মানবতার বন্ধু, মহান শিক্ষক ও নেতা হযরত মুহাম্মাদ সা. আমাদের জীবনের সবক্ষেত্রে আদর্শ রেখে গেছেন। ব্যক্তিগত জীবন থেকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রে এক অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। তিনি তার নাতিদীর্ঘ জীবনে মানুষের মুক্তির জন্য সকল ধরনের দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন। যা অনুসরণ করে আমরা সঠিক পথের দিশা পাই। রাসূল সা.-এর যোগাযোগনীতিকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। ব্যক্তিগত যোগাযোগের ক্ষেত্রে রাসূল সা.-এর নীতিসমূহ, পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে যোগাযোগের নীতিসমূহ, জাতীয়-আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যোগাযোগের নীতিসমূহ।
ব্যক্তিগত যোগাযোগে রাসূল সা.-এর নীতিমালা
শ্রোতার দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে কথা শোনা এবং উত্তর দেওয়া
রাসূল সা. কারো সাথে কথা বলার সময় তার দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে তাকাতেন। এ জন্য তিনি পুরা শরীর ঘুরিয়ে শ্রোতার দিকে ফিরে দাঁড়াতেন। যাতে শ্রোতা এটা বুঝতে পারে যে তার কথা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে শোনা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি করতে যাওয়া একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা আছে। “আমি যখন পিএইচডির শেষ পর্যায়ে তখন আমার কাছে খ্রিস্টান পাদ্রিরা আসতে শুরু করল। তারা মনে করল, একজন বিধর্মীকে ওদের ধর্মে নিয়ে গেলে ওদের জন্য সুবিধা। আমি দেখলাম, ওরা প্রচুর পড়াশোনা করে, জানে। আমি আমাদের প্রফেটকে হাইলাইট করার জন্য এক পাদ্রিকে বললাম যে, শোনো, আমাদের প্রফেট ছিলেন এমনই একজন মানুষ, তিনি যখন কারও সঙ্গে কথা বলতেন, তখন সরাসরি তার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতেন। তিনি যার সঙ্গে কথা বলতেন, তার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে বলতেন না, তিনি পুরো বডিকে তার দিকে টার্ন করতেন, যাতে সে মনে করে তাকে ফুল অ্যাটেনশন দেওয়া হচ্ছে। শুনে পাদ্রি বললেন, দেখুন, স্পন্ডিলাইটিস বলে একটা ডিজিজ আছে যে ডিজিজে ঘাড়ের চামড়া শক্ত হয়ে যায়, আপনাদের প্রফেটের ছিল স্পন্ডিলাইটিস ডিজিজ। উনি ঘাড় ফেরাতে পারতেন না বলে পুরো শরীর অন্যের দিকে ফেরাতেন। তখন গড আমাকে হেল্প করল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে আমাকে একটা লজিক দিয়ে দিলেন এবং লজিকটা আমার তাৎক্ষণিকভাবে আসা। আমি বললাম, আপনার কথাটা ভুল। আমাদের নামাজ পড়ার একটা সিস্টেম আছে, সিস্টেমে মাথা ফেরাতে হয়। আমাদের প্রফেটের যদি স্পন্ডিলাইটিস ডিজিজ থাকত, তাহলে তিনি পুরো শরীর ফেরাতেন, উনি তো তা করেন না। তার এই ডিজিজ ছিল না, তিনি যেটা করতেন তা শ্রদ্ধার জায়গা থেকে করতেন। তিনি আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন এবং বললেন, তোমার লজিক খুব পরিষ্কার, আসলেই তো তোমরা নামাজের সময় দুই দিকে মাথা ফেরাও” (শিলালিপি, দৈনিক কালের কণ্ঠ : ২৭ জুলাই ২০১২)।
ছোট বড়ো কোনো দায়িত্ব পালনে তিনি অমনোযোগী ছিলেন না। একদিন নবী করীম সা. খুতবা দিচ্ছিলেন। ইতোমধ্যে হাসান ও হুসাইন মসজিদে প্রবেশ করল। তাদের পরনে ছিল লাল রঙের জামা। তারা দৌড়ে আসছিল এবং পড়ে যাচ্ছিল। নবী সা. তখন খুতবা শেষ না করেই মিম্বর থেকে নেমে এলেন এবং তাদেরকে কোলে তুলে নিলেন। এরপর বললেন, ‘তোমাদের সম্পদ ও সন্তান তোমাদের জন্য পরীক্ষার বিষয়।’ আমি শিশু দু’টিকে দেখলাম যে, তারা দৌড়ে আসছে এবং পড়ে যাচ্ছে। তখন আমার পক্ষে ধৈর্য ধারণ করা সম্ভব হলো না।’ (তিরমিজি-২/২১৮)
হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেছেন, ‘আমি দীর্ঘ নামাজের ইচ্ছা নিয়ে নামাজ আরম্ভ করি, কিন্তু যখন কোনো শিশুর ক্রন্দনের আওয়াজ শুনি তখন নামাজ সংক্ষিপ্ত করে দেই। কেননা, আমি জানি, শিশুর ক্রন্দনে মার অবস্থা কেমন হয়!’ (বুখারি-৭০৯)
ওয়াদা রক্ষা
ওয়াদা রক্ষা করা যেকোনো ব্যক্তির ইতিবাচক ব্যক্তিত্বের পরিচয় দেয়। তাছাড়া ওয়াদা রক্ষা করা সামাজিক জীবনে পারস্পরিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করে। রাসূল সা. ওয়াদা রক্ষার ব্যাপারে খুবই সতর্ক ছিলেন। যোগাযোগের ক্ষেত্রে তিনি ওয়াদা রক্ষায় অত্যন্ত সচেষ্ট ছিলেন। কারো সাথে সাক্ষাতের জন্য নির্ধারিত সময় বা স্থানে তিনি যথাসময়ে উপস্থিত হতেন সেটা শত্রু হলেও। নবুয়ত পাওয়ার আগে ও পরে তিনি এই অবস্থার উপর দৃঢ় ছিলেন।
আবু আবদুল্লাহ (ইমাম আস সাদিক (রহ)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহর রাসূল সা. এক ব্যক্তির সাথে এক জায়গায় সাক্ষাৎ করার জন্য জন্য কথা দেন (জায়গাটি একটি পাথরের পাশের খোলা জায়গা এবং সেখানে সরাসরি রোদ শরীরে লাগতো)। তিনি লোকটিকে বলেন, “তুমি ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি এখানেই বসে থাকবো।” সূর্যের তাপ বেড়ে গেলে সাহাবিরা তাকে অনুরোধ করেন যে আপনি যদি একটু ছায়ায় গিয়ে অপেক্ষা করেন তাহলে তো সমস্যা হবে না। তিনি সা. বললেন, ‘আমি তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম (আমি তার সাথে এখানেই দেখা করব) তাই যদি সে না আসে তবে সে তার শপথ ভঙ্গ করবে।’
পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে যোগাযোগের নীতিসমূহ
রাসূল সা. তার দাওয়াতি চরিত্র ঘরে বাইরে সবখানেই সমানভাবে বজায় রাখতে সক্ষম ছিলেন। এ কারণে তার উত্তম চরিত্র দিয়ে স্ত্রী, কন্যা, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, গৃহপরিচারক সবাই তাকে সুন্দর ব্যবহারের জন্য ভালোবাসতেন। নবী সা. তার স্ত্রীদের মধ্যেও যাতে ইনসাফ করতে পারেন এ জন্য তার স্ত্রীদের প্রত্যেকের সাথে নির্দিষ্ট দিনে দেখা করার জন্য নির্ধারণ করে দেন। তিনি তার অধীনস্থদের প্রতিও যোগাযোগের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সদয় ছিলেন। আনাস রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সা.-এর একজন ইহুদি খাদেম ছিলো। (তাকে তিনি কখনো মুসলিম হওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করেননি)। একবার সে খুব অসুস্থ হলে তিনি তাকে দেখতে যান। ছেলেটি মৃত্যুশয্যায় ছিলো। রাসূল সা. তার মাথার পাশে বসে বললেন তুমি কালিমা পড়ে মুসলিম হও। সে তার বাবার দিকে তাকালো। তার বাবা তাকে বললেন আবুল কাসিম যা বলছে তার অনুকরণ করো। তখন সে ইসলাম গ্রহণ করলো। রাসূল সা. বের হয়ে এসে বললেন, সমস্ত প্রশংসা তার যিনি তাকে জাহান্নাম থেকে বাঁচালেন। (বুখারি)
রাসূল সা. দাওয়াতি ক্ষেত্রে তাঁর অনুপম যোগাযোগনীতিকে ভালোভাবে কাজে লাগিয়েছেন। এমনকি সেটা ঘরের মধ্যেও। তার দাসী মারিয়া ইহুদি ছিলো। তিনি রাসূল সা.-এর কাছে নীত হওয়ার পথে সাহাবি হাতিব ইবনে আবি বালতায়ার কাছে ইসলাম গ্রহণ করেন। কিন্তু নবীজি সা. তাকে বিবাহের প্রস্তাব দিলে তিনি তা কবুল করেননি। বরং তিনি দাসী হিসেবেই থাকতে চান। হাদিসের বর্ণনা মতে তিনি ইবরাহীম নামে একটি পুত্র সন্তানের জন্মদান করেন। এর ফলে ইসলামী বিধান অনুযায়ী তিনি অটোমেটিক্যালি দাসী হতে মুক্ত (উম্মু ওয়ালাদ) হয়ে যান। এ থেকে প্রমাণিত হয় তিনি শক্তি ও ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কতটা মানবিক ছিলেন।
জাতীয়-আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যোগাযোগের নীতিসমূহ
রাসূল সা. দাওয়াতি কাজের মাধ্যমেই তার প্রতিবেশী হতে গোটা বিশ্ব পর্যন্ত যোগাযোগের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করেন। তাঁর যোগাযোগে ছিলো সুন্দর বাক্যচয়ন, সহমর্মিতা, সহনশীলতা, উত্তম আচরণ, শুভাকাক্সক্ষা, এবং ভালোবাসা। তিনি যখন দাওয়াতি কাজ শুরু করেন তখন তাঁকে তার আপন চাচা ও চাচী দিনের পর দিন নানাভাবে কষ্ট দিতো। মানুষের কাছে তার নামে মিথ্যা দুর্নাম করতো। তার ঘরের মধ্যে ময়লা ফেলে যেতো। ঘরের সামনে রাস্তায় কাঁটা ফেলে রাখতো। কিন্তু তিনি কখনোই এর বিপরীতে তাদেরকে কষ্ট দেননি বা কটু কথাও বলেননি। এ ছাড়াও তিনি যখন তায়েফে দাওয়াত দিতে যান তখন তায়েফ হতে রক্তাক্ত হয়ে ফিরে আসেন কিন্তু তাদেরকে বদ দোয়া দেননি। মদিনাতে হিজরত করার আগেই মদিনা সম্পর্কিত খবরাখবর তিনি সংগ্রহ করেন। সেখানকার মাটি, মানুষ, আবহাওয়া এবং দ্বীনি দাওয়াতের উপযোগিতা সবকিছু তিনি ভালোভাবে ওয়াকিবহাল হন। এরপর দু’টি গ্রুপকে হজের সময় গোপনে তিনি বাইয়াত দেন যারা তাকে মদিনাতে যাওয়ার জন্য সকল ধরনের সহযোগিতা দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করে দাওয়াত দেন। মদিনা হিজরতের আগে আবিসিনিয়ার রাজার সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে সুসম্পর্ক তৈরি করেন। আবিসিনিয়ার রাজা নাজ্জাশি তার পাঠানো মুহাজিরদেরকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে আশ্রয়দান করেন। তাদের সম্পর্ক এতটাই মজবুত ছিলো যে নাজ্জাশির মৃত্যুতে তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হন। তার দাওয়াতের নীতি ছিলো ৩টি। যা অত্যন্ত যৌক্তিক ও কূটনৈতিক। রাসূল সা.-এর যোগাযোগনীতি ও কূটনৈতিক বিচক্ষণতা আধুনিক বিশ্বের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্কলারদেরকে হতবাক করে দেয়। প্রথমত তার সাহস, দ্বিতীয়ত তার প্রস্তাবিত বিষয়ের প্রতি আত্মবিশ্বাস। তিনি তার চিঠিতে লিখতেন যদি ইসলাম গ্রহণ করো তবে তোমাদের জান ও মালের নিরাপত্তার দায়িত্ব আমাদের। আর যদি মুসলমান না হও তবে জিজিয়া দিয়ে জিম্মি হিসেবে বসবাস করো। জিজিয়ার বিপরীতে জানমালের দায়িত্ব ইসলামী রাষ্ট্রের। আর যদি এই দুটি প্রস্তাবে রাজি না হও তাহলে যুদ্ধের প্রস্তুতি নাও।
তিনি বেশিরভাগ যুদ্ধেই ডানদিক দিয়ে চলা শুরু করতেন। শত্রুপক্ষের খবরাখবর নেওয়ার জন্য তার গোয়েন্দাদেরকে রাখাল, ব্যবসায়ী, বেদুইন ইত্যাদি ছদ্মবেশে মাঠে নামিয়ে দিতেন। তার পরিকল্পনা যাতে শত্রুপক্ষ জেনে না ফেলে এ জন্য অত্যন্ত কৌশলে এগোতেন।
মদিনাতে হিজরতের পর তিনি মুহাজির, আনসার, ও মদিনার অন্যান্য নাগরিকগণের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করার জন্য ডায়ালগের ব্যবস্থা করেন। এর ফলে তারই মডারেশনে সবাই একসাথে বসবাস করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। এটিকে তিনি আরো মজবুত ভিত্তি দেওয়ার জন্য সকলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি দাফতরিক সনদ আকারে কিছু শর্ত ও নিয়ম লিপিবদ্ধ করেন। এটি মদিনা সনদ নামে পরিচিত। যা শুধু ইসলামের নয় বরং পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম ফরমাল কোনো লিখিত সনদ বা সংবিধান ও বলা যেতে পারে।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যোগাযোগের জন্য তিনি বিচক্ষণ, জ্ঞানী, শিক্ষিত ও সাহসী সাহাবিদেরকে বাছাই করে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে ইসলাম গ্রহণের আহবান জানিয়ে চিঠি পাঠাতে শুরু করেন। তার চিঠির ভাষাগুলো অত্যন্ত সাবলীল, সহজ, ও পরিষ্কার ছিলো। তিনি তার দূতগণকে চিঠির পাশাপাশি মৌখিকভাবে দাওয়াতের ভাষাও শিখিয়ে দেন। তার দাওয়াত গোটা পৃথিবীর পরাশক্তিদের কাছে সাড়া ফেলে দেয়।
লেখক : সহকারী সম্পাদক, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা
আপনার মন্তব্য লিখুন