আজকের এ লেখাটি মূলত ইমাম হাসান আল বান্নার একটি বক্তব্য। যা ১৯৪৮ সালে দৈনিক ‘ইখওয়ানুল মুসলিমিন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সেটাকেই আমরা নবীজির সিরাত : দাওয়াত, হিজরত ও রাষ্ট্র শিরোনামে তরজমা করছি।
দাওয়াত
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা.। নবুওয়ত পাওয়ার পর তিনি পৌঁছে দিতে লাগলেন ইলাহি রিসালাত। কবিলায় কবিলায় ঘুরে ঘুরে ডাকতে লাগলেন, “ও মানুষজন শুনো, তোমরা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলো, তাহলে সফল হয়ে যাবে। ছেড়ে দাও যত আছে তোমাদের বানানো মূর্তি, প্রতিমা, যেগুলোকে তোমরা খোদার সমকক্ষ মনে করো।
ইলাহি এই রিসালাত পৌঁছে দিতে কে আমাকে আশ্রয় দেবে, কে আমাকে সাহায্য করবে? আর কে আমাকে বাধা দেবে?”
নবীজির পেছনে লেগে ছিল তাঁর চাচা আবু লাহাব। নবীজির দাওয়াতের বিপরীতে সে মানুষজনকে ডেকে বলত-
“ও মানুষজন শুনো, তোমরা মুহাম্মাদকে সত্য বলে মনে করো না; তার কথা বিশ্বাসও করো না। সে তোমাদের নিষেধ করে লাত আর উজ্জার ইবাদত থেকে। নিষেধ করে সেই ধর্মনীতি থেকে, যার ওপর বিশ্বাস তোমরা পেয়েছ তোমাদের পিতৃপুরুষদেরকে।” (মুসনাদে আহমাদ : ৪/৬৩, ৩৪১)।
মক্কায় ব্যর্থ হলো নবীজির দাওয়াত। তিনি গেলেন তায়েফে। সেখানে বনু সাকিফকে আহ্বান জানালেন শাশ্বত জীবনব্যবস্থা ইসলামের দিকে। কিন্তু তারাও নবীজির আহ্বান অগ্রাহ্য করলো, প্রত্যাখ্যান করলো তাঁর দাওয়াত। তাঁর পেছনে লেলিয়ে দিলো শিশু আর নির্বোধদের। তারা নবীজিকে জর্জরিত করতে লাগল পাথরের আঘাতে। তারা তাঁকে বাধ্য করলো আশ্রয় নিতে কোনো এক গাছের নিচে। সেখানে তিনি বসলেন বিশ্রাম নিতে। হাত তুললেন আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে। দুআ করলেন- “ও আল্লাহ, আমি আপনার কাছে আমার শক্তির দুর্বলতা, অসহায়ত্ব এবং মানুষের কাছে আমার মূল্যহীনতার অভিযোগ করছি। ও দয়াময় দয়ালু, আপনি দুর্বলদের রব, আপনি আমারও রব, আপনি আমাকে কার কাছে অর্পণ করছেন যে আমার সঙ্গে রূঢ় আচরণ করবে; নাকি আপনি আমাকে এমন শত্রুর কাছে ন্যস্ত করছেন যাকে আপনি আমার যাবতীয় বিষয়ের মালিক করেছেন? যদি আপনি আমার প্রতি অসন্তুষ্ট না হন, তবে আমার কোনো আফসোস নেই; আপনার ক্ষমা আমার জন্য সম্প্রসারিত করুন। আমি আপনার সেই নূরের আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যার মাধ্যমে অন্ধকার দূরীভূত হয়ে চতুর্দিক আলোয় উদ্ভাষিত হয়। দুনিয়া ও আখিরাতের যাবতীয় বিষয়াদি আপনার ওপরই ন্যস্ত। আপনি আমাকে অভিসম্পাত করবেন কিংবা ধমক দেবেন, তার চেয়ে আপনার সন্তুষ্টিই আমার কাম্য। আপনার শক্তি ব্যতিরেকে অন্য কোনো শক্তি নেই।” (হাইসামি; আল মাজমা : ৬/২৫)।
নবীজি সা. একবার (হজের মওসুমে) বনি শাইবানের কোনো এক বৈঠকে হাজির হন। তিনি তাদের কাছে ইলাহি রিসালাত পৌঁছে দেন নরম ও কোমল পন্থায়, সুমিষ্ট বচনে। নবীজির কথা শুনে মাফরুক ইবনু আমর বলে ওঠে-
“ও কুরাইশের ভাই, তুমি কোন দিকে আহ্বান করছ? কিসের দাওয়াত দিচ্ছ?”
নবীজি সা. জবাব দিলেন-
“আমি তোমাদের ডাকছি, আহ্বান করছি এই সাক্ষ্য দিতে যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই, তাঁর কোনো শরিক নেই আর আমি হচ্ছি আল্লাহর রাসূল। আমি তোমাদের ডাকছি আমাকে সাহায্য করতে, সহযোগিতা করতে, যাতে আমি আল্লাহর তরফ থেকে তা পৌঁছে দিতে পারি, যার আদেশ তিনি আমাকে করেছেন। কুরাইশরা আল্লাহর বিধানের বিরোধিতা করেছে। তারা অস্বীকার করেছে তাঁর রাসূলকে। তারা বাতিল নিয়ে হক থেকে বিমুখ হয়ে গেছে। আর আল্লাহ তায়ালা সকল কিছু থেকে অমুখাপেক্ষী এবং প্রশংসিত।”
এরপর নবীজি সা. তিলাওয়াত করলেন আল কুরআনুল কারিমের এই আয়াত,
“বলুন, এসো, তোমাদের রব তোমাদের ওপর যা হারাম করেছে, তা তোমাদের তিলাওয়াত করে শুনাই।” (সূরা আনয়াম : ১৫১)।
নবীজি আরও পড়লেন, “নিশ্চয় আল্লাহ আদেশ করছেন আদল (ন্যায়পরায়ণতা), ইহসান (সদাচরণ) ও আত্মীয়-স্বজনকে দান করার এবং তিনি নিষেধ করছেন অশ্লীলতা, অসৎকাজ ও সীমালঙ্ঘন থেকে। তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন, যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো।” (সূরা আনয়াম : ৯০)। আয়াতগুলো আঘাত হানে মাফরুকের হৃদয়ে। সে বলে ওঠে- “আল্লাহর কসম, আপনি দাওয়াত দিচ্ছেন শ্রেষ্ঠতম আখলাক ও উত্তম কর্মের দিকে। মিথ্যা বলেছে সেই জাতি, যারা আপনাকে মিথ্যারোপ করেছে এবং বিরোধিতা করেছে আপনার। আল্লাহর কসম করে বলছি, (আপনি যা শোনালেন) এটা কোনো জমিনবাসীর কথা হতে পারে না। জমিনবাসীর কথা হলে অবশ্যই আমরা তা চিনতে পারতাম।” (কানযুল উম্মাল : ৪৫৮৭)।
নবীজির কথা শুনে বনি শাইবান মনস্থ করলো ইসলাম কবুল করার। কিন্তু না; তারা করলো না, করতে পারল না। তাদের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি হানি ইবনু কুবাইসা বাদ সাধলেন। তিনি তাদের আরেকটু বিলম্ব ও অপেক্ষা করে নিতে বললেন। বনি শাইবানের অশ্বারোহী বীরযোদ্ধা মুসান্না ইবনু হারিসা তাদের নজর ফেরালেন কিসরা ও তাদের মাঝে থাকা চুক্তির প্রতি। নতুন কোনো দাওয়াতের প্রতি ঈমান আনা যাবে না, এই চুক্তির দাবি অনুযায়ী। তাই তারা যদি এই দাওয়াতের প্রতি ঈমান এনে নেয়, তাহলে তাদের পোহাতে হবে বিশাল অসুবিধা। কঠিন এক যুদ্ধের মুখোমুখি হতে হবে কিসরার সাথে। আর এই যুদ্ধে তাদের বিজয়ের কোনো নিশ্চয়তাও নেই। বিপরীতপক্ষে, নবীজি সা. তাদের শোনালেন সুন্দর ও সুসংবাদ বাণী। তিনি তাদের জানালেন, তারা (এই দাওয়াত মেনে নিলে) সুন্দর ও সহজ জীবন লাভ করবে। আল্লাহ তাআলা তাদের দান করবেন ভূখণ্ড এবং তারা অধিষ্ঠিত হবে জমিনে। বাস্তবিকই সত্য প্রমাণিত হলো নবীজির এই ভবিষ্যদ্বাবাণী। আবু বকর রা.-এর জমানায় পারস্যে যেই সেনাবাহিনী পাঠানো হয়েছিল, তার প্রধান সেনাপতি ছিলেন মুসান্না ইবনু হারিসা।
বাইয়াত
চলতে থাকে নবীজি সা.-এর দাওয়াতি কার্যক্রম। ইলাহি এই রিসালাত তিনি তুলে ধরতে থাকেন বিভিন্ন কবিলার কাছে। বিভিন্ন মজলিস বা মওসুম উপলক্ষ্যে সাক্ষাৎ জারি রাখেন তাদের ও তাদের প্রতিনিধিদলের সাথে। অবশেষে নবীজি সা.-এর সাথে মুলাকাত হলো ইয়াসরিব প্রতিনিধিদলের। তারা ইসলাম কবুল করলো। ঈমান আনল নবীজির ওপর। তারা আসলেই হয়ে ওঠেন ভালো মুসলমান, ইসলামের প্রতি তাদের আনুগত্য ছিল অবর্ণনীয়। তারা ফিরে যায় নিজেদের আবাসভূমিতে। সেখানে প্রচার করতে থাকে নতুন এই দাওয়াত, নতুন এই রৌশনি।
বাইয়াতে আকাবার মাধ্যমে দিল খুলে যায় আওস ও খাজরাজের, তাদের বক্ষ প্রসারিত হয় নতুন এই দাওয়াতের প্রতি। আকাবার সেই বাইয়াতে হাজির ছিল ৭২ জন আনসারি নরনারী। তাদের তরফ থেকে নবীজি সা. এর হাতে বাইয়াত নেন ১২ জন নকিব। নবীজি সা. সেই বাইয়াতে তাদের শপথ করান- “তারা তাদের রবের ইবাদত করবে। তাঁর সাথে কাউকে শরিক করবে না। আর তারা নবীজিকে হিফাজত করবে সেইসব বিপদাপদ থেকে, যা থেকে তারা হিফাজত করে থাকে নিজেদের এবং নিজেদের বউ-বাচ্চাকে।”
নবীজি সা. বললেন, তারা যদি তাদের কথায় সত্যবাদী হয় এবং তাদের করা অঙ্গীকার পালন করে, তাহলে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে তাদের জন্য চিরস্থায়ী জান্নাতে থাকবে সর্বোত্তম প্রতিদান। তিনি তাদের আরও শপথ করান, তাঁকে তাদেরই একজন মনে করতে হবে। তিনি বলেন, আমি তোমাদেরই একজন এবং তোমরাও আমারই। আমার রক্ত মানে তোমাদেরই রক্ত; তোমাদের রক্ত মানে আমারই রক্ত এবং আমার ধ্বংস মানে তোমাদেরই ধ্বংস; তোমাদের ধ্বংস মানে আমারই ধ্বংস। (আহমাদ : ৩/৪৬০-৪৬১)
ষড়যন্ত্র
নবীজি তাঁর দাওয়াত অব্যাহত রাখেন। কুরাইশরা, যারা নবীজি সাকে নিজেদের বিরোধীশক্তি হিসেবে অপরাধী সাজিয়েছিল, তারা বুঝতে পারে তাঁর এই চলমান দাওয়াতের ফলাফল। তারা অনুভব করে আকাবার সেই চুক্তির ভয়াবহতা, যা হঠাৎ করেই কঠিন হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে তাদের সমাজ ও ক্ষমতার কাঠামোকে। ইসলামের প্রচার-প্রসার বাড়তেই থাকে। ইসলাম ছড়িয়ে পড়ে মদিনার প্রত্যেক ঘরে ঘরে, প্রতিটি কবিলায় কবিলায়। নবীজি সা. ও তাঁর সঙ্গী-সাথি ঈমানদাররা সিদ্ধান্ত নিলেন, তারা হিজরত করে চলে আসবেন ইয়াসরিবে। আর এভাবেই সেখানে গড়ে ওঠবে একটি শক্তিশালী জামাত। নতুন এই জামাত হুমকি দেবে কুরাইশি ক্ষমতাকে, তাদের ভূমিতেই যুদ্ধ করবে তাদের বিরুদ্ধে। কুরাইশরা বুঝতে পারল, মুসলমানরা তাদের দুপুরের খাবার সাবাড় করার আগেই সকালের নাস্তায় তাদের গিলে ফেলতে হবে। তারা আক্রমণ করার আগেই কঠোর আঘাত হানতে হবে তাদের ওপর। মক্কায় থাকাকালীন সময়েই তাদের সামনে থাকার পরও তারা এই দাওয়াতকে থামাতে পারেনি; অথচ তারা এর বিরুদ্ধে অপবাদ, অত্যাচার, নির্যাতন, প্রতিরোধ, বিরোধিতা, সম্পর্কচ্ছেদ ও বয়কটসহ কোনো অস্ত্রই ব্যবহার করতে বাদ রাখেনি। কিন্তু এতদসত্ত্বেও ইসলামের আলো ছড়িয়েছেই, দিগ্বিদিক আলোকিত করেই গেছে এবং এই মুমিন-মুসলমানরাও এর দিকে ছুটে এসেছে। এখন এই দাওয়াত যদি তাদের আওতা থেকে বেরিয়ে গিয়ে খুঁটি গাড়ে মদিনায়, তাদের ভূখণ্ড থেকে দূরে কোথাও গিয়ে লাভ করে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা; তাহলে তারা এর বিরুদ্ধে লড়বে কীভাবে, কীভাবে থামাবে এর অগ্রযাত্রা?
গুরুতর এক সমস্যা হাজির হলো কুরাইশদের সামনে। কিছু না কিছু করতেই হবে তাদের। তারা হাজির হলো দারুন নদওয়ায়। ফয়সালা ঠিক হলো, হত্যা করতে হবে এই দাওয়াতের দাঈকে। তাঁকে হত্যা করলেই থেমে যাবে এই দাওয়াত, এমনটাই ভাবল তারা। কিন্তু হত্যা করবে কে? কুরাইশের প্রতিটি গোত্র ও পরিবার থেকে একজন করে নিয়ে এই হত্যাকাণ্ড চালানোর বাহিনী গঠন করার সিদ্ধান্ত হলো। যাতে রক্তের দায় সবার ঘাড়েই পড়ে। তখন আর বনু হাশিম প্রতিশোধ নিতে যুদ্ধ করতে পারবে না সবার বিরুদ্ধে; বরং রক্তপণ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে তাদের। সবাই একমত হলো তাদের এই সিদ্ধান্তে। পরিকল্পনা সাজাতে লাগল তারা। বাস্তবায়নও শুরু করা হলো। তারা এক ফয়সালা ঠিক করেছে, আর তাকদিরের ফয়সালা তাদের দিকে চেয়ে চেয়ে হাসছে। আল্লাহ তাআলা বলছেন,
“আর স্মরণ করুন, যখন কাফিররা আপনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে আপনাকে বন্দি করার জন্য কিংবা হত্যা করার অথবা নির্বাসিত করার জন্য। আর তারা ষড়যন্ত্র করে এবং আল্লাহও (তাদের ষড়যন্ত্রের বিপক্ষে) কৌশল করেন; আর আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ কৌশলী।” (সূরা আনফাল : ৩০)
বাইয়াতে আকাবা কুরাইশদের যতটা বিচলিত করেছে, মুসলমানদের ঠিক ততটাই প্রশান্ত ও খুশি করেছে। নবীজি সা. মুসলমানদের অনুমতি দিলেন ইয়াসরিবে হিজরত করার। কেননা, সেখানে আছে স্বাধীনতা। সেখানকার আনসারি ভাইদের হৃদয়ে আছে এই দাওয়াতের প্রতি বিশ্বাস ও অবিচল আস্থা। রাসূলুল্লাহর পাঠানো দূত মুসআব ইবনু উমাইর রা. তাদের দীক্ষিত করেছে এই মহান দাওয়াতে। ফলে, মক্কার মুসলমানরা ক্রমেই একাকী বা ছোট ছোট দলে গোপনে পাড়ি জমাতে লাগল মদিনায়। সেখানে গিয়ে তারা দেখল, আনসারি সাহাবিরা তাদের হৃদয়ঘর ও আবাসঘরে তাদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছে এক উত্তম আবাসস্থল।
হিজরত
নবীজি সা. জানতে পারলেন তাঁর জীবননাশের ষড়যন্ত্রের কথা। তিনিও প্রস্তুতি নিলেন হিজরতের, গোছালেন প্রয়োজনীয় জিনিসপাতি। সফরসঙ্গী হিসেবে সাথে নিলেন তাঁর পরমপ্রিয় বন্ধু আবু বকর সিদ্দিক রা.-কে। আর চাচাতো ভাই আলিকে রেখে গেলেন তাঁর জায়গায়, তাঁর বিছানায়। এভাবেই তিনি ছেড়ে গেলেন আল্লাহর এই জমিনে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ভূখণ্ড- যে ভূখণ্ডের প্রভাব তাঁর ওপর সবচেয়ে বেশি। কিন্তু হকের প্রভাব আরও বেশি। তিনি মক্কা ছাড়লেন, আশ্রয় নিলেন সাওর গুহায়।
কুরাইশদের হত্যা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। বিফলে যায় তাদের সকল তদবির। তারা খুঁজতে থাকে নবীজিকে। খুঁজতে খুঁজতে তাদের একদল ঠিক ঠিক পৌঁছে যায় সাওর গুহায়। গুহায় ঢোকার প্রায় মনস্থই করে ফেলেছিল তারা। আবু বকর রা. (গুহার ভেতর থেকে) শুনতে পেলেন তাদের কথাবার্তা। তিনি নবীজিকে বললেন- “ইয়া রাসূলাল্লাহ, তাদের কেউ যদি পায়ের দিকে তাকায়, তাহলেই তারা আমাদের দেখে ফেলবে।”
নবীজির ছিল তাঁর রবের প্রতি গভীর ঈমান, ছিল তাঁর সাহায্যের নিশ্চিত বিশ্বাস। তিনি প্রশান্তচিত্তে জবাব দিলেন, “ও আবু বকর, ওই দুইজনের ব্যাপারে তোমার কী মনে হয়, যাদের তৃতীয়জন হচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। চিন্তা করো না, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন।” (বুখারি, মুসলিম)।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সাকিনা নাজিল করলেন নবীজি সা. ও তাঁর সাথি আবু বকর রা. এর হৃদয়ে। মুশরিকদের চেহারা ঘুরিয়ে দিলেন তাদের থেকে। তিনি তাদের সাহায্য করলেন এমন এক সেনাবাহিনীর মাধ্যমে, যা তাদের কেউই দেখেনি। আর এভাবেই উচ্চকিত হলো আল্লাহর কালিমা। আল্লাহর কালিমাই উচ্চকিত হওয়ার সবচেয়ে বেশি হকদার।
নবীজি সা. ও আবু বকর রা., সম্মানিত এই দুই মুহাজির চলতে লাগলেন মদিনা পানে। অবশেষে তাঁরা পৌঁছে গেলেন কুবার বনি সালিম ইবনু আওফ গোত্রে। সেখানেই নবীজি সা. ভিত্তিস্থাপন করলেন মুবারক এক মসজিদের। নবীজি প্রস্তুতি নিতে লাগলেন মদিনা প্রবেশের। চারদিন পর তিনি কুবা থেকে রওনা করলেন মদিনায়। নবীজিকে সহাস্য বদনে স্বাগত জানালো মদিনার সমভূমি ও পাহাড়, আকাশ ও মাটি। এই মহান আগন্তুককে অভ্যর্থনা জানাতে ঘর ছেড়ে বের হয়ে আসলো সকল মদিনাবাসী। আনন্দ ও খুশির সর্বোচ্চ প্রকাশে তারা বরণ করে নিলো নবীজিকে। ছোট ছোট বাচ্চা ও শিশুরা সোল্লাসে গাইতে লাগল,
“উদয় হয়েছে পূর্ণিমার চাঁদ আমাদের কাছে ছানিয়াতুল বিদা থেকে,
শুকরিয়া ওয়াজিব হয়ে গেছে আমাদের; কেননা আহ্বানকারী (রাসূল) ডেকেছেন আল্লাহর দিকে,
আমাদের কাছে প্রেরিত হে রাসূল, আপনি নিয়ে এসেছেন অনুসরণীয় বিষয়বস্তুকে।” (তিরমিজি, নাসায়ি)।
প্রশান্তচিত্তে নবীজি আবাস গাড়লেন তাঁর নতুন বাসস্থানে। প্রিয় করে নিলেন তিনি নতুন এই আবাসভূমিকে। এখানে তিনি তৈরি করলেন পবিত্র এক মসজিদ। মসজিদকে করে তুললেন আরও মজবুত, তার চারপাশে নির্মাণ করলেন নিজের পবিত্র ঘরগুলো। তারপর নবীজি আবারও লেগে পড়লেন ইলাহি রিসালাত প্রতিষ্ঠার কাজে। এভাবেই তিনি আল্লাহর জমিনের ছোট্ট এই ভূখণ্ডে গড়ে তুললেন এমন এক শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র আল মাদিনাতুল ফাদিলা (The Perfect State), সংস্কারবাদীরা যার কেবল স্বপ্নই দেখেছে, সমাজচিন্তক দার্শনিকরা যার কেবল রূপরেখাই হাজির করেছে। এরকম আদর্শ একটি রাষ্ট্র কেবলই বিরাজ করত তাদের কল্পরাজ্যে; কিন্তু ইসলাম ইয়াসরিব ভূখণ্ডে চমৎকারভাবে বাস্তবতা দান করেছে এই কল্পনাকে। এভাবেই ইসলাম গোটা বিশ্বের সামনে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো হাজির করলো এমন এক সমাজব্যবস্থা, যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পূর্ণাঙ্গ এক শরিয়ত, শ্রেষ্ঠতম এক উম্মাহ এবং আদালতপূর্ণ এক রাষ্ট্রব্যবস্থার ওপর।
এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থা হাজির করার পর মানুষের আর কী চাওয়ার থাকতে পারে? কী থাকতে পারে আর আকাক্সক্ষার?
শরিয়ত
মদিনায় যেই শরিয়ত প্রতিষ্ঠা হলো, তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাওহিদের ওপর। আর এই তাওহিদের মাধ্যমেই কোনোরকম জটিলতা ছাড়াই মানবমনে সৃষ্টি হয় পবিত্রসব অনুভূতি ও আনন্দবোধের বাঁধভাঙা জোয়ার। এই শরিয়ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এমন আমালে সালিহের ওপর, যা কেবল তারই উপকার করে না যে আমল করে; বরং পাশাপাশি সমাজের অন্যসব মানুষেরও উপকারে আসে।
এই শরিয়ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ‘জাজা’ বা প্রতিদানের ওপর। দুনিয়ায় এই প্রতিদান বাস্তবায়িত হবে নাগরিক ও রব্বানি কিসাসের (প্রতিবিধান) মাধ্যমে, আর আখিরাতে বাস্তবায়িত হবে আজাব বা শাস্তিদানের মাধ্যমে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
“কেউ অণু পরিমাণ সৎকাজ করলে সে তা দেখবে। আর কেউ অণু পরিমাণ অসৎকাজ করলে সে তাও দেখবে।” (সূরা যিলযাল : ৭-৮)। আর এই তাওহিদ, আমলে সালিহ ও প্রতিবিধান সবকিছুই মানব ফিতরাতের কাছে সহজ-সরল, পরিষ্কার এবং যুক্তিযুক্ত। এই শরিয়ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পূর্ববর্তী দ্বীন ও শরিয়তের প্রতি বিশ্বাস রেখেই এবং গত হয়ে যাওয়া রাসূল ও মুসলমানের প্রতি তাজিম করেই।
উম্মাহ
মদিনায় নবীজি সা. প্রতিষ্ঠা করলেন একটি উম্মাহ। এই উম্মাহ প্রতিষ্ঠিত হলো ভালোবাসার ওপর। এর প্রতিটি সদস্যের মাঝে বিরাজ করত পারস্পরিক ভালোবাসা। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, “আর যারা মুহাজিরদের আগমনের আগে এই নগরীকে নিবাস হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং ঈমান গ্রহণ করেছে, তারা তাদের কাছে যারা হিজরত করে এসেছে তাদের ভালোবাসে। আর মুহাজিরদের যা দেওয়া হয়েছে, তার জন্য তাঁরা তাদের অন্তরে কোনো (না পাওয়াজনিত) হিংসা অনুভব করে না। তারা তাদেরকে নিজেদের ওপর অগ্রাধিকার দেয়, এমনকি নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও। বস্তুত যাদেরকে অন্তরের কার্পণ্য থেকে মুক্ত রাখা হয়েছে, তারাই সফলকাম।” (সূরা হাশর : ৯)। একইভাবে জীবনযাত্রা ও পারস্পরিক কাজকর্মের প্রতিটি থরে থরে একতার নীতির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই উম্মাহ। এই উম্মাহর প্রত্যেক সদস্য লালন করে একই অনুভূতি, বাস করে একই রুহানি পরিবেশে। তারা তাদের প্রাত্যহিক জীবন পরিচালনাও করে একই রীতিনীতির আদলে।
জাতীয় স্বার্থ (National Interest) নিশ্চিতকরণে হাল জমানার সকল সামাজিক মতবাদ বা রীতিনীতি থেকেই এগিয়ে ছিলেন নবীজি সা.। তিনিই ঘোষণা করেছেন, ধর্মীয় বা বিশ্বাসগত পার্থক্যের কারণে জাতীয় স্বার্থ বিঘিœত হতে পারে না। আর এটা তিনি নিশ্চিত করেছেন ‘মদিনা সনদ’ নামক রাজনৈতিক চুক্তির মাধ্যমে। নিশ্চিতভাবে, ইতিহাসে এটাই এই ধরনের প্রথম কোনো চুক্তি। এই চুক্তির মাধ্যমে মদিনার নতুন সমাজের একতা নিশ্চিত হয়েছে। চুক্তিতে নবীজি সা. ঘোষণা করেছিলেন, মদিনার ইহুদিরা তাদের সকল নাগরিক অধিকার পুরোপুরিভাবে লাভ করবে। তারা ছাড়া তাদের কোনো প্রতিবেশী কবিলাও যদি এই চুক্তিতে শামিল হতে চায়, তাহলে তাদের জন্যও থাকবে একই অধিকার। তাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ ধর্ম ও আচার-অনুষ্ঠান স্বাধীনভাবে পালন করতে পারবে। পাশাপাশি মদিনা যদি কোনো বহিঃশত্রুর মাধ্যমে আক্রান্ত হয়, তাহলে তাদের সবাইকেই এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধে শামিল হতে হবে।
এভাবেই আজ থেকে প্রায় ১৩৬০ বছর আগে প্রণীত নবীজির এই চুক্তি নিশ্চিত করেছিল মানুষের বিশ্বাস, চিন্তা ও আবাসভূমির স্বাধীনতা। আরও নিশ্চিত করেছিল জান ও মালের সম্মান, নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল সকল ফৌজদারি অপরাধ এবং জাতীয় স্বার্থকে বানিয়েছিল জনগণের মাঝে প্রধানতম যোগসূত্র।
একতা ও ভালোবাসার পাশাপাশি এই উম্মাহ আরও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, জীবনচলার পথে নেমে আসা প্রতিটি আপদ-বিপদে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ, সহযোগিতা ও পরিপূরকতার নীতির ওপরে। মদিনার সমাজে বসবাস করা সাহাবিদের ভ্রাতৃত্ববোধ এতই গভীরে পৌঁছে গেছে যে, তাদের একজন তার অপর ভাইয়ের জন্য নিজ ধনসম্পদ এবং স্ত্রীও ছেড়ে দিতে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু তার অপর ভাই তাকে বলেছে, ‘না ভাই, আমার বিয়ে-শাদির দরকার নেই। আমি ব্যবসায়ী মানুষ, আমাকে বাজারটা দেখিয়ে দাও। আর আল্লাহ তাআলা তোমাকে বরকত দিক, তোমার পরিবার-পরিজন এবং ধন-সম্পদেও বরকত দিক।’
রাষ্ট্র
মদিনায় নবীজি প্রতিষ্ঠা করলেন একটি রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো, পূর্ণাঙ্গ আদালত বা ন্যায়পরায়ণতার ওপর। নবপ্রতিষ্ঠিত এই রাষ্ট্রের আদালত এতই সুউচ্চে পৌঁছে গিয়েছিল যে, স্বয়ং এর রাষ্ট্রপ্রধানও নিজের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রের সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তির জন্য কিসাসের (সমবিধানের) ঘোষণা দিয়েছিলেন। নবীজি সা. দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে জনগণকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, (আমার মেয়ে) ফাতিমা বিনতু মুহাম্মাদও যদি চুরি করে, তাও আমি তার হাত কেটে দেব। নবগঠিত এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এক যথাযথ নিজামের (ব্যবস্থার) ওপর। এই রাষ্ট্রের প্রতিটি কাজকর্মই পরিচালিত হয় একটি সংবিধানের আলোকে, যা গৃহীত হয়েছে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের বিধিবিধান থেকে। আল্লাহর এই বিধানাবলি আমাদের কাছে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে জীবন চলার সকল কানুন-বিধি, রীতিনীতি। এমনকি একজন মহিলা তার স্বামীর সাথে বিবাদে জড়িয়েছে, ফতুয়া চেয়েছে নবীজির কাছে। আল্লাহ তাআলা এই তুচ্ছ ঘটনাও ইলাহি ওহিতে শামিল করে সমাধান হাজির করেছেন এভাবে, “আল্লাহ অবশ্যই শুনেছেন সেই নারীর কথা; যে তার স্বামীর বিষয়ে আপনার সাথে বাদানুবাদ করছে এবং আল্লাহর কাছেও ফরিয়াদ করছে। আল্লাহ তোমাদের কথোপকথন শুনেন; নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।” (সূরা মুজাদালা : ১)
এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কুরবানির ওপর। এর প্রতিটি সদস্যই নিজ আবাসভূমির ইজ্জত রক্ষার্থে, আল্লাহর কালিমা বুলন্দ করার স্বার্থে সদা সর্বদা নিজ জান-মাল, স্ত্রী-সন্তানসহ সবকিছু কুরবানি
করার জন্য প্রস্তুত থাকে। আল্লাহ বলেছেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের কাছ থেকে তাদের জীবন ও সম্পদ কিনে নিয়েছেন (এর বিনিময়ে) যে, তাদের জন্য আছে জান্নাত। তারা আল্লাহ্র পথে যুদ্ধ করে, অতঃপর তারা মারে এবং মরে। এর (যুদ্ধে) দরুন (জান্নাত প্রদানের) সত্য ওয়াদা করা হয়েছে তাওরাতে, ইঞ্জিলে এবং কুরআনে; আর নিজ প্রতিজ্ঞা পালনে আল্লাহর চেয়ে শ্রেষ্ঠতর কে আছে? সুতরাং তোমরা যে সওদা করেছ, সে সওদার জন্য আনন্দিত হও। আর সেটাই তো মহাসাফল্য।” (সূরা তাওবা : ১১১)
আমাদের জন্য কী শিক্ষা আছে নবীজির সিরাতে?
দুনিয়ার নানান কোনায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে প্রিয় মুসলমান ভাইয়েরা! আল্লাহ তাআলা বলেছেন- “অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মাঝে রয়েছে উত্তম আদর্শ।” (সূরা আহযাব : ২১)। প্রিয় ভাইয়েরা, আমাদের মনে নাড়া দিচ্ছে নবীর হিজরতের স্মৃতিকথা। হিজরতের এই স্মৃতির মাঝে আমাদের জন্য রয়েছে অনেক বড় শিক্ষা, অনেক বড় নসিহত। হানিফ (বিশুদ্ধ) ইসলাম যেই দাওয়াত নিয়ে এসেছে, তা সজীব, সতেজ, নতুন ও নির্মল আছে এবং সবসময়ই থাকবে। কেননা এই দাওয়াত কুরআনের দাওয়াত। আর কুরআন চিরদিনই মাহফুজ (সুরক্ষিত) থাকবে। দুনিয়ার সব মানুষ মারা যাবে, কেয়ামত কায়েম হবে; কিন্তু তাও টিকে থাকবে আল-কুরআনুল কারিম। আপনাদের চারপাশে এখন ঘুরাঘুরি করছে, গলা ছেড়ে হাঁক দিয়ে যাচ্ছে নানাবিধ ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী দাওয়াত ও বাতিল চিন্তাধারা। উঁচু গলায় এখন নিজের সুনাম ও সুখ্যাতির কথা (?) জানান দিয়ে যাচ্ছে- সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ, নাস্তিকতা ও নৈরাজ্যবাদসহ আরও অনেকেই।
হে মুসলমান ভাইয়েরা, আপনারা কেন এইসব নিরর্থক কথাবার্তা ও বাতিল চিন্তাধারাকে পেছনে ফেলে আল-কুরআনের দাওয়াতের দিকে ফিরে আসছেন না? কেন আপনারা ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলনের স্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত করছেন না? আল্লাহর কসম করে বলছি, এই ইসলামী আন্দোলনের মাঝেই আছে মানবতার সুখ ও চিরস্থায়ী শান্তি।
লালসার করাল গ্রাসে আমাদের এ উম্মাহ আজ ছিন্নভিন্ন, প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার ছোবলে হয়ে গেছে শতধাবিভক্ত। তাহলে কেন আজ আমরা হিজরতের স্মৃতি থেকে একতার তালিম নিচ্ছি না? একতার পাঠ নেওয়ার মাধ্যমেই কেবল নতুন করে আবার আমরা হয়ে উঠতে পারব ‘এক উম্মাহ’, যার প্রতিটি সদস্যকে এক সুতোয় গেঁথে রাখবে ভালোবাসা, পারস্পরিক সহযোগিতা ও ভ্রাতৃত্বের বুনিয়াদ। আদতে, নবীজি সা. ও তাঁর পরবর্তী খুলাফায়ে রাশিদিনের সিরাত আমাদের কাছে তুলে ধরে এমনই একটি জীবন্ত ইসলামী রাষ্ট্রের উজ্জ্বল নমুনা। দুনিয়ার মানুষ আজ হয়রান ও পেরেশান হয়ে চক্কর খাচ্ছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে, হরেক রকম শাসনব্যস্থা ও রাজনৈতিক চিন্তাধারার মাঝে। তাহলে এ সময়ে কেন আমরা ইসলামী শাসনব্যবস্থা (নিজাম) থেকে প্রেরণা নিচ্ছি না? বাস্তবায়ন করছি না সেই রীতিনীতি ও কানুন-বিধি, যা নিয়ে এসেছে এই মহান নিজাম? আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন, “তবে কি তারা জাহিলিয়াতের বিধিবিধান কামনা করে? আর দৃঢ় বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য বিধান প্রদানে আল্লাহর চেয়ে আর কে শ্রেষ্ঠতর? ও মুমিনগণ, তোমরা ইহুদি ও নাসারাদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না; তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু। আর তোমাদের মধ্যে কেউ তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করলে, সে নিশ্চয় তাদেরই একজন। নিশ্চয়ই আল্লাহ জালিম সম্প্রদায়কে হিদায়াত দেন না।” (সূরা মায়িদা : ৫০-৫১)।
প্রিয় মুসলমান ভাইয়েরা, কোনোরকম পূর্ব নমুনা বা অনুসৃত অতীত ভিত্তি ছাড়াই নবীজি সা. এর মাধ্যমে (মদিনায়) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শরিয়ত, গঠিত হয়েছিল উম্মাহ এবং কায়েম হয়েছিল একটি রাষ্ট্র। এতদসত্ত্বেও নবগঠিত এই সমাজব্যবস্থা হাসিল করেছিল সবদিক থেকেই কামালিয়্যাত, যার ফলে তাকে (আল-কুরআনুল কারিমে) এমন সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মাহ হিসেবে অভিহিত করা যথাযথ হয়েছিল, যাদের উত্থান ঘটেছে মানুষের কল্যাণের জন্য। আর আজ অনুকরণ করার মতো আমাদের সামনে হাজির আছে পূর্ব নমুনা, জানা আছে অনুসরণ করার মতো অতীত ভিত্তিও। এখন প্রয়োজন কেবলই কঠিন ইরাদা ও সঙ্কল্প, ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও প্রত্যয়। প্রিয় ভাইয়েরা, এর পরেও কি আমরা এগোব না, কাজ করব না সেই সোনালি সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য?
আমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। ও আল্লাহ, অতীতে যা হয়ে গেছে তার জন্য আপনি আমাদের মাফ করে দিন। ভবিষ্যতে যা আছে, তা আপনি ঠিকঠাক করে দিন। আর আমাদের জন্য আমাদের কাজকর্ম পরিচালনার ব্যবস্থা করে দিন সঠিকভাবে। (আল্লাহুম্মা আমিন)।
লেখক : ইসলামী চিন্তাবিদ আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব
অনুবাদক : শিক্ষার্থী, ঢাবি
আপনার মন্তব্য লিখুন