post

শিক্ষা ও নৈতিকতার সমন্বয় সময়ের অনিবার্য দাবি

ডা. শফিকুর রহমান

২৪ জানুয়ারি ২০২২

মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত অনেক কিছু শেখে। মানুষ যা কিছু শেখে তা-ই কি শিক্ষা বলা যায়? মানুষের বিশেষ কোনো শিক্ষার প্রয়োজন আছে কি? মানবশিশুর বিকাশ, এমনকি অস্তিত্ব পর্যন্ত তার পিতামাতা এবং অন্যান্য শিক্ষকের উপর যেরূপ নির্ভরশীল, অন্যান্য জীবের মধ্যে সেরূপ নির্ভরশীলতার প্রয়োজন হয় না। মানুষকে মানুষ হয়ে ওঠার জন্য প্রকৃত শিক্ষা অর্জন আবশ্যক। কেউ কোনো নির্দিষ্ট একটি বিষয়ে দক্ষ হলে কিংবা উচ্চশিক্ষার পাঠ গ্রহণ করলেই কি তাকে শিক্ষিত বলা যায়? হ্যাঁ বলা যায়, যদি বস্তুগত শিক্ষার পাশাপাশি তার মধ্যে মানুষ হিসেবে মানবিক ও চারিত্রিক গুণ-বৈশিষ্ট্য উপস্থিত থাকে। জ্ঞান, দক্ষতা, বিশ্বাস, ব্যবহার, আচরণ, অভ্যাস, চারিত্রিক সৌন্দর্য অর্জনের বিকাশমূলক প্রক্রিয়া হল শিক্ষা। এটি একটি জীবনব্যাপী ক্রমবিকাশ প্রক্রিয়া। ব্যক্তির জন্মগত সামর্থ্য, অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা ও স্বতঃস্ফূর্ত চিন্তাশক্তির ক্রমবিকাশ, মানবিক আচরণ ও মূল্যবোধের বিকাশ, উদারনৈতিক মনোভাব গঠনের মাধ্যমে নিজের ও সমাজের জন্য ইতিবাচক, কল্যাণকর ও প্রত্যাশিত পরিবর্তন আনতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে শিক্ষা। শিক্ষার ইংরেজি Education শব্দটি ল্যাটিন Educere কিংবা Educare থেকে উদ্ভূত। ইংরেজি অর্থ দাঁড়ায় to lead out hidden treasure or to bring up অর্থাৎ ব্যক্তির মধ্যে বিদ্যমান সুপ্ত প্রতিভাগুলোকে আবিষ্কার করা, পরিচর্যা করা,লালন করা অথবা to train (প্রশিক্ষিত করা) এবং to accustom (অভ্যস্ত করা)। জন মিল্টন-এর ভাষায়- Education is the harmonies development of mind, body and soul. সক্রেটিস বলেছেন, ‘নিজকে জানার নামই শিক্ষা’। আল্লামা ইকবাল বলেছেন, ‘মানুষের আত্মা বা রূহকে পরিচর্যার মাধ্যমে উন্নত করাই প্রকৃত শিক্ষা।’ জার্মান দার্শনিক জন ফ্রেডারিক হার্বার্ট বলেছেন, “মানুষের নৈতিক চরিত্রের বিকাশ সাধনই শিক্ষা”।

শিক্ষা : ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের দেশে ইসলামী রাষ্ট্র কথাটি যেরূপ কুয়াশাচ্ছন্ন, ‘ইসলামী শিক্ষা’ কথাটিও তেমনি অস্পষ্টতার অন্ধকারে নিমজ্জিত। জ্ঞানার্জন করা আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ। ইসলামে শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো আদম সন্তানকে মানুষরূপে গড়ে তোলা। যে শিক্ষা আত্মপরিচয় দান করে, মানুষকে সৎ ও সুনাগরিক হিসেবে গঠন করে এবং পরোপকারী, কল্যাণকামী ও আল্লাহর প্রতি অনুগত হতে সাহায্য করে, সে শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা। শিক্ষা মানুষের অন্তরকে আলোকিত করে, অন্তর্দৃষ্টি উন্মোচিত করে, দূরদর্শিতা সৃষ্টি করে। মূলত শিক্ষা হলো আত্মজ্ঞান বা আত্মোপলব্ধি। এ জন্য আল্লাহ মানুষকে দুই শ্রেণীতে ভাগ করেছেন। একদল চক্ষুষ্মান/জ্ঞানবান, অন্যদল অন্ধ/জ্ঞানহীন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারা কি পৃথিবীর বুকে বিচরণ করেনি, যাতে তারা উপলব্ধিসম্পন্ন হৃদয় ও শ্রবণকারী কানের অধিকারী হতে পারতো! আসল ব্যাপার হচ্ছে চোখ তো অন্ধ হয় না, বরং অন্ধ হয় তাদের হৃদয়, যা বুকের মধ্যে আছে।’ (সূরা হজ : ৪৬) এভাবে কুরআন মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে মানুষ যেন চিন্তাভাবনা করে, শোনে, মনোযোগ দেয়, তুলনা করে বা পরিমাপ করে, ভাবে, বুদ্ধি ও বিবেকের চর্চা করে, বিচার বিবেচনা করে সর্বোপরি মেধাকে যেন কাজে লাগায়। পাশাপাশি যারা চিন্তাশক্তি, মেধা ও মননকে কাজে লাগায় না তাদের তিরস্কার করা হয়েছে। وَ لَقَدۡ ذَرَاۡنَا لِجَهَنَّمَ کَثِیۡرًا مِّنَ الۡجِنِّ وَ الۡاِنۡسِ ۫ۖ لَهُمۡ قُلُوۡبٌ لَّا یَفۡقَهُوۡنَ بِهَا ۫ وَ لَهُمۡ اَعۡیُنٌ لَّا یُبۡصِرُوۡنَ بِهَا ۫ وَ لَهُمۡ اٰذَانٌ لَّا یَسۡمَعُوۡنَ بِهَا ؕ اُولٰٓئِکَ کَالۡاَنۡعَامِ بَلۡ هُمۡ اَضَلُّ ؕ اُولٰٓئِکَ هُمُ الۡغٰفِلُوۡنَ তাদের হৃদয় আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা উপলব্ধি করে না, তাদের চোখ আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা দেখে না এবং তাদের কান আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা শোনে না। এরা পশুর মত; বরং তাদের চাইতেও অধম! তারা চরম গাফিলতির মধ্যে হারিয়ে গেছে। (সূরা আরাফ : ১৭৯) মানুষের জন্য জ্ঞানের মূল উৎস হচ্ছে ওহী। ফেরেশতারা বলেছিলেন, ‘হে আল্লাহ,আপনি পবিত্র! আপনি যা শিখিয়েছেন, তা ছাড়া আমাদের আর কোনো জ্ঞান নেই; নিশ্চয়ই আপনি মহাজ্ঞানী ও কৌশলী। (সূরা বাকারা : ৩২)

আল্লাহ তায়ালা কুরআনের জ্ঞান প্রদানের জন্যই মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। (সূরা রহমান : ১-৪) ওহির প্রথম কথা ছিল, ‘পড়ো, তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন, মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাটবাঁধা রক্তপিন্ড থেকে। পড়ো, তোমার প্রতিপালক মহিমান্বিত, যিনি শিক্ষাদান করেছেন লেখনীর মাধ্যমে। শিখিয়েছেন মানুষকে, যা সে জানতো না।’ (সূরা আলাক : ১-৫) وَ مَاۤ اٰتٰىکُمُ الرَّسُوۡلُ فَخُذُوۡهُ ٭ وَ مَا نَهٰىکُمۡ عَنۡهُ فَانۡتَهُوۡا ۚ ‘রাসূল যা নিয়ে এসেছেন তা তোমরা গ্রহণ করো এবং যা কিছু নিষেধ করেছেন তা বর্জন করো।‘ (সূরা হাশর : ৭)

রাসূলুল্লাহ সা.কে স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন শিক্ষাদান করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমার রব আমাকে আমাকে তালিম দিয়েছেন, তা কতই না উত্তম শিক্ষা। আমার রব আমাকে তারবিয়্যত করেছেন তা কতই না শ্রেষ্ঠ প্রশিক্ষণ।’ (মুসনাদে আহমাদ) ইসলামের দৃষ্টিতে চিরন্তন ও শাশ্বত নৈতিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে সত্য-মিথ্যা, ভালোমন্দ নির্ধারণের ক্ষমতা অর্জন, পরিবেশের সঙ্গে মোকাবিলার জন্য বৈজ্ঞানিক কলাকৌশল ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনের সমন্বিত ব্যবস্থাপনার নামই শিক্ষা। নবী-রাসূলের কার‌্যাবলি বর্ণনা করা প্রসঙ্গে মহান রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘তাদের কাজ হলো, মানুষকে কিতাব, হিকমাহ এবং পরিশুদ্ধ হওয়ার শিক্ষাদান করা।’ هُوَ الَّذِیۡ بَعَثَ فِی الۡاُمِّیّٖنَ رَسُوۡلًا مِّنۡهُمۡ یَتۡلُوۡا عَلَیۡهِمۡ اٰیٰتِهٖ وَ یُزَکِّیۡهِمۡ وَ یُعَلِّمُهُمُ الۡکِتٰبَ وَ الۡحِکۡمَۃَ ٭ তিনি মহান স্বত্তা যিনি উম্মীদের মধ্যে তাদেরই একজনকে রাসূল হিসেবে পাঠিয়েছেন, যে তাদেরকে তাঁর আয়াত শোনায়, তাদের জীবনকে সজ্জিত ও সুন্দর করে এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমাহ শিক্ষা দেয়। (সূরা জুমুআ : ২)

শিক্ষাঙ্গন ও শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষাঙ্গন জ্ঞানার্জনের আঙ্গিনা। আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যতীত জ্ঞান পরিপূর্ণ হয় না। ইসলাম তাই পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জনের কথা বলে। আল কুরআন একটি বিজ্ঞানময় গ্রন্থ। ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকেই মুসলমানগণ আল-কুরআনের শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জ্ঞান চর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সা. শিক্ষাক্ষেত্রে এক বিস্ময়কর জাগরণের সৃষ্টি করেন, যার ফলে পরবর্তীকালে মুসলমানরা শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করতে সক্ষম হয়। তিনি সমগ্র দুনিয়ার জন্য সেরা নমুনা উপস্থাপন করেছেন। সাফা মারওয়ার পাদদেশে অবস্থিত ‘দারুল আরকাম’ ছিল মহানবী সা. তাঁর সঙ্গীদের জ্ঞানার্জনের জন্য নির্ধারিত স্থান, মুসলিম উম্মাহর প্রথম শিক্ষালয়। শিক্ষা গ্রহণের জন্য রাসূল সা. কোনো বয়স বা সময়কে সীমাবদ্ধ করেননি। সমগ্র জীবনব্যাপী মানুষ জ্ঞানচর্চায় আত্মনিয়োগ করবে- এটাই মহানবী সা.-এর শিক্ষা। মদিনায় প্রিয়নবী সা. নারীদের শিক্ষাদানের জন্যও একটি সময় নির্দিষ্ট করেন। উম্মাহাতুল মুমিনীনরা ছিলেন নারীদের প্রশিক্ষক। আকাবার দ্বিতীয় বাইয়াতের সময় মদিনার কিছু মানুষ ইসলাম কবুল করলে রাসূল সা. সাহাবী মুসআব ইবনে উমায়ের রা.-কে তাদের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করেন। মদিনায় হিজরতের পর নির্মিত মসজিদে নববীতে রাসূল সা. একটি শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করেন। যা ‘সুফ্ফা’ নামে পরিচিত। নবীজি স্বয়ং ছিলেন এর শিক্ষক এবং সাহাবায়ে কেরামের শিক্ষা প্রদানে তিনি একটা উল্লেখযোগ্য সময় এখানে ব্যয় করতেন। এতে জ্ঞানার্জনে ব্রত সাহাবীদের বলা হয় আসহাবে সুফ্ফা। যারা জ্ঞানার্জনের জন্য ভোগবিলাস ত্যাগ করে অতি সাধারণ জীবনযাপন বেছে নিয়েছিলেন এবং সর্বদা মসজিদে নববীর চত্বরে অবস্থান করতেন। বলা যায়, মসজিদে নববীকে কেন্দ্র করে এটি মুসলমানদের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। আসহাবে সুফ্ফার অন্তর্ভূক্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছিলেন হযরত আবু হুরায়রা রা., হযরত বেলাল রা., হযরত শোয়াইব রা., হযরত আম্মার রা. প্রমুখ। এসকল জ্ঞানপিপাসু সাহবায়ে কেরামগণ প্রত্যেকেই প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা ও অর্থনীতি, হাদিস শাস্ত্র, কেরাত, আধ্যাত্মিক সাধনা, ফিকাহ, সামরিক বিজ্ঞান ইত্যাদি কোনো না কোনো বিষয়ে প্রভূত জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করেন। রাসূল সা. স্বয়ং ছিলেন তাদের শিক্ষাগুরু। তাঁরা রাসূলের সা. নিকট থেকে যে শিক্ষা পেতেন, দূর দূরান্তে গিয়ে মানুষের মাঝে সেই শিক্ষা ছড়িয়ে দিতেন। হযরত আনাস ইবনে মালেক রা. বলেন, ‘রাসূল সা. আহলে সুফ্ফার শিক্ষার্থীদের শিক্ষক ছিলেন। সুফ্ফার শিক্ষার্থীরা অক্ষরজ্ঞান থেকে শুরু করে পবিত্র কুরআন ও জ্ঞানের অন্যান্য শাখায় ব্যুৎপত্তি অর্জনের চেষ্টা করতেন। পাশাপাশি রাসূলুল্লাহ সা.-এর সান্নিধ্যে থেকে তাঁর জীবনের খুঁটিনাটি সকল দিক প্রত্যক্ষ করে তা নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করতেন। পরবর্তী সময়েও দেখা যায়, মুসলমানরা বহুযুগ ধরে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁরা একই সাথে নিষ্ঠাবান মুসলিম ছিলেন আবার জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অগাধ পা-িত্য অর্জন করেন। কুরআনের বিজ্ঞানময়তার কারণে মুসলমানদের শিক্ষা, গবেষণা এবং আবিস্কার খুলে দিয়েছিল আধুনিক সভ্যতার দ্বার। মুসলমানগণই বিভিন্ন ভাষা থেকে বিভিন্ন বিষয়ের মৌলিক বইসমূহ আরবিতে অনুবাদ করে জ্ঞান-ভা-ার সমৃদ্ধ করেছিলেন। মুসলমানদের প্রণীত ও চর্চিত শিক্ষা ব্যবস্থার ইতিহাস প্রকৃত অর্থেই গর্ব করার মত এবং অনুসরণীয়। মধ্যযুগের মুসলিম শিক্ষা ব্যবস্থার প্রকৃত স্বরূপই ছিল Harmonious development of body, mind and soul together. মুসলিম শাসনামলে বাগদাদ, বসরা, কুফা, কর্ডোভা, কায়রো প্রভৃতি স্থান উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়। মুসলমানরা নিজস্ব চিন্তা চেতনার উর্ধ্বে উঠে একটি মানবকল্যাণময় শিক্ষাব্যবস্থা উপহার দিয়েছিল। যা ছিল একই সাথে উদার, প্রগতিশীল, যুগোপযোগী ও বিজ্ঞানমনষ্ক। খলিফা আল মামুন কর্তৃক বাগদাদে বায়তুল হিকমাহ, নিযামুল মূলক্ তুসীর প্রতিষ্ঠিত নিযামীয়া বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিখ্যাত জ্ঞান চর্চাকেন্দ্র। ইউরোপের কর্ডোভা, গ্রানাডা, মালাগা, সেভিল, টলেডো প্রভৃতি শহরে অসংখ্য বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলেছিল মুসলমানদের নেতৃত্বে। এসব প্রতিষ্ঠানে উচ্চতর মানবিক বুদ্ধিবৃত্তিক বৈজ্ঞানিক শিক্ষা গবেষণাকে উৎসাহিত করা হয়। ফলে সকল জ্ঞান পিপাসুদের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছিল। তাফসীর, হাদিস, ফিকাহসহ ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি রাষ্ট্রবিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, প্রকৌশলবিদ্যা, আরবি ভাষা, ব্যাকরণ, অলংকার শাস্ত্র, সাহিত্য, যুক্তিবিদ্যাসহ বিভিন্ন শাস্ত্রের ব্যাপকতর উৎকর্ষ ঘটে, জন্ম নেয় অসংখ্য মুসলিম প-িত, বুদ্ধিজীবি, বিজ্ঞানী। তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মৌলিক অবদান রেখে যান। মুসলমানদের প্রণীত মৌলিক জ্ঞানের চর্চা করেই আজকের অক্সফোর্ড, কেমব্রিজসহ পাশ্চাত্যের উন্নত সভ্যতা তৈরি হয়েছে।

রাসূল সা. হলেন উভয় জগতের জন্য একজন পরিপূর্ণ আদর্শ। তাঁর পাঠদান কৌশলও ছিল অসাধারণ। যা শিক্ষক সমাজের জন্য অনুকরণীয়। উপযুক্ত পরিবেশে শিক্ষাদান, শিক্ষাগ্রহণে মনোযোগ আকর্ষণ, দরদি ও দয়ার্দ্র, কোমলতা প্রদর্শন ও কঠোরতা বর্জন, গুরুত্বপূর্ণ কথার পুনরাবৃত্তি, থেমে থেমে পাঠদান, ভাষা ও দেহভাষার সমন্বয়, গল্প বলার মিষ্টি ভঙ্গি, শিক্ষার্থীর নিকট প্রশ্ন করা, বিষয়বস্তুর গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করা, আগ্রহী শিক্ষার্থী নির্বাচন, উপমা দিয়ে বোঝানো, প্রশ্ন গ্রহণ এবং প্রশ্নের জন্য প্রশংসা করা, ভালো কাজের জন্য পুরস্কার দেয়া, নিজের ব্যবহারিক চরিত্র ও আমলের মাধ্যমে শিক্ষাদান, বিবেকের মুখোমুখি করা, বার বার পাঠে উদ্বুদ্ধকরণ, আশা ও ভয়ের মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি, মুক্ত আলোচনা ও মতবিনিময়ের মাধ্যমে শিক্ষাদান, গুরুত্বপূর্ণ কথার পুনরাবৃত্তি, ভুল সংশোধনের মাধ্যমে শিক্ষাদান, শাস্তিদানের মাধ্যমে সংশোধন, অজানা বিষয়ে উত্তর না দেয়া, ইত্যাদি ছিলো তাঁর শিক্ষাদানের কৌশল।

আমাদের দেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা আজকে বহুধা বিভক্ত। সাধারণ শিক্ষা, মাদ্রাসা শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা ইত্যাদি। কোনটিকে পরিপূর্ণ বলা যায়? পরিতাপের বিষয় হলো স্বাধীনতার ৫ দশক পূর্ণ হলেও এখনো একটা টেকসই পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। যা একটি ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত জাতি গঠনের অন্তরায়। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় লেখাপড়া করে আমাদের তরুণরা বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। যদিও মাঝে মাঝে কিছু ব্যতিক্রম দেখা যায়। শিক্ষাব্যবস্থার সর্বস্তরে টেকসই ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা দরকার। শক্তিশালী জাতি গঠনের স্বার্থে যে কোনো মূল্যে শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণ মুক্ত রাখা প্রয়োজন। রাজনৈতিক দৈন্যতা আজকে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে সর্বোতভাবে গ্রাস করতে উদ্ধত। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্র রাজনৈতিক দস্যুতা ও অনৈতিকতার বলয়ে আবদ্ধ। বুয়েটে আবরার, চমেকে মেহেদীর রক্তাক্ত শরীর তা-ই প্রমাণ করে। সেষ্ণুরিয়ান মানিকদের সদম্ভ পদচারণা যত্রতত্র দৃশ্যমান। ফলে শিক্ষাঙ্গনে নারীর নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন। কর্মমুখী শিক্ষার অভাবে আমাদের শিক্ষার্থীরা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তুলনামূলক কিছুটা মেধাবী তরুণরা সুযোগ পেলেই দেশের বাহিরে চলে যাওয়ার উপায় খুঁজে নিচ্ছে। এ অবস্থা থেকে অবশ্যই উত্তরণ ঘটাতে হবে। এজন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সততা গুরুত্বপূর্ণ।

নৈতিকতা নৈতিকতার অবক্ষয় আমাদের তরুণ প্রজন্মকে তিলে তিলে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। নৈতিকতা বিবর্জিত শিক্ষা আর যাই হোক সত্যিকার মানবিক গুণ সম্পন্ন মানুষ তৈরী করতে পারে না। অথচ আমরা দেখতে পাই, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় শিক্ষা প্রায় বিসর্জিত বলা চলে। কুরআন ও হাদিসের আনুষ্ঠানিক শিক্ষার পথগুলো বন্ধ কিংবা অনেকটাই সঙ্কুচিত করে ফেলা হয়েছে। ফলে তরুণদের উল্লেখযোগ্য অংশ গড্ডালিকার স্রােতে হারিয়ে ফেলছে নিজেকে। দেশপ্রেম, নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ, মানবিকতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা ছাড়া কিভাবে আমাদের তরুণ প্রজন্ম আগামী নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত হবে? বরেণ্য শিক্ষাবিদ ড. সৈয়দ আলী আশরাফ বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবেই ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা পেশাগত শিল্পভিত্তিক প্রজন্ম ও যুবক তৈরি করে, যারা নিজ নিজ পেশায় দক্ষ হয়ে গড়ে ওঠে; কিন্তু তারা নৈতিকতার দিক থেকে সবচেয়ে পাপাচারী বা দুরাচার হলেও তাতে কোনো অসুবিধা নেই।’ কুরআন অন্যান্য জীবের সাথে মানুষের যে ব্যবধান নির্দেশ করে তা এই যে, ‘মানুষ নৈতিক জীব’ আর অন্যান্য জীব নৈতিকতার বন্ধন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। ভালো ও মন্দ, সৎ ও অসৎ, সত্য ও মিথ্যার বিচার করার ক্ষমতা মানুষ ছাড়া আর কোনো জীবের মধ্যে দেখা যায় না। নৈতিকতার অবনতির ফলে যখন কেউ মিথ্যা বলে তখন সে পশুর চেয়েও অধম হয়ে পড়ে। কেননা পশু মিথ্যা বলতে পারে না। তাই বস্তুগত শক্তির সঠিক ব্যবহার নৈতিকতার উপরই নির্ভরশীল। একটি ছুরি নৈতিকতা সম্পন্ন ব্যক্তির হাতে ব্যবহৃত হলে তা মানুষের উপকারই করবে। কিন্তু নৈতিকতার অভাব হলে এ ছুরিই তাকে ডাকাতে পরিণত করবে। নৈতিকতা বিহীন আধুনিক পরাশক্তিগুলো বিপুল বস্তুগতশক্তির অধিকারী হয়েছে বলেই মানব জাতি আজ এতো বড় সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। কেননা এসব শক্তি নৈতিকতায় ভূষিত মানুষের হাতে ব্যবহৃত হচ্ছে না। তাইতো কুরআন হাত, পা, চোখ-কান সর্বস্ব শরীরটিকে প্রকৃত মানুষ মনে করে না। কুরআনের পরিভাষায় মানুষের ভেতর ‘রূহ’ বা আত্মাই নৈতিকতার আধার। রূহকে উন্নত করার ব্যবস্থা না করলে এ শরীর পশুর ন্যায় আচরণ করবে। গৃহপালিত পশু রশি ছিঁড়ে নিজেরই দয়ালু মনিবের সাজানো বাগান খেতে একটুও দ্বিধাবোধ করে না। নৈতিকতার বন্ধন ছিঁড়তে পারলে মানবদেহও তেমনি একটি পশুতে পরিণত হয়। মহানবী সা. তাই নৈতিকিতাসম্পন্ন মানুষকে এমন এক ঘোড়ার সাথে তুলনা করেছেন, যা রজ্জু দ্বারা এক খুঁটির সাথে আবদ্ধ। এ ঘোড়াটি যেমন স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে পারে না তেমনি মানুষ স্বাধীনতাও নৈতিকতার রজ্জু দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাই কেবল রজ্জুর সীমা পর্যন্তই সে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে সক্ষম। দক্ষ মানব শক্তির সঙ্গে নৈতিকতাবোধ সম্পন্ন একটি প্রজন্মই পারে বিকৃত মানবিকতা ও সামাজিক অপরাধের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিষেধক ও প্রতিরোধ হতে। পৃথিবীকে উন্নত সভ্যতা শিখিয়েছে মুসলিমরা। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সচেতন মুসলমানদের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে তরুণদের তথা ছাত্রসমাজকে অগ্রণী ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসতে হবে। প্রচলিত অপসংস্কৃতির বিভীষিকায় হতাশ কিংবা হারিয়ে যাওয়া নয় বরং উন্নত নৈতিকতার উপর দৃঢ় থাকার মতো সাহস ও মনোবল নিজের মধ্যে সঞ্চয় করতে হবে। সকল আরাম-আয়েশ, বিলাসিতা বিসর্জন দিয়ে তরুণ সমাজকে আসহাবে সুফ্ফার ন্যায় প্রকৃত জ্ঞান সাধনায় নিবেদিতপ্রাণ হতে হবে। হযরত ফাদ্বালাহ ইবনে উবাইদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. যখন লোকদের নামাজ পড়াতেন, তখন কিছু লোক ক্ষুধার কারণে (দুর্বলতায়) পড়ে যেতেন, আর তাঁরা ছিলেন আসহাবে সুফ্ফাহ। এমনকি মরুবাসী বেদুঈনরা বলত, এরা পাগল।’ একদিন রাসূলুল্লাহ সা. নামাজ শেষে তাদের দিকে মুখ ফিরালেন। তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, তোমাদের জন্য আল্লাহর কাছে যা রয়েছে, তা যদি তোমরা জানতে, তাহলে তোমরা এর চাইতেও অভাব ও দারিদ্র্য পছন্দ করতে।’ (তিরমিজি-২৩৬৮, মুসনাদে আহমদ-২৩৪২০)

আমাদের তরুণ প্রজন্মকে তারুণ্যের সেই চেতনায় উজ্জীবিত হতে হবে যেই চেতনা ধারণের ফলে একদল মর্দে মুজাহিদের তাকবির ধ্বনি সভ্যতার গতিপথ পাল্টে দিয়েছিল, পদানত করেছিল অর্ধ জাহান। যারা এক আল্লাহ ছাড়া দুনিয়ার আর কোনো শক্তির কাছে কোনোকিছুর বিনিময়েই কখনো মাথা নত করে নাই। তাই যৌবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়কে নবীজি সা. গণিমত হিসাবে উল্লেখ করে তা যথাযথ কাজে লাগাতে তাগিদ দিয়েছেন। তিনি বলেন, اِغْتَنِمْ خَمْسًا قَبْلَ خَمْسٍ : شَبَابَكَ قَبْلَ هَرَمِكَ، وَصِحَّتَكَ قَبْلَ سَقَمِكَ، وَغِنَاكَ قَبْلَ فَقْرِكَ، وَفَرَاغَكَ قَبْلَ شُغْلِكَ، وَحَيَاتَكَ قَبْلَ مَوْتِكَ ‘তোমরা পাঁচটি জিনিসের পূর্বে পাঁচটি জিনিসকে গণিমত মনে কর। (১) তোমার বার্ধক্য আসার পূর্বে যৌবনকে (২) অসুস্থ হওয়ার পূর্বে সুস্থতাকে (৩) দারিদ্রতার পূর্বে স্বচ্ছলতাকে (৪) ব্যস্ততার পূর্বে অবসরকে এবং (৫) মৃত্যুর পূর্বে জীবনকে’। (তিরমিজি, মিশকাত হা/৫১৭৪) যুবক বয়সে বেশি বেশি আমল ও ইবাদত করা জরুরী। রাসূল সা. বলেছেন, ‘যেদিন আরশের ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না, সেদিন সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর আরশের ছায়ায় আশ্রয় দেবেন। তন্মধ্যে দ্বিতীয় শ্রেণির ব্যক্তি হচ্ছে, ঐ যুবক যে তার যৌবনকালটা আল্লাহর ইবাদতে ব্যয় করেছে।’ (বুখারি ১/২৩৪)। অপর হাদিসে এসেছে, ‘(প্রকৃত) বলবান সে নয়, যে কুস্তিতে (অপরকে পরাজিত করে)। প্রকৃত শক্তিশালী তো সেই ব্যক্তি, যে নিজের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে।’ (বুখারি ৫/২২৬৭)। জ্ঞান মানুষের মধ্যে আল্লাহভীতি সৃষ্টি করে, আর আল্লাহভীতিই পারে মানুষকে যাবতীয় পাপাচার-অনাচার থেকে বিরত রাখতে। আল্লাহ বলেন, ﴿ وَمِنَ ٱلنَّاسِ وَٱلدَّوَآبِّ وَٱلۡأَنۡعَٰمِ مُخۡتَلِفٌ أَلۡوَٰنُهُۥ كَذَٰلِكَۗ إِنَّمَا يَخۡشَى ٱللَّهَ مِنۡ عِبَادِهِ ٱلۡعُلَمَٰٓؤُاْۗ إِنَّ ٱللَّهَ عَزِيزٌ غَفُورٌ ٢٨ ﴾ [فاطر: ٢٨] ‘আর এমনিভাবে মানুষ, বিচরণশীল প্রাণী ও চতুষ্পদ জন্তুর মধ্যেও রয়েছে নানা বর্ণ। বান্দাদের মধ্যে কেবল জ্ঞানীরাই আল্লাহকে ভয় করে। নিশ্চয় আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, পরম ক্ষমাশীল।’ (সূরা ফাতির : ২৮) আমাদের তরুণ-যুবক সমাজের কাছে তাই উদারচিত্তে আহবান জানাই, আসুন নিয়মিত কুরআন ও হাদিস অধ্যয়ন করি, কুরআন বুঝার চেষ্টা করি, আমাদের একমাত্র ¯্রষ্টা মহান রাব্বুল আলামিনকে জানি। নিজেকে একজন সচেতন, নিষ্ঠাবান, দায়িত্বশীল সাচ্চা ঈমানদার যুবক হিসেবে গড়ে তুলি। রাসূল সা.কে অনুসরণের মাধ্যমে নিজেকে আল্লাহর প্রিয়পাত্র হওয়ার সুযোগ তৈরি করি। সমসাময়িক জ্ঞানার্জনে অগ্রগামী হওয়ার মাধ্যমে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার প্রত্যয়ে আমৃত্যু নিজকে অবিচল রাখি। আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেককে তাওফিক দিন। লেখক : বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির