post

পিতা, নেতা ও দা’ঈ ইলাল্লাহ হিসেবে আল্লামা সাঈদী রহ. যেমন ছিলেন

মাসুদ সাঈদী

০৭ জুলাই ২০২৩

১৪ আগস্ট ২০২৩। সোমবার। মুসলিম উম্মাহর শোকাবহ ডায়েরিতে বা শোকের দিনলিপিতে আরো একটি কালো দিন যুক্ত হলো। দীর্ঘ ১৩ বছর ১ মাস ১৬ দিন আওয়ামী জালিম সরকারের রাজনৈতিক রোষানলের শিকার হয়ে কারান্তরীণ থাকা অবস্থায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় রহস্যজনক অসুস্থতা ও সন্দেহজনক চিকিৎসায় ইন্তেকাল করেন মুসলিম উম্মাহর প্রিয় রাহবার, গোটা মুসলিম জাহানে সুপরিচিত আল্লাহর দ্বীনের একনিষ্ঠ দা’ঈ, বিশ্বনন্দিত মুফাসসিরে কুরআন, ইসলামী আন্দোলনের বীর সিপাহসালার, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সম্মানিত নায়েবে আমীর, জননন্দিত মাজলুম জননেতা, আমার পরম শ্রদ্ধেয় পিতা, কুরআনের পাখি আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী রাহিমাহুল্লাহ। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

প্রিয় নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা.-কে হারানোর দিনের চেয়ে বড় ব্যথা আর কষ্টের দিন মুসলিম উম্মাহর শোকাবহ ডায়েরিতে আর নেই। যারা নবীজির আদর্শ এবং জীবনব্যবস্থাকে বুকে ধারণ করে জীবন পরিচালনা করেছেন, যারা নিজেদের জীবনকে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের রঙ্গে রঙিন করে নিয়েছেন, তাদেরকে হাদিসের ভাষায় ওলামা বলা হয়েছে। নবীজির সা. ভাষ্যমতে এই ওলামারাই নবীদের প্রকৃত ওয়ারিশ। নবীজির ইন্তেকালের পর বিভিন্ন সময়ে একে একে নবীর এই ওয়ারিশদের ইন্তেকাল মুসলিম উম্মাহর জন্য ভীষণ বেদনার, কষ্টের এবং শোকের। দিন যায়, বছর যায়, যুগ পার হয়- এক এক করে দুনিয়ার সংক্ষিপ্ত সফর শেষ করে নবীর ওয়ারিশ ওলামারাও চলে যান মহান প্রভুর সান্নিধ্যে। আর মুসলিম উম্মাহর শোকাবহ ডায়েরিতে এক এক করে বাড়তে থাকে শোকের দিনলিপি।

১৪ আগস্ট ২০২৩, মুসলিম উম্মাহর জন্য সে রকমই একটি দিন। আমার পরম শ্রদ্ধেয় পিতাকে হারানোর দিন। আমার পরম শ্রদ্ধেয় নেতাকে হারানোর দিন। আল্লাহ তাআলার পথের একনিষ্ঠ একজন দাঈকে হারানোর দিন। নবীজির ওয়ারিশ মজলুম আলেমে দ্বীন আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে হারানোর দিন। একজন আলেমের মৃত্যুকে নবীজি সা. গোটা জাহানের মৃত্যুর সাথে তুলনা করেছেন। নবীজি বলেছেন, ‘একজন আলেমের মৃত্যু মানে গোটা জাহানের মৃত্যু।’ (সুনানে বায়হাকি: ৩য় খণ্ড, হাদিস নং-১৫৭)। আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মতো একজন আলেমকে হারিয়ে গোটা মুসলিম জাতি তাই আজ ব্যথিত! শোকে স্তব্ধ! আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে এই শোক সইবার শক্তি দান করুন।

শহীদ আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী (রাহিমাহুল্লাহ), যাকে নিয়ে আজ দু’কলম লিখতে বসেছি, যার জীবনের কিছু দিক আজ তুলে ধরতে বসেছি- তিনি একাধারে আমার পিতা, তিনি আমার নেতা, তিনি একজন বিশ্বনন্দিত দাঈ ইলাল্লাহ। একজন পিতা, একজন নেতা এবং দাঈ ইলাল্লাহ হিসেবে আল্লামা সাঈদী কেমন ছিলেন, তাঁকে এই ক্যাটাগরিগুলোতে আমি কেমন দেখেছি, কেমন পেয়েছি, সেই বর্ণনা দেওয়ার মতো উপযুক্ত ভাষা, লেখার যোগ্যতা কোনোটাই যে আমার নেই! কত হাজার শব্দ লেখার পর এই ক্যাটাগরিগুলোতে তাঁকে যথাযথভাবে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হবে- তার অনুমানও আমি করতে পারছি না। এরপরও সাহস সঞ্চয় করে আজ বসেছি আমার পরম শ্রদ্ধেয় শহীদ পিতাকে নিয়ে দু’কলম লিখতে।

শহীদ আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী আমার পরম শ্রদ্ধেয় পিতা। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর মাধ্যমেই আমাদের চার ভাই- মাওলানা রাফিক বিন সাঈদী, শামীম বিন সাঈদী ও আমি এবং নাসীম বিন সাঈদীকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। একজন উঁচু মানের, উন্নত চরিত্রের ব্যক্তিকে বাবা হিসেবে পেয়ে আমরা যে কতটা তৃপ্ত, তা শুধু মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনই ভালো জানেন। তিনি আজ শহীদ। একজন শহীদ পিতার সন্তান আমরা। এটাও আমাদের জন্য চরম সৌভাগ্যের এবং পরম তৃপ্তির একটা বিষয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন একজন মানুষকে দুনিয়াতে এতটা মর্যাদার অধিকারী কী করে বানান, কেন একজন মানুষকে আল্লাহ দয়া করে জগৎজোড়া এতটা খ্যাতি দান করেন, কীসে একজন মানুষকে আল্লাহ তাআলা এতটা উঁচুতে অবস্থান দান করেন, কোন কোন গুণাবলি একজন মানুষকে মানুষের এতটা ভালোবাসার পাত্র বানিয়ে দিতে পারেন- তা আমার পরম শ্রদ্ধেয় পিতাকে খুব কাছ থেকে দেখে দেখে কিছুটা হলেও বুঝতে সক্ষম হয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ।

আল্লাহ তাআলা মানুষকে সম্মান ও ইজ্জত দান করেন। তেমনি মানুষের জীবনে জিল্লতিও তিনিই দান করেন। এগুলো সবই মানুষের নিজের হাত দ্বারা অর্জিত, কর্মের ফল। কাউকে যদি তিনি সম্মানিত করেন অবশ্যই এই সম্মান তার কর্মের দ্বারা আল্লাহর কাছ থেকে প্রাপ্ত হন। কাউকে যদি তিনি অসম্মানিত করেন, এটিও তার কর্ম দ্বারা অর্জিত। হাদিস এসেছে, ‘আল্লাহ যদি কাউকে ভালোবাসেন তাহলে দুনিয়াবাসীর অন্তরে ওই বান্দার জন্য আল্লাহ ভালোবাসা তৈরি করে দেন। ফলে পুরো ফেরেশতাকুল এবং দুনিয়াবাসী তাকে ভালোবাসতে শুরু করে।’ (মুসনাদে আহমদ: ৮৫০০)। আজ আল্লামা সাঈদীর জন্য পুরো দুনিয়া জুড়ে যে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে সেটা নবীজির এই হাদিসেরই সচিত্র উদাহরণ।

আব্বা সাধারণত দেশ এবং বিদেশ সফর মিলিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। শুধু আব্বার ব্যস্ততার বর্ণনা দেওয়ার জন্যই আরো বিশাল মাপের একটি লেখা তৈরি হতে পারে। খুব সংক্ষিপ্ত আকারে এই বর্ণনা দেওয়া সম্ভব না। কিন্তু আব্বা যতই ব্যস্ত কিংবা পেরেশান থাকতেন না কেন- যখনই নামাজের সময় হতো, মনে হতো আব্বার মতো এত ফ্রি এবং অবসর মানুষ দুনিয়ার বুকে আর দ্বিতীয়জন নেই। তখন মনে হতো নামাজ ছাড়া আর কোনো কাজই দুনিয়াতে তাঁর নেই। নামাজের প্রস্তুতি, মসজিদে যাওয়া, স্থিরচিত্তে দীর্ঘ সময় ধরে নামাজ আদায় করা; এসব দেখে বুঝাই যেত না যে তিনি কিছুক্ষণ আগেই ব্যস্ততার সমুদ্রের গভীর থেকে ওঠে এসেছেন। নামাজ আদায় শেষেই আবার সেই গভীরে ডুবে যাবেন। এর মধ্যে কোনো তাড়াহুড়ো নেই। দ্রুত নামাজ শেষ করার কোনো তাড়া নেই। মনে হতো নামাজের সময় হয়েছে মানেই দুনিয়ার সকল কাজ থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেছেন।

প্রসঙ্গক্রমে একটি কথা মনে পড়ে গেল। ১৯৯৬ সালে পিরোজপুর-১ আসনে আব্বার প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়কার কথা। ফজরের নামাজের পর থেকে শুরু করে সারাটা দিন নির্বাচনী এলাকার এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত অক্লান্ত পরিশ্রম করে ঘর্মাক্ত শরীর ও ক্লান্ত দেহ নিয়ে আব্বা যখন রুমে ফিরতেন- তখন আব্বার সফরসঙ্গীরা গোসল শেষে নামাজ পড়ে তাদের ক্লান্ত দেহ নিয়ে লুটিয়ে পড়তেন নরম বিছানায়, আর আমার আব্বা আল্লামা সাঈদী তখন তাঁর ক্লান্ত দেহ নিয়ে লুটিয়ে পড়তেন জায়নামাজে। এভাবেপ্রতিটি রাতেই মহান প্রভুর কুদরতি পায়ে সিজদায় লুটিয়ে পড়তেন তিনি। ফজরের নামাজের আগে তিনি কিছুটা সময় ঘুমাতেন। ফজরের ওয়াক্তে তিনিই আবার সবার আগে উঠতেন, অন্যদেরকেও তিনিই ঘুম থেকে উঠাতেন। এভাবেই চলেছে নির্বাচনের পুরোটা সময়। নির্বাচনের দিন ভোট গ্রহণ শেষে ভোট গণনা চলছিল। গণনা শেষ হওয়ার পরেও ভোটের ফলাফল ঘোষণা করতে স্থানীয় প্রশাসন গড়িমসি করছিল। ভোটের ফলাফল কী হয়, কী হয়- সবাই তখন এক অজানা ভয়, আশঙ্কা ও পেরেশানিতে অস্থির! জেলা প্রশাসকের অফিসের ভেতরে ও বাইরে তখন নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সকল প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের সরব উপস্থিতি। চলছিল মুহুর্মুহু স্লোগান। সে রকম চরম একটি মুহূর্তেও সেখানে উপস্থিত ছিলেন না একজন- তিনি আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। সবার কৌতূহলী দৃষ্টি তখন আব্বাকে খুঁজছিল। কোথায় তিনি! কোথায় তিনি! ঠিক সেই মুহূর্তে পিরোজপুর সদর থানার ওসি এসে সবাইকে জানালেন, ‘সাঈদী স্যার এশার নামাজের পর থেকেই সদর থানা মসজিদে আছেন। তাঁর সাথে কয়েকজন লোক আছে। সেখানে তিনি নামাজ আদায় করছেন।’ উপস্থিত সকলের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। এমন পেরেশানির মুহূর্তেও নামাজে মানুষের মনোযোগ আসে কীভাবে?

রাত ১১-১২টার দিকে ভোটের ফল ঘোষণা করা হলো। ডিসি সাহেব যখন ঘোষণা করলেন, সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পিরোজপুর-১ আসন থেকে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন- দাঁড়িপাল্লা প্রতীক নিয়ে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, ঠিক তখনও আমার পরম শ্রদ্ধেয় পিতা আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। তখন মোবাইল ফোনের প্রচলনও ছিল না। তাই তাঁকে নির্বাচনের রেজাল্ট জানানোর জন্য সবাই ছুটে চললো সদর থানার ওসির দেওয়া তথ্য মতে সদর থানা মসজিদের দিকে। সেখানে গিয়ে আব্বাকে পাওয়া গেল না। মসজিদে খোঁজ নিয়ে জানা গেল তিনি কিছুক্ষণ আগে তাঁর মায়ের কাছে (আমার দাদি) গেছেন। এই খবর পেয়ে হাজারো জনতা ছুটলো আবার আমার দাদির বাড়ির দিকে। সেখানে গিয়ে সবাই জানতে পারলেন- আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী তাঁর সম্মানিতা মায়ের পায়ের কাছে (আমি নিজে দেখেছি, আব্বা সারাজীবন তাঁর মায়ের কাছে গেলে তাঁর পায়ের কাছেই বসতেন) বসে গল্প করছেন। উপস্থিত জনতা ‘লিল্লাহি তাকবির-আল্লাহু আকবর’ বলে চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। জনতা ভেবেই ব্যাকুল- এমন চরম একটি পেরেশানির মুহূর্তে একজন মানুষ কীভাবে এত শান্ত, এত ধীরস্থির থাকতে পারেন?

আব্বাকে নির্বাচনের রেজাল্ট জানানো হলো। আব্বা তখনো তাঁর মায়ের পায়ের কাছেই বসা ছিলেন। আব্বা বিছানা থেকে ওঠে হাঁটু গেড়ে বসে তাঁর মায়ের দু’পায়ে দুটি চুমু দিলেন। এরপর দীর্ঘ সময় নিয়ে দু’রাকাত নফল নামাজ পড়লেন। নামাজ শেষে তিনি জনতার সামনে এলেন। সকলকে সালাম ও কৃতজ্ঞতা জানালেন। উপস্থিত সবাইকে নিয়ে গভীর রজনীতে আকাশের দিকে দু’হাত তুলে চোখের পানি ফেলে মহান রবের শুকরিয়া আদায় করলেন। আব্বা চিৎকার করে ফরিয়াদ করতে লাগলেন- ‘হে আমার রব! যে দায়িত্ব, যে আমানত তুমি আমার উপর অর্পণ করেছো তা পালন করার তাওফিক আমাকে দাও। জনগণের হক আদায়ের তাওফিক আমাকে দাও। আমার যোগ্যতা তুমি বাড়িয়ে দাও।’ 

এর বেশ কিছুদিন পর একদিন আব্বার কাছে আমি জানতে চাইলাম, ‘আব্বা! নির্বাচনের দিন রেজাল্ট জানার জন্য সবাই যখন অস্থির-পেরেশান, ঠিক তখন আপনি রেজাল্ট ঘোষণার জায়গায় ছিলেন না- আবার রেজাল্ট ঘোষণার সময়ও আপনি উপস্থিত ছিলেন না। আপনি বাড়ি এসে দাদির পায়ের কাছে বসে ছিলেন! আপনি এত শান্ত, এত ধীরস্থির কীভাবে ছিলেন? আমার আব্বা আমাকে বললেন- ‘হে আমার কলিজার টুকরো! নামাজে ধীরস্থির হও, সময় দাও- আল্লাহ আজ্জাওয়াজাল জীবনটাকে স্থির করে দিবেন।’ আল্লাহু আকবার। এই অল্প অথচ পাহাড়ের সমান ওজনদার এক কথায় আমি আমার সকল প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম।

সাধারণত আব্বা যখন দেশে থাকতেন তখন আমাদের ভাইদেরকে নিয়ে আব্বা একসাথে মসজিদে যেতেন। ফজরের আযান হওয়ার আগেই আমরা যে যে ফ্লোরে থাকি সেসব ফ্লোরে আব্বা এসে আমাদের সকল ভাইকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতেন। খুব কম সময়ই আমরা আব্বাকে ডেকে তোলার সুযোগ পেয়েছি। যদিও আমরা আব্বার সাথে মসজিদে যাওয়ার জন্য তাঁর ডাকের অপেক্ষায় থাকতাম। আব্বা যখন আমাদের নিয়ে মসজিদের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় নামতেন, আব্বাকে দেখামাত্রই রাস্তায় চলাচল করা মানুষগুলো আব্বার সম্মানে যার যার জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়তেন। তারা চেষ্টা করতেন আব্বা তাদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তারা আব্বাকে আগে সালাম দেবে। কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই তারা সফল হতেন না। দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর পাশে আসার আগেই একটু দূর থেকে আব্বা নিজেই আগে সালাম দিয়ে দিতেন। আব্বা পাশ অতিক্রম করে যাওয়া পর্যন্ত মানুষগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতো আব্বার সম্মানে। মসজিদে ঢুকেই আব্বা যেখানে জায়গা পেতেন সেখানেই বসে পড়তেন, কখনোই মুসল্লিদের ডিঙিয়ে সামনে যাওয়ার চেষ্টা করতেন না।

আব্বা দেশে থাকাকালীন আব্বার দিনলিপি কখনোই আমরা রুটিনের বাহিরে যেতে দেখিনি। তিনি যত ক্লান্তই থাকতেন না কেন, দিনে যত পরিশ্রমই করতেন না কেন- গভীর রাতে ওঠে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে যাওয়া আব্বার মিস হতো না। সাধারণত আব্বা রাত ১১টা থেকে ১১.৩০টার মধ্যে ঘুমিয়ে যেতেন। রাতের খাবার তিনি আমাদেরকে নিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করতেন, কিন্তু মাঝে মধ্যেই আমাদের বাসায় ফিরতে রাত হতো বলে অনেক সময়ই আমরা আব্বার সাথে বসে একসাথে খেতে পারতাম না। পরিমিত সুন্নতি আহারে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। রাত ১০টার মধ্যে রাতের খাবার শেষ করে ছাদে উঠে কিছু সময় হাঁটাহাঁটি করতেন। আমিও আব্বার পাশাপাশি হাঁটতাম। হাঁটতে হাঁটতে আব্বা আমাকে কুরআন-হাদিস থেকে বিভিন্ন উপদেশমূলক নসিহা করতেন। নবীদের জীবনী থেকে বিভিন্ন শিক্ষণীয় ঘটনাবলি শোনাতেন। আমি শুনতাম আর বিভিন্ন প্রশ্ন করে আব্বার কাছে আরো কিছু জানতে চাইতাম। আব্বার চেহারায় কখনো বিরক্তির ভাব আমি দেখতাম না। হাঁটা শেষ হলে আব্বা নিচে নেমে ফ্রেশ হয়ে সোজা তাঁর বিছানায় চলে যেতেন।

বেশিরভাগ সময়ই আব্বা কখনো রাত ৩/৩:৩০ টার বেশি ঘুমাতেন না। কখনো কখনো আরো আগেই ওঠে যেতেন। ফজরের পর আব্বা গায়ে মেশকে আম্বর মাখতেন। রাসূল সা. সুগন্ধি পছন্দ করতেন। আব্বা নবীজির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সুন্নতের পাশাপাশি এই সুন্নতটাকেও মনপ্রাণ দিয়ে আঁকড়ে ধরেছিলেন। সুগন্ধির প্রতি আব্বার এক ধরনের মোহ ছিল। আব্বা কোনো জিনিস ধরলে বা যে কোনো জিনিস তিনি ব্যবহার করে রেখে দিলে আমরা সহজেই বুঝতে পারতাম যে, হয় এটা আব্বা ধরেছেন অথবা ব্যবহার করেছেন। আব্বা সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাইরে গেলেও আমরা টের পেতাম, কেননা পুরা সিঁড়ি তখন সুগন্ধিতে ভরে যেত। আপনারা এটা জেনে কী ভাববেন জানি না, এমনও হতো- আব্বা যখন আমাদেরকে কোনো পারপাসে টাকা দিতেন, আব্বার দেওয়া সেই টাকাতেও আমরা আব্বার ব্যবহার করা আতরের গন্ধ পেতাম।

সৌদি সরকার কাবার গিলাফে ব্যবহার করা সুগন্ধিগুলো মাঝে মাঝে আব্বার জন্য হাদিয়া হিসেবে পাঠাতেন। আব্বা গভীর রাতে উঠে গায়ে সুগন্ধি মেখে চলে যেতেন ৫ তলায় অবস্থিত আব্বার স্টাডি রুমে। আব্বার জীবনের এমন কিছু ঘটনা আছে যেগুলো আমরা পরিবারের সদস্যরা ব্যতীত আর কেউই জানে না। আজকের এই লেখাতেও আমি এ বিষয়ে কিছু লিখবো না। আলিমগণ বলে থাকেন,‘আওলিয়াদের কারামত সত্য।’ আমরা বুঝতাম না আব্বার কাছ থেকে মাঝে মাঝে সেরকম কোনো বিষয় প্রকাশ হতো কিনা। গভীর রাতে আব্বা স্টাডি রুমে ঢুকে মহান রবের সাথে এক গভীর মোলাকাতে মগ্ন হয়ে যেতেন। আব্বা সালাতুত তাহাজ্জুদসহ বাকি সময় চোখের পানিতে সিজদায় কাটাতেন। কিছু সময় কিতাব অধ্যয়ন করতেন। ব্যক্তিগত কালেকশনে আব্বার লাইব্রেরিতে কুরআন-হাদিসের দুর্লভ সব তাফসির গ্রন্থের পাশাপাশি বিজ্ঞান, রাজনীতি, আইন, ইতিহাস,ধর্মতত্ত্ব, ভূমণ্ডল, নারী অধিকার, শ্রমিক অধিকারসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর দুর্লভ সব বইয়ের কালেকশন আছে। তিনি মাঝে মধ্যে গভীর রজনীতে কিতাবের গভীর সমুদ্রে ডুব দিতেন। স্টাডি করতেন। নোট করতেন।

আব্বা তাঁর সন্তানদের দ্বীনের ব্যাপারে কঠোর ছিলেন। কিন্তু আব্বার মতো সন্তানদের প্রতি এত স্নেহশীল পিতা আমরা কম দেখেছি। আব্বা শরিয়তের ব্যাপারে আমাদের প্রতি যেমন কঠোর ছিলেন, তেমনি সন্তান এবং পরিবারের চাহিদা পূরণে আব্বার মতো যত্নশীল এবং স্নেহশীলও আমরা কম দেখেছি। সন্তানদের প্রতি দ্বীনি উপদেশে আব্বাকে লোকমান আ. এর প্রতিচ্ছবি মনে হতো। তিনি সবসময় আমাদেরকে নবীজির একটি হাদিস স্মরণ করিয়ে দিতেন যে, ‘মানুষ মারা যাওয়ার পর তার সকল আমলের দরজা বন্ধ হয়ে যায় শুধুমাত্র তিনটি ছাড়া। তার মধ্যে এক নাম্বারেই হলো নেক সন্তান।’ (মুসলিম: ১৬৩১)। আব্বা সব সময় বলতেন, ‘তোমরা আমার কবরে আমলে জারির উৎস। তোমাদেরকে নেক সন্তান হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে এটার ফল আমি কবরে শুয়ে শুয়ে পাব। তোমরা আমার জন্য নেক সন্তান হও, আল্লাহ তাআলা তোমাদের সন্তানদেরকে তোমাদের জন্য নেক সন্তান বানিয়ে দেবেন।’ আব্বা এই কথাগুলো বলতে গিয়ে হঠাৎ ডুঁকরে কেঁদে উঠতেন আর বলতেন, ‘আমি কি আমার আব্বা আম্মার জন্য নেক সন্তান হতে পেরেছি? আল্লাহ তাআলা কি আমাকে আমার আব্বা আম্মার নেক সন্তান হিসেবে কবুল করেছেন?’ এ কথা বলে সাথে সাথে আব্বা আকাশের দিকে হাত উঁচিয়ে দুআ করতে থাকতেন- ‘আয় আল্লাহ! আমাকে আমার আব্বা আম্মার জন্য এবং আমার সন্তানদেরকে আমার জন্য তোমার প্রিয় হাবিবের ঘোষণা অনুযায়ী সৎ এবং নেক সন্তান হিসেবে কবুল করে নাও।’ আমরা আব্বার কান্নাজড়িত কণ্ঠের আকুতির সাথে আমিন আমিন বলে চোখের পানিতে বুক ভাসাতাম।

আব্বা তাঁর সন্তানদের হকের ব্যাপারেও অত্যধিক যত্নশীল ছিলেন। একজন বাবা হিসেবে সন্তানদের প্রতি শরিয়ত নির্দেশিত হক, দুনিয়াবি চাহিদা পূরণ, উত্তম আখলাক ও নেক সন্তান হিসেবে গড়ে তোলা, সন্তানদের অসুস্থতায় ব্যাকুলতা ও পেরেশানি ইত্যাদির বিষয়ে আব্বা এভাবেই খেয়াল রাখতেন যে মনে হতো, আব্বা এ সকল বিষয়েই কেবল দায়িত্বপ্রাপ্ত। সন্তানদের অসুস্থতায় আব্বা ব্যাকুল হয়ে যেতেন। আল্লাহ তাআলার কাছে কেঁদে কেঁদে সুস্থতা চাইতেন।

১৯৮৯ সাল। আমি হঠাৎ করে দুরারোগ্য এক ব্যাধিতে আক্রান্ত হলাম। বাংলাদেশের তৎকালীন জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে ৮ সদস্যের এক মেডিক্যাল বোর্ড আব্বা গঠন করালেন। আমার সকল মেডিক্যাল পেপারস পর্যবেক্ষণ করে দেশের চিকিৎসকগণ বললেন, বাংলাদেশে আমার আর কোনো চিকিৎসা নেই। সম্ভব হলে ২-১ দিনের মধ্যেই উন্নত চিকিৎসার জন্য আমাকে দেশের বাইরে নিয়ে যেতে হবে। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে আমার চিকিৎসার জন্য উত্তম হবে বলে চিকিৎসকগণ আব্বাকে পরামর্শ দিলেন। আব্বা শুরুতেই একটু ঘাবড়ে গেলেন, পেরেশান হলেন। কেননা, আমার শারীরিক অবস্থাটা এমন ছিল যে, আমি প্লেনে বসে যেতে পারবো না। আমাকে শুইয়ে নিয়ে যেতে হবে। কথা বলে আব্বা জানলেন, আমাকে প্লেনে শুইয়ে নিতে গেলে আমার একার জন্যই ৬টি সিট লাগবে। এরপর আব্বার নিজের জন্য একটি ও আমাদের সাথে একজন চিকিৎসক যাবেন তার জন্যও ১টি সিট- সব মিলিয়ে প্লেনের মোট ৮টি সিট লাগেবে। একসাথে এতগুলো সিট ২-১ দিনের মধ্যে কীভাবে পাওয়া যাবে? আরো সমস্যা হলো, সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ভর্তি হবো কীভাবে? সেখানেই থাকতে হবে কত দিন? সেখানে চিকিৎসা খরচ কেমন? সব মিলিয়ে কত টাকা লাগবে? সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিলো পাসপোর্ট- কেননা আমার তখন পাসপোর্টই নেই! ২-১ দিনের মধ্যে পাসপোর্ট কীভাবে হাতে পাওয়া যাবে?

এতগুলো কঠিন সমস্যা একসাথে সামনে আসাতে এবং সময় অত্যন্ত কম হওয়াতে আব্বা সত্যিই এবার পেরেশান হয়ে গেলেন। কিন্তু মুমিন কখনো হতাশায় ভেঙে পড়ে না। এর জ্বলন্ত উদাহরণ হিসেবে আমি তখন চাক্ষুষ আব্বাকে দেখেছি। আব্বা পেরেশান হয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু তিনি মনোবল হারাননি। হাসপাতালের বেডে শুয়ে আমি সব দেখি, সব বুঝি; কিন্তু কিছু বলার মতোও শারীরিক শক্তি আমার ছিল না। আমাকে যেভাবে শুইয়ে রাখা হতো সেভাবেই আমাকে শুয়ে থাকেতে হতো। নিজে আমি আমার শোয়ার অবস্থার পরিবর্তন করতে পারতাম না, যদি না কেউ আমাকে পরিবর্তন করে দিত। আমি তখন ঢাকার মগবাজারস্থ হোলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালের নিচতলার ১০৬ নম্বর রুমে চিকিৎসাধীন ছিলাম। আমার রুমের সাথেই একটা ছোট্ট বারান্দা ছিল। আমি দেখলাম, আব্বা বাইরে থেকে এসে সোজা ওই বারান্দায় চলে গেলেন। জায়নামাজটা বিছালেন। দাঁড়িয়ে গেলেন নামাজে। সিজদায় গেলেন। প্রভুর সাথে কথা বললেন দীর্ঘক্ষণ। তখন আব্বার কান্নার আওয়াজ আমি শুনতে পেলাম। সেদিন কী কথা বলেছিলেন তিনি তাঁর মালিকের সাথে- তা আমার আর কোনোদিন জানা হয়নি। আব্বা সিজদায় ছিলেন দীর্ঘক্ষণ। নামাজ শেষে আব্বা জায়নামাজ থেকে ওঠে সোজা এগিয়ে এলেন আমার দিকে। আব্বা আমার কপালে লম্বা করে একটা চুমু দিলেন। আমার সমস্ত শরীর প্রশান্তিতে ভরে গেল। মনে হলো- আমার কোনো কষ্ট নেই, ছিলও না কখনো।

আব্বা হাসপাতালের রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন সকালে। ফিরে এলেন বিকেলে। রুমে ঢুকেই আব্বা আমাকে ও আম্মাকে সালাম দিলেন। সকালে আব্বার পবিত্র চেহারায় যেমন পেরেশানি দেখেছিলাম এখন আর সেটা দেখতে পেলাম না, বরং আব্বার চেহারায় উজ্জ্বল এক দ্যুতি খেয়াল করলাম। আম্মা আমার পাশেই বসা ছিলেন। আব্বা আবারো চলে গেলেন সেই বারান্দায়। আবারো লুটিয়ে পড়লেন সিজদায়। এবার মহান মালিকের সাথে কথোপকথন শেষে আম্মাকে এসে বললেন, ‘আলহামদুল্লিাহ! মাসুদের সিঙ্গাপুরে যাওয়ার সকল ব্যবস্থা হয়ে গেছে।’ আম্মা খুশি হলেন, আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করলেন, কিন্তু তখনো মনটা খারাপ করেই রইলেন। আব্বা জানতে চাইলেন ‘মন খারাপ কেন?’আম্মা বললেন, ‘সবই তো ঠিক আছে। কিন্তু মাসুদকে সিঙ্গাপুরে নিবেন কীভাবে? ওর তো পাসপোর্টই নেই!’ আব্বা বললেন, আমার মালিক আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মাসুদের জন্য পাসপোর্টের ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন। আগামীকালই ওর পাসপোর্ট হাতে চলে আসবে ইনশাআল্লাহ। আর পরের দিনই আমি মাসুদকে নিয়ে সিঙ্গাপুরে রওয়ানা করবো ইনশাআল্লাহ।’ সেদিন আমার পরম শ্রদ্ধেয় আব্বা-আম্মার চোখে মুখে আমি মহান রবের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা দেখেছি, তাদের চোখে আনন্দাশ্রু দেখেছি।

দু’দিন পরে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে। আব্বা তো গেলেনই, আমার ছোট চাচা হুমায়ুন কবীর সাঈদীকেও আব্বা সাথে নিলেন। হাসপাতালে আমার কেবিনের জায়গা খুব কম ছিল। গভীর রাতে হঠাৎ সজাগ হলে আমি আব্বাকে খুঁজতাম তিনি কোথায় ঘুমালেন। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখতাম আমার পরম শ্রদ্ধেয় আব্বা তাঁর গায়ের চাদরটা বিছিয়ে হাতটা মাথার নিচে দিয়ে হাসপাতালের বারান্দার সোফায় শুয়ে আছেন। আমি ডুঁকরে কেঁদে উঠতাম। তাঁর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে বলে ডাকতেও সাহস পেতাম না। অসুস্থতার কারণে হাসপাতালে থাকার পুরো সময়ই আমি প্রায় তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকতাম। যখনই একটু সজাগ হতাম দেখতাম আব্বা আমার পায়ের কাছে বসে আমার হাত, পা, শরীর টিপে দিচ্ছেন। আমার গাল বেয়ে চোখের পানি বালিশে পড়তো আর লজ্জা ও ভয়ে আমি চোখ বন্ধ করে থাকতাম।

প্রায় ২ মাস মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসার পর আল্লাহ আজ্জাওয়াজাল আমাকে পরিপূর্ণ সুস্থতা দান করেছিলেন। ঢাকা ও সিঙ্গাপুর মিলে প্রায় তিন মাস চিকিৎসাধীন ছিলাম। যদিও এগুলো সব আজ থেকে ৩৪ বছর আগের কথা, তবুও এর কোনো কিছুই আমি বিস্মৃত হইনি। হাসপাতালে করা আব্বার সেই কষ্টের দিনগুলো আর সেই স্মৃতিগুলো মনে হলে এখনো আমি স্থির থাকতে পারি না। আর এখন আমার সেই কষ্টতো আরো দ্বিগুণ-বহুগুণ বেড়ে গেছে। এখন চিৎকার করে শুধু আব্বাকে ডাকি। বাবা ও বাবা...! তুমি আমাকে ছেড়ে কেন চলে গেলে? তুমি আমার জন্য কী না করেছো বাবা-কিন্তু আমি তো তোমার জন্য কিছুই করতে পারলাম না! আমি তোমার এক ব্যর্থ সন্তান বাবা! আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও। আমি কি আমার আব্বার খেদমত একটুও করতে পেরেছি? আব্বা কারাগারের বাইরে থাকাকালীন অবস্থায় আমার প্রতি যে যত্নশীল ছিলেন- আব্বা বন্দি থাকা অবস্থায় আমি আব্বার প্রতি কতটা দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি? সেই চিন্তায় আমি ব্যাকুল ও পেরেশান হয়ে আছি। শুধু প্রতি মুনাজাতে, গভীর রাতে আল্লাহর কাছে এই দুআটাই করে যাচ্ছি, ‘রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা।’

আব্বা আত্মীয়-স্বজন পাড়া প্রতিবেশীদের ব্যাপারে এতটাই খেয়াল রাখতেন, মনে হতো তারাও আমাদের পরিবারেরই উল্লেখযোগ্য অংশ। আমাদের সমাজ, এলাকা, গ্রাম, উপজেলা, জেলার যিনিই কোনো সমস্যা নিয়ে হাজির হতেন আব্বার কাছে- আব্বা এতটাই গুরুত্ব দিয়ে তাকে রিসিভ করতেন যে মেহমান নিজেও অবাক হয়ে যেতেন। আমাদের বাসায় দেশ-বিদেশের বড় বড় আলিম-ওলামাসহ বিজ্ঞজন এবং পিরোজপুরের মানুষদের যাতায়াত ছিল নিরবচ্ছিন্ন। এত এত মানুষদের আপ্যায়নে আম্মা এবং পুত্রবধূদের কষ্ট হবে বলে মেহমানদের বসিয়ে ভেতরে গিয়ে আব্বা নিজেই নাস্তা রেডি করে ট্রে-তে করে নিয়ে আসতেন। আম্মা এবং পুত্রবধূরা মেহমান আপ্যায়নে সর্বদা প্রস্তুত থাকতেন। এরপরও দেখা যেত আব্বা নীরবে গিয়ে নিজেই রেডি করে নাস্তা নিয়ে এসেছেন। মেহমান আপ্যায়ন সুন্নত। এ সুন্নত আব্বার কাছে আসা মেহমানদের ব্যাপারে আব্বার কখনোই তরক হতো না। নাস্তা নিতে নিতে আব্বা বসে বসে মনোযোগ দিয়ে আগত মেহমানদের কথা শুনতেন। মনে হতো তাঁরা আব্বাকে কত আপন ভেবে, কত কাছের ভেবে নিঃসংকোচে, নির্ভয়ে সকল ব্যথা বেদনা দুঃখ-দুর্দশার কথা শেয়ার করছে। এই দৃশ্য দেখে সাথে সাথে আমার প্রিয় নবীজির শানে গাওয়া সেই নাতে রাসূল সা.-টির কথা মনে পড়ে যেত-

‘ সে কোন বন্ধু বলো বেশি বিশ^স্ত? 

যার কাছে মন খুলে দেয়া যায়

যার কাছে সব কিছু বলা যায়

তার নাম আহমদ বড় বিশ্বস্ত’

আব্বার সাথে কথা বলার ধরন দেখে মনে হতো, আহা! আব্বা কত বিশ্বস্ত মানুষগুলোর! পরিবার, এলাকা, সমাজস্থ মানুষদের জন্য আল্লামা সাঈদী সত্যিই এক পরম বিশ্বস্ত ঠিকানা ছিলেন।

আব্বা সবসময় পবিত্রতার সাথে পরিপাটি থাকার চেষ্টা করতেন। প্রতি ওয়াক্ত নামাজে ওয়াশ করা পাঞ্জাবি পরতেন। আচরণে, চলাফেরায়, কথাবার্তায়, আব্বার বিনয়ী ভাব এমন ছিল যে, সচরাচর এরকম তুলনা করার মতো ব্যক্তি আমাদের চোখে খুবই কম আছে। আব্বাকে দেখে মনে হতো তিনি বোধ হয় সবসময় তাঁর রবের সাথে কানেক্টেড থাকতেন। কোনো বিষয় রবের হুকুম এবং নবীজির সুন্নাহর খেলাফ হয়ে যাচ্ছে কিনা এ ব্যাপারে আব্বা এতটাই সতর্ক থাকার চেষ্টা করতেন যে, ঠিক যেমন কাঁটাযুক্ত বাগানের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মানুষ কাঁটা থেকে সতর্ক থাকে! আব্বার বিনয়ী ভাব এতটাই উঁচু লেভেলের ছিল যে আব্বাকে কখনো উঁচু কণ্ঠে বা উচ্চস্বরে কথা বলতে দেখিনি আমরা। কখনো আব্বা রেগে গেলেও প্রকাশ করতেন না। আমরা আব্বার চেহারা দেখে বুঝতে পারতাম আব্বা হয়তো কোনো বিষয়ে কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু আব্বা রেগে বা রাগান্বিত হয়ে কোনো বাক্য ব্যবহার করতেন না আমাদের সাথে। এই রাগতঃ অবস্থায়ও আব্বা আমাদের ডেকে খুবই নরম কণ্ঠে কুরআন-হাদিস দিয়ে আমাদের ভুলগুলো শুধরিয়ে দিতেন। আমরা তন্ময় হয়ে শুনে নিজেদের ভুল বা গ্যাপগুলো স্বীকার করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতাম। আব্বা আমাদের বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করে দিতেন। কপালে চুমু দিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে বিদায় দিতেন।

প্রতি মাসেই আব্বার সময় সুযোগ অনুযায়ী আব্বা পরিবারের সবাইকে নিয়ে পারিবারিক বৈঠক করতেন। সুযোগ পেলে আব্বা একাধিক পারিবারিক বৈঠকও করেছেন আমাদেরকে নিয়ে। ঘরের মহিলারা পর্দার ওপাশ থেকে অংশগ্রহণ করতেন। এজেন্ডাভিত্তিক আলোচনা হতো পারিবারিক বৈঠকে। পারিবারিক বৈঠকসহ বিভিন্ন ঘরোয়া বৈঠকগুলোতে আমাদের ভাইদের ওপর দারসুল কুরআনসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার দায়িত্ব থাকতো। যার যার বিষয়বস্তু অনুযায়ী আমরা প্রস্তুতি নিতামএবং নির্ধারিত দিনে বৈঠকে আমরা সেটা উপস্থাপন করতাম। আব্বা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। শেষে উপস্থাপনে কোনো ভুল থাকলে আব্বা সেগুলো শুধরে দিতেন। দ্বীনি আলোচনাসহ পরিবারের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় বিষয়ে আলোচনা হতো পারিবারিক বৈঠকে। পারিবারিক এবং পরিবারের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় বিষয়ে পরামর্শভিত্তিক সকলের মতামতের ভিত্তিতে আব্বা সিদ্ধান্ত নিতেন। আব্বা কখনো এককভাবে কোনো পারিবারিক সিদ্ধান্ত নিতেন না। সকলের সাথে পরামর্শ করে আব্বা সিদ্ধান্ত নিতেন। তিনি বারবারই স্মরণ করিয়ে দিতেন, ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কাজের ব্যাপার পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিয়ে তাঁর ওপর তাওয়াক্কুল করতে বলেছেন। কাজেই আমাদের কোনো কাজ যেন আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধ না হয়ে যায়। তোমরা এ ব্যাপারে সদা সতর্ক থাকবে।’ আব্বার প্রত্যেকটা কাজেই ছিল আল্লাহ এবং রাসূল সা.-এর আদেশ নিষেধের যথাযথ প্রতিফলন। আল্লাহ এবং রাসূলের সা. আদেশ নিষেধের ব্যাপারে আব্বা এতটাই সতর্ক থাকতেন যে, তিনি আল্লাহ এবং রাসূলের সা. আদেশ নিষেধের ব্যত্যয় ঘটার ব্যাপারে সর্বাবস্থায় ভীত থাকতেন।

আমাদের সব ভাইয়ের প্রতি আব্বার আচরণ ছিল এক এবং অভিন্ন। তথাপি আমার কাছে মনে হতো আব্বা বোধ হয় আমাকেই বেশি ভালোবাসেন, আমাকেই বেশি আদর করেন, আর আমার সকল অভাব অভিযোগই বেশি পূরণ করেন। আমার অন্য ভাইয়েরাও মনে হয় আমার মতোই মনে করতেন। আসলে আব্বার ভালোবাসাটা এমনই ছিল যে, কোনো বিষয়েই কারো প্রতি কিঞ্চিৎ বেশি কিংবা কম করতেন না তিনি। আমরা সব ভাই-ই আব্বার চোখের মণি ছিলাম। শাসনের ক্ষেত্রেও আব্বার একই অবস্থা ছিল। বিনয় মিশ্রিত কঠোর শাসন। যে শাসনে কখনো আব্বার গলার আওয়াজ উঁচু হতো না। কিন্তু আমরা ভয়ে তটস্থ হয়ে যেতাম। আম্মা এবং পুত্রবধূদের প্রতিও আব্বা সমান যত্নশীল ছিলেন। আব্বা ছেলেদের এবং ছেলের বউদের একই মানের উপহার দিতেন সবসময়। সবার প্রতি স্নেহ-মায়া-মমতার মাত্রাটাও সমান ছিল। এ ক্ষেত্রে আব্বা এত চমৎকার ইনসাফ করতেন, সবাই সন্তুষ্ট হয়ে যেত। আব্বার দুআ নেওয়ার জন্য পুত্রবধূরা এক রমকম প্রতিযোগিতা করতো সবসময়। আব্বাও মন ভরে দুআ করতেন সবার জন্য। আব্বার একটু দুআ নেওয়ার জন্য সবাই সর্বাবস্থায় পেরেশান থাকতো। আসলে আব্বা যে আমাদের দুআর ভাণ্ডার ছিলেন! ছায়া হয়ে আগলে রেখেছিলেন! আব্বার উসিলায় আল্লাহ জাল্লা শানুহু আমাদের পরিবারে এত বরকত ঢেলে দিয়েছেন- কৃতজ্ঞতায় দয়াময় আল্লাহর দরবারে আমাদের মাথা নুয়ে আসতো, নুয়েই আসে।

আজ আমরা ইয়াতিম। মাথার ওপরের সেই ছায়াটা আল্লাহ তাআলা উঠিয়ে নিয়েছেন। দুআর সেই ভাণ্ডারটা তিনি তাঁর কাছ ফেরত নিয়ে নিয়েছেন। (চলবে)


লেখক : আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর তৃতীয় পুত্র

ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান, জিয়ানগর, পিরোজপুর

আপনার মন্তব্য লিখুন

Tahmida

- 11 months ago

বিস্মিত, অশ্রুসিক্ত, অনুপ্রাণিত।

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির