post

শিক্ষার জন্য রাসূল ﷺ এর নির্দেশনা

হাফেজ রাশেদুল ইসলাম

৩০ জুন ২০২৩

حَدَّثَنَا عَلِيُّ بْنُ حُجْرٍ، أَخْبَرَنَا عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ أَبِي الزِّنَادِ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ خَارِجَةَ بْنِ زَيْدِ بْنِ ثَابِتٍ، عَنْ أَبِيهِ، زَيْدِ بْنِ ثَابِتٍ قَالَ أَمَرَنِي رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَنْ أَتَعَلَّمَ لَهُ كَلِمَاتِ كِتَابِ يَهُودَ ‏.‏ قَالَ ‏ "‏ إِنِّي وَاللَّهِ مَا آمَنُ يَهُودَ عَلَى كِتَابٍ ‏"‏ ‏.‏ قَالَ فَمَا مَرَّ بِي نِصْفُ شَهْرٍ حَتَّى تَعَلَّمْتُهُ لَهُ قَالَ فَلَمَّا تَعَلَّمْتُهُ كَانَ إِذَا كَتَبَ إِلَى يَهُودَ كَتَبْتُ إِلَيْهِمْ وَإِذَا كَتَبُوا إِلَيْهِ قَرَأْتُ لَهُ كِتَابَهُمْ ‏.‏ قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ ‏.‏ وَقَدْ رُوِيَ مِنْ غَيْرِ هَذَا الْوَجْهِ عَنْ زَيْدِ بْنِ ثَابِتٍ رَوَاهُ الأَعْمَشُ عَنْ ثَابِتِ بْنِ عُبَيْدٍ الأَنْصَارِيِّ عَنْ زَيْدِ بْنِ ثَابِتٍ قَالَ أَمَرَنِي رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَنْ أَتَعَلَّمَ السُّرْيَانِيَّةَ    

সরল অনুবাদ

আলী ইবন হুজর (রহিমাহুল্লাহ) ...... জায়িদ ইবনু সাবিত রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জন্য আমাকে ইয়াহুদিদের কিতাবের ভাষা শিখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমার পত্রাদির ব্যাপারে কোনো ইয়াহুদির ওপর আমি আস্থা রাখতে পারি না। জায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন- অর্ধ মাস অতিবাহিত হওয়ার পূর্বেই আমি তাঁর জন্য সে ভাষা শিখে ফেললাম। তিনি আরো বলেন, আমার সেই ভাষা শেখার পর তিনি যখন ইয়াহুদিদের কাছে কোনো কিছু লিখতেন তখন আমিই তা লিখে দিতাম। আর তারা যখন তাঁর কাছে কিছু লিখত তখন আমি তাদের লেখা তাঁকে পাঠ করে শোনাতাম। (আবু ঈসা বলেন) হাদিসটি হাসান-সহিহ। জায়িদ ইবনু সাবিত রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে একাধিক সূত্রে এটি বর্ণিত আছে। আর আমাশ (রহিমাহুল্লাহ) এটি সাবিত ইবনু উবায়েদ-জায়িদ ইবনু সাবিত রাদিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে সুরয়ানি ভাষা শিক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।  

কিতাব : সুনান আত তিরমিজি (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায় : অনুমতি প্রার্থনা, পরিচ্ছেদ : সুরয়ানি ভাষা শিক্ষা, হাদিস নং : ২৭১৫, হাদিসের মান : হাসান।


রাবি (বর্ণনাকারী) পরিচিতি

জায়িদ ইবনু সাবিত রাদিয়াল্লাহু আনহু। মূল নাম জায়িদ। কুনিয়াত বা উপনাম আবু সাঈদ, আবু খায়িজাহ, আবু আব্দুর রহমান। পিতা সাবিত বিন জাহহাক। মাতা নাওয়ার বিনতি মালিক। তিনি মদিনার বনু নাজ্জার গোত্রে জন্ম গ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরতের এক বছর পূর্বে মদিনায় দ্বীনি দাওয়াত ও প্রশিক্ষণের জন্য মুসআব ইবনু উমায়ির রাদিয়াল্লাহু আনহুকে পাঠান। তাঁর দাওয়াতে আওস ও খাজরাজ এবং বনু নাজ্জার গোত্রের যে-সকল মানুষ দ্বীন-ইসলাম গ্রহণ করেন, তাঁদের সাথে জায়িদ ইবনু সাবিত রাদিয়াল্লাহু আনহুর পরিবারের সদস্যরাও ছিলেন। তখন জায়িদ রাদিয়াল্লাহু আনহুর বয়স মাত্র ১১ বছর ছিল। ছোটবেলা থেকেই জায়িদ ইবনু সাবিত রাদিয়াল্লাহু আনহু জ্ঞানচর্চার প্রতি বেশ মনোযোগী ছিলেন। দ্বীনে হকে শামিল হওয়ার পর মহাগ্রন্থ আল-কুরআন মুখস্থ করার পাশাপাশি অন্যান্য জ্ঞানার্জনেও তাঁর আগ্রহ এবং অর্জন উল্লেখ করার মতো। পবিত্র কুরআন হিফজ করার প্রবল আগ্রহ এবং জ্ঞানার্জনে তাঁর মনোনিবেশ দেখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে কাতিবে ওহি বা ওহি লেখকের মর্যাদা দান করেন।

জায়িদ ইবনু সাবিত রাদিয়াল্লাহু আনহু আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একান্ত ব্যক্তিগত সচিব ছিলেন। তিনি বিভিন্ন ভাষা শিক্ষা লাভ করেছিলেন এবং সে সকল ভাষায় কথা বলতে এবং লিখতে সমানতালে পারদর্শী ছিলেন। বিশেষ করে এ ভাষা শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দোভাষী হিসেবে কাজ করা (আলোচ্য হাদিসে যার বর্ণনা রয়েছে)। এক্ষেত্রে তিনি সুরয়ানি, ইবরানি, হাবশি, কিবতি, রোমক এবং আরবি ইত্যাদি ভাষা-ভাষীদের সাথে কথা বলতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সহযোগিতা করেছেন। বিভিন্ন দেশ-গোত্র থেকে সেসব দেশের রাজা-বাদশাহ এবং প্রধানদের কাছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হয়ে পত্র লিখে দিতেন এবং পত্র পাঠ করে শোনাতেন। মাত্র ২২ বছর বয়সে জায়িদ ইবনু সাবিত রাদিয়াল্লাহু আনহু আল-কুরআন সংরক্ষণ ও সংগ্রহে দায়িত্ববান হয়ে কাজ করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে তিনি পুরো কুরআন মুখস্থ করেন এবং নবীজির ইন্তিকাল পূর্ব কিছুদিনের মধ্যে দুইবার পুরো কুরআন পাঠ করে শোনান।

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মানবজাতির মূল গাইডলাইন হিসেবে যে অবিকৃত মহাগ্রন্থ আল-কুরআন আমাদের মাঝে বিদ্যমান রয়েছে, সে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন সঙ্কলনে সাঈয়েদুনা আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহুর খিলাফতকালে আল-কুরআন সঙ্কলনকারী হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত সাহাবি উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুকে কেন্দ্র করে যে ১২ সদস্যের সমন্বিত বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়,  সে কমিটিতে জায়িদ ইবনু সাবিত রাদিয়াল্লাহু আনহুও অন্যতম সদস্য ছিলেন। উক্ত কমিটির প্রণীত মাসহাফই আজকের পবিত্র আল-কুরআন। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর খিলাফতকালে তিনি লেখক, মজলিশ-ই শূরার সদস্য এবং মদিনার প্রধান বিচারপতির দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। মহাগ্রন্থ আল-কুরআন সংরক্ষণের অনন্য ভূমিকা পালনকারী জায়িদ ইবনু সাবিত রাদিয়াল্লাহু আনহু ৪৫-৪৬ হিজরিতে ৫৬ বছর বয়সে মদিনায় ইন্তিকাল করেন। তাঁর বর্ণিত হাদিস সংখ্যা ৯২টি।  যার মধ্যে ৫টি হাদিস মুত্তাফাকুন আলাইহি (বুখারি ও মুসলিম কিতাবে যৌথ বর্ণনা)।

হাদিসের গুরুত্ব

ইসলাম যেহেতু সার্বজনীন একটি জীবনব্যবস্থা, তাই এ ব্যবস্থা কোনো স্থান-কাল কিংবা ভাষাগত সীমাবদ্ধতার কাছে থেমে থাকতে পারে না। বিশেষ করে মানুষের কাছে পৌঁছার অন্যতম হাতিয়ার ভাষাগত দিক নিয়ে প্রান্তিকতার কোনো সুযোগ নেই। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট ভাষাভাষী মানুষের কথাগুলো শোনা এবং তাদের কাছে আল্লাহর নির্দেশ পৌঁছে দেওয়ার সাথে সাথে এই অমোঘ বাণী উপলব্ধি করানোর ক্ষেত্রে ভাষাকে বাধা হিসেবে না নেওয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি বড় সুন্নাহ। আলোচ্য হাদিসটিতে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট করা হয়েছে যে, কারো কথা সঠিকভাবে জেনে তার উত্তর করা প্রয়োজন। সেজন্য তিনি কী বলতে চেয়েছেন, তা সরাসরি কথার মাধ্যমে হোক কিংবা চিঠির মাধ্যমে; তা সে ভাষাতেই সুস্পষ্টভাবে জেনে নেওয়া প্রয়োজন। যার কারণে সে ভাষায় কথা বলতে কিংবা লিখতে ভাষা শিক্ষা খুবই জরুরি একটি কাজ। এছাড়াও সুন্দর করে ইবাদাত করতে, জ্ঞানের নানান শাখায় বিচরণ করতে ভাষা শেখা বা ভাষাজ্ঞান অর্জনের কোনো বিকল্প নেই।


হাদিসের ব্যাখ্যা

০১. পৃথিবীকে নেতৃত্ব দিতে হলে, দ্বীন-ঈমান অনুযায়ী চলতে হলে আমাদের যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, সেটা হচ্ছে ইলম বা জ্ঞান। ইলম বা জ্ঞান না থাকলে মানুষ সত্য-মিথ্যা, আলো-আঁধারের পার্থক্য করতে পারে না। কুরআনুল কারিমেও আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে-

قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ ٩

অর্থাৎ বলো, যারা জানে এবং যারা জানে না তারা কি সমান? (সূরা যুমার : ৯)। সে কারণে আমাদের প্রিয় নবী, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নানাভাবে ইলম অর্জনের তাগিদ দিয়েছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন জ্ঞানের জন্য, জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে যে মানুষ বা যে ছাত্র পথ চলে, তার জন্য ফেরেশতাগণ চলার পথে পাখা বিছিয়ে দেন। একটি  হাদিসে বর্ণিত হয়েছে-

وَإِنَّ الْمَلاَئِكَةَ لَتَضَعُ أَجْنِحَتَهَا رِضًا لِطَالِبِ الْعِلْمِ ، وَإِنَّ طَالِبَ الْعِلْمِ يَسْتَغْفِرُ لَهُ مَنْ فِي السَّمَاءِ وَالأَرْضِ ، حَتَّى الْحِيتَانُ فِي الْمَاءِ ، وَإِنَّ فَضْلَ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِ الْقَمَرِ عَلَى سَائِرِ الْكَوَاكِبِ ، إِنَّ الْعُلَمَاءَ هُمْ وَرَثَةُ الأَنْبِيَاءِ ، إِنَّ الأَنْبِيَاءَ لَمْ يُوَرِّثُوا دِينَارًا وَلاَ دِرْهَمًا ، إِنَّمَا وَرَّثُوا الْعِلْمَ ، فَمَنْ أَخَذَهُ أَخَذَ بِحَظٍّ وَافِرٍ

  “ফেরেশতাগণ জ্ঞান অন্বেষীর সন্তুষ্টির জন্য তাদের পাখাসমূহ অবনমিত করেন। আর জ্ঞান অন্বেষীর জন্য আসমান ও জমিনবাসী আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে, এমনকি পানির মধ্যে মাছও। নিশ্চয় ইবাদতকারীর ওপর আলিমের মর্যাদা তারকারাজির ওপর চাঁদের মর্যাদার সমতুল্য। আলিমগণ হলো নবীগণের ওয়ারিশ। আর নবীগণ দিনার ও দিরহাম (নগদ অর্থ) ওয়ারিশি স্বত্ব হিসেবে রেখে যাননি, বরং তাঁরা ওয়ারিশি স্বত্বরূপে রেখে গেছেন ইলম (জ্ঞান)। যে ব্যক্তি তা গ্রহণ করলো, সে যেন একটি পূর্ণ অংশ লাভ করলো।” (সুনানে আবু দাউদ: ৩৬৪১)।

   এখন প্রশ্ন হলো, এই যে ইলম অর্জনের এত মর্যাদা, এ ক্ষেত্রে আমরা কোন ইলমকে অগ্রাধিকার দেব? এর জবাব হচ্ছে পবিত্র কুরআনের ইলমকেই সবচেয়ে অগ্রাধিকার দেব, কারণ কুরআনের মধ্যেই রয়েছে সকল জ্ঞান এবং এটাই হিদায়াতের একমাত্র গ্রন্থ। ইরশাদ হচ্ছে- وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَانًا لِكُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَحْمَةً وَبُشْرَى لِلْمُسْلِمِينَ 

  অর্থাৎ, “আর আমি তোমার ওপর কিতাব নাজিল করেছি, যাতে রয়েছে প্রতিটি বিষয়ের সুস্পষ্ট বর্ণনা, হিদায়াত, রহমত ও মুসলিমদের জন্য তা সুসংবাদস্বরূপ।” (সূরা নাহল : ৮৯)।  অন্যদিকে হাদিসে বলা হয়েছে, যার সিনার মধ্যে কুরআনের জ্ঞান নেই তার শরীরটা একটা বিরান বাড়ির মতো। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে- عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم-  إِنَّ الَّذِى لَيْسَ فِى جَوْفِهِ شَىْءٌ مِنَ الْقُرْآنِ كَالْبَيْتِ الْخَرِبِ  

অর্থাৎ, “আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, কুরআনের কোনো অংশই যে ব্যক্তির পেটে নেই সে (সে পেট বা উদর) বিরান ঘরের সমতুল্য।” (তিরমিজি: ২৯১৩)। এছাড়াও আরেকটা হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন দুনিয়ার সবই অভিশপ্ত, আলিম ও তালিবুল ইলম ছাড়া।

سَمِعْتُ أَبَا هُرَيْرَةَ يَقُولُ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- يَقُولُ  أَلاَ إِنَّ الدُّنْيَا مَلْعُونَةٌ مَلْعُونٌ مَا فِيهَا إِلاَّ ذِكْرَ اللَّهِ وَمَا وَالاَهُ وَعَالِمًا أَوْ مُتَعَلِّمًا

অর্থাৎ, “আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা.-কে বলতে শুনেছি, দুনিয়া এবং এর মধ্যে যা কিছু আছে সব অভিশপ্ত তবে আল্লাহর জিকির এবং তাঁর সাথে সংশ্লিষ্ট সহায়ক অপরাপর আমল, আলিম এবং তালিবে ইলম ছাড়া। (তিরমিজি : ২৩২২ )। ইলম বা জ্ঞান একজন মানুষের মর্যাদাকে বাড়িয়ে দেয়। আমাদের মালিক, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলাও তাঁর কুরআনের মাধ্যমে আমাদেরকে বিষয়টি অবহিত করেছেন। কুরআনুল কারিমে ইরশাদ হচ্ছে-

يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ

অর্থাৎ, যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে আল্লাহ তাদেরকে বহু মর্যাদায় উন্নত করবেন। (মুজাদালা ১১ আয়াত)।


০২. মানুষের প্রতি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের যে সকল নিয়ামত সেরা; সে সবের মধ্যে ভাষা হচ্ছে অন্যতম। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَمِنۡ اٰيٰتِهٖ خَلۡقُ السَّمٰوٰتِ وَالۡاَرۡضِ وَاخۡتِلَافُ اَلۡسِنَتِكُمۡ وَاَلۡوَانِكُمۡ‌ؕ اِنَّ فِىۡ ذٰلِكَ لَاٰيٰتٍ لِّلۡعٰلِمِيۡنَ‏

অর্থাৎ,‘আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের পার্থক্য। অবশ্যই তাঁর মধ্যে বহু নিদর্শন রয়েছে জ্ঞানবানদের জন্য।’ (সূরা রুম-২২)। আসলেই জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে। জ্ঞানের কথা হচ্ছে- মানুষের মনস্তত্ত্ব অনুধাবন করা জরুরি। সেটা পরস্পর ভাব বিনিময় হোক কিংবা অন্য কোনো কিছু আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে। আর এ কাজটি একজন জ্ঞানহীন মানুষ যেভাবে নেবে, জ্ঞানী মানুষ নেবে তার সম্পূর্ণ উল্টোভাবে। জ্ঞানী মানুষ সবসময় চেষ্টা করেন অর্থবহ কাজ করতে।

    বিদায় হজ্জের ভাষণের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে দ্বীনের পরিপূর্ণতার ঘোষণা পান। তা তিনি সেই ভাষণে উল্লেখ করে গেছেন। যার মাধ্যমে মুসলমানদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়- বিশ্বের সকল মানুষকে দ্বীনে হকের আওতায় আনার লক্ষ্যে কাজ করা। এটি করতে যা বিশেষভাবে জরুরি- তা হলো দাওয়াতে দ্বীন। দাওয়াতে দ্বীনের মূলমন্ত্রই হলো মানুষকে মহান আল্লাহ তাআলার দিকে আহ্বান করা, সে কাজকে সেরা কাজ হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া। আর দাওয়াত দান মানেই সুকৌশলী-সুভাষী ও যথাযথ ইলমের অধিকারী হওয়া। মহান আল্লাহর ভাষায়-

وَمَنۡ اَحۡسَنُ قَوۡلاً مِّمَّنۡ دَعَاۤ اِلَى اللّٰهِ وَعَمِلَ صَلِحًا وَّقَالَ اِنَّنِىۡ مِنَ الۡمُسۡلِمِيۡنَ‏

‘সে ব্যক্তির কথার চেয়ে আর কার কথা উত্তম হতে পাওে, যে আল্লাহর দিকে ডাকলো, সৎ কাজ করলো এবং ঘোষণা করলো আমি মুসলমান।’ (সূরা ফুসসিলাত-৩৩)।

ٱدۡعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِٱلۡحِكۡمَةِ وَٱلۡمَوۡعِظَةِ ٱلۡحَسَنَةِ‌ۖ وَجَـٰدِلۡهُم بِٱلَّتِى هِىَ أَحۡسَنُ‌ۚ

অর্থাৎ, ‘হে নবী! প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তা এবং সদুপদেশ সহকারে তোমার রবের পথের দিকে দাওয়াত দাও এবং লোকদের সাথে বিতর্ক করো সর্বোত্তম পদ্ধতিতে।’ (সূরা নাহল-১২৫)।

  এই যে সেরা একটি কাজ প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তা এবং উত্তম পন্থায় উপদেশের আলোকে প্রদান করার সরাসরি নির্দেশ মহান আল্লাহ দিলেন, তার বাস্তবায়ন তো আমাদেরকে যথাযথভাবেই করতে হবে। রাসূলুল্লাহ ﷺ দাওয়াত দানের ক্ষেত্রে বেশ কিছু স্টেপ মেইনটেইন করতেন। বিশেষ করে টার্গেটকৃতদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করা, নিজকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরা, সুন্দর-গোছালো-পরিপাটিভাবে কথা বলা; এবং হিকমত নিশ্চিত করা দাওয়াতের অন্যতম ব্যাপার ছিলো। আর এ সবগুলো স্টেপ মেইনটেইনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যোগাযোগের দক্ষতা। মহান আল্লাহ বিভিন্ন যুগে, বিভিন্ন সময়ে নবী আলাইহিস সালামদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি দিয়ে পাঠিয়েছেন। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহর বর্ণনা হচ্ছে-

وَمَاۤ اَرۡسَلۡنَا مِنۡ رَّسُوۡلٍ اِلَّا بِلِسَانِ قَوۡمِهٖ لِيُبَيِّنَ لَهُمۡ‌ؕ

অর্থাৎ, আমি নিজের বাণী পৌঁছাবার জন্য যখনই কোনো রাসূল পাঠিয়েছি, সে নিজের সম্প্রদায়ের ভাষাতেই বাণী পৌঁছিয়েছে, যাতে সে তাদেরকে খুব পরিস্কারভাবে বোঝাতে পারে। (সূরা : ইবরাহিম-৪)। এমনকি আল্লাহ তাআলা একই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন জাতির জন্য একাধিক নবী পাঠিয়েছেন। ব্যতিক্রম শুধু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ক্ষেত্রে। তিনি প্রধানত আরব জাতির সন্তান হিসেবে আরবি ভাষায় ওহি পেয়েছেন। কিন্তু সমগ্র বিশ্বের জন্য এবং পৃথিবীর শেষ পর্যন্ত একমাত্র শেষ নবী হিসেবে নবুয়াতপ্রাপ্ত হয়েছেন। সেজন্য পৃথিবীর মানুষ যে সংস্কৃতি কিংবা যে ভাষারই হোক না কেন, সকলের কাছে দাওয়াত পৌঁছে দেওয়ার সংস্কৃতি চালু করে গেছেন তিনি। আলোচ্য হাদিস তার প্রমাণ। 

  তৎকালে ইয়াহুদি ও নাসারা সম্প্রদায়ের একটি স্বভাব ছিলো- তারা তাদের কিতাব থেকে রেফারেন্স টেনে কথা বলতো। আর পূর্বেকার নাজিলকৃত (যদিও সেসব বিকৃত ছিলো) সেসব কিতাব ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় ছিল, যা বুঝতে পারা আরবিয়দের জন্য দুরূহ ছিল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের থিওরি ছিল সীমাবদ্ধতা ডিঙানো। তাই জায়িদ ইবনু সাবিতকে সহজে এসব ভাষা বুঝে ফেলার তাগাদা হিসেবে ভাষাগত জ্ঞান শিক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছেন।


হাদিসের শিক্ষা

- ইলম বা জ্ঞান মানুষের মর্যাদাকে উন্নীত করে।

- ইলম অর্জনের প্রথম এবং প্রধান উৎস হবে কুরআন 

- নেতৃত্বের জন্য জ্ঞান অর্জন প্রয়োজন

- প্রত্যেক মানুষ তার মাতৃভাষায় কথা বলতে সহজবোধ করে থাকে; এটি উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।

- কারো সাথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য তার ভাষায় তাকে অনুধাবন জরুরি।

- ইসলামে সীমাবদ্ধতার স্থান নেই।   

লেখক : ইসলামী চিন্তাবিদ, গবেষক ও সংগঠক


আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির