post

ভারসাম্যপূর্ণ জীবনগঠনে রাসূল সা.

ড. মুহাম্মাদ খলিলুর রহমান মাদানী

০৬ অক্টোবর ২০২৩

সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব মুহাম্মদ সা. ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী। রিসালাত কোনো শিক্ষা, যোগ্যতা বা অর্জনযোগ্য বিষয়ের নাম নয়। দক্ষতা, মেধা বা প্রতিভা দিয়ে এটি লাভ করা যায় না। চর্চা, অধ্যবসায়, অনুশীলন ও সাধনা দ্বারা দুনিয়ার অনেক কিছু অর্জন সম্ভব হলেও নবুওয়াত ও রিসালাত অর্জন সম্ভব নয়। এটি সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ তা‘আলার মনোনয়ন। মহান আল্লাহর পয়গাম মানবজাতির কাছে বহন করে আনা এবং তা প্রচার করার উদ্দেশ্যেই আল্লাহ নবী-রাসূল মনোনীত করেন। এ মর্মে কুরআনে এসেছে: ‘‘আল্লাহ ফেরেশতা ও মানবকুল থেকে রাসূল মনোনীত করে থাকেন।’’ (সূরা আল-হাজ: ৭৫)। বিশ্বনবী সা. সরাসরি আল্লাহ তাআলা নিয়ন্ত্রিত আদর্শ মহাপুরুষ এবং তাঁর জীবন ছিল সকল দিক থেকে ভারসাম্যপূর্ণ এবং সকলের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। মানব সমাজের উন্নতি, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থিক ও চারিত্রিক সবক্ষেত্রে গৌরবময় উত্তরণের পথই হলো তাঁর অনুসরণীয় আদর্শ। মনে রাখতে হবে, আদর্শহীন কোনো জনগোষ্ঠী পৃথিবীতে সমাদৃত হতে পারেনি আর পারবেও না। তাই আজকের এই অবক্ষয় মুহূর্তেও যদি মুসলিম উম্মাহ ফিরে পেতে চায় তাদের হারানো অতীত, তাহলে তাদের অনুসরণ করতে হবে প্রিয়নবী সা.-এর পবিত্র জীবনাদর্শ। সুতরাং সেই আদর্শের পথেই হোক আমাদের নবযাত্রা। আদর্শিক প্রত্যয়ে প্রাণবন্ত হয়ে উঠুক আমাদের সমাজ-জীবন। মহান আল্লাহ তাআলা যথার্থই বলেছেন: “নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম, সুন্দর, স্বচ্ছ অনুকরণীয় জীবনাদর্শ।” (সূরা আহজাব: ২১)।


বিশ্বনবীর সা. ভারসাম্যপূর্ণ জীবন

ভারসাম্যপূর্ণ জীবন গঠন করা ইসলামের শিক্ষা। প্রতিটি কাজের হক ঠিকমতো পালন করাই হলো ভারসাম্য। মহান আল্লাহ বলেন, ‘এভাবেই আমি তোমাদের এক মধ্যমপন্থী মানব দলে পরিণত করেছি, যেন তোমরা দুনিয়ার অন্যান্য মানুষের ওপর (হেদায়েতের) সাক্ষী হয়ে থাকতে পারো (এবং একইভাবে) রাসূল সা. তোমাদের সাক্ষী হয়ে থাকতে পারে’ (সূরা বাকারা: ১৪৩)। ইসলাম কৃপণতাকে সমর্থন করে না আবার অপচয়কেও করে না। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বনের নির্দেশনা দেয়। ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত এমন এক জীবনব্যবস্থা যা স্বাভাবিক স্বভাবসম্মত ও পরিপূর্ণভাবে ভারসাম্যপূর্ণ। মানব জীবনের কোনো একটি বিষয় বা দিকের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা এবং স্বাভাবিক ভারসাম্য বিনষ্ট করাকে ইসলাম কোনোক্রমেই সমর্থন করে না। ইসলাম শান্তিপূর্ণ ও নির্ভেজাল জীবনযাত্রার পূর্ণ বাস্তবায়ন ঘটাতে চায়। এ লক্ষ্যে ফিতনা-ফাসাদ ঝগড়া-বিসংবাদ ও দুর্নীতিমুক্ত নিষ্কলুষ জীবন গঠনে মহান আল্লাহ তাআলার খলিফা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ইবাদত-বন্দেগি, কায়-কারবার, মুয়ামালাত, রিসালাত, আমল ও আখলাকের সকল স্তরে এমন কিছু করা মোটেই ইসলামসম্মত নয়, যা দেহ ও মনের স্বভাবজাত চাহিদার বাস্তবায়নে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। রাসূলুল্লাহ সা. ও আল-কুরআনের মাধ্যমে যে দ্বীন বা জীবনব্যবস্থা প্রদান করেছেন, তা একান্তই ভারসাম্যপূর্ণ, স্বভাবসম্মত এবং মানবিক সামর্থ্যরে অনুকূলে।


মানবাধিকার ধারণা এবং তার বিকাশ সাধনে ভারসাম্য

মানুষকে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, জাতি, ধন-সম্পদ, জেন্ডার নির্বিশেষে সমভাবে দেখে তার সহজাত ও স্রষ্টা প্রদত্ত মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করাই হচ্ছে ‘মানব মর্যাদা’। মানুষের অস্তিত্ব ও স্বকীয়তা রক্ষা, সহজাত ক্ষমতা ও প্রতিভার সৃজনশীল বিকাশ ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের অধিকারকে সমুন্নত রাখার জন্য একান্তভাবে প্রয়োজনীয় কতিপয় অধিকার স্বত্বই হচ্ছে ‘মানব মর্যাদা’। মানুষের এই অধিকার তার জন্মগত এবং মানবিক মূল ও মর্যাদার সাথে সংশ্লিষ্ট। ঐতিহাসিকরা যে সময়কে ‘জাহেলিয়াতের বা অন্ধকার যুগ’ বলেছেন সেই সময়ে জন্মলাভ করেও ঝগড়া-বিবাদ, নরহত্যা, সম্পদ লুণ্ঠন, ব্যভিচার ইত্যাদি অকল্যাণকর, মানবতার জন্য চরম অবমাননাকর কর্মকাণ্ডে তিনি কখনো জড়িত হননি। অথচ তখনকার সমাজে যে কোনো যুবকের জন্য তা ছিল স্বাভাবিক। বরং তিনি ছিলেন এতিম, অসহায়, নির্যাতিতদের একমাত্র সহায়, সান্ত¡নাদানকারী, ধন-সম্পদের আমানতকারী এবং অনেকক্ষেত্রে আশ্রয়দাতা। চুরি-ডাকাতির ভয়ে ভীত, আতঙ্কিত মানুষ তাঁর কাছে হাজির হয়ে তাদের মূল্যবান সম্পদ আমানত রেখে যেত, আর তিনি সেই আমানতের যথাযথ হেফাজত করতেন এবং যথারীতি তা ফেরত দিতেন। এভাবে নবুয়ত লাভের অনেক আগেই আরববাসী তাঁকে ‘আল-আমিন’ বা ‘পরম বিশ্বস্ত’ খেতাবে ভূষিত করেছিল। সকল মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা, মানবিক মূল্যবোধকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার এই উদাহরণ তাঁর জীবনের শুরু থেকেই আজীবন নানাভাবে দেখা গিয়েছিল। পরবর্তীকালে যখন তিনি গোটা আরব জাহানের নেতা হয়ে ওঠলেন তখন তিনি কী সমাজজীবনে, কী পারিবারিক জীবনে, কী রাষ্ট্রীয় তথা নাগরিক জীবনে, কী বিশ্ব নাগরিক হিসেবে- সর্বক্ষেত্রে মানুষের মূল্য-মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকারের যে সার্বজনীন আদর্শ প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন আজ পর্যন্ত সারা বিশ্বের ইতিহাসে তা বিরল, অভূতপূর্ব।

মানুষের বেঁচে থাকার ও নিরাপত্তা লাভের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভারসাম্য

মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মানুষের জীবনে অধিকার ও জান-মালের নিরাপত্তা বিধানের ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করেছেন। নরহত্যা যেখানে নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল সেখানে নরহত্যাকে জঘন্য অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন- “সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ হচ্ছে আল্লাহর সঙ্গে কাউকে অংশীদার বানানো এবং মানুষকে হত্যা করা।” মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আরো বলেছেন: “কোনো মু‘আহিদকে (মুসলিম রাষ্ট্রে অবস্থানরত চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিককে) হত্যাকারী জান্নাতের সুঘ্রাণ পর্যন্ত পাবে না। যদিও জান্নাতের সুঘ্রাণ ৪০ বছর দূরত্ব থেকে পাওয়া যায়।’’ বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণে (যাকে মানবাধিকারের আদি সনদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়) মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “হে মানবজাতি! নিশ্চয়ই তোমাদের জীবন, সম্পদ এবং সম্ভ্রম তোমাদের প্রভুর সম্মুখে উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত (অবৈধ হস্তক্ষেপ থেকে) পবিত্র।” মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আত্মহত্যাকে নিষিদ্ধ করেছেন এবং আত্মহত্যাকারী তার নিজের জীবন নিজেই শেষ করে দেওয়ার শাস্তি হিসেবে আত্মহত্যার অনুরূপ পন্থায় দোজখে শাস্তিভোগ করবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। (বুখারি : ১২৭৭)। আল-কুরআনে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে, “আল্লাহ তাআলা শক্তির বহির্ভূত কোনো বোঝা কারো ওপর চাপিয়ে দেন না” (সূরা: ২৮৬)। এতে বুঝা যায় যে, জীবনের সকল অবস্থাতেই এই ভারসাম্যকে রক্ষা করে চলতে হবে এবং নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব কর্তব্য নিষ্ঠার সাথে পালন করতে হবে। কোনোক্রমেই শরিয়ত কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ভারসাম্য নষ্ট করা যাবে না।

জন্মের পর থেকেই রাসূল সা. এর মাঝে বিরাজ করেছিল সর্বোত্তম চরিত্র মাধুর্য, সর্বোত্তম আদর্শ, সর্বোত্তম মহৎ মানুষ ও সর্বোত্তম প্রতিবেশী ইত্যাকার মহত্তম গুণ। বাল্যকাল থেকেই তাঁর স্বভাব ছিল কলুষতা, কাঠিন্য, কর্কশতা ও অহমিকামুক্ত। তিনি ছিলেন দয়াশীল, শ্রদ্ধাশীল সহানুভূতিশীল ও ঔদার্যশীল এবং নিষ্কলুষ নির্ভেজাল সোনা। তাইতো অতি অল্প বয়সেই ‘আল-আমিন’ উপাধিতে বিভূষিত হন। অধিকন্তু পরনিন্দা, অশ্লীল ও অশিষ্ট বাক্য কখনই তাঁর পবিত্র মুখ হতে নিঃসৃত হয়নি। এক কথায় তিনি হলেন, সকল গুণের আধার। 


ব্যক্তিজীবনে ভারসাম্য

রাসূলুল্লাহ সা. সর্বগুণে গুণান্বিত ছিলেন। তিনি সদা প্রফুল্লচিত্ত, কোমল চরিত্রের অধিকারী ও সরল হৃদয়বান ছিলেন। তিনি রূঢ় স্বভাবের ছিলেন না, নির্দয় প্রকৃতিরও ছিলেন না, নির্লজ্জ, গিবতকারী ও বিদ্রƒপকারী ছিলেন না। অতিরিক্ত গুণকীর্তনকারী ছিলেন না, মনে চায় না- এমন বস্তু থেকে বিমুখ থাকতেন, কিন্তু কাউকে তা থেকে নিরাশ করতেন না। কেউ ডাকলে সাড়া দিতেন, কেউ উপহার দিলে গ্রহণ করতেন- যদিও তা ছাগলের খুর হতো এবং তার উত্তম প্রতিদান দিতেন। তাঁকে কোনো সাহাবি বা পরিবারের সদস্য ডাকলে লাব্বাইক বলে সাড়া দিতেন। তিনি সাহাবাদের সঙ্গে রসিকতা করতেন। তাদের সন্তানদের সঙ্গে খেলা করতেন এবং নিজের কোলে বসাতেন। মদিনার দূর প্রান্তে বসবাসকারী কেউ অসুস্থ হলে তারও খোঁজ-খবর নিতেন। আবেদনকারীর আবেদন গ্রহণ করতেন।


পরিবারিক জীবনে ভারসাম্য

রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন: “বিবাহ আমার সুন্নাহ, যে আমার সুন্নাহর প্রতি অনাসক্ত হয় সে আমার আদর্শভুক্ত নয়।” (মুসলিম : ১৪০১)। তিনি আরো বলেছেন: “ইসলামে সন্ন্যাসব্রত বা বৈরাগ্যপ্রথার অনুমোদন নেই।” প্রকৃতপক্ষে ইসলামে ‘বিবাহ’ কেবলমাত্র জৈবিক চাহিদা পূরণের পন্থাই নয়, বরং পারস্পরিক ভালোবাসা, সমঝোতা, সমবেদনা ও নির্ভরশীলতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান। বিবাহের পাশাপাশি পারিবারিক জীবনকে ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ‘যেহেতু স্বামী-স্ত্রীই হলো পরিবারের মূল ভিত্তি এবং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্কের ওপরই প্রাথমিকভাবে পারিবারিক জীবনের শান্তি ও সুখ নির্ভর করে তাই পারিবারিক জীবনে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কেমন হবে এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়ে পবিত্র কুরআনুল কারিমে ঘোষণা করা হয়েছে: “তাঁরা (স্ত্রীগণ) হবে তোমাদের (স্বামীদের) ভূষণ আর তোমরা (স্বামীগণ) তাদের (স্ত্রীদের) ভূষণ।” (সূরা বাকারা : ১৮৭)। 


অধীনস্থদের প্রতি ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ

দাসত্বের পরাধীনতা এক চরম অমানবিক ও অবমাননাকর অধ্যায়। এর প্রচলন ছিল বিশ্বব্যাপী এবং ১৮৯০ সালে ব্রাসেলসে দাস-ব্যবসা নিষিদ্ধকরণ কনফারেন্সের পূর্ব পর্যন্ত বিশ্বের কোথাও এ ব্যবস্থার বিরুদ্ধাচরণ করা হয়নি। গ্রিক, রোমান, পারসিক প্রভৃতি প্রাচীন সভ্যতাসমূহে, ইহুদি, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ও সনাতন হিন্দু ধর্মে এমনকি আধুনিক ইউরোপ এবং আমেরিকাতেও প্রথমদিকে দাসপ্রথা স্বীকৃত প্রথার মর্যাদা পায়। এ থেকে অনুমিত হয় যে, এ প্রথাটির নৈতিকতা সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির প্রাথমিক কাজ করেন মহানবী সা.। তিনি বলেন: সমগ্র মানবজাতি একজন নারী ও পুরুষ থেকে সৃষ্টি, সুতরাং জন্মগতভাবে সকল মানুষ সমান ও স্বাধীন। তিনি আরো বলেন: “যে ব্যক্তি স্বীয় দাসীকে শিক্ষা-দীক্ষায় উন্নত করার পর মুক্ত করে বিবাহ করবে সে দ্বিগুণ সওয়াব পাবে ...।” (আবু দাউদ: ২০৪৯)। বলা বাহুল্য, মহানবী সা.-এর এসব বাণী ও নীতিমালার ফলে বহু দাস-দাসী তাদের দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করে। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সা.-এর দাসপ্রথা বিরোধী এসব নীতিমালা ও সক্রিয় নেতৃত্বের সুদূরপ্রসারী ফল হিসেবে খলিফাদের আমলে আরবের সকল দাস-দাসী স্বাধীনতা লাভ করে এবং আরবের দাসপ্রথার সমাধান এভাবে চল্লিশ বছরের মধ্যে সম্পন্ন হয়েছিল।


নিপীড়ন-নির্যাতন, নিষ্ঠুরতা ও অমানবিক আচরণ থেকে মুক্তির ভারসাম্য নীতি

শান্তিপূর্ণ পরিবেশে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কোনো ব্যক্তিকে শারীরিক-মানসিক শাস্তিদান বা তাকে কষ্ট দেওয়াকে রাসূল সা. সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি বলেছেন, “প্রকৃত মুসলিম হচ্ছে সে ব্যক্তি যার কথা বা হাত থেকে মুসলিমগণ নিরাপদ থাকেন।” (মুসনাদে আহমদ: ৬৬৩১)। এমনকি এক্ষেত্রে অমুসলিম নাগরিকগণের অধিকার সম্পর্কে অত্যন্ত দৃঢ় ভাষায় তিনি বলেছেন: “মনে রেখো! যদি কোনো মুসলিম অমুসলিম নাগরিকের ওপর নিপীড়ন চালায়, তার অধিকার খর্ব করে, তার ওপর সাধ্যাতীত বোঝা (জিজিয়া বা প্রতিরক্ষা কর) চাপিয়ে দেয় অথবা তার কোনো বস্তু জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয় তাহলে কিয়ামতের দিন আমি আল্লাহর আদালতে তার বিরুদ্ধে মামলা করবো।” (মিশকাত : ৪০৪৭)।


অবাধ ও স্বাধীন বিচারব্যবস্থার অধীনে ন্যায়বিচার লাভের ভারসাম্য নীতি

বিশ্বনবীর সা. প্রবর্তিত রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থায় ধর্ম, বর্ণ, রাজনৈতিক-সামাজিক- পেশাগত মর্যাদা নির্বিশেষে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক একটি নিরপেক্ষ, অবাধ ও স্বাধীন বিচারব্যবস্থার অধীনে স্বাভাবিক ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার লাভ করে। মূলত ন্যায়বিচার ধারণার ওপর ইসলামে এতটা গুরুত্ব আরোপ করা হযেছে যে, কুরআনে প্রায় ষাটটি আয়াতে এ সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে আলোচনা করা হয়েছে। একটি আয়াতে বলা হয়েছে, “তোমরা ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকো এবং আল্লাহর জন্য ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্য দাও, তাতে যদি তোমাদের পিতা-মাতা কিংবা আত্মীয়-স্বজনদের ক্ষতি হয় তবুও।” (সূরা আন-নিসা : ১৩৫)।


শান্তি, সাম্য ও মৈত্রী প্রতিষ্ঠায় ভারসাম্য নীতি

আল্লাহ তাআলা স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন যে, “আমি তোমাকে সমগ্র সৃষ্টির জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি”, (সূরা আম্বিয়া: ১০৭)। কুরআনের এ বাণী পরিপূর্ণভাবে সত্যে পরিণত করেছিলেন রাসূল সা.। সমাজ, রাষ্ট্র ও সমগ্র মানবজাতির ভ্রাতৃত্ব, শান্তি, সাম্য ও মৈত্রী প্রতিষ্ঠায় তিনি যে অনন্য সাধারণ উদাহরণ রেখে গেছেন পৃথিবীর ইতিহাসে তা আজো অদ্বিতীয় এবং সর্বজন-স্বীকৃত অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। কেননা তিনি কেবল মুসলিমদের আদর্শ ছিলেন না, ছিলেন গোটা মানবজাতির আদর্শ। আল্লাহ তাঁকে এই মর্মে ঘোষণা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন: “বলুন (হে মুহাম্মাদ), হে মানবজাতি, আমি তোমাদের সবার জন্য আল্লাহর রসূল।” (সূরা আরাফ : ১৫৮)। মনে রাখতে হবে, তিনি যুদ্ধ করেছিলেন সম্পূর্ণভাবে পবিত্র কুরআনের এই নীতিমালার অধীনে: “তাদেরকে যুদ্ধের (কিতাল) অনুমতি দেওয়া হলো, যারা আক্রান্ত হয়েছে, কেননা তাদের ওপর জুলুম করা হয়েছে।” (সূরা হজ: ৩৯)। “যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তোমরাও তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর রাহে যুদ্ধ করো কিন্তু সীমালঙ্ঘন করো না। আল্লাহ সীমালংঘনকারীদের পছন্দ করেন না।” (সূরা বাকারা : ১৯০)।

বংশমর্যাদা আর জাত্যাভিমানের সেই যুগে তিনিই প্রথম শান্তি আর সাম্য প্রতিষ্ঠায় এই মহান বাণী প্রচার করেন যে, “তাকওয়া (খোদা ভীরুতা) ছাড়া অন্য কোনো কারণে অনারবদের ওপর আরবদের কোনো মর্যাদা নেই। সাদা কালোর প্রতি এবং কালো সাদার প্রতি বৈষম্য ছোট বা বড় নয়। তাই তো তিনি হাবসি গোলাম বেলাল রা.-কে পৃথিবীর প্রথম মুয়াজ্জিনের মর্যাদা দিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। উপঢৌকন পাওয়া ক্রীতদাস জায়েদ বিন হারিসকে কেবল আজাদই করেছিলেন তা নয়, নিজের ফুপাতো বোন জয়নাবের সাথে তার বিয়ে দিয়ে পরিবারের একজন করে নিয়েছেন। নাগরিক অধিকারের প্রশ্নে অমুসলিমদেরকেও তিনি সমান অধিকার দিয়েছেন। তাঁর স্পষ্ট নির্দেশ: “ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসরত অমুসলিমদের রক্ত আমাদের রক্তের মতোই পবিত্র। তাদের ধন-সম্পদ আমাদের ধন-সম্পদের মতোই হিফাজতযোগ্য।” (আল বুরহান, ২য় খণ্ড: ২৮২ পৃষ্ঠা)। নাগরিক সাম্য ও মৈত্রীর এই মহান নীতি ইসলাম ও মুসলিম শক্তি ভিন্নধর্মী কোনো নাগরিকের ওপরেই জবরদস্তিমূলকভাবে ইসলাম চাপিয়ে দেয়নি, যার ছোট একটা উদাহরণ এই যে, প্রায় এক হাজার বছর মুসলিমরা এ উপমহাদেশে শাসনকালেও মুসলিম জনসংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার মাত্র এক-চতুর্থাংশ।


দয়া, ক্ষমা ও শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভারসাম্য নীতি:

মহানবী সা. ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু, ক্ষমাশীল ও কোমল। দয়া, ক্ষমা, শান্তি ও সাম্যের প্রতিরূপ এই মহামানব স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন, ‘যে মানুষকে দয়া করে না, আল্লাহ পাক তাকেও দয়া করেন না।’ (বুখারি: ৬০১৩)। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতি দয়া ও ক্ষমা প্রদর্শনকে তিনি নানাভাবে উৎসাহিত করেছেন। অন্য একটি হাদিসে মহানবী সা. বলেন: ‘পৃথিবীতে যারা আছে তাদের প্রতি দয়া কর। আসমানে-ঊর্ধ্বালোকে যারা আছেন আর তারা তোমার প্রতি সদয় হবেন।’ (তিরমিজি: ২০০৬)। অন্যদিকে শ্রমিক অধীনস্থ কর্মচারী চাকর-চাকরানীদের প্রতি সদয় ব্যবহার করা, তাদেরকে নিজেদের অনুরূপ খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-আশাক, বিশ্রাম ইত্যাদির ব্যবস্থা করতেও তিনি বারংবার তাগিদ দিয়েছেন। বস্তুত বিশ্বনবী সা. শ্রমিকদের সব প্রকার বঞ্চনা, অত্যাচার, নিপীড়ন আর গ্লানির অবসান করে এমনসব শ্রমনীতির প্রবর্তন কওে গিেেছন যার সিকি শতাংশও জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা (আই. এল. ও) বিগত প্রায় দেড়শ বছর ধরে মে দিবস উদ্‌যাপনের মাধ্যমেও প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।’

বুখারি ও মুসলিমের উদ্ধৃত এক হাদিসে নবী সা. স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন: শক্তি-সামর্থ্যের অতিরিক্ত কাজ শ্রমিকদের ওপর চাপাবে না। শ্রেষ্ঠ নবী হওয়া সত্ত্বেও নিজে শ্রমিকের কাজ করেছেন। কখনো বাণিজ্য প্রতিনিধি হিসাবে, নিজ হাতে জুতা সেলাই করে, খন্দকের যুদ্ধে পরিখা খনন রে, পরিখা খননে বাধাগ্রস্ত বড় বড় পাথরকে কুঠারের আঘাতে টুকরো করে, সঙ্গী-সাথিদের জন্য রান্নার কাঠ সংগ্রহে নিজ হাতে কুঠার ধরে, শ্রমিককে ভাই সম্বোধন করে, শ্রম ও শ্রমিকের মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি বলেছেন শ্রমকে তাচ্ছিল্য করো না, কারণ শ্রম আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম। তিনি আরো বলেন, সকল নবী-রাসূলই মেষচারী ছিলেন। বিদায় হজের ভাষণে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তিনি নির্দেশ দেন: ‘সতর্ক থাকিও, সতর্ক থাকিও দাস-দাসী সম্পর্কে। তোমরা যেরূপ খাবে তাদেরও অবশ্যই খাওয়ার ব্যবস্থা করিবে। তোমরা যেরূপ পরবে তাদেরও পরার ব্যবস্থা করবে।’ (আদাবুল মুফরাদ: ১৮৮)। এভাবে শান্তি, মৈত্রী, ক্ষমা, দয়া শ্রমের মর্যাদা ও ন্যায়বিচারের যে মহান আদর্শ মহানবী সা. রেখে গেছেন নিজের জীবনে তাঁর প্রতিষ্ঠা করে এক অতুলনীয় দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তাঁর এই গুণাবলি ও দৃষ্টিভঙ্গিতে মুগ্ধ হয়ে বিখ্যাত দার্শনিক, সাহিত্যিক ‘জর্জ বার্নার্ড শ’ বলতে কুণ্ঠাবোধ করেননি যে, “If all the world was united under one leader, Mohammad would have been the best fitted man to lead the peoples of various creeds, dogmas and ideas to peace and happiness.”


নারী অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ভারসাম্য নীতি 

জাহেলি যুগে নারীকে ‘ভোগের বস্তু’, ‘লাঞ্ছনা’ ও ‘পাপের প্রতিমূর্তি’ এবং কোথাও কোথাও অন্যান্য অস্থাবর সম্পত্তির মতো ‘সম্পত্তি’ বলে মনে করা হতো। পবিত্র কুরআনে সূরা আন্-নাহলে আল্লাহ পাক নিজেই তৎকালীন সমাজে নারী সম্পর্কে মানুষের মানসিকতাকে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। “যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হয় তার মুখমণ্ডল কালো হয়ে যায়, সে অসহনীয় মনস্তাপে ক্লিষ্ট হয়। তাকে যে সংবাদ দেওয়া হয় গ্লানি হেতু সে নিজ সম্প্রদায় হতে আত্মগোপন করে। সে চিন্তা করে হানীতা সত্ত্বেও সে তা রেখে দেবে না মাটিতে পুঁতে দেবে।” (আয়াত ৫৮-৫৯)। রাসূল সা.-এর প্রথম পদক্ষেপ ছিল কন্যাশিশু হত্যা বন্ধ করা। তিনি বরং কন্যা শিশুর লালন-পালনকে নানাভাবে উৎসাহিত করেছেন এবং নিজেও তাঁর কন্যাদের লালন-পালন কালে সেটা করে দেখিয়েছেন। পিতাদের তিনি স্পষ্ট বলে দিয়েছেন: ‘কন্যা তার জন্য লজ্জাকর নয় বরং কন্যাসন্তান প্রতিপালন তার জন্য জাহান্নামের পথে বাধা এবং জান্নাত লাভের মাধ্যম হতে পারে।’ তিনি আরো বলেন, “যদি কারো কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করে এবং সে তাদেরকে সন্তুষ্ট চিত্তে লালন-পালন করে তাহলে তার জন্য দোজখের প্রতিবন্ধক-ঢাল হবে।” (তিরমিজি: ১৯১৩)। রাসূল সা. বলেছেন, “যার কন্যাসন্তান আছে সে যদি তাকে জীবন্ত কবর না দেয়, তাকে লাঞ্ছিত না করে এবং তার তুলনায় পুত্রসন্তানদের অধিক গুরুত্ব না দেয়, তবে আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।” (তিরমিজি: ১৯১২)।

রাসূলুল্লাহ সা. ঘোষণা করেন, “পুরুষদের জন্য পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় নেয়ামত হচ্ছে ‘উত্তম স্ত্রী’।” (ইবনে মাজাহ : ১৮৫৫)। অন্যদিকে নারীকে তিনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পরে সবচেয়ে বেশি মর্যাদার অধিকারী করে বলেছেন, আল্লাহ ও রাসূলের পরে সবচেয়ে বেশি সম্মান, মর্যাদা ও সদ্ব্যবহার পাবার যোগ্য ‘মা’। সন্তানের কাছে মায়ের এতবড় সম্মান, এত বড় মর্যাদা মানবেতিহাসে তাঁর মতো করে আর কোনো মহাপুরুষ বা রাষ্ট্রনায়ক প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হননি।

মহানবী সা. নারীকে শুধু বাঁচিয়ে রেখে সম্মান ও মর্যাদা দিয়েই ক্ষান্ত হননি, তিনি নারীকে যথাযথ অধিকার দিয়ে সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। নারীকে তিনি অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষাগত, আইনগত এবং ধর্মীয়; সব দিক দিয়ে অধিকার নিশ্চিত করেছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর বৈপ্লবিক সিদ্ধান্তসমূহকে সংক্ষেপে এভাবে উল্লেখ করা যায়:

ক. নারীকে পিতার সম্পত্তিতে, স্বামী, সন্তান ও মায়ের সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী ধার্য করা হয়েছে

খ. বিয়ের সময় নারীকে মোহরানা বা দেনমোহর প্রাপ্তি আবশ্যিক করেছেন এবং তা আদায় না করার বা তা থেকে জোর করে ব্যয় করার অধিকার স্বামী, পিতা বা ভাই কাউকে দেওয়া হয়নি;

গ. নারীকে স্বামী নির্বাচনের পূর্ণ অধিকার দেওয়া হয়েছে এবং ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে কোথাও বিয়ে দেয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অন্যদিকে একজন অকর্মণ্য, অত্যাচারী স্বামী থেকে বিবাহ বিচ্ছেদের পূর্ণ অধিকার নারীকে দেয়া হয়েছে। একই সাথে বিধবা ও তালাকপ্রাপ্তা নারীকে দ্বিতীয় বিবাহের বা পুনর্বিবাহের পূর্ণ অধিকার দেওয়া হয়েছে;

ঘ. দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনে নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য করেননি তিনি;

ঙ. জ্ঞানার্জন করার ব্যাপারে নারীকে পুরুষের মতোই সমান অধিকার দেওয়া হয়েছে। রাসূল সা. বলেন- “জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য ফরজ বা অবশ্য কর্তব্য।”

চ. অত্যাচার, অপমান, অশালীনতা ও অবমাননা থেকে নারীকে রক্ষার জন্য মহানবী সা. মহিলাদের পোশাক পরিধানে ও জনসমক্ষে চলাফেরার সময় একটি অনুসরণীয় পোশাক-বিধি মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছেন। 


বৃহত্তর সমাজ-জীবনে শান্তি, সাম্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভারসাম্য নীতি

মুহাম্মাদ সা. নিজ পরিবার, আত্মীয়-স্বজনের পর দৃঢ়ভাবে প্রতিবেশীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। মেহমানদের প্রতিও তিনি ভারসাম্য নীতি নির্ধারিত করেছেন। তাঁর মতে- “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষদিনে ঈমান রাখে, সে যেন অবশ্যই মেহমানের সম্মান করে, প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয় এবং অবশ্যই ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে।” (বুখারি : ২৫০৩, ২৫০৫)। মানুষ আজকের দিনেও তার অন্যান্য প্রতিবেশীদের অনিষ্ট থেকে মুক্ত নয়- অথচ নবী করীম সা. বারবার প্রতিবেশীর- তা সে যে ধর্ম, বর্ণ, যে গোত্রেরই হোক না কেন- সন্তুষ্টি ও তার সাথে ন্যায় বিচারের কথা বলেছেন। অত্যন্ত কঠোর ভাষায় তিনি ঘোষণা করেন: “আল্লাহ্‌র কসম! সে লোক মুমিন নয়, আল্লাহ্‌র কসম! সে লোক মুমিন নয়, আল্লাহ্‌র কসম! সে লোক মুমিন নয় যে লোকের অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী (তা সে যে-ই হোক) নিরাপদ নয়।” (মিশকাত : ৪৯৬২)। সামাজিক শান্তির এর চেয়ে বড় দলিল আর কী হতে পারে?


উপসংহার

বিশ্বনবীর ভারসাম্যপূর্ণ নির্দেশনা ও নবুওয়াত মানুষের ধ্যান-ধারণা, আকিদা-বিশ্বাস, নৈতিকতা ও সামাজিকতা, সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং জ্ঞান ও শিক্ষার ক্ষেত্রে এমন বিশেষ অবদান রেখেছেন যা কিয়ামত পর্যন্ত কায়েম থাকবে। তাঁর আগমনের সুবাদে জুলুম-অত্যাচারের পরিবর্তে ন্যায় ও সুবিচার, মূর্খতার পরিবর্তে জ্ঞান ও ভব্যতা, অন্যায়-অপরাধের পরিবর্তে আনুগত্য ও ইবাদত, অবাধ্যতা ও দাম্ভিকতার পরিবর্তে বিনয় ও নম্রতা, স্বেচ্ছাচারী ও নিপীড়নের পরিবর্তে ধৈর্য, কুফর ও শিরকের পরিবর্তে ঈমান ও তাওহিদ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। তাঁর নবুয়ত স্নেহ-দয়া, প্রেম-ভালোবাসা ও অনুগ্রহ-অনুকম্পার বাণী শুনিয়েছে। তাঁর দাওয়াত, মানব জীবন ও মানবিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে যে অলৌকিক কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছে, তার দৃষ্টান্ত খুবই বিরল। তিনি স্বীয় শিক্ষার বদৌলতে মানবতাকে অধঃপতনের অতল গহ্বর হতে উদ্ধার করে অগ্রগতি ও উন্নতির চরম শেখরে সমাসীন করেছেন। তিনি ঈমানের আলো ও জ্যোতি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন। তাঁর আবির্ভাবের ফলে মানুষের আত্মা আলো লাভ করেছে এবং শিরক, কুফর ও ভ্রষ্টতার অন্ধকার দূরীভূত হয়েছে। তাঁর আগমনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল দুনিয়ায় প্রচলিত ও প্রচারিত যাবতীয় মতাদর্শের অসারতা প্রমাণ কওে দ্বীনের শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা দেওয়া এবং দ্বীনকে বিজয়ী আদর্শ হিসেবে মানুষের মাঝে তুলে ধরে। তাই তিনি হেদায়াত ও সত্য দ্বীন সহকারে এ ধরাধামে আগমন করেছেন। এ মর্মে কুরআনে এসেছে: ‘‘তিনি সেই সত্তা (আল্লাহ) যিনি তাঁর রাসূলকে হিদায়াত ও সত্য দীনসহ প্রেরণ করেছেন, যাতে অপরাপর সকল দীন ও মতাদর্শের ওপর একে (ইসলামকে) বিজয়ী ঘোষণা দেওয়া যায়।’’ (সূরা আস-সাফ: ০৯)।

লেখক : বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গবেষক, উপাধ্যক্ষ, 

তা’মিরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসা, ঢাকা

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির