post

‘জাগো বীর নয়া শতাব্দীর’

আহসান হাবীব ইমরোজ

২৮ জুলাই ২০২৩

আসসালামু আলাইকুম ওরাহমাতুল্লাহ। লাল-সবুজের এই বদ্বীপে আমাদের ভবিষ্যৎ বাতিঘর কিশোর-তরুণদের নিয়ে অনেকেই কাজ করছেন। আমি নগণ্য তাদের পদরেখা অনুসরণের চেষ্টা করি মাত্র। গত চার বছর যাবৎ করোনাকাল চলছে। যদিও গত বছর মাঝামাঝি থেকেই চৌদিকে জীবন-স্পন্দনের দেখা মিলছে। এই সুবাদে গেল ক’মাস সিলেট, কক্সবাজার, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, সাভার ও আশুলিয়ায়  কিশোর-তরুণদের বেশ ক’টি বাঁধভাঙা অত্যুঙ্গ জোয়ারের সামনে হাজির হয়েছি। আমিতো  বক্তৃতা পারি না ; অগত্যা কিছু গল্প বলে তাদের তুষ্ট করতে চেষ্টা করেছি মাত্র । 

করোনাপূর্ব প্রায় চার বছরের অনেকটা সময় মালয়েশিয়ায়  ছিলাম। সেখানে অবস্থানকালীন সময়ে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় মালয়েশিয়ায় নানাদেশের আন্ডারগ্রেড স্টুডেন্টদের দুই সেমিস্টার ‘লিডারশিপ অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট’ কোর্স নেওয়ার সুযোগ হয়েছে। সে সময়েই তুরস্ক, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া সফরের সময়ে সেমিনার, সভা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বক্তব্য দিতে হয়েছে। অতঃপর সশরীরে মালয়েশিয়ায় অধ্যয়নরত বাংলাদেশী কৃতী শিক্ষার্থী  এবং অনলাইনে জাপানপ্রবাসী বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের ডজনখানেক আয়োজনে কথা বলেছি। যারা সেখানকার বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের মাস্টার্স, পিএইচডি প্রোগ্রামে যুক্ত আছেন। কেউবা মালয়েশিয়া-জাপান পাট চুকিয়ে এখন তুরস্ক, যুক্তরাজ্য এমনকি আমেরিকার হার্ভার্ডের মতো প্রতিষ্ঠানে উচ্চতর অধ্যয়ন করছেন। 

 

আমি তাদেরকে হয়তো আলপিনসমও শেখাতে পারিনি; তবে তাদের কাছ থেকে শেখেছি হিমালয়সম। সে অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশ-বিদেশের বাংলাভাষী কিশোর-তরুণদের জন্য কিছু লেখার মুসাবিদা করতে চাই। যদিও আয়োজনটা এখনও আঁতুড়ঘরে। আমার মতো দুর্বল মানুষের দুর্বলতম এই আয়োজন। তবে যাই হোক না কেন পদ্মলোচনের মতো যুতসই একটি নামতো চাই। 

‘মোরা বড় হতে চাই’ এবং ‘বিশ্ব মাঝে শীর্ষ হব’ এ নামসমূহের ধারাবাহিকতায় ‘জাগো বীর নয়া শতাব্দীর’ এমন একটা নাম চিন্তা করেছি। শত শুভাকাক্সক্ষীর পরামর্শে তা চূড়ান্তও করেছি। আল্লাহ তাআলার ওপর ভরসা করে মাসিক প্রেরণা কর্তৃপক্ষের বিপুল প্রেরণায় বাধ্য হয়ে শুরু হলো যাত্রা; এবারের প্রথম কিস্তি। 


যে জিনিয়াস সে সিরিয়াস

‘সাধারণ’ শব্দটা এদেশে অনেকটা পান্তা ভাতের মতো। সারা বছর পান্তা নিয়ে নাক সিটকানো আর বৈশাখ এলেই এটি হয় আকাশচুম্বী। ‘সাধারণ’ বা ‘পাবলিক’ ব্যক্তিটাও ঠিক তেমনি; সর্বদা  মূল্য নেই  কিন্তু নির্বাচন এলেই সাধারণ হয়ে ওঠেন তখন অসাধারণ। সে সময় নেতারা বলেন, আপনারাইতো সব। পা-টা একটু দেনতো কদমবুসি করি- এমন একটা ভাব! কিন্তু অসাধারণের প্রতি আমাদের আকর্ষণ চিরন্তন। এ অসাধারণরা আসেন ক্ষমতা, সম্পদ আর ধর্মীয় বা রাজনৈতিক আবেগের সিঁড়ি বেয়ে। পরিবার, দলীয় বা গোষ্ঠীর পাইপলাইন দিয়ে। উজ্জ্বল ব্যতিক্রম বাদে দেখা যাবে সমাজের সবচেয়ে অযোগ্য, অসৎ লোকটি এসব লাইনের সুবাদে ক্ষমতার মসনদে বসে আছে। আর সবার নাকের ওপর ছড়ি ঘুরাচ্ছে। কিন্তু এসব লাইনের বাইরে নিজস্ব প্রতিভা বা মেধায় অনন্য সাধারণ হয়ে ওঠেন যারা তাদের বলা হয় জিনিয়াস। আজ হোক জিনিয়াসদের অসাধারণত্বের গল্প। তবে তার আগে জানি, ‘জিনিয়াস’ জিনিসটা আসলে কী? এটা আদতে হয় কীভাবে? প্রাথমিকভাবে বলা যায়, ‘জিনিয়াস’ বলতে মূলত বোঝায় এমন একজন ব্যক্তি, যিনি নিজের অসাধারণ সামর্থ্য, সৃজনশীলতা, স্বাতন্ত্র্য এবং চমৎকার কোনো অবদানের মধ্যমে নিজেকে স্মরণীয় রেখেছেন সাধারণের মাঝে।

১. জিনিয়াস বা প্রতিভা কাকে বলে ? 

জিনিয়াস বা প্র+তি+ভা মানে কী? অভিধানে আমরা প্রধানত চারটি অর্থ পাই; এক. প্রজ্ঞা বা প্রভুর সাথে সম্পর্কিত জ্ঞান, দুই. প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব বা উপস্থিত বুদ্ধি, তিন. তীক্ষ্ণ বুদ্ধি বা বিশ্লেষণ ক্ষমতা, চার. ভালো কিছু উৎপাদনক্ষমতা বা সৃজনীশক্তি। চারটি অর্থের প্রথম বর্ণগুলো প্র (প্রজ্ঞা + প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব)+তি (তীক্ষ্ণবুদ্ধি)+ভা (ভালো কিছু উৎপাদন) একত্র করলেই প্রতিভা পাওয়া যায়। প্রতিভার কোনো সর্বজনস্বীকৃত সংজ্ঞা নেই। কখনো কখনো Intelligent (বুদ্ধিমান) কিংবা Talent (মেধা) কে প্রতিভার সাথে বিযুক্ত করা হয়। প্রতিভার ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে, Genius.

১৪শ শতকের শেষের দিকে, ল্যাটিন শব্দ জেনি (from root gene- give birth, beget, with derivatives referring to procreation and familial and tribal groups”.) থেকে জিনিয়াস শব্দের উৎপত্তি। যার সরল শাব্দিক অর্থ জন্ম, পয়দা। ১৬৪০ সালে  ‘প্রাকৃতিক বুদ্ধি বা প্রতিভাবান ব্যক্তি’ এবং ‘উন্নত প্রাকৃতিক মানসিক ক্ষমতা’ এর অর্থে সর্বপ্রথম এর ব্যবহার শুরু হয়। এমনটা বলা হয়ে থাকে যে, একজন সাধারণ মানুষের জিনিয়াস হয়ে উঠতে যুগের পর যুগ লেগে যায়। বিশ্বকে বদলে দেওয়া অসাধারণ কাজ সবাই কিন্তু পারেন না; এ সংখ্যা নেহাতই কম। আর এ স্বল্পসংখ্যক মানুষেরাই অনেকে ‘জিনিয়াস’ আখ্যা পেয়ে থাকেন। তাতে সাধারণ বিবেচ্য বিষয় হিসেবে প্রথমেই যেটা আসে, সেটা হচ্ছে আইকিউ। অন্তর্দৃষ্টির এ ঝলকানি দেখানোটা শুধু বুদ্ধিই নয়, বরং প্রতিভার উন্মেষও প্রমাণ করে। লিওনার্দো দা ভিঞ্চির আইকিউ ছিলো ২২০, গ্যালিলিওর ১৮৫, মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর ১৭৭,  এবং আইনস্টাইনের ১৬২। নবী রাসূল এবং সাহাবাদের জমানায় এই আইকিউ মাপার ব্যবস্থা ছিল না। তবে তাদের কর্ম ও প্রভাব বিশ্লেষণ করে বুঝা যায়- নিশ্চিতভাবেই তাঁরা আইকিউ এর দিক থেকে ছিলেন অন্যতম সেরা!

তবে শুধু আইকিউ হিসেব করাটাই জিনিয়াস পরিমাপের একমাত্র মাপকাঠি নয়। সাথে প্রয়োজন বিস্ময়কর কার্যক্ষমতা, অধ্যবসায় এবং দারুণ সৌভাগ্য। এর বাইরে কিছু বৈশিষ্ট্যকেও হিসেবের খাতায় নেওয়া যায়; তবে সেগুলো স্বতঃসিদ্ধ নয়, বরং জিনিয়াসদের জীবনচরিত ঘেঁটে পাওয়া কিছু সাধারণ ঘটনামাত্র! তাহলে সহজ কথায় দাঁড়ালো প্রতিভা বা প্রতিভাবান হচ্ছেন এমন ব্যক্তি যিনি ব্যতিক্রমী বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা, সৃজনশীল উৎপাদনশীলতা, মৌলিকতায় সর্বজনীনতা প্রদর্শন করেন, সাধারণত এমন একটি ডিগ্রিতে যা জ্ঞানের জগতে নতুন অগ্রগতির অর্জনের সাথে সম্পর্কিত হয়।


২. সব মানুষই কি জিনিয়াস?

আল-কুরআনের সর্বপ্রথম নাজিলকৃত আয়াত দুটিই হচ্ছে ‘মানুষ’ সংক্রান্ত। ‘পড় সেই প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন জমাটবাঁধা রক্তপি- হতে।’ (সূরা আলাক : ১-২)। আল-কুরআনে প্রায় ১৫০টি বিষয়ে ৩০০টি আয়াতে মানুষ প্রসঙ্গে আলোচনা এসেছে। আল-কুরআনে মানুষের দুটি প্রধান পরিচয় দেওয়া হয়েছে, প্রথমটি আবদ বা বান্দাহ হিসেবে, ‘তিনি জিন ও মানুষকে ইবাদাত ভিন্ন অন্য কোনো উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেননি (সূরা জারিয়াত: ৫৬)’। এবং অপরটি হচ্ছে খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে, ‘স্মরণ করো, যখন তোমার প্রতিপালক ফিরিশতাদের বললেন, আমি পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি সৃষ্টি করছি (সূরা বাকারা : ৩০, ফাতির : ৩৯)।  অর্থাৎ মানুষের পেশা হচ্ছে সকল মাখলুকের মতোই আল্লাহর ইবাদত, কিন্তু তার পদবি হচ্ছে খলিফা বা প্রতিনিধি যে দায়িত্ব আর কোনো মাখলুককেই দেওয়া হয়নি।

তাই একজন মুসলিম হিসেবে আমরা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি প্রতিটি মানুষকে আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রদত্ত খিলাফতের দায়িত্ব পালনের স্বার্থেই বিপুল ক্ষমতা ও সম্ভাবনা দিয়েছেন। না হয় এত বড় দায়িত্ব সে কীভাবে পালন করবে? তাই প্রতিটি মানুষই জিনিয়াস বা অপার সম্ভাবনার আধার। তবে সাধারণত তা সুপ্ত অবস্থায় থাকে।


৩. জিনিয়াস : এ যেন গুপ্তধন!

আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন : রাসূলুল্লাহ সা.কে বলতে শুনেছি, “মানুষ সোনা ও রূপার মতো; যারা জাহিলিয়াতে সেরা ছিল তারা ইসলামে সেরা, যদি তাদের ধর্মীয় বোধশক্তি থাকে। (বুখারি-৩১৩৫)। জিনিয়াস এ যেন গুপ্তধনের মতো। ১৯৫১ সালে প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ইস্তাম্বুল যান। সে সময় ‘ইস্তাম্বুল যাত্রীর পত্র’ শিরোনামে আজাদ পত্রিকায় তাঁর ভ্রমণকাহিনী প্রকাশিত হয় এবং পরবর্তীতে বই আকারে বাজারে আসে। তিনি তাতে লেখেন মধ্যপ্রাচ্যের হৃতদরিদ্র অবস্থা। আর আজকে বিশ্বের ধনী দেশগুলোর অনেকের অবস্থান মধ্যপ্রাচ্যে। কারণ একটাই- গুপ্তধন; পেট্রোলিয়াম বা তরল সোনা। প্রতিটি মানুষের ভেতর বিপুল সম্ভাবনার সম্ভার লুক্কায়িত। মহামূল্যবান খনিজ পদার্থের মতোই। এক. এর অবস্থান খুঁজে বের করতে হবে। অতঃপর দুই. তা আধুনিক যন্ত্রপাতি দ্বারা উত্তোলনের ব্যবস্থা করতে হবে। অবশেষে তিন. রিফাইন বা পরিশুদ্ধ করতে হবে। চার. সেগুলো ক্ষতি বা চুরির হাত থেকে সংরক্ষণ করতে হবে। সর্বশেষ পাঁচ. সেগুলো উপযুক্তভাবে মার্কেটিং বা বাজারজাত করতে হবে। পর্যায়ক্রমে এ পাঁচটি ধাপ সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে পারলেই সে দেশ বা ব্যক্তি বিপুল সম্পদ বা ক্ষমতায় ক্ষমতাবান হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়; ফ্রান্স স্বর্ণ মজুদের দিক থেকে বিশ্বের চার নম্বরে আছে। ফ্রান্সের রিজার্ভে আছে ২৪৩৭ টন স্বর্ণ। অথচ ফ্রান্সের কোনো স্বর্ণের খনি নেই! অপরদিকে ফ্রান্সের সাবেক কলোনি আফ্রিকার মালি  বার্ষিক ৬১ টন স্বর্ণ উৎপাদন করে। মালির অন্যতম প্রধান প্রাকৃতিক সম্পদ হলো সোনা, এবং দেশটি আফ্রিকা মহাদেশে তৃতীয় বৃহত্তম সোনা উৎপাদনকারী। কিন্তু তার অর্ধেক জনসংখ্যা চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে। 

বর্তমানে (২০২২ সালে) ক্রয়-ক্ষমতা-সমতার ওপর ভিত্তি করে বিশ্বব্যাপী মোট দেশজ পণ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অংশ আনুমানিক ১৪.৮৫ শতাংশ, অর্থাৎ সে পৃথিবীর তৃতীয় অর্থনৈতিক শক্তি। অপরদিকে ভারতের অবদান মাত্র ৭.২% তার অবস্থান বিশ্বে পঞ্চম। অথচ মুঘল আমলে (১৫২৬-১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দ) ভারত সমগ্র পৃথিবীতে অভূতপূর্ব সমৃদ্ধির অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল। ১৭০০ সালে, যখন দেশের বেশির ভাগ অংশ মুঘলদের দ্বারা শাসিত ছিল, সে সময় ভারতের বিশ্ব জিডিপির ২৪.৪ শতাংশ অংশ ছিল। যা সমগ্র ইউরোপের ২৩.৩ শতাংশের চেয়েও বেশি। ইংরেজ দখলের মাত্র ১৩ বছরের মাথায় ১৭৭০ সালে সেই ভারতে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ দুর্ভিক্ষ ‘গ্রেট বেঙ্গল দুর্ভিক্ষ’, হয়; যাতে প্রায় কোটি মানুষ (জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ) মারা যায়। ভাবা যায় ঠিক কতটা শোষণ ও লুণ্ঠন করলে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশে ১৩ বছরের ব্যবধানে ১ কোটি লোক না খেয়ে মারা যেতে পারে!

ঠিক সেভাবেই সৃষ্টির সেরা মানুষ যদি আল্লাহ প্রদত্ত তার অভ্যন্তরীণ সম্পদ জিনিয়াস বা প্রতিভাকে : এক. চিহ্নিতকরণ, দুই. উন্মেষ ঘটানো, তিন. পরিশুদ্ধকরণ, চার. সংরক্ষণ এবং পাঁচ. সর্বোপরি বিপণন করতে পারেন; তবে তিনি হবেন সত্যিকার খলিফা বা একজন ক্ষমতাবান সফল মানুষ। আর যদি তা করতে ব্যর্থ হন তবে তিনি হবেন একজন হত-দরিদ্র অসহায় এবং ব্যর্থ মানুষ। এ পাঁচটি পর্যায়ের সাথেই রয়েছে বিপুল ও বিশুদ্ধ জ্ঞানার্জনের প্রক্রিয়া। জ্ঞান ব্যতীত কেউ অগ্রসর হলে সেও গুপ্তধন পাবে তবে তা হবে হয়তো সোনার নয়, কয়লা, লোহা কিংবা সিলভারের খনি। যেমনটা এখানে বলা হয়েছে; Genius without education is like silver in the mine. Benjamin Franklin.

প্রশ্ন হতেই পারে কে এই ভদ্রলোক? আসুন জানি; বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন (১৭০৬-১৭৯০) একজন আমেরিকান পলিম্যাথ ছিলেন। যিনি একজন লেখক, বিজ্ঞানী, উদ্ভাবক, রাষ্ট্রনায়ক, কূটনীতিক, মুদ্রক, প্রকাশক এবং রাজনৈতিক দার্শনিক হিসাবে সক্রিয় ছিলেন। তাঁর সময়ের নেতৃস্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে, ফ্র্যাঙ্কলিন ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের খসড়া ও স্বাক্ষরকারী এবং প্রথম পোস্টমাস্টার জেনারেল। তিনি আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট না হয়েও এতটা সম্মানিত যে, সেখানকার ৭টি কাগজের নোটের ভেতর সবচেয়ে দামি ১০০ ডলারে তাঁর ছবি আঁকা। 

 


৪. polymath বা বহুমুখী প্রতিভা

ইতিহাস জুড়ে বহু বিষয়ে পণ্ডিত (Genius) উপস্থিতি সত্ত্বেও, অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী কেবলমাত্র এক ধরনের ক্রিয়াকলাপে উচ্চ সাফল্য দেখিয়েছেন। যেমন : রবিঠাকুর ২২৩২টি গান, হাজারো কবিতা ও ছোট গল্প লিখেছেন সাথে তাঁর শৈল্পিক মন থেকে কিছু ছবিও এঁকেছেন। কিন্তু তিনি তৎকালীন বিশ্ব-শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সাথে সাক্ষাৎ করলেও তাঁর নিজের তেমন কোনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার পাওয়া যায় না। উল্টোক্রমে টমাস এডিসন হাজারের ওপর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করলেও তাঁর উল্লেখযোগ্য কোনো কবিতা বা গল্প খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু এর উজ্জ্বল ব্যতিক্রম আছেন, যেমন ইবনেসিনা; যাকে আধুনিক মেডিসিনের জনক হিসোবে বিবেচনা করা হয়। তিনি একাধারে একজন অন্যতম কুরআনের হাফিজ, গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসক, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, দার্শনিক, চিন্তাবিদ এবং ইসলামী স্বর্ণযুগের লেখক। তাঁর প্রায় ৪৫০টি রচনাসম্ভারের মধ্যে ২৪০টির মতো পাওয়া যায়, যার ভেতর দর্শনশাস্ত্রে ১৫০ এবং চিকিৎসার ৪০টি রয়েছে। তাঁর সর্বাধিক বিখ্যাত রচনাগুলো হলো বুক অফ হিলিং, এটি একটি দার্শনিক ও   বৈজ্ঞানিক বিশ্বকোষ, এবং দ্য কানুন অফ মেডিসিন, একটি মেডিক্যাল এনসাইক্লোপিডিয়া। যা বহু মধ্যযুগীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একটি স্ট্যান্ডার্ড মেডিক্যাল পাঠ্যবই  হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিল। 

 

এমনভাবে আবু-রুশদ, আলফারাবী, আলকিন্দি, আলখাওয়ারিজম, আলজাবেরসহ শতশত মনীষীর নাম নেওয়া যায়। পশ্চিমা বিশ্বের লিউনার্ডো দ্যা ভিঞ্চি এমন একজন ছিলেন। যাদেরকে polymath বা বহুমুখী প্রতিভা বলা হয়। নবী, সাহাবি এমনকি তাদের পরবর্তীদের জীবনে যারা শুধু আমাদের কাছে নয় বরং পশ্চিমা বিশ্বের কাছেও জ্ঞানের দিকপাল। যাদের বিষয়ে ওরা সাধারণকে ভ্রান্তিতে ফেলতে নাম দিয়েছে আভিসিনা, আভেরুস ইত্যাদি। কিন্তু তাদের অবদানকে অস্বীকার করতে পারেনি। 

আজকে আমাদেরই দায়িত্ব হচ্ছে সে সকল হারানো দিকপালদের তারকাসম কৃতিত্ব বিশ্বের সামনে তুলে ধরা। এ জন্য নিজেদেরকে তৈরি করতে হবে জ্ঞান, যোগ্যতা ও চরিত্রে বিশ্বমানের। প্রতিভার এমন শ্রেষ্ঠ ও অনন্য উদাহরণ খুঁজে পাই আমরা  প্রথম মানুষ হযরত আদম আ.-এর ভেতর। 


৫. জিনিয়াস বা প্রতিভার অর্থ : জীবন থেকে নেওয়া

তত্ত্বীয় জ্ঞান সর্বদা বুঝে আসে না। জীবন থেকে উদাহরণ নিতে পারলে সহজে বোঝা যায়। তাহলে জিনিয়াসের অর্থ বুঝতেও আমরা তত্ত্বের সাথে বাস্তব জীবন মেলাই; দেখি কেমন হয়। জিনিয়াসদের প্রাথমিক যোগ্যতা  নিয়ে একটি চমৎকার কথা ; “I do not think there is any other quality so essential to success of any kind as the quality of perseverance. It overcomes almost everything, even nature.”- John D. Rockefeller


জীবন উন্নয়নে যেমন প্রতিভা গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু সেটির উন্মেষ ঘটাতে দরকার প্রচ- পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের অনুশীলন। ওপরের বক্তব্যটি যিনি দিয়েছেন তাঁর পরিচয় এবং বাস্তব জীবনের গল্প দিয়েই আজকে শেষ করছি ;

জন ডি রকফেলার (১৮৩৯-১৯৩৭) একজন আমেরিকান ব্যবসায়ী এবং সমাজসেবী ছিলেন। তিনি সর্বকালের সবচেয়ে ধনী আমেরিকান। রকফেলার ১৮৭০ সালে স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ৯৮ বছরের দীর্ঘ আয়ু পেয়েছিলেন। এ জন ডি রকফেলার প্রথম জীবনে ঘণ্টায় মাত্র চার সেন্টের (মার্কিন চার পয়সা) বিনিময়ে আলুক্ষেতে কাঠফাটা রোদের ভেতর লোহার কোদাল দিয়ে কাজ করেছেন। অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের বিনিময়ে তিনি পরিণত হয়েছিলেন সে সময়কার আমেরিকার সবচেয়ে সেরা ধনীতে। ১৯৩৭ সালে মৃত্যুর পূর্বে তিনি দুই বিলিয়ন ডলার (প্রায় এগারো হাজার কোটি টাকা) এর মালিক হয়েছিলেন, যা ছিল তৎকালীন আমেরিকার এউচ এর ৬৬ ভাগের ১ ভাগ আর বিলগেটসের সম্পদ বর্তমান আমেরিকার এউচ এর ২২৫ ভাগের একভাগ। তাঁই তাকে বলা হয় আমেরিকার সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ধনী! যার সম্পদ এখনও বেড়ে চলেছে প্রতি মিনিটে প্রায় একশ ডলার, অর্থাৎ দিনে প্রায় ৭২ লক্ষ টাকা করে। যদিও তিনি মুসলিম ছিলেন না তবুও তিনি নিয়মিত প্রার্থনা করতেন, নাচতেন না, থিয়েটারে যেতেন না, কখনো মদ্যপান এমনকি ধূমপান পর্যন্তও করতেন না। 

জন ডি. রকফেলার সিনিয়র, যিনি কবিতা পছন্দ করতেন এবং অন্যদের জীবনে সাফল্য দেখতে আগ্রহী ছিলেন, একবার তাঁর জীবনের বর্ণনা দিয়ে পাঁচটি লাইনের একটি কবিতা লিখেছিলেন। যতদূর জানা যায়, এটি ছিল তাঁর কলম থেকে একমাত্র কবিতা। তিনি তা কার্ডে মুদ্রিত করেছিলেন এবং অনেক কপি বিতরণ করেছিলেন। কবিতাটি উল্লেখ করেই আজকের জন্য ইতি টানছি-

I was early taught to work as 

Well as play

My life has been one long 

Happy holiday 

Full of work full of play 

I dropped the worry on the way 

And God was good to me 

Every day

(চলবে)

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির