ঐতিহাসিক ১১ মে কুরআনপ্রেমীদের ত্যাগের মিছিল
ডা: মো. ফখরুদ্দিন মানিক
০৫ এপ্রিল ২০১৬
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন দুনিয়ায় মানুষ পাঠানোর সাথে তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য নবী ও রাসূল প্রেরণ করেছেন। সেই সাথে অবতীর্ণ করেছেন আসমানি কিতাব। নবী-রাসূল প্রেরণ এবং কিতাব নাজিলের ধারাবাহিকতায় আজ থেকে প্রায় সাড়ে চৌদ্দশত বছর আগে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব রাসূল মুহাম্মদ (সা)-এর ওপর নাজিল হয় মহাগ্রন্থ আল কুরআন। সে সময় আরবসহ সারা বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই অশান্তি, অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছিল। ছিল না কোথাও এতটুকু শান্তি। মানুষ হয়ে স্বজাতি মানুষকে নির্যাতন, নিষ্পেষণ আর অবজ্ঞা-অবহেলা করা এবং পশুর মতো আচরণ করা ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। তাইতো সেই সময়টাকে আইয়ামে জাহেলিয়াত বা অন্ধকার যুগ নামে অভিহিত করা হয়। ইতিহাস সাক্ষী, এই কুরআন সেই জাহেলিয়াতের ঘোর অমানিশায় নিমজ্জিত পূতিগন্ধময়, কুসংস্কার এবং বর্বরতায় আচ্ছন্ন একটি জাতিকে শুধুমাত্র আলোর পথ দেখায়নি বরং কুরআনের মাধ্যমে আরবের শ্রেষ্ঠত্বকে পৃথিবীর সকল জাতির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছে। আজকের পৃথিবীতে সভ্যতা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-সংস্কৃতির যতগুলো সৌধ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, তার ভিত্তি রচিত হয়েছে কুরআন অনুসারীদের জ্ঞানগবেষণার মাধ্যমে। তাইতো বিখ্যাত প্রাচ্যভাষাবিদ জার্মান পন্ডিত ইমানুয়েল ডিউস বলেন, ‘কুরআনের সাহায্যে আরবরা মহান আলেকজান্ডারের জগতের চাইতেও বৃহত্তর জগৎ, রোম সাম্রাজ্যের চাইতেও বৃহত্তর সাম্রাজ্য জয় করে নিয়েছিলেন। কুরআনের সাহায্যে তারাই রাজাধিপতি হয়ে এসেছিলেন ইউরোপে যেথায় ভেনিসীয়রা এসেছিল ব্যবসায়ী রূপে আর ইহুদিরা এসেছিল পলাতক বা বন্দী রূপে।’
কুরআনের এই সাম্রাজ্য এমনি এমনি তৈরি হয়নি। যারা এই কুরআনকে বুকে ধারণ করেছিলেন তাদেরকে সহ্য করতে হয়েছিল অকথ্য নির্যাতন এবং জুলুম। বারবার এই কুরআনের আলোকে নিভিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল কুরআনবিরোধী শক্তিদের পক্ষ থেকে। কিন্তু তাদের সমস্ত চক্রান্ত কূট-কৌশলের বিরুদ্ধে আল্লাহর সিদ্ধান্তই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। আল্লাহ নিজেই বলেছেন, “এরা (কাফেররা) তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়, অথচ আল্লাহর ফয়সালা হলো তিনি তার নূরকে প্রজ্বলিত করবেন।” (সূরা সফ : ৮)
আর সেই জন্য দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ মানব রাসূলকে (সা) সংগ্রাম করতে হয় দীর্ঘ ২৩টি বছর। পাপিষ্ঠদের পাথরবৃষ্টির আঘাতে রক্তাক্ত হতে হয়েছিল তাদেরই কল্যাণকামী এই মহা মানবকে। ওহুদের ময়দানে পবিত্র দাঁত হারাতে হয়েছে। আর ঠাট্টা-বিদ্রুপ তো ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। এমনকি, নিজের জন্মভূমি পর্যন্ত ত্যাগ করতে হয়েছে দীনের নকিবকে। এই আল্লাহর রাসূলের (সা) পথকে অনুসরণ করতে গিয়ে অসংখ্য সাহাবীকে শহীদ হতে হয়েছে।
একই পথ ধরে রাসূল (সা) এবং খোলাফায়ে রাশেদিনের পর যারা কুরআনের বাণী নিয়ে মানুষের কাছে গিয়েছিলেন, তাদেরকেও জুলুম-নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ দায়ী ইলাল্লাহ বদিউজ্জামান সাইয়্যেদ নুরসী, শহীদ হাসান আল বান্না, সাইয়্যেদ কুতুব শহীদ, সাইয়্যেদ আহমদ বেরলভি, শাহ ইসমাইল শহীদ, শায়খ আহমেদ সরহিন্দ, সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদীÑ তারা সবাই একই পথের সহযাত্রী। বর্তমান শতাব্দীতে এই কাতারে সংযুক্ত হয়েছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত জনপদ আমাদের প্রিয় জন্মভূমিকে দুর্নীতিমুক্ত ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্রে পরিণত করার স্বপ্ন দ্রষ্টা এবং কারিগর শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, শহীদ কামারুজ্জামান, শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা, মরহুম অধ্যাপক গোলাম আযম, মরহুম এ কে এম ইউসুফ, মরহুম নাজির আহমেদ। জালেম সরকারের রোষানলের শিকার কারান্তরীণ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর আন্তর্জাতিক ইসলামী ব্যক্তিত্ব মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, আন্তর্জাতিক মোফাসসিরে কুরআন মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মাওলানা আব্দুস সোবহান, এ টি এম আজহারুল ইসলাম, মীর কাসেম আলী। নির্যাতন, মামলা, কারাগারের অন্ধকার কুঠুরি, জালেম সরকারের ফাঁসির মঞ্চ এসব মুজাহিদের নির্ভীকতা এবং অবিচলতার কাছে হার মেনেছে, পরাজিত হয়েছে তাদের সকল ষড়যন্ত্র। যখনই কুরআনের বিরুদ্ধে, ইসলামী আইনের বিরুদ্ধে ষডযন্ত্র হয়েছে, তখনই দীনের এই মুজাহিদরা তাঁদের বক্তব্য ও লেখনীর মাধ্যমে ঈমানদারদের তাওহিদি চেতনাকে উজ্জীবিত করেছেন, তৈরি করেছেন প্রতিবাদ এবং প্রতিবাধের দেয়াল। এভাবে কুরআন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের কর্মীরা জীবনকে উৎসর্গ করেছেন কিন্তু কুরআনের মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন থেকে পিছু হটে যাননি।
ইতিহাসের পথপরিক্রমায় ৪৫ বছরের বাংলাদেশ এরকম অনেক ঘটনার নীরব সাক্ষী। স্বাধীনতা-পরবর্তী এই স্বল্পসময়ে অনেক অর্জন যেমন বাংলাদেশকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সহায়তা করেছে তেমনি অনেক ঘটনাই আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চেতনায় আঘাত করেছে, বারবার। ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে অগণিত মানুষের হৃদয়ে। যার দগ দগে ঘা থেকে রক্তক্ষরণ হয় মাঝে মাঝে। নির্বাক একটি গাছ কিংবা ইট-পাথরের দেয়ালগুলোর যদি কথা বলার সুযোগ থাকতো তাহলে হয়তো তারাও চিৎকার করে বলতো, ‘না, এই আঘাত অথবা অপমান আর সহ্য করার মতো নয়।’ ১৯৮৫ সালের ১১ মে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ঠিক তেমনই একটি ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে সংযোজিত হয়েছে।
১৯৮৫ সালের ১০ এপ্রিল ভারতীয় দু’জন উগ্রবাদী হিন্দু পদ্মমল চোপরা ও শীতল শিং ভারতীয় আদালতে কুরআন বাজেয়াপ্ত করার মামলা দায়ের করে। তারা মহাগ্রন্থ আল কুরআনের সূরা বাকারার ১৯১ নম্বর আয়াত ও সূরা তাওবার ৩১ নম্বর আয়াতের রেফারেন্স দিয়ে মামলা দায়ের করেছিল। তাদের বক্তব্য ছিল, ‘কুরআন যেহেতু কাফের-মুশরিকদের বিরুদ্ধে লড়াই ও তাদের হত্যা করার কথা বলেছে সেহেতু কুরআন একটি সাম্প্রদায়িক উসকানিদাতা গ্রন্থ।’ (নাউজুবিল্লাহ) তাই একে বাজেয়াপ্ত করার দাবি তুলে মামলা দায়ের করে এই দুই পাপিষ্ঠ। ভারতীয় সংবিধানের ২২৩ নম্বর ধারা সিআরপিসি ১১৫(ক) ও ২৯৯(ক) উদ্ধৃতি দিয়ে তারা কুরআনকে ভারতীয় সংবিধানবিরোধী বলে উল্লেখ করে। বিচারপতি পদ্ম খাস্তগীর ভারতীয় সংবিধানে ঐশীগ্রন্থ সম্পর্কে যে বক্তব্য রয়েছে তা হজম করে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মামলা গ্রহণ করেন। তিনি ১২ এপ্রিল এ বিষয়ে তিন সপ্তাহের মধ্যে অ্যাফিডেভিট প্রদানের জন্য রাজ্য সরকারের প্রতি নির্দেশ দেন। এ ঘটনায় গোটা ভারতে মুসলমানদের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বের প্রতিটি মুসলিম দেশ এর প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে যার উত্তাল তরঙ্গের ধারা আছড়ে পড়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর দেশ বাংলাদেশেও। এর প্রতিবাদে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ হয়। বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ ইসলামপ্রিয় তৌহিদি জনতার মিছিলে অত্যাচার, নিপীড়নও চালায়। আহত, নির্যাতিতদের গ্রেফতার এবং হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলার শিকার হন কুরআনপ্রেমিক মানুষেরা।
কুরআন অবমাননার এই মামলার বিরুদ্ধে সারা বাংলাদেশ যখন বিক্ষোভে উত্তাল, সেই সময় চাঁপাইনবাবগঞ্জ আলিয়া মাদরাসার অধ্যক্ষ জনাব হোসাইন আহমদ একটি সভার আহ্বান করেন। সেই সভা থেকে ১১ মে চাঁপাইনবাবগঞ্জ কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ময়দানে বিকেল ৩টায় প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দেয়া হয়। সভার প্রস্তুতির জন্য পুরো জেলায় লিফলেট বিতরণ ও মাইকিং করা হয়। এর আগের দিন শুক্রবার মসজিদে জুমার খুতবায় এবং নামাজ শেষে ইমাম সাহেবেরা পরদিন সমাবেশে অংশগ্রহণের জন্য আহ্বান জানান। সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে আবেগ ও উত্তেজনা বইতে থাকে। আবালবৃদ্ধ সবাই সেই সমাবেশে অংশগ্রহণের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। কিন্তু ১১ মে হঠাৎ করে প্রশাসন উদ্যোক্তাদের জরুরি তলব করে বিভিন্নভাবে হুমকি দিয়ে তাদেরকে সমাবেশ না করার জন্য মুচলেকা দিতে বাধ্য করেন।
প্রতিবাদসভা করতে প্রশাসন বাধা দিচ্ছে এমন খবরে উত্তেজিত জনতার মাঝে অদম্য স্পৃহা আরো বেড়ে যায়। বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো হাজার হাজার জনতা ঈদগাহের দিকে আসতে থাকে। তৎকালীন পুলিশ সুপার আওলাদ হোসেন এবং কুখ্যাত ম্যাজিস্ট্রেট ওয়াহিদুজ্জামান মোল্লার নেতৃত্বে সভাস্থলে ১৪৪ ধারা জারি করে ব্যাপক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। পুলিশ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। এখানে কোনো সভা হবে না বলে নিজেরাই ঘোষণা দেয়। আবেগে উদ্বেলিত জনতা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। ‘সভা করবো না, আমরা শুধু দোয়া করে চলে যাবো’- এই বলে কিছু সময় চাওয়া হয়।
কিন্তু তাতেও ম্যাজিস্ট্রেট ওয়াহিদুজ্জামান মোল্লা রাজি না হয়ে দম্ভ করে চেঁচিয়ে ওঠে। বলে, ‘এই মুহূর্তে স্থান ত্যাগ করতে হবে নইলে গুলির আদেশ দেবো, শালা মৌলবাদীদের সাফ করে দেবো।’ উত্তেজিত আবেগাকুল জনতা চলে তো গেলেনই না, বরং তারা জানিয়ে দিলেন, গুলির ভয়ে এ স্থান ত্যাগ করা মানেই আল কুরআনের অপমান। আমরা এ স্থান ত্যাগ করবো না।
এই উত্তাল তরঙ্গমালার সাথে সেই দিন শামিল হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিকামী তৌহিদি ছাত্র-জনতার প্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। যে আল কুরআনকে প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে শুরু হয়েছিল এই কাফেলার যাত্রা, তারা তাদের সকল কর্মীবাহিনী নিয়ে ঈদগাহ ময়দানে শামিল হয়েছিল কুরআন অবমাননার প্রতিবাদ জানাতে। জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে খন্ড খন্ড মিছিলের মাধ্যমে তারা ঈদগাহ ময়দানে জমায়েত হয়। একপর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেট মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান বিনা উসকানিতে গুলির নির্দেশ দেয়। পুলিশ একনাগাড়ে প্রায় পনেরো মিনিট পর্যন্ত গুলি, রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করতে থাকে। মানুষরূপী এই হায়েনাদের নির্মমতায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢলে পড়লো পনেরো বছরের কিশোর ইসলামী ছাত্রশিবিরের স্কুলকর্মী আব্দুল মতিন, আর সেই দিনের শহীদি কাফেলার প্রথম শহীদ ছিল সে-ই। পুলিশের গুলিতে একে একে শাহাদাত বরণ করলেন কৃষক আলতাফুর রহমান, রিকশাচালক মোক্তার হোসেন, দশম শ্রেণীর ছাত্র ছাত্রশিবিরের কর্মী রাশিদুল হক, অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র শিবিরকর্মী শীষ মোহাম্মদ ও সেলিম এবং ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র শাহাবুদ্দিন। আহত হয় শামীম, গোলাম আযম বুলু, শরীফুল ইসলাম, আলাউদ্দিন, মানিক রায়হান, এনামুল হক, মাহবুব, রেজাউল, শাহজাহান, রাজুসহ নাম না জানা আরো অনেকেই। লাশ আর আহতদের স্তূপে ভরে গেল ঈদগাহ ময়দান। নিরাপদ স্থানে গমনরত অসহায় মানুষের পিছু ধাওয়া করে শহরের অভ্যন্তরেও গুলি চালাতে থাকে পুলিশ বাহিনী। টুপি, পাঞ্জাবি, দাড়ি দেখলেই নির্মমভাবে তাদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়।
হাসপাতালের হৃদয়বিদারক দৃশ্য!
শহীদ ও গাজীদের রক্তে লালে লাল হয়ে যায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের পিচঢালা কালো পথ। আহতদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন ডাক্তাররা। তাদেরকে রাজশাহীতে নিয়ে যাওয়া হলো দুটো মিনিবাসে করে। দেড় ঘণ্টা পর যখন মিনিবাস থানা পার হচ্ছিল, কুখ্যাত ম্যাজিস্ট্রেট আবারো গাড়ি থামিয়ে গুলির নির্দেশ দেয়। এতে আহত হয় গাড়ির হেলপার, মারা যান কাপড় ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম। আহতদের নামিয়ে দৈহিক নির্যাতন চালানো হয় এবং নিখোঁজ হয় কয়েকজন আহত ব্যক্তি। কেবল হত্যা ও জখম করেই ক্ষান্ত হয়নি পুলিশ, হতাহতদের গুম করে ফেলেছিল সেই দিন। জানাজার মুহূর্তে লাশ কেড়ে নিয়ে আসা হয়েছে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে। গ্রেফতার করা হয়েছে শিবিরেব সাথী এনামুল, রেজাউল, শামীম, সেতাউর রহমান, সাইফুলসহ আরো অনেককে। এর মধ্যে কারফিউ জারি করা হলো। শুরু হলো সেনা টহল। সামরিক জান্তাদের কাছে অনেকেই নাজেহাল হলো। রাতের চাঁপাইনবাবগঞ্জ যেন এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হলো।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন বর্বরতা ঘটে গেল সেদিন। বিক্ষুব্ধ মানুষ রাস্তায় বের হলো অথচ পরদিন পত্রিকায় কোনো সংবাদ ছাপা হলো না। কারণ সেন্সরশিপ অর্ডিন্যান্স জারি করে পত্রিকার কণ্ঠরোধ করা হলো। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে আবার সেই পুরনো বাকশালের প্রকাশ ঘটালো। ১৩ মে সরকার একটি প্রেসনোট করে আসল ঘটনাকে আড়াল করার চেষ্টা করল। তাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জবাসী হতবাক হলেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে যেখানে শহীদের সংখ্যা ১১, চাঁপাইনবাবগঞ্জবাসীর মতে ২০-এর অধিক, নিখোঁজ সংখ্যা ৮-৯। কিন্তু প্রেসনোটে শহীদের সংখ্যা বলা হয়েছে মাত্র ৬। এ ব্যাপারে দেশের জনগণকে অন্ধকারে রাখা হয়।
কিন্তু খবর চাপা পড়ে থাকেনি। পরদিন হরতাল আহ্বান করা হয়। বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে, বাজারে ও মসজিদে লিফলেট বিলি করা হয়। গভীর রাতে কারফিউ ভঙ্গ করে সাইকেলে চড়ে ওয়াহিদুজ্জামান মোল্লার ফাঁসির দাবিতে পোস্টারিং করা হয়। ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মীরা প্রতিদিন ঘটনাকে তুলে ধরতে থাকে মসজিদে মসজিদে, প্রতি ওয়াক্ত নামাজের পর। মুসল্লিদের সুপ্ত ঈমান যেন আবার জেগে উঠলো। ঘটনার বিহবলতায় হু হু করে কেঁদে ওঠেন মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধরা। উত্তেজনায় হাঁপাতে থাকেন যেন এখনই ঝাঁপিয়ে পড়বেন তাগুতের বিরুদ্ধে।
পরদিন সরকারি ঘোষণা এলো নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা দেয়া হবে। এটি ছিল সবচেয়ে হাস্যকর। ঠান্ডামাথায় মানুষ হত্যা করে কিছু টাকা দিয়ে তার দায় এড়াতে চাওয়া, এর মতো নির্মমতা আর কী হতে পারে! কিন্তু আজও চাঁপাইনবাবগঞ্জবাসীর দাবি হত্যাকান্ডের মূল নায়ক ডিসি এ কে এম. শামসুল হক, এসপি আওলাদ হোসেন এবং ম্যাজিস্ট্রেট ওয়াহিদুজ্জামান মোল্লাসহ খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।
এই ঘটনায় ছাত্রশিবির বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করে। ১৪ মে সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ও ১৫ মে প্রতিবাদ দিবসের কর্মসূচি এবং বিশেষ বুলেটিন বের করে। একই সাথে সারা বিশ্বে একটি জনমত সৃষ্টি হয় ও ১৩ মে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি কে বি সি বাসক বামন উক্ত মামলাটি খারিজ করে দেন। সেই থেকেই বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ১১ মে দিনটি ঐতিহাসিক ‘কুরআন দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঈদগাহ মাঠে যেন আজও শোনা যাচ্ছে কিশোর শীষ মোহাম্মদের আর্তনাদ, শহীদ রাশিদুলের করুণ আহাজারি, শহীদ আব্দুল মতিন ও সেলিমের আর্তচিৎকার, শহীদ সবুর ও নজরুলের বুকফাটা কান্না।
এই আওয়াজ শহর-গ্রাম-গঞ্জের প্রতিটি দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হলেও কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না যারা আছেন শাসকের সিংহাসনে। এখনও কুরআনের বিরুদ্ধে ষডষন্ত্র অব্যাহত।
ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থার নামে ধর্মহীন শিক্ষাব্যবস্থা জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। ইসলামের ফরজ বিধান নারীদের ইজ্জত-আবরু হেফাজতের গ্যারান্টি হিজাবকে আইন করে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা চলছে। নারী স্বাধীনতা, নারীর ক্ষমতায়নের নামে নারীদেরকে মর্যাদার আসন থেকে নামিয়ে পুরুষের প্রতিপক্ষ বানিয়ে এক অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত করে দিচ্ছে।
সরকার এ সকল কর্মকান্ডের মাধ্যমে তার ইসলামবিরোধী চেহারা প্রকাশের পাশাপাশি তৌহিদি জনতার হৃদয়ে এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে একের পর এক আঘাত হেনে চলেছে। শুধুমাত্র কুরআনের শাসন কায়েমের আন্দোলন করার কারণে সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর প্রবীণ রাজনীতিবিদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে। নায়েবে আমীর দেশবরেণ্য আলেম আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে আমৃত্য কারাদন্ড প্রদান করেছে।
তাওহিদবাদী জনমানুষের হৃদয়ের এ ক্ষত সময়-কাল গড়িয়ে আজ আরও দগদগে আরো নির্মম। নতুন সহ¯্রাব্দে কুরআন উপেক্ষা অবজ্ঞার ইতিহাস নতুন মাত্রা পেয়েছে। কুরআন ও কুরআননির্ভর সংস্কৃতি, জীবনবোধ দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশে আজ ফৌজদারি অপরাধ, আবু জাহেল আবু লাহাবের প্রেতাত্মারা এ তাওহিদ বিশ্বাসনির্ভর সবুজ বাংলার বুক থেকে ইসলামের শেষ চিহ্নটুকুও মুছে ফেলতে চায়। শেকড়হীন পরজীবী একটি জনপদে পরিণত করতে চায়। যেখানে ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম থাকবে কি না তার প্রশ্ন আসে, যেখানে হিজাবের অধিকার আদায়ে অমুসলিম দেশের মতো রাস্তায় নামতে হয়, কুরআনের বিধান চর্চার অপরাধে হাজার হাজার যুবককে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নির্যাতিত হতে হয়। বার্ধক্যের ভারে ন্যুব্জ অসুস্থ এমনকি বাসাবাড়ি থেকে মহিলাদেরকেও গ্রেফতার হতে হয়। পৌত্তলিক, ব্রাহ্মণ্যবাদী, সংস্কৃতি, যেখানে প্রগতির স্মারক। আফসোস!
সুকৌশলে একটি জাতিকে যারা ব্রাহ্মণ্যবাদী বিশ্বাস ও চেতনায় দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করতে চায়, সেই ব্রাহ্মণ্যবাদী, তাগুতি শক্তির বিরুদ্ধে আজ প্রয়োজন সর্বাত্মক সর্বব্যাপী সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ। যেমনটি আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বিশ্বাসীদের প্রতি আহ্বান করেছেন- “এ (কুরআন) নিয়ে অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে মোকাবেলা কর।” (সূরা ফুরকান : ৫২)
রাজপথে যখন সরকারের ফ্যাসিবাদী এবং ইসলামবিরোধী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম দানা বেঁধে ওঠে, তখন সরকার তার পুলিশবাহিনী দিয়ে- কোনো কোনো ক্ষেত্রে দলীয় ক্যাডার বাহিনী দিয়ে- শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পন্ড করে দিয়ে তাদেরকে দমনের চেষ্টা করছে। গুম-হত্যা-নির্যাতনের মাধ্যমে দমন করা হচ্ছে ইসলামপ্রিয় জনতাকে। ইসলামবিরোধী শক্তির মনে রাখা উচিত, প্রশাসনকে দলীয় ক্যাডার বাহিনীতে পরিণত করে বিরোধী মতের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা যাবে, মিথ্যা সাজানো অপরাধের নাটক সাজিয়ে আইনের কূটকৌশলে ফাঁসি দেয়া যাবে, নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার মাধ্যমে মিথ্যা অপপ্রচারে বিভ্রান্তি ছড়ানো যাবে কিন্তু একটি আদর্শিক আন্দোলনকে কখনও চিরতরে নির্মূল করা যায় না। বরং এই হত্যা, গুম, নির্যাতন, গ্রেফতারের পথই জালেমের পতনকে ত্বরান্বিত করবে ইনশাআল্লাহ। কুরআনের কর্মীদের শাহাদাতের খুন কখনও বৃথা যাবে না। এই খুন একদিন বাংলাদেশের মাটিতে বিপ্লবের তরঙ্গমালা সৃষ্টি করবে।
বিশ্বের দেশে দেশে যে সময় গণ-বিস্ফোরণের মুখে স্বৈরাচারদের পতন হচ্ছে সেখান থেকে সরকারের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। কুরআনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে পৃথিবীর কোনো জালেম টিকে থাকতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না বরং জুলুমের পথেই তাদের পরাজয় হবে। ফাঁসি, গুপ্ত হত্যা, মামলা, রিমান্ডের নামে নির্যাতন, বছরের পর বছর কারাগারে আটকিয়ে রাখা, পুলিশের টিয়ার শেল, রাবার বুলেট, লাঠিচার্জ, জলকামান দিয়ে জনতার আন্দোলনকে দমানো যাবে না।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের মাটি যে কুরআনের কর্মীদের রক্তে উর্বর হয়েছে, তার উর্বরতা আজকে বাংলাদেশের প্রতি ইঞ্চি জমিতে বিরাজমান। কুরআনের মর্যাদা রক্ষায় শহীদ মতিন, সেলিম, শীষ মোহাম্মদ, শাহাবুদ্দিন, রাশিদুল হক যেভাবে নির্ভীকতার পরিচয় দিয়েছেন, তাঁদের উত্তরসূরিরা আজকেও একইভাবে অটল-অবিচল কুরআন, ইসলামী আন্দোলন এবং ইসলামী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সকল ষডযন্ত্র মোকাবেলা করার জন্য। হ
আপনার মন্তব্য লিখুন