[১ম কিস্তি]
প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সা.-এর অবমাননার প্রেক্ষিতে বিশ্ব মুসলিম সমাজ নানাভাবে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় ফ্রান্সের বিরুদ্ধে। বিশেষ করে তাদের আপত্তিকর এই ঘটনায় ফ্রান্স সরকারের সরাসরি সম্পৃক্ততার ব্যাপারে। কিন্তু চিরন্তন বাস্তবতা হলো মুসলমানদের এই উদ্বেগ, ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ খুবই সাময়িক। ইতোমধ্যেই বন্ধ হয়েছে সব ধরনের বিক্ষোভ। সার্বজনীন ফ্রান্স পণ্য বর্জনের ডাক দিলেও এই ডাকে কতজন সাড়া দিয়েছে, তার কোন প্রভাব আদৌ মার্কেটগুলোতে এখন আছে কিনা সন্দেহ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ফ্রান্সের পণ্যগুলো বরং নতুন করে প্রচারণা পেয়েছে। বিশ্ব মুসলিমদের উপর এ ধরনের অবমাননা, অত্যাচার আর জুলুম প্রতিনিয়তই চলছে। মাঝে মাঝে বিষয়গুলো কিছুটা আলোচনায় আসলেও গত কয়েক শতাব্দীর ঘটে যাওয়া বিষয়গুলোর আজও কোন সমাধান হয়নি। মুসলমানদের আবেগকে ধারণ করে বিশ্বমিডিয়া নানাভাবে পরিকল্পিত প্রচারণা চালিয়েছে, আবার তাদের উদ্যোগেই এখন প্রচারণা বন্ধ রয়েছে। এই ধরনের দুষ্কর্মের পেছনে যারা কলকাঠি নাড়ছেন তারা সকলেই জানতেন যে রাজপথের এই উত্তাল মিছিল খুব শিগগিরই থেমে যাবে। এ কারণেই নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষক ড. আব্দুর রব খান বলেছিলেন এই ক্ষোভ ‘সাময়িক’। তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘ইসলাম নিয়ে বাংলাদেশে স্পর্শকাতরতা রয়েছে, ফ্রান্সে যা হচ্ছে তা নিয়ে হয়ত আগামী কিছুদিনে আরও বিচ্ছিন্নভাবে কিছু প্রতিবাদ দেখা যাবে, এরপর তা থেমে যাবে।’ বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেনও মনে করেন না যে নবী সা.-এর কার্টুন বিতর্ক এবং প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর কিছু মন্তব্য নিয়ে বাংলাদেশে যে মিছিলসহ কর্মসূচি পালিত হচ্ছে তা বেশি দিন প্রলম্বিত হবে। তিনি এ প্রসঙ্গে ২০০৫ সালে ডেনমার্কের একটি পত্রিকায় নবী সা.-এর কার্টুন ছাপার প্রসঙ্গ টানেন। তখনও বাংলাদেশে বিক্ষোভ হয়েছে, ডেনিশ পণ্য বর্জনের ডাক দেয়া হয়েছিল। মি. হোসেন বলেন, ‘তখনও সেগুলো ছিল তাৎক্ষণিক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। এ নিয়ে পরবর্তীতে আর কোনো আলোচনা হয়নি।’ ঘটেছেও তাই। দেশে-বিদেশে তৈরি হয়েছে নতুন ইস্যু, সবার নজর এখন অন্য দিকে। অনেকটা ভুলতে বসেছে ফ্রান্সের ঘটনা। ভুলে যাওয়া এই জগদ্বাসীকে সচেতন করে তুলতে, এই ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে সে জন্য সোচ্চার করতে সচেতন সমাজকে ভূমিকা রাখতে হবে। জানতে হবে ঘটনার অন্তর্নিহিত কারণ, সমাজের সামনে তুলে ধরতে হবে সকলের করণীয়। বিশ্ব মুসলমানদের প্রতিবাদ বন্ধ হলেও, বন্ধ হয়নি নির্যাতন, অত্যাচার আর অবমাননা। ফ্রান্সে বসবাসরত মুসলিমরা সামাজিক বিদ্বেষ, রাষ্ট্রীয় আইনের কঠোরতা ও ধর্মীয় সম্প্রীতির অবনতির আশঙ্কা করছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেছেন, ‘কোন ইসলামিস্ট ফ্রান্সের শান্তিতে ঘুমাতে পারবে না।’ অন্য দিকে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে দুই মুসলিম নারীকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। এ ছাড়া সাময়িকভাবে মসজিদ বন্ধ, মসজিদে মসজিদে চলছে পুলিশি অভিযান এবং প্রকাশ্যে রাসূলুল্লাহ সা.-এর ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন। ফরাসি সরকার মুসলিম সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। এবং ফ্রান্সের একাধিক মসজিদে প্রতিক্রিয়াশীলরা হামলা চালিয়েছে। গত ২ অক্টোবর ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ব্যাপক সমালোচনার পরও ‘ইসলামিস্ট সেপারেটিজম’ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বেশ কয়েকজন মুসলিম কমিউনিটির নেতা ও ইমামকে ইতোমধ্যেই গ্রেফতার করা হয়েছে। মসজিদ প্রাইভেট স্কুল, সংস্থা ও বিভিন্ন মুসলিম ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। চলতি বছরেই প্রায় ৭২টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে ফ্রান্স। মুসলিম কমিউনিটির নেতৃবৃন্দ ও মসজিদের ইমামদের নিয়ন্ত্রণ করতে ইতোমধ্যেই চালু করেছে চার্টার অফ রিপাবলিকান ভ্যালুস (Charter of Republican Values) নামে এক নির্দেশপত্র। এই নির্দেশপত্র অনুযায়ী প্রত্যেক ইমামকে এখন থেকে একটি অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড দেওয়া হবে। যাঁদের কাছে এই কার্ড থাকবে তাঁরাই একমাত্র ইমাম হিসেবে কাজ করতে পারবেন। যেকোনো সময় এই কার্ড কেড়ে নেওয়ার অধিকার থাকবে রাষ্ট্রের। ‘দ্য কালেক্টিভ অ্যাগেইনস্ট ইসলামফোবিয়া ইন ফ্রান্স’ নামক একটি সংগঠনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও কর্মী মারওয়ান মোহাম্মদ এক টুইট বার্তায় লিখেছেন ফ্রান্সে এখন যা হচ্ছে তা নজিরবিহীন। মৌলিক স্বাধীনতা হুমকির মুখে। কেননা সরকার মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর দোষারোপ ও তাদের অপরাধী প্রমাণে মনোনিবেশ করেছে।
কিন্তু কেন, কী চায় ফ্রান্স? শুধু ফ্রান্স নয়, ইউরোপীয় আধিপত্যবাদীরা মুসলিমদের উত্থান ও অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়। অন্যান্য আধিপত্যবাদীদের আলোচনা পরে কখনও করা যাবে ইনশাআল্লাহ। আজ ফ্রান্সের কথায় আসি। ফ্রান্স আধুনিক বিশ্বের শক্তিশালী দেশসমূহের একটি। ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর আগমন এখানে কয়েকটি ধাপে হয়েছে। মুসলমানদের স্পেন বিজয়ের সাথে মূলত ফ্রান্সে ইসলামের আগমনের সেতুবন্ধন হয়েছে। স্থায়ীভাবে মুসলমান ও ইসলামের ভিত গেঁথেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, যেখানে ফ্রান্সের পক্ষে যুদ্ধ করেছেন মুসলমানরা। মারা গেছেন অগণিত মুসলিম জনগোষ্ঠী। পরবর্তীতে কৃতজ্ঞ ফরাসি জাতি যুদ্ধাবশিষ্ট গাজী মুসলমানদের এখানে স্থায়ীভাবে থেকে পুনর্বাসন সুযোগ দেয় ও তাদের ধর্ম কর্মের সুবন্দোবস্ত করে দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠা করে দেওয়া হয় এর কৃতজ্ঞতা হিসেবে ‘Grandemosquée de Paris’ ‘প্যারিস বড় মসজিদ’। মূলত এখান থেকেই ফ্রান্সে ইসলাম ও মুসলমানদের আগ্রযাত্রার সোপান তৈরি হয়েছে। ফ্রান্স আজ মুসলমানদের সেই অবদান ভুলে গিয়ে মুসলিম নিধনে তৎপর। কারণ ফ্রান্সে হু হু করে বাড়ছে মুসলমানদের সংখ্যা। ফ্রান্সের মোট জনসংখ্যা যেখানে প্রায় ৭ কোটি, সেখানে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ লাখ মুসলমানের বাস। সেখানে ধর্মীয় ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতিগোষ্ঠী হচ্ছে মুসলিমরা। অনেকে উদ্বিগ্ন যে মুসলমানদের সংখ্যা আগামী ৫০ বছরে কয়েকগুণ বাড়বে। কেননা স্থানীয়দের চেয়ে মুসলমানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কয়েক গুণ বেশি। ফ্রান্সের বর্তমান ধর্মীয় বিশ্বাসের হার উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী নিম্নরূপ- ৫১.১% খ্রিষ্টান ৩৯.৬% ধর্মহীন ৫.৬% মুসলিম ০.৮% ইহুদি ধর্ম ২.৫% অন্যান্য বিশ্বাস
মার্কিন গবেষণা কেন্দ্র ‘পিউরিসার্চ সেন্টার’ ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, ফ্রান্সে মুসলমানদের সংখ্যা ২০২৫ সালের মধ্যে ১ কোটি ৩২ লাখ হবে। গবেষণা কেন্দ্র ‘পিউরিসার্চ সেন্টার’ ইউরোপে মুসলমানদের বৃদ্ধির সাথে সম্পর্কিত তিনটি সম্ভাব্য পরিস্থিতিতে পরীক্ষা করেছে। প্রথম দৃশ্যকল্পটি ‘শূন্য অভিবাসন’ মোডে অঞ্চলের মুসলমানদের সংখ্যাকে পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য দ্বিতীয় দৃশ্যকল্প, বৈধ ইমিগ্রেশন শাসনব্যবস্থায় এবং তৃতীয় অবস্থানে, ২০০১ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ইউরোপীয় মহাদেশে প্রবেশ করে আইনি এবং অবৈধ অভিবাসীদের প্রবেশের জন্য ভিত্তি প্রদান করে। বিবেচনা করা হয়েছে। ফ্রান্সে মুসলমানদের সংখ্যা গত বছর ছিল ৫৭ লাখ, বা মোট জনসংখ্যার ৮.৮ শতাংশ। কেন্দ্র অনুযায়ী, যা শূন্য অভিবাসনে আট বছর পরে মুসলমানদের সংখ্যা ৮৬ লাখ বৃদ্ধি আশা করা যায়। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, গবেষকরা ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে মুসলমানদের সংখ্যা ১৭.৪ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে যা ১ কোটি ২৬ লাখের সমান এবং তৃতীয় ক্ষেত্রে ১৮ শতাংশ এবং ১ কোটি ৩২ লাখের মধ্যে পৌঁছাবে। এই গবেষণা ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৮টি দেশ এবং নরওয়ে এবং সুইজারল্যান্ড অন্তর্ভুক্ত। বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০১০ ও ২০১৩ সালের মধ্যে অভিবাসী মুসলমানদের মধ্যে ৫৩ শতাংশ ইউরোপে এসেছে। ২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি ‘ইসরাইল ন্যাশনাল নিউজে 'Catholic France, Adieu; Welcome, Islam' শিরোনামে একটি নিবন্ধ ছাপা হয়। যার সরল অনুবাদ, ‘ক্যাথলিক ফ্রান্স বিদায়, স্বাগতম ইসলাম। নিবন্ধটির সাবহেডিং ছিলো, ‘Minarets instead of church towers, muezzins instead of churchbells.’ (চার্চ টাওয়ারের বদলে মসজিদের মিনার এবং চার্চ ঘণ্টার বদলে মুয়াজ্জিনের আজান।’ লেখক নিবন্ধটি শুরু করেন এভাবে এভাবে ফ্রান্সে গির্জার ঘণ্টাধ্বনির দিন কি শেষ? প্যারিসের সিনজেলা শহরে বাস করে ৫০০ লোক। গত সপ্তাহ পর্যন্ত প্রতি আধাঘণ্টা পরপর এখানকার বয়েসেটস গির্জার ঘণ্টা বাজে। এরপর প্রশাসনিক আদালু সেই ঘণ্টাধ্বনি বন্ধ করে দিয়েছে। মূলু পৃথিবীর স্পটলাইট থেকে বহু বছর আগেই হারিয়ে গেছে ফ্রান্স। এক সময়ে গির্জাকন্যা নামে দেশটির যে পরিচিতি ছিল তাও এখন আর অবশিষ্ট নেই। একদিকে রাষ্ট্রীয় সেক্যুলারিজম, অপর দিকে ইসলামের প্রাধান্যের কারণে ক্যাথলিক ফ্রান্স নৈতিকভাবে এখন মৃতপ্রায়। গত ২৫ বছরে ফ্রান্সে ইসলাম গ্রহণের হার দ্বিগুণ বেড়েছে। গত ১০০ বছরে ফ্রান্সে যতগুলো ক্যাথলিক গির্জা নির্মিত হয়েছে, গত ৩০ বছরেই তার চেয়ে বেশি মসজিদ ও নামাজকেন্দ্র তৈরি হয়েছে। অতি সম্প্রতি ফ্রান্সের সবচেয়ে প্রভাবশালী মুসলিম নেতা দালিল বুবাকিউর ফ্রান্সে আগামী দু’বছরে মসজিদের সংখ্যা দ্বিগুণ করার আহবান জানিয়েছেন। প্যারিস মসজিদের প্রধান ইমাম দালিল বুবাকিউর বলেছেন, বর্তমানে দেশটিতে যে পরিমাণ মসজিদ আছে সেগুলো মুসলিমদের চাহিদা পূরণে যথেষ্ট নয়। তাই তিনি এ আহবান জানিয়েছেন। বর্তমানে ফ্রান্সে মসজিদের সংখ্যা প্রায় ২,২০০টি। দলিল বুবাকিউর ফ্রেঞ্চ মুসলিম কাউন্সিলেরও প্রেসিডেন্ট। ফরাসি ইউনিয়ন অফ ইসলামিক অর্গানাইজেশনের বার্ষিক এক সম্মেলনে তিনি এই আহবান জানান। ফরাসী সরকারের পরিসংখ্যান অনুসারে দেশটিতে মুসলমানের সংখ্যা ৫০ থেকে ৬০ লাখের মতো। পশ্চিম ইউরোপের যেকোনো দেশের চাইতে ফ্রান্সে মুসলমানের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বস্তুত ফ্রান্সে জনসংখ্যার তাত্ত্বিক হিসেবে ইসলামই বিজয়ী। ফ্রান্সে অমুসলিম পরিবার প্রতি শিশুর সংখ্যা ১.২। কিন্তু মুসলিম পরিবারে শিশুর সংখ্যা এর ৫ গুণ বেশি। আগে ফ্রান্সের মানুষ প্রতি রোববার গির্জায় যেতো, এখন যায় প্রতি দুই মাসে একবার। তাই গির্জাগুলোর তিন-চতুর্থাংশই খালি পড়ে থাকে। এ ছাড়াও রয়েছে যাজক সঙ্কট। ফরাসী যাজক না পাওয়ায় এখন তাদের স্থান দখল করছে আফ্রিকার যাজকরা। ইতোমধ্যেই অন্তত ৬০টি ক্যাথলিক গির্জা বন্ধ হয়ে গেছে। যেগুলো মুসলমানরা কিনে মসজিদ রূপান্তরের কাজ করছে। গ্রেট মস্ক অব প্যারিস বা প্যারিসের বড় মসজিদে প্রতিনিয়ত ধর্মান্তরিতদের জন্য অনুষ্ঠান করতে হয়। ৮১ মিটার উঁচু মিনারের এই মসজিদে ধর্মান্তরিতদের অনুষ্ঠানের বিষয় প্রমাণ করে, ফ্রান্সে মুসলমানদের শক্তিশালী অবস্থানের কথা। ফ্রান্সে ইসলাম দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম। ২০১৪-২০১৬ সালে সর্বকালের রেকর্ড সংখ্যক শরণার্থী ফ্রান্সে আশ্রিত হয়েছেন, যার অধিকাংশ ছিলেন মুসলিম। ঢ়বি ৎবংবধৎপয পবহঃবৎ-এর গবেষণায় দেখা গেছে এ হারে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে তা বর্তমান সংখ্যার তিনগুণ হবে ২০৫০ সালে এবং ইউরোপিয়ান মুসলিম সংখ্যা হবে মূল জনগোষ্ঠীর ১৪%। ধর্মের বিবেচনায় ইসলাম হবে ইউরোপের প্রধান ধর্ম।
ফ্রান্সে সর্ববৃহৎ ধর্মীয় কনফারেন্সর আয়োজন আরবী আল খালিজ অন লাইন এর এপ্রিল ২০১৮ এর রিপোর্ট অনুযায়ী একটি নাতিদীর্ঘ প্রতিবেদন তৈরি করেছে ফ্রান্সে সর্ববৃহৎ ধর্মীয় কনফারেন্সর ৩৪তম আয়োজন। যা ১৯৮৪ সাল থেকে নিয়মিত হয়ে আসছে। তিনদিন ব্যাপী এই অনুষ্ঠানে বিশ্বের প্রসিদ্ধ ইসলামিক স্কলার, গবেষক, মুসলিম সমাজবিজ্ঞানীদের উপস্থিতি হয়েছে। বর্তমান বিশ্বের নামকরা মুসলিম দার্শনিক ড. তারেক রামাদান জেলে থাকায় এবার শুধু উপস্থিত থাকতে পারেননি। তা ছাড়া সুদানের ড. বশির, অল ইউরোপিয়ান মুসলিম কমিউনিটির চেয়ারম্যান এবং ফ্রান্সের মুসলিম শিক্ষাবিদ আহমদ জাবাল্লাহসহ বহু সমাজবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক উপস্থিত ছিলেন। প্রায় দুই লক্ষাধিক মুসলিমদের উপস্থিতি ছিলো এবারের এই কনফারেন্স এ। উক্ত কনফারেন্স থেকে ফ্রান্সের মুসলমানদের সর্বশেষ তথ্যের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হয়েছে। ১. ফ্রান্সের বর্তমান জনসংখ্যা হলো ৬২ মিলিয়ন। ২. মুসলিম জনসংখ্যা হচ্ছে ৬ মিলিয়নেরও বেশি। ৩. বর্তমানে ফ্রান্সে ৩০০০ হাজার মসজিদ আছে। পাঁচশতের বেশি রয়েছে শুধু প্যারিস শহরে। ৪. ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও মসজিদ কেন্দ্রিক মাদ্রাসার সংখ্যা প্রায় দুই হাজারের অধিক। ৫. ফ্রান্সে সরকারি ইসলামিক ইনস্টিটিউট মাত্র ৩৬টি। ইয়াহুদি ও খ্রিষ্টান ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের তুলনায় একেবারে কম।
যে সমস্ত বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে তার সংক্ষেপ- ১. বিজ্ঞানের সাথে তাল মিলিয়ে ফ্রান্সে ইসলাম দ্রুত অগ্রসরমান। ২. বিশ্ব মুসলিমদের সাথে সন্ত্রাসের তকমা লাগানো হলেও ইসলামই ফ্রান্সের দ্রুত অগ্রসর ধর্ম। প্রায় এক মিলিয়ন মুসলমান যারা মূল ফরাসি। কন্ভারটি মুসলিম। ইউরোপিয়ান মুসলমানরা সন্ত্রাসের তকমা এখন আর তাদের গায়ে মাখে না। ৩. ইউরোপিয়ান মুসলমানরা এখন নিজেদেরকে ভিন্ন জনগোষ্ঠী ভাবে না। তাঁরা এখন ইউরোপের মাটি ও মানুষের একাংশ।
ফ্রান্সের শারলী হেবদো আক্রমণ পরবর্তী ইসলাম এম সি ইনস্টিটিউট, ফ্রান্স-এর প্রিন্সিপাল বদরুল বিন হারুন তার এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন- ২০১৫ ফ্রান্সের শারলী হেবদো আক্রমণের গোটা বিশ্ব কেঁপে ওঠে। এর দায় স্বীকার করছিলো সন্ত্রাসী আল কায়েদা গোষ্ঠী। ফ্রান্স তথা বিশ্ব মিডিয়া একাট্টা হয়ে যায় ইসলাম ও মুসলমানদের সন্ত্রাসী লকব দিতে। ফরাসি মিডিয়া অতি উৎসাহী হয়ে ওঠে ইসলামের ব্যাপারে। রাতদিন মিডিয়াগুলো ব্যাপকভাবে এর প্রচার চালায়। মনে করা হয় এরপর ইসলামের আগ্রযাত্রা থমকে দাঁড়াবে। কিন্তু, হলো তার উল্টো। জনগণ ইসলাম থেকে পলায়নের পরিবর্তে কৌতূহলী হয়ে ওঠে। শুরু করে নতুনভাবে ইসলাম নিয়ে গবেষণার। প্যারিস বড় মসজিদের ইমাম জঞখ এর সাক্ষাৎকারে বলেন-এই ঘটনার কোনো প্রভাব ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর উপর হয়নি। বরং মহাগ্রন্থ আল কুরআনের বিক্রি অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে। অসধুড়হ থেকে লক্ষ লক্ষ কপি সেল হয়েছে। ফরাসি মুসলিম কমিউনিটির প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থাগুলো, আল মাহাদ আল ইসলামী, টঙওঋ এবং ঈঋঈগ এর মতবড় দায়িত্বশীল মুসলিম সংগঠনগুলো অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে আরো শক্তিশালী দায়িত্ববান হয়ে ইসলাম ও মুসলমানদের রক্ষায় তাদের কার্যক্রম আরো জোরদার করেছে এবং নিজেদের মধ্যে সমঝোতা তৈরি হয়েছে। গবেষণা সংস্থা “মান্তিনিন”এর রিপোর্টর ভিত্তিতে শারলী হেবদো আক্রমণ পরবর্তী যে সমস্ত পরিবর্তন হয়েছিল তা প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ-এর বিশেষ সহযোগী, কলামিস্ট ও সাংবাদিক হাকিম আল কারভীর ভাষায়- ১. ফরাসি মুসলমানদের সম্পত্তির হার তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। মুসলমান ব্যবসায়ীরা ফ্রান্সের টপ ধনীদের তালিকায় ঢুকে গেছে। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের হার ফ্রান্সে সর্বকালের বেশিসংখ্যক কন্ভারটি হচ্ছে। মুসলিম নতুন প্রজন্ম শিক্ষা দীক্ষার সাথে সাথে ধর্মের প্রতি অধিক হারে ঝুঁকছে। ২. মসজিদ ও মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা যে কোন সময়ের তুলনায় দশগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ৩. ফ্রান্সের শেষ দশ বছরে মসজিদ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।
ফ্রান্সসহ ইউরোপের সবচেয়ে বড় মাথা ব্যথার কারণ হলো মুসলিম কমিউনিটির প্রায় ৭৫% যুবক। এবং এদের প্রায় ৬৫ % প্র্যাকটিসিং মুসলিম। এই যুবসমাজ তাদের নৈতিকতা, দক্ষতা, যোগ্যতা ও উন্নত আদর্শিক প্রভাব দিয়ে খুব সহজেই সামাজিক নেতৃত্বের উপযোগী হয়ে উঠছে। অশ্লীলতা, বেহায়াপনা আর মাদকের ছোবলে বিধ্বস্ত ফ্রান্সের যুবসমাজের এই অবক্ষয়ের মুহূর্তে মুসলিম যুবকদের এই ঈর্ষণীয় সফলতাই ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর চরিত্রহীন জারজ সন্তানদের মাথায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। ফ্রান্সের অন্যতম চিন্তক প্রতিষ্ঠান ‘INSTITUT MONTAIGNE’ তাদের ‘A FRENCH ISLAM IS POSSIBLE’ শীর্ষক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন- Their (Muslim community) age structure highlights the large numbers of zoung people among Muslims living in France. The average age of respondents is 35, and 75 % are under 45.’ Principal Component Analysiy (PCA). একটি প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় দেখা যায়-Around 65 % of respondents of Muslim faith or culture claim to be in favour of the headscarf17, and 24 % are in favour of the full-face veil18. In both cases, 10 % of those surveyed remained at a remove by selecting the answer: “it is her choice, everyone can do as they like”
ফ্রান্সসহ সমগ্র ইউরোপে গত এক দশকে মুসলমানদের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠী ও সামগ্রিক অগ্রগতি অনেকের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব ব্যবস্থার মোড়লদের এই দুশ্চিন্তা দূর করতে তারা ফ্রান্সসহ বিভিন্ন জায়গায় মুসলিমদের উপর জুলুমের নতুন ফন্দি আঁটছে। রুখে দেওয়ার চেষ্টা করছে মুসলিমদের অগ্রগতি। গণতন্ত্রের নামে স্বৈরাচারী শাসকদের এই জুলুমবাজ শক্তি মুসলিমদের রুখতে পারবে না ইনশাআল্লাহ। এই ফ্রান্স আঠারো শতক থেকেই ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে মুসলিমদের উপর জুলুম নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাঁদের দমাতে পারেনি। স্বৈরাচারী শক্তির মোকাবেলায় মুসলমানরা তাদের রবের প্রতি বিশ্বাসকে সমুন্নত রেখেছেন। ঈমানদারদের নরম দেহের উপর অস্ত্রের আঘাত হেনে বারবার দেহ রক্তাক্ত করে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু মুহূর্তকালের জন্য তারা মুত্তাকি বৈশিষ্ট্য বিসর্জন দিতে রাজি হয়নি। আমরা দেখেছি ইমাম আবু হানিফাকে কারাগারেই বিষ প্রয়োগে শহীদ করে দেয়া হয়েছে। ইমাম ইবনে তাইমিয়াকে কুরআনের চেতনাবিরোধী স্বৈরাচারী শক্তি গ্রেফতার করে কারাবন্দি করেছিল। এরপরও আজীবন তিনি কুরআনের কথা লিখেছেন, কারাগারে থেকেও তিনি কুরআনের বাণী প্রচার করেছেন। কারাগারে লেখার জন্য তিনি কাগজ-কলম চাইলে তাকে কাগজ-কলম দেওয়া হয়নি। তিনি কয়লার টুকরো সংগ্রহ করে, তাই দিয়ে কারাগারের দেয়ালে দেয়ালে কুরআনের কথাগুলো লিখতেন। এক সময় কারাগারেই জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
বালাকোটের ময়দানে সাইয়েদ আহমদ বেরলোবি (রহ.)-এর নেতৃত্বে মুসলমানরা যখন জুমার নামাজের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন কুরআনের দুশমনরা শাণিত অস্ত্র হাতে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। একে একে সকলেই শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করে ঈমানের বৈশিষ্ট্য অক্ষুণœ রেখে মহান আল্লাহ তায়ালার সান্নিধ্যে চলে গিয়েছেন। এভাবে কুরআন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করার অপরাধে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে কাউকে গুলি করে আবার কাউকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছে। হত্যা করার পূর্বে তাদের অনেককেই স্বৈরাচারী শক্তি সরকারি উচ্চপদসহ মন্ত্রীর পদ গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছে। তারা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, ‘মন্ত্রীর পদ গ্রহণ করে যদি কুরআনের বিধান দেশে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারি, তাহলে এমন মন্ত্রিত্ব আমার কোনই প্রয়োজন নেই।’ অবশেষে স্বৈরাচারী শক্তি তাদেরকে হত্যা করেছে। ফাঁসির রশিতে আল্লাহপ্রেমিক মুত্তাকি বান্দারা ফুলের মালা হিসেবে স্বাগতম জানিয়েছেন, কিন্তু মুসলমান হিসেবে আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে ইসলামের চেতনাবিরোধী শক্তির সামনে মাথা নত করেননি। আজ ফ্রান্সের মুসলমানদের ওপর যে অত্যাচার করা হচ্ছে, জুলুমের যে নতুন কৌশল প্রয়োগ করে তাদেরকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। একজন মুসলিম হিসেবে আমরা প্রত্যাশা করতে চাই ফ্রান্সের মুসলিম কমিউনিটির শাহাদাতের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে মুসলমানদের আত্মমর্যাদাবোধকে জাগ্রত রেখে ত্যাগের নমুনা পেশ করবে ইনশাআল্লাহ। সমুন্নত রাখবে প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সা.-এর শাশ্বত মর্যাদা, প্রচার করে যাবে মহান আল্লাহর অমিয় বাণী। আল্লাহ তাঁদের তৌফিক দান করুন। ফ্রান্সে মুসলমানদের আগমন, ইউরোপীয় সভ্যতা বিনির্মাণে মুসলমানদের অবদান ও পশ্চিমাদের অকৃতজ্ঞতা ও কপটতার মুখোশ উন্মোচন করা হবে আগামী সংখ্যায় ইনশাআল্লাহ। [চলবে]
লেখক : সম্পাদক, প্রেরণা
আপনার মন্তব্য লিখুন