post

মুসলিম উম্মাহ : সমস্যা ও আমাদের করণীয় । প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ । অনুবাদ : বুরহান উদ্দিন

০৩ ডিসেম্বর ২০১৮

মুসলিম উম্মাহ (দ্বিতীয় কিস্তি)

ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়া কিভাবে মুসলমান হলো? ইয়েমেনের ওপর দিয়ে যাওয়া মুসলিম ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে। আমি সব সময় এই কথাটি উল্লেখ করে থাকি। ইসলাম প্রচারের ইতিহাস পড়ার সময় আমি খুব আশ্চর্যান্বিত হয়ে যাই। আমি মনে করতাম যে, পৃথিবীতে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছেন আলেমগণ কিন্তু আমি ইসলাম প্রচারের ইতিহাস পড়ে জানতে পারি যে, পৃথিবীর সকল স্থানে ইসলামের বাণী সর্বপ্রথম পৌঁছিয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীগণ। এই সম্মানের মালিক সৎ ব্যবসায়ীগণ। এর কারণ কী? এই উত্তর পাওয়ার জন্য গবেষণা করে যা পাই তা হলো, ব্যবসায়ীগণ আলেম-উলামাদের মত আগে ঈমান এবং ইলিম নিয়ে যায় নাই। তারা সর্বপ্রথম হালাল এবং আখলাককে নিয়ে যান। পরবর্তীতে ঈমান এবং ইসলামকে নিয়ে যান। আগে গিয়েছিল হালাল এবং আখলাক, পরে যায় ঈমান এবং ইসলাম। আফ্রিকা মহাদেশের দেশ ক্যামেরুন, মোজাম্বিক, সোমালিয়া এবং কেনিয়াতে ইসলাম কিভাবে হাবশিস্তান (ইথিওপিয়া) এর মাধ্যমে প্রচারিত ও প্রসারিত হয়েছিল আমাদের সন্তানদেরকে এইসব কিছু জানানো প্রয়োজন। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সিলেবাসে ২টি বিষয় থাকা উচিত। ১. সারা পৃথিবীতে ইসলাম কিভাবে প্রচারিত হয়েছে? ২. মুসলিম উম্মাহর বর্তমান অবস্থা। এই দু’টি বিষয় এই জন্য থাকা প্রয়োজন যেন আমাদের সন্তানগণ উম্মাহর চেতনা নিয়ে বেড়ে ওঠে। মুসলিম উম্মাহ সম্পর্কে যেন তারা অবগত থাকে। আমাদের প্রিয় কবি নুরী পাকদিলের ‘পাশ্চাত্যের স্মৃতিকথা’ নামক বইয়ে আফ্রিকা নামে একটি সুন্দর অধ্যায় রয়েছে। তিনি সেখানে বলেন, “রাসূলে আকরাম (সা) তার এত সাহাবীর মধ্যে বিলালকে নির্বাচন করার মাধ্যমে আফ্রিকা মহাদেশে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেন।” আমরা সকলেই জানি যে OIC সদস্য রাষ্ট্রসংখ্যা ৫৭টি, এর মধ্যে ২০টি মুসলিম দেশ আফ্রিকা মহাদেশের। রাশিয়ার বাইরে মধ্য এশিয়ার তারকিশ রিপাবলিকসমূহ ওজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কাজাকিস্তান, কিরগিজিস্তান, আজারবাইজান আপনারা এই সকল দেশ সম্পর্কে খুব ভালোভাবেই জানেন। এদিকে ককেশাস অঞ্চল এমন একটি অঞ্চল যে অঞ্চলটি ইসলামের আশক (ভালোবাসা) এবং মুহাব্বতকে বহন করে চলছে। কাবারদিনো-বালকারিয়া, কারাচায়-চেরকেসিয়া, আডিসেয়া, ইঙ্গুশেতিয়া, চেচনিয়া, দায়েস্তান অসাধারণ একটি অঞ্চল। এ ছাড়াও বাল্টিক প্রজাতন্ত্রসমূহ রয়েছে, বিশেষ করে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মধ্য এশিয়া থেকে এই অঞ্চলে অনেক মুসলমান হিজরত করে। বেলারুশ, লিথুয়ানিয়া, ইউক্রেনে অনেক মুসলমান রয়েছে। এ ছাড়াও ঐ অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশ এবং সভ্যতার কেন্দ্রভূমি ক্রাইমিয়া সেখানে অবস্থিত। এই ক্রাইমিয়াতে অনেক মুসলমান বসবাস করে থাকে। এই অঞ্চলকে অর্থাৎ রাশিয়ার অভ্যন্তরে বসবাসকারী মুসলমানগণ, ককেশাস অঞ্চল, মধ্য এশিয়ার তারকিশ রিপাবলিকসমূহ এবং বালটিক প্রজাতন্ত্রের দেশসমূহে বসবাসকারী মুসলমানদের দিকে যদি আমরা তাকিয়ে দেখি, তাহলে এই অঞ্চলেই রয়েছে এক বিশাল মুসলিম বিশ্ব! আচ্ছা, এই অঞ্চলের সর্বশেষ অবস্থা এখন কী? ১০০ বছরের এক দীর্ঘ বিরতির পর তাদের মুসলিম পরিচয়কে উদ্ধার করার জন্য অনেক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মুসলিম উম্মাহর কেন্দ্রভূমি থেকে এই সকল অঞ্চলে কিছু ভুল তথ্য ও প্রতিষ্ঠান গিয়েছে, যা একটি বড় ভুল। প্রিয় ভাইয়েরা, আমাদের নিকট থেকে এই অঞ্চলের শেখার কিছু নেই। এই অঞ্চলের জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো তাদের নিজেদের প্রতিষ্ঠিত সভ্যতাকে যেন খুঁজে পেতে পারে সে জন্য তাদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করা। আমাদের দায়িত্ব হলো, তারা যেন তাদের মাওয়ারাউন নাহর সভ্যতাকে পুনরায় খুঁজে পায় সে জন্য তাদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করা। এ সভ্যতা উসুলের সাথে দর্শনকে, হাদিসের সাথে তাসাউফকে, জ্যোতির্বিদ্যার সাথে ফিকহকে একত্রিত করেছিল। নাকলি (ওহি) ইলিমের সাথে আকলি ইলিমের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছিল। চোখধাঁধানো মহান এক সভ্যতার ওপর তারা বসবাস করছে। এই অঞ্চলটি এমন এক অঞ্চল যে অঞ্চল হাদিসশাস্ত্রের সবচেয়ে বড় আলেম ইমাম বুখারীর সাথে দর্শনশাস্ত্রের সবচেয়ে বড় পণ্ডিত ইবনে সিনাকে একই অঞ্চল প্রতিপালিত করেছে। এই অঞ্চল এমন অসাধারণ এক অঞ্চল, যে অঞ্চল দর্শনশাস্ত্রের মহা-পণ্ডিত, আল মাদিনাতুল ফাদিলা গ্রন্থের লেখক আবুল ফজল আল-ফারাবির সাথে আহমেত ইয়েসেবীকে এক সাথে গড়ে তুলেছে। ইমাম সারখসীর সাথে প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, গণিতবিদ উলু বেয়কে এক সাথে গড়ে তুলেছে। ইমাম মাতুরিদির এবং ইমাম তিরমিজিকে একসাথে গড়ে তুলেছে। এ জন্য এখানে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাবের কিতাবুত তাওহিদকে নিয়ে যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। কেননা সেখানে ইমাম মাতুরিদির কিতাবুত তাওহিদ আবদুল ওয়াহাবের ১০০০ বছর পূর্বে লিখিত হয়েছে। অন্য একটি চিন্তা, অন্য একটি দর্শন, অন্য একটি আদর্শ সেখানে নিয়ে যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। আমাদের উচিত ছিল, তারা যেন নিজেদেরকে খুঁজে পায় এ জন্য তাদেরকে সাহায্য করা। এই অঞ্চলে ফেতুল্লাহ গুলেনের স্থলসমূহ নিয়ে যাওয়া আমাদের জন্য বড় ভুল, এটা করে আমরা অপরাধ করেছি। উপসাগরীয় দেশসমূহে বের হওয়া নতুন ধর্মীয় ফেরকাসমূহকে এই অঞ্চলে নিয়ে যাওয়ায় মুসলমানরা অনেক বড় গুনাহ করেছে। অথচ আমাদের মূল দায়িত্ব ছিল, তারা যেন তাদের নিজেদের প্রতিষ্ঠিত সভ্যতাকে খুঁজে পেতে পারে সে লক্ষ্যেই তাদেরকে সাহায্য করা। কিন্তু আজ তারা এই সুযোগ থেকে অনেক বেশি মাহরুম (বঞ্চিত)। এখনো তারা বঞ্চিত হয়েই চলছে। এ অঞ্চলে বসবাসরত মুসলমানদের আজ সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, নিজেদের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে নিজেদের ইসলামী পরিচয়কে প্রতিষ্ঠা করা। আর এই ক্ষেত্রে আমাদের কর্তব্য তাদের এই কাজে সাহায্য সহযোগিতা করা। সেলচুকলু, ওসমানী এবং আমরা আজ যে ইতিহাসের উত্তরাধিকারী এর মূল উৎস হলো এই অঞ্চলে। মাওয়ারাউন নাহরে। কিন্তু আজ তারা দরিদ্রতার জাঁতাকলে নিষ্পেষিত। আমি এই স্মৃতিটি কক্ষনোই ভুলতে পারি না; ইমাম আজম আবু হানিফার পরে হানাফি মাজহাবের সবচেয়ে বড় আলেম ইমাম সারাখসানির কবর ওজসেন শহরের একটি বাড়ির জরাজীর্ণ একটি আঙিনায়। এটা জানার পর আমি খুবই আশ্চর্যান্বিত হয়ে যাই। সে কূপের পাশে বসে ৩০ খণ্ডের আল মাবসুতি নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেন তার পাশের একটি ঘরের পাশেই তার কবর!

দুই. দ্বিতীয় অঞ্চল দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ। আমরা যে অঞ্চলকে বালকান অঞ্চল বলে চিনে থাকি। কিন্তু এই অঞ্চলকে আমাদের ইউরোপে বসবাসরত মুসলমানদের সাথে চিন্তা করা উচিত। দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ আলবেনিয়া, বুলগেরিয়া, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, কসোভা, সানজাক, রোমানিয়া, মেসিডোনিয়া। এই সমগ্র অঞ্চলটি এমন এক অঞ্চল এই অঞ্চলে বসবাসরত মুসলমানদের সাথে ৫০০-৬০০ বছর একসাথে বসবাস করেছি, একই সভ্যতাকে একে অপরের সাথে ভাগ করে নিয়েছি, একই মসজিদে নামাজ পড়েছি এবং একই রণাঙ্গনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছি। এই অঞ্চলটিও ১০০ বছরের দীর্ঘ এক বিরতির পর নিজেদের মূল পরিচয়কে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছে। তারা যেন তাদের সেই অতীতের ৫০০-৬০০ বছরের মহান সেই সভ্যতাকে খুঁজে পেতে পারে এই জন্য আমাদের উচিত তাদেরকে সাহায্য করা। আমাদের এতটুকু সাহায্যই তাদের জন্য যথেষ্ট এর বেশি কিছু নয়। এই অঞ্চলটি সবসময় ভয়াবহ এক হুমকির সম্মুখীন। কারণ ইউরোপ এই অঞ্চলকে তার সামগ্রিকতাকে বিনষ্টকারী একটি অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। তারা এই অঞ্চলকে তাদের সভ্যতা ও ধর্মীয় চিন্তার আলোকে গড়ে তোলার জন্য সকল ধরনের মিশনারি কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। পৃথিবীর এমন কোন বড় মিশনারি গোষ্ঠী নেই যারা বালকান নামক এই ছোট্ট অঞ্চলটিতে নেই। ভৌগোলিক দিক থেকে এই অঞ্চলটি ছোট হতে পারে কিন্তু মুসলিম উম্মাহর নিকট ও সমগ্র দুনিয়ার নিকট এর গুরুত্ব অনেক বেশি।

তিন. তৃতীয় অঞ্চল, এই অঞ্চল নিয়ে অনেক কথা বলা যায় কিন্তু সময় কম হওয়ার কারণে আমাকে সংক্ষিপ্ত করতে হবে। তৃতীয় অঞ্চল হলো আফ্রিকা। আফ্রিকা এটি এমন একটি অঞ্চল, এমন কোন গর্হিত কাজ নেই যা সাম্রাজ্যবাদীরা এই অঞ্চলে করেনি। আল্লাহপ্রদত্ত সমগ্র নিয়ামতকে সাম্রাজ্যবাদীরা শোষণ করে নিয়ে গিয়েছে এই অঞ্চল থেকে। সকল নিয়ামতে পরিপূর্ণ বিশাল এক মহাদেশ হলো আফ্রিকা মহাদেশ। সাহাবায়ে কেরাম বিলাদি হাবশিস্তান (বর্তমান ইথিওপিয়া) এ হিজরত করার মাধ্যমে সর্বপ্রথম এই মহাদেশে পা রাখেন। আফ্রিকান সম্রাট বাদশাহ নাজ্জাশির দুনিয়া। ইসলামে সভ্যতার বিনির্মাণে অনেক বড় ভূমিকা পালনকারী মিশর এবং সুদান এই অঞ্চলে। উত্তর আফ্রিকার মাধ্যমে শুধুমাত্র আফ্রিকা নয়, ইউরোপকে আলোকিত এবং মানব ইতিহাসের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী সভ্যতার প্রতিষ্ঠাকারী আন্দালুসিয়াও এই আফ্রিকার মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। উপনিবেশবাদীরা যাওয়ার পরে আফ্রিকার জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো নিজের পায়ের ওপরে দাঁড়ানো এবং তাদের অতীত হারানো ইতিহাসকে পুনরুদ্ধার। সাম্রাজ্যবাদীরা এই মহাদেশে ভয়াবহ দু’টি অপকর্ম করে। প্রথমে তারা দাসের বাণিজ্য করে আফ্রিকান সন্তানদেরকে, আফ্রিকান মানুষদেরকে তাদের দাসে পরবর্তীতে তারা শোষণের মাধ্যমে তাদের আধুনিক দুনিয়া প্রতিষ্ঠা করে। এই মহাদেশের মানুষকে শোষণ করে নিজেরা উন্নতির চরম শিখরে উপনীত হয়। তারা যখন এই অঞ্চলের মানুষকে বঞ্চিত করে তখন একমাত্র তাদের সামনে বাধা হিসেবে দাঁড়ায় উসমানী খিলাফত। এই মহাদেশের মানুষকে ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদীদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য উসমানী খিলাফতের প্রচেষ্টা ও অবদান অনস্বীকার্য। এই অঞ্চলের মুসলমানগণ যেন তাদের ইসলামী পরিচয়কে ফিরে পেতে পারে এবং সম্মানের সাথে বসবাস করতে পারে এই জন্য দুনিয়ার সকল মুসলমানের উচিত তাদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করা। এখানে কুয়েত কাতারসহ অন্যান্য দেশ থেকে অনেকেই উপস্থিত আছেন। তারাও আফ্রিকার বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে সাহায্য সহযোগিতা করার চেষ্টা করছেন। তুরস্কের সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাসমূহও সেখানে অনেক কাজ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু সমস্যা হলো এই সকল সংস্থা ও সংগঠনের মধ্যে কোন সমন্বয় নেই। কোন অঞ্চলের জন্য আসে কী প্রয়োজন সেগুলোর তালিকা করে সেই অনুযায়ী সাহায্য করা প্রয়োজন। আফ্রিকা মহাদেশের এমন অনেক অঞ্চল রয়েছে যেখানে কোরআনে কারীমের মুসহাফ এখনো পৌঁছেনি। যে কিতাবের ওপর ঈমান এনে তারা মুসলমান হয়েছে সেই কিতাব দেখার সৌভাগ্যও এখনো অনেকের হয়নি। সেখানকার শিশুরা কাঠের খণ্ডের ওপর, পাতার ওপরে, পাথরের ওপরে কোরআনের আয়াতকে লিখে লিখে পবিত্র কোরআনকে মুখস্থ করে থাকে। এই সকল বিষয়কে সামনে রেখে আমাদের সাহায্য সহযোগিতা করা প্রয়োজন।

চার. চতুর্থ অঞ্চল ভারতীয় উপমহাদেশ। হিন্দুস্তান (ভারত), পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান। ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানগণ বিশেষ করে জহির উদ্দিন বাবর শাহ যে ইসলামী সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সে সম্পর্কে আমাদের সন্তানদেরকে শিক্ষা দিতে হবে, তাদেরকে ইসলামের সুমহান সভ্যতা সম্পর্কে অবগত করতে হবে। হিন্দুস্তান (ভারত) কিভাবে ভাগ হয়ে পাকিস্তান হলো এবং পরবর্তীতে পাকিস্তান ভেঙে কিভাবে বাংলাদেশের জন্ম হলো এবং ঐ অঞ্চলকে সব সময় অস্থিতিশীল করে রাখার জন্য কাশ্মির সমস্যাকে কিভাবে জাগ্রত করে রাখা হয়েছে এই সম্পর্কে আমাদের ভালোভাবে জানতে হবে। একটি দেশ ও একটি সমাজের জন্য দ্বীনি ঐক্য, দ্বীনের নিরাপত্তা, দ্বীনি স্থিতিশীলতা কত যে গুরুত্বপূর্ণ এই শিক্ষা আমাদেরকে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে গ্রহণ করতে হবে। এই মুসলিম সমাজের জন্য এই বিষয়সমূহ কত বেশি গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়ে আমাদের বিস্তর গবেষণা করতে হবে। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের কাছ থেকে যেমন আমাদের শিক্ষা নেয়ার মত অনেক কিছু আছে তেমনিভাবে তাদেরকে দেয়ার মতও আমাদের অনেক কিছু আছে। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয় তাদের মধ্যে অনৈক্যের দেয়াল রয়েছে। এই দেয়ালকে ভেঙে ফেলার জন্য ভূমিকা পালন করতে হবে।

পাঁচ. পঞ্চম অঞ্চল হলো চীন। চীনের আশপাশের মঙ্গোলিয়াসহ আরও কিছু মুসলিম অঞ্চলকে আমরা চীনের সাথে বিবেচনা করতে পারি। কিন্তু চীনের মুসলমানদেরকে নিয়ে আমাদের আলাদাভাবে গবেষণা করা প্রয়োজন। ২০০৮ সালে OIC-র একটি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করি। সম্মেলনের বিষয় ছিল সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়। কিন্তু সম্মেলনের বিষয়বস্তু যাই হোক সবাই ঘুরে ফিরে শুধু ফিলিস্তিনের দিকেই আসতেন এবং ফিলিস্তিন নিয়ে আলোচনা করতেন। ফিলিস্তিন অবশ্যই আমাদের সকলের জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং মুসলিম উম্মাহ যদি তার ওপরে অর্পিত ইসতিখলাফের দায়িত্ব পালন ও কেন্দ্রীয় একটি উম্মাহ হতে চায় তাহলে ফিলিস্তিনকে মুক্ত করে বায়তুল মুকাদ্দাস ও কুদুসকে রাজধানীসমূহের রাজধানী ঘোষণা করার কোন বিকল্প নেই। আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, আমরা একটা বিষয় নিয়ে যখন কাজ করি তখন অন্যান্য বিষয় ও সারা দুনিয়ার কথা ভুলে যাই। ঐ সম্মেলনে আমি কথা বলার সুযোগ চাই এবং চীনের মুসলমানদের সম্পর্কে সম্মেলনে উপস্থিত সকলকে অবহিত করি। আমি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করি আপনাদের হাতে চীনের মুসলমানদের সম্পর্কে কোন রিপোর্ট আছে কি? চীনে কতগুলো ফিলিস্তিন রয়েছে আপনারা কি জানেন? আমার বক্তব্যের পর সম্মেলন শেষে ডেক্লারেশন ঘোষণার সময়ে চীন সম্পর্কে একটি ধারা যোগ করা হয় এবং OIC-র পক্ষ থেকে চীনে একটি পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আমাকেও সেই দলের একজন সদস্য করা হয়। কুয়েতের ভাইয়েরা এখানে আছেন কুয়েতের সাবেক ওয়াকফ বিষয়ক মন্ত্রী আমার বন্ধু আবদুল্লাহ মাতুফও সেই প্রতিনিধিদলে ছিলেন। বিভিন্ন মুসলিম দেশ থেকে অংশগ্রহণকারী একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে আমরা চীনে যাই। এই প্রতিনিধিদলের মধ্যে রাজনীতিবিদসহ অনেক আলেম উলামাও ছিলেন। প্রথমে হুই মুসলমানগণ বসবাসকারী অঞ্চলে, কানসু প্রদেশে, নিজিয়া প্রদেশে বসবাসকারী মুসলমানদের সাথে দেখা করি। পরে সিংজাঙ্ক স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশে যাই। উরুমচি, কাশগর, হটন, তুরফানে যাই। আমার জীবনে প্রথম এই সকল অঞ্চলে জিয়ারত করতে যাই। কাশগরের মাহমুদ এবং ইউসুফ হাজ হাজিবির সাথে দেখা করি। অসাধারণ এক সভ্যতার ওপর প্রতিষ্ঠিত সেই অঞ্চলকে খুঁজে পাওয়ার পর বিগত ২০০ বছর যাবৎ মুসলিম উম্মাহ থেকে বিছিন্ন হয়ে বসবাস করার ফলে যে সকল সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে সেগুলো সরেজমিনে দেখার সুযোগ হয়। ঐ সময়ের একটি স্মৃতি আমি সবসময় আপনাদের সামনে বলে থাকি। ঐ অঞ্চলে ২০ জন মানুষ কেবলমাত্র ১টি মুসহাফ (কোরআন শরীফ) দিয়ে হাফেজ হচ্ছিল। ১টি কোরআন শরীফকে একজন পড়ার পর আরেকজন পড়ত। তাদের কাছে কিছুই ছিল না। মহান আল্লাহর শুকরিয়া জানাই পরে তাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক স্থাপন হয় এবং আমরা তাদের মাধ্যমে অনেক কিছু করতে সক্ষম হই। আমাদের মননে ও মানসে যে বিষয়টি সবসময় লালন করতে হবে তা হল, মুসলিম উম্মাহ অনেক বড়, সমগ্র পৃথিবীতেই আমাদের বিচরণ রয়েছে। সরকারি হিসাবে বলা হয়ে থাকে যে চীনে নাকি ২০ মিলিয়ন মুসলমান রয়েছে, এই তথ্যটি সঠিক নয়। চীনের ভেতরে ১০০ মিলিয়ন তথা ১০ কোটির বেশি মুসলমান রয়েছে। চীনের মুসলমানগণ এখনো তাদের মুসলিম পরিচয়কে ধারণ করে আছে। কয়েক বছর আগে কয়েক হাজার চাইনিজ মুসলমান হজ করতে গিয়েছিল এই ধারা এখনো অব্যাহত আছে। বিভিন্ন অঞ্চলে মসজিদসমূহ নতুন করে আস্তে আস্তে খুলে দেয়া হচ্ছে। শিশুরা আস্তে আস্তে কোরআন শিখছে। তবে আমাদের উচিত হলো এই দুনিয়ার সাথে সঠিক একটি সম্পর্ক স্থাপন করা এবং চীনের মুসলমানদের সাথে সম্পর্ক করতে চাইলে পেকিনের ওপর দিয়ে করতে হবে। অন্য কোন স্থান থেকে নয়। আমি কিছুক্ষণ পূর্বে চীনের একটি মসজিদ সম্পর্কে বলেছিলাম। সেই মসজিদে নামাজ পড়ার পর বের হয়ে দেখি মসজিদের সামনে বিশাল এক দেয়াল। একজন এসে আমাকে বলেন যে, আপনি কি জানেন এই দেয়ালের পেছনে কী রয়েছে? - আমি তাকে জবাবে বললাম, ‘কি আছে?’ - তিনি আমাকে জবাবে বলেন, ‘এখানে সুলতান আবদুল হামিদের প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।’ তার এই জবাব শুনে আমি আশ্চর্যান্বিত হয়ে যাই। সেখানে আমি যাদের মুসাফির ছিলাম তাদেরকে অনুরোধ করি যে, আমাকে কি এই দেয়ালের পেছনে একটু দেখানো যাবে? আমার কথা শুনে তিনি মুচকি হেসে দরজা খুলে দেন। দরজা খোলার পর অনেক বড় একটি শিলালিপি দেখতে পাই। সেই শিলালিপিতে লেখা ‘দারুল উলুমুল হামিদিয়্যা’। সুলতান আবদুল হামিদ হান সেই সময়ে মুসলমানদেরকে একটি প্রতিনিধিদল সেখানে প্রেরণ করেন এবং সেখানে মুসলমানদের শিক্ষা-দীক্ষার জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। এই সকল অঞ্চল এবং সেখানে বসবাসরত মুসলমানদের সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে। চীনের মুসলমানদের সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং তথ্যসমৃদ্ধ বই লিখেছে একজন ইসরাইলি ইয়াহুদি! এই সকল বিষয় বলতে অনেক কষ্ট লাগে। আজকে আমাদের চীনের মুসলমানদের সম্পর্কে আমাদের কয়টি মাস্টার্স এবং ডক্টরেট রয়েছে?

ছয়. আমাদের ষষ্ঠ শিরোনাম প্যাসিফিক এশিয়ার মুসলমানদেরকে নিয়ে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং এর আশপাশের অঞ্চল। এই অঞ্চলের মানুষদের মুসলমান হওয়া একটি মুজিযা। এখানে যুবসমাজের ইসলাম নিয়ে যে জজবা এটা আমাদের সকলের মধ্যে একটি প্রেরণা সৃষ্টি করে। কিন্তু এখানেও পাকিস্তান, হিন্দুস্তান ও আফগানিস্তানের মত সমস্যা রয়েছে। এই ব্যাপারে একটু পরেই উদাহরণ দেবো।

সাত. ল্যাটিন অ্যামেরিকা। এই ল্যাটিন অ্যামেরিকাতে ৭০ লাখ মুসলমান রয়েছে। কয়েক বছর পূর্বে ব্রাজিলের একজন আলেম আমার কাছে আসেন। -তিনি আমাকে বলেন আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে। -আমি বললাম বলেন, তিনি বলেন, ‘বাগদাদের আবদুর রহমান এফেন্দীর ব্রাজিল সফর কাহিনী খুঁজে বের করে আমাদের ভাষায় অনুবাদ করতে পারবেন?’ -আমি তার কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে বললাম উনি কে? -তিনি জবাবে বলেন, ব্রাজিলে ইসলাম প্রচারকারী ব্যক্তি। -আমি তাকে জবাবে বলি যে, ‘আমি জানি না!’ এর পরে সুলেয়মানিয়া কুতুবখানা তে খোঁজাখুঁজি করে সেই বই খুঁজে পাই। ১৮৬০ সালের দিকে উসমানী খিলাফতের দুটি প্রতিনিধিদল বসরায় যাওয়ার জন্য রওনা করে। কিন্তু ঝড়ের কবলে পড়ে পথ হারিয়ে ফেলে। পথ হারিয়ে ভালোই হয়েছিল। কয়েক মাস পরে তারা নিজেদেরকে ব্রাজিলের জরড় ফব Rio de Janeiro নামক সৈকতে আবিষ্কার করেন। তাদের মধ্যে ছিলেন বাগদাদের ইমাম আবদুর রহমান এফেন্দী। ইমাম আবদুর রহমান এফেন্দী জুব্বা আর পাগড়ি পরা অবস্থায় সমুদ্রসৈকতে নামলে দলে দলে মানুষ এসে তাকে সালাম দিতে থাকেন ‘আসসালামু আলাইকুম’। -তাদের সালাম শুনে আবদুর রহমান এফেন্দী তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেন তোমরা এটা কিভাবে জান? এখানে মুসলমান আছে নাকি? -জবাবে তারা বলেন যে, হ্যাঁ আমরা মুসলমান। -পর্তুগিজরা যুদ্ধ করার জন্য আফ্রিকা থেকে আমাদেরকে গোলাম হিসেবে এখানে নিয়ে এসেছে তাদের হয়ে যুদ্ধ করার জন্য। আমাদের পূর্বপুরুষ সকলেই মুসলমান। আমাদেরকে এখানে নিয়ে এসে তারা গোলাম বানিয়ে রেখেছে। আমরা এখানে মুসলমান দাস। -তিনি তাদের এই কথা শুনে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেন, এখানে তোমাদের সংখ্যা কত হবে? -জবাবে তারা বলেন যে, অনেক আছে। -কিছুকাল পরে আবদুর রহমান এফেন্দী আবিষ্কার করেন যে, ব্রাজিলে বড় একটি মুসলিম জনগোষ্ঠী রয়েছে। কিন্তু নামাজ কী, রোজা কী, ঈদ কী, কোরআন কী এই সবের কিচ্ছু জানে না। শুধুমাত্র ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ আর ‘আসসালামু আলাইকুম’ এছাড়া আর কিচ্ছু জানে না। সেখানে কিছুদিন থাকার পর বসরার উদ্দেশ্যে গমনকারী প্রতিনিধিদল যখন আবার সেখান থেকে যাত্রা করবে তখন আবদুর রহমান এফেন্দী বলেন যে, আমি এখান থেকে যেতে পারব না। এখানে অবস্থান করা আমার জন্য ওয়াজিব। এখানে অবস্থান করে এই সকল মুসলমানকে দ্বীন শিক্ষা দিতে হবে। এই কথা শুনে প্রতিনিধিদলের আমির তাকে বলেন যে, তুমি যদি এখানে থাকতে চাও তাহলে ফিরে গিয়ে আমাকে বলতে হবে যে, তুমি হারিয়ে গিয়েছ। - আবদুর রহমান এফেন্দী তাকে বলেন যে, আচ্ছা তাই করো, সমস্যা নেই। পরে প্রতিনিধিদলের আমির তার খাতায় লিখেন যে, Rio de Janeiro সৈকতে নামার পরে আবদুর রহমান এফেন্দী হারিয়ে গিয়েছেন। আমির সেখান থেকে ফিরে আসার সময় পেছনের দিকে তাকিয়ে আবদুর রহমান এফেন্দী ডাক দিয়ে বলেন যে, উস্তাজ এদিকে একটু আসেন। আসার পর তিনি তার হাতে কিছু স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে বলেন এটা আমার পক্ষ থেকে উপহার। এর পরে আবদুর রহমান এফেন্দী সেখানে দীর্ঘ ৬ বছর অবস্থান করেন। তার লেখা ‘ব্রাজিলের সফরনামা’ নামক বইটি আমরা কয়েক বছর পূর্বে প্রকাশ করেছি। সকলকে অনুরোধ করব বইটি পড়ার জন্য। ৬ বছর পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করার পর তার স্মৃতিকথামূলক এই বইটি রচনা করেন। ল্যাটিন অ্যামেরিকাতে শুধুমাত্র মুসলমানরা কি এরাই? না। ১. আফ্রিকা থেকে যে সকল মুসলমানকে ধরে নিয়ে সেখানে গোলাম বানিয়ে রাখা হয় তারা, তারও পূর্বে আন্দালুসিয়া থেকে পালিয়ে সেখানে আশ্রয় নেয়া মুসলমানগণ। আন্দালুসিয়া থেকে সমুদ্রপথে যাত্রা করলে তাদের মধ্যে অনেকেই সাগরে ডুবে মরে আবার অনেকেই সম্ভাব্যস্থলে পৌঁছতে সক্ষম হয়। ২. উসমানী খিলাফতের শাসনাধীন অঞ্চল লেবানন, বৈরুত থেকে খ্রিষ্টানদের সাথে মুসলমানগণও সমুদ্রপথে সেখানে যান। ফিলিস্তিনসহ আরও অনেক অঞ্চল থেকে মুসলমানগণ ব্রাজিলে যান এবং তাদের সমন্বয়ে মুসলমানদের এই বৃহৎ একটি সম্প্রদায় গঠিত হয়।

শুধুমাত্র ল্যাটিন অ্যামেরিকা নয়, ক্যারিবিয়ান সাগরের আশপাশে হাইতি, ডমিনিক প্রজাতন্ত্রেও অনেক মুসলমান রয়েছে। হাইতি হলো এমন এক স্থানের নাম, এই স্থানটিকে ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের দাস ব্যবসার টার্মিনাল হিসেবে ব্যবহার করার জন্য সেখানে পূর্বে থেকে বসবাসকারীদের ওপরে গণহত্যা চালায় এবং সকলকে হত্যা করে। সেখানের মূল অধিবাসীদেরকে হত্যা করার পরে তারা তাদের আনুগত্যপরায়ণ দাসদেরকে সেখানে পুনর্বাসন করে। পরে যখন দাস ব্যবসা শেষ হয়ে যায় তখন তারা তাদেরকে ভুলে যাওয়ায় সেখানে অবস্থানকারী দাসরা সেখানে একটি নতুন সম্প্রদায় গড়ে তুলে। কিন্তু এর পরেও ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদীদের নির্যাতন থেমে থাকেনি। শুধুমাত্র চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যে সেখানে বসবাসরত দাসদেরকে দিয়ে আখ চাষ করানোর জন্য ফরাসিরা সেই অঞ্চলকে আরও ১০০ বছর উপনিবেশ করে রাখে। শুধুমাত্র একটি প্রয়োজনকে পূরণ করার জন্য তারা এমন ভয়াবহ নির্যাতন চালায়। এটাই হলো পাশ্চাত্যের আসল রূপ।

আট. অষ্টম অঞ্চল মধ্যপ্রাচ্য। আরব বিশ্ব, উপসাগরীয় দেশসমূহ এবং তুরস্ক ইরাক এবং ইরান। আপনারা এই অঞ্চলে বসবাস করার কারণে এই অঞ্চল সম্পর্কে ভালোভাবেই জানেন এই জন্য আমি এই অঞ্চল সম্পর্কে বেশি আলোচনা করব না। শুধুমাত্র এই অঞ্চল সম্পর্কে উল্লেখ করলাম।

নয়. এটি হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই অংশে আমরা মুসলমান সংখ্যালঘুদেরকে নিয়ে আলোচনা করব। প্রিয় ভাইয়েরা আপনারা জানেন, ইউরোপের ভেতরে ৩৫ মিলিয়ন তথা সাড়ে তিন কোটি মুসলমান রয়েছে। কিন্তু ইউরোপের তৈরি করা ইসলাম ফোবিয়ার কারণে সবসময় তারা আতঙ্কে থাকে। অ্যামেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে মুসলিম জনগোষ্ঠী রয়েছে। একটু আগে আমি বলেছি যে, ইন্দোনেশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে ছোট ছোট অনেক দ্বীপ ও দ্বীপপুঞ্জ রয়েছে। এই সকল দ্বীপের প্রত্যেকটিতেই মুসলমান জনগোষ্ঠী রয়েছে। মিউকালোডনিয়া নামে একটি দেশ রয়েছে, এই দেশে নেতাদের সাথে দেখা হলে আমি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করি এখানে কতজন মুসলমান রয়েছে? তিনি আমাকে জবাবে বলেন যে, দশ হাজার বা তার চেয়ে বেশি। -আমি তাদেরকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করলাম, আপনারা কোথা থেকে এখানে এসেছেন? -তিনি আমাকে জবাবে বলেন যে, ফরাসিরা আলজেরিয়াকে দখল করে তাদের উপনিবেশ বানালে আলজেরিয়ান মুসলমানরা ফরাসিদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করে। স্বাধীনতাযুদ্ধের পূর্বে যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী চার হাজার মুসলমানকে বন্দী করে এই দ্বীপে নিয়ে এসে বন্দী করে রাখে। আজকের গুয়ান্তেনামোর মত তারা এই দ্বীপকে সেই সময়ের গুয়ান্তেনামো বানিয়ে রেখেছিল। তখন থেকে আমরা এখানে। প্রতিটি অঞ্চলেই এমন মুসলমান সংখ্যালঘু রয়েছে কিন্তু তাদেরকে দেখার, তাদের খোঁজ নেয়ার মত কেউ নেই। অ্যামেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইউরোপে বসবাসকারী মুসলমানদেরকে নিয়ে আলাদাভাবে আলোচনা করা দরকার বলে আমি মনে করি। এখন আমি মূল কথায় আসতে চাই। প্রিয় ভাইয়েরা, আজকে আপনাদের এই প্রোগ্রামের নাম ‘মুসলিম বিশ্বে ঐক্যের মডেল এবং ভবিষ্যৎ’ মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা কী? কোন বাধাটি আমাদের ভবিষ্যৎকে অন্ধকার করে রেখেছে? সেটা কী? যে দ্বীন এসেছিল আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য। আমাদেরকে উম্মাহ বানানোর জন্য, আজকে আমরা সেই দ্বীনের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা, বেহুদা এবং অর্থহীন বিষয়সমূহ নিয়ে বিভিন্ন দলে উপদলে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার কারণে আজ সেই দ্বীনকে আমরা আমাদের মধ্যে বিভক্তির কারণে পরিণত করেছি। বড় বড় সভ্যতার পতন শুরু হয় দ্বীনের শাখা-প্রশাখা এবং অর্থহীন বিষয়সমূহ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক এবং এই সব বিষয় নিয়ে দলাদলি করার ফলে। অর্থহীন বিষয়সমূহকে বড় করে দেখিয়ে উম্মাহকে আজ বিভক্ত করে রাখা হয়েছে। অথচ আমাদেরকে যে বিষয়টি ঐক্যবদ্ধ করে তা হলো, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। এর বাহিরে যা আছে তা সব গুরুত্বহীন। আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে ইসলামের আদালত। আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করবে আখলাক। আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করবে ইমাম আজম আবু হানিফার সেই গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি, ‘আহলে কিবলাকে তাকফির করা যাবে না’। এটা কতই না বড় একটি মূলনীতি। যে মানুষ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ বলবে’ তাকে তাকফির করা যাবে না। এটা কতই না বড় একটি মূলনীতি। ইমাম আজম আবু হানিফার ফিকহুল আকবর গ্রন্থের একটি বিশ্লেষণ হলো, ‘যারা আল্লাহর অবতীর্ণ গ্রন্থের প্রতি ঈমান এনেছে তাদেরকে সেই কিতাবের তা’বিল (ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ) এর কারণে তাকফির (কাফির বলা যাবে না) করা যাবে না।’ আমরা কোন কোন বিষয়ের কারণে বিভিন্ন দলে উপদলে বিভক্ত হয়েছি? প্রথমে, ইমামত ও সিয়াসেত (রাজনীতির) ওপর ভিত্তি করে শিয়া, সুন্নিতে বিভক্ত হয়েছি পরবর্তীতে সেটা আরও গভীর থেকে গভীরতর হয়ে সারা দুনিয়াতে ছড়িয়ে পড়েছে। পরবর্তীতে সেটা বিভিন্ন জাতীয়তাবাদের সাথে মিলে আরও বহুধা বিভক্ত হয়ে পড়ে। আজ এগুলো বিভিন্ন জাতীয়তাবাদের সাথে মিলে মিশে তার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রেখেছে। এর পরে মাজহাবের ওপর ভিত্তি করে বিভক্ত হয়েছি। যে মাজহাব সমূহ দ্বীনে মুবিন ইসলামকে সহজভাবে বুঝার জন্য আমাদের সামনে ইসলামকে উপস্থাপন করেছিল আমরা সেটাকে অন্যভাবে বুঝে নিজেদেরকে বিভক্ত করে ফেলেছি। এরপর ইসলামের মূল বিষয়সমূহের ওপর বিভক্ত হয়ে পড়েছি। আহলে কোরআন ও আহলে হাদিস নামে দলের সৃষ্টি হয়েছে। কোরআন এবং সুন্নাহ হল ইসলামের এমন একটি বিষয় একটা থেকে অপরটিকে আলাদা করলে যেখানে দ্বীনে মুবিন ইসলামই ধসে পড়বে আমরা সেই বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে নিজেদেরকে বিভক্ত করে রেখেছি। এরপর ইরাদি এবং কুদরত তথা ইলমে কালামের ওপর ভিত্তি করে বিভক্ত হয়ে পড়েছি। এটা নিয়ে অনর্থক বাড়াবাড়ি এবং তর্ক-বিতর্ক করার কারণে আমরা বিভিন্ন দলে উপদলে বিভক্ত হয়েছি। এর তারিকাত এবং তাসাউফের ওপরে ভিত্তি করে বিভক্ত হয়েছি। আমাদের অন্তরকে বিশুদ্ধ করার জন্য যে মক্তবের সৃষ্টি হয়েছিল, যে মক্তব বা চিন্তা সমগ্র আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া ও ভারতে ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটিয়েছে সেই তাসাউফের ওপর ভিত্তি করে আমরা বিভক্ত হয়েছি। এরপর রাজনৈতিক বিভাজন সমূহ। আমি শুধুমাত্র এই সকল বিষয়ের ওপরে ২টি উদাহরণ পেশ করব। একটি হলো ভারতীয় উপমহাদেশের অপরটি হল ইন্দোনেশিয়ার। ভারতীয় উপমহাদেশের কাহিনীটি হলো, আড়াই বছর আগে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আমাকে পাকিস্তানে আমন্ত্রণ করেন। আমি তার দাওয়াতে সাড়া দিয়ে পাকিস্তানে যাই। পরে লাহোরে তার ভাই শাহবাজ শরীফের বাসায় বসে আমাকে যে কথাগুলি বলেছিলেন তা আমি কোনদিনই ভুলব না, তিনি বলেন, ‘উস্তাজ! আমরা ভারতে হিন্দুদের সাথে শতাব্দীর পর শতাব্দী এক সাথে বসবাস করেছি। পরে আমরা দেখলাম যে আর এক সাথে বসবাস করা সম্ভব নয়। পরে আমরা চিন্তা করলাম যে, তাদের থেকে পৃথক হয়ে আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করব। আমাদের পূর্বপুরুষগণ এই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার জন্য আন্দোলন করে এবং শেষ পর্যন্ত আমরা পৃথক হয়ে আলাদা একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হই এবং পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করি। পাকিস্তানে আমাদের যেই বিষয়টি আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করবে তা ছিল কেবলমাত্র ইসলাম। আমাদের মধ্যে গোত্রপ্রথা, আঞ্চলিকতা এবং ভাষার ভিন্নতা একটি বিভাজনের বড় কারণ। কিন্তু আমাদেরকে একটি বিষয় ঐক্যবদ্ধ করেছিল তা হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা)’। তাদের একটি বিখ্যাত বিশ্লেষণ রয়েছে, আল্লামা ইকবাল এই বিশ্লেষণটির জনক। তা হলো, ‘পাকিস্তান কা মতলব কিয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। কোন সমাবেশে তারা যখন বলে পাকিস্তান কী? তখন সবাই সমস্ব^রে বলে উঠে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। আমরা এমন একটি ভালোবাসা ও চিন্তার ওপর ভিত্তি করে পাকিস্তান থেকে পৃথক হই। শুধুমাত্র ভারত থেকে পাকিস্তানে হিজরত করার সময় বিভিন্ন স্থানে সংঘাত ও সংঘর্ষের কারণে আড়াই লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হওয়ার কয়েক বছর পরেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে এবং পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে ‘বাংলাদেশ’ নামক আলাদা একটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। আজকে আমরা এমন এক অবস্থায় উপনীত হয়েছি যে, আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধকারী একমাত্র উপাদান ‘ইসলাম’ আজকে আমাদের মধ্যে বিভাজনের সৃষ্টি করেছে। প্রতিটি মসজিদ আজকে একটি মাজহাব, প্রতিটি মাদরাসা আজকে একটি ফিরকায় (দলে) পরিণত হয়েছে। এই জন্য আমি সকল আলেমকে এক সাথে করেছি। আপনি অনুগ্রহ করে তাদের সাথে একটু কথা বলেন।” এরকম একটি উদ্দেশ্যে আমি পাকিস্তানে গিয়েছিলাম। পাকিস্তানের কাদিয়ানি, আহমাদিয়া, আহলে হাদীস, আহলে কোরআন এরকম যারা বিভিন্ন দলে উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে তাদেরকে যদি এক পাশে রেখে দেই, তবুও আমরা দেখতে পাই যে পাকিস্তানের বড় একটি জনগোষ্ঠী ২টি জামায়াতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একটি হল বেরেলভি, অপরটি হল দেওবন্দি। এগুলো অবিভক্ত ভারতের সময়ে এই বড় দু’টি মাদরাসার নাম ছিল। কিন্তু বেরেলভিদের অনুসারীর সংখ্যা ৭০ মিলিয়ন আর দেওবন্দিদের অনুসারীদের সংখ্যা ৪৮ মিলিয়ন। এই দুই গ্রুপের উভয় গ্রুপই মুসলমান, উভয় গ্রুপই হানাফি, উভয় গ্রুপই মাতুরিদী, উভয় গ্রুপই সুফি কিন্তু মাঝে মধ্যে তারা একে অপরের পেছনে নামাজ পর্যন্ত আদায় করে না। তাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব সম্পর্কে আমি আলোচনা করব না। ইখতিলাফের বিষয় যাই হোক না কেন, এসকল ফিরকাবাজি মুসলমানদেরকে মানায় না। ব্রিটিশরা ভারতকে শাসন (শোষণ) সময়ে বেরেলভি মাদরাসার সূচনা হয়। তারা রাসূল (সা)কে জীবিত এবং সকল স্থানে হাজির ও নাজির হিসেবে জানে। শুধুমাত্র একটি ব্যাখ্যার কারণে তারা ইখতিলাফ করে থাকে। এই সকল বিষয়সমূহ নিয়ে ইখতিলাফ করা থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন। এই সকল বিষয় ইখতিলাফের বিষয়বস্তু না হওয়া দরকার। আমি আপনাদেরকে দু’টি আকাঈদ গ্রন্থের মধ্যকার পার্থক্যকে বুঝানোর জন্য ঐ দুইটি আকাঈদ গ্রন্থের প্রথম বাক্যসমূহ আপনাদের সামনে পেশ করব। আবু মুইন আন-নাসাফির আকাঈদ গ্রন্থের প্রথম বাক্য হলো, ‘আহলে হকগণ বলেন যে, মূল বস্তুগুলো বাস্তবে বিদ্যমান। এই সম্পর্কিত জ্ঞানসমূহ সত্য। এই সকল সত্য বিষয়সমূহ সুফাস্তাইয়্যাহ সম্প্রদায় এর সম্পূর্ণ বিপরীত। আর ইলমের উৎস তিনটি। সুপ্ত পঞ্চইন্দ্রিয় এবং আকল।’ বর্তমান সময়ে সারা পৃথিবীতে একটি আকাঈদ গ্রন্থ ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে, যার প্রথম বাক্য হলো, “ঈমান ভঙের কারণ দশটি। এর প্রথমটি হলো কবরসমূহ জিয়ারত করা।” এই পার্থক্য একটু চিন্তা করুন! একটি গ্রন্থ তার প্রথম বাক্যে আমাদের শিক্ষা দিচ্ছে বিষয়সমূহের হাকিকত সম্পর্কে আর অপরটি শিক্ষা দিচ্ছে তাকফির! এই জন্য এই সকল বিষয়সমূহ মুসলিম উম্মাহর বিতর্কের বিষয়সমূহ থেকে যত দ্রুত সম্ভব বাদ দেয়া প্রয়োজন। আমাদেরকে মূলের দিকে ফিরে আসা প্রয়োজন। আমাদেরকে আমাদের মূলনীতিসমূহের দিকে ফিরে আসা প্রয়োজন। দ্বীনের মূল এবং অপরিবর্তনীয় মৌলিক বিষয়সমূহের দিকে ফিরে আসা প্রয়োজন। ব্রিটিশ শাসনামলে বেরেলভি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন আহমেদ রেজা খান। এরপরে আমজাদ আলী, আহমেদ ইয়ারখান এরা এই ধারাকে বজায় রাখেন। তারা যে সকল বিষয় নিয়ে ইখতিলাফ করে আপনারা পরে বিস্তারিত দেখে নিতে পারেন। একইভাবে দেওবন্দি মাদরাসা ইসলাহ এবং তাজদিদ এর মূলনীতি হিসেবে নিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। প্রখ্যাত দেহলভি মাদরাসা বা ধারা এই মাদরাসা থেকে বের হয়। আনোয়ার শাহ কাশ্মিরি এই ধারা থেকে বের হোন, নদভি মাদ্রাসা এই ধারা থেকে বের হয়, আজামি মাদরাসা এই ধারা থেকে বের হয় এবং পরবর্তীতে তাবলিগ জামায়াত বের হয়। আপনারা সকলেই জানেন ইউসুফ খান দেহলভির লেখা হায়াতুস সাহাবা নামক বইকে দাওয়াতের গ্রন্থ হিসেবে ব্যবহারকারী মুহাম্মাদ ইলিয়াস আলী এই তাবলিগ জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা। যেই বিষয়টি বলার জন্য আপনাদের সামনে এই উদাহরণের অবতারণা করেছি তা হলো, আজকে পাকিস্তানে দ্বীনের নিরাপত্তা ও দ্বীনি স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে এই গ্রুপসমূহ। তাদের মধ্যকার ইখতিলাফি দ্বন্দ্ব মুসলমানদেরকে আরও বেশি বিভাজিত করে রেখেছে।


বড় বড় সভ্যতার পতন শুরু হয় দ্বীনের শাখা-প্রশাখা এবং অর্থহীন বিষয়সমূহ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক এবং এই সব বিষয় নিয়ে দলাদলি করার ফলে। অর্থহীন বিষয়সমূহকে বড় করে দেখিয়ে উম্মাহকে আজ বিভক্ত করে রাখা হয়েছে। অথচ আমাদেরকে যে বিষয়টি ঐক্যবদ্ধ করে তা হলো, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। এর বাহিরে যা আছে তা সব গুরুত্বহীন। আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে ইসলামের আদালত। আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করবে আখলাক।


পাকিস্তানের মতো একই অবস্থা ইন্দোনেশিয়াতেও। ইন্দোনেশিয়াতেও রয়েছে নাহদাতুল উলামা এবং আহমাদিয়া। নাহদাতুল উলামার সদস্য সংখ্যা ৭০ মিলিয়ন, আহমাদিয়া আন্দোলনের সদস্য সংখ্যা ৫০ মিলিয়িন। উভয় সংগঠনের শত শত বিশ্ববিদ্যালয়, গ্রামে মহল্লাতে হাজার হাজার স্কুল এবং হাসপাতালসমূহ রয়েছে। এইগুলোকে কি কল্যাণের জন্য ব্যবহার করা সম্ভব? অবশ্যই সম্ভব। কখন? যখন তারা এক সাথে বসে কাজ করবে। বেহুদা বিষয়সমূহ নিয়ে বিতর্ক করা থেকে বিরত থাকবে। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত তারা এটা না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত এই সকল বিষয়সমূহ তাদের মধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি করেই যাবে। আমি শুধুমাত্র এই দু’টি উদাহরণ দিলাম। এরকম অনেক উদাহরণ সমগ্র মুসলিম উম্মাহর মধ্যেই বিদ্যমান রয়েছে। সুদান, মিসর, আফ্রিকাসহ সারা দুনিয়াতেই এর উদাহরণসমূহ রয়েছে। এই জন্য আগামী দিনে ইসলামী ঐক্য গঠনের পথে সবচেয়ে বড় বাধা এই তাফরিকা (দলাদলি)কে আমাদের খুব গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করার প্রয়োজন। বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসী তার বিখ্যাত খুতবা খুতবায়ে শামিয়েতে মুসলিম উম্মাহর তিনটি বড় সমস্যার কথা উল্লেখ করেন। এগুলো হলো, ১. তাফরিকা (দলাদলি) ২. দরিদ্রতা ৩. জেহালেত (মূর্খতা) এই তিন সমস্যা এখনো আমাদের মধ্যে বিদ্যমান। মুসলিম উম্মাহর মধ্যে এই সমস্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। তবে বিশেষ করে ইন্টারনেটের মাধ্যমে তথ্যপ্রবাহ সহজতর হওয়ার ফলে এই তাফরিকা আরও বেশি বেড়েছে। মুসলিম উম্মাহর ইসলাম সম্পর্কে ধারণা আরও ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে। তুরস্কেও ইসলামের ধারণা দিন দিন ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে। এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার জন্য, ইসলামের বিশ্বজনীন বাণীকে পুনরায় জাগ্রত করার জন্য কোরআন এবং সুন্নাহর স্থায়ী বিষয়সমূহকে মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করে এবং রাসূলে আকরাম (সা)-এর বিশ্বজনীন রহমতের বাণীকে মূলনীতি হিসেবে নিয়ে, সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে সাথে নিয়ে আমাদেরকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে। তাহলেই কেবল এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। আমি গতকাল রাতেই বলেছি, এই বিষয়ে আমাদের ওপর অনেক দায়িত্ব কর্তব্য অর্পিত হয়েছে। মুসলিম উম্মাহর কেন্দ্রে বসবাসকারী ভাইয়ের ওপরে এই ব্যাপারে অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। কেবলমাত্র মুসলিম উম্মাহর জন্য আশার প্রতীক হয়ে বসে থাকলেই চলবে না, তাদের আশার বাস্তব প্রমাণ আমাদের দিতে হবে। মুসলিম উম্মাহর বিভিন্ন প্রান্তে আমরা ভ্রাতৃত্বের বাণীকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছি এটা খুবই সুন্দর। সত্য, সুন্দর ও ভালোকে বহন করে নিয়ে যাওয়া অসাধারণ একটি বিষয়। তবে শুধুমাত্র কোরবানি নয়, কোরবানির সাথে সাথে উৎসর্গিত প্রাণকেও নিয়ে যেতে হবে, খাদ্য ও অন্যান্য পণ্যসামগ্রীর প্যাকেট বহন করাই যথেষ্ট নয় এর সাথে সাথে ইলিম এবং হিকমাহর প্যাকেটও বহন করা প্রয়োজন। আমাদেরকে জ্ঞান (ইলিম) ও হিকমাহ নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। শুধুমাত্র সুন্দরকে নয় এর সাথে মারিফত এবং শান্তিকে আমাদের সাথে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। আমাদের তুর্কির বিভিন্ন সংগঠন আফ্রিকার বিভিন্ন প্রান্তে সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে গিয়ে থাকে, কিন্তু একই সাথে তারা তাদের নিজেদের চিন্তা ও মতাদর্শকেও সেখানে নিয়ে গিয়ে থাকে। এটা কোনক্রমেই সঠিক নয়, দয়া করে মুসলিম উম্মাহর এই ক্ষতি করবেন না। যদি মধ্য এশিয়ায় সাহায্য করতে যান তাহলে তাদের প্রতিষ্ঠিত মাওয়ারাউন নাহর সভ্যতাকে পুনরায় খুঁজে পাওয়ার জন্য তাদেরকে সাহায্য করুন। দয়া করে এখান থেকে নিজেদের চিন্তা, মতাদর্শ, মাজহাব ও তারিকাতকে নিয়ে যাবেন না। যদি আফ্রিকাতে যান তাহলে দয়া করে আপনাদের নিজেদের বিশেষ ধরনের টুপি, পাগড়ি ও জুব্বাকে নিয়ে যাবেন না। কারণ তাদের স্থানীয় পোশাক তাকে আরও বেশি সুন্দর মানায়। নিজেদের সংস্কৃতি ও মাজহাবকে নিয়ে যাইয়েন না দয়া করে। সেখানে আখলাক নিয়ে যান, সেখানে আদালত নিয়ে যান। জ্ঞান (ইলিম) নিয়ে যান, হিকমাহ নিয়ে যান। আমাদের নিজেদের সমস্যা ও অসুস্থ চিন্তাকে যেন আমরা সেখানে বইয়ে না নিয়ে যাই। যদি আমরা তা করতে না পারি তাহলে মুসলিম উম্মাহর এই ভয়াবহ সঙ্কট মুহূর্তে একটি গ্রুপ (ফেতুল্লাহ গুলেন ও তার সংগঠন) ১৫ জুলাই তুর্কিতে এবং সমগ্র মুসলিম উম্মাহর যে ক্ষতি করেছে তাদের শিক্ষা থেকে আমরা কোন শিক্ষাই নিতে পারব না। তারা তাদের নিজস্ব চিন্তাকে মুসলিম দেশসমূহে নিয়ে গিয়ে মুসলিম উম্মাহর অনেক বড় ক্ষতি করেছে। তারা ইসলামের নামে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আমি পুনরায় আপনাদের এই সম্মেলনের সফলতা কামনা করে আমার এই বক্তব্য এখানেই শেষ করছি। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আপনাদের এই ঐক্যকে মুসলিম উম্মাহর ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে যেন কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে এই জন্য মহান আল্লাহর কাছে তওফিক কামনা করি। আপনাদের সকল কাজ যেন ইখলাস এবং কেবলমাত্র বারি তা’য়ালার সন্তুষ্টির জন্য হয় এবং কোন প্রকার প্রদর্শন ও দুনিয়াবি কোন উদ্দেশ্যে না হয়। আপনাদের কাজ যেন কোন প্রোপাগান্ডা ও প্রচারের জন্য না হয়, এই কাজ যেন মুসলিম উম্মাহর ঐক্য এবং ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ইটের কাজ করে এবং আমাদের সকলকে মহান আল্লাহর মুখলিস বান্দা হওয়ার তওফিক দান করেন। এই দোয়া করে আমার বক্তব্য শেষ করছি। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। (সমাপ্ত) অনুবাদক : কলামিস্ট, আঙ্কারা, তুরস্ক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির