post

বঙ্কিম

সরদার আবদুর রহমান

০১ জুন ২০২২

‘বঙ্কিম-রবি-শরৎ : একশো বছরের দায় একাই টেনেছেন নজরুল’- প্রবন্ধের শিরোনামটি প্রথমে পরিষ্কার হোক। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এবং সাংস্কৃতিক জগৎকে সমৃদ্ধ ও পরিপুষ্ট করতে যে সকল দিকপাল ব্যক্তিত্ব অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন তাদের মধ্যে চারটি নাম এই শিরোনামে যুক্ত হয়েছে। বিশেষত সমাজ ও সংস্কৃতিকে- এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনীতিকেও- তাঁরা প্রভাবিত করতে সচেষ্ট থেকেছেন। শুধু কি এই চারজনই? না, আরো অনেকে আছেন। তবে এই প্রবন্ধের আলোচ্য তারাই। মূলত কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক লড়াইয়ের প্রসঙ্গ তুলতে গিয়ে এই আলোচনার সূত্রপাত। তিনি তাঁর সময়ে একাধারে তিন তিনজন মহীরুহকে পেয়েছেন- যাদের সঙ্গে অন্তরালে এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক ও আদর্শিক যুদ্ধে মোকাবেলা করেছেন। সময়কালটা উল্লেখ করলে দেখা যাবে এরকম: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (জন্ম: ২৬ জুন ১৮৩৮ ও মৃত্যু: ৮ এপ্রিল ১৮৯৪), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (জন্ম: ৭ মে ১৮৬১ ও মৃত্যু: ৭ আগস্ট ১৯৪১), শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (জন্ম: ১৫ সেপ্টেম্বর ১৮৭৬ ও মৃত্যু: ১৬ জানুয়ারি ১৯৩৮) এবং কাজী নজরুল ইসলাম (জন্ম: ২৫ মে ১৮৯৯ ও মৃত্যু: ২৯ আগস্ট ১৯৭৬)। কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে তিনি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। অর্থাৎ জন্ম থেকে নিয়ে মাত্র ৪৩ বছর তিনি সুস্থ ছিলেন এবং সাহিত্য রচনায় সক্ষম থেকেছেন মাত্র ২৩ বছর। বঙ্কিমচন্দ্রের ১৮৩৮ থেকে নজরুলের ১৯৪২ পর্যন্ত এই শতবর্ষ সময়কালের মধ্যে এই প্রধান চার সাহিত্য স্রষ্টার দাপট বিরাজমান ছিল। বঙ্কিমচন্দ্র এবং শরৎচন্দ্র মূলত গদ্যশিল্পী। বিশেষত উপন্যাস রচনায় যশস্বী হয়েছেন। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় রাজত্ব করেছেন প্রায় সমানতালে। তবে কবিতা ও সঙ্গীত রচনার প্রধান বাহনের কারণে কবি হিসেবেই মূল পরিচয় লাভ করেছেন।

এবার আসা যাক ‘বঙ্কিম-রবি-শরৎ : একশো বছরের দায় একাই টেনেছেন ‘নজরুল’- প্রবন্ধের মূল বিষয়ের দিকে। বঙ্কিম-রবি-শরৎ এই ত্রয়ীর সাহিত্যচর্চার শিল্পগত দিক নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো প্রয়োজন নেই। নানান আলোচনা-সমালোচনার পাঠ চুকিয়ে তাঁরা খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করেছেন। তবে মূল যে বিষয়টি আমাদের আলোচ্য তা হলো তাঁদের সমাজ ও আদর্শ চেতনা। সেই সঙ্গে ভাষাচেতনার বিষয়টিও প্রাসঙ্গিক। প্রথম তিনজন চিন্তাগত দিক থেকে প্রায় সমধারার ছিলেন- একথা নতুন করে উল্লেখের প্রয়োজন নেই। একই ধর্মীয় চেতনার মানুষও ছিলেন তাঁরা। প্রসঙ্গত, একই সময়কালে আরো কয়েকজন সাহিত্যিক সমধারার ছিলেন এবং তারা তাদের রচনায় বিশেষ একটি জাতির প্রতি ভয়াবহরকম বিদ্বেষ প্রকাশ করেছেন। এদের মধ্যে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮৩৮-১৯০৩ খ্রি.), রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮২৭-৮৭ খ্রি.), ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯ খ্রি.) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। তবে এরা বাংলাদেশে সেভাবে পঠিত বা আলোচিত নন। অন্যদিকে কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন তাদের বিপরীতে ভাষা ও চিত্রকল্পের একক লড়াকু। তিনি যে কোনো ঘোষণা দিয়ে বা বিশেষ প্রস্তুতি নিয়ে এমন কিছু করেছেন তা নয়। তাঁর স্বভাবজাত বিদ্রোহচেতনাই তাঁকে সেদিকে ধাবিত করেছে। তাঁর যে ‘বিদ্রোহী’ অভিধা অর্জন তা কেবল ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লেখনীর কারণেই বলে মনে করা হয়। প্রকৃতপক্ষে তা শুধু ব্রিটিশের বিরুদ্ধেই নয়, বা শুধু সমকালীন সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ছিল না- একই সঙ্গে তাঁর স্বজাতিকে অপমান-অপদস্থ করার বিষয়টির বিরুদ্ধেও ছিল। এজন্য তিনি যেমন স্বজাতির ভাষাকে শাণিত করেছেন, উপকরণ সংগ্রহ করেছেন, লেখনীকে তীক্ষè করেছেন। স্বজাতির বুকে হাতুড়ি ঠুকেছেন তাদের বোধোদয় ঘটানোর জন্য। নজরুলের কিছু কবিতা, কিছু সঙ্গীত এবং কিছু অভিভাষণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তাঁর ভেতরে এক জ্বালা সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো উদগিরণের অপেক্ষায় ছিল। শতবর্ষ ধরে আলোচ্য তিন মহারথী লেখকের কোনো না কোনোভাবে মুসলিম জাতিকে লক্ষ্য করে রচিত রচনাবলির উপাদান নজরুলের কলমকে উসকে দেয়। যা লাভার প্রবণ আকারে প্রবাহিত করতে থাকে। উল্লিখিত লেখকদের এমত লেখার সংক্ষিপ্ত একটি বিবরণ দিয়ে তা নমুনা হিসেবে উপস্থাপন করা যাচ্ছে। আলোচ্য ত্রয়ী লেখকের বিভিন্ন রচনায় মুসলিম চরিত্রগুলোকে সচরাচর যে বিশেষণে পরিচিত করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে, ম্লেচ্ছ, যবন, নেড়ে, পাষণ্ড, পাপিষ্ঠ, পাপাত্মা, দুরাত্মা, দুরাশয়, নরাধম, নরপিশাচ, পাতকী, বানর, এঁড়ে, দেড়ে, ধেড়ে, অজ্ঞান, অকৃতজ্ঞ, ইতর, ইত্যাদি।র

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বঙ্কিমচন্দ্র তার নিজের ভাণ্ডারের সবগুলি গালিগালাজ ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে মুসলিমদের উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করেছেন ‘ম্লেচ্ছ’ হতে শুরু করে ‘যবন’ পর্যন্ত। এমনকি প্রাচীনকালে বৌদ্ধদেরকে দেয়া ‘নেড়ে’ গালিটাও দিতে বাদ রাখেনি। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘আনন্দ মঠ’ (১৮৮২) উপন্যাসে এক মন্তব্যে বলেন, ‘‘ধর্ম গেল, জাত গেল, মান গেল, কুল গেল, এখনতো প্রাণ পর্যন্ত যায়। এ নেড়েদের (মুসলমানদের) না তাড়াইলে আর কি হিন্দুয়ানি থাকে।” এমনকি গল্পের মাধ্যমে মসজিদ ভেঙে মন্দির গড়ার ইচ্ছাও প্রকাশ পেয়েছে এ উপন্যাসে; “ভাই, এমন দিন কি হইবে, মসজিদ ভাঙ্গিয়া রাধা মাধবের মন্দির গড়িব?”রর শুধু তাই নয়, তিনি ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’-এ দানেশ খাঁকে দিয়ে মুসলমানদেরকে ‘শুয়ার’ বলে গালি দিয়েছেন। ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসে কতিপয় স্ত্রীলোককে দিয়ে সম্রাট আওরঙ্গজেবের মুখে লাথি মারার ব্যবস্থা করেছেন। ‘মৃণালিনী’তে বখতিয়ার খলজীকে ‘অরণ্য নর’ বলেছেন। কবিতা পুস্তকে তিনি লিখেছেন, ‘‘আসে আসুক না আরবী বানর- আসে আসুক না পারসী পামর’’।ররর বাদশাহ আওরঙ্গজেব ও তাঁর পুণ্যবতী কন্যা জেবুন্নেসার চরিত্রহননে বঙ্কিম ছিলেন একশো কদম এগিয়ে। “সতীসাধ্বী পুণ্যবতী মুসলিম রমণীদের চরিত্রে কতখানি কলঙ্ক আরোপ করা হয়েছে তা ইতিহাসের ছাত্র মাত্রেই স্বীকার করবেন। বঙ্কিমচন্দ্র ‘লেখনী কলুষিত করিতে পারিলাম না’ বলে খেদ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু একজন লোকের নিছক মুসলিম বিদ্বেষের কারণে বিবেক ও রুচি কতখানি বিকৃত ও ব্যাধিগ্রস্ত হলে কোনো অন্তঃপুরবাসিনী, পর্দানশীন, সতীসাধ্বী, দ্বীনদার, খোদাভীরু ও মুসলিম রমণীর চরিত্র তিনি এমনভাবে কলঙ্কিত করতে পারেন তা পাঠকের বুঝতে বাকি থাকার কথা নয়।”রা “...জেল, ফাঁসি, দ্বীপান্তর, স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বাজেয়াপ্তকরণ এবং ইংরেজ কর্তৃক অন্যান্য নানাবিধ অমানুষিক-পৈশাচিক অত্যাচারে মুসলিম সমাজদেহ যখন জর্জরিত, সে সময় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখনির মাধ্যমে নির্মম আঘাত শুরু করেন মুসলিম জর্জরিত দেহের ওপর। তিনি তাঁর আনন্দমঠ, রাজসিংহ, দুর্গেশনন্দিনী, দেবী চৌধুরাণী প্রভৃতি উপন্যাসগুলোতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ সৃষ্টি এবং তার বর্ণনামতে মুসলমান কর্তৃক ‘হিন্দু মন্দির ধ্বংস’, ‘হিন্দু নারী ধর্ষণ’ প্রভৃতি উক্তির দ্বারা হিন্দুজাতির প্রতিহিংসা বহ্নি প্রজ্বলিত করার সার্থক চেষ্টা করা হয়েছে।”া বঙ্কিমচন্দ্র ঢাকা সফর শেষে কলকাতা গিয়ে পূর্ব বঙ্গের মুসলিমদেরকে কাক ও কুকুরের সঙ্গে তুলনা করে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় লিখেছেন, “ঢাকাতে দুই-চার দিন বাস করিলে তিনটি বস্তু দর্শকদের নয়ন পথের পথিক হইবে- কাক, কুকুর এবং মুসলমান। এই তিনটি সমভাবে কলহপ্রিয়, অতি দুর্দম, অজেয়। ক্রিয়া বইড়তে কাক আর কুকুর, আদালতে মুসলমান।”ার

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্কিম বাবুর মত না হলেও পিছিয়ে ছিলেন না। ‘রীতিমত নভেল’ ছোটগল্পের প্রথম পরিচ্ছেদ শুরুই করেছেন এভাবে: “আল্লা হো আকবর শব্দে বনভূমি প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিয়াছে। একদিকে তিন লক্ষ যবনসেনা, অন্যদিকে তিন সহস্র আর্য সৈন্য। বন্যার মধ্যে একাকী অশ্বথ-বৃক্ষের মতো হিন্দু বীরগণ সমস্ত রাত্রি এবং সমস্ত দিন যুদ্ধ করিয়া অটল দাঁড়াইয়া ছিল, কিন্তু এইবার ভাঙিয়া পড়িবে তাহার লক্ষণ দেখা যাইতেছে। এবং এই সঙ্গে ভারতের জয়ধ্বজ্জা ভূমিস্মাৎ হইবে এবং আজিকার এই অস্তাচলের সহস্র রশ্মির সহিত হিন্দুস্থানের গৌরবসূর্য চিরদিনের মতো অস্তমিত হইবে।”ারর ‘হর হর বোম বোম’। পাঠক বলিতে পার কে এ দৃপ্ত যুবা পঁয়ত্রিশ জন মাত্র অনুচর লইয়া মুক্ত অসি হস্তে অশ্বারোহণে ভারতের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর করনিক্ষিপ্ত দীপ্ত বজ্রের ন্যায় শক্রসৈন্যের উপরে আসিয়া পতিত হইল, বলিতে পার কাহার প্রতাপে এই অগণিত যবনসৈন্য প্রচণ্ড বাত্যাহৃত অরণ্যানীর ন্যায় বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিল? কাহার বজ্রমন্দ্রিত ‘হর হর বোম বোম’ শব্দে তিন লক্ষ ম্লেচ্ছ কণ্ঠের ‘আল্লা হো আকবর’ ধ্বনি নিমগ্ন হইয়া গেল?”াররর রবিঠাকুর তাঁর বিশাল গল্পভাণ্ডারে কোনো মুসলিম তরুণ-যুবক বা হিরোকে নায়ক করতে আগ্রহী হননি। দু’চারটে চরিত্র যা এনেছেন পিয়ন-চাপরাশি-পাহারাদার গোছের মাত্র। রবি ঠাকুর তাঁর ‘দূরাশা’ গল্পে অত্যন্ত চতুর ও সুনিপুণ কায়দায় মুসলমানদের চরিত্রের উপর এক হাত নেওয়ার এবং হিন্দু চরিত্রের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি তুলে ধরার প্রচেষ্টা নিয়েছেন। গল্পে মুসলিম নবাবকে বিশ্বাসঘাতক, ইংরেজ অনুগত এবং কাপুরুষ হিসেবে চিত্রিত করা, হিন্দু ব্রাহ্মণ যুবককে বীর ও দৃঢ় চরিত্রের তুলে ধরা, গল্পের নায়িকা মুসলমান হলেও হিন্দু ধর্মীয় আচারের প্রতি গভীরভাবে আগ্রহী করে দেখানো এবং মুসলিম রমণী হয়েও হিন্দু সেনাধ্যক্ষের প্রতি প্রগাঢ় প্রেম, মুসলমানদের জোরপূর্বক ব্রাহ্মণ কন্যাকে বিবাহ করা প্রভৃতি বহুবিধ বিষয় উপস্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি নবাব কাদের খানের কন্যার জবানিতে বলেছেন, ‘আমরা হিন্দু দাসীর নিকট হিন্দু ধর্মের সমস্ত আচার-ব্যবহার, দেবদেবীর সমস্ত আশ্চর্য কাহিনি, রামায়ন-মহাভারতের সমস্ত অভূতপূর্ব ইতিহাস তন্নতন্ন করিয়া শুনিতাম, শুনিয়া সেই অন্তঃপুরের প্রান্তে বসিয়া হিন্দুজগতের এক অপরূপ দৃশ্য আমার সম্মুখে উদঘাটিত হইত। মূর্তি, প্রতিমূর্তি, শঙ্খঘণ্টা-ধ্বনি, স্বর্ণচূড়াখচিত দেবালয়, ধুপধুনার ধুম, অগুরুচন্দনমিশ্রিত পুষ্পরাশির সুগন্ধ, যোগীসন্ন্যাসীর অলৌকিক ক্ষমতা, ব্রাহ্মণ্যের অমানুষিক মাহাত্ম্য, মানুস ছদ্মবেশধারী দেবতাদের বিচিত্র লীলা- সমস্ত জড়িত হইয়া আমার নিকটে এক অতি পুরাতন, অতি বিস্তীর্ণ, অতি সুদূর অপ্রাকৃত মায়া লোক সৃজন করিত, আমার চিত্ত যেন নীড়হারা ক্ষুদ্র পক্ষীর ন্যায় প্রদোষকালের একটি প্রকাণ্ড প্রাচীন প্রাসাদের কক্ষে কক্ষে উড়িয়া উড়িয়া বেড়াইত। হিন্দু সংসার আমার বালিকাহৃদয়ের নিকট একটি পরম রমণীয় রূপকথার রাজ্য ছিল।’রী রবিঠাকুর তাঁর ‘শিবাজী উৎসব’ কবিতা লিখেও হিন্দু পুনরুজ্জাগরণের পক্ষে তাঁর ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটকে প্রতাপাদিত্যের মুখ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলাচ্ছেন- “খুন করাটা যেখানে ধর্ম, সেখানে না করাটাই পাপ। যে মুসলমান আমাদের ধর্ম নষ্ট করেছে তাদের যারা মিত্র তাদের বিনাশ না করাই অধর্ম।” রবীন্দ্রনাথের ব্রিটিশ-ভক্তি ও মুসলিম বিদ্বেষের নজির মেলে তাঁর ‘কণ্ঠরোধ’ (ভারতী, বৈশাখ-১৩০৫) নামক প্রবন্ধে। তিনি লিখেছেন, “কিছুদিন হইল একদল ইতর শ্রেণীর অবিবেচক মুসলমান কলিকাতার রাজপথে লোষ্ট্রখণ্ড হস্তে উপদ্রবের চেষ্টা করিয়াছিল। তাহার মধ্যে বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে- উপদ্রবের লক্ষ্যটা বিশেষ রূপে ইংরেজদেরই প্রতি। তাহাদের শাস্তিও যথেষ্ট হইয়াছিল। প্রবাদ আছে- ইটটি মারিলেই পাটকেলটি খাইতে হয়; কিন্তু মূঢ়গণ (মুসলমান) ইটটি মারিয়া পাটকেলের অপেক্ষা অনেক শক্ত শক্ত জিনিস খাইয়াছিল।”

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলাদেশে এক সময় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস বিপুলভাবে পঠিত হয়েছে। কিন্তু তাঁর লেখাতেও মুসলিম বিদ্বেষ বিদ্যমান। তার হিন্দু সাম্প্রদায়িক চেতনার প্রমাণ মেলে ‘বর্তমান হিন্দু-মুসলমান সমস্যা’ নামক প্রবন্ধে। উক্ত প্রবন্ধে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মুসলিমদের ‘পাণ্ডা’ বলে সম্বোধন করেন। তিনি লিখেছেন: “হিন্দুস্থান হিন্দুর দেশ। হিন্দু-মুসলমান-মিলন একটা গালভরা শব্দ। বস্তুত, মুসলমান যদি কখনও বলে, হিন্দুর সহিত মিলন করিতে চাই, সে যে ছলনা ছাড়া আর কি হইতে পারে, ভাবিয়া পাওয়া কঠিন।” “একদিন মুসলমান লুণ্ঠনের জন্যই ভারতে প্রবেশ করিয়াছিল, রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য আসে নাই। সেদিন কেবল লুট করিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই, মন্দির ধ্বংস করিয়াছে, প্রতিমা চূর্ণ করিয়াছে, নারীর সতীত্ব হানি করিয়াছে, বস্তুত অপরের ধর্ম ও মনুষ্যত্বের পরে যতখানি আঘাত ও অপমান করা যায়, কোথাও কোন সঙ্কোচ মানে নাই।”ীর তাই তাকে নিয়ে আহমদ ছফা বলেছেন, “এই রকম সাম্প্রদায়িক রচনা শরৎবাবুও লিখতে পারেন আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছে।”ীরর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর লেখকজীবনের প্রথম দিকে যথেষ্ট উদারতার পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুসলিম বিদ্বেষ তিনি চাপা দিয়ে রাখতে পারেননি। তিনি তাঁর উপন্যাসে মুসলমানদের ‘যবন’ এবং হিন্দুদের ‘বাঙালি’ বলে পরিচিত করতে ভোলেননি। তিনি তাঁর এক প্রবন্ধে লেখেন “হিন্দুস্তান হিন্দুর দেশ। সুতরাং এদেশকে অধীনতার শৃঙ্খল হইতে মুক্ত করিবার দায়িত্ব একা হিন্দুরই। মুসলমান মুখ ফিরাইয়া আছে তুরস্ক ও আরবের দিকে, এদেশে তাহার চিত্ত নাই।”ীররর

কাজী নজরুল ইসলাম উপরের উদ্ধৃতিসমূহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রায় শতবর্ষজুড়ে মুসলমানদেরকে সাহিত্যক্ষেত্রে কী এক দুঃসহ বিরুদ্ধতা ও প্রতিকূলতার মধ্যে দিনাতিপাত করতে হয়েছে। এর জবাব দেওয়ার যেন কেউ নেই। দু’একজন থাকলেও শিল্পসম্মতভাবে এবং ততোধিক বলিষ্ঠতায় বিপরীতে দাঁড়ানোর লোক ছিল না। সেই অভাব পূরণ করলেন কাজী নজরুল ইসলাম। বলতে গেলে দুহাতে দুধারী তলোয়ার চালালেন- অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে, যথাযোগ্যভাবে এবং দক্ষতার প্রমাণ সহকারে। আগেই বলেছি, ইতিহাস-ঐতিহ্যের চেতনা একটি জাতিসত্তাকে উজ্জীবিত করে, প্রেরণা জোগায়। যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়ের প্রেক্ষিতে কখনো সঙ্কটে, বিপদে কিংবা পদস্খলনের মুহূর্তে। কবি কাজী নজরুল ইসলাম সেই মহান ও গুরুদায়িত্ব পালন করতে কার্যত এক ঐতিহাসিক ভূমিকায়ই নিয়েছিলেন। কি সাহিত্য বিচারে, কি ভাষায় আর কি বিষয়ের উপকরণে- তিনি আমাদের সামনে ঐতিহ্যের আলোকবর্তিকা হয়েই আবির্ভূত হয়েছিলেন। একটি প্রায় বিরুদ্ধ ও বিপরীত ঐতিহ্যের প্লাবনে একেবারে গা ভাসানোর কবল থেকে রক্ষা পেতে নজরুল-স্রােত অনেকাংশেই প্রতিরোধক ও প্রতিষেধকের কাজ করেছে- একথা বলতে দ্বিধা নেই। রবি-কিরণের অত্যুজ্জ্বল ছটা যখন আমাদের দৃষ্টি বিভ্রম ঘটাতে উদ্যোগী এবং দিক-ভ্রান্তি আমাদের প্রায় পেয়ে বসেছিল ঠিক সে সময়টিতেই নজরুলের পাল্লা দিয়ে সামনে এসে দাঁড়ানোর ঘটনাকে হালকা করে দেখার উপায় নেই।

উত্থানের প্রেক্ষাপট কবি নজরুল কি শুধু ব্রিটিশখেদাও কর্মসূচিতে শামিল হয়ে বিদ্রোহী কিংবা অগ্নিবীণা রচনা করেছিলেন? না, তিনি এতটুকুতে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। বিদ্রোহী ছিলেন, একই সঙ্গে সে সময়ের স্বার্থপর রাজনীতি, কূপমণ্ডূক ধর্মীয় সম্প্রদায়- কি হিন্দু, কি মুসলমান, আত্মকেন্দ্রিক মৌলবী ও পুরোহিতসহ সমাজ নিয়ন্ত্রক শক্তি প্রভৃতির বিরুদ্ধে একসঙ্গে, একই কলমের অস্ত্রাঘাত তিনি করেছিলেন। আবার, এই জাগরণ ও আক্রমণমূলক কৌশলে তিনি যেমন ইসলামী ঐতিহ্যের প্রতি আহবান জানান মুসলমানদেরই ভাষা ও ধর্মীয় মূল্যবাধের আলোকে। আবার, হিন্দু সম্প্রদায়কেও জাগাতে চেষ্টা করেন তাদের নিজস্ব বাণী ব্যবহার করে। এসবই ছিল একজন কবি হিসেবে সর্বজনগ্রাহ্য, সর্বস্পর্শী মানুষের কাজ। এর পাশাপাশি তিনি নিজ জাতির প্রতি ব্যক্তির ভূমিকা উপেক্ষা করতে পারেননি। দীর্ঘ পরাধীন জাতির হীনম্মন্যতা, অশিক্ষা কিংবা কুশিক্ষার প্রভাবমণ্ডিত নিজের মানুষের পশ্চাৎপদতা ও হীনম্মন্যতা তিনি সহ্য করতে পারেননি। গানে, কবিতায়, ব্যঙ্গ রচনায়, অভিভাষণে নজরুল আঘাত করতে চেয়েছেন বারবার। ভাষা ও সাহিত্যের মাধ্যমে মুসলমানদের প্রতিও দায়িত্ব পালন করেন তাঁর সৃষ্টিশীল রচনার মাধ্যমে। বলাবাহুল্য, এসবই ছিল একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অংশ। নজরুল-উত্থান প্রসঙ্গে ‘কাজী নজরুল ইসলাম ও এক মহান কবি পুরুষ’ শীর্ষক প্রবন্ধে কবি আল মাহমুদ বলেন, “...তিনি যে সম্প্রদায়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সে সম্প্রদায়ের তৎকালীন রাজনৈতিক ও বৈষয়িক পরাজয়ের ক্ষোভ, সামাজিক অধঃপতনের ক্ষোভ ধারণ করেছিলেন তাঁর হৃদয়ের অন্তঃস্থলে। মুঘল রাজশক্তির পতনের পর সিপাহি বিদ্রোহও যখন নিরাশার মধ্যে অবসিত হলো তখন থেকেই এই যুক্তিহীন ক্ষুব্ধ বিবেক কাজ করছিল পরাজিত মুসলিম যুবকদের মধ্যে। ...পরবর্তীকালে, একটু বিলম্বে হলেও সাহিত্যের জগতে প্রতিরোধ গড়ে তুলেন কাজী নজরুল ইসলাম। যাকে বলে কার্যকর প্রতিরোধ। রাজনীতি, ধর্ম কিংবা সাহিত্য অথবা সামাজিক আচরণে তৎকালীন বাঙালি মুসলমানের যুবশক্তি, তারা আরবী, ফারসী কিংবা ইংরেজি- যে শিক্ষায় শিক্ষিত হোন না কেন, উপরোক্ত বিদ্রোহী মনোভাব বহন করে চলেছিলেন। নজরুল যেহেতু ছিলেন কবি, সে কারণে তাঁর বিস্তার ঘটেছিল অবিশ্বাস্য দ্রুততায়।”ীরা নজরুলের উত্থানের এই পটভূমি সম্পর্কে আরো অনেক উদ্ধৃতি দেয়া যায়। কিন্তু এখানে সে সুযোগ কম। নজরুলের রচনাবলিই উপরোক্ত উদ্ধৃতি সমূহের সঙ্গে সমর্থন যোগাতে যথেষ্ট বলে মনে করি। এ কথাও উল্লেখ করার মতো যে, নজরুল শুধু রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় চেতনার উদ্বোধন করেননি, মানুষের অন্তরাবেগকে সৌন্দর্য ও সুষমামণ্ডিত এবং মধ্যযুগীয় বিকৃত কাব্যকলার কবল থেকেও রক্ষা করেছেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে। রথী-মহারথী লেখক-সাহিত্যিকদের কলমযুদ্ধের মোকাবেলা করেও কার্যত তিনি ভাষাসত্তার অস্তিত্ব রক্ষায় এক যুগান্তকারী অধ্যায় রচনা করেছেন। এটা নজরুলের সাংস্কৃতিক আন্দোলনেরই অংশ বৈকি। মুসলিম চেতনাকে জাগ্রত করতে কবি নজরুলের আহবান ছিল খুবই উদ্দীপক। ১৩৪৩ বঙ্গাব্দে ফরিদপুরে ছাত্রদের সম্মেলনে ‘বাংলার মুসলিমকে বাঁচাও’ শীর্ষক এক অভিভাষণে ডাক দিয়ে তিনি সে সময়ের জন্য অভাবনীয় শব্দমালার প্রয়োগ করেন। তিনি উচ্চারণ করেন, “কোথায় গেল শমসের, কোথায় সে বাজু, সেই দরাজ দস্ত? বাঁধো আমামা, দামামায় আঘাত হানো আর একবার তেমনি করে। যে কওম- যে জাতি চলেছে গোরস্থানের পথে, ফেরাও তাকে সেই পথে যে পথে তারা একদিন পারস্য সা¤্রাজ্য, রোম সা¤্রাজ্য জয় করেছিল, আঁধার বিশ্বে তৌহিদের বাণী শুনিয়েছিল। তোমাদের মাঝে থেকে বেরিয়ে আসুক তোমাদের ইমাম- দাঁড়াও তার পতাকা তলে তহরিমা বেঁধে। বলো আল্লাহু আকবার, হাঁকো হায়দারী হাঁক- সপ্ত আসমানে চাক হয়ে ঝরে পড়ুক খোদার রাহমাত, নবীর দোওয়া, চাঁদ-সেতারা গড়ে পড়ুক, কল্যাণের পাগল ঝোরা।”ীা আলোচ্য ত্রয়ী লেখক স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের ধর্ম, সমাজ, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও কিংবদন্তিকে তাঁদের রচনার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সেটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু সমালোচনার বিষয় হলো তাঁরা তাদের রচনায় মুসলমানদের ভাষা, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ব্যঙ্গ ও কটাক্ষ করেছেন। নজরুল তাঁর কাজের মধ্যে পৃথক ও নিজস্ব ধারা রচনা করে এর মোক্ষম জবাব দিয়েছেন। বলতে গেলে সম্পূর্ণ একটি স্রােতধারা সৃষ্টি করেছেন। ত্রয়ী লেখকদের যুগের অবসান ঘটাতে প্রয়াস পেয়েছেন। কবিতায় তিনি একইভাবে আপন ইতিহাসের উপকরণ ও বিপুল শব্দ-সম্ভার ব্যবহার করেছেন তার কয়েকটি নমুনা: ‘খেয়াপারের তরণী’ কবিতায় তিনি ইসলামকে নৌকার সঙ্গে এবং মুসলিমদেরকে যাত্রীর সঙ্গে তুলনা করে বলেন: ‘পুণ্য পথের এ যে যাত্রীরা নিষ্পাপ ধর্মেরি বর্মে সুরক্ষিত দিল-সাফ। নহে এরা শঙ্কিত বজ্র-নিপাতেও কান্ডারী আহমদ, তরী ভরা পাথেয়। আবু বকর উসমান উমর আলী হায়দার দাঁড়ি যে এ তরীর, নাই ওরে নাই ডর। কান্ডারী এ তরীর, পাকা মাঝি মাল্লা দাড়ি মুখে সারি গান-লা শরীক আল্লা।

কবি শুধু উদ্দীপনার বাণী নয়, মুসলমানদের ঐতিহ্যচ্যুতি, চারিত্রিক পতনের বিষয়েও ধাক্কা দিয়েছেন। আঘাত করেছেন হৃদয়তন্ত্রীতে। ‘খালেদ’ কবিতায় তিনি বলেন : ‘তোমার ঘোড়ার ক্ষুরের দাপটে মরেছে যে পিপীলিকা, মোরা আজ দেখি জগৎ জুড়িয়া তাহাদেরি বিভীষিকা হঠিতে হঠিতে আসিয়া পড়েছি আখেরি গোরস্থানে, মগরেব বাদে এশার নামাজ পাব কিনা কে সে জানে। খালেদ! খালেদ! বিবস্ত্র মোরা পরেছি কাফন শেষে, হাতিয়ার হারা, দাঁড়িয়েছি তাই তহরিমা বেঁধে এসে।

‘চির-নির্ভয়’ কবিতার ক’টি পঙক্তি: “আমি আল্লাহর সৈনিক, মোর কোন বাধা ভয় নাই, তাঁহার তেজের তলোয়ার সব বন্ধন কেটে যায়। তুফান আমার জন্মের সাথী, আমি বিপ্লবী হাওয়া, জেহাদ, জেহাদ, বিপ্লব, বিদ্রোহ, মোর গান গাওয়া।”

নজরুল ইসলামের বাণী প্রচারে বৈপ্লবিক কর্মপদ্ধতির যে দিক দিশা দিয়েছেন তাও উল্লেখযোগ্য। ‘এক আল্লাহ জিন্দাবাদ’ কবিতায় তিনি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন: “উহারা প্রচার করুক হিংসা বিদ্বেষ আর নিন্দাবাদ, আমরা বলিব ‘সাম্য, শান্তি, এক আল্লাহ জিন্দাবাদ। নিত্য-সজীব যৌবন যার এসো এসো সেই নওজোয়ান, সর্ব্বক্লৈব্য করিয়াছে দূর তোমাদেরই চির আত্মদান। ওরা কাদা ছুড়ে বাধা দিবে-ওদের অস্ত্র নিন্দাবাদ, মোরা ফুল ছুঁড়ে মারিব ওদের, বলিব, আল্লাহ- জিন্দাবাদ।”

কবিতা ছাড়াও অসংখ্য গানে কবি নজরুল তৎকালের মুসলিম জাতিকে তার সাংস্কৃতিক সত্তার জাগরণে বজ্রনির্ঘোষ বাণী প্রচার করেছেন। তার এ ধরনের বিখ্যাত গানের স্রােতধারা আজও আমাদের অস্তিত্বে আছাড় মারে। যেমন- “দিকে দিকে পুনঃ জ্বলিয়া উঠেছে। দ্বীন-ইসলামী লাল মশাল, ও রে বেখবর তুইও ওঠ জেগে তুইও তোর প্রাণ-প্রদীপ জ্বাল।” কিংবা- “সত্য-মুক্তি স্বাধীন জীবন লক্ষ্য শুধু যাদের, খোদার রাহায় প্রাণ দিতে আজ ডাক পড়েছে তাদের।” অথবা- “বাজিছে দামামা, বাঁধরে আমামা শির উঁচু করি মুসলমান, দাওয়াত এসেছে নয়া জামানার ভাঙ্গা কেল্লায় ওড়ে নিশান।”

নজরুলের সেই বিখ্যাত গান : “শহীদি ঈদগাহে দেখ আজ জমায়েত ভারী হবে দুনিয়াতে ফের ইসলামী ফরমান জারী’ কিংবা : “তওফীক দাও খোদা ইসলামে মুসলিম জাঁহা পুনঃ হোক আবাদ দাও সেই বাহু, সেই দিল আজাদ।”

কবি জেগে ঘুমানোর দলকে আজানের ধ্বনি দিয়ে জাগিয়ে দেবার আহ্বান জানাচ্ছেন: “আঁধার মনের মিনারে মোর হে মুয়াজ্জিন দাও আজান, গাফেলতির ঘুম ভেঙ্গে দাও হউক নিশি অবসান। আল্লাহ নামের যে তকবীর ঝর্ণা বহে পাষাণ চিরে শুনি সে তকবীরের আওয়াজ জাগুক আমার পাষাণ প্রাণ।”

কাজি নজরুল ইসলাম শুধু শব্দ বাছাইয়ে নয়- বিষয়বস্তু চয়নেও ঐতিহ্যবাদের স্বাক্ষর রেখেছেন। অজ¯্র নমুনা তিনি পেশ করেছেন এক্ষেত্রে। গবেষক-লেখক মুনীর চৌধুরীর একটি উদ্ধৃতি দিয়ে এই প্রবন্ধের ইতি টানবো। তিনি বলেন, “.... তার ঐতিহ্যবোধ ছিল জীবন-সম্পৃক্ত। অতীতকে তিনি নকল করেননি, ঐতিহ্যকে আউড়ে যাননি, তাকে নবরূপ দান করেছেন, বর্তমানের সঙ্গে তার সেতুবন্ধন ঘটিয়েছেন, অনাগত দিনের স্বপ্ন সম্ভাবনায় তাকে ঐশ্বর্যশালী করে তুলেছেন।”ীার

তথ্যসূত্র:

i) ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান: আধুনিক বাংলা কাব্যে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক, প্রথম প্রকাশ, ঢাকা, বাংলা একাডেমি, ১৯৭০। ii) বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়: আনন্দমঠ, তৃতীয় খণ্ড, অষ্টম পরিচ্ছেদ। iii) মুকুল চৌধুরী: ‘আফজাল চৌধুরীর শেষ কবিতা’ শীর্ষক প্রবন্ধ, দৈনিক সংগ্রাম, ঈদসংখ্যা-২০১২। iv) আব্বাস আলী খান: বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, পৃ. ১২০। v) প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৯। vi) বঙ্গদর্শন, সপ্তম বর্ষ, সংখ্যা ৮০, কলকাতা, পৃ. ৩৭৮। vii) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : গল্পগুচ্ছ। viii) প্রাগুক্ত। ix) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : দূরাশা, গল্পগুচ্ছ। x) রবীন্দ্র রচনাবলী, ১০ খণ্ড, পৃ. ৪২৮। xi) শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়: ‘বর্তমান হিন্দু-মুসলমান সমস্যা’ শীর্ষক প্রবন্ধ। xii) আহমদ ছফা: যদ্যপি আমার গুরু, পৃষ্ঠা ৫৬। xiii) রিয়াজউদ্দীন আহম্মদ ও মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী সম্পাদিত: সাপ্তাহিক সুলতান, ১৯২৩ জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা। xiv) আল মাহমুদ: ‘কাজী নজরুল ইসলাম ও এক মহান কবি পুরুষ’ শীর্ষক প্রবন্ধ। xv) কাজী নজরুল ইসলাম: ‘বাংলার মুসলিমকে বাঁচাও’ শীর্ষক অভিভাষণ। xvi) মুনীর চৌধুরী: ‘নজরুল-কাব্যে মুসলিম ঐতিহ্যের রূপায়ণ’ শীর্ষক প্রবন্ধ।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গ্রন্থপ্রণেতা

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির