post

জাগো বীর নয়া শতাব্দীর

ড. আহসান হাবীব ইমরোজ

২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩

বিশ্ব পর্যটন দিবস ২৭ সেপ্টেম্বর। ওই দিকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী কোম্পানি ও সার্চইঞ্জিন গুগল তাদের জন্মদিনটা ওই দিনই ঠিক করেছে। মজা করে তাদেরকে আমি বার্থডেমেট বলি। তাই ভোঁ-ভোঁ ভ্রমণ এবং গুগলে গুঁতোগুঁতি আমার এক মজার আকর্ষণ।


ভ্রমণের ভোঁ-ভোঁ চক্কর

ভ্রমণের আরবি প্রতিশব্দ ‘সাইর’। যার অর্থ ভ্রমণ বা চলাফেরা। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে এটি মোট ২৭ বার এসেছে। কুরআন সম্ভাব্য একটি জ্ঞান-যাত্রা হিসেবে ভ্রমণকে তুলে ধরেছে। যেহেতু ভ্রমণের সময় একজন ব্যক্তি অসংখ্য ‘আয়াত’ বা নিদর্শন পেয়ে থাকেন (সূরা লুকমান : ৩১, সূরা ইউসুফ : ১০৫, সূরা হাজ্জ : ৪৬; সূরা জাসিয়া : ০৩, সূরা ইউনুস: ০৬)। এছাড়াও, মানুষের ভ্রমণ করার ক্ষমতাকে সমস্ত প্রাকৃতিক শক্তির ওপরে মানুষের উচ্চ মর্যাদার অংশ হিসেবে মানুষকে দেওয়া একটি বিশেষ সম্মান হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে (সূরা বনি ইসরাইল : ৬৬, ৭০)।

একটি প্রবাদে বলা হয়েছে, “The world is a book, and those who do not travel read only a page.”

 মাত্র ৩০ বছরে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ভ্রমণকারী ছিলেন, রেকর্ডবুকে যার ১,২০,০০০ কিলোমিটার ভ্রমণের হিসেব সংরক্ষিত, সেই গর্বিত মুসলিম ইবনে বতুতা বলেন, ‘ভ্রমণ’- এটি আপনাকে বাকরুদ্ধ করে দেয়, তারপর তা আপনাকে একজন গল্পকারে পরিণত করে। আর বিজ্ঞ লেখকদের অভিজ্ঞতা বলে, যে ব্যক্তি একেবারে জিরো লেভেল থেকে লেখক হতে চান তার উচিত ভ্রমণ করা এবং সে অভিজ্ঞতা নিয়েই লেখা শুরু করা।

 

লাইটহাউস : এক অন্যরকম লাইফ

লাইটহাউস স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাস, করটিয়া, টাঙ্গাইল। লাইটহাউসের একটু গল্প বলি, ২০০১ সালে এর যাত্রা শুরু। বর্তমানে বাংলাদেশের নানা জায়গায় এর ১০টি ক্যাম্পাস। টাঙ্গাইলের করটিয়াতে যখন এর প্রথম ক্যাম্পাস শুরু হলো, স্থানীয় স্কুলগুলোর তুলনায় সে স্কুলের চারগুণ বেশি বেতন; তবুও উপচে পড়া ভিড় সেখানে। সা’দত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের প্রিন্সিপালের মেয়ে এবং এক বিভাগীয় প্রধানের মেয়ে ভর্তি হবে। তারা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়ায় নেওয়া যায়নি। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম শুধু বলেছেন, এটি কেমন স্কুল- যে স্কুলে সা’দত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের প্রিন্সিপালের মেয়ে ভর্তিই হতে পারবে না? কিন্তু বিভাগীয় প্রধান একজন নিয়মিত শরীরচর্চাবিদ। তিনি অফিসে এসে রীতিমতো জামার হাত গুটিয়ে প্রতিবাদ করলেন, তবুও কাজ হলো না। প্রাইমারি বৃত্তি পরীক্ষায় জেলায় দ্বিতীয় স্থান, সৃষ্টি-স্কুল ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম। এমনকি জেলাস্কুলে ভর্তি হওয়া ছাত্রও ভর্তি বাতিল করে চলে এসেছে এ স্কুলে। তিন বছরের মাথায় কোয়ালিটি কনভেনশনে আমরা সারাদেশে দ্বিতীয় হলাম। দেশের শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান এমনকি বিশ্বের শীর্ষ দেশসমূহে পড়তে গেল আমাদের দীপ্তিমান শিক্ষার্থীরা। এরাই আমাদের দুনিয়ার গৌরব ও আখেরাতের মুক্তির মাধ্যম। কিন্তু নানা সমস্যা ও ষড়যন্ত্রে আমি প্রতিষ্ঠানে সশরীরে থাকতে পারিনি। প্রতিষ্ঠানে আগুন দেওয়া হয়েছে, মিথ্যা মামলায় আমাকে জেলে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু আমাদের প্রজ্ঞাবান ও নিবেদিত কর্মকর্তা, শিক্ষকমণ্ডলী, কর্মচারী এমনকি অভিভাবকমণ্ডলী এটিকে এগিয়ে নিতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। আমি নিজে শিক্ষা-দীক্ষায় বকলম হলেও দেশ-বিদেশে শিক্ষা নিয়ে যে বকবক করি তা এ লাইটহাউস থেকেই হাতে-কলমে শেখা। বিশ্বমানের একটি প্রতিষ্ঠান করার জন্য আমরা ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও জাপানের বিশ্বের শীর্ষ প্রতিষ্ঠানসমূহ ভিজিট করেছি। এমনকি বাংলাদেশের যে প্রান্তেই হোক ভালো কিছুর খবর পেলেই, দিয়েছি সেদিকে ভোঁ-দৌড়। 


দেশে-বিদেশে নজর কেড়েছে একটি বিদ্যালয় 

সেদিন ছিলো ২৩ জানুয়ারি, ২০০৪। লাইটহাউসে সকালের ছাত্র-সমাবেশ, ক্লাস-পরিদর্শন এবং অভিভাবকদের সাথে জরুরি সাক্ষাৎ শেষে পত্রিকা হাতে ধূমায়িত চা-এ চুমুক দিয়েছি মাত্র। অমনি চশমা ভেদ করে রঙিন প্রজাপতির মতো চোখে উড়ে এলো এক রঙিন হেডলাইন। দৈনিক প্রথম আলোর প্রথম পাতায় চার কলামের বিশাল নিউজ “দেশে-বিদেশে নজর কেড়েছে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়।” দেশের সর্বত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের যে জীর্ণরূপ ও মলিন ভাবমূর্তি, তাতে কোনো একটি বিদ্যালয় কি হঠাৎ কোনো অঘটন ছাড়া সংবাদপত্রের প্রধান শিরোনামের খবর হতে পারে? প্রথম আলো এমন খবরের জন্য একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্বাচন করেছে। সেটা গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার শিবরাম গ্রামে অবস্থিত ‘শিবরাম আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’। 

এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। নাহ, আর তর সইছে না। মাথায় ভ্রমণের ভোঁ-ভোঁ চক্কর শুরু হয়ে গেছে। আসলে শিক্ষা, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী নিয়ে আমার জ্ঞানগরিমা খুবই সামান্য। তবে মামা, চাচা, চাচাতো ভাই-বোনেরা অনেকেই শিক্ষকতার মহান পেশায় যুক্ত। বাবা-মা জেলার শীর্ষ স্কুলের বালক ও বালিকা শাখার প্রধান ছিলেন। চাচাতো বোন এখনো বালিকাতে প্রধান আছেন। সেহেতু রক্তের টানে এ বিষয়গুলো আমাকে খুবই আকর্ষণ করে।


দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া 

এটি একটি কবিতার অংশ। এ কবিতা, যা সকল বাংলাভাষীই জীবনে অন্তত একবার হলেও শুনে থাকবেন। মজার ব্যাপার হলো, এ কবিতাটার সাথে দুটো বিখ্যাত নাম জড়িত। সত্যজিৎ রায় ছোটবেলায় মায়ের সাথে শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন বেড়াতে। সে রবিঠাকুরকে তার খাতা এগিয়ে দেয় কিছু একটা লিখে (নিশ্চয়ই তখন অটোগ্রাফ শিকারিদের জন্ম হয়নি) দিতে। রবিঠাকুর সত্যজিৎ-এর খাতায় “এটার মানে ও আরেকটু বড় হলে বুঝবে” বলে এই আটলাইনের কবিতাটা লিখে তার মায়ের হাতে দিয়েছিলেন। 

সত্যিই আমরা সাধারণত নিজের আশপাশের সেরা জিনিসগুলোর দিকে তাকাই না। শুধু লন্ডন, আমেরিকা, জাপান ইদানীং যুক্ত হয়েছে ভারত, চীন; তাদের না দেখলে নাকি সেরা হওয়া যায় না! কিন্তু “ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া” অনেক সময় সেরাটা যায় মিলিয়া। 

সপ্তাহখানেকের ভেতরই মওকা মিললো। টাঙ্গাইল থেকে যাত্রা শুরু করে আয়তনে পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম নদী যমুনা পাড়ি দিলাম দক্ষিণ এশিয়ার ষষ্ঠ দীর্ঘতম সেতুর ওপর দিয়ে। ঘণ্টা পাঁচেক লাগলো ১৮২ কিলোমিটার দূরে গাইবান্ধা শহরে পৌঁছতে। বেশ ছিমছাম শহর কিন্তু অনুন্নতির ছাপ স্পষ্ট। উত্তরবঙ্গের পাঁচটি জেলার মতো এটিও মঙ্গা-ক্লিষ্ট এলাকা।

এরপরের গন্তব্য সুন্দরগঞ্জ উপজেলা। 

ও বাবা! ওতে ‘সুন্দর’ শব্দ যুক্ত থাকলেও যেতে হয় লক্কড়-ঝক্কড় মুড়িরটিন বাসে চেপে। এরপর আর বাসও নেই, অবশেষে ভ্যানে চেপে পৌঁছলাম ছাইতানতলা বাজারে। মুরুব্বিরা সবুজ ক্ষেতের মাঝে একটি চওড়া আইল দেখিয়ে দিলেন। সে পথেই চললাম শিবরাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খোঁজে। তখন ভর-দুপুর। ডানপাশে বেতের ঝোপ। আর তাতে বেশ খোশহালে শেয়াল ডেকে যেন এ নতুন মেহমানকে স্বাগত জানাচ্ছে। একেবারে আক্ষরিক অর্থেই অজপাড়াগাঁ। 


সাহারা মরুতে এক মরূদ্যান

হ্যাঁ, অবশেষে স্কুল পেলাম, যেন সাহারা মরুতে এক মরূদ্যান, জমকালো সাজানো-গোছানো। হাসিমুখে একজন পিয়ন পথ দেখিয়ে প্রধান শিক্ষকের রুমে নিয়ে গেলেন। সেখানে বড় ধরনের ধাক্কা খেলাম, প্রধান শিক্ষক মহোদয় চেয়ারে পা তুলে বসে আছেন। আর মজা করে পান চিবোচ্ছেন। ঠোঁটের কোনা বেয়ে কিছু অবাধ্য লাল পান-পিক তার ধবধবে সাদা জামাটিকে কিছুটা রঙিন করেছে বৈকি। আমার ঘোর না কাটতেই তিনি বললেন- এখানে চট্টগ্রাম জেলার ডিসি সাহেবের ছেলে পড়ে। আমিতো ‘থ’। বোধ হয় এ অবস্থাকেই ব্যাকরণবিদরা বলেছেন, ‘বিনা মেঘে বজ্রপাত।’

সেখানে আন্তরিকতায় টইটম্বুর আপ্যায়ন হলো। অতঃপর হেডমাস্টার সাহেব আমাকে চতুর্থ শ্রেণির এক কক্ষে, শ্রেণিশিক্ষকের হাতে বুঝিয়ে দিয়ে এলেন। এবার শ্রেণিশিক্ষক বললেন, স্যার ছাত্রদের কিছু দক্ষতা দেখাই? আমি জি বলতেই, তিনি আমার ঘাড়েই দিলেন বাছাইয়ে দায়িত্ব। মুরুব্বিদের কাছে শুনেছি আগের ডাকসাইটে স্কুল ইন্সপেক্টরদের কথা। স্কুল-প্রধানরা তাদের ভয়ে কম্পমান থাকতেন। প্রতি ক্লাসে কিছু ছাত্রকে পড়িয়ে-শুনিয়ে টিয়েপাখির মতো রেডি রাখতেন, যারা গড় গড় করে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতো।

সে জ্ঞান-স্মৃতির কারণে আমি এক্কেবারে পেছন থেকে এক গোবেচারা মতো ছেলেকে বাছাই করলাম। তাকে কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস না করে শিক্ষক হিসেবে কিছুক্ষণ ক্লাস পরিচালনা করতে বললাম। ছেলেটি হেলেদুলে আসলো। পুরো ক্লাসের ছাত্রদের চারটি গ্রুপে ভাগ করলো। ওরা নিজেরাই গ্রুপ লিডার, কো-লিডার ঠিক করে নিলো। এরপর ছেলেটি তাদের পাঠ্যপুস্তক থেকে একটি কাজ দিলো। প্রতিটি গ্রুপ নিজেরা পরামর্শ করে লিডারের নেতৃত্বে ঢাউস সাইজের কাগজে তাদের সিদ্ধান্তের বিবরণ লিখছে। নির্ধারিত সময় শেষ হলে শিক্ষক সাজা সে ছেলেটি একে একে গ্রুপ-লিডারদের ডাকছে। লিডারগণ এসে তাদের ঢাউস কাগজটি ব্ল্যাকবোর্ডের সাথে আটকিয়ে তাদের আলোচনার বিবরণ দিচ্ছে। একটি গ্রুপ শেষ হচ্ছে আর মুহুর্মুহু করতালি পড়ছে। কিন্তু আমি বেচারা স্থবির, একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কারণ ভারতের লাক্ষ্নৌতে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ স্কুল City Montessori School, Lucknow Rvcv‡bi Waseda University সিঙ্গাপুরের  Nanyang Technological University এর কোয়ালিটি কনভেনশনগুলোতে প্রেজেন্টেশন স্কিলের ওপর এতদিন যে বিষয়গুলো শেখেছি। আজ ঢাকা থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে এই অজপাড়াগাঁয়ের একটি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রবৃন্দ কর্তৃক এর সুনিপুণ ব্যবহার দেখে আমি তো এক পায়ে খাড়া তালগাছের মতোই তাজ্জব।


ইউনিসেফ-এর ‘আওয়ার স্কুল’

দেশে এই মুহূর্তে মোট ১, ১৮, ৮৯১টি প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। যার মধ্যে ৬৫, ৫৬৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এ বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে শিবরাম বিদ্যালয় নানা দিক থেকে ব্যতিক্রমী। কারণ স্কুলটির রয়েছে কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য; স্থায়ীভাবে স্কুলটির পরিপাটি পরিবেশ, সুশৃক্সক্ষল পরিচালনা, শিশুদের জন্য আকর্ষণীয় শিক্ষণপদ্ধতি ও শিক্ষা-উপকরণের সমাবেশ, শিক্ষার মান, পাঠক্রমের অতিরিক্ত প্রতিভা বিকাশের অনুকূল সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কার্যক্রম। 

এছাড়াও রয়েছে হাতে-কলমে ছাত্র-ছাত্রীদের শেখানোর জন্য নানা বাস্তবভিত্তিক আয়োজন। যেমন, তাদের প্রিয় কক্ষটির নাম ‘ভৌগোলিক কক্ষ’ এতে নদ-নদী, আগ্নেয়গিরি, জলপ্রপাত, বন-মরু, শহর, বন্দর, গ্রামের প্রকৃতি থরে থরে সাজানো। ভূগোল, সাধারণ জ্ঞান ওরা মুখস্থ করে নয় বরং হাতে ধরে ধরে শেখে। এছাড়াও ‘উপকরণ কক্ষ’-এ আছে বাঘ, হরিণ, পাখি, গাড়ি-ঘোড়াসহ প্রায় এক হাজারটি বিষয়। আরো আছে ১০টি গ্লোব ও ৩০টি মানচিত্র। আছে দেশ-বিদেশের বরেণ্য কবি-সাহিত্যিক-বিজ্ঞানী-রাষ্ট্রনেতা প্রমুখের ছবি। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে শিশুরা চিনে নিচ্ছে এখান থেকেই।


ছাত্র-ছাত্রীদের ‘ভৌগোলিক কক্ষ’ 

এ সকল বিশেষ পদক্ষেপের কারণেই বাংলাদেশের ৬৪ জেলার সাড়ে ৬৫ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভেতর এটি একটি মডেল হয়ে শুধু জাতীয় পুরস্কারই পায়নি, স্কুলটি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থারও নজর কেড়েছে। প্রাথমিক শিক্ষায় অনন্য দৃষ্টান্ত রাখার স্বীকৃতি হিসেবে প্রধান শিক্ষক নূরুল আলম ১৯৮৫ সালে জাতীয় পর্যায়ে “শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক” নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে ইউনিসেফ স্কুলটিকে শ্রেষ্ঠ স্কুল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৯৬ সালে স্কুলটিও জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। ২০০০ সালে জাতীয় পদক লাভ করে স্কুলটির ম্যানেজিং কমিটি। স্কুলটির ছাত্রছাত্রীদের সমবায় সমিতিও বিভাগীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে। ১৯৯০ সালে এ স্কুলটি নিয়ে ইউনিসেফ ‘আওয়ার স্কুল’ নামে এর পরিচিতি ছাপিয়ে প্রকাশ করে। এটি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্কুলে পাঠানোর পর থেকে অভিভাবকরা এই স্কুলে যোগাযোগ করতে থাকেন। স্কুলটির সাফল্যগাথা পৌঁছে যায় দেশের সর্বত্র এমনকি সীমান্ত পেরিয়ে বহির্বিশ্বেও। 


নূরুল আলম: কিভাবে হলেন জিনিয়াস প্রধান শিক্ষক?

নূরুল আলম গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে ১৯৫১ সালে স্কুল শিক্ষক আবুল হোসেনের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। ৬ ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। ১৯৬৯ সালে এসএসসি পাসের পর ’৭৩ সালে শিক্ষকতায় যোগ দেন। ১৯৮৪ সালে এই স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর স্বপ্নদর্শী, সৃজনশীল ও আত্মবিশ্বাসে টগবগে এই যুবকের চেষ্টায় স্কুলটি নতুনরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯৮৫ সালে জাতীয় পর্যায়ে ‘শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক’ হিসেবে সম্মাননা অর্জন করেন। ৩৫ বছরের শিক্ষকতা পেশা থেকে তাঁর ২০০৮ সালে অবসরে যাওয়ার কথা থাকলেও সরকারের সর্বোচ্চ মহলের বিশেষ নির্দেশনায় আরো তিন বছর এক্সটেনশন দেওয়া হয়, যা বাংলাদেশে ব্যতিক্রম। অবশেষে ২০১১ সালে অবসরে গিয়ে গাইবান্ধা শহরের অদূরে তিনি গড়ে তোলেন ‘আমার বাংলা বিদ্যাপীঠ’। তাঁর প্রণীত ‘আনন্দপাঠ ধারা’ আজ সমগ্র দেশে চালু হচ্ছে। তাঁর পদ্ধতি জানতে চায়না ও সিঙ্গাপুরের শিক্ষা-কর্তৃপক্ষ তাঁকে সে দেশসমূহে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। 


যে জিনিয়াস সে সিরিয়াস 

ইতঃপূর্বে এ বিষয়ে আলোচনা করেছি, এখন দেশখ্যাত একজন শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষকের জীবন থেকে এটি বোঝার চেষ্টা করবো। আমি এ প্রতিষ্ঠানে চারবার গিয়েছি; দু-চারদিন থেকেছিও। আমাদের শিক্ষকরা এ স্কুলে থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ওনার নতুন স্কুলেও দুবার গিয়েছি। ওনাকেও চারবার আমন্ত্রণ করে আমাদের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য সশরীরে নিয়ে এসেছি। অনলাইনে তিনবার প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছি। শিক্ষকতায় অনন্য অবদানের জন্য, নূরুল আলম স্যারকে আমি গুরু ডাকি আবার উনিও মজা করে আমাকে গুরু ডাকেন। ওনার ওপর যত লেখালেখি ছিল, আমি সেগুলো পড়ার চেষ্টা করেছি। সেই সামান্য অভিজ্ঞতায় নিজের সাজানো ফর্মুলায় লিখছি। 


সি+রি+য়া+স- একটি ম্যাজিক ফর্মুলা 

সি-সিধা কাজে যুক্ত হওয়া : এসএসসির পর তিনি পারিবারিক সমস্যায় আর পড়ালেখায় এগোতে পারেননি। বরং বড় ছেলে হিসেবে মাত্র ২২ বছর বয়সে শিক্ষকতায় ঢুকতে হয়েছে। প্রতিদিন তিল তিল করে নিজেকে গড়েছেন। দরিদ্রতার বিরুদ্ধে সেই তারুণ্যেই তিনি চ্যালেঞ্জ নিয়ে মাত্র ১১ বছরের মাথায় ১৯৮৪ সালে প্রধান শিক্ষক হন। তাঁর বয়স তখন মাত্র ৩৩ বছর। বন্ধুরা যখন মাস্টার্স শেষ করে বেকারত্বে খাবি খাচ্ছে তিনি তখন বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখছেন। 


২. সি- সিনসিয়ার : (sincere) মানে অকৃত্রিম; আন্তরিক; খাঁটি। তিনি বিশ্বজয়ের জন্য এ পেশাটি ইবাদাত হিসেবে নিয়েছিলেন। ১২ মাসের ৫২ সপ্তাহের ৩৬৫ দিনের অষ্টপ্রহর তিনি এই স্কুল নিয়েই থাকতেন। ফজরের পর থেকে রাত ১১-১২টা পর্যন্ত চলতো তাঁর কর্মযুদ্ধ। এটিই ছিল তাঁর ধ্যান-খেয়াল, স্বপ্ন-সাধনা। 

রি- রিপিটেশন : বারবার চেষ্টা : একটি জ্ঞান-বিপ্লব করার জন্য তিনি তাঁর টিম নিয়ে শিক্ষার্থীদের পেছনে জোঁকের মতোই লেগে থাকতেন। প্রতিটি শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত কমতি চিহ্নিত করে তা শোধরাতে নিয়মিত চেষ্টা চালিয়ে যেতেন। তাদের বোঝার ক্ষমতা, উচ্চারণ, হাতের লেখা; কোনো কিছুই সেই টিমের নজর এড়াতো না। 

য়া/আ- আনন্দের মাধ্যেমে কাজ (পাঠদান) : অধিকাংশ শিক্ষকের মতো তিনিও আগে পিটিয়ে পড়া আদায় করতেন। একদিন নির্ধারিত ক্লাসে ঢুকতে যাবেন, বারান্দা থেকেই শুনলেন ছেলেরা বলাবলি করছে, এখন কার ক্লাস রে? কয়েকজন একত্রে উত্তর দিলো- বুঝবি মজা, এখন লাঠিয়ালের ক্লাস। তিনি দরজার অপর পার্শ্বে বারান্দায় থমকে গেলেন। বুঝলেন তাকেই এই শিশু-ছাত্ররা লাঠিয়াল ডাকে। কী মনে হলো আর সে মুহূর্তে তিনি ক্লাসে ঢুকলেন না। শিক্ষক-কমনরুমে ঝিম মেরে বসে থাকলেন। সেদিন আর কোনো ক্লাসই করা হলো না। রাতে কেঁদে-কেটে নিজের সাথেই শপথ নিলেন। পরদিন তিনি অন্য এক মানুষ। শুরু হলো তাঁর নতুন বিপ্লব- আনন্দের মাধ্যমে পাঠদান।

য়া/আ- আন্দোলন : একটি মহৎ কাজ জোরদার, বাস্তবায়ন কিংবা দীর্ঘমেয়াদি করতে চাইলে সেটিকে সংশ্লিষ্ট সবার মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে তাকে একটি আন্দোলনের রূপ দিতে হবে। স্যার এটি সার্থকভাবে করেছিলেন। আমরা ট্রেনিং থেকে দেখেছি- বৃদ্ধ পরিচ্ছন্নতাকর্মী গাছের নিচে হাত পেতে আছে। জিজ্ঞেস করায় বললো- সমগ্র ক্যাম্পাসে কোনো ময়লাতো দূরের কথা, একটি পাতাও নেই। সে চায় গাছের একটি পাতা মাটিতে পড়ার আগেই ধরে ফেলবে। কী সর্বগ্রাসী স্যারের আন্দোলন! 

স- সত্য-সুন্দর লক্ষ্য : সত্যের আলোয় দীপ্ত ও সুন্দর লক্ষ্য না থাকলে সবাইকেতো দূরের কথা- নিজের সহযোগী, পরিবার এমনকি নিজকেও সর্বদা উজ্জীবিত রাখা যায় না। নূরুল আলম স্যার প্রতিটি শিক্ষার্থীকে আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে একটি সমৃদ্ধ ও আলোকিত বাংলাদেশ তৈরি করার স্বপ্ন দেখতেন। তাই তিনি সর্বদা নিজের থেকেই প্রেরণা পেতেন। 

তিনি জিনিয়াস ছিলেন তাই সিরিয়াস হয়ে তাঁর সকল কমিটি মেম্বার, শিক্ষক, কর্মচারী, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের জাগিয়ে তুলে এই অজপাড়াগাঁয়ে নতুন এক বিপ্লব সৃষ্টি করেছিলেন। যেটি দেখতে ইতোমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, ও ভারতসহ প্রায় ২৭টি দেশের অসংখ্য প্রতিনিধি স্কুলটি পরিদর্শন করেছেন। এমনকি বিশ্বব্যাংকের আবাসিক পরিচালক স্কুলটি পরিদর্শন করেছেন। জাপানের শিক্ষা-বিশেষজ্ঞ তুশিমা পরিদর্শন বইয়ে মন্তব্য লেখেন, ‘বাংলাদেশে এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেখে আমি অভিভূত।’ (চলবে)

লেখক : শিক্ষাবিদ ও ক্যারিয়ার স্পেশালিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির