post

বাংলাদেশের রাজনীতির রহস্যপুরুষ ও তার রহস্য উন্মোচন

সরদার আবদুর রহমান

২২ এপ্রিল ২০২৩

কোনো মানুষের ‘রহস্যপুরুষ’ কিংবা ‘কাপালিক’ আখ্যা পাওয়া তার কোনো ইতিবাচক পরিচয় বহন করে না। এ ধরনের উপাধি পাওয়া মানুষদেরকে সাধারণভাবে ‘ষড়যন্ত্রকারী’ অথবা ‘জাদুটোনাকারী’ হিসেবে মনে করা হয়ে থাকে। সম্প্রতি এমন একজন মানুষের জীবনের ইতি ঘটেছে। যিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে কারো নিকট ‘মহানায়ক’ এবং কারো নিকট ‘খলনায়ক’ হিসেবে পরিচিত। তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের পঞ্চাশ থেকে সত্তর দশক পর্যন্ত অন্তরালে থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ থেকে সমাজতন্ত্রের উগ্রবাদী রাজনীতিতে প্রভাবক হিসেবে ভূমিকা পালনকারী সিরাজুল আলম খান। একথা অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সিরাজুল আলম খানের বড় অবদান রয়েছে। তবে তিনি রাজনীতির ‘রহস্যপুরুষ’ খেতাব পান স্বাধীনতার পরে। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি ‘সরোজ দা’ ছদ্মনামে চলাফেরা করতেন বলে দলের মধ্যে ‘দাদা’ হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। সিরাজুল আলম খানের উগ্রবাদী চেতনার ধারাবাহিকতায় বহুসংখ্যক অঘটন রাজনীতিতে সংঘটিত হতে থাকে। যেগুলো পরবর্তীকালে ধর্মনিরপেক্ষ ও বাম রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত হয়ে যায় এবং সেগুলো বিপুল মাত্রায় অনৈতিক ও অগণতান্ত্রিক হলেও নিছক ‘কৌশল’ হিসেবে পার পেয়ে যায়। এখানে তার কিছু নমুনা সংক্ষিপ্তাকারে উল্লেখ করা হলো।


ভারতীয় আধিপত্যের শেকড় স্থাপন

বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ের মূল দুটি ধারা বিরাজমান ছিল। একটি ছিল দেশকে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম ভূখণ্ড হিসেবে পৃথক সত্ত্বা হিসেবে রক্ষার লড়াই। অপরটি ছিল একে পাকিস্তান থেকে স্বাধীন করার নামে ভারতের আধিপত্যের দিকে ঠেলে দেওয়া। সিরাজুল আলম খান ছিলেন দ্বিতীয় ধারার নেতৃত্বে। তথ্যে জানা যায়, পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র চার বছরের মাথায় ১৯৫১ সালের শেষদিকে বিশেষ এ্যাসাইমেন্ট নিয়ে চিত্তরঞ্জন সুতার নামে এক ব্যক্তি তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে প্রবেশ করেন। তার সাথে ছিলেন কালিদাস বৈদ্য ও নিরোদ মজুমদার। তারা রিচার্স এন্ড এনালাইসিস উইং (‘র’) এর কর্মকর্তা ছিলেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানকে ভাঙা। এই চিত্তরঞ্জন আওয়ামী লীগের ব্যানার ব্যবহার করে রাজনীতি করেন। একাত্তরে বাংলাদেশকে ভারতের সাথে সংযুক্ত করে দেয়ার জন্য ইন্দিরাকে অনুরোধকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন। আশির দশকে বাংলাদেশের দক্ষিনাঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য ‘স্বাধীন বঙ্গভূমি’ নামে যে আন্দোলন হয় তারও নেতৃত্ব এরাই দিতেন। চিত্তরঞ্জন সুতার পরে বাংলাদেশের এমপিও নির্বাচিত হন।

মহিউদ্দিন আহমদ তাঁর গবেষণায় ডা. আবু হেনার সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয় উল্লেখ করেন। এতে আবু হেনা বলেন, আমি সিরাজ ভাইয়ের (সিরাজুল আলম খান) খুব কাছের লোক। সব ঘটনার সূত্রপাত আমি জানতাম। ওনাদের সঙ্গে ভারত সরকারের একটা সম্পর্ক ছিল। এই গ্রুপের সঙ্গে এখানে নেটওয়ার্কে যারা কাজ করত, তার মধ্যে রূপলাল হাউসের জমিদার, শ্যামবাজারের জমিদার-তার ছেলে রূপা মুখার্জিরে বিয়া কইরা এখানে থাকতেছে। কালিদাস বৈদ্য একটা রাজনৈতিক দল বানাইছিল, গণমুক্তি দল। সেই দলে ছিল চিত্ত সুতার। পরে কলকাতায় চিত্ত সুতারের ওখানে গিয়া এদের সবার সঙ্গে পরিচয় হইছে। এই নেটওয়ার্কের সঙ্গে সিরাজদের একটা সম্পর্ক ছিল। এই নেটওয়ার্কের কাজ কী ছিল? টু ডিস্টার্ব ইস্ট পাকিস্তান। তারা বলত, ইস্ট পাকিস্তানে হিন্দুদের-মাইনরিটিকে অত্যাচার করা হচ্ছে। তাদের জন্য সেপারেট এনটিটি তৈরি করা দরকার। ‘স্বাধীন বঙ্গভূমি’ বানানোর জন্য ম্যাপ তৈরি হইছিল ইন্ডিয়ায়। আমি জানি এইগুলো। মুজিব ভাই জানত। তাজউদ্দীনও জানত। আইয়ুব খান এটা জানতে পারছে, চিত্ত সুতারকে ধইরা জেলে পুরছে। জেল থিকা মুক্ত হইলে মুজিব ভাই ডাইকা পাঠাইল, ‘তুমি হিন্দু হিন্দু করতেছ, আমি বাঙালি বাঙালি করতেছি। আমার পক্ষে তুমি কাজ করো। তুমি ইন্ডিয়া চইলা যাও।’ চিত্ত সুতার কলকাতায় পাটের অফিস নাম দিয়া একটা বাড়িতে থাকে। ইন্ডিয়া বলছে, ‘তুমি তো আমাদের লোক। তাদের একজন লোক দাও।’১ 

চিত্তরঞ্জনের মতো এরকম স্পষ্টতই ‘র’-এর এজেন্টের সাথে সিরাজুল আলম খানের সম্পর্ক ছিল একাত্তর পরবর্তীতেও। জাসদের সাথে মুজিব সরকারের ঝামেলার সময়ে বেশ কয়েকবার ভারত যান তিনি। থাকতেন চিত্ত সুতারের বাড়িতে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে কিংবা পরে সিরাজুল আলম খানের জন্য ভারতের দরোজা ছিল অবারিত। সকাল-বিকাল যাতায়াতের মতো ব্যাপার ছিল। বলা যায় বাংলাদেশে যারা ভারতীয় স্বার্থ হাসিলের কাজ করেছে তারমধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। ভাষ্যকাররা মনে করেন, একাত্তরে ভারতের শাসকেরা চেয়েছিল একটি খণ্ড, কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশ— যে বাংলাদেশ নামে স্বাধীন কিন্তু প্রকৃত অর্থে ভারতের শাসক ও শোষকদের তাবেদারি করবে। এইক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশের স্বাধীনচেতা জনগণ। ভারতের শাসকদের দরকার ছিল এমন একটি নেকড়ের, যে একইসঙ্গে হিংস্র এবং প্রভুভক্ত। যে ষড়যন্ত্রে এবং ছদ্মবেশ ধারণে দক্ষ ও কূটকৌশলী। আমাদের রাজনৈতিক প্রাঙ্গনে সেই ছদ্মবেশী নেকড়েটি ছিল সিরাজুল আলম খান।


জনসভায় হামলা ও হত্যার সূচনা

প্রতিটি রাজনৈতিক দলের জনসভা করে সাধারণ মানুুষকে দলের কার্যক্রমের প্রতি আহ্বান জানানো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ। এই প্রক্রিয়া ধ্বংসের সূচনা হয় বলতে গেলে সিরাজুল আলম খানের হাত ধরেই। শুধু সভা পণ্ড করা নয়— একটি ঘটনায় দুজন নিরীহ মানুষকে হত্যা ও বহুসংখ্যককে আহত করা হয়। বলা বাহুল্য, তখন পর্যন্ত ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র নামে কোনো চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার অবকাশ তৈরি হয়নি। সিরাজুল ইসলাম খানের জীবনী রচয়িতা মহিউদ্দিন আহমদ এমন একটি ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন এরূপ :

“১৯৭০ সালে প্রকাশ্য রাজনীতি শুরু হওয়ার পর প্রায় প্রতি রোববার ছুটির দিনে পল্টনে জনসভা হতো। প্রথম রোববার পড়েছিল ৪ জানুয়ারি। ওই দিন আতাউর রহমান খানের জাতীয় লীগ সভা করেছিল। পরের রোববার ১১ জানুয়ারি ছিল আওয়ামী লীগের জনসভা। তার পরের রোববার ১৮ জানুয়ারি ছিল জামায়াতে ইসলামীর জনসভা। ওই দিন পল্টনে তুলকালাম হয়। সিরাজুল আলম খান আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন, জামায়াতের সভা পণ্ড করে দিতে হবে। হয়েছিলও তাই। পরের রোববার ২৫ জানুয়ারি ছিল পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) সভা। সভাপতিত্ব করবেন নুরুল আমিন। ওই মিটিংয়েও হামলা করে তা বানচাল করে দেওয়া হয়েছিল। এসবের নাটের গুরু ছিলেন সিরাজুল আলম খান। পরে তিনি এ ব্যাপারে কথা বলেছিলেন ছাত্রলীগের সংগঠক আবু করিমের সঙ্গে। তার কাছ থেকেই বিষয়টি শোনা। সিরাজুল আলম খানের অবশ্য এ ব্যাপাওে কোনো রাখঢাক ছিল না। ঢাকায় জামায়াতকে আর নুরুল আমিনকে মিটিং করতে দেব না— এটাই ছিল তাঁর কথা। আবু করিমের সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারলাম:

আবু করিম : সিরাজ ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা যদি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, ১৯৭০ সালে জামায়াতকে মিটিং করতে দিলেন না কেন? আসলেই কি জামায়াতের মিটিং ভেঙেছিলেন?

‘হে, ইট ইজ মি।’ সিরাজ ভাই নিজে এটা আমাকে বলেছে। 

মহিউদ্দিন আহমদ : আমিও তো ছিলাম ওই মিটিংয়ে।

করিম : সিরাজ ভাই বলেছেন, ‘ইট ইজ মি।’ ‘ইট ইজ মি’ মানে পার্টি ডিসিশন না।

মহি : তাঁর ডিসিশনই তো?

করিম : উনি এটা কীভাবে অর্গানাইজ করেছেন, সেটাও বলেছেন আমাকে। ওনার কিছু পরিচিত লাকড়ি বিক্রেতাকে ভাড়া করেছেন। জামায়াত তো পল্টনে প্যান্ডেল-ট্যান্ডেল করেছে। এর বাইরে যে সলিমাবাদ রেস্টুরেন্ট, এর কর্মচারীরা সবাই হচ্ছে সিরাজুল আলম খানের চামচা। এরা পরে আমাদের বিনা পয়সায় খাওয়াত।

এই রেস্টুরেন্টে লাকড়ি লাগে দৈনিক দুই মণ বা তিন মণ। উনি অর্ডার দিয়েছেন ৩০০ মণ। ঘটনাটা কি আপনি বুঝতে পেরেছেন? লাকড়ির একটা পাহাড় হয়ে গেছে সেখানে। তখন ছোট চিরকুটের মাধ্যমে ওনার যত ক্যাডার, যেমন আফতাব, মধু, বুলবুল, বদিউল, মাহবুব থেকে আরম্ভ করে, মানে তখনকার দিনে যারা যারা ছিল। 

মহি : মানে ‘গ্রুপের’ লোকজন।

করিম : মানে লাকড়ির অভাব নাই। জামায়াত মিটিং আরম্ভ করেছে। মিটিংয়ের একপর্যায়ে ওরা শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে কী একটা সেন্টেন্স বলছে...জিব্বা টাইনা ছিঁড়া ফেল। এই যে পেটানো আরম্ভ করল। মুহূর্তের মধ্যে মিটিং রণক্ষেত্র।

মহি : ওই দিন দুজন নিহত, ৫০০ আহত।

করিম : মানে নিহত তো পত্রিকায় ওভাবে আসে নাই। 

মহি : পত্রিকায় এভাবেই এসেছে, ১৯ জানুয়ারি ১৯৭০।”২ 

পল্টনের জনসভায় যে দুজন শহীদ হন তাদের একজনের বাড়ি খুলনার মোড়লগঞ্জ থানার পাঠা মারা গ্রামে। তাঁর নাম ছিল আব্দুল মজীদ। দ্বিতীয় জনের নাম আব্দুল আওয়াল, বাড়ি নোয়াখালী। দুজনই ঢাকা আলীয়া মাদরাসার ছাত্র। পরের দিন চক বাজার শাহী মসজিদে তাদের জানাযায় মাওলানা মুফতি দীন মোহাম্মদ ইমামতি করেন।৩ 

এই হামলার প্রতিবাদ জানাতে সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল হলে বিভিন্ন স্থানে হামলা করে বহু লোককে আহত করে বাম-ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা। পরবর্তীকালে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতিপক্ষের সভা-সমাবেশে আক্রমণ করে তা পণ্ড করার সিলসিলা চালু হয়ে যায়। এর পুরো কৃতিত্ব সম্ভবত সিরাজুল আলম খানের। এছাড়াও ষাটের দশক থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদকেন্দ্রিক যে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের সৃষ্টি, সেটা তার হাত ধরেই। একাত্তরে অবাঙালি মুসলিম এবং ইসলামপন্থীদের ওপর চালানো ভয়াবহ গণহত্যায় প্ররোচণা দেয়ার তাত্ত্বিক গুরু এই সিরাজুলই।


হঠকারী উগ্রবাদী রাজনীতির নায়ক

সিরাজুল আলম খানের চরিত্রে যে প্রবল উগ্রবাদিতা ভর করে থাকতো তা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও প্রকাশ পায়। দেশে এ ধরনের রাজনীতির অন্যতম দোসর ছিল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগকে এই রাজনীতিতে অভ্যস্ত করে তোলার পর হাত দেন জাসদে। বিশ্লেষকরা বলেন, এই জাসদ বাংলাদেশের দুটো বড় ধরনের বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। একটি হচ্ছে স্বাধীনতার পরের সময়ে হাজার হাজার মেধাবী ও দেশপ্রেমিক তরুণকে হঠকারী রাজনীতিতে ঠেলে দিয়ে তাদের জীবন ধ্বংস করা। দ্বিতীয়টি হলো শ্রেণিহীন সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলার নামে হঠকারী নীতিতে বহু অফিসারকে হত্যা করা এবং আরো অনেককে মৃত্যুদন্ডের দিকে ঠেলে দেয়া। এই জাসদের রাজনীতির প্রধান নেতা হয়েও সিরাজুল আলম খানকে কোনদিন উপযুক্ত শাস্তি পেতে হয়নি। কেন হয়নি এটা হচ্ছে প্রথম রহস্য। দ্বিতীয় রহস্য হচ্ছে দেশে-বিদেশে তার বিলাসবহুল জীবনযাপনের আতিথ্য বা সুযোগ গ্রহণ। যিনি সমাজতন্ত্রের জন্য হাজার হাজার তরুণকে প্রাণ দেয়ার রাজনীতিতে টেনে আনলেন, এমন বিলাস বহুল জীবনের দিকে কীভাবে তিনি ধাবিত হলেন— সেও এক প্রশ্ন। তাঁর ঘনিষ্ঠ অনুসারীদের কেউ কেউ পরে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে য্দ্ধু করা কেউ কেউ আওয়ামী লীগের দালাল হয়েছেন। তিনি এসব দেখে নির্বিকার ছিলেন কেন? এসব রহস্য ভেদ করা গেলে বাংলাদেশের ইতিহাস আর রাজনীতি নিয়ে বহু কিছু জানা যেত বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। জাসদের এই তাত্ত্বিক গুরু রাজনীতিতে কী ভয়ঙ্কর ধারা চালু করেছিলেন তার কিছু নমুনা এখানে দেয়া যেতে পারে।


১১ এমপিকে হত্যা

বর্তমান মহাজোট সরকারের শরিক দল জাসদের অঙ্গসংগঠন গণবাহিনীসহ সশস্ত্র বামপন্থীরা ১৯৭২-৭৫ সালে আওয়ামী লীগের ১০ জন এমপিকে হত্যা করে। এ সময় এরাসহ আরও বহু নেতা-কর্মীকে হত্যা করে গণবাহিনীর সদস্যরা। রক্ষীবাহিনীর তৎকালীন সহকারী পরিচালক এবং এই বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম আনোয়ার উল আলম তাঁর রক্ষীবাহিনীর সত্য-মিথ্যা নামক গ্রন্থে আওয়ামী এমপিদের এই হত্যাকাণ্ডের বিবরণ প্রদান করেছেন। তিনি উল্লেখ করেন, এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে সমাজের দুষ্কৃতিকারী, চরম বামপন্থী, নকশাল বাহিনী, সর্বহারা ও জাসদের গণবাহিনীর হাত ছিল।৪ 


ঘরে বসে টাইম বোমা তৈরি

বাংলাদেশে ঘরে বসে বোমা তৈরি ও প্রতিপক্ষের ওপর বিস্ফোরণ ঘটানোর প্রথম প্রচলনও করে জাসদ। মহিউদ্দিন আহমদ জানিয়েছেন, চুয়াত্তরের নভেম্বরে বোমা বানাতে গিয়ে নিখিল নিহত হয়েছিল। তার নামে ওই বোমার নামকরণ হয় ‘নিখিল’। ‘নিখিল’-এর প্রস্তুতপ্রণালি ছিল খুবই স্থুল। ঢাকা নগর গণবাহিনীর কমান্ডার আনোয়ার হোসেন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের লেকচারার। তিনি ‘নিখিল’ ইমপ্রভাইজ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর শেখ মুজিবের আগমন যাতে নির্বিঘ্ন না হয়, সেজন্য আনোয়ারের নির্দেশে গণবাহিনীর সদস্যরা ১৪ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে তিনটি ‘নিখিল’ ফাটায়। এগুলো ছিল টাইম বোমা। আনোয়ারের সরবরাহ করা এই বোমাগুলোর একটি বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের কাছে, একটি সায়েন্স অ্যানেক্স বিল্ডিংয়ের চত্বরে এবং আরেকটি কার্জন হলের সামনে রেখে দিয়েছিলেন গণবাহিনীর সদস্যরা। দুপুর ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে এগুলোর বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।৫


সেনাবাহিনীতে গণহত্যা

শুধু বেসামরিক লোকদেরই নয়, রীতিমতো সেনাবাহিনীতেও হত্যাকাণ্ড চালান সিরাজুল আলমের শিষ্যরা। নিহত এ লোকদের ‘অপরাধ’ ছিল কেবল সেনা অফিসার হওয়া। ‘অফিসারের রক্ত চাই’ স্লোগান দিয়ে এই হত্যাকাণ্ড ছিল এক নজিরবিহীন ঘটনা। সাবেক সেনা কর্মকর্তা মইনুল হোসেন চৌধুরী তাঁর স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেন-

“৭ নভেম্বর (১৯৭৫) সৈনিকদের সঙ্গে বেসামরিক প্রশাসনের তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কিছু সরকারি কর্মচারীও যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। তারাও বেসামরিক প্রশাসনে তাদের ঊর্ধ্বতন অফিসারদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করছিল। ফলে কিছু কর্মরত এবং অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক তাদের সঙ্গে সেনানিবাসের বাইরে চলেও গিয়েছিল। কিন্তু সেনানিবাসের পরিস্থিতি আয়ত্তে আসায় পরে বাইরে তারা আর তেমন কোনো উচ্ছৃঙ্খলতা করার সাহস পায়নি। আজও ভাবলে গা শিউরে ওঠে যে, ঢাকা সেনানিবাসের সৈনিকদের যদি সেদিন নিয়ন্ত্রণে আনা না যেত, তাহলে সারা দেশে সামরিক-বেসামরিক পর্যায়ে একটা নেতৃত্বহীন ভয়াবহ উচ্ছৃঙ্খল শ্রেণিসংগ্রাম শুরু হয়ে যেত। সৈনিকদের সেদিনের স্লোগানই ছিল “সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই, অফিসারের রক্ত চাই। সিপাহি-জনতা ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই।”

আরেকজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা এমএ হামিদ পিএসসি’র বিবরণে বলা হয় : “৭/৮ নভেম্বরের (১৯৭৫) ওই বিভীষিকাময় রাতে গভীর অন্ধকারে উন্মাদ সৈনিকরা অফিসারদের রক্তের নেশায় পাগল হয়ে উঠল। ঘটে গেল বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ড। বহু বাসায় হামলা হলো। অনেকে বাসায় ছিলেন না। অনেকে পালিয়ে বাঁচল। সৈনিকরা মেজর করিম, মিসেস মুজিব, মিসেস ওসমানকে গুলি করে হত্যা করল, মেজর আজিম ও মুজিব চট্টগ্রামে যাচ্ছিলেন। বিপ্লবী সৈনিকরা তাদের এয়ারপোর্টে পাকড়াও করে। আজিমকে গুলি করে হত্যা করে। মেজর মুজিব প্রাণ নিয়ে পালাতে সক্ষম হয়। অর্ডিন্যান্স অফিসার মেসে সৈনিকরা হামলা করে তিনজন তরুণ অফিসারকে গুলি করে হত্যা করে। এদের মধ্যে ছিলেন মেজর মহিউদ্দিন; যিনি শেখ সাহেবের লাশ টুঙ্গিপাড়ায় নিয়ে দাফন করেন। সৈনিকরা বনানীতে কর্নেল ওসমানের বাসায় আক্রমণ করে। ওসমান পালিয়ে যান, তারা মিসেস ওসমানকে গুলি করে হত্যা করে। হকি খেলতে এসেছিল দুজন তরুণ লেফটেন্যান্ট। তাদের স্টেডিয়ামের পাশে গুলি করে হত্যা করা হয়। অর্ডিন্যান্স স্টেটে দশজন অফিসারকে এক লাইনে দাঁড় করানো হয় মারার জন্য। প্রথমজন এক তরুণ ই.এম.ই. ক্যাপ্টেন। তার পেটে গুলি করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। বাকিরা অনুনয়বিনয় করলে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। বেঁচে গেল তারা অপ্রত্যাশিতভাবে। একজন টেলিভিশনের অফিসার মুনিরুজ্জামান। বঙ্গভবনে খালেদের সময় খুবই অ্যাকটিভ ছিলেন। তাকে ধরে গুলি করা হয়। তিন দিন পর তার লাশ পাওয়া যায় মতিঝিল কলোনির ডোবায়। সেনাবাহিনী মেডিকেল কোরের ডাইরেক্টর কর্নেল (পরে ব্রিগেডিয়ার) খুরশিদ। বিপ্লবীরা তার বাসা আক্রমণ করে কয়েক ঝাঁক গুলি বর্ষণ করে। তিনি পালিয়ে যান। কিন্তু পরে আবার সেপাইদের হাতে ধরা পড়েন। বিপ্লবীরা তার দুই হাত বেঁধে যখন গুলি করতে উদ্যত, ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। হঠাৎ আশুরিক শক্তিতে বনবাদাড় ভেঙে তিনি দেন ছুট। তারা পেছনে গুলি ছুড়লেও আর তাকে ধরতে পারেনি। রাস্তার ওপরে অর্ডিন্যান্স স্টেটের অবস্থা ছিল ভয়াবহ। উচ্ছৃঙ্খল সৈনিকরা দলবেঁধে প্রায় প্রতিটি অফিসার্স কোয়ার্টারে হামলা চালায়। ভীত-সন্ত্রস্ত অফিসাররা বাসা ছেড়ে অন্ধকারে পেছনের পানির ডোবায়, ঝোপে-জঙ্গলে আত্মগোপন করে সারা রাত কাটায়। এই সময় ঈঙউ-এর কমান্ডিং অফিসার কর্নেল বারী সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি জীপে চড়ে ভেতরে যাচ্ছিলেন। গোলাগুলির খবর শুনে তার বিশ্বস্ত ড্রাইভার গেট থেকেই সজোরে মোড় ঘুরিয়ে তাকে নিয়ে পালিয়ে যায়। ঈঙউ-এর ভেতরে ঢুকলেই নিশ্চিত তিনি বিদ্রোহী সৈনিকদের হাতে মারা পড়তেন।”


এক রাতে ১২ অফিসার হত্যা

এমএ হামিদ আরও উল্লেখ করেন, ১২ জন অফিসার মারা পড়েন ওই রাতে। আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যান বেশ কজন অফিসার। নিহত ক’জন অফিসার হলেন মেজর আনোয়ার আজিম, মেজর মহিউদ্দিন, ক্যাপ্টেন খালেক, ক্যাপ্টেন আনোয়ার, লে. সিকান্দার, লে. মুস্তাফিজ, বেগম ওসমান ও অন্যান্য। সারা রাত ভয়ানক আতঙ্কের মধ্যে দিয়ে কাটে। মাঝেমধ্যে থেমে থেমে গুলির আওয়াজ। বিপ্লবী সৈনিকরা সত্যি সত্যিই অফিসারদের রক্ত নেশায় পাগল হয়ে ওঠে। ভাগ্যিস অধিকাংশ অফিসার ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে সন্ধ্যার আগেই শহরে তাদের নাগালের বাইরে চলে যান। সেপাইগণ কর্তৃক আপন অফিসারদের ওপর হামলা কস্মিনকালেও ঘটেনি এর আগে! বস্তুত এসব অবিশ্বাস্য ঘটনা!’ 

এম. এ. হামিদ আরও জানান, ভোর হতে না হতেই সারা ক্যান্টনমেন্টে অফিসারদের মধ্যে গভীর আতঙ্কের ছায়া। আপন সেপাইদের কাছ থেকে অফিসাররা ছুটে পালাতে লাগল। কোনো ইউনিটে, হেডকোয়ার্টারে, অফিসে অফিসার নাই। সবাই ছুটে পালাচ্ছে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে। যে যেদিকে পারছে ছুটে যাচ্ছে আশ্রয়ের খোঁজে। প্রস্থানের পথে বহু অফিসার স্টেশন হেডকোয়ার্টারে এসে ভিড় করলেন। বিপ্লবের আকস্মিকতায় সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বেশির ভাগ অফিসার নিজের জন্য নয়; বরং তাদের পরিবারের নিরাপত্তার চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়লেন। ওই দিন সকাল ৮টার সময়ও কয়েকজন অফিসারের ওপর গুলি বর্ষণ করা হলো। বহু অফিসারকে সৈনিকরা নাম ধরে খুঁজতে লাগল। অরাজকতার মধ্যে কে কাকে ধরছে, মারছে, লাঞ্ছিত করছে, কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না।৭


হাইকমিশনে অপারেশন

এই রহস্যপুরুষের তত্ত্বে উদ্বুদ্ধ বাহিনী রাষ্ট্রকে বেকায়দায় ফেলার মতো বিভীষণের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দ্বিধা করেনি। রাজনৈতিক ও সামরিক গণফ্রন্টসমূহ চরম নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতির ওপর জাসদ নেতৃবৃন্দের নিজেদের হারিয়ে যাওয়া কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মূলত তাহেরের গ্রেফতারের পরই জাসদের দ্বিতীয় সারির একদল জঙ্গি সংগঠক ভারতীয় রাষ্ট্রদূত শ্রী সমর সেনকে জিম্মির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। মোহাঃ রোকনুজ্জামানের মতে, (১৯৭৫ সালের) ২৪ নভেম্বর ঢাকা শহরের গণবাহিনীর প্রধান আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে এই জিম্মির ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশের ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ছিলেন শ্রী সমর সেন। এই অপারেশনের মূল দায়িত্ব ছিল ৬ সদস্যবিশিষ্ট একটি সুইসাইড স্কোয়াডের ওপর। এর সদস্য ছিলেন বাহার, বেলাল, সবুজ, মাসুদ, হারুন ও বাচ্চু। কর্নেল তাহেরের ভাই সাখাওয়াত হোসেন বাহারই ছিলেন এই স্কোয়াডের অধিনায়ক। ভারতে অধ্যয়নে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীর ছদ্মবেশে স্কোয়াডের সদস্যরা ২ নভেম্বর দূতাবাসে যেয়ে সামগ্রিক অপারেশনের ছক তৈরি করে আসেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৬ নভেম্বর সকালে সমর সেন তার কার্যালয়ে এসে গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই স্কোয়াডের ৪ সশস্ত্র সদস্য তাকে জিম্মি করে দূতাবাস ভবনের ভেতরে প্রবেশ করে। গ্রুপের বাকি ২ সদস্য উপস্থিত রক্ষীদের অস্ত্র ফেলে হাত উঁচু করে দাঁড়াতে বাধ্য করে। পরিস্থিতির নাটকীয়তায় সমর সেন ছিলেন হতবিহ্বল। গণবাহিনীর সদস্যগণ চিৎকার করে বলছিলেন, কেউ গুলি চালালে রাষ্ট্রদূতকে হত্যা করা হবে। একপর্যায়ে তাকে জোর করেই দোতলার সিঁড়িতে তুলতে হচ্ছিল। ঠিক তখনই নিচতলায় এক কক্ষ থেকে ১০/১২ জন সশস্ত্র ভারতীয় রক্ষী বেরিয়ে এসে তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এটা ছিল একটা বিস্ময়কর ব্যাপার।৮

হ্যাঁ, এরকমই অসংখ্য অঘটনের নেপথ্যের গুরু ছিলেন সিরাজুল আলম খান। কেই কেউ মনে করেন, এসব কারণে তিনি আলোতে আসতে ভয় পেতেন, পর্দার অন্তরালে থেকেই ষড়যন্ত্র চালিয়ে যেতেন। তাঁর স্বার্থান্বেষী পোষা ভক্তের দল তাঁকে স্বাধীন রাষ্ট্রের অন্যতম মহান কারিগর, রহস্যময় ইত্যাদি সব বিশেষণ লাগিয়ে তাঁকে উজ্জ্বল তারকা বানাতে চেয়েছে। কিন্তু ইতিহাসের এসব তিক্ত সত্যে কি তিনি আদৌ উজ্জ্বল?

লেখক : ঐতিহাসিক ও সাংবাদিক

তথ্য নির্দেশ:

মহিউদ্দিন আহমদ: প্রতিনায়ক সিরাজুল আলম খান, প্রথমা, ২০২১, পৃ. ১৪৯-১৫০।

প্রাগুক্ত।

অধ্যাপক গোলাম আযম: জীবনে যা দেখলাম, তৃতীয় খণ্ড, কামিয়াব প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৪, পৃ. ৯৯। 

আনোয়ার উল আলম : রক্ষীবাহিনীর সত্য-মিথ্যা, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা; অক্টোবর, ২০১৩, পৃ. ২১০।

মহিউদ্দিন আহমদ : জাসদের উত্থান-পতন : অস্থির সময়ের রাজনীতি, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা; অক্টোবর, ২০১৪, পৃষ্ঠা : ১৭০।

মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী (অব:) বীর বিক্রম : এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য : স্বাধীনতার প্রথম দশক, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা; ফেব্রুয়ারি, ২০০০, পৃ. ৯৬।

লে. কর্নেল (অব.) এম. এ. হামিদ পি.এস.সি : তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা, হাওলাদার প্রকাশনী, ঢাকা; ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, পৃ. ১৩৯-১৪০।

মোহাঃ রোকনুজ্জামান : জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ও বাংলাদেশের রাজনীতি, মীরা প্রকাশন, ঢাকা; ফেব্রুয়ারি, ২০১০, পৃ. ৭৬-৭৭।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির