নির্বাচনের নামে জনগণের সঙ্গে এক মশকরা শুরু করেছে সরকার। নির্বাচনে সরকার উপযুক্ত প্রার্থী দিতে পারেনি বলে, ডামি প্রার্থী হাজির করেছে। এই ডামি প্রার্থীর কাজ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করে তোলা।
২০১৪ সালে বিনা ভোটে নির্বাচন করে এই জাতির কপালে যে কলঙ্ক-তিলক দিয়েছে, তা নিয়ে সারা পৃথিবীতে ঢিঁ ঢিঁ পড়ে গেছিল। সরকার বলছে, নির্বাচন হয়ে গেছে। তাতে ব্যাপক হারে ভোটাররা অংশগ্রহণ করেছে। প্রকৃতপক্ষে নির্বাচন কেন্দ্রে সরকার বলছে যে যাই বলুক সে নির্বাচন ছিল সহিহ। ২০১৪ সালে তথাকথিত যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে ভোট লাগেনি। বিনা ভোটেই আওয়ামী লীগের ১৫৩ জন প্রার্থীকে বিজয়ী দেখানো হয়। স্তম্ভিত হয়ে যায় গোটা পৃথিবী। এই ভোট নিয়েই সরকার গঠিত হয় এবং তারা নির্লজ্জভাবে বলতে থাকে যে, ভোট যা পড়েছে তা যথেষ্ঠ।
বিরোধীদল বিএনপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এ ভোট বর্জন করে। ফলে সরকার ১০ শতাংশ ভোটকে ৬০ শতাংশ ভোট বানিয়ে দেয়। কিন্তু পৃথিবীর কোনো দেশই সে ফলাফল বিশ্বাস করেনি। ভারত-রাশিয়ার প্রত্যক্ষ মদদে সে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সরকারের গৃহপালিত বিরোধীদল নামে খ্যাত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টিও এই নির্বাচনের পিঠা ভাগের সাথে যুক্ত হয়।
নির্বাচনে এরশাদের যাওয়ার শর্ত ছিল এই যে, তাকে সমস্ত মামলা থেকে রেহাই দিতে হবে। এরশাদকে কখনও বিশ্বাস করেনি শেখ হাসিনা। যদিও এরশাদের সাথে গাঁটছড়া বেঁধেই হাসিনা রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছেন এবং রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। সেই কারণেই তাকে আশ্বাস দিলেও তার বিরুদ্ধে মামলাগুলো কখনও প্রত্যাহার করা হয়নি। বরং তাকে বাগে আনতে হাসিনা ভারতে সাহায্য নেন। এরশাদ হঠাৎ বলে বসলেন যে, তিনি নির্বাচনে যাবেন না।
তখন ভারত তাকে বোঝানোর জন্য তাদের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংকে এরশাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য ঢাকায় পাঠান। সুজাতা সিং তাকে জানান যে, এরশাদ যদি এই নির্বাচনে অংশ না নেন, তাহলে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এসে যাবে। তখন এরশাদ বলেন, তাতে আমার কী করার আছে। তাই যদি হয়, তাহলে তার জন্য দায়ী থাকবে আওয়ামী লীগই। কিন্তু এরশাদ নিজে এবং তার দলের প্রার্থীদের মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু সে নির্বাচন এমনই এক তামাশা ছিল যে, নির্বাচন কমিশন তার এই প্রত্যাহার পত্র আমলে নেয়নি।
এরশাদকে এই পর্যায়ে সরকারি সংস্থা অপহরণ করে। প্রায় ১৫ দিন অজ্ঞাতবাসে থেকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে আবিষ্কৃত হন। তিনি বার বার জোর দিয়ে বলতে থাকেন যে, তিনি মোটেও অসুস্থ নন। তাকে জোর করে অসুস্থ বানানো হচ্ছে। তা সত্ত্বেও এরশাদ ও তার দলের সদস্যদের মনোনয়নপত্র জন্মান্ধ নির্বাচন কমিশন বৈধ ঘোষণা করে। সে ছিল নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশে নতুন খেলার শুরু। তারপর বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার চাপে ও ন্যাক্কারজনক ঘটনার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালের তথাকথিত নির্বাচন।
এ নির্বাচনে ১৫৩ আসনে আওয়ামী লীগের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, বিনা ভোটে নির্বাচনের প্রথম মহড়া। হাসপাতাল থেকে এসে এরশাদ ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা নির্বাচনে অংশ নেয়। এরশাদকে মন্ত্রী-পদমর্যাদায় করা হয় শেখ হাসিনার বিশেষ দূত। তার এমপিদের মধ্য থেকে বেশ কয়েকজনকে মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দেন শেখ হাসিনা। কিন্তু এরশাদের জাতীয় পার্টিকে বলা হতে থাকে বিরোধীদল।
বিরোধীদলের যাবতীয় সুযোগ সুবিধা তারা ভোগ করতে থাকে। এরশাদ শেখ হাসিনার মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক উপদেষ্টা নিয়োজিত হলে এই পদ তিনি ব্যবহার করেননি। বরং সবসময় মনমরা হয়ে থাকেন। তার প্রধান উদ্বেগ ছিল তার নামে দায়েরকৃত মামলায় শেখ হাসিনা যখন তখন তাকে ফের জেলে পুরতে পারেন। ১৯৯১ সালে একবার তিনি ৫ বছর জেল খেটেছেন। কিন্তু তার আর জেলে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না। শেখ হাসিনা যে কতটা নিষ্ঠুর প্রকৃতির সেটা তিনি জানতেন। ফলে বিদ্রোহ করার মতো সামর্থ্য তার ছিল না।
এই লেখা যখন লিখছি তখনও জাতীয় পার্টির তথাকথিত নির্বাচনে যাওয়া নিশ্চিত হয়নি। জাতীয় পার্টির বর্তমান চেয়ারম্যান এরশাদের ভাই জি এম কাদের নিশ্চিত হতে পারেননি যে জাপা নির্বাচনে অংশ নেবে। জাপাকে ২৫-৩০টা আসন দিতে সম্ভবত সরকার রাজি আছে। এ ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টির তরফ থেকে জানানো হয়েছে যে, তারা তাদের যেসব আসন দেওয়া হবে সেখানে নৌকা মার্কা নিয়ে আওয়ামী লীগ ভোট করবে না। তেমনি ঐ সব আসনে আওয়ামী লীগ থেকে যারা স্বতন্ত্র দাঁড়িয়েছে তাদেরকেও প্রত্যাহার করে নিতে হবে।
স্বতন্ত্র দাঁড়াতে আওয়ামী লীগ নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে অনেক আওয়ামী লীগার সে সব আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এসব জায়গায় কার্যত ৪ ধারার প্রার্থী রয়েছে। প্রথম ধারায় আছে নৌকা মার্কা নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী। দ্বিতীয় ধারায় আছে আওয়ামী লীগের মনোনয়নের, যারা আওয়ামী লীগের অনুমতি নিয়ে স্বতন্ত্র দাঁড়িয়েছে। আর আছে আওয়ামী লীগের অনুমোদনহীন দলীয় প্রার্থীরা। তাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে জাতীয় পার্টিকে। সে এক কঠিন সমস্যা। আর এই ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি যে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে যাবে কি যাবে না।
নির্বাচন নিয়ে জাতীয় পার্টি ইতোমধ্যেই দুভাগ হয়ে গেছে। একদিকে গুরুতর অসুস্থ রওশন এরশাদ। অপরদিকে আছেন জি এম কাদের। নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে জি এম কাদেরের পাল্লাই ভারী। রওশন এরশাদ শেখ হাসিনাকে বলে এসেছেন যেন তিনি জি এম কাদেরকে বিশ্বাস করেন না। এদিকে দলীয় প্রার্থীদের জয় নিশ্চিত করার জন্য জাতীয় পার্টির সভাপতি জি এম কাদের দাবি তুলেছেন যে, যেসব আসন তাদের দেওয়া হবে সেখানে আওয়ামী লীগ, স্বতন্ত্র এবং খুচরা আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের প্রত্যাহার করা হবে।
এর পক্ষেও জি এম কাদেরের বক্তব্য স্পষ্ট। তিনি জানেন, আওয়ামী লীগ যদি নৌকা প্রার্থী প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে যে আওয়ামী লীগাররা পৌঁছেচেন তাদেরই জিতিয়ে আনা হবে। একই রকম আশঙ্কা ইনু-মেনন প্রভৃতি ১৪ দলীয় জোটের যারা মনোনয়ন পাবেন বা পেয়েছেন, তাদেরও রয়েছে। ফলে এই নির্বাচন বানরের পিঠা ভাগের খেলায় পরিণত হয়েছে। আসলে নির্বাচনের নামে এভাবেই আসন ভাগাভাগি হচ্ছে।
সংসদে তো একটা বিরোধীদল দরকার। ইনু-মেননকে দিয়ে তো আর তা হবে না। তার জন্য চাই জাতীয় পার্টিকে। সেজন্য জাতীয় পার্টি যাতে নির্বাচন বর্জন না করে, শেখ হাসিনাকে সেটাও খেয়াল রাখতে হচ্ছে। তবে নিতান্ত চালবাজি না করলে রওশনকে এখন বিরোধীদলের নেতা করার সুযোগ নাই। এক্ষেত্রে ২০১৪ সালের নির্বাচনের মতো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সরকার গঠনে সরকার কসুর করবে না। এতে দেশে বিদেশে যে দুর্নামই হোক, শেখ হাসিনা তার থোড়াই পরোয়া করেন।
২০১৪ সালের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সরকার গঠনের মতো আসনে জয়লাভ করায় বিশ্বব্যাপী যে ধিক্কার হয়েছিল, সেরকম ঝুঁকি আর আওয়ামী লীগ নিতেই পারেনি। সেজন্য মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছিলেন যে, কেউই যেন এবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে না পারে। প্রত্যেক প্রার্থীকেই কমপক্ষে একজন করে ডামি প্রার্থী রাখতে হবে।
এর কারণ ছিল প্রত্যেকেই যেন তার তার সমর্থকদের ভোট কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। তাতে ভোটারের উপস্থিতি যেমন বাড়বে তেমনি নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখানো সহজ হবে। আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা যদি ২৫% ভোটও কেন্দ্রে আনতে পারে তাহলে তাকে ৫০%-৬০% দেখানো কঠিন হবে না। অর্থাৎ নির্বাচন হবে ট্রিকস-এর নির্বাচন। শেখ হাসিনা মনে করছেন, এই নির্বাচন চালানো বর্হিবিশ্বে প্রশ্নের সম্মুখীন হলেও সরকার দেখাবে যে নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক হয়েছে এবং তারা সঠিকভাবেই জনগণের রায়ে নির্বাচিত হয়েছেন।
বিদেশিরা যারা এই নির্বাচনকে অবাধ নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করার কথা বলছেন, তাদেরকে বলা যাবে যে, নির্বাচনে ৬০% লোক অংশ নিয়েছে এবং বিনা ভোটে কেউ নির্বাচিত হয়নি। শেখ হাসিনার এ এক নতুন তত্ত্ব এখন প্রচারে সক্রিয় কিছু দালাল সাংবাদিক। তারা বলতে চাইছেন, বেশি মানুষ নির্বাচনে ভোট দিলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে। দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি বা তৃতীয় বৃহৎ দল জামায়াত এই নির্বাচনে অংশ না নিলেও তা অংশগ্রহণমূলকই হয়েছে। যদিও পশ্চিমা বিশ্ব বলছে যে, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো অংশ না নিলে সে নির্বাচন কিছুতেই অংশগ্রহণমূলক হবে না। কিন্তু সরকার সেটা মেনে নেয়নি। সরকার মনে করছে, একবার নির্বাচন হয়ে গেলে ক্রমে সবাই তা মেনে নিবে, যেভাবে মেনে নিয়েছিল ২০১৪ সালের তথাকথিত নির্বাচন। তবে সরকার বোধহয় এটা জানে না যে, এক নদীতে দুইবার স্নান হয় না।
লেখক : সাহিত্যিক ও কলামিস্ট
আপনার মন্তব্য লিখুন