post

পরিবেশ সংরক্ষণ ও বৃক্ষ রোপণের গুরুত্ব

আবুল খায়ের নাঈমুদ্দীন

০৭ জুন ২০২৩

একটি লাথির মূল্য লাখ টাকা। কথাটি শুনতে অবাক লাগলেও সত্য। ছাত্র অবস্থায় বৃক্ষরোপণের উপর জেলা বন বিভাগের আয়োজনে একটি প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেছিলাম। সেখানে এ কথাটির মর্মার্থ আমাদেরকে ভালো করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষক বলেছিলেন- আপনি চলতি পথে একটি বৃক্ষের বিচি দেখতে পেলেন। সেটি তালের, আমের, জামের, গাবের, করইয়ের, বরইয়ের, সেগুনের, মেহগনির বা চন্দন কাঠের, যে কোনো গাছের বিচি হতে পারে। বিচিটিতে একটি লাথি মেরে মাটিতে গেড়ে দিলেন, ব্যাস। একটি ফলের বিচি একটি গাছের জন্ম দেবে, গাছ অক্সিজেন দেবে, সুন্দর পরিবেশের জন্ম দেবে, গাছের আসবাবপত্র তৈরি হবে, গাছ বিক্রি করে অর্থ পাওয়া যাবে, হয়তো আইজ্যাক নিউটনের মতো আরো বৈজ্ঞানিকও জন্ম দেবে। গাছ একটি জড় পদার্থ অথচ জীবের প্রাণ রক্ষার্থে গাছের বিকল্প নেই।

আমাদের পাঠ্যবইয়ের একটির নাম ‘পরিবেশ পরিচিতি’। পরিবেশের পরিচিতিটা পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে সকলের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়ার গুরুত্ব বোঝানো হয়েছে। পরিবেশের গুরুত্ব বুঝাতে ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ পালিত হয়। বিশ্বে শান্তি বজায় রাখার অন্যতম মাধ্যম পরিবেশ ঠিক রাখা। আমরা কথায় বলি- পরিবেশ শান্ত হলে, বা পরিবেশ পরিস্থিতি আগে ঠিক হোক এসব কথার মূল কথা শান্তি। তাই আমি মনে করি সমাজে শান্তি বজায় রাখার ক্ষেত্রে বৃক্ষজনিত পরিবেশের গুরুত্ব অপরিসীম।

পরিবারে সমাজে কিংবা রাষ্ট্রের পরিবেশ ঠিক থাকলে তখন সমাজ সুশৃঙ্খল ও সৌন্দর্যে ভরপুর হবে। শান্ত পরিবেশের ফলে মানুষের মনেও শান্তি থাকে। সেটা রাজনৈতিক পরিবেশ কিন্তু ভৌগোলিক পরিবেশ ঠিক রাখার একমাত্র সুপথ হলো বৃক্ষ ও বনাঞ্চল। সেই পরিবেশের সংজ্ঞা দিতে বলা হলে অবশ্যই সবাই গাছ-পালা, নদী-নালা, খাল-বিলের কথাই সামনে আনবেন। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খরা, ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি ও খরা প্রতিরোধে বৃক্ষের ভূমিকা অনস্বীকার্য, বৃক্ষ সংবলিত পরিবেশ হলে সেখানে চৈত্র মাসেও তাপমাত্রা ২৫ থেকে ২৮ ডিগ্রির মাঝে থাকে। তাই পরিবেশের জন্য বৃক্ষের গুরুত্ব অপরিসীম।

মুসলমানগণ সব সময় কৃষি ও পরিবেশ বান্ধব কাজের সাথে জড়িত ছিলেন। তারা এসব গবেষণায় সব সময় এগিয়ে। নবী রাসূলগণও গবাদি পশু পালন ও কৃষিবিষয়ক কাজের সাথে জড়িত ছিলেন। তাঁরা আকাশের দিকে তাকিয়ে আবহাওয়ার খবর বলতেন। তারা মৌসুম অনুযায়ী বিভিন্ন ফসল চাষ করতেন। তারা বছরে চারটি ফসলও চাষ করতেন। তাদের হাতে বরকতও ছিলো। যেখানে হাত দিতেন সেখানে ফসলে ভরে যেত। পাশ্চাত্য দেশগুলো বা ইউরোপের লোকেরা এখনো স্বীকার করে। একজন ফ্রেঞ্চ অধ্যাপক মন্তব্য করেছেন, এখনো যদি পৃথিবীতে মুসলমানদের শাসন ক্ষমতা দেওয়া হতো, তারা তাদের হাতে বিচিত্র ফসল আবাদ করতে পারতো। বিশ্ব পরিবেশ ও সামাজিক শান্তি বজায় থাকতো।

হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো একটি বৃক্ষ রোপণ করল, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এর বিনিময়ে তাকে এই বৃক্ষের ফলের সমপরিমাণ সওয়াব প্রতিফল দান করবেন।’  (মুসনাদে আহমদ)। গাছের প্রতিটি পাতা আল্লাহর জিকির করে। সেই জিকিরের সওয়াব রোপণকারীর আমলনামায় লেখা হয়। ফলমূল মানুষের কাজে আসে, ছায়া দেয় জগতের প্রাণীদেরকে। যা সদকায়ে জারিয়ার সাওয়াবে পৌঁছে। পরকালেও বৃক্ষের নিচে ছায়া পাওয়ার প্রত্যাশা সব মুসলিম করেন। তার মানে সেখানেও বৃক্ষ রেখেছেন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন।

গাছ আমাদের পরম বন্ধু। গাছের প্রয়োজনীয়তা সকল সময়, সকল যুগে, সকল সমাজে, সকল কাজে সকলভাবেই প্রযোজ্য। অক্সিজেন, ছায়া, পুষ্টি ও সৌন্দর্য ছাড়াও অকাজের গাছটিও জ্বালানি হিসেবে মানুষের উপকারে আসে। শিল্পের নানা উপাদান হিসেবে গাছ ও তার ফল ব্যবহার হয়। গাছের সীমাহীন গুরুত্ব সত্ত্বেও আমাদের বনগুলোর অবস্থা আজ হতাশাজনক। অথচ বিখ্যাত সুন্দরবন আমাদের গর্ব। যার সৌন্দর্য আর বিলুপ্ত প্রায়। দুঃখজনক হলেও সত্য এখন আর সুন্দরবনের সেই সৌন্দর্য নেই। ভাওয়ালের শাল-

গজারির বন ধ্বংসের পথে। মধুপুর আর সিলেটের বনের অবস্থাও ভালো নয়। 

মানুষের মৌলিক চাহিদা অন্ন বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা চিকিৎসা। এই পাঁচটির মধ্যে বস্ত্র ব্যতীত বাকি চারটি চাহিদার সাথে পরিবেশের সাথে সম্পর্ক রয়েছে। পরিবেশের সৌন্দর্যের অন্যতম মাধ্যম বনায়ন। তাইতো সকল পেশাজীবী মাঝে মধ্যে দু’দণ্ড শান্তির অন্বেষায় বনাঞ্চলে ঘুরে আসেন। এমনকি শিক্ষার্থীদের পিকনিকও চলে এসব সুন্দর মনোরম ও বনাঞ্চল পরিবেশে। সুস্থ সুন্দর জীবনের জন্য বৃক্ষ রোপণ, যত্ন গ্রহণ ও সংরক্ষণ জরুরি।

পরিবেশের দূষণ ও বিপর্যয়সহ জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির দিক দিয়ে বাংলাদেশ বিশে^র প্রথম সারির দেশগুলোর একটি। উষ্ণায়ন বৃদ্ধির ফলে জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবে ভুগছে দেশ। ফলে নানাবিধ ক্ষতির সঙ্গে বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগও। বাংলাদেশকে ষড়ঋতুর দেশ বলা হলেও এখন তিনটি ঋতু ছাড়া অন্যান্য ঋতু এখন আর দৃশ্যমান ও অনুভূত হয় না! আবার এখন জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবে চিরচেনা গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত ঋতুর বিশৃঙ্খল আচরণ প্রকৃতিকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। এ বছর ঢাকা শহরেই ৩৭ থেকে ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রা অহরহ পাওয়া যাচ্ছে যা কখনো কেউ দেখেনি। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে ভালো উপায় হচ্ছে বেশি বেশি করে গাছ লাগানো। ঠিক বিপরীতে সৌদি মরুভূমির দেশ হয়েও তারা বৃক্ষ রোপণে এগিয়ে থাকার দরুন তাদের দেশে এখন তাপমাত্রা কমে এসেছে। বৃষ্টি হচ্ছে, সুন্দর সুন্দর ফসল হচ্ছে।

গবেষকদের গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীর মোট উদ্ভিদ প্রজাতির ভেতরে ২৫ শতাংশই বৃক্ষ। বৃক্ষ ছাড়া প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য কল্পনা করা অবান্তর। সঙ্গত কারণেই ইসলাম পরিবেশ সংরক্ষণ ও বৃক্ষরোপণে জনসচেতনতা তৈরিতে উৎসাহ ও নির্দেশনা দিয়েছে।

পরিবেশ ও জীব জগতের পরম বন্ধু এই বৃক্ষ জীব জগতের জন্য আল্লাহর শ্রেষ্ঠ উপহার হলো বৃক্ষ। মানুষ আল্লাহকে সিজদা করুক আর না করুক তারকারাজি ও বৃক্ষ আল্লাহকে সিজদা করে। বৃক্ষ রোপণ করলে তার ফলমূল অন্যরা খেলে তার জন্য রোপণকৃত ব্যক্তির নামে সাওয়াব লেখা হবে। বাস্তবে আমরা দেখি, বৃক্ষ আমাদের ফল-ফসল দেয়, ফুল দেয়, ছায়া দেয় ও কাঠ দেয়। বৃক্ষ আমাদের আরও অনেক উপকার সাধন করে। যেমন মাটিকে উর্বর করে তোলে। বেঁচে থাকার জন্য আমাদের অতীব প্রয়োজনীয় উপাদান অক্সিজেন আসে এই বৃক্ষ থেকে। যেখানে বৃক্ষ বেশি থাকে, সেখানে বৃষ্টিপাতও বেশি হয়। বন্যা-জলোচ্ছ্বাসে মাটির ক্ষয়রোধ, খরায় ছায়া, ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি হ্রাসে বৃক্ষের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বৃক্ষ ছাড়া প্রাণিকুলের জন্য পৃথিবীতে বসবাস করা প্রায় অসম্ভব। পৃথিবীর শত কোটি মানুষের খাদ্য, ঔষধ, বস্ত্রের সুতা, ভারসাম্যপূর্ণ আবহাওয়া, পরিষ্কার পানি প্রবাহ, কৃষি জমিতে উৎপাদন বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্ব দূর করা ইত্যাদির ক্ষেত্রে বৃক্ষ অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বৃক্ষহীন রুক্ষ মাটি দেশের জন্য, দশের জন্য অভিশাপ স্বরূপ। সুতরাং আমাদের জীবনে বৃক্ষের গুরুত্ব ও অবদান অপরিসীম। 

শিশুর পুষ্টি ও সুষম বিকাশের জন্য মাতৃদুগ্ধ যেমন অপরিহার্য, তেমনি জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষার জন্যও বৃক্ষ অপরিহার্য। পরিবেশ শান্ত-শীতল ও মনোমুগ্ধকর রাখে বৃক্ষ। বৃক্ষ আল্লাহর অপরূপ সৃষ্টি। পৃথিবীর শোভাবর্ধনে বৃক্ষের অবদান অপরিসীম। চৈত্রের খরতাপে বৃক্ষের ঝিরিঝিরি বাতাস আমাদের দেহ-মন শীতল করে। নির্মল বায়ু স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। গ্রীষ্মের উত্তপ্ত রৌদ্রে বৃক্ষছায়া প্রশান্তি ও স্বস্তি আনে। প্রচুর পরিমাণ বৃক্ষ থাকলে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকে। ফলে মানুষ সহজে রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয় না। জমির উর্বরাশক্তি ও ফলন বাড়াতে বৃক্ষের অবদান অপরিসীম।

আমাদের পৃথিবীর সর্ব বৃহৎ সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, নিঝুমদ্বীপ, কুয়াকাটা, সিলেট, বগুড়া, রংপুর, সুন্দরবন, বাগেরহাট, পার্বত্য অঞ্চলসহ বাংলাদেশে রয়েছে অসংখ্য পর্যটন কেন্দ্র যা বৃক্ষনির্ভর ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। পৃথিবীর খুব কম দেশেই এমন আছে। আমরা সুজলা সুফলা সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশে বাস করি। ১৩০০ নদী আর সুন্দরবনের বৃক্ষই এ দেশকে সৌন্দর্যের নীলাম্বরীর আকর্ষণ দিয়েছে। তাইতো পৃথিবীর সব দেশ থেকে এ দেশে আসেন পর্যটকগণ।

বিশ্ব কবি বৃক্ষের প্রেমে পড়ে বৃক্ষের এ দেশকে বলেছেন মা। এই সৌন্দর্যের অন্যতম রহস্য হচ্ছে বৃক্ষ এবং বৃক্ষ আর নদীমাতৃক দেশ। কেউ বলেছেন রূপসী বাংলা কেউ বলেছেন সোনার বাংলা, কেউ বলেছেন পৃথিবীর সব সুখ এদেশে এই বৃক্ষে। আমাদের বাঁচতে হলে বৃক্ষ রোপণের বিকল্প নেই। প্রত্যেকে তার নিজস্ব পরিমণ্ডলে একটি গাছ রোপণ করলে সতেরো কোটি গাছ হবে তা এ দেশের উন্নয়নে বিরাট অর্থনৈতিক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি।

বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যা করতে নির্দেশ দিয়ে মহানবী সা. বলেছেন, যদি নিশ্চিতভাবে জানো যে কিয়ামত এসে গেছে, তখন হাতে যদি একটি গাছের চারা থাকে, যা রোপণ করা যায়, তবে সেই চারাটি রোপণ করবে। একদা নবী করিম সা. হজরত সালমান ফারসি রা.-কে মুক্তির জন্য তাঁর মালিকের কাছে গেলেন। মালিক মুক্তিপণ হিসেবে ১০০ খেজুর গাছ রোপণের শর্তারোপ করলে রাসুলুল্লাহ সা. তাতে রাজি হলেন এবং নিজ হাতে ১০০ খেজুর গাছের চারা রোপণ করে তাঁকে মুক্ত করলেন। 

আরেক হাদিসে এসেছে কোনো ব্যক্তি বৃক্ষ রোপণ করে তা ফলদার হওয়া পর্যন্ত তার পরিচর্চা ও সংরক্ষণে ধৈর্যধারণ করে তার প্রতিটি ফল যা নষ্ট হয় তার বিনিময়েও আল্লাহ তায়ালা তাকে সদকার নেকি দেবেন। (মুসনাদে আহমদ)

আরো বলেছেন, যে ব্যক্তি বিনা প্রয়োজনে গাছ (যে গাছ মানুষের উপকার করে) কাটবে, আল্লাহ তার মাথা আগুনে নিক্ষেপ করবেন। (আবু দাউদ-৫২৪১)

সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ কথাটি বলা দরকার তাহলো- বৃক্ষের মাধ্যমে আমাদের বেকারত্ব দূর করাও সম্ভব। চরাঞ্চলে, পাহাড়ে, সাগর পাড়ে, অনাবাদি জমিনে বৃক্ষ লাগাতে পারি, সম্প্রতি বিভিন্ন খামার ও ফার্ম করে যেভাবে যুবকরা নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করছে তেমনি করে পরিকল্পিত বৃক্ষ রোপণেও বেকারত্ব দূর করা সম্ভব।

এ জন্য পরিবেশ সংরক্ষণে মানুষের সর্বপ্রধান দায়িত্ব হলো, দূষণের যথার্থ কারণ চিহ্নিত করে তা রোধকল্পে কার্যকরী ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এবং খালি জমি না রেখে সব স্থানে বৃক্ষ রোপণ করা। নদী ও বৃক্ষের সমন্বয়ে পরিণত হবে পৃথিবীর সুন্দর ও সর্বশ্রেষ্ঠ দেশ আমাদের বাংলাদেশ।


লেখক : সাবেক অধ্যাপক ও প্রবন্ধকার

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির