post

সমকালীন রাজনৈতিক সঙ্কটের তত্ত্ব ও তথ্য উত্তরণের উপায়

ড. আবদুল লতিফ মাসুম

০২ ডিসেম্বর ২০২৩

বাংলাদেশ জাতি রাষ্ট্রের অব্যাহত সঙ্কট বহুমাত্রিক। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জিল্লুর আর খান তাঁর একটি গ্রন্থে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতাকে সঙ্কটের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অপরদিকে লিফসুজ (Laurence Lifsultz) প্রমুখ সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে অসমাপ্ত বিপ্লব (Unfinished Revolution) বলেছেন। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের ভাষায়, বাংলাদেশ জাতির রাষ্ট্রটি জাতীয়তাবাদের পরিপূর্ণ পরিণতির পূর্বেই আবির্ভূত হয়েছে। রুপার্ট ইমারসন (Ropart Eumerson) রাজনৈতিক তত্ত্ব প্রয়োগ করে এ ধরনের জাতি রাষ্ট্রকে বলেছেন, ‘Nations in hope’। বাঞ্ছিত রাষ্ট্রনায়কেরা জাতি গঠনপ্রক্রিয়ার (Nation Building Process) মাধ্যমে ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রকে কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। অপরদিকে অবাঞ্ছিত রাষ্ট্রনায়কেরা একটি সমজাতিক সমাজ (Homogeneous society) কে বিভক্ত করে কৃত্রিম জাতীয় পরিচয়ের সঙ্কট (Crisis in National Identity) সৃষ্টি করেছেন। বাংলাদেশের বিগত পাঁচ দশকের রাজনৈতিক উন্নয়ন, শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন, সামাজিক অস্থিরতাকে এই বহুমাত্রিক পটভূমিতেই বিশ্লেষণ করতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশ যে রাজনৈতিক সঙ্কট অতিক্রম করছে তা সমাগত ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচন কেন্দ্রিক। দুর্ভাগ্যের বিষয়, যারা জাতিকে কৃত্রিম জাতীয় পরিচয়ের সঙ্কটে নিক্ষেপ করেছে, তারাই নির্বাচন ব্যবস্থাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে রাজনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টি করছে।

সঙ্কট : রাষ্ট্রিক ও ব্যক্তিক (Crisis: State Centric & Individual)

পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ (Internal Colonialism) থেকে একটি স্বকীয় স্বাধীন সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র গঠনই ছিলো মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত লক্ষ্য। বাইরের হস্তক্ষেপ ব্যতীত বাংলাদেশের মানুষ নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণ করবে, জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন করবে, শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করবে এবং নিজস্ব বিশ্বাস, মূল্যবোধ এবং জীবনধারা গড়বে- এটাই ছিলো স্বাধীনতার উদ্দেশ্য। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল থেকে আজ পর্যন্ত দেশটি পরাশক্তি এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অব্যাহত ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে আসছে। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে যে রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় তারা বৃহৎ প্রতিবেশীর ‘অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি’ (Subsidiary Alliance) স্বেচ্ছায় মেনে নেয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা রীতিমতো বিপন্ন হয়ে পড়ে। ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টের ঘটনাবলীর মাধ্যমে রাজনৈতিক স্বাধীনতা সংহতকরণের যে প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়, বিগত পাঁচ দশকে তা বারবার ব্যাহত হয়। অবশেষে ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে প্রকৃতপক্ষেই বাংলাদেশে একটি তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। নিকট প্রতিবেশীর রণকৌশল বিশারদরা সানন্দে তা স্বীকার করেন। (Sreeradha Dutta, ÒSynergy with IndiaÓ in Caretaking Democracy, DSA. New Delhi, 2008)

সম্প্রসারণবাদী প্রতিবেশীর শক্তির সমীকরণে একজন জাতীয়তাবাদী জিয়াউর রহমানকে যেমন জীবণ দিতে হয় (Subramaniam Swamy, Sunday, Calcutta, September 18-24, 1988) তেমনই একটি প্যাকেজ ডিল (Package Deal) এর মাধ্যমে বস্তা বস্তা টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশের বর্তমান শিখণ্ডী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। (The Economist, 18-24- March 2012.) ক্ষমতাসীন সরকার কার্যত প্যাকেজ ডিলের আওতায় বাংলাদেশের ভৌগোলিক কাঠামোকে তছনছ করে দিয়েছে। প্রতিবেশী এখন বাংলাদেশের সকল সম্পদের উপর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রয়োগে প্রস্তুত। দেশজ শিল্প ব্যবসা-বাণিজ্য ধ্বংসের উপক্রম। বাংলাদেশকে বিপন্ন করার জন্য টিপাইমুখ ড্যামসহ ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করছে। তিস্তা নদীর ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সীমান্তে অসংখ্য নাগরিগকে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীরা (Border Security Force) হত্যা করছে। আমাদের ফেলানীরা কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলছে। এসবের পরও ক্ষমতাসীন সরকারের মন্ত্রী বন্ধুত্বের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণের নির্লজ্জ উচ্চারণ করছেন। ট্রানজিটসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা উজাড় করে দেওয়া হয়েছে। এখন বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রের (Failed State) শিরোপা সইতে হচ্ছে। বাংলাদেশ দিল্লি থেকে শাসিত হচ্ছে এমন উচ্চারণ অহরহ শোনা যাচ্ছে। এই হলো বাংলাদেশের সার্বিক স্বাধীনতার মানচিত্র।

ব্যক্তিক: অপরদিকে ব্যক্তিক স্বাধীনতা বিপন্ন। বাংলাদেশের সংবিধানে মৌলিক অধিকার (Fundamental Rights) এর বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে। বিগত পাঁচ দশক ধরে অনেক সীমাবদ্ধতার মাঝেও যে নাগরিক অধিকার সংরক্ষিত ছিলো, সংবিধানের ১৫ সংশোধনীর মাধ্যমে তাও আজ বিপন্ন। মৌলিক নীতিমালার নামে সংযোজিত ৫৫ ধারা মোতাবেক সংবিধানের সমালোচনা করা, লঙ্ঘন করা ইত্যাদি সর্বোচ্চ দণ্ডযোগ্য অপরাধ। এ ধারা আবার ভবিষ্যতেও পরিবর্তনযোগ্য নয়। এই বিপজ্জনক সংশোধনীর মাধ্যমে নাগরিক সাধারণের অবশিষ্ট স্বাধীনতাটুকুও কেড়ে নেয়া হয়েছে। (Ali Riaz, Inconvenient Truth about Bangladesh Politics, Forum Vol.5, Issue 11, November 2011)

ব্যক্তিক স্বাধীনতার এই কাঠামোগত পরিবর্তন থেকেই এটা দৃশ্যমান হয় যে, শাসক এলিটরা নাগরিক সাধারণকে কতটুকু মৌলিক অধিকার দিতে চান। এই তাত্ত্বিক পরিবর্তনের বাস্তব প্রয়োগ আরও ভয়াবহ। নাগরিক সাধারণ, রাজনৈতিক দলসমূহ, সভা-সমিতি, সংগঠন, আন্দোলন এমনকি ধর্মীয় স্বাধীনতা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। প্রধান বিরোধীদলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তিকে নির্মূলের মহাপরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে সরকার। ২০২৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তাদের শক্তি প্রয়োগের মহড়া সকল সীমা অতিক্রম করেছে। সবচেয়ে ঝুঁকিহীন নির্দোষ মানববন্ধনেও পুলিশ পেটায়। সামান্য পোস্টার বা দেয়াল লিখনও অন্যায়। মিটিং মিছিল অবরোধ ও হরতাল কোনো কর্মসূচিই সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। বিরোধীদল আহূত মহাসমাবেশ এবং হরতালকে কেন্দ্র করে নাগরিকদের উপর যে নিপীড়ন নির্যাতন করা হয়েছে তা কোনো সভ্য সমাজে সম্ভব নয়। মহাসমাবেশ ঠেকানোর জন্য সরকার ন্যাক্কারজনকভাবে সকল যানবাহন বন্ধ করে দেয়। হামলা-মামলা নিত্যদিনের কর্মসূচি হয়ে দাঁড়িয়েছে। শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে হাস্যকর ও গায়েবি মামলা দিয়ে সকল প্রকার রাজনৈতিক শিষ্টাচার ভঙ্গ করেছে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে রিমান্ডে নিয়ে পাশবিক আচরণ করা হচ্ছে। তাদের ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করছে।

প্রাতিষ্ঠানিক সঙ্কট (Institutional Crisis)

একটি রাষ্ট্র ও সরকারব্যবস্থায় প্রাতিষ্ঠানিকতা, নিয়মতান্ত্রিকতা তথা আইনের শাসন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে সব কাঠামো ও ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে একটি দেশ শাসিত হয় সে সব প্রতিষ্ঠানের কাঠামো, কার্যক্রম, ক্ষমতার সীমারেখা এবং শৃঙ্খলা নির্ধারণ ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত সরকারের দায়িত্ব। মোটা দাগে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়:

আইন সভা (Legislature)

নির্বাহী বিভাগ (Executive)

বিচার বিভাগ (Judiciary)

ক. আইনসভা (Legislature)

আইনসভা যা আমাদের সংবিধানে ‘জাতীয় সংসদ’ বলে কথিত রাষ্ট্রব্যবস্থায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। আইনসভা গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, একইসাথে প্রতিষ্ঠানটি নাগরিক সাধারণের পক্ষ থেকে আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান। লর্ড ব্রাইসি (Lord Bryce) কথিত ‘ক্ষয়িষ্ণুমান আইনসভা তত্ত্ব’ এর ব্যাপক কোনো পরিবর্তন না ঘটলেও বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে আইনসভার ভূমিকা ব্যাপক।

বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রটি সংসদীয় সরকারব্যবস্থায় তার যাত্রা শুরু করে। কিন্তু খুব অল্প সময়ের মধ্যেই শাসক গোষ্ঠী স্বৈরতন্ত্রে পরিণত হয়। ১৯৭৫ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে একদলীয় শাসন কায়েম করা হয়। ১৯৭৫-১৯৯০ পর্যন্ত দেশ রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা দ্বারা শাসিত হয়। ১৯৯০ সালে সামরিক স্বৈরতন্ত্রের পতনের মধ্য দিয়ে আবার সংসদীয় ব্যবস্থা ফিরে পায় দেশ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, রাজনৈতিক অপশক্তির অভ্যুদয়ে সংসদীয় ব্যবস্থা অকার্যকর (Disfunction) হয়ে পড়েছে। সমাজতাত্ত্বিকরা বলছেন রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন ঘটেছে, রাজনীতির বাণিজ্যিকরণ ঘটেছে। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো যারা গণতন্ত্রের প্রবক্তা, গণতন্ত্রের মানসকন্যা বলে পরিচিতি পেতে আগ্রহী তারা স্বাধীনতার সূচনাতে যেমন গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে বর্তমান সময়ে সেই অপশক্তিই গণতন্ত্রকে পদদলিত করছে। সংসদকে এরা এমনভাবে পরিচালিত করছে, এমনসব কর্মব্যবস্থা নিচ্ছে, এমন সব নিবর্তনমূলক বিধি ব্যবস্থা নিচ্ছে যেখানে বিরোধীদলের ভূমিকার আর কোনো সুযোগ থাকছে না। বারবার তাড়স্বরে যেমন তারা বলছে ‘জাতীয় সংসদ’ হবে রাষ্ট্রযন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু অপরদিকে বিরোধীদলের উপর নিপীড়নের স্টিম রোলার চালিয়ে তাদের অংশগ্রহণের পরিবেশ বিনষ্ট করছে। বিগত ৫০ বছরের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাস প্রমাণ করছে সংসদকে স্বাভাবিককরণের চেয়ে সঙ্কটময় করতেই শাসকদেও অধিক আগ্রহ।

খ) বিচার বিভাগ (Judiciary)

মন্টেস্কু (Montesquieu) বিচার বিভাগকে স্বাধীনতার রক্ষাকবচ বলে বর্ণনা করেছেন। বাংলাদেশের সংবিধানে মৌলিক মানবাধিকার রক্ষায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। সংবিধানের দ্বিতীয় অংশে বর্ণিত অধিকারসমূহ এবং অলঙ্ঘনীয় বলে বর্ণনা করা হয়েছে। শাসক দলই এই অলঙ্ঘনীয় বিষয়গুলো সর্বপ্রথম লঙ্ঘন করেছে। বাকশাল ঘোষণার প্রাক্কালে বিশেষ ক্ষমতা আইনের (Special Power Act) মতো নিবর্তনমূলক কালা কানুন এবং জরুরি অবস্থা (Emergency Act) ঘোষণার মতো হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টিকারী বিধি ব্যবস্থা তারা সংবিধানে সংযোজন করে। একদলীয় শাসনব্যবস্থা ঘোষণার পর বিচার ব্যবস্থা ‘অধীনতামূলক ব্যবস্থায়’ পরিণত হয়। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে বিচার বিভাগে অবৈধ হস্তক্ষেপের পথ প্রশস্ত করে। ২০০৮ সালে তাদের নিরঙ্কুশ বিজয় বিচার বিভাগের উপর তাদের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের পথ প্রসারিত করে। বিচারক নিয়োগে প্রচলিত রীতিনীতি বিধি ব্যবস্থা লঙ্ঘন করে প্রশ্নসাপেক্ষ লোকদের নিয়োগ দেয়া হয়। TIB এর সমীক্ষায় বিচার বিভাগ সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত হয়। নাগরিক অধিকার রক্ষার জন্য যে প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়েছে তা নাগরিক অধিকার হরণের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আইনের আশ্রয় থেকে বঞ্চিত হন। সম্পাদক সাংবাদিকরা নিগ্রহের শিকার হন। কথায় কথায় কারণে এবং অকারণে রুল জারি হতে থাকে। ট্রাফিক জ্যাম থেকে সংবেদনশীল রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিষয় কোর্টের আদেশ আসতে থাকে। দলীয়করণের মাত্রাটা এতটাই ঘটে যে, ভাষ্যকাররা সর্বোচ্চ কোর্টকে শাসকদলের সম্প্রসারিত অংশ বলে অভিহিত করে। তাদের ঔদ্ধত্য এতটাই বেড়ে যায় যে, অবশেষে সরকারের দুটো অবিচ্ছেদ্য অংশ আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। এসব কার্যকারণের প্রেক্ষিতে বিচার বিভাগের উপর থেকে নাগরিক সাধারণের আস্থা বিশ্বাসের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। এদেশের প্রধান বিচারপতিকে ন্যাক্কারজনকভাবে বিদায় করে বিচার বিভাগের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণে সমসাময়িক বিশে^ তারা নতুন রেকর্ড স্থাপন করেছে।

গ) নির্বাহী বিভাগ (Executive)

আইন বিভাগ আইন প্রণয়ন করে। বিচার বিভাগ ভারসাম্য রক্ষা করে। দেশ পরিচালনা করে মূলত নির্বাহী বিভাগ। নির্বাহী বিভাগ প্রত্যাশিত সুশাসনের নিয়ামক। নির্বাহী বিভাগকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়: 

রাজনৈতিক নির্বাহী বিভাগ (Political Executive) মন্ত্রিসভা

প্রশাসনিক নির্বাহী বিভাগ (Administrative Executive) আমলাতন্ত্র

স্থানীয় নির্বাহী বিভাগ (Local Executive) ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা

তিনটি নির্বাহীর মূল হচ্ছে রাজনৈতিক নির্বাহী। সংসদীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যে রাজনৈতিক দল একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য শাসনের সম্মতি অর্জন করে তারাই সরকারব্যবস্থা পরিচালনা করে। রাজনৈতিক দল নীতি নির্ধারণ করে আর আমলাতন্ত্র তা বাস্তবায়ন করে। সব সময়ই রাজনৈতিক কর্তৃত্ব এবং আমলাতন্ত্রের মধ্যে একটি শোভন সীমা রক্ষা করা হয়। বর্তমান শাসকদের অতীত এবং বর্তমান প্রমাণ করছে যে, তারা সেই শোভন সীমায় বিশ্বাস করে না। ‘এক নেতা এক দল এক দেশ’- সব একাকার করে নিরঙ্কুশ দলীয় ব্যবস্থাপনায় তারা দেশ চালাতে অভ্যস্ত। সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রতন্ত্র ও দলতন্ত্রের সমাহার লক্ষ্য করা যায়। সেখানে ইতিবাচক দিকটি হলো যে দলীয় ক্যাডাররা সেবা এবং কল্যাণ ধারণায় প্রশিক্ষিত থাকে। এখানে তার উল্টোটা। নিরঙ্কুশ সন্ত্রাস, নিকৃষ্ট দুর্নীতি, অবাধ স্বেচ্ছাচারিতা এবং নির্লজ্জ দলীয় মনোভাব হচ্ছে তাদের প্রকাশিত চরিত্র। যখনই তারা ক্ষমতায় গেছে তখনই সব বাধা বন্ধনহীন আচরণ করেছে। রাষ্ট্রিক আইন, সামাজিক সদাচার এবং পারিপার্শি¦ক সৌজন্যের তোয়াক্কা না করে তারা তাদের ভাষায় ‘নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি’ (শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম সংবাদ সম্মেলন, প্রথম আলো, ১০ জানুয়ারি ২০০৯) জাতিকে উপহার দিয়ে চলেছেন। শুরু থেকে ২০২৩ সালে পাদভূমিতে দাঁড়িয়ে সেই একই দৃশ্য অবলোকন করছে জাতি।

সবচেয়ে হাস্যকর হচ্ছে কাকদৃষ্টি। অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে দ্রব্যমূল্যের আকাশছোঁয়া বৃদ্ধি এবং সিন্ডিকেট তাদের অর্থনৈতিক ব্যর্থতা নিকৃষ্ট উদাহরণ। একজন বাণিজ্যমন্ত্রীর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার ব্যর্থতার পুরস্কার পদ পরিবর্তন মাত্র। আর একজন মন্ত্রী সর্ব সাধারণের জীবণ রক্ষার পরিবর্তে ড্রাইভারদের দিয়ে জীবনহরণের সার্টিফিকেট দিতে ব্যস্ত। টাকার পাহাড় গড়ার কারিগর সর্বোচ্চ কর্তৃত্বের ‘কামাই এবং সাফাই’ এর ধারক ও বাহক মন্ত্রী অবশেষে পদত্যাগ করলেন। অর্থমন্ত্রী অর্থব্যবস্থায় ধস নামিয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রী উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। শিল্পমন্ত্রী শিল্পের বারোটা বাজিয়েছেন। এভাবে বর্তমান ক্যাবিনেট অবাধ লুটপাট, দুর্নীতি, দলপ্রীতির অতীতের যেকোনো রেকর্ড ব্রেক করেছে। এই অযোগ্য, অকর্মণ্য, অদক্ষ অসৎ অনভিজ্ঞ এবং অযাচিত মন্ত্রিসভা গোটা জাতিকে সর্বনাশের প্রান্তসীমায় নিয়ে গেছে। 

দুর্নীতি ও দুঃশাসনের দুষ্টচক্র (Vicious Circle of Corruption & Mal-administration)

সমাজতাত্ত্বিকরা গবেষণা, ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন প্রতিটি সমাজে একদল জনগোষ্ঠী নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বেড়ে ওঠে। বংশানুক্রমিকভাবে তারা ঐ সমাজে প্রভাব বিস্তার করে। সমাজ সংস্থায় সম্পদ লুণ্ঠন মানুষকে নিপীড়ন করা তাঁদের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। তারা শাসন শোষণকে চিরস্থায়ী করার বাসনা পোষণ করে। কখনও কখনও আদর্শের নামে সমাজ ও রাষ্ট্রে তারা প্রভুত্ব কায়েম করতে চায়। বাংলাদেশ জাতীয় রাষ্ট্রের উত্থানে আওয়ামী লীগের ভূমিকা অবশ্যই অনস্বীকার্য। কিন্তু সেই সাথে একমাত্র সত্য যে- তারা বাংলাদেশকে তাদের ‘নিজস্ব সম্পত্তি’ অথবা ‘পিতৃ পরিত্যক্ত’ সম্পত্তি মনে করে। অন্য মতাদর্শ বা আপামর জনসাধারণের যে কোনো অধিকার থাকতে পারে সম্ভবত তা তাদের বোধগম্য নয়।

১৯৭১-৭৫ পর্যন্ত এ প্রবণতার ফলে তাদের জনসমর্থন শূন্যের কোঠায় পৌঁছায়। ২১ বছর পরে যখন তারা ১৯৯৬ সালে আবার ক্ষমতাসীন হয় তখনও তাদের ঐ প্রবণতা পরিদৃষ্ট হয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিশেষ পরিস্থিতিতে সকল স্বাথবার্দী গোষ্ঠী একত্রিত হয়ে যখন জামায়াত-বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করে এবং প্রতিবাদী ভূমিকা দুর্বল হয়ে আসে তখন তারা আগের চেয়ে ভয়ঙ্করভাবে আবির্ভূত হয়। জাতীয় সংসদে তাদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা তাদের ফ্যাসিবাদী ভূমিকার দিকে ঠেলে দেয়। ১৯৭১ সালে যে রণকৌশল নিয়ে তারা মানুষের জীবন, সম্পদ ও সম্মানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ২০০৮ সালের পর সেই একইভাবে তারা পুনঃআবির্ভূত হয়। তারা এখন হত্যা, গুম, রাহাজানি, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি নিয়ে সমাজকে অতিষ্ঠ করে তুলছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় চক্রাকারে আবির্ভূত এ গোষ্ঠীকে ‘দুঃশাসনের দুষ্টচক্র’ বলে অভিহিত করা হয়। এদের দ্বারা বাংলাদেশের রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন ও বাণিজ্যিকীকরণ ঘটেছে। ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে তারা সেই দুষ্টচক্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা চায়।

আস্থা ও বিশ্বাসের সঙ্কট (Crisis of Confidence & Trust)

সমাজবিজ্ঞানী ইবনে খালদুন তার বিখ্যাত গ্রন্থ আল মোকাদ্দিমায় প্রদত্ত আসাবিয়াত বা গোত্র তত্ত্বে জনগণের মানস গঠনে বিশ্বাস, জীবনাচার, পরিবেশ প্রকৃতির প্রভাবের কথা বলেছেন। বাংলাদেশ জনগোষ্ঠী সম্পর্কে ইতিহাস প্রসিদ্ধ ভ্রমণকারীদের মন্তব্য খুব সুখকর নয়। বর্তমান সমাজ ও সময়কে বিশ্লেষণ করলেও একই ধারণা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এত বড় সমগোত্রীয়, সমভাষা, সম জীবণযাত্রার, সম উৎপাদন ব্যবস্থার একটি দেশে যে বিদ্বেষ, কোন্দল, হিংসা প্রতিহিংসা পরিদৃষ্ট হয় তা অভাবনীয়। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের শাসন প্রণালী, আমাদের গণতন্ত্র অগ্রসরমান ছিলো। কিন্তু পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের অভাবের কারণে অর্জিত সেই সাফল্য বিনষ্ট হওয়ার পথে। এটি একটি অপ্রিয় সত্য যে, সংসদীয় নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অন্য কোনো দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নেই। বাংলাদেশে এই তত্ত্ব বাস্তবতা লাভ করেছে এই কারণে যে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব একে অপরকে বিশ্বাস করে না। বিশ্বাস না করার যথার্থ ও যৌক্তিক কারণও রয়েছে। ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারগুলো তাদের অধীন নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে ব্যর্থ হয়। ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে গৃহীত নির্বাচনে বড় ধরনের কারচুপি করা হয়। ১৯৮৫ ও ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে পুকুর চুরি সকলেরই জানা কথা। ১৯৯১ সালের নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্য করতে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে আমদানি করতে হয়। ১৯৯০ এ প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ঐকমত্যকে অগ্রাহ্য করে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর যৌথ আন্দোলনে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। বিএনপি সরকার জাতীয় স্বার্থে সে ব্যবস্থা মেনে নেয়। ২০০৬ সালে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের অভাবে সরকার ও বিরোধীদলের শীর্ষ পর্যায়ের আলোচনা ব্যর্থ হয়। ২৮ অক্টোবর (২০০৬) প্রকাশ্য রাস্তায় মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড সঙ্ঘাতের রাজনীতি, প্রতিহিংসার রাজনীতির প্রতিচ্ছবি বহন করে। ঐ অনাকাক্সিক্ষত সঙ্ঘাত সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের পথ সুগম করে। পারস্পরিক দ্বন্দ্ব বিদ্বেষে লিপ্ত প্রধান দুই দল জাতির দুর্ভাগ্যজনক সময়েও একে অপরকে বিশ্বাস করতে ব্যর্থ হয়। এখনও সে অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং আওয়ামী দুঃশাসনে সে দূরত্ব যোজন যোজন বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে ২০২৪ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে যে সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা জাতিকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।

রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্কট (Crisis of Political Leadership)

রাজনৈতিক নেতৃত্ব বলতে রাজনীতিবিদদের এমন গুণাবলীকে বুঝায় যার দ্বারা একটি খণ্ডিত-বিখণ্ডিত জাতি ঐক্যবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রনায়কোচিত (States Mans Like) নেতৃত্ব তাকেই বলা হয় যিনি ব্যক্তিক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে শুধুমাত্র জাতীয় স্বার্থে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। লক্ষ্যহীন অসংবদ্ধ জনগোষ্ঠীকে সুনির্দিষ্ট আদর্শ ও কর্মসূচির মাধ্যমে একজন নেতা সম্মোহিত করতে পারেন। আমাদের জাতীয় জীবনে এরকম জন নন্দিত নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি সফল। কিন্তু রাষ্ট্রব্যবস্থাকে কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছাতে তিনি ব্যর্থ হন। পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রনায়কোচিত গুণাবলি দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে পরিচালিত করতে চাইলেও দেশী বিদেশী চক্রান্তে জীবনাবসান হলে তার কাক্সিক্ষত বাংলাদেশ অসমাপ্তই থেকে যায়।

বিগত চার দশকে বাংলাদেশ জাতি রাষ্ট্র অনেক সঙ্কট অতিক্রম করেছে। প্রাথমিক শাসক এলিটরা জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে ব্যর্থ হয়। শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা অবাঞ্ছিত সামরিক শাসন ডেকে আনে। ১৯৮২ সালে দ্বিতীয়বার যখন সেনা অভ্যুত্থান হয় তাও শীর্ষ নেতৃত্বের অপারগতা এবং অযোগ্যতার কারণে। সে সময়ে একজন নেত্রী প্রকারান্তরে সামরিক শাসনকে স্বাগত জানান। ২০০৬ সাল পরবর্তীকালে সেই নেত্রী সামারিক শাসনকে বৈধতাদানের আগাম ঘোষণা দেন। ১৯৯০ সালে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হলেও জাতীয় নেতৃবৃন্দ সে ঐক্য অব্যাহত রাখতে ব্যর্থ হন। ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে ব্যর্থতার জন্য উভয় দল ও নেতৃত্বই দায়ী। সেনাশাসন আমলে এক প্রবীণ আইনজীবী উভয় নেত্রীর একটি যৌথ বিবৃতির প্রয়াস নিলে ক্ষমতা লাভে অতি উৎসাহীদের অনিচ্ছায় তা ব্যর্থ হয়। 

জাতীয় ঐকমত্যের সঙ্কট (Crisis of National Consensus)

একটি জাতির রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় জাতীয় ঐকমত্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় বলা যায় জাতি গঠনপ্রক্রিয়ায় (Nation Building Process) এবং রাষ্ট্র গঠনপ্রক্রিয়ায় (State Building Process) এ জাতীয় ঐকমত্য (National Consensus) একটি অনিবার্য বিষয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মাইরন উইনার (Myron Weiner) জাতীয় ঐকমত্যের ধারণাকে জাতীয় ঐক্য-সংহতি এবং উন্নয়নের সাথে এক করে দেখেছেন। জাতীয়তাবোধ, কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, শাসক শাসিতের নৈকট্য ইত্যাদি বিষয়ের সমন্বিত ফলাফল হচ্ছে জাতীয় ঐকমত্য। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও সমঝোতার চেয়ে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠছে। ঐকমত্যের অভাবে জাতীয় উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হচ্ছে, অর্থনৈতিক সঙ্কট তীব্রতর হচ্ছে এবং সমাজের শান্তিশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় দীর্ঘদিন ধরে ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’ এর মাধ্যমে যে সংবিধান প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জন করতে যাচ্ছিল পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তা বিতর্কের শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছেছে। বর্তমান সরকার একটি বহুল মীমাংসিত বিষয়ে ক্ষমতা চিরতরে কুক্ষিগত করার মানসে জাতীয় স্বার্থ এবং ঐকমত্যকে জলাঞ্জলি দিয়েছে। রাষ্ট্রচিন্তাবিদরা মনে করেন একটি জাতির অনেক বিষয়ের মধ্যে নিম্নোক্ত বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি হওয়া প্রয়োজন।

বিগত চল্লিশ বছরে এসব মৌলিক সঙ্কটের আবর্তে নিবর্তিত হয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমান সময়ে সবকিছু ছাপিয়ে যে সঙ্কট আমাদের গণতন্ত্রকে বিপন্ন করছে তাহলো পঞ্চদশ সংশোধনী।

পঞ্চদশ সংশোধনী ও সাংবিধানিক সঙ্কট (Fifteenth Amendment & Constitutional Crisis)

সময় সমাজ এবং জনগণের সাথে সঙ্গতি রেখে যদি সংবিধান পরিবর্তন পরিমার্জন সংশোধন করা না হয় তাহলে যেমন সমস্যার সৃষ্টি হয় তেমনই কোনো মীমাংসিত বিষয় রাজনৈতিক কর্তৃত্বের ইচ্ছা অনুযায়ী উত্থাপিত এবং সংশোধিত হলে বড় ধরনের রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হতে পারে। আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনে সাম্প্রতিক কালের পঞ্চদশ সংশোধনী সেরূপ একটি সংশোধনী। ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংসদীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা স্বাভাবিক গতিতেই চলছিল। একটি উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে উত্থিত বিতর্ক অবশেষে নির্বাচন ব্যবস্থাকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং নির্দলীয় করার পক্ষে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী যৌথ আন্দোলন শুরু করে। ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকার জাতীয় স্বার্থে অভ্যন্তরীণ বিরোধিতা সত্ত্বেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা সংবিধানে সংযোজন করে। এর ত্রুটি বিচ্যুতি সত্ত্বেও পর পর কয়েকটি নির্বাচন মোটামুটি গ্রহণযোগ্যতা সহকারে অতিক্রান্ত হয়। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। আসনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অথচ জনমনে অগ্রহণযোগ্যতা এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতা স্থায়ী করার সুযোগ খুঁজতে থাকে। ঘটনা পরম্পরায় সুপ্রিম কোর্ট ৭২ এর সংবিধান পুনঃস্থাপন করলে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যায়। সকল মহলের কাছে ইতোমধ্যে গৃহীত এবং অব্যাহত এ ব্যবস্থা বাতিল হওয়ায় রাজনৈতিক মহলে তোলপাড় শুরু হয়। যদিও সুপ্রিম কোর্ট আরও দুই মেয়াদের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখার সুপারিশ করে তবুও নিজেদের জন্য সুবিধাজনক রায়টুকু গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলগুলোর সমস্ত আন্দোলন, আপত্তি ও সুপারিশ অগ্রাহ্য করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে। এ অবস্থায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনই বর্তমান সঙ্কট নিরসনের প্রকৃষ্ট পন্থা বলে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। অতি সাম্প্রতিককালে বিচারক, আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে প্রক্রিয়া ও আইনগতভাবে তত্ত্ববধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে, তা অবৈধ। বিচারপতি ইকতেদার আহমেদও তার বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আইনত বহাল রয়েছে। এখন যে কোন নাগরিক যদি পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয় এবং সর্বোচ্চ আদালত যদি তা গ্রহণ করে তাহলে সঙ্কট নিরসনের ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের বিপ্লব ঘটে যাবে। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ধারক সরকারি দল হয়তো কিছুতেই তা হতে দিবে না। কিন্তু গণআন্দোলন যদি অলঙ্ঘনীয় হয়ে ওঠে, দুর্দমনীয় হয়ে ওঠে, তাহলে সম্মানজনক নিষ্পত্তি হিসেবে শাসকদল তা মেনে নিলে বুদ্ধিমানের পরিচয় দিবে। বিএনপি দৃঢ়তার সাথে বলে আসছে, নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ব্যতীত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। জনমত পর্যবেক্ষণ, গণমাধ্যমের ভূমিকা এবং বৃহত্তর সিভিল সোসাইটির মতামত দৃশ্যে মনে হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য আগের মতোই রয়েছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বনাম তত্ত্বাবধায়ক সরকার (Interim Government v/s Caretaker Government)

তত্ত্বাবধায়ক সরকার টার্মটি নিয়ে আওয়ামী লীগের এলার্জি থাকার কারণে ঐ ব্যবস্থাকে নানাজন নানাভাবে উপস্থাপন করছেন। যেমন- ডা. জাফরুল্লাহ জাতীয় সরকারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। একটি রাজনৈতিক দল দলীয় অংশগ্রহণে নির্বাচনপূর্ব জাতীয় সরকারের কথা বলছে। নির্বাচনকালীন সরকারকে যে নামেই ডাকা হোক- ধারণাগতভাবে সকলেই এর সাথে একমত। প্রধান বিরোধীদল বিএনপিও এ বিষয়ে নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে। সুতরাং সমাগত নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকার এর অধীন ছাড়া অনুষ্ঠিত হওয়া অসম্ভব বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। 

বিকল্প প্রস্তাবনা (Alternative Proposal)

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল প্রস্তাবে সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টাকরণের প্রস্তাব ছিল। এতে বিচারব্যবস্থা প্রভাবিত হয় বলে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। একজন সর্বজন গ্রাহ্য ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়াও কঠিন সেক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক অথবা অনানুষ্ঠানিক পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাচিত শীর্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ হতে পারে। সেখানে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অথবা বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফেডারেশনের সভাপতি, ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন, ডকটরস অ্যাসোসিয়েশন পেশাগত ফোরামের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা শামিল হতে পারেন। সর্ব প্রবীণ ব্যক্তি প্রধান উপদেষ্টা হতে পারেন। অপরদিকে আর একটি কাঠামো বিবেচনা করা যেতে পারে, যেখানে সংসদে প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক দলসমূহের মনোনীত ব্যক্তি উপদেষ্টা হতে পারেন যিনি বা যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন না। তবে সঙ্কট সমাধানে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো সুরাহা বা সমঝোতা সম্ভব নয়। যেহেতু বৈধ অথবা অবৈধ যেভাবেই হোক একটি সরকার দেশে প্রতিষ্ঠিত আছে, তাদেরকেই সঙ্কট মুক্তির বা সঙ্কট উত্তরণের উপায়-কৌশল খুঁজতে হবে। আর সচেতন নাগরিক সাধারণ জানেন যে, পৃথিবীর সর্বত্রই সংলাপ হচ্ছে সঙ্কট উত্তরণের উৎকৃষ্ট বা একমাত্র পন্থা। মহাযুদ্ধের অবসানও সংলাপ ব্যতীত সম্ভব হয়নি। কিন্তু সরকারি দলের অনড়, অনমনীয় ও অনুদার দৃষ্টিভঙ্গি বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটকে আরও দীর্ঘায়িত ও তীব্রতর করবে মাত্র। 

বর্তমান সঙ্কটের পটভূমি (Banckground of the Present Crisis)

ক. ১/১১ উপাখ্যান: ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে গৃহীত নির্বাচনে বিএনপি জামায়াত জোট ক্ষমতায় ফিরে আসে। হতাশ হয় আওয়ামী লীগ। তারা এ নির্বাচনী ব্যর্থতার জন্য তাদের মনোনীত ‘স্বজন’ সাবেক সচিব এম. এ সাঈদকে দায়ী করে। তিনি বলেছিলেন, আমি নিরপেক্ষ নই, কিন্তু নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা আমার দায়িত্ব। নির্বাচন বাতিলের জন্য তারা প্রেসিডেন্ট বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করে। শাহাবুদ্দিনের মতো নিরপেক্ষ, নিরুত্তাপ ও নির্বিরোধী মানুষকে তারা বিশ্বাসঘাতক বলে অভিহিত করে। পরে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন জাতিকে সব জানিয়ে একটি কঠিন বিবৃতি দেন। এই নির্বাচনী ব্যর্থতা থেকে প্রথমত আওয়ামী লীগ, দ্বিতীয়ত, পরাক্রমশালী প্রতিবেশী এবং তৃতীয়ত, পশ্চিমা শক্তি নতুন ষড়যন্ত্র শুরু করে। দুর্ভাগ্যক্রমে এই সময়ে বৈশি^কভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নিরন্তর যুদ্ধ’ শুরু হয়। বাংলাদেশে তাদের ভাষায় ইসলামপন্থী সরকারকে উৎখাতের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। ঐ ত্রিশক্তি একত্রিত হয়ে বাংলাদেশে ৬৪টি জেলায় পটকা ফুটিয়ে বোমাবাজির মহড়া ঘটায়। এর আগে তারা ইসলামী সরকারের বিরোধিতার জন্য বাংলাদেশে তথাকথিত পীর মাশায়েখ কেন্দ্রিক সরকার বিরোধী জোট গঠন করে দৃশ্যমানভাবেই। সাম্রাজ্যবাদের একটি কৌশল হচ্ছে ‘A red flag to oppose a red flag’ বাংলাদেশে তারা ‘A green flag to oppose a green flag’ কৌশল গ্রহণ করে। ফলে রাজনীতি বিবর্জিত একটি উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীকে তারা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়। মূলত ১/১১ ঘটনাবলি তাদেরই পরিকল্পিত নীলনকশা অনুযায়ী ঘটে যায়। তথাকথিত ২০০৮ সালের সেনাসমর্থিত কৃত্রিম নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। ১/১১ এর সরকার ক্ষমতায় থাকতেই প্রতিবেশীর সাথে বোঝাপড়া নিষ্পন্ন হয়। প্রকাশিত তথ্য ও স্মৃতিকথা থেকে এসব প্রমাণিত হয়। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি তার আত্মজীবনীতে মঈন ইউ আহমেদ গংকে রাজনৈতিক নিরাপত্তা প্রদান করেন। 

খ. আওয়ামী সরকার (২০০৯-২০২৩) : আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ক্ষমতাসীন হওয়ার পরপরই কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা শুরু করে। তারা নিশ্চিত ছিল যে, একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার কোন সম্ভাবনা তাদের নেই। রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে অর্জিত ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থা সংবিধান থেকে বাতিল করে দেয়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূলের সিদ্ধান্ত নেয় তারা। একসময়ে রাজনৈতিক সুবিধার জন্য যাদের সাথে গড়ে তুলেছিল সখ্যতা তা শত্রুতায় পরিণত হয়। রক্তপাত ঘটে। অপরদিকে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য মিথ্যা মামলায় বেগম খালেদা জিয়াকে জেলে পাঠায়। পরবর্তী উত্তরাধিকারী তারেক জিয়ার দেশান্তর ঘটায়। হামলা-মামলা, গুম-খুন, অর্থাৎ রাজনৈতিক নিপীড়নকে তারা রাজনীতির স্থায়ী কৌশল হিসেবে গ্রহণ করে। ২০১৪ সালে যে ভোটারবিহীন নির্বাচন হয় এখন রাজনীতি বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ এর বয়ানে আমরা জানতে পারছি বিএনপি নেতাদের ঘুষ দেওয়া হয়েছিল। ২০১৮ সালের নিশীথ রাতের নির্বাচনের কথা দিবালোকের মতো সত্য। এখানে একটি বিষয় খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে, উভয় নির্বাচনেই তিনি জাতিকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমায় বিশ^াস করুন’। তিনি বিশ^াস ভঙ্গ করেছিলেন। তাতে মনে হচ্ছে যে বর্তমান সরকার চাণক্য-ম্যাকিয়াভেলির কৌশল অবলম্বন করছেন। মিথ্যাচার, অন্যায়-অত্যাচার, শঠতা, প্রতারণা দ্বারা তারা স্বাভাবিক রাজনীতিকে অস্বাভাবিক পথে পরিচালিত করছেন। তিনি এমনভাবে কথা বলছেন, হয়তো গুয়েবলসও লজ্জা পাবেন। রাজনৈতিক ভদ্রতা, সভ্যতা, সৌজন্য-শিষ্টাচার সবকিছু বিসর্জন দিয়ে ক্ষমতা এবং ক্ষমতার জন্য যা খুশি করছেন। 

গ. সরকার বিরোধী আন্দোলন : ২০০৯ সালের পর থেকেই সরকার বিরোধী আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। সরকার রাজনৈতিকভাবে আন্দোলনের মোকাবেলা না করে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে আন্দোলন দমনের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৪ সালে বিজয়ের প্রান্তসীমায় পৌঁছেও বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি ফসল ঘরে তুলতে ব্যর্থ হয়। ২০১৫ সালে আন্দোলনকে সরকার সন্ত্রাসের লকব দিয়ে দমন করতে সক্ষম হয়। ২০১৮ সালে তারা রীতিমতো প্রতারিত হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সাধারণ রাজনীতিবিদরা অস্বাভাবিক আচরণের সম্মুখীন হয়। ২০২১ সালের দিকে বিরোধী দলের আন্দোলন গণভিত্তি অর্জন করতে শুরু করে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সারাদেশে আন্দোলনকে তুঙ্গে উপনীত করে। জামায়াত ইসলামী প্রায় নিষিদ্ধ থাকার পরেও ২০২৩ সালের দিকে বিরোধী আন্দোলনে শামিল হয়। সর্বশেষ বিয়োগান্ত ঘটনার মাধ্যমে ২৮ অক্টোবরের সৃষ্ট গণঅভ্যুত্থান আবারও সরকারের নীলনকশায় আপাত স্তিমিত হয়। 

ঘ. চলমান আন্দোলন : সরকার এজেন্সি এবং নিজেদের লোক ঢুকিয়ে ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। পত্রপত্রিকা ও অন্যান্য মাধ্যমে সরকারের লোকই যে এসব ঘটিয়েছে তার প্রমাণ মিলছে। মিথ্যাচারকে সম্বল করে বিএনপি তথা সকল বিরোধী শক্তির উপর সরকারের সর্বাত্মক নির্যাতন চলছে। বিএনপির সকল শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তৃণমূল থেকে গ্রাম অবধি এমন কোন বিএনপির কর্মী বা নেতা নেই যারা ঘরে থাকতে পারছে। সারাদেশে সরকার জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশ যুদ্ধাবস্থায় নিপতিত হয়েছে। সারাদেশ যেন জেলখানা। 

এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বিরোধী শক্তি অবশেষে হরতাল ও অবরোধের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বিএনপি ও জামায়াত ইসলামীসহ ডান-বাম সকল ধারার রাজনৈতিক দলগুলো একীভূত হয়েছে। তাদের ঘোষিত অবরোধ কর্মসূচিতে দেশ অচল হয়ে পড়েছে। অবশেষে সরকার এদেশের জনগণের উপর ভর না করে তাদের রাজনৈতিক তাঁবেদারদের আশ্রয় প্রার্থনা করছে। প্রকাশিত সংবাদে জানা গেছে যে, অবশেষে দিল্লি ওয়াশিংটনকে বাংলাদেশে তাদের মিত্রকে বিরক্ত না করার অনুরোধ জানিয়েছে। এতে ওয়াশিংটনের নীতি ভঙ্গির কোন পরিবর্তন হবে না বলেই সাক্ষ্য দিচ্ছেন কূটনীতিকরা। অপরদিকে নিপাতনে সিদ্ধ ঘটনায় বর্তমান সরকারের প্রতি চীনও সমর্থন জ্ঞাপন করেছে। আওয়ামী লীগাররা ভারতকে প্রকৃত মিত্র এবং চীনকে বাণিজ্যিক মিত্র বলার পরও চীনারা রা করেনি। কারণ টাকা তাদের প্রয়োজন। একসময় চীন সাম্যবাদ রফতানি করতো। এখন তারা ইউয়ান রফতানি করছে। মোটকথা ভারত, চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমীকরণে ত্রিশঙ্কু অবস্থায় রয়েছে বাংলাদেশ। 

ঙ. ঢাকা না দিল্লি : ১৯৭১ সালে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে পাকিস্তানের জাঁতাকল থেকে মুক্ত হয় বাংলাদেশ। তখন স্লোগান ছিল ‘ঢাকা না পিন্ডি- ঢাকা ঢাকা’। এখন প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে বাংলাদেশ কোথা হতে শাষিত হয়- ঢাকা না দিল্লি? 

নয়াদিল্লিতে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনায় বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গটি আলোচিত হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন উত্থাপন করা যায় যে, বাংলাদেশ কি স্বাধীন? ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম ৬ অক্টোবর ২০২৩ প্রকাশিত এক নিবন্ধে সে প্রশ্নই উত্থাপন করেছেন। বিগত ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশের অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতিতে ভারত প্রযত্ন ব্যতীত অন্যকোনো নীতিমালা ছিল না। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের সৃষ্ট সার্ক নিষ্ক্রিয় করে দেওয়ার কথা বলা যায়। আফগানিস্তান ইস্যুর কথা উল্লেখ করা যায়। এরকম অনেক উদাহরণ রয়েছে। সরকার বাংলাদেশের বুক চিড়ে ভারতকে ট্রানজিট দিয়েছে। ভারত আমাদের তিস্তার পানি আজও দেয়নি। এমনকি সময়ের কালে পেঁয়াজ রফতানিতেও তাদের নিষেধাজ্ঞা। ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বলেছিলেন, ‘পরসি পহেলে, লেকিন বাংলাদেশ সবসে পহেলে’। এর হাজারও বিপরীত নমুনা বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করছে। 

চ. মার্কিন প্রসঙ্গ : মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলতেন ‘America is for the Americans’। তিনি বিদেশ নিয়ে অত মাথা ঘামাতে চাননি। কিন্তু জো বাইডেন আমেরিকার কর্তৃত্ব পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান সারা বিশ্বে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রশ্ন চিরায়ত মার্কিন নীতি প্রয়োগে কঠোর হলেন তিনি। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের দুরবস্থা ও মানবাধিকারের দুর্দশা বাইডেন প্রশাসনের দৃষ্টিগ্রাহ্য হলো। প্রথমত তারা নমনীয়ভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বদলে সরকার অকূটনৈতিকসুলভ ভাষায় তার উত্তর দিয়েছে। ক্রমশ বাংলাদেশ মার্কিন সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। ইতোমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসা বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে বাংলাদেশের নাগরিকদের ওপর। উদ্দেশ্য একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান। কিন্তু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে এটা নিশ্চিত যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে আসবে না। সেখানেই নীতিগত বিরোধ। বাংলাদেশের মানবাধিকার সংরক্ষণে এবং গণতন্ত্রায়নে ভিসানীতি কার্যকর ভূমিকা রাখছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চায় শান্তিপূর্ণ উপায়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। সর্বশেষ সংবাদ অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু শর্তহীন সংলাপের আহবান জানিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রধান ৩টি রাজনৈতিক দল বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও শাসক আওয়ামী লীগকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। শাসক আওয়ামী লীগ ও নির্বাচন কমিশন এ ধরনের উদ্যোগকে অবজ্ঞা করে নির্বাচন তফসিল ঘোষণা করেছে। শেষ অবধি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে কী ভূমিকা নেওয়া হয় তার উপর নির্বাচনী ব্যবস্থা নির্ভরশীল হতে পারে বলে রাজনৈতিক ওয়াকিফহাল মহলের ধারণা। 

জাতীয় সঙ্কট উত্তরণ কৌশল (National Crisis Overcome Strategy)

জাতীয় সঙ্কট উত্তরণ বা সমাজ পরিবর্তনের স্বীকৃত/ অস্বীকৃত কৌশল তিনটি: গণতন্ত্র, বিপ্লব, গণঅভ্যুত্থান।

ক) গণতন্ত্র/ নির্বাচন : নিয়মতান্ত্রিক গঠনতান্ত্রিক তথা গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থার মাধ্যমে সঙ্কট উত্তরণ। তৃতীয় বিশ্বের স্বাধীনতাকামী অধিকাংশ জনগোষ্ঠী নিয়মতান্ত্রিক পথেই স্বাধীনতা অর্জন করে। সভ্যতার ইতিহাস প্রমাণ করে ‘ব্যালট’ অর্থাৎ সম্মতির কাছে বুলেট বা শক্তির পরাজয় অবধারিত। 

খ) বিপ্লব : মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী সমাজ পরিবর্তনের জন্য, সঙ্কট উত্তরণের জন্য বিপ্লব অনিবার্য। এ বিপ্লব অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অস্ত্র নির্ভর। ‘গেরিলা ওয়ার ফেয়ার’ এ ধরনের বিপ্লব প্রয়াস। স্বপক্ষের সামরিক অভ্যুত্থানকেও বামরা বিপ্লব বলেন। অন্যদিকে পাশ্চাত্যমুখী সামরিক অভ্যুত্থানকে স্ব-ঘোষিত লৌহ মানবেরা বিপ্লব বলে অভিহিত করেন।

গ) গণঅভ্যুত্থান : এস.পি. হান্টিনটন কথিত ৯০ দশকের ‘থার্ড ওয়েভ’ ছিল গণতন্ত্রের তৃতীয় অভিযাত্রা। সাম্প্রতিককালের আরব বসন্তকে কেউ কেউ গণতন্ত্রের চতুর্থ অভিযাত্রা বলছেন। দুটো অভিযাত্রায় জনগণই মূল চালিকাশক্তি। উত্থিত গণঅভ্যুত্থানকে স্বৈরশাসকরা অস্ত্রের দ্বারা অবদমিত করতে চাইলেই কেবল অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে সাধারণ জনতা। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র অথবা বিকারগ্রস্ত ব্যক্তিতন্ত্র উদ্ভূত জাতীয় সঙ্কট উত্তরণের জন্য জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতৃত্ব অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগ করতে চায় না। গণতান্ত্রিক পথে পরিবর্তন প্রত্যাশী। মূলত গোটা জনগোষ্ঠী লাঞ্ছনা, গঞ্ছনা, বঞ্চনায় রাগে দুঃখে ক্ষোভে বিস্ফোরণোন্মুখ অবস্থায় রয়েছে। নির্যাতিত, নিপীড়িত অত্যাচারিত সাধারণ জনগোষ্ঠী একটি সার্বিক গণ অভ্যুত্থানের দিন গুনছে। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নাগরিক সাধারণ প্রত্যাশিত গণঅভ্যুত্থানকে গণবিপ্লবে পরিণত করবে। গণবিপ্লব গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে। জনতার প্রত্যাশা ব্যর্থ হবে না। টি এইচ গ্রিনের ভাষায়- “Democracy may lose many battles but it wins the last” 

লেখক: প্রফেসর (অব:), সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির