পশ্চিমা এনলাইটেনমেন্টের কাছে ইসলামী বিশ্ব পরাজয়ের আগ পর্যন্ত মুসলমানদের দ্বীন ও রাষ্ট্র কখনো আলাদা ছিল না। ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে কোনো বিভাজন ছিল না। ধর্মকে কেবল ব্যক্তিজীবনে সীমাবদ্ধ করে ফেলারও বিন্দুবিসর্গ কোনো ধারণা মুসলিম মানসপটে ছিল না। কিন্তু যখনই পাশ্চাত্য সভ্যতা বিজয়ীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো, তখনই তারা তাদের নির্জীব ধর্ম থেকে রাষ্ট্রকে পৃথক করে ফেলে। ধর্মকে তারা এক প্রকার বন্দি করে ফেলে। এমনকি ব্যক্তিজীবনেও ধর্মকে এমন একটা বিষয়ে পরিণত করে যে, ইচ্ছে হলে তা মানা যায়, আর না মানলেও সমস্যা নেই; বরং জীবনকে কানায় কানায় ভোগ-উপভোগ করতে ব্যক্তিগত জীবনেও ধর্মকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করাটাই শ্রেয়- এই হয়ে যায় তাদের মানসিক অবস্থা! আর সেই থেকে বা তখন থেকে তাদের জীবন-দর্শনে ভোগবাদ-বস্তুবাদ, ধর্ম-দর্শনে আজ্ঞেয়বাদ ও নাস্তিকতা, অর্থনৈতিক দর্শনে এক সময় সমাজতন্ত্র অন্য সময় পুঁজিবাদ, এই দুয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাতও ঘটে ব্যাপকভাবে। এরপর তারা সমাজ-রাষ্ট্র-পরিবার ও নৈতিক জীবনে সেক্যুলারিজম এবং লিবারেলিজমের কোলে আশ্রয় গ্রহণ করে সেগুলোকে আপন করে নেয়। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের উৎস হিসেবে মানুষের বিবেক ও সম্মতিকেই গ্রহণ করে। সাথে সাথে তারা তাদের এসব ব্যর্থ-মূল্যহীন মানবতা ও ঈমান বিধ্বংসী মতবাদগুলো মুসলিম দুনিয়াও রফতানি করার সর্বাত্মক অপপ্রচেষ্টা করে।
পরাজিত মুসলিমরাও নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ভুলে সেসব মতবাদকে আঁকড়ে ধরে নিজেদেরকে যুগোপযোগী আর প্রগতিশীল প্রমাণে ব্যতিব্যস্ত হয়ে যায়। বস্তুবাদ-ভোগবাদকে জীবনের কামনা মনে করে সেসবে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। ভোগবাদ-বস্তুবাদ-পুঁজিবাদের শেকড় উচ্ছেদকারী দ্বীন আল-ইসলামই যেহেতু তাদের এহেন জীবনের প্রধান ও একমাত্র প্রতিপক্ষ, তাই তারাও ইসলামকে শত্রুজ্ঞান করে সেক্যুলারিজমকে আপন করে নেয়। ব্যক্তিগত জীবনে কথিত লিবারেল এথিক্সকে গ্রহণ করে নিয়ে সর্বদিক থেকে দ্বীনে হক আল-ইসলামকে ছুড়ে ফেলে দেয়। মুসলিমরা দ্বীনে হক ছেড়ে দ্বীনে বাতিলের ধারক-বাহক বনে গেল। মুসলিম নেতারা তাদের অনুসরণকারীদেরও পথভোলা পথিকে পরিণত করলো। এক উম্মাহ নানাভাবে বিভক্ত হয়ে পড়লো। মুসলমানগণ নানাভাবে দিকে দিকে নির্যাতিত আর নিষ্পেষিত হতে লাগলো। এক খিলাফত ভেঙে মুসলিম উম্মাহ ৫৭-৫৮টি রাষ্ট্রে পরিণত হলো। দ্বীনকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্র না গড়ে বরং ভাষা-বর্ণ-অঞ্চল আর ভূখণ্ডকে কেন্দ্র করে বিভক্ত হতে লাগলো তারা। সেই বিভক্ত রাষ্ট্রের নাগরিকরাও এবার ইসলামবিরোধী নানাবিধ তন্ত্রমন্ত্রের ধোঁয়ায় নিজেরা তো আচ্ছাদিত হলোই, সাথে তাদের বন্ধুবান্ধব এবং অনুসারীদেরকেও সে পথে টেনে নিতে লাগলো। বিংশ শতাব্দীর এই পথভোলা মুসলিম উম্মাহকে, এই আত্মঘাতী মুসলমানদেরকে তাদের হারানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের জন্য ইসলামের ওপর সংঘবদ্ধ হতে ডাক দিলেন যে কয়জন মহান ব্যক্তি, তাদের অন্যতম হলেন মিসরের একজন স্কুলশিক্ষক ইমাম হাসান আল বান্না এবং বয়সে তাঁর থেকে তিন বছরের সিনিয়র ইমাম সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী রাহিমাহুমুল্লাহ।
আমরা দুজনেরই জন্ম, বেড়ে ওঠা, মৃত্যু ও শিক্ষাদীক্ষা সবই জানি। আমরা জানি- মাওলানা মওদূদী ছিলেন উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ ইলমি মারকাজ, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও খেলাফত আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র দারুলউলুম দেওবন্দের ছাত্র। তিনি দ্বীনি শিক্ষাও নিয়েছেন দারুলউলুম দেওবন্দের উস্তাদদের থেকে। কৈশোরেই তিনি তাঁর বাবাকে হারান। সে কারণে ছোটবেলা থেকেই তিনি একজন অপ্রতিরোধ্য সংগ্রামী মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠেন। দ্বীন ও উম্মাহর জন্য তাঁর হৃদয়ের পরতে পরতে ছিল দরদের দরিয়া। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা তাঁকে নানা বৈচিত্র্যময় গুণে গুণান্বিত করেছেন। তাঁর লেখনীশক্তি ছিল ধারালো তলোয়ারের মতো। মানুষের চিন্তারাজ্যে টর্নেডো সৃষ্টির মতো। তিনি খুবই অল্প বয়সে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন। ১৩ বছর থেকেই আরবি বইপত্র অনুবাদ করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। মাত্র পনেরো বছর বয়সে বিজনৌর থেকে প্রকাশিত ‘মদিনা’ নামক একটি পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯২০ সালে মাত্র সতেরো বছর বয়সেই তিনি সম্পাদক হন ‘তাজ’ পত্রিকার। ১৯২৫ সালে জগদ্বিখ্যাত ইসলামী বিদ্যাপীঠ, ভারতের দারুলউলুম দেওবন্দের মুখপাত্র ‘আল জামিয়াহ’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হয়েছিলেন। ১৯৩৩ সালে তিনি নিজেই ‘তরজুমানুল কুরআন’ নামক পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন। সেই পত্রিকার পাতায় তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর সাথে পরিচিত হন উপমহাদেশের কিংবদন্তিতুল্য মুসলিম কবি ও দার্শনিক আল্লামা ইকবাল রহ.। চৌধুরী নিয়াজ আলী খান তাঁর ৬৬ একর জমি আল্লাহর দ্বীনের জন্য ওয়াকফ করেন। এই জমিকে যথাযথভাবে ইসলামের চাষের উপযোগিতা দিতে আল্লামা ইকবাল ইমাম মওদূদীকে যথাযথ ব্যক্তি মনে করেন। সে কারণেই আল্লামা ইকবাল ১৯৩৮ সালে মাত্র ৩৫ বছর বয়সী টগবগে যুবক মওদূদীকে হায়দারাবাদ (ভারত) থেকে পঠানকোট (পাকিস্তান) আমন্ত্রণ জানান। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে সাইয়েদ মওদূদীও সেখানে হিজরত করেন। দারুল ইসলাম ট্রাস্টে (পাঠানকোট) যোগদান করেন। অখণ্ড ভারত যখন খণ্ড হলো, তখন তিনি হিজরত করেন লাহোরে। এ সম্পর্কে তাঁর জীবনীরচয়িতা আব্বাস আলী খান রহ. বলেন- ‘কোনো আঞ্চলিক ভূখণ্ডের মায়া তাঁকে আদর্শ পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। জীবনের শেষ তেত্রিশ বছর লাহোরে কাটিয়ে তিনি লাহোরি বা পঞ্জাবি হয়ে যাননি। তিনি ছিলেন সারা জাহানের। তিনি ছিলেন বিশ্বমানবতার।’
বলছিলাম মাওলানার হিজরতের কথা। পাঠানকোটে গিয়ে তাঁর কাজের গতি আরো বৃদ্ধি পায়। তিনি তাঁর সকল শক্তি আর ইখলাস দিয়ে মুসলমানদেরকে আল্লাহ প্রদত্ত যে খিলাফতের কাজ, সে কাজের দিকে আহ্বান করতে লাগলেন। জনতাকে উজ্জীবিত করতে লাগলেন। ইমাম মওদূদী উপসর্গের দিকে নজর না দিয়ে মুসলমানদের সমস্যার মূলে লক্ষ্য করলেন, এবং হাতও দিলেন মূলে। তিনি দেখলেন মুসলমানদের জীবন থেকে কুরআন উপেক্ষিত। অথচ বিশ্বনবী মুহাম্মদ সা. বিদায় হজের ভাষণে বলেছেন, ‘আমি তোমাদের মাঝে দুটো জিনিস রেখে যাচ্ছি, যতক্ষণ তোমরা এই দুটিকে আঁকড়ে ধরে রাখবে ততক্ষণ তোমরা কেউই পথভ্রষ্ট হবে না। আর তা হলো আল্লাহ তায়ালার কিতাব ও আমার সুন্নাহ।’ (মুয়াত্তা ইমাম মালেক : ৩৩৩৮)। কিন্তু আজকে মুসলমানরা কুরআন ছেড়ে দিয়েছে। কুরআনকে মুসলিমরা পড়ে না কুরআনের দাবি অনুযায়ী। টুকটাক যারা পড়ে, তারাও কুরআন অনুযায়ী জীবন গড়ার জন্য পড়ে না। কুরআন এসেছে মানুষকে পথপ্রদর্শনের জন্য, আলোর পথে ধাবিত করার জন্য। অথচ মুসলিমরা কুরআনের পথে চলতে, আলোর পরশ পেতে কুরআন পড়ে না। কুরআনকে অধিকাংশ মানুষ সে সময় তাবিজের কিতাবে পরিণত করে দিয়েছে। কুরআনের শিক্ষাকে ছেড়ে দেওয়ার এহেন আত্মঘাতী কর্ম লক্ষ্য করে তিনি তাদেরকে কুরআনের মূল দাবি আর মূল শিক্ষার দিকে ফিরিয়ে আনার জন্য হাত দিলেন ‘তাফহিমুল কুরআন’ নামক অনবদ্য তাফসিরগ্রন্থটি রচনার কাজে। উক্ত তাফসিরগ্রন্থ ১৯৪২ সালে রচনা শুরু করেন আর দীর্ঘ ত্রিশ বছর পরে তা ১৯৭২ সালে তা সমাপ্ত করেন।
মাওলানার এ অনবদ্য কীর্তি তাফসিরগ্রন্থ “তাফহিমুল কুরআন” পড়ি আর বিস্ময়ে “থ” হয়ে যাই, একটা মানুষ এত বিজ্ঞান, ভূগোল, ইতিহাস, রাজনীতি ও দর্শনের এত আপডেট তথ্যসমৃদ্ধ তাফসির কীভাবে উপহার দিতে পারেন! কুরআনের সাথে সম্পর্কিত ঐতিহাসিক যে স্থানগুলো, মাওলানা সে স্থানগুলো স্বচক্ষে দর্শন করেছেন। আর মানচিত্র দিয়ে তা পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। এই ধাঁচের তাফসির আর দ্বিতীয়টি আছে বলে আমার জানা নেই।
তাফহিমুল কুরআন হচ্ছে এমন এক গ্রন্থ, যেটা কুরআন এবং ইসলামের মূল যে আবেদন, সেই আবেদন পরিপূর্ণভাবে বর্তমান সময়োপযোগী করে তুলে ধরেছেন। দ্বীনকে তার আবেদন ও দাবি অনুযায়ী উপস্থাপন করা হয়েছে এটায়। এটা স্রেফ কোনো একটা মতবাদকে খণ্ডন করার তাফসির নয়। নয় কৈফিয়ত মূলক রচনা। অথবা স্রেফ ফাজায়িল-মাসায়িল বর্ণনারও তাফসির নয়। যদিও ফাজায়িল-মাসায়িলও এটায় বর্ণিত আছে। মূলত তাঁর এই তাফসিরগ্রন্থটা মানব মানসে এক বৈপ্লবিক মনন তৈরির টনিক হিসেবে কাজ করেছে। এখনো করে যাচ্ছে। এটি কেবল শখ আর স্বপ্নের বশেই রচনা করেননি তিনি। এই তাফসিরগ্রন্থকে তিনি ভবিষ্যৎ মুসলিম উম্মাহর জন্য একান্ত কর্তব্য মনে করেই রচনা করেছেন। এ সম্পর্কে তিনি তার শেষ বিকেলের আসর গ্রন্থে বলেন- ‘আমি আমার দিন-রাতের সময় তিন অংশে ভাগ করে রেখেছি। এক অংশ দেশ ও সংগঠনের দৈনন্দিন কাজকর্মে, এক অংশ বর্তমান বংশধরদের জন্য এবং এক অংশ ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য। আর তাফহিমুল কুরআন লেখার কাজ আমার উপরে ভবিষ্যৎ বংশধরদের হক বলে মনে করি। এ হক আমি বর্তমান বংশধরদের খাতিরে নষ্ট করতে পারি না।’
মাওলানা যে কেবল তাফসিরই লিখেছেন, তেমনটা নয়। তিনি ইলমের দুনিয়ার প্রত্যেকটা শাখাতেই পা রেখেছেন। জ্ঞানের প্রত্যেকটা অঙ্গনেই বিচরণ করেছেন। আসলে প্রত্যেকটা মানুষের কাজের জন্য নির্দিষ্ট একটা বিষয়ের ওপর আগ্রহ থাকে। কিন্তু মওদূদীর আগ্রহ এবং কাজ ছিল সর্বব্যাপী। রাজনীতি থেকে অর্থনীতি, ইতিহাস থেকে থেকে সমাজনীতি, ফিকহ থেকে দর্শন, হাদিস-তাফসির ও উসুলুদ দ্বীন, সংস্কৃতি ও সংগঠন ; এমন কোনো শাখা নেই, এমন কোনো বিষয় নেই, যে বিষয়ে ইমাম মওদূদী কলম ধরেননি। মাওলানাকে আমরা কোনো না কোনো দিকে গ্রহণ করতেই পারি। কোনো না কোনো গ্রন্থ থেকে, কোনো না কোনো সাইট থেকে উপকৃত হতেই পারি। অথচ আমাদের কারো কারো সঙ্কীর্ণতার দরুন কিছু কিছু মানুষ তাঁর ইলম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যদিও সে সঙ্কীর্ণতার চাদর এখন ধীরে ধীরে খসে পড়ে যাচ্ছে।
তাফসিরগ্রন্থ তাফহিম ছাড়াও মাওলানা মওদূদীর একটি অনবদ্য গ্রন্থ হচ্ছে কুরআনের চারটি পরিভাষা নামক গ্রন্থটা। এ গ্রন্থে তিনি ইলাহ, রব, ইবাদত ও দ্বীন; এ চারটি বিষয় সম্পর্কে স্বচ্ছ ও সঠিক ধারণা হাজির করেছেন। মাওলানা মনে করতেন ইলাহ, রব, ইবাদত ও দ্বীন সম্পর্কে কুরআনের পাঠকের ধারণা সুস্পষ্ট না হলে তার দ্বারা কুরআন অনুধাবন করা মোটেই সম্ভব হবে না। মানুষ যদি এসবের ভুল অর্থ করে তাহলে মহাগ্রন্থের ভুল পাঠই নেওয়া হবে। তিনি বলেন, মানুষ যদি ইলাহ অর্থ কোনো উপাস্য দেবতা, দ্বীন অর্থ কোনো গতানুগতিক কোনো ধর্ম, রব অর্থ প্রতিপালক এবং ইবাদত অর্থ স্তুতি ও পূজা-পার্বণ বুঝায়; তাহলে কুরআনের মর্মকথা উপলব্ধি করা তার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। (আল-কুরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষা : ১১-১৩)। যার পরিপ্রেক্ষিতেই এ মহাগ্রন্থ আল কুরআনের এই চারটি পরিভাষার সঠিক ব্যাখ্যা হাজির করাকে তিনি আবশ্যক মনে করেছেন, আর রচনা করেছেন উক্ত গ্রন্থখানা। যদিও আলিমদের একটা অংশের পক্ষ থেকে এর কিছু অংশ সম্পর্কে আপত্তি তোলা হয়েছে। কেউ কেউ এসব ব্যাখ্যার কারণে অভিযোগ করেন যে, তিনি ইসলামকে অতিমাত্রায় রাজনৈতিকায়ন করেছেন।
মুসলমান যুবকেরা যখন মার্ক্সের আফিম খেয়ে বুঁদ হয়ে যাচ্ছিলো দলে দলে, তিনি সেই কার্ল মার্ক্সের খোদাদ্রোহী মতবাদ থেকেও যুবকদের ফেরানোর জন্য কলম যুদ্ধ চালিয়েছেন। কমিউনিজমকে তিনি এই উপমহাদেশে অপাঙক্তেয় করে দিয়েছেন তাঁর অবিরাম কলম যুদ্ধ দ্বারা। যেসব পাশ্চাত্যপ্রেমী মুসলিম পাশ্চাত্যের সকল কিছুকেই আল্লাহর দ্বীনের চাইতেও, রাসূলের আনীত ওহির থেকেও বেশি মর্যদা দিয়ে চোখ বুজে গ্রহণ করেছে, তিনি সেসব হীনম্মন্য-পাশ্চাত্যপ্রেমী জনতার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী সভ্যতার অসারতা। দেখিয়ে দিয়েছেন তাদের প্রগতিবাদের ফাঁকাবুলি। তিনি ইসলামকে নিয়ে তাদের বয়ানগুলোর ব্যাপারে এপোলোজেটিক হননি কখনো। তিনি শক্ত হাতেই তাদেরকে উল্টো প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেছেন। মাওলানা জানতেন, কৈফিয়ত সুলভ বয়ান দিয়ে কখনো বিজয়ী হওয়া যায় না। বরং পরাজিতদের বয়ানই হয় কৈফিয়তসুলভ, ডিফেন্সিভ। তাই তিনি কখনো কৈফিয়ত সুলভ বয়ানে যাননি। এ সম্পর্কে তিনি উস্তাজা মরিয়ম জামিলা রহ. এর সাথে এক পত্রালাপে বলেন- “আমি আত্মরক্ষামূলক কৌশল ও কাজে কখনো বিশ্বাস করিনি।” এটা যে কেবল তাঁর মুখেরই বাণী, তা নয়। বরং বাস্তবেই তিনি এ পথে পা বাড়াননি এবং সর্বদায় ছিলেন অত্যধিক সতর্ক। আপনারা মাওলানার বইপত্রের প্রতিটি পরতে পরতে এ বিষয়টা দেখতে পাবেন। পাশ্চাত্য সভ্যতার ভিত্তিমূলে আঘাত করে তিনি “ইসলাম ও পাশ্চাত্য সভ্যতার দ্বন্দ্ব” নামে আলাদা একটা গ্রন্থ লিখেছেন। এছাড়াও আপনি যদি মাওলানার জীবনের একেবারে শুরুর দিকে রচিত “আল জিহাদু ফিল ইসলাম” পড়ে দেখেন, দেখবেন সেখানেও জিহাদ সম্পর্কে বিন্দুবিসর্গও এপোলোজেটিক হননি। তাঁর এ গ্রন্থটা আল্লামা ইকবাল সকল জ্ঞানী ব্যক্তিদের পড়ার আমন্ত্রণও জানিয়েছেন। আবার যদি তাঁর পর্দা ও ইসলাম নামক কিতাবটি দেখেন, দেখবেন সেখানেও তিনি শিথিলতার আশ্রয় গ্রহণ করেননি। মুখ না ঢাকলেও চলে, মুখ খোলা রাখলেও সমস্যা নেই; এ ধরনের পশ (Posh) বয়ান তিনি দেননি। আসলে তিনি পশ হতেও চাননি। বা যারা পশ শ্রেণির মানুষ, তাদেরকেও তিনি তুষ্ট করার গরজ বোধ করেননি। তাই তো তিনি নিকাব বা মুখ ঢাকার পক্ষে শক্তিশালী দলিল ও যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। হুবহু মিউজিকের বিষয়েও যদি দেখেন, সেখানেও তিনি কুল হতে চাননি। মিউজিক শিল্পে আধ্যাত্মিকতার ছিটেফোঁটাও তিনি দেখেননি। বরং এটা যে রাসূল সা. এর হাদিস এবং নির্দেশ মোতাবেক হারাম, সে ব্যাপারেই শক্তপোক্তভাবে অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তিনি যারা বাদ্যযন্ত্র বাজায়, এর ব্যবসা করেন, তাদেরকে রাসূলের উম্মত হিসেবে পরিচয় দিতেও কুণ্ঠিত ছিলেন। (রাসায়েল মাসায়েল, ১ম খণ্ড : ১২৬-২৭, এছাড়াও যুব জিজ্ঞাসার জবাব, শেষ বিকেলের আসর দেখতে পারেন)।
এভাবে তিনি ফ্রি মিক্সিং তথা নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশারও কঠিন বিরোধী ছিলেন। আসলে বিরোধী ছিলেন বললে ভুল হবে। মূলত এটাই ইসলামের মূল দাবি। আর এসব দাবির ওপর তিনি মজবুতভাবে অবস্থান করেছেন। তিনি সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থারও ঘোর বিরোধী ছিলেন। শিক্ষাব্যবস্থাকে ইসলাম অনুযায়ী ঢেলে সাজানোর জন্যও তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যয় হয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তাঁর উল্লেখযোগ্য চিন্তা ছিল-
দ্বীন ও দুনিয়া অর্থাৎ ধর্মীয় জীবন ও দুনিয়াবি জীবনের যে পার্থক্য, সেটার অবসান ঘটানো।
পুঁথিগত বিদ্যার চেয়ে চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব গঠনকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া।
নারীদেরকেও ইলমের আলোয় আলোকিত করা। এ সম্পর্কে তিনি বলেন- “নারীর শিক্ষা পুরুষের মতোই জরুরি। নারীদের অজ্ঞ ও অনগ্রসর রেখে পৃথিবীতে কোনো জাতিই উন্নতি ও অগ্রগতির পথে অগ্রসর হতে পারে না। এজন্য মুসলিম পুরুষদের মতো মুসলিম নারীদের শিক্ষার জন্যও যতদূর সম্ভব উন্নত ব্যবস্থা করা উচিত। এমনকি তাদের সামরিক ট্রেনিং দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।”
তাই বলে একই ক্যাম্পাসে একই সাথে ছেলেমেয়ে শিক্ষা অর্জন করবে, তা না। সহশিক্ষাকে তিনি বিন্দুমাত্রও বরদাশত করেননি। তাঁর চিন্তা ছিল ছেলেদের ক্যাম্পাস আলাদা হবে, মেয়েদের ক্যাম্পাসও হবে আলাদা। আবার নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে কোন্ বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত, সেটাও তিনি স্পষ্ট করে বলেন- “নারীদের শিক্ষায় এ কথাটা বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা দরকার যে, তাদের আসল ও স্বাভাবিক দায়িত্ব হলো গার্হস্থ্য জীবন পরিচালনা ও মানুষ গড়া, কৃষি খামার, কল-কারখানা, অফিস-আদালত চালানো নয়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কাজ হবে নারী জাতিকে একটা সাচ্চা মুসলিম জাতি গঠনের যোগ্য করে তোলা, যে জাতি দুনিয়ার সামনে স্রষ্টার রচিত কল্যাণকর ও স্বাভাবিক জীবনব্যবস্থার বাস্তব দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারবে।” (শিক্ষাব্যবস্থা : ইসলামী দৃষ্টিকোণ, পৃষ্ঠা: ১১৮-১৯)।
এভাবেই তিনি জীবনের প্রত্যেকটা বিষয় নিয়ে কলম ধরছেন। প্রত্যেকটা বিষয়কে তিনি জাহিলিয়াতের কালো থাবা থেকে মুক্ত করতে চিন্তা-যুদ্ধ করেছেন। চালিয়েছেন কলমের জিহাদ। প্রত্যেকটা বাতিল মতাদর্শকে যেভাবে চূর্ণবিচূর্ণ করেছেন, তদ্রুপ ইসলামের আপস মূলক বয়ান, শিথিলতাপূর্ণ অবস্থান, আধুনিকতাবাদের (Modernism) প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে ইসলামের কথিত আধুনিক বয়ানগুলোকেও খণ্ডন করছেন মজবুতভাবে। যার কারণে এসব আধুনিকতাবাদীরাও (modernist) তাঁকে শত্রুজ্ঞান করতো। থামিয়ে দিতে চেষ্টা করতো। তাঁকে তাদের চক্ষুশূল মনে করতো। এ সম্পর্কে তিনি নিজেই মরিয়ম জামিলা রহ. এর সাথে পত্রালাপে বলেন- “আধুনিকতাবাদীরা আমাকে বিপজ্জনক ও শত্রুজ্ঞান করে।”
তাঁর কলম আবার তাদের বিরুদ্ধেও সোচ্চার ছিল, ইসলামকে যারা একটি অকার্যকর অচল পণ্যসামগ্রীর মতো করে কেবল মসজিদ আর খানকায় সীমাবদ্ধ করে ফেলেছিল। তাঁর এমন চতুর্মাত্রিক কাজ থাকার পরে, দ্বীন নিয়ে এত বিশাল ও বিস্তৃত পরিসরে কাজ করার পরও তাঁর ভাগ্যে জুটেছে অগণিত কটুকথা ও গালিগালাজ। শুনতে হয়েছে সাহাবায়ে কেরামবিদ্বেষী। ইসলামের নতুন ভাষ্যকার। নবীদের দুশমন, হাদিস অস্বীকারকারী ইত্যাদি। তাঁকে হাদিস অস্বীকারকারী অপবাদ দেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছেও। অথচ তিনি হাদিস অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে হাদিসের সত্যতা আর কার্যকারিতা প্রমাণে একটা অসাধারণ অনবদ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন “সুন্নাতে রাসূলের আইনগত মর্যাদা” নামে। আসহাবে রাসূলকে তিনি কতটা মর্যাদার আসনে দেখেন তা তাঁর “সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদা” নামক গ্রন্থে প্রমাণ মেলে। এমনকি মুয়াবিয়া রা.-এর মর্যাদা নিয়েও তিনি ছিলেন সর্বোচ্চ সচেতন। তাঁর সম্পর্কে তিনি বলেন- “সালফে সালেহিনের মধ্যে যদিও সাহাবায়ে কেরামের সংজ্ঞা নিয়ে মতপার্থক্য ছিল, কিন্তু যেকোনো সংজ্ঞানুযায়ী মুয়াবিয়া রা. সাহাবি ছিলেন। তাঁর কোনো ব্যক্তিগত কাজ হয়তো ভেবে দেখার বিষয়, কিন্তু সামগ্রিকভাবে তাঁর খিদমত ও অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর মাগফিরাত ও মর্যাদা লাভ সুনিশ্চিত ব্যাপার।” (সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদা, পৃষ্ঠা : ২১-২২)।
ইমাম মওদূদীর ওপর এমন আরো কিছু বর্বর মিথ্যাচার আর জুলম রয়েছে, এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তিনি আলিম না। তাঁর ইসলামী শিক্ষার কোনো সার্টিফিকেট নেই। তাঁকে আরো একটা বর্বরতার শিকার হতে হয়েছে এরকম- মওদূদীবাদ আর কাদিয়ানিবাদ এক জিনিস, মানে আমরা ছোট বেলায় আমাদের কিছু কিছু আলিমদের কাছে এমনই শুনতাম। অথচ সেই মওদূদীর বই-ই আছে কাদিয়ানিদের বিরুদ্ধে। সেই বইতে তিনি তাদের অমুসলিম ঘোষণা করেন এবং তা প্রমাণও করেন। মূলত “কাদিয়ানি সমস্যা” নামক সে বই লেখার জন্য তাঁকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী গ্রেফতার করে এবং মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। এই যে তাঁকে ফাঁসির দণ্ড দেওয়া হলো, এই ফাঁসিতে ঝুলবার রায় শুনেও তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। তাঁকে অনুরোধ করা হলো যে আপনি ক্ষমা প্রার্থনা করুন, তার দীপ্ত-কঠিন ঘোষণা ছিল এই, “আমি মাজলুম হয়ে জালিমের নিকট কেন ক্ষমা প্রার্থনা করবো? তাঁর ঈমান জাগানিয়া উক্তি ছিল- “মৃত্যুর ফয়সালা মহান আল্লাহর আসমানে হয়, জমিনে নয়!” তাঁর ঈমানদীপ্ত দৃপ্ত ঘোষণাটি আমাদের জন্য যুগের পর যুগ অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে যাবে। আমরা যারা দ্বীনের ওপর সাহসিকতার সাথে পথ চলতে চাই, তাঁর সেই ঘোষণাটি আমাদের ঈমানের সূর্যটাকে আরো তেজোদীপ্ত করে তুলবে। তাঁর পক্ষে তিনি তাঁর সংগঠন, পরিবার-সুহৃদ; সকলকে দৃঢ়তার সঙ্গে রাষ্ট্রের কাছে কোনো প্রকার ক্ষমা প্রার্থনা করতে নিষেধ করেছেন। পরবর্তীতে মুসলিম বিশ্ব এবং বিশ্বনেতৃবৃন্দের চাপে তাঁর মৃত্যুদণ্ড বাতিল করে পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী। একটা বিষয় লক্ষণীয় হলো যে, পাকিস্তান সৃষ্টিই হয়েছে ইসলামের বিধিবিধানের আলোকে সমাজ-রাষ্ট্র পরিচালিত হয়ে পূর্ণাঙ্গ ইসলামকে ধারণ করার জন্যেই। কিন্তু শাসকশ্রেণি সে বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়ায় ইমাম মওদূদী রহ. ১৯৪৮ সালে ইসলামী সংবিধান ও ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচারণা শুরু করেন। সে কারণেও পাকিস্তান সরকার তাঁকে কারাগারে বন্দি করে। অতঃপর ১৯৫০ সালে কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন তিনি।
পরিশেষে বলবো- ইমাম মওদূদী রহ. এমন একটা সময়ে আবির্ভূত হয়েছেন, এমন একটা সময় কলম তুলে নিয়েছেন, যখন চারিদিকে সমাজতন্ত্রের নাস্তিক্যবাদের ধূম্রজাল, যখন শিক্ষিত শ্রেণির মনে ইসলাম নিয়ে হীনম্মন্যতার সয়লাভ, যখন ইবাদতকে কেবলই মসজিদ-মাদরাসা আর খানকায় সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে। তাঁর কলমের কালিতে তিনি মুসলিম উম্মাহকে তাঁর হারিয়ে যাওয়া গৌরবকীর্তন ফিরিয়ে আনার জন্য, আত্মসচেতনতা সৃষ্টির এক আকুলতা তৈরি করেছেন। জ্ঞানী-বিচক্ষণ মানুষজনের চিন্তাজগতে বিপ্লব সৃষ্টি করেছেন। উল্লেখ্য, এই গুরুত্বপূর্ণ মুজতাহিদ-মুজাদ্দিদ আলিমেদ্বীন মহান মনীষী ১৯০৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। এবং ১৯৭৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পৃথিবীর আলো বাতাস থেকে বিদায় গ্রহণ করেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা ইমাম মওদূদীকে ক্ষমা করুন। তাঁর ওপর রহমের বারিধারা বর্ষণ করুন। তাঁর খিদমতগুলো কবুল করুন। আমাদেরকেও উম্মতের খিদমতে তাঁর মতো নিবেদিত হওয়ার মতো তাওফিক দান করুন। আমিন।
গ্রন্থপঞ্জি
১. তাফহিমুল কুরআন, ২. কুরআনের মর্মকথা
৩. মাওলানা মওদূদী একটি জীবন একটি ইতিহাস
৪. শিক্ষাব্যবস্থা : ইসলামি দৃষ্টিকোণ
৫. মাওলানা মওদূদীর সঙ্গে মরিয়ম জামিলার পত্রালাপ
৬. আল জিহাদ, ৭. পর্দা ও ইসলাম, ৮. কুরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষা
৯. রাসায়েল-মাসায়েল
লেখক : সহকারী সম্পাদক, ছাত্রসংবাদ
আপনার মন্তব্য লিখুন