post

বাংলা ভাষার অবস্থা

মো: আবুল কালাম আজাদ

০৫ জুন ২০২২

ভাষা মানুষের জন্য মহান প্রভু প্রদত্ত একটি নিয়ামত। সময় এবং প্রকৃতি অমোঘ নিয়মের কারণে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ও অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। বাংলা ভাষা ও তার বিপরীত কিছু নয়। স্ব স্ব মায়ের কোল থেকেই ভাষার ধারাবাহিকতা শুরু হয়। বাংলা ভাষার ইতিহাস অনেক দীর্ঘ পথ পরিক্রমা ও ইতিহাস সমৃদ্ধ। সময়ের ব্যবধানে এক পর্যায়ে আন্তর্জাতিক মানে রূপান্তর এবং আন্তর্জাতিক মানে রূপান্তর এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে ও স্বীকৃতি লাভ করেছে। কিন্তু বর্তমানে মাতৃভাষা বাংলার দৈন্যদশা তা আমরা গভীরে তলিয়ে দেখার উপায় নেই। আমাদের সংবিধানে বলা হয়েছে “প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা, এই কথার অর্থ হলো যে রাষ্ট্রের যাবতীয় কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হবে বাংলা ভাষা, অন্য কোনো ভাষা নয়”। অর্থাৎ বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষার ব্যবহার রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত নয়। বাংলা ভাষাকেই প্রাধান্য দিতে হবে। স্বাধীনতার আগেও বাংলা ভাষা বাংলাদেশের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ছিল এবং পাকিস্তানের ১৯৬২ এর সংবিধানেও। সেখানে বলা হয়েছিল যে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হচ্ছে বাংলা এবং উর্দু তবে এই অনুচ্ছেদটির অর্থ এই নয় যে অন্য কারো ভাষা ব্যবহারে বাধা থাকবে। বিশেষভাবে ইংরেজি ভাষা সরকারি ও অন্য কাজে ব্যবহার করা যাবে। সে পর্যন্ত না এর পরিবর্তনের জন্য উপযোগীকরণ ব্যবস্থা করা হবে। তবে বাংলাদেশের সংবিধানে বাংলা ভাষার সঙ্গে এমন কোনো শর্ত নেই যে বিকল্প হিসেবে ইংরেজি ব্যবহার করা যাবে। এমন সব নির্দেশনা প্রবিধান থাকা সত্ত্বেও স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত নানা দাফতরিক কাজকর্মে বাংলার সঙ্গে ইংরেজিকে বাদ দেওয়া যায়নি।

সময়ের পরিক্রমায় ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের পর পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশের মানচিত্র জয় করে ১৯৭১ সালে। বঙ্গবন্ধু এককভাবে নেতৃত্ব দেন এদেশের জনমানুষের নেতা হিসেবে। ১৯৭৪ এর ১৭ সেপ্টেম্বর এ বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। বিশ্বে বাংলাদেশ নতুনভাবে স্বীকৃতি লাভ করে। পরিণতি হয় লাল-সবুজের মানচিত্র। বিশ্বসভায় সম্মানের আরেক ধাপ এগিয়ে যায়। এর এক সপ্তাহ পর প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতিসংঘে ভাষণদানের সুযোগ দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে স্পষ্ট বাংলা ভাষণ দেন, যা ঐ সময়ের জন্য ছিল এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। বিশ্বসভায় বাংলা ভাষায় ভাষণ দিয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষার এক মাইলফলক ও শুভসূচনা করেন। বঙ্গবন্ধু সে ভাষণ তৎকালীন জাতিসংঘে নিয়োজিত কূটনৈতিক ফারুক চৌধুরী ইংরেজি ভাষায় তরজমা করে সারা বিশে^ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন এর পাশাপাশি আরো পাঁচটি ভাষায় প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের সে ভাষা সাথে সাথে তরজমা হয়ে বিশ্ববাসীর কাছে ঐতিহাসিক বাংলা ভাষার ঐতিহাসিক বক্তব্য পৌঁছে যায়। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু আরেকবার এমন সুযোগ আর পাননি বিশ^বাসীর উদ্দেশ্যে বাংলা ভাষায় ভাষণ দেয়ার। এটাই তার জাতিসংঘে বাংলার প্রথম এবং শেষ ভাষণ। পরের বছর অবশ্য জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদ বাংলাদেশের প্রতিদিন দলের নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী। কিন্তু তিনি সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে ভাষণ দেন ইংরেজি ভাষায়। এর পর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১৯৭৬ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্র ও সরকারের প্রধান হিসেবে জাতিসংঘের জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পর্যন্ত রাষ্ট্রপ্রধান বা তার প্রতিনিধিরা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ইংরেজিতে ভাষণ দান করেন। বঙ্গবন্ধু সূচিত বাংলায় ভাষণ দেওয়ার প্রথা অনেক বছর অনুসৃত হয়নি। বঙ্গবন্ধুর পর জাতিসংঘে প্রথম বাংলায় ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯৩তে। তার বাংলা ভাষণের ইংরেজি অনুবাদ পাঠ করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জাতিসংঘে শাখার মহাপরিচালক ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী। এই ক্ষেত্রে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার তিন মেয়াদেই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলায় ভাষণ প্রদান করেন। এভাবে বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিচিতি লাভ করেছে। সময়ের বিবর্তনে ভাষার ক্রমধারায় নানান ব্যাপ্তি ঘটেছে। দেখা গেছে মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ অর্জন বাংলাদেশে সংবিধানে ৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা”। এছাড়া সংবিধানের ১৫৩/৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “সংবিধানের বাংলা ও ইংরেজি পাঠের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে বাংলা পাঠ প্রাধান্য পাবে”। বাংলা ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামল পর্যন্ত অক্ষুণœ ছিল ১) এবং ১৯৭৮ সালে সংবিধানের পাঠ জটিলতা সম্পর্কিত দ্বিতীয় ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে “সংবিধানের যে কোনো পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন, অর্থগত অসঙ্গতি ইত্যাদির ক্ষেত্রে ইংরেজি প্রাধান্য পাবে”। ২) বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় ভাবে ব্যবহারের জন্য ১৯৭৮ সালে ২৮ ডিসেম্বরের সভার সিদ্ধান্তে লেখা হয়েছিল এবং সর্বত্র পরিপত্র জারি করা হয়েছিল ইংরেজি ভাষায়। জাতীয় জীবন থেকে বাংলা ভাষাকে হটানোর সূত্রপাত ঘটল এখান থেকেই। বাংলার পরিবর্তে সারাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইংরেজি ভাষা প্রাধান্য পেতে আরম্ভ করল ইংরেজি ভাষা নিয়ে দেখা দিল নতুন মাতন। সংবিধানে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে বাংলা স্বীকৃতি থাকলেও সাংবিধানিকভাবে বাংলার অবমূল্যায়নের ফলে জাতীয় জীবনে বাংলা ভাষার প্রভাব ক্রমশ কমতে থাকে।

বাংলাদেশে বাংলা ভাষা নিয়ে এখনো চলছে চরম নৈরাজ্য। আলোচনা করলে মনে হয় এ ব্যাপারে কারও কোনো দায়িত্ব বোধ নেই। মন্দ প্রভাবে প্রচুর বই প্রকাশিত হচ্ছে। এ ছাড়া এখন প্রকাশিত অগণিত বিভিন্ন কিসিমের নানান পত্রিকা। দুঃখের বিষয় এ ব্যাপারে কোথাও কোন নিয়মনীতির বালাই নেই। এমনকি বাংলা একাডেমির বইয়ে উপেক্ষিত হচ্ছে তাদের নিজেদের তৈরি “প্রমিত বানান রীতি”। টেক্সবুক বোর্ড বইয়ের কথাতো বলার উপায় নেই। বানান ভুলের এবং কোনো রীতি এ ব্যাপারে তা মনেই হয় না। এ ছাড়া সংবাদপত্রগুলো বাংলা ভাষার নানামাত্রিক ব্যবহার সৃষ্টি করছে বহুমুখী বিভ্রান্তি। বানানরীতি মানা হচ্ছে না। ব্যাকরণের নিয়মরীতি বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে রেডিওতে প্রচারিত হচ্ছে অপ্রত্যাশিত উদ্ভট জগাখিচুড়ি ভাষার উপস্থাপনা। সামগ্রিকভাবে ভাষার ব্যবহার দেখলে মনে হয় দেশের প্রকাশনা শিল্প ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ভাষার ব্যাপারে যেন পরোক্ষ ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। বিষয়টি দিন দিন ক্রমশ ভালোর দিকে যাচ্ছে না। যাদের বাংলা ভাষা ও বইপত্র নিয়ে একটু নাড়াচাড়ার অভ্যাস ছিল, তারাও আজকাল ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করে এবং সহজে তথ্য-উপাত্ত পেয়ে যায়। অর্থাৎ মৌলিক ভাবে ভাষার ক্ষেত্রে পদচারণা ও স্টাডির পরিবেশ অনেকটা হারিয়ে ফেলছে। একটা বিষয় বিশেষ ভাবে লক্ষণীয় যে, দেশের এক শ্রেণীর মানুষ আবেগে হোক আর না বুঝে হোক তাদের সন্তানকে ইংলিশ মিডিয়ামে অধ্যয়ন করাচ্ছে। কিন্তু এ শ্রেণীর ছাত্ররা আদৌ কি ইংরেজি ভাষা শিখতে পারছে! পারে নাই। বরং নানান সমস্যার সম্মুখীন হয়ে এ শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীরা জীবনের চরম লক্ষ্যচ্যুত হয়ে ঝরে পড়ে। যার ফলে তাদের একূল ওকূল সব কূল নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে অবলীলায়। এ ব্যাপারে কিছু কিছু অভিভাবক মারাত্মক সমস্যায় পড়ে অবশেষে ইংরেজি মিডিয়াম থেকে বাংলায় লেখাপড়া করার জন্য ফিরে আসতে হচ্ছে। মূলধারা হলো বাংলা ভাষা বা বাংলা মিডিয়াম স্কুল ও কলেজ। এখানে বলা দরকার যে, যাদের টাকা পয়সা আছে, অর্থশালী, তারা সমাজে লোকদেখানো হোক বা অনাগত দিনের কথা ভেবে হোক, ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ানোর বাতিক দেখিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে বাস্তবিক ক্ষেত্রে যা দেয়া হয় তা হলো সংশ্লিষ্ট ঐ ছাত্রছাত্রীর জীবনে সত্যিকারে শিক্ষার উন্মেষ সাধন হয় না। প্রকৃত পক্ষে দো-আঁশলা বা বাংরেজি ধারার কখনো ভাষা সাহিত্যের ধারা উন্নয়ন সম্ভব না। বাংলা সাহিত্যের বাস্তব অবস্থার কথা চিন্তা করে বাংলা সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘শিক্ষার বাহন’ প্রবন্ধে ১৯১৫ সালে অত্যন্ত গ্রাহী ভাষায় লিখেছেন “উচ্চশিক্ষাকে আমাদের দেশের জিনিস করিয়া লইতে হইবে। পশ্চিম হইতে যা কিছু শিখিবার আছে, জাপান তা দেখিতে দেখিতে সমস্ত দেশে ছড়াইয়া দিল, তার প্রধান করা এই শিক্ষাকে তারা ভাষার আধারে বাধাই করিতে পারিয়াছে। অথচ জাপানি ভাষার ধারণা শক্তি দিব এবং দেওয়া যায়, এবং দিলেই তবেই বিদ্যার ফসল দেশ জুড়িয়া ফলিবে।”

স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ^বিদ্যালয়ে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল ১৯৬৭ সালে। ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ঘোষণার পর উচ্চ আদালতে বেশ কিছু রায় লিখিত হয়েছিল বাংলা ভাষায়। এসব দৃষ্টান্ত ঐতিহাসিকভাবে মাইলফলক হলেও সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন যুগের পর যুগ শুধু ফেব্রুয়ারির সেমিনারের আলোচনার বিষয় হিসেবেই বেঁচে আছে। ১৯৮৭ সালে প্রণীত বাংলা ভাষা প্রচলন আইন এর তৃতীয় ধারায় অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে। এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথ্য সরকারি অফিস শাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যতীত অন্য সব ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনগত কার‌্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে। এই আইনের ২(১) উপধারায় বলা হয়েছে, “কর্মস্থলে যদি কোনো ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন, তাহলে তা বেআইনি ও অকার্যকর নলে গণ্য হবে। বাংলা ভাষা ব্যবহার না করলে শাস্তি প্রদানের কথাও বলা হয়েছে উক্ত আইনে। প্রকৃতপক্ষে সেই আইন এখনও বলা আছে, তবে কোনো প্রয়োগ নেই। বরং সর্বত্র ঘটছে উল্টো প্রয়াস। বাংলা ভাষাকে নির্বাসনে পাঠানোর প্রচেষ্টা। বাংলা সমৃদ্ধ ভাষা, এই ভাষায় কবি এক শতাব্দীরও বেশি আগে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। সেটাও ভাষার বিশ^ স্বীকৃতি। এখন বাংলা ভাষায় কথা বলে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ। তারা শুধু বাংলাদেশ ও ভারতে নয়, ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে বাস করছে। সেসব বিবেচনা ও ভাবাবেগবশত দাবি উঠেছে অথবা আমরা আশা করছি জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা করা হোক বাংলা ভাষাকে। বর্তমান ইংরেজি, ফরাসি, স্প্যানিশ, রুশ, আরবি, চৈনিক, মান্দারিন জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা কিন্তু বাস্তবতার আলোকে ব্যয় বহুলতার দিক দিয়ে বাংলা ভাষা জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষার স্বীকৃতি পায়নি।

ভাষা নিয়ে পৃথিবীর কোনো দেশে এত মাতামাতি, বাড়াবাড়ি, শোরগোল ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায় না। পৃথিবীর কোনো দেশে ভাষার মাস নেই এবং কোনো দেশে এত সেমিনার, সিম্পোজিয়াম অথবা মেলা ও ভাষাকেন্দ্রিক এত ব্যবসার নিমিত্তে বই প্রকাশিত হয় না। মনে হয় ফেব্রুয়ারি মাস এলেই কিছু বই প্রকাশ করা দরকার। যার দ্বারা কোনো সমৃদ্ধ সফল ব্যবসার মুখ দেখা যায় না। বর্তমান দেশে ভাষার মাসেই এ ধরনের মানসিকতা বেশির ভাগ লেখক/সাহিত্যিকদের। পৃথিবীর কেন দেশে ভাষার মাস নেই কিন্তু তারা ভাষা সাহিত্য চর্চা স্বদেশী ভাষায় করে থাকে। তাদের বোমা মারলেও একটু ইংরেজি বের হবে না, অথচ তারা বিশ্বের যেকোনো দেশে গিয়ে স্বদেশী ভাষায় বক্তৃতা দেয়। ইংরেজিতে কখনো নয়। তারা জানে মায়ের ভাষার উপর আর কোনো ভাষা থাকতে পারে না। গুরুত্বের আলোকেই মাতৃভাষায় বক্তৃতা যে দেশের ঐতিহাসিক তা হয়ত দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ এখনো অনুধাবন করতে পারেনি। বিশেষ করে বাংলা ভাষা আমাদের কাছে ঐতিহাসিক হলেও তার এতটুকু শ্রদ্ধাবোধ এখনো যথাযথভাবে আসেনি। যদি সে রকম শ্রদ্ধা, ভালোবাসায় সিক্ত করা যেত, তাহলে দেশে বিদেশে মাতৃভাষার গুরুত্ব অবশ্যই উন্মোচিত হতো।

আজ আমরা যদি বাংলা ভাষার দিকে তাকাই, দেখা যাবে বাংলা ভাষা কোনো রকম স্যালাইন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। পথে-ঘাটে, রাস্তায়, বাসা-বাড়ি, স্কুল-কলেজে, মাদ্রাসায়, বিশ^বিদ্যালয়ে, সাইনবোর্ডে কোনো ক্ষেত্রেই লেশমাত্র নেই। বানান ভুল কোনটা, বাংলা কোনটা, কোনটা ইংরেজি-উর্দু বোঝা দায়। যেমন- ‘এখানে রেন্ট এ কার ভাড়া দেওয়া হয়’। বাক্যটি আসলে না বাংলা না ইংরেজি। বানানে যে পরিমাণ ভুল তা বোঝানো দায়। যা হোক বাংলা নিয়ে যেভাবে শিক্ষা সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে তাতে অনাগত দিনে ৫২ রক্ত¯œাত ইতিহাস হয়ত থাকবে, কিন্তু থাকবে না বাংলা ভাষা সাহিত্যের মৌলিক ধারা।

একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, পৃথিবীর অনেক উন্নয়নশীল দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে এসেছেন ও এখনো আসছেন বিভিন্ন প্রোগ্রাম নিয়ে। তারা মাতৃভাষায় অতি চমৎকারভাবে ভাষণ দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। অথচ বাংলাদেশের অনেক ব্যক্তি ছোটখাটো প্রোগ্রামে গেলেই বাংলা ভাষায় কথা বলতে চান না। অথচ চীন, জাপান, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়াসহ পৃথিবীর অনেক দেশ কখনো ভাষা নকল করে না। বরং স্বদেশী ভাষা অতি গর্বের সাথে উচ্চারণ করে। তাতে করে মায়ের ভাষায় কথা বলা আরো আনন্দের ব্যাপার মাত্র। সময়ের ব্যবধানে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও বাংলা ভাষায় ব্যাপক প্রচার প্রসারের জন্য এবং ভাষাশহীদদের স্মৃতি বিজড়িত ভাষার মাসের দিক শেষ হয়ে গেছে। হাজার হাজার বই প্রকাশিত হয়েছে। অনেকের ব্যবসার সফল প্রকাশনা হয়েছে কিন্তু বাংলা ভাষার কি সফলতা লাভ হয়েছে এই মেলায়? এ প্রশ্ন সবার। ভাষাকে নিয়ে বাড়তি বই প্রকাশ পেয়েছে, সে হিসেব নেয়ার এখনই সময়। ভাষার ব্যাপারে আরো সচেতন এবং সংশ্লিষ্ট মহলে এগিয়ে আসা দরকার। লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির