জালাল উদ্দিন ওমর
২০১৩ সালের ৩ জুলাই মিসরের সামরিক বাহিনী সে দেশের প্রথম নির্বার্চিত প্রেসিডেন্ট ড: মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে এবং দেশের সাংবিধানিক আদালতের প্রধান বিচারপতি আদিল মনসুর দেশের অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান হিসাবে শপথ নিয়েছেন। ক্ষমতা গ্রহণের এক বছর পূর্তিতে মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো মুরসির পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনের ডাক দেয় এবং এর অংশ হিসেবে ৩০ জুন বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে প্রেসিডেন্ট মুরসিকে পদত্যাগের আহ্বান জানায়। মিসরের যখন সরকার এবং বিরোধী দল মুখোমুখি অবস্থান নেয়, তখন সেনাবাহিনী এই সমস্যা সমাধানের জন্য ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম ঘোষণা করে। প্রেসিডেন্ট মুরসি বিরোধী দলের দাবি এবং সেনাবাহিনীর এই আলটিমেটাম প্রত্যাখ্যান করে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পদত্যাগে অস্বীকৃতি জানায় এবং গণতন্ত্র রক্ষায় প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গ করার কথা ঘোষণা করেন। অবশেষে ৪৮ ঘণ্টা শেষে সেনাপ্রধান জেনারেল আবদুল ফাত্তাহ সিসির নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনী দেশের প্রেসিডেন্ট মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার কথা ঘোষণা করেন। জেনারেল সিসি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। তিনি পার্লামেন্ট এবং সংবিধান বাতিল করেন। প্রেসিডেন্ট মুরসিসহ তার সহযোগীদের আটক করা হয়। সেনাবাহিনী ব্রাদারহুডের সকল শীর্ষনেতাদের গ্রেফতার করেছে এবং তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ এনে তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করেছে। সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে এবং ড. মরসিকে স্বপদে পুনর্বহালের দাবিতে জনগণ আন্দোলন শুরু করে। সেই আন্দোলনকে দমন করতে সেনাবাহিনী নির্মম হত্যাকা- চালায়। ১৪ আগস্ট সংঘটিত সেনাবাহিনীর এই হামলায় সরকারি হিসাবেই নিহতের সংখ্যা পাঁচশতের বেশি। আর মুসলিম ব্রাদারহুডের দাবি মতে নিহত হয়েছে দুই হাজারেরও বেশি মানুষ। এর আগেও সেনাবাহিনীর হামলায় বিভিন্ন সময়ে কয়েক শত মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। সেনাবাহিনীর এই নির্যাতন এখনো অব্যাহত আছে। সেনাবাহিনীর এসব হামলায় নিহত হয়েছে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনরত নিরস্ত্র মানুষ, যেখানে আছে নারী-পুরুষ শিশুসহ আবালবৃদ্ধবনিতা। সেনা কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যেই ব্রাদারহুডের সব টিভি চ্যানেল এবং পত্রিকাসমূহ বন্ধ করে দিয়েছে। সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন আদালত আবারো ব্রাদারহুডকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। ক্ষমতা গ্রহণ করার পর সেনাবাহিনী মুসলিম ব্রাদারহুডের ওপর চরম দমন নিপীড়ন শুরু করে যা এখনো অব্যাহত আছে। এভাবে মিসরের সেনাবাহিনী দেশটির ৬০ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করল, জনগণের নির্বাচিত পার্লামেন্টকে বাতিল করল এবং জনগণের ভোটে অনুমোদিত সংবিধানকেও বাতিল করল। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের প্রবক্তা বলে দাবিদার যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপসহ পুরো পশ্চিমা বিশ্বই আজ এই বিষয়ে নীরব। অধিকন্তু এসব দেশ উল্টো এই সেনা-অভ্যুত্থানকে সমর্থন দিচ্ছে। মুখে অন্য কথা বললেও, মিসরের রাজনীতিতে ইসলামপন্থীদের ক্ষমতারোহণকে প্রতিহত করাই যে এই সেনা অভ্যুত্থানের প্রধান কারণ সে বিষয়ে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। কিন্তু সেনা অভ্যুত্থানে জড়িত এবং তাদের সহযোগী ও সমর্থকদের জানা উচিত, ষড়যন্ত্র এবং নির্যাতন করে ইসলামের পুনর্জাগরণকে প্রতিহত করা যাবে না। বন্দুকের মুখে ষড়যন্ত্র করে গায়ের জোরে ইসলামপন্থীদের অগ্রযাত্রাকে সাময়িক বাধাগ্রস্ত করা যাবে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এই ইসলামপন্থীরাই বিজয়ের মুকুট পরবে। তাই মিসরে সেনাবাহিনীর এ্ই অগণতান্ত্রিক আচরণ সময়ের ব্যবধানে তাদের জন্য বুমেরাং হবে আর ইসলামপন্থীদের জন্য আশীর্বাদই হবে। কারণ অন্যায় কাজ কখনো কারো জন্য সুফল বয়ে আনে না। ইসলামপন্থী জনতার রক্তে মিসরের রাজপথ আজ রক্তাক্ত। প্রায় প্রতিদিনই ইসলামপন্থী জনতার রক্তে মিসরের রাজপথ রঞ্জিত হচ্ছে। ওদের অপরাধ ওরা গণতন্ত্রের কথা বলেছে। ওদের অপরাধ ওরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড. মুরসিকে অগণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতাচ্যুত করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। ওদের অপরাধ ওরা স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে রাজপথে কথা বলেছে। কিন্তু মিসরের ইসলামপন্থী জনতার বড়ই দুর্ভাগ্য, গণতন্ত্রের জন্য জীবন দিলেও ওরা আজ বিশ্বের হর্তাকর্তাদের কাছে উপেক্ষিত। নির্যাতিত নিপীড়িত অধিকার হারা এসব মানুষের পক্ষে আজ কেউ কথা বলছে না। দুঃখজনক হলেও সত্য, সেনাবাহিনী মিসরের গণতন্ত্রকে হত্যা করলেও এবং গণতন্ত্রকামী মানুষগুলোকে নির্মমভাবে হত্যা করলেও, বিশ্ব বিবেক আজ নীরব। গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের প্রবক্তা বলে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ সবাই আজ নীরব। জাতিসংঘ, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন, ওআইসি এবং আরব লিগসহ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো সবই নীরব। একইভাবে মানবাধিকার সংগঠনগুলোও আজ নীরব। অধিকন্তু এরাই আজ সেনাবাহিনীকে ক্ষমতায় এনেছে এবং সেনাবাহিনীর অগণতান্ত্রিক কাজসমূহকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। আর ওদের নীরব সমর্থনের কারণেই সেনাবাহিনী এসব অন্যায় কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য মিসরের ইসলামপন্থী জনতার এই আত্মত্যাগ কখনো বৃথা যাবে না। তাদের রক্তে মিসরের জমিন ইসলামের জন্য আরো উর্বর হবে। ইসলামী পুনর্জাগরণ আন্দোলন হবে বেগবান এবং শক্তিশালী। গণতন্ত্রের জন্য, সত্য ও ন্যায়ের জন্য এবং সর্বোপরি ইসলামী অনুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য হাসিমুখে জীবন উৎসর্গকারী এই আবালবৃদ্ধবনিতার রক্তের বিনিময়ে মিসরসহ সারা বিশ্বজুড়েই ইসলামের বিজয় পতাকা উড়বেই ইনশাআল্লাহ। আর সময়ের ব্যবধানে এই হত্যাকা-ের হোতারা ইতিহাসের আঁস্তাকুড়েই নিক্ষিপ্ত হবে। তাদের জন্য অপেক্ষা করছে করুণ পরিণতি এবং বেদনাদায়ক শাস্তি, যা তাদেরকে ভোগ করতেই হবে। কারণ ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। ইসলামপন্থীদের ওপর নির্যাতন ইসলামের পুনর্জাগরণকে যেমন ত্বরান্বিত করবে, ঠিক তেমনি এই দমন নির্যাতনের প্রতি সমর্থনও নীরবতা পশ্চিমাদের পতনকেও ত্বরান্বিত করবে। জনতার ভোটে বিজয়ী হয়ে ২০১২ সালের ৩০ জুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন মুসলিম ব্রাদারহুড নেতা ড. মোহাম্মদ মুরসি। আর ২০১৩ সালে ৩ জুলাই সেনাবাহিনী কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত হলেন তিনি। মাত্র ১ বছর ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। একজন শাসকের কর্মকা-কে মূল্যায়নের জন্য একটি বছর কোনোভাবেই যথেষ্ট নয়। একটি বছরের সফলতাকে যেমন মানদ- হিসেবে গণ্য করা যায় না, ঠিক একটি বছরের ব্যর্থতাকেও মানদ- হিসেবে গণ্য করা যায় না। অথচ দেশ শাসনে ব্যর্থতার অভিযোগ এনে তাকে এক বছরের মাথায় ক্ষমতাচ্যুত করা হলো। মূলতপক্ষে মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পেছনে অন্য একটি উদ্দেশ্য রয়েছে। তা হচ্ছে মিসরের ক্ষমতা থেকে ইসলামপন্থীদেরকে উৎখাত করা। জনতার আন্দোলনের মুখে পশ্চিমাদের মিত্র হোসনি মোবারকের পতন এবং ইসলামপন্থীদের উত্থান পশ্চিমা বিশ্ব কখনোই মেনে নিতে পারেনি। মিসরের রাজনীতিতে ইসলামপন্থীদের ক্ষমতায় আরোহণ ইসরাইল কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। তা ছাড়া মিসরের ক্ষমতায় ইসলামপন্থী অবস্থান সারা বিশ্বজুড়ে ইসলামপন্থীদেরকে অনুপ্রাণিত এবং শক্তিশালী করছিল। ফলে শুরু থেকেই মিসরের ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিসমূহ ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে। সংসদ নির্বাচনের পরপরই মিসরের সাংবিধানিক আদালত ২০১২ সালের ১৪ জুন মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতৃত্বাধীন সংসদকে অবৈধ ঘোষণা করে। সে সময় সামরিক কর্তৃপক্ষ আদালতের রায়ের সূত্র ধরে নির্বাচিত সংসদ বাতিল করে দেয় এবং নিজেদের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য নতুন নতুন ডিক্রি জারি করে। এ অবস্থায় জনগণ আবারো রাস্তায় নেমে আসে এবং ২০১২ সালের ২৪ জুন নির্বাচন কমিশনার ড. মুরসিকে প্রেসিডেন্ট পদে বিজয়ী ঘোষণা করে। মিসরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইসলামপন্থীদের এই বিজয় ছিল বিশ্বরাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ইসলামপন্থীদের এই বিজয়ে সারা বিশ্বের অনুন্নত এবং নিপীড়িত মুসলমানরা অনুপ্রাণিত হয় আর পশ্চিমাবিশ্ব এবং ইসরাইলকে আশাহত করে। ফলে মিসরের ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠী এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক পশ্চিমাবিশ্ব মিসরের ক্ষমতায় ইসলামপন্থীদের অবস্থান মেনে নিতে পারেনি। তারা শুরু থেকেই মুরসি এবং তার দল ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে। মিসর একটি ঐতিহ্যবাহী মুসলিম দেশ। কয়েক হাজার বছরের ঐতিহ্যে এই দেশ সমৃদ্ধ। এক কথায় অতি প্রাচীন সভ্যতার দেশ। পিরামিডের ইতিহাস মিসরকে সারা বিশ্বজুড়েই আলাদা পরিচিতি দিয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বিশ্বরাজনীতিতে মিসর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া মিসর মধ্যপ্রাচ্যের অত্যন্ত প্রভাবশালী দেশ। এই ভূখ-ে কয়েক শত নবী রসূলের আবির্ভাব হয়েছিল। কিন্তু মুসলিম ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এই মিসর দীর্ঘদিন থেকেই ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি দ্বারা শাসিত হয়েছে। যারা সবসময় ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থকে বিসর্জন দিয়েছে এবং পশ্চিমাদের স্বার্থকে প্রতিষ্ঠা করেছে। এই মিসরই সর্বপ্রথম মুসলিম দেশ, যে মুসলমানদের জাতশত্রু ইসরাইলকে ১৯৭৮ সালে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং তার সাথে শান্তি চুক্তি করেছে। কিন্তু মিসরের ইসলামপ্রিয় জনতা তা কখনো মেনে নেয়নি। আর তাই জনগণের ইচ্ছাকে ধ্বংস করার জন্য মিসরের ক্ষমতা নিয়ে সবসময় ষড়যন্ত্র হয়েছে। দেশটি ১৯৫২ সালে স্বাধীনতা অর্জন করে এবং তখন থেকেই সামরিক বাহিনীর ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিরা মিসরের ক্ষমতায় ছিল আর এদেরকে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমাবিশ্ব সরাসরি সমর্থন এবং সহযোগিতা করেছে। স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই বাদশাহ ফারুক সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন। পরবর্তীতে মিসর শাসনকারী মোহাম্মদ নাজিব, জামাল আবদুল নাসের, আনোয়ার সাদাত এবং হোসনি মোবারকরা সবাই ছিল সামরিক বাহিনীর লোক। হোসনি মোবারক গণ-আন্দোলনের মুখে ২০১১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পদত্যাগ করেন। পরবর্তী পরিস্থিতিতে মুসলিম ব্রাদারহুড ক্ষমতায় আসে। কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায় এলেও ইসলামপন্থীদের মেনে নিতে পশ্চিমাবিশ্ব বরাবরই নারাজ। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। ইসলামপন্থীদের উৎখাত করার জন্য গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছে। আর পশ্চিমাবিশ্ব গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের শ্লোগান দিলেও, এসব শ্লোগানের কোন প্রয়োগ এবং কার্যকারিতা আজ মিসরের বেলায় নেই। মূলতপক্ষে মুসলমানদের বেলায় পশ্চিমাদের নীতি বরাবরই দ্বিমুখী এবং এক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা সম্পূর্ণ উল্টো। ১৯৯১ সালে আলজেরিয়ার নির্বাচনে ইসলামপন্থীরা বিজয়ী হলেও, তাদেরকে ক্ষমতায় আসতে দেয়া হয়নি। বরং চালানো হয়েছে নির্মম নির্যাতন, যেই নির্যাতনে আলজেরিয়ায় দুই লক্ষ ইসলামপন্থী জনতাকে হত্যা করা হয়েছে। ২০০৬ সালে ফিলিস্তিনের নির্বাচনে হামাস বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় এলেও পশ্চিমারা তাদেরকে স্বাগত জানায়নি বরং তাদেরকে সাহায্য বন্ধ করে দিয়েছে এবং ক্ষমতাচ্যুত করেছে। মুসলিম দেশগুলোতে বছরের পর বছর ধরে ক্ষমতাসীন স্বৈরশাসকদেরকে এই পশ্চিমারাই ক্ষমতায় বসিয়েছে এবং সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে টিকিয়ে রেখেছে। কিন্তু পশ্চিমাদের এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে আজ সারাবিশ্বজুড়েই জনগণ জেগে উঠছে। সেনাবাহিনী কর্র্তৃক মিসরের নির্বাচিত ইসলামপন্থী প্রেসিডেন্ট মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করা এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের ওপর দমন নির্যাতনে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে জনগণ আরো ক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে। মিসরের জনগণ ইসলামপন্থীদের প্রতি আরো বেশি সহানুভূতিশীল হবে এবং সময়ের ব্যবধানে ইসলামপন্থীরা আরো বেশি জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করবে। কারণ মানুষকে জোর করে যেমন কোনো মূল্যবোধ গ্রহণ করানো যায় না, ঠিক তেমনি জোর করে তাকে তার ঐতিহ্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখাও যায় না। আর যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমাবিশ্ব গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ইসলামপন্থীদেরকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ না করায় তা পশ্চিমাদের জন্য আরো বেশি বিপর্যয় নিয়ে আসবে। কারণ নদীর পানি প্রবাহকে স্বাভাবিক গতিতে প্রবাহিত হতে দেয়াটাই ভালো এবং কল্যাণকর। স্বাভাবিক গতি প্রবাহে যে কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা নদীর প্রবাহকে সাময়িকভাবে বন্ধ রাখে মাত্র, কিন্তু পরবর্তীতে সেই নদীর প্রবাহ শুধু প্রতিবন্ধকতাকেই উৎখাত করে না বরং পুরো জনপদকেই ডুবিয়ে ধ্বংস করে। সুতরাং মিসরের সেনাবাহিনীর অগণতান্ত্রিক আচরণ এবং তার প্রতি সেখানকার ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠী সমূহের সমর্থন, একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের দ্বিমুখী নীতি মিসরের ইসলামপন্থীদেরকে আরো বেশি শক্তিশালী করবে। সেনাবাহিনী, মিসরের ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি এবং তাদের অব্যাহত সমর্থক ও পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাবিশ্ব যদি মনে করে থাকে মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে দমন নির্যাতন চালিয়ে ইসলামের পুনর্জাগরণকে নির্মূল করা যাবে, তাহলে আমি বলব তারা ভুলের মধ্যে আছে। কারণ অন্যায় এবং অগণতান্ত্রিক আচরণ কখনো কারো জন্য সুফল বয়ে আনে না। ইতিহাস তার সাক্ষী। আর মুসলিম ব্রাদারহুড বছরের পর বছর ধরে দমন নির্যাতন মোকাবেলা করেই টিকে আছে এবং সময়ের সাথে সাথে কেবল শক্তি অর্জন করেছে । মিসরের রাজনীতিতে মুসলিম ব্রাদারহুড একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। ১৯২৮ সালে এর প্রতিষ্ঠা, বর্তমানে ৮৫ বছরের ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। কিন্তু অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় এই দলটি নিষিদ্ধ ছিল। এই দলটির প্রতিষ্ঠাতা হাসানুল বান্নাকে ১৯৪৯ সালে গুলি করে হত্যা করা হয়। ১৯৬৬ সালে দলটির শীর্ষ নেতা সাইয়েদ কুতুবকে ফাঁসি দেয়া হয়। ব্রাদারহুডের অসংখ্য নেতাকে ফাঁসি দেয়া হয়। ব্রাদারহুডের হাজার হাজার নেতাকর্মী বছরের পর বছর জেল খাটেন। কিন্তু এত কিছুর পরও ব্রাদারহুড নির্মূল হয়নি বরং গতি লাভ করেছে। তাই যখনই নির্বাচন হয়েছে তখনই দলটি জনতার ভোটে বিজয়ী হয়েছে। এ রকম একটি দলকে নির্যাতন করে কখনো নির্মূল করা যায় না, সাময়িক সময়ের জন্য দমিয়ে রাখা যায় মাত্র। সুতরাং মিসরের রাজনীতিতে ব্রাদারহুড ছিল, আছে এবং থাকবে। ইসলামবিরোধী শক্তির ষড়যন্ত্রের কারণে তারা ক্ষমতাচ্যুত হলেও জনগণের হৃদয়ে তাদের অবস্থান রয়েছে। সুতরাং সময়ের ব্যবধানে মুসলিম ব্রাদারহুড আরো বেশি জনপ্রিয়তা এবং শক্তি অর্জন করবে। আর ব্রাদারহুডকে বাদ দিয়ে মিসরের রাজনীতি সম্ভব নয়। কারণ একটি জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর অংশকে বাদ দিয়ে যেমন ঐ জনগোষ্ঠীর কোন সমস্যা সমাধান করা যায় না, ঠিক তেমনি ব্রাদারহুডকে বাদ দিয়ে মিসর চলতে পারবে না। সুতরাং সেনা কর্র্তৃপক্ষের উচিত হবে আর বাড়াবাড়ি না করে ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে দমন নির্যাতন বন্ধ করা এবং অতি দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করে জনগণের কাছে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়া। তা না হলে শুধু মিসর কেন সারা বিশ্বজুড়েই ছড়িয়ে পড়বে ইসলামী পুনর্জাগরণের ঢেউ, যে ঢেউয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিসমূহের ক্ষমতার মসনদ। সুতরাং ব্রাদারহুড নির্মূল নয় বরং আরো গতিশীল হবে। সেনাবাহিনীর অগণতান্ত্রিক আচরণ মিসরকে ইসলামী বিপ্লবের জন্য আরো উর্বর করবে। পশ্চিমাবিশ্ব গণতন্ত্রের কথা বললেও তারা মুসলিম দেশসমূহে গণতন্ত্র চায় না। কারণ গণতন্ত্র থাকলে সব সময় ঐসব দেশে দেশপ্রেমিক ও জাতিয়তাবাদী শক্তির উত্থান হয়, যারা কখনো পরাশক্তির তাঁবেদারি করে না। এ জন্য পশ্চিমাবিশ্ব সবসময় মুসলিম দেশসমূহে গণতন্ত্রের বিকাশকে বন্ধ এবং স্বৈরশাসকদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। মিসরের সাম্প্রতিক ঘটনা তার জ্বলন্ত প্রমাণ। তিউনিসিয়ায় দুই যুগ ধরে চলেছে জয়নাল আবেদীন বিন আলীর শাসন। আলজেরিয়ায় ১৯৯১ সাল থেকেই চলছে সামরিক শাসন ও জরুরি অবস্থা। ইসলামপন্থীরা বিজয়ী হওয়ায় সেখানে গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছে। মিসরে ১৯৮১ সাল থেকেই চলেছে জরুরি অবস্থা এবং হোসনি মোবারকের শাসন। মোবারক-পরবর্তী মিসরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু হলেও তাকে হত্যা করা হয়েছে। ইয়েমেনে ৩০ বছর ধরেই চলেছে আলি আবদুল্লাহর শাসন। এসবের পাশাপাশি সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, আরব আমিরাত, জর্ডান, মরক্কোসহ অনেক দেশেই কয়েক দশক ধরেই চলে আসছে রাজপরিবারের শাসন। অন্যান্য সব মুসলিম দেশের অবস্থাও একই। এসব দেশে প্রায় শতভাগ লোক মুসলমান হলেও ইসলামের আলোকে রাজনীতি এখানে নিষিদ্ধ। অধিকন্তু এসব দেশের শাসকেরা সবসময় ইসলামের স্বার্থকে বিসর্জন দিয়েছে এবং পশ্চিমাবিশ্বের লেজুড়বৃত্তি ও স্বার্থরক্ষা করেছে। এরা নিজ ধর্ম এবং দেশের মুসলমানদেরকে বানিয়েছে শত্রু আর ভিন ধর্ম ও ভিন দেশের জনগণকে বানিয়েছে বন্ধু। তাই বছরের পর বছর ধরে পাশ্চাত্য এবং তাদের তল্পিবাহক মুসলিম নামধারী শাসকদের হাতে নিপীড়িত এবং নির্যাতিত এসব দেশের মুসলমানেরা তাদের ভাগ্যকে পরিবর্তনের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রকে পেয়ে বসেছে সাম্রাজ্য আর আধিপত্য হারানোর ভয় আর ইসরাইলকে পেয়ে বসেছে অস্তিত্ব হারানোর ভয়। কারণ তারা ভাল করেই জানে এই পরিবর্তনের মাধ্যমে মুসলিম দেশসমূহে যে নেতৃত্ব সৃষ্টি হচ্ছে তা কখনই যুক্তরাষ্ট্রের আনুগত্য করবে না আর ইসরাইলের স্বার্থরক্ষাও করবে না। তাই যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাবিশ্ব আজ মুসলিম দেশের পতনোন্মুখ স্বৈরশাসকদের রক্ষায় মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছে। একই সাথে ইসলামপন্থীরা যেখানে ক্ষমতায় এসেছে, সেখানেই তাদেরকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য মাঠে নেমেছে। মিসরের প্রেসিডেন্ট মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করা এবং ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে দমন নির্যাতন তারই অংশ এবং ধারাবাহিকতা। কিন্তু মুসলমানরা আজ তাদের আসল আদর্শ ও ঐহিত্য প্রতিষ্ঠার দৃপ্ত ্রত্যয়ে যেভাবে জেগে উঠেছে, তাতে ধর্মনিরপেক্ষগোষ্ঠী এবং পশ্চিমাবিশ্বের শেষ রক্ষা হবে না। সকল বাধা পেরিয়ে ইসলাম আবারো পৃথিবীতে বিজয়ী হবেই। কারণ ইসলামের কালজয়ী আদর্শকে কখনো নির্মূল করা যায় না। একইসাথে ইসলামী আদর্শকে প্রতিষ্ঠার জন্য হাসিমুখে জীবন উৎসর্গকারী কোটি জনতার নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামকেও কখনো প্রতিহত করা যাবে না। মিসরসহ বিশ্বব্যাপী ইসলামের অনিবার্য উত্থান এবং বিশ্বক্ষমতায় ইসলামের ক্রমবর্ধমান অংশীদারিত্ব এবং একই সাথে নিজেদের পরাজয়কে স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করাটাই হচ্ছে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের মূল কথা। ইতিহাসের এই অনিবার্য বাস্তবতাকে মেনে চলাই ভালো। আর এতেই বিশ্বমানবতার জন্য কল্যাণ নিহিত আছে।
আপনার মন্তব্য লিখুন