ইসলামী জীবনব্যবস্থার বিভিন্ন দিকের ভারসাম্যপূর্ণ ব্যাখ্যা, সমকালীন যুগজিজ্ঞাসার জবাব, ইসলামের পুনর্জাগরণ আন্দোলনের ইলমি ভিত্তি নির্মাণ এবং মুসলিম উম্মাহর করণীয় নির্দেশ করত বর্তমান বিশ্বে যিনি সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধি অর্জন করেছেন, তিনি হলেন শাইখ ইউসুফ আল কারজাভী (রহ.)। কুরআন-হাদিসের অগাধ পাণ্ডিত্য, আধুনিক জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পারদর্শিতা, ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি, অসাধারণ লেখনী শক্তি, বক্তব্যের বলিষ্ঠ উপস্থাপনা, বিষয় নির্বাচনে দক্ষতা প্রভৃতিতে তিনি ইলমি অঙ্গনে তাঁর সমসাময়িকদের ছাড়িয়ে গেছেন। শুধু জ্ঞানের জগতেই নয় ইসলামী জীবনবিধান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামেও তিনি ছিলেন সমান তৎপর। বার্ধক্যের অক্ষমতাকে এড়িয়ে তিনি তারুণ্যের দীপ্তি ছড়িয়ে গেছেন ইসলামের পুনর্জাগরণ প্রত্যাশী জনতার হৃদয়ে।
জীবনের প্রারম্ভিকা
ইউসুফ আল কারজাভীর জন্ম ১৯২৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর উত্তর মিসরের নীলনদ তীরবর্তী সাফাত তুরাব গ্রামে। এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে পৃথিবীর আলো দেখেন তিনি। মাত্র দুই বছর বয়সে শিশু ইউসুফের পিতা ইন্তেকাল করলে চাচার তত্ত্বাবধানে তিনি প্রতিপালিত হন। কারজাভীর শিক্ষা-সূচনা হয় নিজ গ্রামের নিকটবর্তী মফস্বল শহর তানতায়। মিসরের রাজধানী কায়রো থেকে ৯৪ কিলোমিটার উত্তরে তানতার অবস্থান। প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী কারজাভী নিয়মিত পড়াশোনার পাশাপাশি মাত্র দশ বছর বয়সে কুরআন মাজিদ হিফজ করেন। তানতায় অবস্থিত আল আজহার পরিচালিত ইনস্টিটিউট থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা সমাপ্ত করেন তিনি। অতঃপর উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে কায়রো গমন করেন। আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় উসুলুদ দ্বীন বিভাগে ভর্তি হয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে ব্যাপৃত হন ইউসুফ আল কারজাভী। ১৯৫৩ সালে আল আজহার থেকে কৃতিত্বের সাথে স্নাতক শেষ করেন। ১৯৫৮ সালে সম্পন্ন করেন আরবি ভাষা ও সাহিত্যের ওপর ডিপ্লোমা। ১৯৬০ সালে কুরআনিক স্টাডিজ বিভাগ হতে মাস্টার্স করেন।
১৯৭৩ সালে ইউসুফ আল কারজাভী আল আজহার হতে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। তাঁর পিএইচডির বিষয় ছিল- “জাকাতের সুফল এবং সামাজিক সমস্যা দূরীকরণে জাকাতের ভূমিকা”।
ইমাম বান্না ও ইখওয়ানুল মুসলিমিনের সান্নিধ্যে
অসামান্য প্রতিভার অধিকারী ইউসুফ আল কারজাভী ছাত্রজীবনেই ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যমণিতে পরিণত হন। তবে তিনি অন্যান্য মেধাবী ছাত্রদের মতো কেবল পড়ালেখার মধ্যেই বুঁদ হয়ে ছিলেন না; বরং পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি ইসলামী জীবনবিধান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
তানতা আজহারি ইনস্টিটিউটে ছাত্র থাকাকালে ইউসুফ আল কারজাভী সাক্ষাৎ পান ইমাম হাসান আল বান্নার। হিজরতের ওপর ইমাম বান্নার বক্তব্য শুনে তিনি মুগ্ধ হন। এরপর থেকে তানতায় যেকোনো অনুষ্ঠানে ইমাম বান্না সফরে এলে সেখানে হাজির হতেন তরুণ কারজাভী। একপর্যায়ে ইখওয়ানুল মুসলিমিনে ছাত্র শাখায় যোগদান করেন তিনি। ইখওয়ানে সক্রিয় ভূমিকা রাখার অপরাধে মাধ্যমিকের পাঠ চুকানোর আগেই গ্রেফতার হন ইউসুফ আল কারজাভী। তিনি স্বপ্ন দেখতেন, মাধ্যমিক শেষ করে আল আজহারে ভর্তি হবেন এবং এর ফলে কায়রোতে অবস্থানের সুবাদে ইমাম বান্নার সরাসরি ছাত্রত্ব ও সাহচর্যের সৌভাগ্য লাভ করবেন। কিন্তু আল্লাহর ফয়সালা ছিল ভিন্ন। কারজাভীর কারাবন্দিত্বের সময়ই ১৯৪৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি কায়রোর রাজপথে আততায়ীর গুলিতে শহীদ হন ইমাম হাসান আল বান্না। ফলে ইমামের সান্নিধ্যের স্বপ্ন অধরাই থেকে যায় কারজাভীর। তবে তিনি তা পুষিয়ে নেন ইমাম বান্নার রচনাবলির নিবিড় অধ্যয়নে এবং ইমামের সহকর্মী ও প্রত্যক্ষ ছাত্রদের ছাত্রত্ব গ্রহণের মাধ্যমে। প্রখ্যাত দাঈ উসতায বাহি আল খাওলির দীর্ঘ সাহচর্য তরুণ কারজাভীকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। কারাবন্দিত্বের দিনগুলোতে প্রখ্যাত লেখক ও ইখওয়ান নেতা মুহাম্মাদ আল গাজালির সাহচর্য লাভ করেন কারজাভী। এছাড়াও ইখওয়ানের প্রথম প্রজন্মের প্রায় সকল শীর্ষ দায়িত্বশীলদের সান্নিধ্যে থেকে ইসলামী আন্দোলনের মনোযোগী পাঠ নেন তিনি।
বহুমাত্রিক কর্মজীবন
শিক্ষা সমাপনান্তে ইউসুফ আল কারজাভী মিসরের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ওহংঃরঃঁঃব ড়ভ ওসধসং-এর পরিদর্শক হিসেবে কর্মজীবনে পদার্পণ করেন। কিছুদিন তিনি আওকাফ মন্ত্রণালয়ের ‘বোর্ড অব রিলিজিয়াস অ্যাফেয়ার্স’-এ কর্মরত ছিলেন। ১৯৫৪ সাল থেকে জামাল নাসের সরকার ইখওয়ানুল মুসলিমিনের ওপর ধারাবাহিক নিপীড়ন শুরু করে এবং তার এই জুলুম নিকট অতীতের সকল সীমা ছাড়িয়ে যায়। নাসের সরকারের আমলে ইউসুফ আল কারজাভী বেশ কয়েকবার কারারুদ্ধ হন। একপর্যায়ে ১৯৬১ সালে তিনি নবগঠিত রাষ্ট্র কাতার গমন করে সেখানকার শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্রিয় হন। কাতারে ইউসুফ আল কারজাভী আল আজহারের আদলে ইনস্টিটিউট গড়ে তোলেন। ১৯৭৭ সালে কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ে শরিয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ অনুষদ প্রতিষ্ঠায় তিনি প্রধান ভূমিকা রাখেন এবং এ অনুষদের ডিন নিযুক্ত হন। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তিনি কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৯০ সালে আলজেরিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্টিফিক কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মনোনীত হয়ে তিনি আলজেরিয়া গমন করেন। সেখানে দু’বছর দায়িত্ব পালন করে ১৯৯২ সালে কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিরাত ও সুন্নাহ গবেষণা কেন্দ্রের ডিরেক্টর হিসেবে পুনরায় কাতার প্রত্যাবর্তন করেন।
ইউসুফ আল কারজাভীর কর্মক্ষেত্র আঞ্চলিকতা পেরিয়ে আফ্রিকা, এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকা পর্যন্ত বিস্তৃত। তিনি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে আন্তর্জাতিকতাবাদের একজন প্রবক্তা। ইউসুফ আল কারজাভী ইউরোপভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা European Council For Fatwa and Research-এর প্রধান ছিলেন। ইসলামিক স্কলারদের বিশ্বজনীন সংগঠন International Union for Muslim Scholars (IUMS)-এর চেয়ারম্যান হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০১৮-এর নভেম্বরে মরক্কোর বিখ্যাত আলিম শাইখ আহমাদ আর রাইসুনি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন IUMS-এ। শাইখ কারজাভী (রহ.) ওআইসির ফিকহ একাডেমি, রাবেতায়ে আলমে ইসলামীর ফিকহ একাডেমি, রয়্যাল একাডেমি ফর ইসলামিক কালচার অ্যান্ড রিসার্চ জর্ডান, ইসলামিক স্টাডিজ সেন্টার অক্সফোর্ড প্রভৃতি সংস্থার শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব। কর্মক্ষেত্রের দিক দিয়ে বাংলাদেশের সাথেও সম্পৃক্ততা ছিল ড. ইউসুফ আল কারজাভীর। তিনি আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম (IIUC)-এর ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ছিলেন। তিনি আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ও গণমাধ্যমকে ইসলাম প্রচারকার্যে ব্যবহারের পথিকৃৎ। তাঁর ‘আশ শরিয়াহ ওয়াল হায়াহ’ (শরিয়ত ও জীবন) শিরোনামের টিভি প্রোগ্রামটি বিশ্বের সর্বাধিক দর্শকপ্রিয় অনুষ্ঠানসমূহের একটি। আল জাযিরা টিভি সম্প্রচারিত এ অনুষ্ঠানটির বিশ্বব্যাপী নিয়মিত দর্শক সংখ্যা ৬০ মিলিয়ন বলে অনুমান করা হয়।
ইসলামী আন্দোলনের ইলমি ভাষ্যকার
ড. ইউসুফ আল কারজাভী সমাজবিচ্ছিন্ন জ্ঞানসাধনায় বিশ্বাস করেন না। জীবনঘনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারাও সুস্পষ্ট। তিনি সর্বক্ষেত্রে ইসলামকে চূড়ান্তভাবে বিজয়ী ও প্রতিষ্ঠিত করার পক্ষপাতী। তবে এক্ষেত্রে তিনি প্রান্তিকতা ও শিথিলতাকে প্রত্যাখ্যান করে মধ্যপন্থাকেই যথার্থ পথ মনে করেন। ফিকহি ক্ষেত্রেও ইউসুফ আল কারজাভী ভারসাম্য ও মধ্যপন্থী ধারাকেই উচ্চকিত করেছেন। ফলে তিনি মধ্যপন্থার পথিকৃৎ বা ‘ইমামুল ওয়াসাতিয়্যাহ’ অভিধায় প্রসিদ্ধ।
ইউসুফ আল কারজাভী ইসলামের পুনর্জাগরণপ্রয়াসী আন্দোলনগুলোর ইলমি ভাষ্যকার। তিনি ফিলিস্তিন, কাশ্মিরসহ সকল পরাধীন মুসলিম ভূমিগুলোর স্বাধীনতার ইস্যুতে উচ্চকণ্ঠ। স্বাধীন মুসলিম দেশগুলোতে ইসলামী জীবনবিধান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের তিনি ইলমি অভিভাবকে পরিণত হয়েছেন।
ড. কারজাভী ইখওয়ানুল মুসলিমিনের প্রধান তাত্ত্বিক পৃষ্ঠপোষক। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ইখওয়ানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি নিজেকে ইমাম হাসান আল বান্নার ছাত্র পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। ইখওয়ানে সক্রিয় ভূমিকার কারণে ১৯৪৭ সালে বাদশাহ ফারুকের আমলে প্রথমবার রাজবন্দি হন ইউসুফ আল কারজাভী। ১৯৬১ সালে মিসর ত্যাগ করে কাতার গমনের আগ পর্যন্ত কুখ্যাত নাসের সরকার তাঁকে আরও তিনবার কারাবন্দি করে। ২০১১ সালে আরব বসন্তের যে উত্তাল ঢেউ মিসরে আছড়ে পড়ে, সে বিপ্লবের প্রধান রূপকারদের একজন ড. কারজাভী। এ গণবিপ্লবে নেতৃত্ব দিতে তিনি মিসর ফিরে আসেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি তাহরির স্কয়ারে প্রায় বিশ লক্ষ মুক্তিকামী জনতার সমাবেশে জুমার পূর্বক্ষণে এক ঐতিহাসিক খুতবা দেন কারজাভী। অতঃপর তাঁর ইমামতিতে রাজপথে আদায় করা হয় জুমার সালাত। মিসর বিপ্লবের সিদ্ধান্তকারী উপসংহারে পৌঁছার ক্ষেত্রে তাঁর এ বক্তব্যের অনেকখানি ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
নানামুখী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে মিসর বিপ্লবের অর্জন ব্যর্থ হয়ে যায়। মিসরের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদ মুরসি মাত্র এক বছরের মাথায় ক্ষমতাচ্যুত ও বন্দি হন। সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় জুড়ে বসে সামরিক জান্তা আবদুল ফাত্তাহ আল সিসি। সিসি সরকার হাজার হাজার ইখওয়ান নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে নিপীড়ন চালায়। অনেককে সম্পূর্ণ জবরদস্তিমূলক বিচারপ্রক্রিয়ায় ফাঁসির দণ্ড দিয়ে চিরতরে বিদায় করে দেয় পৃথিবী থেকে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ইউসুফ আল কারজাভীর বিরুদ্ধেও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে সিসি সরকার।
গবেষণা ও সাহিত্যকর্ম
ড. ইউসুফ আল কারজাভী অনন্য সাধারণ লেখনীর গুণে বিভূষিত। অসামান্য পাণ্ডিত্য ও চমৎকার উপস্থাপনা পদ্ধতির কারণে তাঁর সাহিত্য সম্ভার বিশ্বব্যাপী বহুল পঠিত। তিনি যে বিষয়ে কলম চালনা করেন, সে বিষয়টির কোনো দিক তাঁর আলোচনার বাইরে থাকে না। তাঁর রচনা তত্ত্ব ও তথ্যসমৃদ্ধ, কিন্তু তা তথ্যের ভারে রসহীন নয়, বরং সাবলীল। নিজের মত কারও ওপর চাপিয়ে দেন না তিনি, কিন্তু এত জোরালো যৌক্তিকতা ও দলিলের সাহায্যে স্বীয় মত প্রতিষ্ঠা করেন যে, তাঁর সাথে দ্বিমতের অবকাশ খুব কমই থাকে। ড. কারজাভী শুধু গবেষণা-প্রবন্ধ লিখেই ক্ষান্ত হননি; তিনি একজন স্বনামধন্য আরবি কবিও। তাঁর অনেক কবিতায় সুরারোপ করে শিল্পীরা গান হিসেবে পরিবেশন করেছে। নিজস্ব কাব্যবৈশিষ্ট্যের কারণে তিনি কবি ও কবিতার অঙ্গনেও আলোচিত।
মূল্যায়ন
ইসলামের খেদমতে বহুমুখী অবদানের জন্য ইউসুফ আল কারজাভী বিভিন্ন দেশ ও সংগঠন কর্তৃক ব্যাপক সংবর্ধিত হয়েছেন। ইসলামী অর্থনীতিতে মৌলিক অবদানের জন্য ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (IDB) পুরস্কার, ইসলামী শিক্ষা বিস্তারের জন্য বাদশাহ ফয়সাল আন্তর্জাতিক পুরস্কার, ইসলামী সংস্কৃতির বিকাশে অবদানের জন্য সুলতান আল ওয়াইস পুরস্কার ইত্যাদি ড. কারজাভীর প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যায়নের মধ্যে কয়েকটি।
সহকর্মী ও উত্তরসূরিরা তো বটেই, অগ্রজরাও ইউসুফ আল কারজাভীর ইলমি অবদানের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম চিন্তানায়ক সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী তাঁর লেখনীর দারুণ প্রশংসা করেন, বিশেষ করে তাঁর রচিত বৃহৎ গ্রন্থ ফিকহুজ জাকাত-এর। সাইয়েদ মওদূদী (রহ.) বলেন-
“ইসলামী ফিকহের ইতিহাসে ফিকহুজ জাকাত শতাব্দীর সেরা গ্রন্থ। যদি ইউসুফ আল কারযাভী ফিকহুজ জাকাত ছাড়া আর কোনো গ্রন্থ না-ও লিখতেন, তাহলে এই একটি গ্রন্থই তাঁকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য যথেষ্ট ছিল।”
বিশ্ববিখ্যাত লেখক ও দাঈ আবুল হাসান আলী নদভী বলেন-
“কারজাভী একজন মুহাক্কিক আলিম। তিনি এ সময়ের বড় আলিম ও পথিকৃৎদের একজন।”
প্রখ্যাত আলিম ও রাজনীতিবিদ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ বলেন-
আল্লামা কারজাভী আমাদের ফকিহ ও রাহবার।”
পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর কাজী হুসাইন আহমাদ বলেন-
উসতায কারজাভী হচ্ছেন জ্ঞান, ফিকহ ও দাওয়াতের এক স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। মুসলিম উম্মাহর উচিত তাঁর জ্ঞানের সুপেয় ঝরনাধারা থেকে উপকৃত হওয়া।”
প্রখ্যাত ফকিহ জাস্টিস তাকি উসমানি বলেন-
“আমি ইউসুফ আল কারজাভীর ব্যক্তিত্বে অনুসরণীয় ইসলামী গুণাবলির প্রতিফলন দেখেছি। কেননা, একজন মুসলিম হওয়ার পূর্বে তিনি একজন মানুষ, একজন দাঈ হওয়ার আগে তিনি একজন পরহেজগার মুসলিম এবং একজন আলিম ও ফকিহ হওয়ার পূর্বে তিনি একজন দাঈ।”
কাতার বিশ্ববিদ্যালয় ড. ইউসুফ আল কারজাভীর সম্মানার্থে ২০০৯ সাল থেকে চালু করেছে ‘শায়খ কারজাভী স্কলারশিপ’। প্রতি বছর মাস্টার্স অধ্যয়নরত পাঁচজন সেরা ছাত্রকে এ স্কলারশিপ দেওয়া হয়।
পারিবারিক জীবন
পারিবারিক জীবনে ড. কারজাভী ব্যক্তিত্ববান ও দায়িত্বশীল অভিভাবক। তিনি বিয়ে করেন ইসয়াদ আবদুল জাওয়াদকে, যিনি উম্মু মুহাম্মাদ নামেই সমধিক পরিচিত। দাম্পত্য জীবনে তাঁরা তিন পুত্র ও চার কন্যা সন্তানের জনক-জননী। ২০১২ সালে কারজাভীপত্নী উম্মু জাওয়াদ ইন্তেকাল করেন। পরে তিনি মরক্কো অধিবাসী আয়িশাকে বিয়ে করেন। পারিবারিক জীবনে ইউসুফ আল কারজাভী একজন আদর্শ স্বামী ও পিতা। কারজাভীর পারিবারিক জীবনের চমৎকার চিত্র দেখা যায় তাঁর ছেলে আবদুর রহমান কারজাভীর লেখায়। তিনি লিখেছেন এভাবে-
“আমরা একটি ঘনিষ্ঠ, প্রেমময় ও পারস্পরিক আন্তরিকতাপূর্ণ পরিবারে বড় হয়েছি। আমার বাবা ও আমার মায়ের মধ্যে আমরা কখনো দ্বন্দ্ব বা ঝগড়া হতে দেখিনি। বরং আমার বাবা তাঁর স্ত্রীর কাছে ছিলেন সেরা স্বামী, ঠিক যেমন আমার মা তাঁর স্বামীর কাছে ছিলেন সবচেয়ে বিশ্বস্ত স্ত্রী। মা ছিলেন আমার বাবার কর্ম ও মিশনের সহযোগী। এমনকি তিনি ছিলেন তাঁর কর্ম, পেশা ও দায়িত্বের সহায়ক শক্তি। আমার পিতার কাঁধে উম্মাহর বোঝা ও দাওয়াহর দায়িত্ব থাকা সত্ত্বেও বৈবাহিক এবং পারিবারিক জীবনের বিষয়টিকে তিনি মোটেও অবহেলা করেননি; বরং যথাসাধ্য ও উপযুক্ত যত্ন নিয়েছেন।”
প্রাণবন্ত বয়স্ক তরুণ
ড. ইউসুফ আল কারজাভীর বয়স ২০২৬ এলে শত বছর পূর্ণ হতো। প্রায় শতবর্ষী এ মনীষী ইসলামী সমাজ-বিনির্মাণের স্বপ্নে ক্লান্তিহীন, সতেজ ও প্রাণবন্ত তরুণের মতোই সচল ছিলেন ইন্তেকালের পূর্ব-মুহূর্ত পর্যন্ত। জ্ঞানের রাজ্যে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী, ত্যাগের ক্ষেত্রে অগ্রগামী এবং ব্যক্তিত্বের দিক দিয়ে দুর্লভ গুণে গুণান্বিত। এ মহান মনীষী ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়ে গেছেন। আরববিশ্বের মশহুর আলিম সালমান আওদাহকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে উসতায কারজাভী যথার্থই বলেছেন-
“আমার শরীর নব্বই ছুঁয়ে এগিয়ে চলছে আর মন এখনও বিশের ঘরে রয়ে গেছে।”
৯৬ বছরের বর্ণাঢ্য জীবন শেষে শাইখ ইউসুফ আল কারজাভী ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ সালে রবের সান্নিধ্যে পাড়ি জমান।
তথ্যসহায়িকা
মুহাম্মদ আবু সুফিয়ান সম্পাদিত। ইমামুল ওয়াসাতিয়্যাহ ইউসুফ আল কারজাভী (প্রকাশিতব্য পাণ্ডুলিপি)।
মু. সাজ্জাদ হোসাইন খান। ড. ইউসুফ আল কারজাভী রচনাবলি। ইমামুল ওয়াসাতিয়্যাহ ইউসুফ আল কারজাভী (প্রকাশিতব্য পাণ্ডুলিপি)।
আবদুর রহমান আল কারজাভী, মুহাম্মাদ শাহাদাত হোসাইন অনূদিত। আমার বাবা ইউসুফ আল কারজাভী। ইমামুল ওয়াসাতিয়্যাহ ইউসুফ আল কারজাভী (প্রকাশিতব্য পাণ্ডুলিপি)।
ড. ইউসুফ আল কারজাভী। আধুনিক যুগ : ইসলাম কৌশল ও কর্মসূচি, চতুর্থ সংস্করণ মুহাম্মদ সানাউল্লাহ আখুঞ্জী অনূদিত। ঢাকা : বুক মাস্টার, আগস্ট ২০১৩।
ড. ইউসুফ আল কারজাভী। ইসলামী পুনর্জাগরণ : সমস্যা ও সম্ভাবনা, পঞ্চম প্রকাশ। মুহাম্মদ সানাউল্লাহ আখুঞ্জী অনূদিত। ঢাকা : আহসান পাবলিকেশন, নভেম্বর ২০১১।
হারুন ইবনে শাহাদাত। “ইউসুফ আল কারজাভী”। সাপ্তাহিক সোনার বাংলা। ঢাকা : জানুয়ারি ১৬, ২০১৫।
ফাহমিদ-উর-রহমান। উত্তর আধুনিক মুসলিম মন (দ্বিতীয় খণ্ড)। ঢাকা : কালার পেন্সিল, অক্টোবর ২০২০।
লেখক : প্রবন্ধিক ও প্রকাশক
আপনার মন্তব্য লিখুন