সাম্প্রতিক সময়ে শ্রীলঙ্কার বর্তমান এই দুর্দশার সঙ্গে সম্ভবত চীনের নামই সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে। ন্যাশ ডেইলি, নাইটফেম, প্রজেক্টসিন্ডিকেট ইত্যাদি জনপ্রিয় সব কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের বানানো ভিডিও দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সয়লাব লাখ লাখ শেয়ার কমেন্ট পাচ্ছে। টুইস্টভরা এসব ভিডিও। তবে এর সাথে চীনের নামই উচ্চারিত হচ্ছে বেশি। আর এ কারণে অনেকে আবার চীন থেকে ঋণ নিয়ে দেশীয় প্রকল্প বাস্তবায়নের ঘোরবিরোধী। অনেকে মনে করছেন, চীন শ্রীলঙ্কাকে ইচ্ছে করে অনেক টাকা ধার দিয়ে ঋণের জালে আবদ্ধ করে ফেলেছে। আর বোকা শ্রীলঙ্কাও বাছবিচার না করে বিশাল বিশাল অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলো হাতে নিয়ে সেটার মাশুল দিচ্ছে এখন।
কিন্তু আসল ঘটনা কী! এপ্রিল পর্যন্ত চীনের কাছে শ্রীলঙ্কার স্টক ঋণ মাত্র ১০ শতাংশ। এমনকি জাপানও তার থেকে বেশি ঋণ দিয়েছে শ্রীলঙ্কাকে। অন্যদিকে, শ্রীলঙ্কার বেশির ভাগ বাহ্যিক ঋণের স্টক আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজারে পাওনা, যা প্রায় ৪৭ শতাংশ! আরও প্রায় ২২ শতাংশ বহুপাক্ষিক উন্নয়ন ব্যাংকগুলোর হাতে। তার মানে দেখা যাচ্ছে, শ্রীলঙ্কার এই দুর্দশার জন্য চীনের অবদানের আগে আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজার, উন্নয়ন ব্যাংকগুলো, জাপানের নাম আসা উচিত।
বিবিসিসহ বেশ কয়েকটি জার্নাল মোটাদাগে শ্রীলঙ্কার এই সমস্যার মূল কারণগুলো চিহ্নিত করেছে এভাবে-
১. রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া রাজাপাকসের অধীনে শ্রীলঙ্কার বর্তমান সরকার তার দেশে বড় ধরনের কর কমিয়েছে। ব্যক্তিগত কর ও প্রতিষ্ঠানের কর উভয়ই তার আওতাভুক্ত ছিল। অতিমাত্রায় কর কমানোর ফলে সরকারের আয় কমে রাজস্ব ও রাজস্বনীতিকে প্রভাবিত করেছে। ফলে বাজেট ঘাটতি বেড়েছে। কিন্তু বিভিন্ন সরকারি খরচ তো সে অনুপাতে কমেনি বরং বেড়েছে। এবং সেই অতিরিক্ত খরচ মেটানোর জন্য শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক অতিরিক্ত টাকা ছাপতে শুরু করে। যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) অর্থ ছাপানো বন্ধ করার জন্য ও পাশাপাশি সরকারি খরচ কমানোর জন্য, সুদের হার বাড়ানো ও কর বাড়াতে শ্রীলঙ্কান সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিলো। সেইসঙ্গে আইএমএফ সতর্ক করে দিয়েছিলো যে টাকা ছাপানো অব্যাহত থাকলে একটি অর্থনৈতিক বিস্ফোরণ হতে পারে। সেটাই হলো শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা যদি মার্কেটে বিচরণ করে, সেটা মূল্যস্ফীতি তৈরি করে।
২. ২০২১ সালের এপ্রিলে, রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া রাজাপাকসে ঘোষণা করেছিলেন, শ্রীলঙ্কা কেবলমাত্র কৃষি রাসায়নিক ভিত্তিক সার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে জৈব চাষের অনুমতি দেবে। পরিবেশ আগে না অর্থনীতি আগে, দীর্ঘসময় ধরে চলা এই বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে শুধুমাত্র এই সার নিষেধাজ্ঞার ফলে শ্রীলঙ্কায় চা উৎপাদন কমে যায় প্রায় ৪২৫ মিলিয়ন ডলার। শ্রীলঙ্কার অন্যতম প্রধান রফতানি পণ্য হলো এই চা। সুতরাং হঠাৎ এমন প্রসূত নীতির ফলে শুধুমাত্র প্রথম ছয় মাসের মধ্যে চাল উৎপাদনে ২০ শতাংশ হ্রাস পায়। ধান উৎপাদনে পূর্বে অর্জন করা স্বয়ংসম্পূর্ণতাকে উল্টিয়ে ৪৫০ মিলিয়ন ডলার এর ধান আমদানি করতে বাধ্য হয়। একবার ভাবুন আমাদের তৈরি পোশাক যদি হঠাৎ করে এভাবে ধসে পড়ে আমাদের কি অবস্থা হবে? রফতানি করে যদি ডলারই না পায়, তাহলে একটি দেশ কিভাবে বিদেশি ঋণ পরিশোধ করবে আর আমদানি করবে?
৩. আবার বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য শ্রীলঙ্কাকে অনেক নামিদামি জিনিস আমদানি করতে হয়। এসব আমদানির জন্য প্রয়োজন প্রচুর ডলারের। আমদানির বিপরীতে রফতানি কম হওয়ায়, ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত বৈদেশিক রিজার্ভ ২.৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে যাওয়ার কারণে শ্রীলঙ্কাকে দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়, যা বিদেশি ঋণের দায় পরিশোধের জন্য অপর্যাপ্ত।
২০২১ এর নভেম্বরের শেষে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক রিজার্ভ মাত্র ১.৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে যা মাত্র এক মাসের মূল্যের আমদানির জন্য যথেষ্ট। কারণ শুধুমাত্র ২০২২ সালের জন্য শ্রীলঙ্কাকে ৭ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ ও আরো এক বিলিয়ন ডলার আন্তর্জাতিক বন্ড (ISB) পরিশোধ করতে হবে। আবার আমাদের মতো শ্রীলঙ্কার এত বিশাল জনগোষ্ঠী প্রবাসে থাকে না কিংবা বিদেশ থেকে ডলার পাঠায় না যাতে করে আমদানি-রফতানির গ্যাপ সহজে পূরণ করতে পারবে। ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ, আমদানিনির্ভরের ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে শ্রীলঙ্কায় সামাজিক অস্থিরতা ও প্রতিবাদ দেখা দেয়।
৪. শ্রীলঙ্কার অন্যতম প্রধান আয়ের ক্ষেত্র পর্যটন খাত যা আবার ২০১৯ সালের সন্ত্রাসী হামলার দ্বারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তারপরে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে কোভিড-১৯ মহামারী এটিকে পুনরুদ্ধার করা থেকে বাধা দেয়। জুন ২০১৯ এ বিশ্বব্যাংকের মতে, শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ও এর জনগণের জীবনে কোভিড-১৯ মহামারীর ব্যাপক ক্ষতি সত্ত্বেও, ২০২১ সালে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করবে এমন ধারণা পোষণ করা হলেও সেটা বাস্তবে হয়নি। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠবার ইতিবাচক লক্ষণ এরই মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে, কিন্তু শ্রীলঙ্কার আত্মনির্ভরশীলতা গড়ে তুলতে ও ভবিষ্যতে বিদেশি ঋণের ওপর উচ্চ নির্ভরতা এড়াতে যথাযথ কর আরোপকে অত্যন্ত উৎসাহিত করা হয়েছে।
নগদ সঙ্কটে পড়া শ্রীলঙ্কা তার বিশাল চীনা ঋণের বোঝা পুনরায় নির্ধারণ করতে চেয়েছে আর চীন তাতে সম্মতি দিয়েছে। পাশাপাশি বর্তমান অবস্থা সামাল দেবার জন্য শ্রীলঙ্কা ভারত ও চীন উভয়ের কাছেই ফের হাত পাতে। অনেকটা বাংলাদেশের মতো। অর্থনৈতিক মন্দা আর উন্নয়নের মুলা ঝুলিয়ে সরকারের বড় বন্ধু ভারতকে ওভারকাম করে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ধার নিচ্ছে চীনের কাছ থেকে। চীন হচ্ছে শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় দ্বিপাক্ষিক (একক) ঋণদাতা। ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার ৩৫ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋণের প্রায় ১০ শতাংশ চীনের ছিল। অবশ্য অর্থনীতিবিদরা বলেছেন চীনের মোট ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি হতে পারে। শ্রীলঙ্কা অবকাঠামো তৈরির জন্য চীনের কাছ থেকে প্রচুর ধার নিয়েছে। যেমন দক্ষিণ শ্রীলঙ্কায় একটি বন্দর নির্মাণের জন্য ১.৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পরিশোধ করতে অক্ষম হলে ২০১৭ সালে একটি চীনা কোম্পানির কাছে ৯৯ বছরের জন্য লিজ দিতে বাধ্য হয়েছিলো। এটি কি চীনের ইচ্ছাকৃত ঋণের ফাঁদ নাকি শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি, অক্ষমতা সেটা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত সতর্ক করেছিল যে হাম্বানটোটা বন্দর, অত্যাবশ্যক পূর্ব-পশ্চিম আন্তর্জাতিক শিপিং রুট বরাবর অবস্থিত, ভারত মহাসাগরে চীনকে একটি সামরিক আধিপত্য দিতে পারে। আমেরিকা ও ভারতের এই সাবধান করা যতটা না অর্থনীতিক তার চাইতে বেশি সামরিক বলে গুঞ্জন রয়েছে।
জানুয়ারিতে বিবিসির একটি রিপোর্টের শিরোনাম ছিল- ""Colombo Port City: A new Dubai or a Chinese Enclave?" Enclave?" ঊহপষধাব মানে ছিটমহল। খবরটি দাবি করছে যে, শ্রীলঙ্কার বন্দর এলাকায় বিস্তৃৃত এলাকাজুড়ে মাটি ভরাট করে যে নতুন শ্রীলঙ্কা জন্ম নিচ্ছে সেটি হতে যাচ্ছে দেশটির জন্য ‘খেলা বদলে দেওয়ার মত ঘটনা’, যে কারণে প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহ বিশেষ করে হংকং ও সিঙ্গাপুরের মতো আন্তর্জাতিক বন্দর শহরগুলোর কপালে ভাঁজ পড়ছে কারণ এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে শ্রীলঙ্কার অবস্থাতো বদলাবেই সেই সঙ্গে অসুবিধায় পড়বে এসব বন্দরনগরীগুলোও। সাগর ভরাট করে ৬৬৫ একর (২.৬ বর্গকিলোমিটার) ভূমি উদ্ধারের জন্য শ্রীলঙ্কা দায়িত্ব দিয়েছে চায়না হার্বার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিকে, যারা এখানে বিনিয়োগ করছে ১৪০ কোটি ডলার। তবে এর বিনিময়ে এই চীনা কোম্পানিকে ৯৯ বছরের জন্য দিয়ে দিতে হচ্ছে মোট ভূমির ৪৩ শতাংশ।
এই মুহূর্তে বিশ্লেষকরা চীন থেকে বাংলাদেশের অতিরিক্ত ধার নিয়ে উন্নয়নের রূপক বাতচিতকে শ্রীলঙ্কার সাথে তুলনা করছেন। তবে মজার ব্যাপার হলো রাজাপাকসে পরিবার শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে এই মুহূর্তে অভিশপ্ত নাম হলেও তারা কিন্তু জনগণের ভোটের মাধ্যমেই ক্ষমতায় এসেছে। সেই অর্থে বাংলাদেশ তার উল্টো। শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশ থেকে খুব বেশি দূরের দেশ নয়। উপমহাদেশের কোনো একটি দেশে কোনো নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটলে তার প্রভাব ও ছায়া দুটোই বাকি দেশগুলিতে পড়ে থাকে। বাংলাদেশ নিয়েও যথেষ্ট সতর্ক হওয়ার কথা বলছেন অর্থনীতিবিদরা। চলমান মেগা প্রকল্পসমূহ অতি দ্রুত শেষ করে সেগুলোকে লাভজনক করে তুলে বাংলাদেশকে যতো দ্রুত ‘ঋণমুক্ত’ করা যায় সেদিকেও নজর দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু কথাতো সেখানেই, শ্রীলঙ্কার মতো নেতিবাচক উদাহরণ যদি আমাদের সামনে থাকে এবং শ্রীলঙ্কায়, যা ঘটেছে, যেভাবে দেশটি আজকের অবস্থায় এসেছে সেসব ধর্তব্যে এনে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সেসব ঘটতে না দিলেই যে বিপদমুক্তি, সেটা বোঝার জন্য তো আর অর্থনীতির পণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজন নেই, সাদা চোখেই এসব বোঝা যাওয়ার কথা।
চীনের অর্থে বাংলাদেশের অনেক মেগা প্রকল্প শেষ হবার নির্দিষ্ট মেয়াদ বারবার বাড়ানো হচ্ছে। শ্রীলঙ্কা একযুগের বেশি সময় ধরে তাদের দেশে বেশ কিছু মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, রাস্তা এবং আরও নানা ধরনের প্রকল্প রয়েছে, যেগুলো বর্তমানে অপ্রয়োজনীয় ও অতিবাহুল্য বলে বিবেচিত হচ্ছে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে দেদার ঋণ নিয়েছে শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন সরকার। যার কারণে তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধীরে ধীরে খালি হতে থাকে। সেদেশের অর্থনীতিবিদদের ভাষ্য, গত ১৫ বছর ধরে শ্রীলঙ্কায় সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ তেমন একটি হয়নি। বিদেশি বিনিয়োগের পরিবর্তে বিভিন্ন সরকার ঋণ করার প্রতি মনোযোগী হয়েছে।
১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে কখনো এতটা দুরবস্থায় পড়েনি দেশটি। বৈদেশিক ঋণের ভারে জর্জরিত শ্রীলঙ্কা। পরিস্থিতি এমন অবস্থায় ঠেকেছে যে তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারছে না। খবরে বলা হচ্ছে- জিনিসপত্রের দাম এখন আকাশছোঁয়া। কাগজের অভাবে দেশটির স্কুল পর্যায়ের পরীক্ষা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ। কারণ, কাগজ আমদানি করার মতো বৈদেশিক মুদ্রা তাদের কাছে নেই। জ্বালানি তেলের তীব্র সঙ্কট তৈরি হয়েছে দেশটিতে। তেল সংগ্রহের জন্য হাজার-হাজার মানুষ লাইনে ভিড় করেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে দেশের পেট্রোল পাম্পগুলোতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছে দেশটির সরকার। কারণ, জ্বালানি তেল আমদানি করার জন্য বৈদেশিক মুদ্রা নেই শ্রীলঙ্কার কাছে। ইরানের কাছ থেকে জ্বালানি তেল আমদানি বাবদ আড়াই শ’ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে পারেনি শ্রীলঙ্কা। এর বিনিময়ে প্রতি মাসে পাঁচ মিলিয়ন ডলারের চা ইরানে রফতানি করবে দেশটি। এভাবে ধীরে ধীরে সে টাকা পরিশোধ করা হবে।
একটা প্রশ্ন হতে পারে চীনের ঋণ পরিশোধ করা কি কঠিন? পশ্চিমা দেশের সরকার যতো সুদে ঋণ দেয় চীন তার চাইতেও বেশি সুদে ঋণ দিয়ে থাকে। তাদের সুদের হার প্রায় ৪%, যা বাণিজ্যিক মার্কেটগুলোর সুদের হারের প্রায় সমান। এ ছাড়াও বিশ্বব্যাংক কিংবা ফ্রান্স অথবা জার্মানির মতো ভিন্ন কোনো দেশের দেয়া ঋণের সুদের হারের চেয়েও চীনা ঋণের সুদের হার প্রায় চার গুণ বেশি। কিন্তু চীনা ঋণ পাওয়াটা অনেকটা সহজ। চীনা ঋণ সাধারণত অল্প সময়ের মধ্য পরিশোধ করতে হয়- সেটা ১০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে। কিন্তু অন্যান্য দাতারা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে যেসব ঋণ দেয় সেগুলো পরিশোধ করতে সময় দেয়া হয় ২৮ বছরের মতো।
দরিদ্র দেশগুলোকে চীন যেভাবে ঋণ দিচ্ছে তার কারণে অনেক সমালোচনা হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে যে এই ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে সেসব দেশ হিমশিম খাচ্ছে এবং এর ফলে তারা বেইজিংয়ের কাছ থেকে চাপের মুখেও পড়ছে। গত এক দশকে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে দেয়া চীনের ঋণের পরিমাণ তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ সালের শেষ নাগাদ এর পরিমাণ ছিলো ১৭০ বিলিয়ন ডলার। তবে চীনের সার্বিক ঋণের পরিমাণ এই হিসাবের চাইতেও আরো অনেক বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের উইলিয়াম অ্যান্ড মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কেন্দ্র এইডডাটার এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোকে চীন যে পরিমাণ ঋণ দিয়েছে তার অর্ধেকই সরকারি পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়নি। এসব ঋণ প্রায়শই সরকারি হিসাবপত্রের বাইরে রাখা হয়। কোনো একটি দেশের সরকারকে দেয়া ঋণকে চীন সরকারের সরাসরি ঋণ হিসেবে না দেখিয়ে চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি এবং ব্যাংক, যৌথ প্রকল্প কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে দেওয়া ঋণ হিসেবে দেখানো হয়। এইডডাটার হিসেব অনুসারে, বর্তমানে ৪০টিরও বেশি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশ আছে, যাদের এসব ‘গোপন ঋণের’ কারণে চীনা ঋণদাতাদের কাছে যাদের ঋণের পরিমাণ তাদের বার্ষিক মোট জাতীয় উৎপাদনের ১০ শতাংশের চাইতেও বেশি। চীনের কাছে জিবুতি, লাওস, জাম্বিয়া এবং কিরগিস্তানের ঋণের পরিমাণ তাদের বার্ষিক মোট জাতীয় উৎপাদনের ২০ শতাংশের সমান। চীনের কাছ থেকে নেয়া এসব ঋণের বেশির ভাগই বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য নেয়া যার মধ্যে রয়েছে সড়ক, রেলওয়ে এবং বন্দর নির্মাণ। খনি উত্তোলন থেকে শুরু করে জ্বালানি শিল্পের জন্যও এসব ঋণ নেয়া হয়েছে। অধিকাংশ ঋণই দেওয়া হয়েছে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের আওতায়।
সম্প্রতি বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ব্রিটেনের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা এমআই সিক্সের প্রধান রিচার্ড মুর বলেছেন, অন্যান্য দেশের কাছ থেকে সুবিধা লাভের জন্য চীন তার ভাষায় এই ‘ঋণের ফাঁদ’ ব্যবহার করে থাকে। দাবি করা হয় যে চীন অন্যান্য দেশকে ঋণ হিসেবে অর্থসহায়তা দিয়ে থাকে যারা সেই ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে তাদের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ বা অধিকার নিয়ে নেয়। চীনের সমালোচকরা এ ব্যাপারে প্রায়শ যে দেশটির উদাহরণ দেয় তা হচ্ছে শ্রীলঙ্কা।
‘চীনা ঋণের ফাঁদ’ কথাটি এখন উন্নয়ন ডিসকোর্সে একটি বহুল প্রচলিত অভিযোগ। বলা হচ্ছে, চীন তার বিশ্ব আধিপত্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রধানত মহাসড়ক, রেলপথ, গভীর সমুদ্রবন্দর, বিদ্যুৎ উৎপাদন প্ল্যান্ট, খনিজ আহরণ প্রকল্প ইত্যাদি ভৌত অবকাঠামোতে সহজ শর্তে যে বিপুল ঋণ প্রদান করছে, তাতে বেশির ভাগ দেশ প্রলুব্ধ হয়ে এমন সব প্রকল্পে এই ঋণের অর্থ বিনিয়োগ করছে, যেগুলোর ‘ইকোনমিক ফিজিবিলিটি’ নড়বড়ে হওয়ায় প্রকল্প সম্পন্ন হওয়ার পর ওই সব প্রকল্পের আয় থেকে সুদাসলে চৈনিক ঋণ পরিশোধ করা যাচ্ছে না। ফলে এসব দেশ একের পর এক চৈনিক ঋণের ফাঁদে আষ্টেপৃষ্ঠে আটকা পড়ে ওই প্রকল্পগুলোর দীর্ঘমেয়াদি কর্তৃত্ব চীনকে অর্পণ করতে বাধ্য হচ্ছে, অথবা চীনকে নিজেদের সার্বভৌমত্ববিরোধী নানা সুবিধা দিতে বাধ্য হচ্ছে।
পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী বর্তমান স্যাটেলাইটের সক্ষমতাই আমরা পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারছি না। এই অবস্থায় দ্বিতীয় স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের উদ্যোগ অযৌক্তিক। এ ধরনের ব্যয়বহুল অথচ অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের মোহে ডুবতে থাকলে বাংলাদেশও একসময় ‘ঋণের ফাঁদে’ আটকে যাবে। এছাড়া পটুয়াখালীর পায়রায় নির্মিতব্য এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রে চীন বিনিয়োগ করেছে ১৬ হাজার কোটির টাকার বেশি। রাজধানী ঢাকার বিদ্যুতের আধুনিকায়নে বিনিয়োগ করছে চীন। বিশেষত ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের আওতায় বিদ্যুৎ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগ রয়েছে ১১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা। এছাড়া ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ১০ হাজার ৯৫০ কোটি টাকার অর্থায়ন করছে চীন।
এসব বিনিয়োগ অর্থবহ ও জনবান্ধব করতে প্রয়োজন প্রকল্প বাস্তবায়নে সময়ক্ষেপণ রোধ, দুর্নীতিমুক্ত জবাবদিহিমূলক জনগণের সরকার। যেখানে সব সূচকেই ব্যর্থ আমরা- আর তাই শ্রীফঙ্কার মতো ব্যর্থতার আশঙ্কার কথা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
এখন শ্রীলঙ্কার এই দশা থেকে বাংলাদেশ কী শিক্ষা নেবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের ঋণের হার এখন জিডিপির ৩৮ শতাংশ। গত জুন পর্যন্ত হিসাবে বাংলাদেশের মোট দেনার পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৪৪ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। এর প্রায় ৩৭ শতাংশ এসেছে বিদেশি উৎস থেকে, পরিমাণ ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা। বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের হার জিডিপির ১৩ শতাংশ। সুতরাং আপাতত চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই বলেই সরকার বলছে। আইএমএফের হিসাবে এই হার ৫৫ শতাংশের বেশি হলেই বিপদ। তবে শ্রীলঙ্কার উদাহরণ থেকে এখন থেকেই কয়েকটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সতর্ক হতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রথমত, বড় প্রকল্পের সংখ্যা বাড়ছে, যার প্রায় সব ক’টিই অবকাঠামো প্রকল্প। এসব ঋণের মধ্যে সরবরাহ ঋণও (সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট) আছে। এর সুদহার বেশি, ঋণ সরবরাহকারীরাই প্রকল্প তৈরি করে দিচ্ছে। এ ধরনের ঋণে বাস্তবায়িত প্রকল্পের মান নিয়ে প্রশ্ন থাকে, অর্থ খরচের জবাবদিহি কম এবং সময়মতো প্রকল্পের কাজও শেষ হয় না। দ্বিতীয়ত, বর্তমানে ১০টি বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর একটির কাজও সময়মতো শেষ হয়নি। সময় বেড়েছে, ব্যয়ও বেড়েছে। এতে এর অর্থনৈতিক মূল্যও কমে যাচ্ছে। ফলে সব কটি প্রকল্প থেকে বিনিয়োগ কতটা সময়ে ফেরত আসবে, সেটিও এখন বড় প্রশ্ন। তৃতীয়ত, বড় প্রকল্পের কারণে এখন বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের দায় বাড়ছে আগের চেয়ে দ্রুতগতিতে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্র বলছে, ২০০৯-১০ অর্থবছরেও বাংলাদেশকে পরিশোধ করতে হয়েছিল ৮৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯১ কোটি ডলার। সূত্রগুলো জানাচ্ছে, রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বড় প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হলেই এই ঋণ পরিশোধের দায় অনেক বেড়ে যাবে। ফলে চাপ তৈরি হবে। চতুর্থত, স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে বের হয়ে গেলে কম সুদে আর ঋণ পাবে না বাংলাদেশ। মিলবে না বাণিজ্যে বিশেষ অগ্রাধিকার সুবিধা। নিতে হবে বেশি সুদের ঋণ। এতে দায় পরিশোধও বাড়বে। ফলে এখন থেকেই ঋণের দায় নিয়ে সতর্ক হতে হবে। লেখক : সংস্কৃতিকর্মী
আপনার মন্তব্য লিখুন