নির্বাচন আজ মুখোশে পরিণত হয়েছে, এমনকি নৃশংস স্বৈরশাসকদের কাছেও এটা একটা মুখোশ। খুনি, চোর-ডাকাত ও ব্যভিচারীগণও যেমন মিষ্টি কথা ও ভদ্র লেবাসে জনসম্মুখে হাজির হয়, তেমনি নৃশংস ও বর্বর স্বৈরাচারী শাসকগণও ঘটা করে নির্বাচনের আয়োজন করে এবং সে নির্বাচনে নিজেদের বিজয়ী হওয়া নিয়ে নির্লজ্জভাবে বড়াই করে। এর কারণ, নির্বাচনের আলঙ্কারিক মূল্য। প্রতিটি সভ্য সমাজেই স্বৈরাচার নিন্দিত হয় জনগণের মৌল অধিকারের ওপর নৃশংস ডাকাতির কারণে। এবং স্বৈরশাসক চিত্রিত হয় গণতন্ত্রের শত্রু রূপে।
সভ্য ও ভদ্র ইমেজ নিয়ে বাঁচার শখ দুর্বৃত্ত স্বৈরাশাসকদেরও। তারাও চায় তাদের ইমেজকে জনগণের সামনে গ্রহণযোগ্য করতে। এজন্য তারা নিজেদের কদর্য চরিত্রের ওপর গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মুখোশ পরাতে চায়। তাদের আগ্রহ স্রেফ লোকদেখানো নির্বাচনের আয়োজন নিয়ে, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকরূপ দেওয়া ও জনগণকে ইচ্ছামত সরকার নির্বাচনের অধিকার দেওয়া নিয়ে নয়। তখন নির্বাচনটি হয় অতি নিয়ন্ত্রিত। সে সব নির্বাচনের লক্ষ্য হয়, যে কোনোভাবে তাদের বিজয়কে সুনিশ্চিত করা। বাংলাদেশে সেরূপ নির্বাচন এরশাদের আমলে হয়েছে, হাসিনার আমলে ২০১৪ সালে ও ২০১৮ সালেও হয়েছে। ২০১৪ সালে নির্বাচনে ১৫৩ সিটে কোনো ভোটকেন্দ্রই খোলা হয়নি। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরে নির্বাচনের নামে যা হয়েছে সেটি ছিল নিরেট ভোট ডাকাতি। ভোটার ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারেনি, ব্যালট পূর্বের রাতেই ভোট ডাকাতরা ছিনতাই করে নিজের ইচ্ছামতো ব্যালটবক্সে ফেলেছে। কোন সভ্য ও ভদ্র দেশে কি সেটি আশা করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশে ভোট ডাকাতরা সেটিই করেছে এবং সে নির্বাচনের ছুতো ধরে শেখ হাসিনা এখন ক্ষমতায়। বাংলাদেশের পুলিশ, আদালত ও জনগণের ব্যর্থতা তারা ডাকাতদের ধরতে ও শাস্তি দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
স্বৈরাচার শাসকের দুর্বৃত্তি এবং স্বৈরাচার নির্মূলের ইবাদত
স্বাধীনতার অর্থ স্রেফ ঘরবাঁধা, চাষাবাদ, দোকানদারি, পানাহার, বিয়েশাদি ও খেলাধুলার স্বাধীনতা নয়। বরং সেটি হলো রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তি নিয়ে মতপ্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা। থাকতে হয় মিটিং-মিছিলের পূর্ণ স্বাধীনতা। এটিই হলো গণতন্ত্রের মূল কথা। সে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা ছাড়া সভ্য রাষ্ট্র নির্মিত হয় না। পশু গলায় রশি নিয়ে বাঁচে, কিন্তু সভ্য মানুষ মৌলিক অধিকার ছাড়া বাঁচতে পারে না। জনগণের সে গণতান্ত্রিক অধিকার লুণ্ঠিত হলে লুণ্ঠিত হয় স্বাধীনতা। তবে সে পূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকার জনগণকে দিলে তাতে বিপদ খাড়া হয় স্বৈরাচারী সরকারের। তখন রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ স্বৈরাচারী শাসকের হাতে থাকে না, চলে যায় জনগণের হাতে। জনগণের এরূপ ক্ষমতায়নকে গণতন্ত্র বলা হয় বলে আমরা জানি। গণতন্ত্রের অর্থ জনগণের রায়কে ইজ্জত দেওয়া। এটিই হলো সভ্য সমাজের সভ্যরীতি। কিন্তু স্বৈরাচারে গুরুত্ব পায় স্বৈরচারী শাসকের এজেন্ডা এবং গুরুত্ব হারায় জনগণ। এটি হলো জনগণকে শক্তিহীন ও অধিকারহীন করার দুর্বৃত্তি। পৃথিবীপৃষ্ঠে এটিই হলো সবচেয়ে বড় অপরাধ। অসভ্য রাষ্ট্র নির্মাণের কাজটি এখান থেকেই শুরু হয়।
ইসলামে সবচেয়ে বড় নেককর্ম হলো দুর্বৃত্ত শাসকের নির্মূল। এখান থেকেই শুরু হয় সভ্যরাষ্ট্র নির্মাণের কাজ। সকল ধর্মের মাঝে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব হলো, মানব ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য অপরাধকে সঠিক ভাবে শনাক্ত করতে পেরেছে এবং তার সঠিক প্রতিকার দিয়েছে। ইসলাম এ অপরাধীদের নির্মূলকে জিহাদ তথা সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতের মর্যাদা দিয়েছে। কিন্তু অন্য কোনো ধর্মে দুর্বৃত্ত নির্মূলের এ রক্তক্ষয়ী কাজকে ইবাদতের মর্যাদা দেওয়া হয়নি। এ মহান কাজে নিহত হলে পুরস্কারের প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়নি। কিন্তু ইসলামে নিহত ঈমানদারকে দেয় শহীদের মর্যাদা।
স্বৈরাচারী শাসকদের ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং
স্বৈরশাসকদের কাছে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন এজন্যই অপরিহার্য যে, তাতে অতি দুর্বৃত্ত স্বৈরশাসকেরও পরাজয়ের ভয় থাকে না। এ কারণেই সেরূপ নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন করেছে জেনারেল এরশাদ ও শেখ হাসিনা। একই রকম নির্বাচন করে মিসরের স্বৈরাচারী জেনারেল আবদুল ফাতাহ আল সিসি ও সিরিয়ায় স্বৈরাচারী শাসক বাশার আল-আসাদ। অতীতে সেরূপ নির্বাচনে শতকরা ৯৮ ভাগের বেশি ভোট পেয়েছে মিসরের সাবেক স্বৈরাচারী শাসক হুসনি মোবারক, সিরিয়ার হাফিজ আল আসাদ এবং অন্যান্য স্বৈরাচারী শাসকগণ। সরকার-নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনে জনগণকে ভোটকেন্দ্রে নেওয়া হয় স্রেফ লোকদেখানোর জন্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভোটকেন্দ্রে যেতে সরকার জনগণকে বাধ্য করে। এটি হলো উলঙ্গ ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং। সে কাজে ব্যবহৃত হয় পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ, প্রশাসনিক কর্মচারী ও দলীয় ক্যাডার। এজন্যই স্বৈরাচারী শাসকের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন করা অসম্ভব। সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল আসাদ চার লাখের বেশি মানুষকে হত্যা করেছে। ৬০ লাখের বেশি নাগরিককে দেশছাড়া করেছে। সরকার টিকে আছে রাশিয়া ও ইরানি সৈন্যদের সহয়তা নিয়ে। অথচ নির্বাচনে এই জালিম শতকরা ৯৫ ভাগের বেশি ভোট পায়। তেমনি ঘটে মিসরেও। জেনারেল আবদুল ফাতাহ আল সিসি মিসরের ইতিহাসে প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে সামরিক ক্যু করে। ২০১৩ সালের ১২ আগস্ট সন্ধ্যায় কায়রোর রাবা আল আদাবিয়ার চৌরাস্তায় দেড় থেকে দুই হাজার নিরস্ত্র প্রতিবাদী মানুষকে মেশিন গান ও কামান দেগে হত্যা করে। মিসরে ৭০ হাজারের বেশি রাজনৈতিক কর্মী এখনো জেলে। অথচ সে জালিম জেনারেলকে বিপুল ভোটে বিজয়ী দেখানো হয়েছে বিগত দু’টি নির্বাচনে।
পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের স্বৈরাচার প্রেম
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যুদ্ধটি খোদ জনগণকে করতে হয়। সে যুদ্ধটি কখনোই বিদেশীরা করে দেয় না। যারা ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে দেবে, তারা ব্যর্থ হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চিনতে। গণতন্ত্রের প্রতি মার্কিনীদের দরদ থাকলে তারা ২০১৪ ও ২০১৮ সালের অবৈধ নির্বাচনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতো। কিন্তু সেটি করেনি। গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংঘটিত সে নাশকতার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নীরব থেকেছে; নিন্দা জানায়নি। বিশ্বের বহু দেশে তাদের অবস্থান স্বৈরাচারী শাসকদের পক্ষে। তাদের কাছে ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ গুরুত্ব পায়, গণতন্ত্র, মানবতা ও মৌলিক মানবিক অধিকার নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলোর কাছে কদর পায় মিসরের জেনারেল আবদুল ফাতাহ আল-সিসির ন্যায় খুনি জেনারেলগণ। কারণ, তারা যেমন ইসরাইলকে নিরাপত্তা দেয়, তেমনি ইসলামপন্থীদের নির্মূলে নির্মম ও নৃশংস। এ কারণেই গুম, খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাসের জোয়ার আনা সত্ত্বেও শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকারকে পাশ্চাত্যের দেশগুলো মেনে নিয়েছে। ভোটডাকাতির নির্বাচনও তাদের কাছে দোষের নয়। এই হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলোর গণতন্ত্র প্রেম। গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা দিতে যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সাহায্য চায় তাদের অন্তত এরূপ বিষয় নিয়ে বোধোদয় হওয়া উচিত।
যতদিন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে হাসিনা সরকারের অধীনে ততদিন হাসিনাকে হারানো অসম্ভব। নিজে পরাজিত হওয়ার জন্য হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রথাকে বিলুপ্ত করেনি। মাঠে নিজ দলের রেফারি থাকলে খেলায় হেরে যাওয়ার ভয় থাকে না। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে যেমন ইচ্ছামত পেনাল্টি দেওয়া যায়, তেমনি লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠের বাইরেও পাঠানো যায়। বাংলাদেশে তেমন লালকার্ড ইতোমধ্যে দেখানো হয়েছে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ও তাঁর পুত্র তারেক রহমানকে। লাল কার্ড দেখানো হয়েছে পুরা সংগঠন জামায়াতে ইসলামীকেই। ঠুনকো বাহানায় জেলে পাঠানো হয়েছে ভিন্ন চিন্তার নেতাকর্মীদের। গণতন্ত্রের আন্তর্জাতিক মানের একটি স্বীকৃত সংজ্ঞা রয়েছে। গণতন্ত্রের অর্থ স্রেফ পাঁচ বছর পর পর বিশেষ এক দিনে ঘটা করে জনগণের ভোটদান নয়। এটি হলো শান্তিপূর্ণভাবে শাসক নির্বাচন ও দেশ পরিচালনার একটি সভ্যতার সংস্কৃতি। সরকার কীরূপে নির্বাচিত হবে এবং প্রশাসনের অঙ্গনে জনগণের মতামত কীভাবে প্রতিফলিত হবে- তা নিয়ে গণতন্ত্র দেয় একটি উন্নততর ও ভদ্রতর নীতিমালা। সরকার ও প্রশাসনের উপর কোনো একজন ব্যক্তির নয়, বরং জনগণের নিয়ন্ত্রণটিই হলো গণতন্ত্রের মূল কথা। জনগণ যখন সে নিয়ন্ত্রণটি হারায়, তখন সেটিকে আর গণতন্ত্র বলা যায় না। সেটি স্বৈরতন্ত্রে রূপ নেয়। রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞানের ময়দানে ইসলামের নেতা নির্বাচন হলো সবচেয়ে কল্যাণকর আবিষ্কার। ইসলাম এমন একটি সভ্যনীতি মানব ইতিহাসের বুকে সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল- যে যুগে রাজপুত্র না হলে কেউ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার আসনে বসার স্বপ্নও দেখতো না, সে যুগেই আবু বকর (রা:), উমর (রা:), উসমান (রা:), আলী (রা:)-এর মতো ব্যক্তিগণ রাষ্ট্রীয় প্রধান হয়েছেন কোনো রাজপুত্র না হয়েই। এমন একটি ভদ্র রীতিতে রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রী হতে যুদ্ধের প্রয়োজন পড়ে না, প্রয়োজন পড়ে না একদলীয় রাজনীতি ও ভোট ডাকাতির নির্বাচনেরও।
গণতন্ত্রের কবর ও লুণ্ঠিত স্বাধীনতা
রাষ্ট্রপরিচালনায় প্রশাসনিক ত্রুটি-বিচ্যুতি এবং দেশের প্রতিরক্ষা, আইনশৃঙ্খলা, শিক্ষা-সংস্কৃতি, ও বিদেশনীতির ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে জনগণ তাদের মতামতটি শুধু নির্বাচনের দিনে নয়, বরং প্রতি মাস, প্রতিদিন ও প্রতি মুহূর্তে জানায়। সেগুলো লেখালেখি, বক্তৃতা ও মিটিং-মিছিলের মধ্যে। সরকারের দায়িত্ব হলো জনগণের সে মতামতের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া। একমাত্র তখনই রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত এবং রীতি-নীতির ওপর জনগণের নিয়ন্ত্রণটি নজরে পড়ে। জনগণের সে নিয়ন্ত্রণটি স্বৈরাচারী শাসনে থাকে না, বরং সেখানে নজরে পড়ে স্বৈর-শাসক, রাজা, রাজপুত্র, রাজকন্যা, দলপতি বা গোত্রপতির নিয়ন্ত্রণ। সরকারের ওপর জনগণের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণটি প্রতিষ্ঠিত হয় নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। জনগণের ইচ্ছে পূরণে ব্যর্থ হলে জনগণ ভোট দিয়ে সরকারকে শাস্তি দেয়। তবে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন গণতন্ত্রের অতি অপরিহার্য অঙ্গ হলেও তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো সংসদের বাইরেও গণতান্ত্রিক পরিবেশের প্রতিষ্ঠা দেওয়া। সেটি হলো স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা। মাছ যেমন পানি ছাড়া বাঁচে না, তেমনি গণতান্ত্রিক শাসন প্রক্রিয়াও মতপ্রকাশের স্বাধীন পরিবেশ ছাড়া বাঁচে না। সরকারের নীতিতে যেমন প্রতিদিন পরিবর্তন আসে, জনগণও তেমনি প্রতিদিন সে নীতির ওপর নিজেদের অভিমত ব্যক্ত করে। সে অভিমত লাগাতর প্রকাশের জন্য চাই কথা বলা ও লেখালেখির স্বাধীনতা। এক্ষেত্রে জনগণের অধিকার না বাঁচলে স্বাধীনতা বাঁচে না। অথচ বাংলাদেশে সে স্বাধীনতা বেঁচে নাই। দেশটিতে ৫ বছর পর পর নির্বাচন হলেও বিলুপ্ত করা হয়েছে মতপ্রকাশের সে গণতান্ত্রিক পরিবেশ। জনগণের মত-প্রকাশের বিষয়টি স্রেফ ৫ বছর পর ভোটদানের বিষয় নয়, বরং সেটি এক অবাধ ও বিরামহীন স্বাধীন প্রক্রিয়া। অথচ সে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিই বাংলাদেশে গুরুত্বই পায়নি। বরং ফ্যাসিবাদী কায়দায় হত্যা করা হয়েছে সে স্বাধীনতাকে। তা ছাড়া নির্বাচনের নামে যা কিছু হয় সেটিও কোনো স্বাধীন গণতান্ত্রিক নির্বাচন নয়, বরং সরকার নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন।
জনগণ নিজেদের মতামত স্বাধীনভাবে ব্যক্ত করে যেমন মিটিং-মিছল ও বক্তৃতা-বিবৃতিতে, তেমনি টিভি, পত্র-পত্রিকা, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, ওয়াজ মহফিল, ক্লাসরুম ও মসজিদের মিম্বরে। এগুলোর কারণে সমগ্র দেশ পরিণত হয় সংসদে। জনগণের সে সংসদকে সমৃদ্ধ করতে অপরিহার্য হলো, কথা বলা ও লেখালেখির স্বাধীনতা। চাই, মিটিং-মিছিল ও সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের মুক্ত অঙ্গন। চাই, স্বাধীন পত্র-পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া। নির্বাচিত সদস্যদের সংসদে কথা বলতে হলে স্পিকারের অনুমতি লাগে। কিন্তু দেশব্যাপী বিস্তৃত সে সংসদে কথা বলতে কারো অনুমতি লাগে না। উন্মুক্ত এ গণসংসদে কথা বলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিচারপতি, উকিল, ধর্মীয় চিন্তাবিদ, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, পত্রিকার কলামিস্ট, লেখক, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, মানবাধিকার কর্মী, সমাজকর্মীসহ নানা পেশা ও নানা মতের মানুষ। ফলে সংসদে যা আলোচনা হয়, তার চেয়ে অধিক জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হয় জনগণের এ মুক্ত সংসদে। উদাহরণ স্বরূপ, বিলেতের পত্র-পত্রিকাগুলোতে যে মানের গভীর আলোচনা হয় তা কি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে হয়? বরং বাস্তবতা হলো, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্যদের লাগাতর শিখতে হয় পত্রিকার কলামগুলো থেকে। তা ছাড়া আরো সত্য বিষয় হলো, বছরের বেশিরভাগ দিন পার্লামেন্টের কোনো বৈঠক বসে না। যখন বসে তখনও অধিকাংশ সময় কেটে যায় সরকারি ও বিরোধীদলীয় এমপিদের রাজনৈতিক বিতর্কে; ফলে সেখানে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা বা গভীর চিন্তাভাবনার সুযোগ থাকে সামান্যই। অথচ বিলেতে পত্র-পত্রিকা একদিনের জন্যও বন্ধ হয় না। রাজপথে জনগণের সংসদ বসে প্রতিদিন। ফলে এমপিগণ পার্লামেন্টে বসে যা শেখে বা নির্দেশনা পায়, তার চেয়ে বহুগণ বেশি শেখে ও নির্দেশনা পায় পার্লামেন্টের বাইরে জমজমাট মুক্ত গণ-পার্লামেন্ট থেকে। দেশের জনগণও নিয়মিত জ্ঞান পায় এবং আলোকিত হয় সে গণসংসদের আলোচনা থেকে।
নিষিদ্ধ জনগণের সংসদ এবং বিজয় স্বৈরাচারের
তাই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সমাজ নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো দেশব্যাপী বিস্তৃত জনগণের উন্মুক্ত সংসদ। এ গণ-সংসদের আলোচনায় অংশ নেয় দেশের নীরব মেজোরিটি। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞ প্রসেফর, জ্ঞানসাধক বুদ্ধিজীবী, বিখ্যাত আলিম বা চিন্তাবিদদের সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া এবং সে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার সামর্থ থাকে না। ফলে সংসদে প্রবেশ করে নিজের অভিমত ব্যক্ত করার দরজা তাদের জন্য বন্ধ। সেটি এক আলাদা জগৎ। সংসদীয় নির্বাচনে জিততে হলে চাই অর্থ, চাই দল, চাই দলীয় মনোনয়ন, চাই দলীয় ক্যাডার, চাই জনগণের সামনে অভিনয়ের সামর্থ। সেগুলোই নির্বাচনে বিজয় আনে। কিন্তু বিজ্ঞ জ্ঞানসাধক হওয়ার জন্য এ সবের প্রয়োজন পড়ে না। তারা ঘরে বসে নিজের সামর্থ বাড়াতে পারেন এবং কথা বলেন দেশবাসীর উন্মুুক্ত সংসদে। দলীয় টিকিট ও দলীয় ক্যাডারদের সহযোগিতা পেতে হলে চাই দলীয় নেতার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য। চাই, দলীয় নেতার সদা চাটুকর হওয়ার সামর্থ। সে সামর্থ জ্ঞান-তাপসদের থাকে না। কিন্তু রাষ্ট্র, সমাজ ও জনগণের কল্যাণে তাদের সুচিন্তিত অভিমতগুলোকে কি অবহেলা করা যায়? সেটি করলে রাষ্ট্র ভয়ানক অকল্যাণের দিকে ছুটে চলে। তাদের মুখ দিয়ে বিবেক কথা বলে। রাষ্ট্র পরিচালনাকে তাই উন্নততর ও সভ্যতর করার ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ নির্বাচনই শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং অতি গুরুত্বপূর্ণ হলো রাজপথ, ময়দান, ক্লাসরুম, মসজিদ-মাদ্রাসা, রেডিও-টিভি ও পত্রপত্রিকায় মতামত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা। এগুলোই গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ ইনস্টিটিউশন। কিন্তু স্বৈর শাসকেরা এগুলোকে শত্রু মনে করে। ফলে কেড়ে নেয় এগুলোর স্বাধীনতা। ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টগণ এরূপ স্বাধীনচেতা বুদ্ধিজীবীদের শহুরে নকশাল বলে আখ্যায়িত করে।
স্রেফ নির্বাচনকে যারা গণতন্ত্র বলে- তাদের ভ্রান্তিটি মূলত গণতন্ত্র না বুঝায়। দেশের এ মুক্ত সংসদ বন্ধ করলে যেমন গণতন্ত্র বাঁচে না, তেমনি জনগণের স্বাধীনতাও বাঁচে না। দায়িত্বশীল ও জনকল্যাণশীল সরকারের দায়িত্ব তাই স্রেফ স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠান নয়, বরং চিন্তা-ভাবনা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বাঁচিয়ে রাখা এবং জনগণের সংসদ থেকে উত্থিত পরামর্শগুলেকে গ্রহণ করা। গণতান্ত্রিক রাজনীতির এখানেই প্রকৃত কল্যাণ। এতে সরকারের সাথে সংশ্লিষ্টতা বাড়ে জনগণের। এবং সেই সাথে সরকারের ওপর আস্থা বাড়ে জনগণেরও। সংসদের বাইরের মুক্ত সংসদের গুরুত্বটি অন্যদিক দিয়েও অপরিসীম। পার্লামেন্টের বাইরে যারা দেশ, সমাজ ও জনগণের কল্যাণ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে তারা যেমন সরকার পক্ষের হতে পারে, তেমনি বিপক্ষেরও হতে পারে। যেসব দেশে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪টির অধিক, সেসব দেশে ক্ষমতায় যেতে শতকরা ৩৫ ভাগের বেশি ভোটারের ভোট লাগে না। বাংলাদেশে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ এ দু’টি বড় দলের কারোই দলীয় ভোটারদের সংখ্যা শতকরা ৩৩-৩৫ ভাগের বেশি নয়। ফলে ক্ষমতায় গিয়ে তারা প্রতিনিধিত্ব করে সংখ্যালঘিষ্ঠ জনগণের। অথচ ক্ষমতাসীন দলের বাইরে থাকে বাকি শতকরা ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ ভোট। ফলে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বক্তব্য ধ্বনিত হয় পার্লামেন্টের বাইরে বসা জনগণের মুক্ত সংসদে। সেটি পত্র-পত্রিকা, মিটিং-মিছিল, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম ও ওয়াজ-মাহফিলের মাধ্যমে। ফলে তাদের মতামত অগ্রাহ্য করলে মারা পড়ে গণতন্ত্র। তখন প্রতিষ্ঠা পায় নির্বাচিত সংখ্যালঘিষ্ঠদের নিরেট স্বৈরতন্ত্র। বাস্তবতা হলো, স্বৈরাচারী সরকার যেমন ভোট-ডাকাতির মাধ্যমে সংসদকে অকার্যকর করে, তেমনি মতপ্রকাশের অধিকার কেড়ে নিয়ে অকার্যকর করে জনগণের মুক্ত সংসদকেও। স্বৈরাচারী সরকারের এটিই হলো সবচেয়ে বড় নাশকতা। অথচ অবিকল সেটিই ঘটেছে বাংলাদেশে- সেটি যেমন হয়েছে মুজিবের বাকশালী স্বৈরাচারে, তেমনি জেনারেল এরশাদ ও জেনারেল মঈনের সামরিক স্বৈরাচারেও। ঘটছে তা শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদে। এরা যেমন গণতন্ত্রের শত্রু, তেমনি জনগণের শত্রু। তাদের ডাকাতিটি জনগণের মৌলিক অধিকারের ওপর। পরিতাপের বিষয় হলো- জনগণ বাঁচছে সে শত্রুকে মাননীয় ও শ্রদ্ধেয় প্রধানমন্ত্রী বলে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিসট
আপনার মন্তব্য লিখুন