্টা করেন না যে, রাসূল সা.-এর মতো জগৎশ্রেষ্ট মানুষ এবং সুবক্তা দীর্ঘ ৪৫টি বছর পর্যন্ত ওয়াজ নসীহত দ্বারা সমাজের আমূল পরিবর্তন করেননি। তাহলে বর্তমান সময়ের সকল আলেম ওলামা মিলে কিয়ামত পর্যন্ত কেবলই ওয়াজ নসীহত করে সমাজ পরিবর্তন কীভাবে করবেন? আল্লাহর জমিনে রাষ্ট্রীয়ভাবে কুরআনের আইন কায়েম করা ছাড়া কখনো-ই সমাজ পরিবর্তন সম্ভব নয়।
কালিমা উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন তো! যে ব্যক্তি ‘আল্লাহ একজন’ এটা মানতে রাজি, কিন্তু আল্লাহর আইন মানতে রাজি নয়- যেমন : কুরআনের বিধান অনুযায়ী তাকে বলা হলো- সুদ, জুয়া, মাদক হচ্ছে মুসলমানের জন্য নিষিদ্ধ জিনিস, সে বললো- এইসব সে মানবে না, তখন সব আলেম একমত না হয়ে উপায় আছে যে, লোকটি কাফের? তাহলে দ্বীনের অর্থ কী? শুধু কি আল্লাহ একজন এটা মানা? নাকি তাঁর আইন সবগুলোই মানা? কালিমার হক কথা পবিত্র কুরআনের সমস্ত বিধান মেনে নেওয়াকেই বলে। কেউ তাওহীদ মানবে, আবার মানুষের বানানো আইনও মানবে এটা হতে পারে না। তাহলে তাঁর দ্বীন মানা হবে না। আল্লাহর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট ঘোষণা-
لَاۤ اِکۡرَاهَ فِی الدِّیۡنِ ۟ۙ قَدۡ تَّبَیَّنَ الرُّشۡدُ مِنَ الۡغَیِّ ۚ فَمَنۡ یَّکۡفُرۡ بِالطَّاغُوۡتِ وَ یُؤۡمِنۡۢ بِاللّٰهِ فَقَدِ اسۡتَمۡسَکَ بِالۡعُرۡوَۃِ الۡوُثۡقٰی لَا انۡفِصَامَ لَهَا ؕ وَ اللّٰهُ سَمِیۡعٌ عَلِیۡمٌ ﴿۲۵۶﴾
“দ্বীন গ্রহণের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই। নিশ্চয়ই হিদায়াত স্পষ্ট হয়েছে ভ্রষ্টতা থেকে। অতএব, যে ব্যক্তি তাগূতকে অস্বীকার করবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে, অবশ্যই সে মজবুত রশি আঁকড়ে ধরল, যা ছিন্ন হবার নয়। আর আল্লাহ সবকিছু শুনেন এবং সব বিষয়ের খবর রাখেন।” (সূরা বাকারা : ২৫৬)।
দ্বীন কায়েমের পদ্ধতি নিয়ে আমাদের সমাজে কত মত পার্থক্য! কেউ বলেন, দ্বীন কায়েমের জন্য রাজনীতির প্রয়োজন নেই, দাওয়াতই যথেষ্ট। কিন্তু যারা রাজনৈতিক উপায়ে দ্বীন কায়েম করতে চান, তারা কি তাদের কর্মসূচি থেকে দাওয়াত বাদ দিয়েছে? যদি তাদের কর্মসূচিতে দাওয়াত থাকে, তাহলে বিতর্ক করছেন কী নিয়ে? যারা শুধু দাওয়াতকেই দ্বীন কায়েমের মাধ্যম বলছেন, তারা জীবনের সর্বস্তরে দ্বীন কায়েমের ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে অনেক পিছিয়ে রয়েছেন। আপনি দাওয়াত দিলেন আর লোকজন তাওহীদ মেনেও নিল, এতেই কি দ্বীন কায়েম হয়ে যাবে? দেশের অফিস, আদালত, সংসদ, সচিবালয়সহ রাষ্ট্রের প্রতিটি জায়গায় আল্লাহ দ্বীন কায়েমের জন্য যে পরিমাণ যোগ্য ও দক্ষ জনবল প্রয়োজন, সেই সমস্ত জনবল তৈরির দৃশ্যমান কোনো কাজ আপনারা কি আদৌ শুরু করেছেন? সুতরাং শুধু দাওয়াত দিলেই দ্বীন কায়েম হবে না, যারা দাওয়াত কবুল করবে তাদেরকে প্রশিক্ষণও দিতে হবে। আর যারা রাজনৈতিকভাবে দ্বীন কায়েম করতে চান, তারাও নিশ্চয় দাওয়াতের মাধ্যমেই তাদের কাজ শুরু করে থাকেন। আর এটাই স্বাভাবিক। দাওয়াত শুরু হয় ব্যক্তি সংশোধনের মাধ্যমে। যারা দাওয়াত কবুল করেন তাদেরকে সংগঠিত করে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দেশের সর্বস্তরে দ্বীন কায়েমের পরিকল্পনা নিয়ে তারাও কাজ করে যাচ্ছেন। তবে এটাও মনে রাখা দরকার, জোর করে আল্লাহর আইন চাপিয়ে দেওয়ার নাম দ্বীন কায়েম নয়। জবর দখল করে ক্ষমতা কেড়ে নিলেই দ্বীন কায়েম হয়ে যাবে, এ চিন্তা একেবারে ভুল। বরং দাওয়াতের মাধ্যমে দ্বীন মেনে চলার মানসিকতা সম্পন্ন লোক তৈরি না করে ক্ষমতা হাতে পেলেও দ্বীন কায়েম হবে না। তার মানে দ্বীন কায়েমের জন্য শুধু দাওয়াত নয়, আবার দাওয়াতবিহীন শুধু ক্ষমতার মসনদে বসার স্বপ্নও নয়। বরং এ দুটোর সমন্বয় বড়ই জরুরি। লোকজনকে বুঝাতে হবে, কালিমা মেনে নেওয়ার সাথে সাথেই আল্লাহর এই বিধান মেনে নিতেই হবে-
اَلَا لَهُ الۡخَلۡقُ وَالۡاَمۡرُؕ
“সৃষ্টি যার আইন চলবে তাঁর।” (সুরা আরাফ : ৫৪)
কালিমার পরবর্তী অংশ আপনাকে বলে, পৃথিবীতে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা এবং সৎলোকের শাসন কায়েমের উদ্দেশ্যে দুনিয়াতে নবীজি সা.-এর আগমন। এই নবীয়ানা দায়িত্ব এখন আপনারও ওপর। কুরআনকে রাষ্ট্রীয় সংবিধান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত না করা পর্যন্ত আপনার বিশ্রাম নেই। আর রাষ্ট্রে কুরআনের রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত করতে শুধুমাত্র ওয়াজ-নসীহত কিংবা দুআই যথেষ্ট নয়। সমাজের সমস্ত অনৈসলামিক কার্যকলাপ নির্মুল করে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে নবীদের অনুসরণ করাই কালিমার দ্বিতীয় অংশের মূল দাবি। মহানবী সা.কে আল্লাহ নিজেই দোয়া করতে শিখিয়েছেন-
وَقُل رَّبِّ اَدۡخِلۡنِىۡ مُدۡخَلَ صِدۡقٍ وَّاَخۡرِجۡنِىۡ مُخۡرَجَ صِدۡقٍ وَّاجۡعَل لِّىۡ مِنۡ لَّدُنۡكَ سُلۡطٰنًا نَّصِيۡرًا
“আর দোয়া করো- হে আমার পরওয়ারদিগার! আমাকে যেখানেই তুমি নিয়ে যাও সত্যতার সাথে নিয়ে যাও এবং যেখান থেকেই বের করো সত্যতার সাথে বের করো। এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাকে পরাক্রান্ত শক্তির (রাষ্ট্র ক্ষমতার) অধিকারী বানিয়ে দাও।” (সূরা বনি ইসরাইল : ৮০) তার মানে হে আল্লাহ! তুমি নিজেই আমাকে ক্ষমতা দান করো অথবা কোনো রাষ্ট্র ক্ষমতাকে আমার সাহায্যকারী বানিয়ে দাও, যার ব্যবহার করে আমি দুনিয়ার অনিয়ম ব্যবস্থাপনা সংশোধন করতে পারি; সমস্ত জুলুমের যবনিকাপাত করে তোমার বিধান কায়েম করতে পারি। স্বয়ং আল্লাহই যখন তাঁর প্রিয় হাবিবকে এই দুআ শিখিয়ে দিচ্ছেন তখন তো এটিই প্রমাণিত হয় যে, দ্বীন প্রতিষ্ঠা ও শরীয়া কায়েম করার জন্য রাষ্ট্র ক্ষমতা লাভের প্রত্যাশা শুধু জায়েযই নয় বরং কাঙ্খিত এবং প্রশংসিত। তাহলে যারা এ প্রচেষ্টা ও প্রত্যাশাকে দুনিয়াদারী রাজনীতি বলে আখ্যায়িত করেন তারা ভুলের মধ্যে অবস্থান করছেন। কেউ যদি নিজের জন্য রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে চায় তাকে আপনি বৈষয়িক স্বার্থ পূজারি বলবেন সমস্যা নেই। কিন্তু আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্র ক্ষমতা লাভের প্রত্যাশা করা পার্থিব স্বার্থপূজা বলতে পারেন না, এটি তো আল্লাহর আনুগত্যের কাজ। আল্লাহ তো সরাসরি বলেই দিচ্ছেন-
شَرَعَ لَكُمۡ مِّنَ الدِّيۡنِ مَا وَصّٰى بِهٖ نُوۡحًا وَّالَّذِىۡۤ اَوۡحَيۡنَاۤ اِلَيۡكَ وَمَا وَصَّيۡنَا بِهٖۤ اِبۡرٰهِيۡمَ وَمُوۡسٰى وَعِيۡسٰٓى اَنۡ اَقِيۡمُوۡا الدِّيۡنَ وَلَا تَتَفَرَّقُوۡا فِيۡهِؕ
তিনি তোমাদের জন্য দ্বীনের সেই সব নিয়ম-কানুন নির্ধারিত করেছেন যার নির্দেশ তিনি নূহকে দিয়েছিলেন এবং (হে মুহাম্মাদ) যা এখন আমি তোমার কাছে অহীর মাধ্যমে পাঠিয়েছি। আর যার আদেশ দিয়েছিলাম আমি ইবরাহীম (আ), মূসা (আ) ও ঈসা (আ)কে। তাদেরকে তাগাদা দিচ্ছিলাম এই বলে যে, এ দ্বীনকে কায়েম করো এবং এ ব্যাপারে পরস্পর ভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করো না। (সূরা শুরা : ১৩)
তাহলে সমাজ ও রাষ্ট্র সংশোধনের নবীয়ানা এ কাজ অনুসরণ করে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করার বড় দায়িত্ব তো আপনারও। আল্লাহ তায়ালা সমাজের অর্থনীতি, রাজনীতিসহ সকল বিষয়ে ইসলামী সমাধান দিয়েছেন নবী-রাসূলগণের মাধ্যমেই। সুতরাং এই বিষয়ে যদি কেউ অবহেলা কিংবা অস্বীকার করেন তিনি প্রকৃত মুমিন হতে পারবেন না, রাসূলের প্রকৃত উম্মতও হতে পারেন না। আল্লাহ বলেছেন-
الۡيَوۡمَ يَٮِٕسَ الَّذِيۡنَ كَفَرُوۡا مِنۡ دِيۡنِكُمۡ فَلَا تَخۡشَوۡهُمۡ وَاخۡشَوۡنِؕ الۡيَوۡمَ اَكۡمَلۡتُ لَكُمۡ دِيۡنَكُمۡ وَاَتۡمَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ نِعۡمَتِىۡ وَرَضِيۡتُ لَكُمُ الۡاِسۡلَامَ دِيۡنًاؕ
“তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে (ইসলামের বিধানকে) পরিপূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য একমাত্র বিধান হিসেবে মনোনীত করলাম যা আমার পক্ষ থেকে তোমাদের প্রতি বড় অনুগ্রহ।” (সূরা মায়িদা : ০৩)
সুতরাং, ইসলাম ঠিক তখনই পরিপূর্ণ হয়েছিল যখন দ্বীনের সমস্ত বিধানগুলো রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই আয়াত নাজিলের প্রেক্ষাপট আমাদেরকে তাই বলে। এখন যারা ইকামাতে দ্বীনের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়ে জালিমদেরকে সহযোগিতা করছেন তাদের এমন ফতোয়া নিজেরদেকে আবু জাহেলের কাতারে নিয়ে যাচ্ছে কিনা দেখুন তো! আসুন, আমরা আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীনকে বাস্তবায়নের জন্য ঐক্যবদ্ধ হই। দ্বীনি আন্দোলনের কাতারে সমবেত হয়ে পরিপুর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করি। নিছক দুনিয়াবি রাজনীতির লাগাম থেকে নিজেদের মুক্ত রাখি। আমাদের রাজনীতি হোক ইসলামী রাজনীতি। দ্বীন হোক আমাদের জীবনোদ্দেশ্য।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সংগঠক
আপনার মন্তব্য লিখুন