ক্রিকেট থেকে রাজনীতিতে ইমরান খান
পাকিস্তানের পাঞ্জাবের সচ্ছল পরিবারে ১৯৫২ সালের ৫ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন ইমরান আহমেদ খান নিয়াজি। তবে ক্রিকেট-বিশ্বে ইমরান খান নামেই খ্যাতি কুড়ান। যে কারণে পুরো নাম ঢাকা পড়ে। তার বাবার নাম ইকরামুল্লাহ খান নিয়াজি। তিনি ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। মা শাওকাত খানুম গৃহিণী। বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে তিনি। নিয়াজি বংশের এ পরিবার উত্তর পাঞ্জাবে বসবাস করতো। ইমরান খানের চার বোন ছিল। ছোটবেলায় তিনি শান্ত স্বভাবের ছিলেন। উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, ইমরানের পরিবারে ক্রিকেটপ্রীতি ছিল। তার মামাতো ভাই জাভেদ বারকি এবং মাজিদ খান ক্রিকেট খেলতেন। ফলে স্কুলে থাকতেই তার ভেতরে ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা জন্মে। মাত্র ১৩ বছর বয়সে ইমরান ক্রিকেট খেলতে শুরু করেন।
মামাতো ভাইদের উৎসাহেই তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এবং পাকিস্তানের হয়ে খেলতে শুরু করেন। ইমরান খান লাহোরের অ্যাটকিনসন কলেজ এবং ক্যাথেড্রাল স্কুলে পড়াশোনা করেন। পরে তিনি অরচেস্টারের রয়েল গ্রামার স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৭৫ সালে তিনি যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ কেবলি কলেজ থেকে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে তিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। ইংল্যান্ডে থাকাকালেই তিনি কাউন্টি ক্রিকেটে নজর কাড়েন। ১৯৭১ সালের ৩ জুন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট খেলার মধ্য দিয়ে তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখেন। ৮৮টি টেস্ট ম্যাচ খেলা ইমরান অলরাউন্ডারের খেতাব পান এবং ইংল্যান্ডের ইয়ান বোথামের পর বিশ্বের দ্বিতীয় দ্রুততম খেলোয়াড় হিসেবে রেকর্ড গড়েন।
পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম ডনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইমরান খান ১৯৯৬ সালে তেহরিক-ই-ইনসাফ রাজনৈতিক দল গঠন করে সবাইকে চমকে দেন। খেলার মাঠ ছেড়ে রাজনীতির মাঠে নামায় তাকে নিয়ে সমালোচনা ও হাস্যরস তৈরি হয়েছিল। ক্রিকেটের অলরাউন্ডার, রাজনীতির কঠিন মারপ্যাঁচের কী জানেন তিনি এ নিয়ে তৎকালীন রাজনীতিবিদরা মিডিয়া সরগরম করে তুলেছিলেন। দল গঠনের পরের বছরই পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে দু’টি আসনে ভোটযুদ্ধে নামেন ইমরান খান। দুই আসনেই খালি হাতে ফেরেন। দলের ভরাডুবি বলতে যা বোঝায় সেটাই হলো। ১৯৯৯ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দেশটির ক্ষমতায় থাকা স্বৈরশাসক পারভেজ মোশাররফের ব্যাপক সমালোচনায় মুখর ছিলেন তিনি। দলের পরিচিতি বাড়াতে ক্রিকেটার ইমেজটাই কাজে লাগান।
এরই মধ্যে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের শিরোনামে জায়গা পেয়ে যান। ২০১৩ সালে দেশটির সাধারণ নির্বাচনে ভোট কারচুপির অভিযোগ এনে ব্যাপক প্রতিবাদের ডাক দেন ইমরান। মাত্র ১৯ শতাংশ ভোট পায় ইমরানের পিটিআই। আবারো ভরাডুবি তার দলের। তবে এই হতাশাজনক ফলাফলের পর রীতিমতো পুনর্জন্ম ঘটে পিটিআই বা তেহরিক-ই-ইনসাফের। ২০১৩ সালে নির্বাচনে নিজ আসনে জয়ের পর সংসদ সদস্য হয়ে রাজনীতিতে নতুন রূপে দেখা যায় ইমরান খানকে। বিরোধী দলের ভূমিকায় নামে তার দল। সরকারের সমালোচনায় সর্বদা মুখর থাকেন তিনি। তাকে নিয়ে সমালোচনার পাহাড় থাকলেও সাধারণ মানুষের কাছে তিনি দিন দিন জনপ্রিয় হতে থাকেন দুইটি কারণে। প্রথমত, দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান এবং দ্বিতীয়ত, সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে আমেরিকার ভূমিকা নিয়ে তিনি সোচ্চার হয়ে ওঠেন। তরুণ সমাজের কাছে ইমরান খানের বিপুল জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে গোটা পাকিস্তানে ছড়িয়ে যায়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জনমত ও বুথ ফেরত সমীক্ষায় পাল্লা ভারী ছিল তেহরিক-ই-ইনসাফের পক্ষে। ঘটলও তাই। অনেক নাটকীয়তার পর ২০১৮ সালের ১৮ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ‘প্লে বয়’ খ্যাত ক্রিকেটার ইমরান খান।
ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব ও তা বাতিল
রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর সময় মস্কো সফর করেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। হামলার জন্য রাশিয়ার নিন্দাও জানায়নি ইসলামাবাদ। এর পর ধীরে ধীরে পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে থাকে।
এছাড়া উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বিপুল বৈদেশিক ঋণের বোঝা, করোনাকালে বেহাল অর্থনীতি এবং পরবর্তী সময়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে ইমরানের গদি টলমল করছিল। কিন্তু কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয় বিরোধীরা ৮ মার্চ জাতীয় পরিষদে ইমরানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব এনে।
৩৪২ সদস্যের (একজন এমপির মৃত্যুতে আদতে ৩৪১ সদস্য) পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে পিটিআইয়ের এমপি ছিল ১৫৫ জন। শরিক মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট পাকিস্তান (এমকিউএমপি), পাকিস্তান মুসলিম লিগ-কাফ (পিএমএল-কিউ), বেলুচিস্তান আওয়ামী পার্টি (বাপ) এবং গ্র্যান্ড ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়ান্সের (জিডিএ) ২০ এমপির সমর্থনে ইমরান খান সরকার গড়েন। সঙ্গে ছিল দুই স্বতন্ত্র, আওয়ামী লীগ মুসলিম এবং জুমুরে ওয়াতান পার্টির চার এমপির সমর্থন। জোটের ১৭৯ আসন থাকায় সংখ্যার অনাস্থা প্রস্তাব পার হতে প্রয়োজনীয় ১৭২ ভোট ইমরানের জন্য কঠিন ছিল না। কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে পরিস্থিতি ইমরানের জন্য কঠিন থেকে কঠিনতর হয়েছে।
বিরোধীদের পক্ষে নিশ্চিত সমর্থন ছিল ১৭৬ এমপির। আর ইমরানের পক্ষে কাগজে কলমে ১৬৪ এমপির সমর্থন থাকলেও আদতে সংখ্যাটি ১৪২। কারণ ইমরান খান দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ করতে যাদের গত নির্বাচনে এমপি পদে মনোনয়ন দিয়েছিলেন, তাদের অন্তত ২২ জন অনাস্থা প্রস্তাবের পর জার্সি বদলে পিটিআই ছেড়ে বিরোধী জোটে ভিড়ে গেছে। পাকিস্তানের সংবিধানের ৬৩ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, তারা অনাস্থা প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ইমরানের বিরুদ্ধে ভোট দিলে ৩০ দিনের মধ্যে এমপি পদ খারিজ হওয়া নিশ্চিত ছিল।
অনাস্থা প্রস্তাব ২৮ মার্চ আলোচনার জন্য উত্থাপিত হয়। পরে ৩ এপ্রিল ইমরান খানের বিরুদ্ধে আনা প্রস্তাব খারিজ করে দেন পার্লামেন্টের ডেপুটি স্পিকার কাসিম খান সুরি।
সংসদ ভেঙে দেন প্রেসিডেন্ট
অনাস্থা প্রস্তাব খারিজ হওয়ার পর পাকিস্তানের বর্তমান জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি। সংসদে স্পিকার অনাস্থা প্রস্তাব খারিজ করে দিলে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে সংসদ ভেঙে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
পাকিস্তানের দ্য ডন এ খবর দিয়েছে। খবরে বলা হয়েছে, ৩ এপ্রিল প্রেসিডেন্টের কার্যালয় থেকে সংসদ ভেঙে দেওয়া সংক্রান্ত একটি বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ ভেঙে দিতে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ প্রেসিডেন্ট ড. আরিফ আলভি সংবিধানের ৫৮ (১) ধারা ও ৪৮ (১) ধারা অনুযায়ী অনুমোদন করেছেন।
পাকিস্তানে পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে বিরোধীরা
পাকিস্তানে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে গেলে দেশটির প্রধান বিচারপতি উমর আতা বন্দিয়াল বলেন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার বিষয়ে যে আদেশ ও কার্যক্রম চালিছেন তার বিষয়ে নির্দশনা দিবে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট।
উল্লেখ্য, পাকিস্তানে শাসক দলের পদক্ষেপগুলোকে সাংবিধানিকভাবে অবৈধ বলে আখ্যায়িত করে তা প্রত্যাখ্যান করেছে দেশটির বিরোধী দলগুলো। এরপর পাকিস্তানের শাসক দলের পদক্ষেপগুলোর বিষয়ে তারা সুপ্রিম কোর্টের শরণাপন্ন হন।
পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের রায়
পাকিস্তানে ভেঙে দেওয়া জাতীয় পরিষদ পুনর্বহালের নির্দেশ দেয় দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। একইসঙ্গে ৯ এপ্রিল সকালে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের নির্দেশ দেয় আদালত। আদালত বলে, ‘প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের সমাপ্তি ছাড়া অধিবেশন মুলতবি করা যাবে না।’ ৭ এপ্রিল রাতে দেশটির শীর্ষ আদালত সরকারের পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত এবং ডেপুটি স্পিকার কাসিম সুরির প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব খারিজ করার সিদ্ধান্ত ‘সংবিধান বিরুদ্ধ’ উল্লেখ করে রায় ঘোষণা করে। রায়ে আদালত বলে, ‘প্রধানমন্ত্রীর অধিকার নেই রাষ্ট্রপতিকে পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়ার।’ ৫ দিনের শুনানি শেষে পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি উমর আতা বন্দিয়ালের নেতৃত্বে বিচারপতি ইজাজুল আহসান, বিচারপতি মাজহার আলম মিয়াঁখেল, বিচারপতি মুনিব আখতার ও বিচারপতি জামাল খান মান্দোখেলের সমন্বয়ে গঠিত ৫ সদস্যের বেঞ্চ এ রায় দেন।
সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন ইমরানের দলের
পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন দাখিল করেছে ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)। রিভিউ পিটিশনে পিটিআই বলেছে, সংসদের ব্যাপারে আদালত হস্তক্ষেপ করতে পারে না। এদিকে পাকিস্তানের আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে আনীত অনাস্থা প্রস্তাবের ভোটাভুটি বিলম্বিত করার লক্ষ্যেই এই রিভিউ পিটিশন করা হয়েছে।
অনাস্থা ভোটে হেরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে বিদায় নেন ইমরান খান
ইমরান খান পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী অনাস্থা ভোটে পরাজিত হয়ে যাকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হলো। বহু নাটকীয়তার পর পাকিস্তানের পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে হেরে প্রধানমন্ত্রীর পদ হারিয়েছেন ইমরান খান। ৯ এপ্রিল সারাদিন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন তিন চার দফা মুলতবি হবার পর পাকিস্তানে মধ্যরাতের পর অনাস্থা ভোট অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় পরিষদের ৩৪২ জন সদস্যের মধ্যে ১৭৪ জন সদস্য তার প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে ভোট দেন। পাকিস্তানের ইতিহাসে এই প্রথম একজন প্রধানমন্ত্রীকে অনাস্থা ভোটে পরাজিত হয়ে ক্ষমতা ছাড়তে হলো। সুপ্রিম কোর্টের আদেশের পর ৯ এপ্রিল সকালে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসে। কিন্তু ভোটাভুটি গড়ায় মধ্যরাতের পর। এর মাধ্যমে পাকিস্তানে সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খানের সরকারের শাসনামল শেষ হয়ে গেল। অক্টোবর ২০২৩ এ পরবর্তী নির্বাচন হবার কথা। তার আগে নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় থাকবেন।
ভোট অনুষ্ঠানের কয়েক মিনিট আগে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের স্পিকার, ইমরান খানের ঘনিষ্ঠ, আসাদ কায়সার পদত্যাগ করেন। ইমরান খানের পার্টির সদস্যরা ভবন ত্যাগ করে যান এবং জোর দিয়ে বলতে থাকেন যে ইমরান খান আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার। ভোটাভুটি পরিচালনা করেন নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লিগ, পিএমএল-এন-এর আইয়ায সাদিক। বিরোধী নেতা শাহবাজ শরিফ এক টুইট বার্তায় বলেন পাকিস্তান এবং পাকিস্তানের সংসদ ‘অবশেষে গভীর সঙ্কট থেকে মুক্তি পেল।’
পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ
পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) সভাপতি শাহবাজ শরিফ। ১১ এপ্রিল সোমবার বিকেলে পাকিস্তানের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ জাতীয় পরিষদে তার পক্ষে ১৭৪টি ভোট পড়ে। এক দিন আগে অনাস্থা ভোটে প্রধানমন্ত্রীর পদ হারানো ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) নেতারা এ সময় অধিবেশন বর্জন করেন।
পার্লামেন্টে এই ভোটাভুটিতে শাহবাজ শরিফের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন পিটিআইয়ের সহসভাপতি ও সদ্য বিদায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশি। তার নেতৃত্বে পিটিআইয়ের আইনপ্রণেতারা অধিবেশন বর্জন করায় শাহবাজের আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না। পরে ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য যেখানে ১৭২ জন সদস্যের সমর্থন লাগে, সেখানে ১৭৪ জনের রায় পেয়েছেন শাহবাজ শরিফ।
এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের ২৩তম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ছোট ভাই শাহবাজ। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সম্প্রতি আলোচিত হলেও দেশের ভেতরে প্রশাসনিক দক্ষতার জন্য আগে থেকেই শাহবাজ শরিফের সুনাম ছিল।
৭০ বছর বয়সী শাহবাজের জন্ম লাহোরে। ধনী ব্যবসায়ী পরিবারের এই সন্তানের পড়াশোনা পাকিস্তানেই। পড়াশোনা শেষে পারিবারিক ব্যবসায় যোগ দেন তিনি। বর্তমানে পাকিস্তানের একটি ইস্পাত কারখানায় যৌথ মালিকানা রয়েছে তার।
শাহবাজের রাজনৈতিক জীবন শুরু ১৯৯৭ সালে, পাঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। ১৯৯৯ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে কারারুদ্ধ হন তিনি। পরের বছরেই সৌদি আরবে নির্বাসনে পাঠানো হয় তাঁকে।
দীর্ঘদিন নির্বাসনে থাকার পর ২০০৭ সালে নিজ দেশে ফিরে আসেন শাহবাজ। আবার পা রাখেন রাজনীতিতে। ২০০৮ সালে নির্বাচনে জিতে আবার পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি। তৃতীয় মেয়াদে শাহবাজ প্রদেশটির মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন ২০১৩ সালে।
শাহবাজ জাতীয় রাজনীতিতে পা রাখেন তার ভাই নওয়াজ শরিফ দুর্নীতির মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে পাকিস্তান ত্যাগের পর। এরপর তিনি পাকিস্তান মুসলিম লিগের (নওয়াজ) সভাপতির দায়িত্ব পান।
বিদেশী ষড়যন্ত্র ও এর প্রভাব
ইমরান খান তার দল থেকে একাধিক এমপির পদত্যাগের পর তার সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর মুখে পড়লে বারবার দাবি করেন যে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পদক্ষেপের পেছনে একটি ‘বিদেশী-সমর্থিত ষড়যন্ত্র’ ছিল। মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার বিদেশী অর্থ লোকদের কেনার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।
বলা হচ্ছে, ইমরান খান পদত্যাগ ও অনাস্থার মুখোমুখি হওয়া আর নতুন নির্বাচন দেওয়া- এই তিন বিকল্পের মধ্যে শেষটি বেছে নিয়েছেন। কিছুদিন আগ পর্যন্ত বিরোধী দলগুলো পাকিস্তানে নতুন নির্বাচন দাবি করে আসছিল। সে বিষয়ে ইমরান একমত হওয়ার পরও বিরোধী জোট আর তাতে সম্মত না হয়ে সরকার গঠনের স্বপ্ন দেখে। কিন্তু সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর এখন সবকিছু উলটপালট হয়ে যায়।
পাশ্চাত্যের সাথে রাশিয়ার বর্তমানে যে সঙ্ঘাত সৃষ্টি হয়েছে তা ইউক্রেনের যুদ্ধ শেষ হলেও আরো অনেক দূর যেতে পারে। চীন ও রাশিয়া বিকল্প অর্থনৈতিক ও বিশ্বব্যবস্থার দিকে এগোতে চাইছে। এ ক্ষেত্রে ভারত পশ্চিমা বলয়ের সাথে না থাকলে পাকিস্তানকে কাছাকাছি রাখার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা বিশেষভাবে সক্রিয় হতে পারে।
পাকিস্তানে তৃতীয়বার অনাস্থা ভোট
পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে এর আগে আরো দুইবার দায়িত্বরত প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটের প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়েছে। তবে সেই দুইবারই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীরা-১৯৮৯ সালে বেনজির ভুট্টো এবং ২০০৬ সালে শওকত আজিজ-দায়িত্বে থেকে যেতে সক্ষম হন।
ইমরান খানকে সঙ্কটে ফেলে দেওয়া নেপথ্যের খেলোয়াড় যারা
২০১৮ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন ইমরান খান। নিজের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) ওপর ভর করে তিনি ক্ষমতায় আসতে পারেননি। কয়েকটি দলের সঙ্গে জোট বেঁধে তাকে প্রধানমন্ত্রী হতে হয়েছে। ইমরানের সেই জোটে যে ফাঁক ছিল, তাই প্রকাশ পেয়েছে গত কয়েক সপ্তাহে।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ইমরান খানের পিটিআই দলের ‘দুর্বল জোট’ কয়েক সপ্তাহের ‘ষড়যন্ত্র’ পুঁজি করেছে। ইমরান খানকে সঙ্কটে ফেলে দেওয়া সেই নেপথ্যের খেলোয়াড়দের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হলো:
শাহবাজ শরিফ
তিনি পাকিস্তানের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ভাই। ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব সফল হলে তাকেই প্রধানমন্ত্রী করার কথা ভেবেছিল বিরোধী নেতারা। ৭০ বছর বয়সী এই হেভিওয়েট রাজনীতিবিদ এখন পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন)-এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
কঠোর প্রশাসক হিসেবে তার খ্যাতি রয়েছে। বক্তব্য দিতে গিয়ে বিভিন্ন সময় তিনি বিপ্লবী কবিতার উদ্ধৃতি করে থাকেন। একাধিক বিয়ে, লন্ডন ও দুবাইয়ে তার বিলাসবহুল একাধিক অ্যাপার্টমেন্ট নিয়ে ট্যাবলয়েডে শিরোনাম হয়েছিলেন। কিন্তু এরপরও দেশটিতে তার জনপ্রিয়তা রয়েছে।
আসিফ আলি জারদারি
পাকিস্তানের ধনী সিন্ধু পরিবার থেকে উঠে আসা এই রাজনীতিবিদ বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্য বেশি পরিচিত ছিলেন। বেনজির ভুট্টো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কিছু দিন আগে তিনি তাকে বিয়ে করেছিলেন।
উৎসাহের সঙ্গে রাজনীতিতে এলেও দুর্নীতি, মাদক চোরাচালান ও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তাকে দু’বার কারাগারে যেতে হয়েছিল। তবে কখনো তিনি বিচারের মুখোমুখি হননি।
২০০৭ সালে বেনজির ভুট্টো হত্যাকাণ্ডের পর ৬৭ বছর বয়সী আসিফ আলি জারদারি পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) সহসভাপতি হন। এক বছর পর পিএমএল-এন-এর সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি চুক্তিতে দেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন।
বিলাওয়াল ভুট্টো-জারদারি
তিনি বেনজির ভুট্টো ও আসিফ আলি জারদারির ছেলে। মায়ের হত্যাকাণ্ডের পর মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি পিপিপির চেয়ারম্যান হন। অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করা ৩৩ বছর বয়সী এই তরুণকে তার মায়ের ইমেজে প্রগতিশীল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাকে প্রায়ই নারী ও সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে দেখা যায়।
এখন পাকিস্তানের জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি ২২ বছর বা তার কম বয়সী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শিক্ষিত তরুণদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় তিনি। তবে অনেকেই তাকে উপহাস করে মন্তব্য করেন।
মাওলানা ফজলুর রহমান
তিনি দেশটিতে একজন কট্টরপন্থী নেতা হিসেবে বেশ পরিচিত। রাজনৈতিক জীবন শুরু করার পর অনেক চেষ্টা চালিয়ে জনসাধারণের কাছে যেতে পেরেছেন। একই সঙ্গে বাম ও ডানে ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোর সঙ্গে তাকে জোট গঠন করতে দেখেছে দেশটির জনগণ।
তিনি হাজার হাজার মাদরাসা শিক্ষার্থীকে একত্রিত করতে পেরেছেন। সেই ক্ষমতা নিয়েও তার জেইউআই-এফ পার্টি কখনই ক্ষমতায় যেতে পারবে না। তবে তিনি যেকোনো সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়।
ইমরান খানের সঙ্গে তার শত্রুতা বেশ পুরনো। ব্রিটিশ উপস্থাপক জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করার কারণে ইমরানকে তিনি ‘ইহুদি’ হিসেবে আখ্যা দেন। এর জবাবে জ্বালানি লাইসেন্স দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে তাকে ‘মোল্লা ডিজেল’ উপাধি দেন ইমরান খান।
ইমরান খানের ভবিষ্যৎ
ক্রিকেট কিংবদন্তি ইমরান খান তার দলের খেলোয়াড়দের একবার বলেছিলেন কোণঠাসা হয়ে পড়া বাঘের মতো লড়াই করতে। প্রায় আড়াই দশকের আন্দোলন সংগ্রামের পর পাকিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণের সাড়ে তিন বছরের মাথায় রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হলেন।
নানা নাটকীয়তার পর তার বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রিত্ব হারানো ইমরান খান কি এখন সেই কোণঠাসা বাঘের মতো লড়াই করতে পারবেন? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, প্রধানমন্ত্রীর পদ হারালেও এখনই ইমরান খানের রাজনৈতিক মৃত্যু ঘটছে না। ক্রিকেট ম্যাচে তিনি যেমন শেষ বল পর্যন্ত জেতার জন্য খেলেছেন, ঠিক তেমনি রাজনীতিতেও তার লড়াই অব্যাহত থাকবে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, ইমরান খানের একটা জনপ্রিয়তা এখনও আছে। অনাস্থা ভোটেও আমরা দেখছি, মাত্র ২-৩ ভোটে তিনি হেরেছেন। স্বাভাবিকভাবেই ভোটের রাজনীতিতে তিনি আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসতে চাইবেন। অন্যদিকে তার বিরোধীরা চাইবে, নির্বাচন কিভাবে দীর্ঘায়িত করা যায়। বলে রাখা দরকার, বিরোধীদের রাজনৈতিকভাবে আদর্শ এক নয়। নীতিগত অনেক প্রশ্নে তাদের মধ্যে ঐতিহাসিক মতবিরোধ আছে। ওলামাদের সঙ্গেও তাদের পার্থক্য অনেক। এমতাবস্থায় পাকিস্তানে নতুন বিরোধী জোটের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত হবে কিনা- সে শঙ্কা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে ইমরান খান আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরতে পারেন ভবিষ্যতে। কিন্তু মনে রাখতে হবে- তিনি জনসাধারণের কাছে নিজের সমর্থন কতটা বাড়াতে পারেন; একই সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সঙ্গেও কতটা সদ্ভাব বজায় রেখে এগোতে পারেন, তার ওপরেই তার ভবিষ্যৎ নিহিত।
ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের (সোয়াস) দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক গবেষক ও পাকিস্তান বিশ্লেষক আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, পাকিস্তানের সমাজে, এমনকি সামরিক বাহিনীতেও তার অনেক সমর্থক রয়েছে। তিনি বলেন, ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে তিনি দক্ষতার সঙ্গে মার্কিন ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলেছেন। ষড়যন্ত্রের এই গল্প পাকিস্তানে অত্যন্ত জনপ্রিয়। পাকিস্তানের মানুষ এ ধরনের ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব বিশ্বাস করতে পছন্দ করে। সবকিছুর পেছনেই আমেরিকার হাত আছে-এ রকম ধারণার ওপরেই গড়ে উঠেছে এই দেশের সমাজ। তারা মনে করে আমেরিকার হস্তক্ষেপ ছাড়া পাকিস্তানে কিছুই হয় না। ফলে ইমরান খানের এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব তার ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য শক্তিশালী ভূমিকা পালন করবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক নাসিম জেরা মনে করেন, রাজনীতিতে এখন ইমরান খানের আরেকটি অধ্যায় শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, ইমরান খান আগেও প্রমাণ করেছেন তিনি একজন যোদ্ধা। তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের প্রতিও তার অঙ্গীকার রয়েছে। এখন তিনি আবার সেই লড়াই করার অবস্থায় ফিরে যাচ্ছেন।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হতে তার ২০ বছরের বেশি সময় লেগেছে। তিনি জানেন কিভাবে কঠিন সময় মোকাবেলা করতে হয়। এখন দেখা যাক এখান থেকে তিনি কোথায় গিয়ে পৌঁছান।
তবে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে নির্বাচনে জয়লাভ করে তিনি পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারবেন কিনা তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন।
ইসলামাবাদে রাজনৈতিক বিশ্লেষক নাসিম জেহরা বলেন, পাকিস্তানে কারো ক্ষমতায় আসার পেছনে অনেক ফ্যাক্টর কাজ করে। রাজনৈতিক সংগ্রাম, প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো কেমন, সার্বিক পরিস্থিতি কেমন ইত্যাদি। এসব কারণে তার ক্ষমতায় ফিরে আসার সম্ভাবনা আমি উড়িয়ে দিতে চাই না।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইমরান খানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে আগামী অন্তর্র্বর্তী সরকারের পারফরম্যান্সের ওপরে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
আপনার মন্তব্য লিখুন