post

বাংলাদেশের অর্থনীতির হালচাল

ড. মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম

০৯ আগস্ট ২০২৩

বাংলাদেশের বয়স বায়ান্ন হতে চলছে। ইতোমধ্যে নানান শিল্পোদ্যোগ, কৃষি-উদ্যোগ এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে বাংলাদেশের অর্থনীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। দেশটি কৃষি ও ট্রেড নির্ভরতা থেকে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে অগ্রসরমান। হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো অবকাঠামোগত উন্নয়ন দেখাতে গিয়ে বিদেশী কঠিন শর্তেও ঋণ ও চুক্তির মধ্যে জড়িয়েছে। সাম্প্রতিককালে ভূ-রাজনীতি (Geo-politics)-এর বিবদমান পক্ষগুলোকে হাতে রাখার মতো স্বাভাবিক শাঁখের করাতের মুখে দেশ, সমাজ ও অর্থনীতি। বাস্তবে যখন দেশে এ পরিস্থিতি চলমান, তখন বাংলাদেশ চাইলেই এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ হতে পারে। জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫) হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলায় ব্যাপক বিপর্যয়, ধূলিসাৎ হয়ে যাওয়া অর্থনীতিকে যেভাবে চাঙ্গা করতে সক্ষম হয়েছিল, সেরকম জনসম্পদ, ন্যায়নীতি নির্ভর ও জবাবদিহিতামূলক (Accountability) মনোভঙ্গি বা পরিবেশ যদি বাংলাদেশেও থাকে, মানে জনসম্পদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও উন্নয়নমূলক পরিবেশ-পরিস্থিতি যদি থাকে, তাহলে বাংলাদেশ তো বটেই, যে কোনো দেশের অর্থনীতিই ঘুরে দাঁড়াতে পারে।

বাংলাদেশ জনসংখ্যারভারে ন্যুব্জ একটি দেশ। এদেশের মোট জনসংখ্যা হচ্ছে ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ১৮ হাজার ৯১১ জন। নারী ৮ কোটি ৫৬ লাখ ৫৩ হাজার ১২০ জন। জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ এর চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী এ তথ্য জানিয়েছে বিবিএস। মুসলিম ৯১ শতাংশ, অন্যান্য ৯ শতাংশ। (দেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি, দৈনিক ইনকিলাব, ১০ এপ্রিল ২০২৩, পৃ. ১২।) এক সময় বিশ্বে অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে দেখা হতো বোঝা হিসেবে। বাংলাদেশের কিছু মানুষও এ মতবাদে প্রভাবিত হয়েছিল। কিন্তু হাল আমলে জনসংখ্যা নিয়ে নতুন ভাবনার উদয় হয়েছে। এখন অতিরিক্ত মানুষ আর বোঝা নয়; বরং বহুদেশে সম্পদ হয়ে উঠেছে। দেশে দেশে জনশক্তিকে জনসম্পদে রূপান্তরের নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশেও নাগরিকদের যথাযথভাবে মানবসম্পদে রূপান্তরে মনোযোগী হলে কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া যাবে। বর্তমান জমানায় এ সত্য উন্মোচিত হয়েছে যে, জনশক্তিকে জনসম্পদে রূপান্তর করতে পারলে যেকোনো দেশই উন্নতির উচ্চ শেখরে পৌঁছতে পারে। সেজন্য দরকার সরকারের বৈষম্যহীন নীতি অনুসরণ। এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে আনা জরুরি। সব নাগরিক যেন উন্নয়নের সুফল সমভাবে পেতে পারে রাষ্ট্রকেই তা নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য চাই সুশাসন। কিন্তু দেশে সুশাসনের বেহাল দশা। ক্ষমতাসীনরা গোষ্ঠীস্বার্থের বাইরে সার্বজনীন নীতি গ্রহণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যর্থ। ফলে উন্নয়নের সুবিধাভোগী মুষ্টিমেয় ব্যক্তি বা গোষ্ঠী। এ কারণে তীব্রতর হচ্ছে ধন-বৈষম্য। বাড়ছে বাজেট, বাড়ছে দারিদ্র্য।

বাংলাদেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এ সুযোগ কাজে লাগাতে জনশক্তিকে আরো অধিক দক্ষ করতে হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে তরুণ-যুবকদেরকে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত করে তাদের কাজে লাগাতে হবে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের সিংহভাগ অঞ্চলের মাটিই উর্বর ও আবাদযোগ্য। তাই বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে দক্ষ জনশক্তির মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারলে উৎপাদন বৃদ্ধি করা আমাদের জন্যে সহজ। কৃষিকে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি বলা হচ্ছে। এ মুহূর্তে বাংলাদেশে ১৫ বছর থেকে ৬০ বছর বয়সের মানুষ বেশি, যারা কর্মক্ষম। জনসম্পদে ধনী দেশ গরিব থাকতে পারে না। দেশের বিশাল জনসংখ্যাকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে চাষাবাদ, প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ, জনশক্তি রফতানি প্রক্রিয়া সহজীকরণসহ সহজশর্তে বিনিয়োগ প্রদানের মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিতে হবে। যার জন্যও প্রয়োজন সঠিক কর্মপরিকল্পনা ও তার  বাস্তবায়ন। বাংলাদেশ ‘উন্নয়নশীল’ দেশ হিসেবে জাতিসঙ্ঘের স্বীকৃতি পেয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ২০২৪ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে বুক চিতিয়ে হাঁটতে পারবে। এখানে একটি কথা না বললেই নয়, একটি দেশ উন্নয়নশীল হওয়া মানে এই নয় যে সবাই উন্নয়নের গাড়িতে সওয়ার হতে পারবে। এটি এক ধরনের গড় অবস্থান। বাংলাদেশে অনেক পরিবার অনেক আগে থেকেই শিল্পোন্নত দেশগুলোর নাগরিকদের মানের জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত। আবার যুক্তরাষ্ট্রেও আছে অনেক গৃহহীন মানুষ। জাতিসংঘের একটি প্রত্যয়নপত্র পেলেই যে দেশে দুধ আর মধুর নহর বয়ে যাবে, এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। 

বাংলাদেশে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। জাতীয় বাজেটের খুব কম অংশই খরচ হয় সামাজিক উন্নয়ন খাতে। আয় বৈষম্য বাড়ছে সমাজে। সব ধরনের সুযোগ-সুবিধার কেন্দ্রীভবন হচ্ছে রাজধানীতে। এগুলোর কোনাটাই সুখকর খবর নয়। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হলে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর ওপর নজর দেওয়া দরকার। সবচেয়ে বেশি দরকার লাভজনক কর্মসংস্থান তৈরি করা। বাগাড়ম্বর নয়, দরকার পরিকল্পনা এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন। টেস্ট রিখি, কাবিখা, ও এমএস- এসব শব্দ মনে করিয়ে দেয় যে, দেশে দারিদ্র্য ও সামর্থ্যহীন মানুষের সংখ্যা এখনো যথেষ্ট। অতীতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই ছিল অর্থনীতির গবেষক ও নীতিনির্ধারকদের প্রধান লক্ষ্য। গত কয়েক দশক ধরে তারা উপলব্ধি করছেন যে, খাদ্যহীনতা, খাদ্যপ্রাপ্তির অনিশ্চয়তা এবং খাদ্যে ভেজালের ভয়াবহতা/অনিরাপদ খাবারের আগ্রাসনের মধ্যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন কখনই তাৎপর্যবহ হতে পারে না।

খাদ্যে ভেজালের কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে বাংলাদেশ। দেশের সাধারণ মানুষের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাদ্যে ভেজালের ভয়াবহতা সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে। বাংলাদেশের অন্যতম চ্যালেঞ্জ মানসম্মত কর্মসংস্থান। দারিদ্র্য বিমোচনসহ উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের প্রশংসা করলেও মানসম্মত কর্মসংস্থানের অভাবকে বড় উদ্বেগের কারণ মনে করে বিশ্বব্যাংক। সংস্থার এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এখনও অর্ধেক নারীশ্রমিক এবং এক-তৃতীয়াংশ পুরুষ শ্রমিক পরিবারে পারিশ্রমিকবিহীন কাজ করে অথবা সাধারণ দিনমজুর হিসেবে কাজে খাটে। এ কারণে সুবিধাজনক অবস্থান সত্ত্বেও জনমিতির বৈশ্বিক রূপান্তরকে মানবসম্পদ উন্নয়নে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো ইস্যুভিত্তিক সমস্যা সমাধানের জন্য যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশের শ্রমবাজারে অন্যান্য চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে যুব-কর্মসংস্থান, কর্মস্থলে নারীর সুরক্ষা, অভিবাসনের ঝুঁকি ও দারিদ্র্য এবং নাজুকতা। এসব বিষয়ে নীতি সহায়তা অগ্রাধিকার দেওয়া এবং বিদ্যমান সামাজিক কর্মসূচির উন্নয়ন এবং অধিক আয় ও কর্মসংস্থানমুখী নীতি নেওয়া দরকার।

ব্যবস্থা ও তত্ত্বাবধান পর্যায়ে বিদেশীদের (বিশেষ করে ভারতীয়দের) নিয়োগ অব্যাহত থাকলে বা রাখলে দেশের চাকরি বাজার দেশীয়দের জন্য আরো অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। এহেন পরিস্থিতি থেকে কার্যকরভাবে পরিত্রাণ পেতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে। চ্যালেঞ্জগুলো নিম্নরূপ : 

১. বাজারে ভোক্তা পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা, মূল্যস্ফীতি প্রবৃদ্ধির হারের উপর চাপ। 

২. বাস্তবভিত্তিক প্রবৃদ্ধি প্রক্ষেপণ করা; প্রবৃদ্ধির হারকে আরো সংশোধন করে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা।

৩. বৈষম্য দূর করা; 

৪. বিনিয়োগ বাড়ানো;

৫. অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় বাড়ানো; 

৬. অভ্যন্তরীণ করভিত্তি সম্প্রসারণ; 

৭. বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির গুণগত বাস্তবায়ন; 

৮. কৃষি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি;

৯. বিদ্যুৎ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের সঠিক ব্যবহার;

১০. রফতানি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা; 

১১. বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহ বৃদ্ধি; 

১২. পুঁজিবাজারে অর্থজোগান বাড়ানো; 

১৩. টেকসই রেমিট্যান্স প্রবাহ ধরে রাখা; 

১৪. কাঠামোগত সংস্কার অব্যাহত রাখা; 

১৫. বৈদেশিক সাহায্য প্রাপ্তি বাড়ানো।

বাংলাদেশের অর্থনীতি বৈষম্যমূলক অর্থনীতিতে পরিণত হচ্ছে। বৈষম্য প্রবৃদ্ধিকে আক্রান্ত করছে। বেড়ে যাচ্ছে হত দরিদ্রের সংখ্যা। আঞ্চলিক বৈষম্যও বেড়ে যাচ্ছে। মানসিকভাবে গরিবের সংখ্যা কমেনি। মজুরির বাজারেও নারী-পুরুষ বৈষম্য রয়েছে। বর্তমানে মূল্যস্ফীতিরও মূল্যস্ফীতি হচ্ছে। বর্তমানে মধ্যমেয়াদি কৌশল ছাড়াই সরকার বাজেট প্রণয়ন করছে। বিদ্যুৎ ঘাটতিও প্রকট হয়ে উঠছে। নেতিবাচক দিকগুলোর মধ্যে রয়েছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, দুর্বল রাজস্ব আয়, অতিমাত্রায় রাজস্ব ব্যয়, সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি, এডিপি বাস্তবায়নের নিম্নহার, ডিজেল ও সার সঙ্কট, কৃষিঋণ বিতরণের পরিমাণ কমে যাওয়া  প্রভৃতি। 

লেখক : সাবেক ব্যাংকার, কলামিস্ট ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির