আশরাফুল মাখলুকাত মানুষ জ্ঞান, বিবেক ও ইচ্ছার স্বাধীনতা প্রাপ্ত হওয়াতেই তার শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা নিশ্চিত হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদীর মতে মানুষের দু’টি প্রধান সত্তা। একটি তার পাশবিক সত্তা (Animality) অপরটি মনুষ্যত্ব (Humanity)। এ দুটো পরস্পর সাংঘর্ষিক। মনুষ্য সত্তাটিই তার নৈতিক সত্তা (morality)। মনুষ্য সত্তার অভাব কিংবা ঘাটতি দেখা দিলে তার পশু সত্তা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এ কারণেই মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তার পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক শক্তি নানা আয়োজন করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- “মানুষকে মানুষ করার আয়োজনের নাম শিক্ষা।” এ আয়োজনের সূচনা তার আঁতুড়ঘর থেকে। পরিবার (মা, বাবা, ভাই, বোন আত্মীয়-স্বজন), সমাজ তাকে বয়স ও মানসিক বিকাশের সাথে সাথে আনুষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিক ও উপ-আনুষ্ঠানিকভাবে শেখাতে থাকে। এরচেয়ে বড় কথা, যখন থেকে বিদ্যায়তনের ধারণা তৈরি হয়েছে, তখন থেকে শিশু-শিক্ষা থেকে উচ্চতর শিক্ষা পর্যন্ত নানা আয়োজন করা হয়েছে। এসব আয়োজনের মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর হচ্ছে সরকারের বা রাষ্ট্রের আয়োজন। প্রতিটি রাষ্ট্র সে রাষ্ট্রের জাতীয় নীতিমালাকে সামনে রেখে শিক্ষানীতি, কারিকুলাম, সিলেবাস, শিক্ষার স্তরবিন্যাস, শিক্ষার জন্য উপযুক্ত ও প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ করে শিক্ষাকে সার্বজনীন করার মাধ্যমে মানুষকে শারীরিক, মানসিক ও আত্মিকভাবে তৈরি করার প্রয়াস নেয়। তবে এক কথায় বলতে হবে- মানুষ নৈতিক জীব। শরীর, মন ও আত্মার সমন্বয়েই একটি সত্তা।
সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের নৈতিক সত্তার প্রকাশ
মানুষ না বস্তু শক্তি নিরপেক্ষ হতে পারে, আর না নৈতিক শক্তির মুখাপেক্ষীহীন হয়ে কিছু সময় বাঁচতে পারে। তার উন্নতি লাভ হলে উভয় শক্তির ভিত্তিতেই হবে, আর পতন হলেও ঠিক তখন হবে, যখন এ উভয়বিধ শক্তি হতেই সে বঞ্চিত হবে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও যে মূল জিনিসটি মানুষের পতন ঘটায়, উত্থান দান করে এবং তার ভাগ্য নির্ধারণের ব্যাপারে যে জিনিসটির গুরুত্ব সর্বাপেক্ষা অধিক তা একমাত্র নৈতিক শক্তি ভিন্ন আর কিছুই নয়। এটা স্পষ্ট যে, মানুষকে এর দেহসত্তা বা এর পাশবিক দিকটার জন্য কখনো মানুষ বলে অভিহিত করা হয় না বরং মানুষকে মানুষ বলা হয় এর নৈতিকগুণ গরিমার (moral qualities) কারণে।..... মানুষ নৈতিক গুণসম্পন্ন জীব, তার নৈতিক স্বাধীনতা ও নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে।” (ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি, পৃ. ১৩)
নৈতিক মূল্যবোধ ও চরিত্রের প্রকারভেদ :
নৈতিক মূল্যবোধ (Moral value)-কে দু’ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথমটি মৌলিক মানবীয় গুণ (Basic moral value) আর অপরটি ইসলামী নৈতিক চরিত্র (Islamic moral value)। বুঝাই যাচ্ছে- মানুষের চারিত্রিক ক্রম পর্যায়টি যেহেতু নিম্নের গ্র্যাফের মতো সেহেতু ঠাণ্ডা মাথায় এই সত্যটিকে অনুধাবন করতে হবে। আমাদের প্রকৃত ভিত্তি একজন মানুষ হিসেবে।
আমার ঈমান থাক বা না থাক, আমি মুসলিম হই অথবা না হই, এমনকি কাফির-মুশরিক নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষকে মানবিক গুণাবলিতে অভিষিক্ত হতে হবে। মৌলিক মানবীয় গুণাবলির
মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ইচ্ছাশক্তি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ শক্তি, প্রবল বাসনা। উচ্চাশা ও নির্ভীক সাহস, সহিষ্ণুতা ও দৃঢ়তা, তিতিক্ষা ও কৃচ্ছ্রসাধনা, বীরত্ব ও বীর্যবত্তা, সহনশীলতা ও পরিশ্রমপ্রিয়তা। উদ্দেশ্যের আকর্ষণ এবং সে জন্য সব কিছু উৎসর্গ করার ক্ষমতা, পরিস্থিতি যাচাই করা ও তদনুযায়ী নিজেকে ঢেলে গঠন করা ও অনুকূল কর্মসূচি গ্রহণ করার যোগ্যতা। নিজের হৃদয়াবেগ, ইচ্ছা বাসনা, স্বপ্নসাধ, হৃদয়াবেগ ও সংযম শক্তি। অন্যান্য মানুষকে আকৃষ্ট, তাদের হৃদয়-মনে প্রভাব বিস্তার করা এবং তাদেরকে কাজে নিযুক্ত করার দুর্বার বিচক্ষণতা। আগেও বলেছি- এসব গুণাবলির সাথে মানুষের ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের কোনো সম্পর্ক নেই। এ জন্য সব ধর্মেই কিছু সাহসী বীর, উদ্যমী উদ্যোক্তা, স্বপ্নবাজ নেতা দেখা যায়; যারা পৃথিবীতে মহৎ কীর্তি তৈরি করেছেন। এরা এসব মানবিক গুণাবলির জিয়নকাঠির ছোঁয়ায় বিজয়ী হন।
পূর্ণতাদানকারীর গুণাবলি
এসব গুণ মানবীয় মৌলিক গুণকে শাণিত করে। ভদ্রতা, নম্রতামূলক স্বভাব প্রকৃতি হিসেবে পরিচিত এসব গুণ কারো ভেতর থাকলে মানুষ মানবসমাজে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত হয়। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : আত্ম-সম্মানবোধ, বদান্যতা, দয়া ও অনুগ্রহ, সহানুভূতি, সুবিচার, নিরপেক্ষতা, ঔদার্য ও হৃদয় মনের প্রসারতা, বিশ্বাসপরায়ণতা, ন্যায়-নিষ্ঠা, উদারতা, সত্যবাদিতা ও সত্যপ্রিয়তা, ওয়াদা পূর্ণ করা, বুদ্ধিমত্তা, সভ্যতা, ভদ্রতা, পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা এবং মন ও আত্মার সংযম শক্তি। এ দুই ধরনের গুণাবলি যখন ব্যাপকভাবে বিকশিত হয় তখন ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তারকারী এবং বিজয়ী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
ধূসর মরুর ঊষর বুকে যখন আইয়ামে জাহেলিয়াত সবকিছুকে ছেয়ে নিয়েছিল তখন আরবের শ্রেষ্ঠ বংশের (কুরাইশ) এক হতদরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণকারী ইয়াতিম মুহাম্মদ সা. তাঁর ভিতরে বিদ্যমান এসব অসাধারণ মানবীয় গুণাবলির কারণেই আশৈশব সকলের প্রিয় হয়ে ওঠেন। সবাই তাঁকে শৈশবেই আল-আমিন, আস-সাদিক হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে। পূর্ণ যৌবনে তিনি নবুয়তপ্রাপ্তির পর দলে দলে মানুষ তাঁর নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হয়েছে, তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে মাতৃভূমি ছেড়ে হিজরত করেছে, পৃথিবীর সকল পরাশক্তিকে পরাজিত করে তারা সারা দুনিয়াতে ইসলামের বিজয় পতাকা উড়িয়েছে।
নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ও আজকের সমাজ
পৃথিবীতে যদি আইনের শাসন না থাকতো তাহলে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান জাহেলিয়াত ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ (Secularism) এর তাণ্ডবটি আমরা বুঝতে পারতাম। ১৯৭৭ সালের ১৩ জুলাই কয়েক ঘণ্টার জন্য আমেরিকার ম্যানহাটনে বিদ্যুৎ চলে যায়। এ অল্প সময়ের মধ্যে ৩৭০০ মানুষকে গ্রেফতার করা হয় চুরি, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ইত্যাদি অপরাধে। বাংলাদেশের মতো প্রতিনিয়ত বিদ্যুৎ গেলে কী ঘটতো ভাবা যায়? এ ছোট্ট উদাহরণ দিয়ে আমরা বুঝলাম কেবল আইন মানুষকে বড় হতে সাহায্য করে না, বরং বৃহত্তর মানবসমাজের কল্যাণ, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন মানুষের আত্মশক্তির উন্নয়ন, মূল্যবোধ সংরক্ষণ ও নৈতিকভাবে তাদেরকে তৈরি করা।
আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত বাংলাদেশ, অর্থপাচারে পর্যুদস্ত যার অর্থনীতি, ন্যায়বিচার যেখানে নির্বাসিত, তরুণ-তরুণীরা যেখানে পশ্চিমা সংস্কৃতির বুকে গা ভাসিয়ে দিয়েছে, পরকীয়া সেখানে পরিবার প্রথাকে চ্যালেঞ্জ করে বসেছে, ঘুষ ছাড়া সেখানে কোনো সরকারি অফিসে ফাইল নড়ে না, অনিয়ন্ত্রিত যানবাহনের কারণে যে দেশের রাজধানীতে ব্যাপক যানজট গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের হাজার হাজার কর্মঘণ্টা রাস্তায় বসে কাটাতে বাধ্য করে, অন্যায় ও অসাধু পন্থায় যে দেশে প্রতি বছর লক্ষ মানুষ আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়, সে দেশের সাধারণ ও সচেতন নাগরিকগণ হতাশায় নিমজ্জিত। তারা বুঝতেই পারছে না এ অমানিশার অন্ধকার থেকে কী করে মুক্ত হবে তারা। কী করে দেশকে এগিয়ে নেবে সামনে।
সকলেই এ সত্যটি উপলব্ধি করতে পারছেন যে দেশের প্রতিটি মানুষের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধের সৃষ্টি ও চর্চার কোনো বিকল্প নেই। আর এ কাজটি করতে হলে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রিক ও সামাজিক উদ্যোগ নিতে হবে। বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে সমাদৃত কতিপয় নৈতিক মূল্যবোধ :
১. সততা (Honesty)
সততার একমাত্র বিকল্প সততা। ব্যাপক প্রচলিত ও গ্রহণযোগ্য কথা হচ্ছে- সততাই সর্বোত্তম নীতি। (Honesty is the best policy)। স্থান-কাল-পাত্রভেদে এ নীতির সাথে কারোই কোনো দ্বিমত নেই।
২. শ্রদ্ধাবোধ (Respect)
পারস্পরিক শ্রদ্ধা একটি সমাজকে সুন্দর করে। শ্রদ্ধা দিলেই শ্রদ্ধা পাওয়া যায়। না এটি কেনা যায় না এটি আইন করে বাস্তবায়ন করা যায় না। যে সমাজে শ্রদ্ধা নেই, সে সমাজে স্বস্তি ও শান্তি নেই।
৩. সহানুভূতি (Compassion)
মানুষের প্রতি অপর মানুষের সহানুভূতি থাকা চাই। এটি একজন অপরাধীরও অধিকার। অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে সহানুভূতির সাথে দেখতে হবে, এমনকি প্রমাণিত অপরাধী হওয়ার পরও তার সংশোধনের জন্য সহানুভূতিপূর্ণ আচরণ করতে হবে।
৪. সহযোগিতা (Co-operation)
একে অন্যকে সকল ধরনের প্রকাশ কাজে সহযোগিতা করা দরকার। সমাজের অনেকেই অনেক কিছুর সাথে পরিচিত নন। এক্ষেত্রে একটু সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেই বেড়ে যায় সম্প্রীতির বন্ধন, আর তাতেই সমাজ হতে পারে সুন্দর। পরিবার থেকে সমাজ সর্বত্র একে অন্যকে সহযোগিতার হাত বাড়ালেই সমাজটা সুন্দর হবে এবং অন্যরাও তা দেখে তা শিখবে।
৫. কৃতজ্ঞতা (Gratitude)
যে কেউ আমার সাথে একটু ভালো আচরণ করলে আমার উচিত তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। অকৃতজ্ঞকে কেউই ভালোবাসে না। আমরা প্রতিদিন-ধন্যবাদ। আপনার সহযোগিতার কথা মনে থাকবে, এভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকি। একটি সহাস্য কৃতজ্ঞতা লক্ষ টাকার চাইতেও দামি। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে না পারলেও অকৃজ্ঞ বা কৃতঘ্ন হওয়া মোটেই উচিত নয়।
৬. দয়ার্দ্রতা (Kindness)
অন্য মানুষের প্রতি আমাদের ভদ্রতাজনিত আচরণ, যত্নশীলতা ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে এই নৈতিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আমরা হাজী মুহাম্মদ মুহসিন, হাতেমতায়ী, নাইটিঙ্গেল এর মতো দয়ালু লোকজনের কথা জানি। শিশুরা তাদের বাবা মা, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী ও অন্যদের কাছ থেকে এটি শেখে।
৭. দায়িত্ববোধ (Responsibility)
প্রতিটি মানুষই দায়িত্বশীল। নিজের, মা-বাবা, ভাই-বোন, পরিবারের সদস্য, সমাজ, রাষ্ট্র থেকে সবার প্রতি আমাদের দায়িত্ব রয়েছে। এ দায়িত্ববোধ তিলে তিলে তৈরি হয়। ছোট ছোট দায়িত্ব পালন করতে করতে মানুষ বড় দায়িত্বের জন্য উপযুক্ত হয়। দায়িত্বহীন মানুষ মানুষ নয়। সে একটি জড় বস্তুর নামান্তর।
৮. ভাগাভাগি করা (Sharing)
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কারো না কারো সাথে আমাদেরকে কোনো না কোনো না বস্তু, বিষয়, আনন্দ বেদনা ভাগাভাগি করতে হয়। এটিও একটি নৈতিকতা। যারা অন্যকে তার প্রাপ্য ভাগ (শেয়ার) দিতে চায় না, তারা নিজের ভাগটা দেবে এটা আশাই করা যায় না। অথচ বাবা-মা নিজের সর্বস্ব তাদের সন্তানকে ভাগ করে দেন, না খেয়েও খাওয়ান।
৯. সমতা (Equality)
প্রতিটি মানুষই আইন, ধর্ম ও সমাজের চোখে সমান। কিন্তু আমরা প্রায়শ মানুষকে সমানভাবে দেখতে পারি না। ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে সবাই সমান। প্রত্যেককে তার অধিকার সমানভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে। রাসূল সা. একবার বলেছেন- চুরি যদি আমার প্রিয়তমা কন্যা ফাতিমাও করে তারও হাত কেটে নেওয়া হবে। অর্থাৎ সবাইকে সমান প্রাপ্য দিতে হবে, আইনের চোখে সমান বিচার করতে হবে। কোন ধরনের স্বজনপ্রীতি চলবে না। অধিকার, সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদার ক্ষেত্রে বৈষম্যমুক্ত হতে হবে।
১০. মহানুভবতা (Generosity)
সন্তানকে সুন্দরতম সামাজিক মানুষ হিসেবে গড়তে হলে তার ভেতর মহানুভবতা সৃষ্টি করতে হবে। সে যেন শৈশব থেকেই অন্যের জন্য সময়, শ্রম, অর্থ ও মেধা ব্যয় করতে শেখে।
১১. পরিশ্রম (Hard work)
প্রতিটি শিশু তার বাবা-মার কাছে সাত রাজার ধন, রাজপুত্র কিংবা রাজকন্যা। বাবা মা চেষ্টা করেন তাদেরকে আরামে আয়েশে প্রাচুর্যে বড় করতে। কিন্তু এ কথাতো ঠিক- পরিশ্রম সৌভাগ্যের চাবিকাঠি। কঠোর পরিশ্রম ছাড়া জীবনে সফলতা পাওয়া সহজ নয়। সেজন্য বড় হতে হতে আমাদের সবাইকেই পরিশ্রমপ্রিয় হতে হবে। পরিশ্রম করলেই শ্রমের মর্যাদা বোঝা যায়।
১২. একনিষ্ঠ সততা (Integrity)
জীবনের সকল পর্যায়ে সততা ও নৈতিক মূল্যবোধের ওপর শক্তভাবে স্থির থাকা একটি বিরাট গুণ। খুব কম সংখ্যক মানুষ এক্ষেত্রে সফল হন। কেউই যখন দেখছে না তখনও সঠিক কাজটি করা, সত্যপথে থাকা- এ গুণের বহিঃপ্রকাশ।
১৩. সাহস (Courage)
বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত কবির ভাষায় বলতে হয় :
“সাহসের সাথে কিছু স্বপ্ন জড়াও, তারপর পথ চলো নির্ভয়
আঁধারের ভাঁজ কেটে আসবে বিজয়, সূর্যের লগ্ন সে নিশ্চয়।”
সাহসী হওয়া মানেই ভয়হীন হওয়া নয়, বরং এর অর্থ ভয়কে জয় করার প্রজ্ঞা। বুকে আশা, মনে সাহস থাকলেই মানুষ বিজয় অর্জন করতে পারে। সাহসীরাই বিশ্বে বড় বড় বিজয়ের পদচিহ্ন রেখে যেতে পেরেছেন। যেমন পেরেছেন ৩১৩ জন সাহাবি ১০০০ সৈন্যের বিশাল বাহিনীকে বদরে পরাস্ত করতে। শীর্ণকায় ছিন্ন বসনের একজন সেনাপতি পেয়েছে পারস্য সমাজের বিশাল রুস্তম বাহিনীকে হাতির পিঠ থেকে ফেলে পরাজয়ের গ্লানি দিতে।
১৪. সংসার (Family)
নৈতিক মূল্যবোধ শেখার, শেখানোর ও প্র্যাকটিস করার একটি অন্যতম ক্ষেত্র পরিবার। বলা হয় পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষুদ্রতম একক। পরিবার তার প্রতিটি সদস্যের মাঝে নৈতিক শিক্ষা প্রবর্তন, প্রচলন ও ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। শৈশব থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত ছয়টি ধাপে ব্যাপ্ত জীবন। শৈশব, কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব, বার্ধক্য অবধি: সব মূল্যবোধ পর্যায়ক্রমে গড়ে ওঠে আমাদের মাঝে। যাদের সংসার যতো সুন্দর, পরিচ্ছন্ন, ভালোবাসায় ভরা, আদরে স্নেহে মোড়ানো, তাদের জীবন তত বেশি নৈতিকতায় পরিপূর্ণ।
১৫. ন্যায় বিচার (Justice)
প্রতিটি শিশু শৈশব থেকেই নৈতিক মানদণ্ড ও ন্যায়ানুগতার অনুভূতি নিয়ে বড় হওয়া দরকার। তাহলেই সে সবার প্রতি ন্যায়বিচার, সুবিচার আর কারো প্রতি অবিচার নয়- এ বিষয়টি চর্চা করতে পারবে।
১৬. ভদ্রতা-নম্রতা (Politeness)
সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য আচরণ, সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্যপন্থায় কথা বলা ও কাজ করা, অন্যদের প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধা ও স্নেহ প্রদর্শন- এসবকেই এক কথায় আমরা ভদ্রতা বা নম্রতা বলি। এগুলো পুঁথিগত বিদ্যা নয় বরং দৈনন্দিন জীবনে বাস্তবায়ন করতে করতে অর্জন করতে হয়। সদাচরণ ও সৌজন্যবোধ আমাদেরকে নৈতকভাবে তৈরি হতে সাহায্য করে। এসবে অর্থ ব্যয় হয় না, কিন্তু ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে।
১৭. সাহায্য করা (Helping)
মানুষ পরস্পর নির্ভরশীল। তারা একে অন্যকে সাহায্য করে বড় হতে, টিকে থাকতে এবং ভালো হতে। পরোপকারী মানুষই সত্যিকারের মানুষ। একটা প্রবাদ আছে, “পরের জন্য করলে কিছু নিজের জন্য করা হয়”। মানুষকে অন্যের উপকারের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। সন্তানদেরকে অন্যের উপকার করার শিক্ষা ছোটবেলা থেকে দেওয়া লাগবে। সে যেন বুঝতে পারে অন্যের উপকার করলে কখনো না কখনো তার বিনিময় ফিরে পাওয়া যাবে বা যায়।
১৮. ধৈর্যশীলতা (Perseverance)
বিজয়ের জন্য মানুষের ধৈর্য থাকতে হয়। আমাদের রব বা স্রষ্টা ধৈর্যশীলদের সাথে থাকেন। ইসলাম আমাদেরকে ধৈর্যশীল হতে শেখায়, সবর করতে শেখায়। এর অর্থ হচ্ছে সব সময় ভালো কাজে লেগে থাকা, কখনো হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেওয়া নয়। আমাদের শিশুদের কোনো ব্যর্থতাকে বড় করে না দেখিয়ে তাকে আশা দেখাতে হবে। ধৈর্য ও পরিশ্রমের মাধ্যমে বিজয় ছিনিয়ে আনার শিক্ষা দিতে হবে।
১৯. সমন্বয় ও আপস (Adjusting and compromising)
এটাও একটি নৈতিক মূল্যবোধ যে, সব সময় আমাদের গৃহীত কর্মসূচি সাফল্য নাও পেতে পারে। সে ক্ষেত্রে আমাদেরকে নীতিগত বিষয়ে ছাড় না দিয়ে অন্যদের সাথে সমন্বয় ও কিছুটা আপস বা Understanding এ যেতে হবে।
২০. উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার পদ্ধতিকে প্রশংসা করা (Appreciate how they handle the situation)
অনেক সময় শিশুরা কোনো কিছুর সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে চায়। সে ক্ষেত্রে তারা নিজের মতো পদক্ষেপ নিতে চায়, স্বাধীনতা চায়। এটি তার জন্য প্রয়োজন। এ পথ ধরেই সে সফলতার দিকে যেতে পারবে। (চলবে)
লেখক : বিশিষ্ট গবেষক, সংগঠক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
আপনার মন্তব্য লিখুন