post

যাদের হৃদয়ে আছে আল্লাহর ভয়

ইয়াসিন মাহমুদ

২৯ মে ২০২১

এক. ভয় শব্দটির সাথে আমাদের সবারই কম-বেশি পরিচিতি রয়েছে। কেউ ভয় দেখায়। আবার কেউ ভয় পাই। প্রভাব প্রতিপত্তির ভয়। ক্ষমতার দাপট। আবার জিন-পরির ভয়েও ভীত সন্ত্রস্ত হই। ভয়ের এই সংস্কৃতি দীর্ঘকাল থেকে আমরা প্রত্যক্ষ করে আসছি। ভয়ে আমরা চুপসে যাই। তবে এইসব সঙ্কট মুহূর্তে কিছুই বলার বা করার থাকে না। বরং জীবন নিয়ে টানাটানি অবস্থা। কিন্তু আমি যে ভয়ের কথা বলছি, যেখানে জবরদস্তি নেই; নেই দাপুটে ক্ষমতার অব্যবহার। তবে সেই ভয়ের রয়েছে নির্দেশিকা। স্থায়ী নীতিমালা। সেই ভয় একান্ত নিজের। একান্ত অনুভবে নিজেকে চেনা। নিজের সম্পর্কে নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন- নিশ্চয় আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি অধিক সম্মানিত যিনি তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক খোদাভীরু। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সব কিছু জানেন এবং সব বিষয়ে অবহিত। (সূরা হুজরাত : ১৩)

দুই. আমাদের কানও মাঝে মাঝে কিছু দুঃসংবাদ শুনতে অপ্রস্তুত থাকে। আমরা তো বটেই। নৈতিক পতন কিংবা পদস্খলনের সংবাদ। জীবনমান অবনতির খবর। সেই সংবাদগুলো আপনাকে আমাকে উতলা করে তোলে। ভারাক্রান্ত করে। মনমরা কিংবা মন ভেঙে দেয়। হ্যাঁ, এমন মুহূর্তের জন্য আমরা কেউই অপেক্ষা করি না। তার পরেও মেনে নিতে হয়। এটাই চরম বাস্তবতা। অনেকটাই নিয়তি তবে চ্যালেঞ্জ থাকতে হবে নিজেকে জয়ী করা। কারণ আমাদের চারিদিকে শত্রুর নানান ফাঁদ। একটু পিছলে গেলেই জীবননাশের আশঙ্কা তো আছে। এই ফাঁদ আজকের নয়; বহু শতাব্দীকাল থেকেই এই ষড়যন্ত্রের কবলে আমরা ব্র্যাকেট বন্দী। ফিরে আসার একটিই পথ নিজেকে চেনা। প্রভুকে চেনা। তাহলেই খুব সহজেই মানজিল চেনা যাবে। যেখানেই মানুষেরা মিলিত হয় সত্য মুক্তি স্বাধীন জীবনের মেলবন্ধনের অভিপ্রায়ে। বস্তুবাদী জীবনধারা ও পাশ্চাত্য চিন্তার পতাকাবাহীরা সেখানেই চালায় নগ্ন হামলা। আমাদের ঈমান আকিদায় বিভেদ আর সংশয়ের ডানা বিছিয়ে বাধিয়ে দেয় দাঙ্গা-হাঙ্গা। এই বিষদাঁত ও বিষাক্ত নখর বিছানোর অঙ্গীকার এবং ইশতেহার পেশ করেছিলো বেশ জোরালোভাবে। তাদের (শয়তানের) সেই দাবি সম্পর্কে মহান আল্লাহর ঘোষণা: আমি (হামলা করার জন্য) এদের (মানবজাতির) সামনে থেকে আসবো, পেছন থেকে আসবো, ডান থেকে আসবো, বাম থেকে আসবো। (সূরা আরাফ : ১৭)

তিন. দেশ, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন কিংবা কোন সংস্থার কাজের উন্নয়নের জন্য একটি চুক্তিপত্র অনিবার্য হয়ে ওঠে। তরতর করে অবকাঠামো মজবুতীকরণের জন্য প্রত্যেক দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি একটি আউটলাইন তৈরি করে। নির্ধারিত একটি পলিসিকে সামনে রেখেই সম্মুখে আগানোর স্বপ্ন দেখেন। যথাযথ পদক্ষেপে এগিয়ে যায় কিংবা উন্নয়ন হয় প্রতিষ্ঠান অথবা সংগঠনটির। দেশের ক্ষেত্রেও একই নীতি। অন্যথায় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় সকল ভালো চিন্তাধারাও। মহান আল্লাহ তায়ালার সাথে বান্দার সম্পর্ক উন্নয়ন এবং একজন মুমিনের জীবনযাত্রায় বায়াতের হাকিকত খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয়। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন- হে রাসূল! যেসব লোক আপনার নিকট বাইয়াত হচ্ছিল, তারা আসলে আল্লাহর নিকটই বাইয়াত হচ্ছিল। তাদের হাতের উপর আল্লাহর কুদরতের হাত ছিলো। (সূরা ফাতহ্ : ১০)

চার. সদিচ্ছা আগ্রহ যেকোনো কাজ বা স্বপ্নকে তাঁর লক্ষ্যপানে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। সকল ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা মানেই সফলতার হাতছানি। আমরা সাধারণত বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনসহ জীবন চলার ক্ষেত্রে বিভিন্ন কার্যোদ্ধার করার অবলম্বন হিসেবে প্রতিশ্রুতি নিই। প্রতিশ্রুতি দেই। আদান- প্রদানের সিলসিলা আমরা দেখতে পাই। এই প্রতিশ্রুতি রাখা না রাখার মধ্যে সম্পর্কের টানাপড়েন হয়। সম্পর্ক নষ্টও হয় মাঝে মধ্যে। এটি হলো মানুষের দুনিয়াবি সম্পর্কের খতিয়ান। অথচ আমরা মহান আল্লাহর কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছি- আমরা তোমার প্রশংসা করবো। আমরা কেবলই তোমার ইবাদত বন্দেগি করবো। তোমার সাথে কাউকে শরিক করবো না। নিশ্চয় আমার সালাত, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও মৃত্যু সবই কেবল তোমারই জন্য। এই কথাগুলোর মৌখিক স্বীকৃতি যতটাই সহজ বাস্তবিক জীবনে পালন কি এতোটাই সহজ? নিশ্চয় না। সুতরাং এই প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য চাই নিয়মিত আত্মসমালোচনা।

পাঁচ. প্রতিটি সৃষ্টিকে টিকিয়ে রাখতে চাই শক্তিশালী স্তম্ভ। একটি সিঁড়ি। আল্লাহর পথে টিকে থাকার ক্ষেত্রে বান্দাকেও পাথেয় অবলম্বন করতে হবে। আমাদের জীবন চলার পথের গাইডলাইন সম্পর্কে মহানবী সা. বিদায় হজের ভাষণে বলেন- আমি তোমাদের কাছে দুটি জিনিস রেখে গেলাম। কুরআন ও সুন্নাহ। যতক্ষণ তোমরা এই দুটি বিষয় ধরে রাখবে ততক্ষণ পথভ্রষ্ট হবে না। (মুয়াত্তায়ে মালিক-১৬২৮) সত্য ও সুন্দরের পথে চলা খুব সহজ নয়। এই পথ কুসুমাস্তীর্ণ কিংবা ফুল বিছানো নয়। এই পথে কাঁটা বিছানো। তাই এই পথে কেবল যাদের ঈমান পাকা তারাই টিকে থাকে। ইতিহাস পড়ে পড়ে তাইতো জানা যায়।

ছয়. সময় কখনো কখনো পক্ষে আবার কখনো কখনো জীবনের বিপক্ষে চলে যায়। কেউ কেউ পকেট শক্তির ভারে তছনছ করে দেয় কারো কারো স্বপ্ন। জীবনের আকাক্সক্ষা। রাতারাতি গণমাধ্যম রিপোর্টে নির্দোষ নিরপরাধ মানুষও হয়ে ওঠে দাগি আসামি। তালিকায় বাড়তে থাকে নানান অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগপত্রের কেস স্টাডি। রিমান্ড-জামিন না মঞ্জুরে কয়েদিজীবনের ব্যাপ্তিকাল বর্ধিত হয়। ঘাত-প্রতিঘাতের নানান বেদনায় জর্জরিত দগদগে ক্ষতের চিহ্ন বহন করে তবুও তো সম্মুখ সমরে পা বাড়াতে হয় একজন মুজাহিদকে। সত্যকে যিনি গেঁথে নিয়ে হৃদয়ের গভীরে। এবং এই পথে যেতে যেতে হয়ে যায় যদি জীবনেরই শেষ। সেতো আমার জীবনের পরম পাওয়া। শহীদি দরজা। আর এই ঠিকানায় অপেক্ষমাণ থাকুক প্রবাহিত ঝরনাধারা। আর সেই পিচঢালা পথ আর ছোপ ছোপ রক্তের দাগই যেন বিজয়ের ধ্বনি। এ প্রসঙ্গে কবি আসাদ বিন হাফিজ বলেছেন- একটি বুলেট বড়জোর একটি বুকই এফোঁড় ওফোঁড় করতে পারে কিন্তু, একজন শহীদের একফোঁটা রক্ত নিমিষে লক্ষ কোটি জনতার মনে জে¦লে দিতে পারে, বিপ্লবের দাউ দাউ আগুন যে আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে যেতে পারে, কুচক্রীর নরম ফোমের গদি চৈত্রের উত্তপ্ত আরণ্যে দেয়াশলাইয়ের সামান্য এক শলাকা যেমন মুহূর্তে সৃষ্টি করতে পারে লেলিহান দাবানল, তেমনি মাত্র একজন শহীদের রক্ত বিক্ষুব্ধ জনতার উত্তেজিত হাতগুলোকে অবলীলায় বানিয়ে দিতে পারে টানটান মিসাইল। ................................................. জেনেছি কেনানের কারাগারে ইউসুফকে বন্দী করলে পরিণামে ফেরাউনকে ইউসুফের হাতেই তুলে দিতে হয় সিংহাসন আর রাজমুকুট।

ইতিহাস পড়ে পড়ে জেনেছি চিরকাল অবশেষে দেশপ্রেমিকরাই জয়ী হয়। বুুলেট, বেয়নেট, গুম, খুন, হত্যা, সন্ত্রাস, কারাগার , নির্যাতন- সেই বিজয় পথের একেকটি ফলক মাত্র।

সাত. আমাদের জীবনে একেক সময় একেক পরিস্থিতি হাজির হয়। এই মনে হয় আর এক কদমও সামনে চলা সম্ভব নয়। দীর্ঘ নিঃশ^াস। তারপর আবার ঠিক হয়ে যায়। নানান উত্থান পতনের ট্র্যাজেডি ঘটে যায় এই জীবন সংসারে। আর এইসব সঙ্কটময় মুহূর্তে নিজেকেই দায়িত্বশীল হয়ে উঠতে হয়। দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হয়। পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয় খুব ঠাণ্ডা মাথায়। স্বাভাবিক জীবনের সন্ধ্যানে অনুসন্ধিৎসু হতে হয়। পাগলের মতো ছুটে বেড়াতে হয় এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত। দ্বীন প্রতিষ্ঠার প্রতিটি পদক্ষেপে এর চেয়ে আরো বেশি ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। কেবল যারা এই সময়ের সামনে নিজেকে পেশ করেছেন কেবল তারাই বোঝেন খারাপ সময় কাকে বলে। অনেকটাই কূলকিনারহীন দরিয়ার মাঝে নিজের হাতের মুঠোয় তুলে নিতে হয় বৈঠা। বৈঠা বেয়ে বেয়ে তারপর কূলে ভিড়তে হয়। খোঁজ করতে হয় জীবনের পথ। নিঃসন্দেহে এমন পরিস্থিতিতে কেউই স্থির থাকার কথা নয়। কেবল যারা আপন শক্তিতে নিজেকে জ্বেলে রাখতে পেরেছেন; কেবল তারাই টিকে থাকে এমন সময়গুলোতে। আশপাশের প্রতিটি মানুষ যখন বিপক্ষ অবস্থান। তেমনি সন্ধিক্ষণে বাতাসের বিরুদ্ধাচরণের শন শন শব্দও কানে ভেসে আসে। সেই মুহূর্তে নিজেকে ঠিক রাখতে কেবলই প্রয়োজন আধ্যাত্মিক শক্তি। মহান প্রভুর সাথে একান্ত ঘনিষ্ঠতা ছাড়া সবই অচল এবং অকার্যকর। জনপ্রিয় গীতিকার বিলাল হোসাইন নূরীর কলমে তাইতো উঠে এসেছে-

যাদের হৃদয়ে আছে আল্লাহর ভয় তারা কভু পথ ভুলে যায় না। আল্লাহর প্রেম ছাড়া এই দুনিয়ায় কারো কাছে কোনো কিছু চায় না।

লেখক : কবি ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির