post

ভয়াল ২৮ অক্টোবর বিদেশী প্রচারমাধ্যমে ফুটে ওঠে নির্মম চিত্র

সামছুল আরেফীন

০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩

আটাশে অক্টোবর এক রক্তাক্তের ইতিহাস। রাজপথে প্রকাশ্য দিবালোকে নির্মমভাবে মানুষ হত্যা করার ইতিহাস। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠা দিয়ে মানুষ হত্যার চিত্র পরদিন শুধু দেশীয় মিডিয়াই যে ফুটে ওঠেছিলো তা নয়, আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়ও তা ঝড় তুলেছিল। নিন্দা আর প্রতিবাদের ঝড় ওঠেছিলো জাতিসংঘের তদানীন্তন মহাসচিবসহ দেশ ও বিদেশের বিবেকবান মানুষের পক্ষ থেকে। 

২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর পল্টন এলাকায় লগি-বৈঠা, পিস্তল ও বোমার মাধ্যমে যেভাবে মানুষ খুন করা হয়েছে তা সভ্য সমাজের জন্য একটি কলঙ্কজনক ঘটনা। তাদের পৈশাচিকতা ও বর্বরতার হাত থেকে রেহাই পায়নি মায়ের কোলের শিশু, নারী, বৃদ্ধ এবং নিরীহ জনগণও।

চারদলীয় জোট সরকারের ৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরীর উদ্যোগে বায়তুল মোকাররমের উত্তর সড়কে বিকেল ৩টায় এক সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল। সকাল থেকেই চলছিল মঞ্চ তৈরির কাজ। হঠাৎ করেই সকাল ১১টার দিকে লাঠি, বৈঠা, লগি ও অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা জামায়াতের সমাবেশস্থল দখল করার জন্য হামলা চালায়। এই হামলায় পিস্তলসহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার হয় বলে সে সময় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছিলেন। তাদের হামলায় মারাত্মকভাবে আহত হয় জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের অসংখ্য নেতা-কর্মী। তাদের এই আক্রমণ ছিল সুপরিকল্পিত ও ভয়াবহ। এক পর্যায়ে সন্ত্রাসীরা পল্টনের বিভিন্ন গলিতে ঢুকে পড়ে এবং নিরীহ জামায়াত-শিবির কর্মীদের বেধড়ক পেটাতে থাকে। তারা শিবির নেতা মুজাহিদুল ইসলামকে লাঠি ও বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে।

সেদিন জামায়াত কর্মী জসীম উদ্দিন লগি-বৈঠা বাহিনীর নির্মমতার শিকার হন। লগি-বৈঠা বাহিনী তাঁকে আঘাতের পর আঘাত দিয়ে হত্যা করে। তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরও সন্ত্রাসীরা সাপ মারার মতো পেটাতে থাকে এবং লগি দিয়ে তাঁর মুখে আঘাত করে। তারা তাঁর লাশের ওপর নৃত্য করে উল্লাসও প্রকাশ করে। যা সেদিন স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হয়।

দফায় দফায় তাদের হামলায় সেদিন শিবিরের ছয়জন শহীদ হয় ও আহত হয় ৬ শতাধিক। হামলায় পুরো সময়টা জুড়ে পুলিশের ভূমিকা ছিল রহস্যজনক। পুলিশের উপস্থিতিতেই ১৪ দলের আগ্নেয়াস্ত্র ও লগি-বৈঠাধারী সন্ত্রাসীরা জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালায়। কেন যেন এ সময় পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। জামায়াতের সভাস্থলে সন্ত্রাসীদের হামলায় এক পর্যায়ে বেলা ২টার দিকে পল্টন মোড়ে উভয় পক্ষের মাঝে পুলিশ অবস্থান নেয়। বিকেলে জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বক্তৃতা চলাকালে লগি-বৈঠাধারী সন্ত্রাসী বাহিনী উপর্যুপরি বোমা ও আগ্নেয়াস্ত্র হামলা শুরু করলে পুলিশ চুপচাপ সরে পড়ে। পুলিশ “লগি বৈঠা কাস্তে বা অন্য কোনো অস্ত্রশস্ত্র বহন নিষিদ্ধ ও বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ” ঘোষণা করলেও সেদিন লগি বৈঠাধারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

ঢাকায় প্রকাশ্য দিবালোকে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের হত্যার দৃশ্য আন্তর্জাতিক মিডিয়া ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে। যুক্তরাজ্যে সিএনএন, এবিসি, এনবিসি, সিবিএসসহ বিভিন্ন মিডিয়াতে পিটিয়ে হত্যার ঐ দৃশ্যটি বারবার প্রদর্শিত হয়েছে। নিউ ইয়র্ক সিটির টাইমস স্কয়ারে রয়টার হেড কোয়ার্টারের ওপর স্থাপিত বিশাল টেলিভিশন স্ক্রিনে ওয়ার্ল্ড নিউজের শিরোনামে বাংলাদেশ ঘটনাবলির মধ্যে ঐ দৃশ্যটি প্রদর্শিত হয়েছে বারবার। আমেরিকানদের অনেকেই সেই ঘটনায় বীভৎসতা দেখে বিস্মিত হন। 

নিউ ইয়র্ক থেকে ‘নিউজ ওয়ার্ল্ড’ পরিবেশিত খবরে বলা হয়, “নিউ ইয়র্ক বাংলাদেশী অনেকেই তাদের সন্তান-সন্ততিরা যাতে জীবন্ত মানুষ হত্যার দৃশ্য না দেখে সে জন্য টেলিভিশনের অনুষ্ঠান দেখাই বন্ধ রেখেছিলেন।” 

তাইওয়ানের ‘টাইপেই টাইমস’ এ বলা হয়, “প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের বিক্ষোভে দেশব্যাপী ২১ জন নিহত হয়েছে। সহিংসতা ঠেকাতে তিন দিন পর কেবল রাজধানী ঢাকায় ১৫ হাজার পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়। এছাড়া দেশব্যাপী আরো ১২ হাজার পুলিশ মোতায়েন করা হয়। সাতক্ষীরা জেলায় আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলায় জামায়াতে ইসলামীর আরো একজন নেতা নিহত হয়েছেন বলে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়।”

‘ইউপিআই’ নামক ‘অস্ট্রেলিয়া প্রচার মাধ্যমে বলা হয়, বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত কয়েক দিন অন্তত পক্ষে ১৪ জন নিহত এবং কয়েক শ’ লোক আহত হয়। আওয়ামী লীগের সমর্থকরা ঢাকায় সকল রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেয়।’ 

ভারতের ‘এশিয়ান ট্রিবিউন ডট কম’ জানায়, ‘বাংলাদেশ সহিংসতার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। বিরোধী আওয়ামী লীগ এবং ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের মধ্যকার সহিংসতায় এ পর্যন্ত নিহত হয়েছে ১২ জন এ ছাড়া আহত হয় দুই সহস্রাধিক।’ ভারতের ‘তেলেগু পোর্টাল’ জানায়, ‘১৪ দলীয় বিরোধী জোট সহিংস আন্দোলন অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। গত দু’দিনের সহিংসতায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ১৭ জন কর্মী প্রাণ হারায়। এর মধ্যে শনিবার ১৪ জন এবং রোববার ৩ জন কর্মী নিহত হয়।’ 

অস্ট্রেলিয়ার ‘দ্যা অস্ট্রেলিয়ান’ এ উল্লেখ করা হয়, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে বাংলাদেশ জুড়ে ভয়াবহ রাজনৈতিক সংঘাত টানা তিন দিনের মতো অব্যাহত থাকে। চারদলীয় জোট এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের সমর্থকদের মধ্যকার সংঘর্ষে অন্তত পক্ষে ১৪ ব্যক্তি প্রাণ হারায়।’ 

কাতারের ‘আল জাজিরা’ জানায়, ‘গত রোববারও ঢাকার রাজধানীর রাস্তাঘাট ছিল সম্পূর্ণ ফাঁকা। ক্রমবর্ধমান উদ্যোগের প্রেক্ষিতে লোকজন নিজেদেরকে ঘরের ভিতর বন্দি করে রাখে। পুলিশ জানায়, বিরোধী আওয়ামী সমর্থকরা দেশের বেশির ভাগই মহাসড়ক অবরুদ্ধ করে রাখে এবং দেশের প্রধান প্রধান সমুদ্রবন্দরের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে।’

কুয়েতের ‘কুয়েত নিউজ এজেন্সি’ জানায়, ‘আওয়ামী লীগের অবরোধের কারণে দেশব্যাপী ব্যবসায়িক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে এবং শিল্প কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হয়।’ 

ভারতের ‘হিন্দুস্থান টাইমস’ এর রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, ‘বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য এলাকায় রাজনৈতিক সহিংসতা ভয়াবহ আকার ছড়িয়ে পড়েছে। গত শনিবারের সংঘটিত রাতভর সংঘর্ষে অন্ততপক্ষে ৯ জন নিহত এবং সহস্রাধিক আহত হয়। আওয়ামী লীগের উন্মত্ত কর্মীরা তাদেরকে পিটিয়ে হত্যা করে।

এছাড়া কানাডার ‘কানাডিয়ান প্রেস’ ও ‘টরন্টো ডেইলি নিউজ’, তুরস্কের ‘তার্কিস’, ফ্রান্সের ‘ইন্টারন্যাশনাল হেরান্ড ট্রিবিউন’, ওমানের ‘টাইম অব ওমান’, সৌদি আরবের ‘আরব নিউজ’, ইউএইর ‘খালিজ টাইমস’, আমেরিকার ‘বোস্টন হেরাল্ড’ ও ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’, দক্ষিণ কোরিয়ার ‘ওমে নিডস ইন্টারন্যাশনাল’সহ বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদপত্রে এ ঘটনায় আওয়ামী লীগের লগি-বৈঠা বাহিনীর বীভৎসতার দৃশ্য ফুটে ওঠে। এভাবেই দেশে বিদেশের বিভিন্ন মিডিয়ায় নিন্দার ঝড় ওঠে। এছাড়া জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানও এ বর্বর সন্ত্রাসী ও মানবতাবিরোধী ঘটনার নিন্দা জানান। 

লেখক: সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির