post

মনন সংস্কারে মহানবী সা. এর সূক্ষ্মদর্শিতা

ড. কামরুল হাসান

১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩

আল্লাহ পৃথিবীর মানুষকে সঠিক পথের দিশা দিতে, অন্যায়-বিচ্যুতি হতে হেফাজত করতে, অপকর্ম-খোদাদ্রোহিতা হতে মুক্ত রাখতে, যুগে-যুগে প্রতিটি অঞ্চলে প্রয়োজনমাফিক হেদায়াতকারী, সতর্ককারী প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ বলেন- “কোনো জাতিকে সতর্ককারী প্রেরণ ব্যতীত রাখেন না।” (৩৫ : ২৪)। প্রত্যেক নবীই তাঁর আপন অঞ্চলের, নির্ধারিত জাতির বা ভাষাভাষী লোকজনের মধ্যে একান্ত আন্তরিকতার সাথে এ শুদ্ধিকর্ম পরিচালনা করেন। 

এই শুদ্ধি অভিযানের জন্য যারাই আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত ও নির্বাচিত তারাই আমাদের কাছে নবী ও রাসূল হিসেবে পরিচিত। যুগে যুগে তারাই অন্ধকার পৃথিবীতে জ্বালিয়েছেন আলোর মশাল। অশান্ত পৃথিবীতে ছড়িয়েছেন শান্তির বার্তা। যাবতীয় অশ্লীলতাকে ধুয়ে মুছে সাফ করে দিয়েছেন শ্লীল সংস্কৃতির অমিয় বাতাবরণে। সংস্কারের এই মহান দায়িত্ব সকল নবীর জন্যই আবশ্যক ছিল। 

 রাসূল সা. যদ্যপি নবী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন সেদিন হতেই মক্কাবাসীর উন্নয়ন ও শুদ্ধির জন্য মনন ও মানসের চাষ শুরু করেছেন অতীব যতেœর সাথে। কারণ জাতির টেকসই উন্নয়নের জন্য এটি পূর্বশর্ত। তিনি নবুওয়তি জীবনের প্রথমাংশ তথা মাক্কিজীবনের প্রতিটি পরতকে গ্রথিত করেছেন মানস চাষের নিয়মতান্ত্রিকতায়। এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল মক্কা হতে মদিনা হিজরতের পরও। হিজরত পরবর্তী জীবনে তাঁর রাষ্ট্রিক ব্যস্ততা, যুদ্ধ অভিযান পরিচালনা, আরবের বাইরের বিশ্বে ইসলামের সুমহান আহ্বান পৌঁছানোর মহান প্রয়াস, নবদীক্ষিত মুসলিমদের ইসলামের সঠিক দীক্ষা প্রদান, রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো মজবুতকরণের সঠিক নির্দেশনা ইত্যাকার সকল দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি মুমিনদের মননের চাষ ও তাকে উৎকর্ষ মাত্রায় পৌঁছানোর সার্বক্ষণিক ব্যস্ততা লক্ষণীয়। কারণ রাষ্ট্রের বা সমাজের কিংবা পরিবারের কোনো ভিত্তিই টেকসই হবে না যদি না সেই কর্মোদ্যোগের পথে মনন ও মানসের যথা সংযোগ থাকে। এই উপলব্ধির বাস্তবতা থেকেই মহানবী সা. মননের সংস্কারের প্রতি গভীর মনোযোগ প্রদান করেন। কী ব্যক্তি, কী সমাজ, কী অতিথি, কী বিদেশী সবার সাথেই তাঁর ব্যক্তি আচরণ কিংবা সামাজিক আচরণের নেপথ্যের উদ্দেশ্য ছিল মননের উৎকর্ষ বিধান ও সমাজ কাঠামোর ভিত্তিকে দৃঢ় করতে তা কাজে লাগানো। ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক মননের উৎকর্ষতায় তাঁর বাস্তবানুগ নানান পদক্ষেপ, পরিকল্পনা ও কর্মসূচির প্রতি আমরা দৃকপাত করতে প্রয়াস পাব।

 একজন মানুষের মনন ও মানসকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিশীলিত করে তার নিত্য দৈনিকতা, তার নিত্য আচরণের এসব বিষয়ে লক্ষ্য করলেই উপলব্ধি করা যায় তিনি কেমন মানসিকতার? তার প্রকৃতি কোন ধরনের? তার ব্যক্তিত্ব ও পর্যবেক্ষণ প্রকৃতি কেমন? আধুনিক মনোবিজ্ঞান মনে করে মানুষের ব্যক্তিত্ব, আচরণ, স্বভাব, প্রকৃতি ইত্যাদিকে নিয়ন্ত্রিত, নিয়মিত, পরিমিত ও পরিশীলিত করে প্রধানত তার নিত্য চারটি অভ্যস্ততা। সেগুলো হলো-

ক. খাদ্যাভ্যাস বা Eating pattern, খ. নিদ্রাভ্যাস বা Sleeping pattern

গ. আচরণাভ্যাস বা Behaviouring pattern, ঘ. চিন্তাভ্যাস বা Thinking pattern

এই চারটি অভ্যাস বা প্যাটার্নই মূলত একজন মানুষের মনন, মানস এমনকি মস্তিষ্কের ওপরও নীরবে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। সত্যি বলতে মনন ও মানসের পরিগঠনে উপর্যুক্ত অভ্যাসগুলোর প্রভাব অনস্বীকার্য ও অনিবার্য। 

  যে নিদ্রা-স্বল্পতা আমার চোখ-মুখ ফুলিয়ে রাখে, চেহারার সর্বত্র অবসন্নতা ছড়িয়ে দেয়, এমনকি অল্পনিদ্রা বা অনিদ্রার অসুখে পরিণত হয় সেই নিদ্রা কি আমার সুখের কারণ হতে পারে না? বিশেষায়িত নিদ্রা কি অধিকাংশ অসুখের দাওয়াই হিসেবে কাজ করে না? অবশ্যই করে। তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যায়- নিদ্রা যদি হয় নিয়ন্ত্রিত, নিয়মিত, পরিমিত তবে তা মনন গঠনের সহায়ক হতে বাধ্য।

আচরণের ক্ষেত্রেও আমরা একই ধরনের পর্যবেক্ষণ পেয়ে থাকি। দেখা থেকে, বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে, সমৃদ্ধ পড়াশুনা থেকে, মহানজনদের জীবন থেকে শেখা পরিশীলিত আচরণ অবশ্যই ব্যক্তিকে সুমার্জিত, সুসৌজন্য করতে সক্ষম। আবার সাহচর্য কিংবা সঙ্গ থেকে, চারপাশের পরিবেশ ও প্রতিবেশ থেকে, পরিবেশের সংক্ষুব্ধতা থেকে, পারিবারিক বেষ্টনীর সীমাবদ্ধতা কিংবা অপূর্ণতা থেকে বেরুতে না পারলে অবশ্যই তা ব্যক্তিকে অপরিশীলিত, অপূর্ণাঙ্গ কিংবা অযাচিত ব্যক্তিতে পরিণত করে এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর চিন্তাভ্যাসের বিষয়টি আমরা কিয়দ বিলম্বে কিঞ্চিৎ বিস্তারিত আলোচনার চেষ্টা করব। কারণ আমাদের আজকের আলোচনার গন্তব্যবিন্দু সেটিই।

  রাসূল সা.-এর খাদ্যাভ্যাস এবং এ সংক্রান্ত তাঁর বিবৃতি ও নির্দেশনা সত্যিই অবাক করার মতো। তিনি তো এমন মানুষ যার প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ ও অধ্যয়ন বলতে কিছু ছিল না। স্বাস্থ্যবিজ্ঞান তো অনেক দূরের বিষয়। আর সে জমানায় স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের তেমন কোনো উৎকর্ষতাও ছিল না। তাই আজকের স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞ মাত্রই তাঁর খাদ্যাভ্যাস ও খাদ্য নির্দেশনার শৃঙ্খলা কাঠামো দেখে বিস্মিত না হয়ে পারে না। রাসূল সা.-এর খাদ্যাভ্যাস ছিল সর্বদার জন্য অনুকরণীয়, অনুসরণীয়। তিনি অরুচি ও কুরুচিপূর্ণ খাবার হতে বিরত থাকতেন। তিনি ওই সকল প্রাণী বা প্রাণীর মাংস খেতেন না, যারা ময়লা-বর্জ্য নিয়মিত ভক্ষণ করে। এর নেপথ্যের কারণ সম্ভবত এমন হয়ে থাকবে অরুচি ও কুরুচিপূর্ণ খাবার স্বভাবত মানব মনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে যা হজম প্রক্রিয়ায় বিঘœ সৃষ্টি করবে। ফলশ্রুতিতে ব্যক্তিকে উদারপীড়ায় নিপীড়িত ও অসুস্থ করে তুলবে। এমন উদরপীড়া ব্যক্তির মনন ও মানসকে শিগগির অসুস্থ ও বিষণœ করবে। যা তার শারীরিক মানসিক বিপর্যস্ততার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

 একইভাবে তিনি বেশি খেতে বারণ করেছেন। কারণ তিনি প্রত্যয়ী ছিলেন যে, অতি সেবন মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। আধুনিক স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের পাঠ আমাদেরকে সে সবক দিয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। রাসূল সা. বলেছেন মুমিন খায় এক পেটে আর কাফির খায় সাত পেটে। অর্থাৎ কাফিরের খাওয়ার পরিমাণ অনির্ধারিত, অপরিমেয়। আর মুমিনের খাবার অবশ্যই স্বল্প ও পরিমিত। পরিমিত আহারের ব্যাপারে তিনি উৎসাহিত করে বলেন- “দু’জনের খাবার তৃতীয়জনের জন্যও যথেষ্ট।” খাবারে পরিমিতিবোধের ব্যাপারে এর চেয়ে উৎকৃষ্ট বিবৃতি আর কী হতে পারে? এ শুধু বিবৃতি নয় এর প্রকৃষ্ট ও বাস্তব দৃষ্টান্ত নবী জীবনের পরতে পরতে পাওয়া যাবে।

তাঁর খাদ্যাভ্যাসে পাওয়া যায়- তিনি খেজুর, লাউ, মধু, সির্কা, যব, গোশত ইত্যাদি পছন্দ করতেন। স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের গবেষণায় খেজুর ও লাউয়ের বহুবিধ উপকারের সংবাদ সর্বত্র প্রচারিত। খেজুর এবং লাউ আজ স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের আদর্শ খাদ্য তালিকাভুক্ত। আলহামদুলিল্লাহ। হাদিসে এসেছে- “তোমরা জায়তুনের তেল খাও এবং তা মালিশ করো” (শামায়েলে তিরমিজি)। জাবির ইবনু আবদুল্লাহ রা. আল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি তাঁর বাবা হতে বর্ণনা করেন- “একদা আমি রাসূল সা.-এর নিকটে যাই। দেখি একটি লাউ কেটে ছোট ছোট টুকরা করা হচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করি- এটি কী? জবাবে বলা হয়- এই লাউ দ্বারাই তো আমরা অধিকাংশ ব্যঞ্জন তৈরি করে থাকি। (শামায়েলে তিরমিজি)।

অন্য হাদিসে উম্মুল মুমিনিন আয়েশা বিনতু আবু বকর রাদি আল্লাহু তায়ালা আনহা বলেন- “নবী সা. মিষ্টি ও মধু পছন্দ করতেন।” (বুখারি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন : ৫০৮৫) ইউসুফ ইবনু আবদুল্লাহ হতে বর্ণিত তিনি বলেন- আমি একদা দেখি রাসূল সা. একটি যবের রুটির ওপর একটি খেজুর রেখে বলেন- এটিই এর ব্যঞ্জন। এরপর তা খেলেন। এ হাদিসগুলো নিঃসন্দেহে খাবারে অল্পে তুষ্টির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। একইভাবে খাবারে স্থিরতা অবলম্বন করা, সৌজন্য রক্ষা করা, পানি পানের শিষ্টতা, খাবার নষ্ট না করা, প্লেট চেটে বা মুছে খাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে রাসূলের সামগ্রিক নির্দেশনা প্রকৃতই স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য উপাদেয়। রাসূল সা.-এর খাদ্যাভ্যাস নিয়ে যত গবেষণা হচ্ছে ততই তা বৈজ্ঞানিক ও যৌক্তিক বলে প্রমাণিত হচ্ছে। একজন মানুষের দৈনন্দিন খাবারের ব্যাপারে রাসূলের নির্দেশনা সুস্থ দেহ ও মানস পরিগঠনে সত্যিই অনবদ্য। যেমন তিনি বলেন- তোমরা খাবার গ্রহণের সময়ে পেটকে তিন ভাগ করো। এক অংশে খাবার, আরেক অংশে পানীয় অবশিষ্টাংশ বাতাস দ্বারা পূর্ণ করো। অর্থাৎ তা খালি রাখো। আধুনিক স্বাস্থ্যবিজ্ঞানেও খাবারের এ নির্দেশনা অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর হিসেবে প্রমাণিত। রাসূল সা. যেভাবে খেতেন, যেভাবে খেতে বসতেন, যেভাবে চিবাতেন, পানীয় সেবনে যেভাবে শ্বাস নিতেন, যেরূপ সময় নিয়ে খেতেন, যে পরিমাণ খেতেন, দুই খাবারের মাঝখানে যতটুকু বিরতি দিতেন সবই আজকের আধুনিক স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের এক একটি বিস্ময়কর উপাদান ও মানব স্বাস্থ্যের অনস্বীকার্য আদর্শ হিসেবে পরিগণিত। আমরা রাসূল সা. পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত সমাজে দেখেছি মানুষের অসুস্থতার হার। ঐ সমাজে মানুষ বিশেষত মুমিন সমাজের সভ্যবৃন্দ তেমন কোনো অসুখে ভুগতেন না। সাহাবিরা অসুস্থতা কী জিনিস তা যেন ভুলেই গিয়েছিল। এর মূল কারণও ছিল তাদের খাদ্যাভ্যাস।


ঘুম বা নিদ্রা জীবনের অনিবার্য অনুষঙ্গ। নিদ্রা ব্যতীত মানবদেহ সম্পূর্ণ নিরোগ ও সুস্থ হতে পারে না। তাই এই ঘুমেরও থাকা চাই নির্দিষ্ট ব্যাকরণ। নতুবা তা ভুলপথে পরিচালিত হবে। যা হবে মানবদেহের সমূহ ক্ষতির সূতিকাগার। এই ক্ষতি হতে বাঁচতে হলে অবশ্যই বিশেষ নিয়মের অনুবর্তী হতে হবে। মুসলিম উম্মাহর সদস্য হিসেবে আমাদের সৌভাগ্য এটিই যে, আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ব্যাপারেও দিয়েছেন সঠিক নির্দেশনা। যেমন-

ক. ফজরের পর দ্বিতীয়বার না ঘুমাতে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ তা স্বাস্থ্য সংহারক। বরং ফরজ সালাতের পর কর্মোদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ার নির্দেশনা ইসলামের। আল্লাহ বলেন- আর যখনই তোমাদের সালাত সম্পন্ন হয়ে যাবে তখন তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড়ো। আর রিজিকের তালাশ করো। (৬২ : ১০)।

খ. দুপুরের খাবার পর কিঞ্চিৎ বিশ্রাম। কেননা তাতে শরীরে ফিরে আসবে স্বতঃস্ফূর্ততা।

গ. রাতে খাবারের পর অল্প হাঁটাহাঁটি করো। কেননা তাতে রাতের ঘুমে আরাম হবে। নিদ্রা গভীরতর হবে। রাসূল সা.-এর এই নির্দেশনা দেখেই জনৈক ইংরেজ মন্তব্য করেন- After launch rest a while. After dinner walk a mile.

আমরা বাংলায় বলি-

মধ্যাহ্নভোজের পর হালকা বিশ্রাম, নৈশভোজের পর হাঁটাহাঁটি

সুস্থ শরীর, সতেজ মন, ঘুম হবে একদম খাঁটি।

ঘ. সার্বিক ঘুমের ব্যাপারে তার নির্দেশনা সকাল-সকাল ঘুমিয়ে যাওয়া। প্রতিটি মুমিনের জন্য প্রয়োজনীয় এ ঘুমকে নিশ্চিত করতে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন- তোমরা ইশার সালাতের পর কেউ অপ্রয়োজনীয় গল্প-গুজবে মত্ত হবে না। এ সংক্রান্ত অনেকগুলো হাদিসের বর্ণনা আমাদের সামনে রয়েছে। সকাল-সকাল ঘুমানো একদিকে স্বাস্থ্যকর। অন্যদিকে বিষণ্ন তা নিবারক। এই ঘুম একদিকে প্রশান্তিদায়ক। অন্যদিকে একাধিক অসুস্থতা থেকে মুক্তিদায়ক।

হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি তিনি অযথা নিশি জাগরণ করতেন না। বরং তিনি রাত্রির প্রথমভাগেই ঘুমিয়ে যেতেন। আর মধ্যভাগ বা তার পরপরই জেগে যেতেন। তিনি অন্তত এক প্রহর ভালোভাবে নিদ্রা যাপন করতেন। ফলে তিনি সর্বদাই সুস্বাস্থ্য, নীরোগ, স্বতঃস্ফূর্ত জীবন যাপন করতেন। তার নিদ্রাচার থেকে উদ্বুদ্ধ হয়েই হয়তো জ্ঞানীজনরা মন্তব্য করেছেন-

Early to bed and early to rise

makes a man healthy, wealthy & wise.

আধুনিক স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক গবেষণা বলে- দিবা-রাত্রির যে সকল প্রহর রয়েছে তার মধ্যে একটি প্রহর মানবদেহ ও মানব মস্তিষ্কের জন্য খুবই উপাদেয়। মানুষ যখন ঘুমায় তখন তার মস্তিষ্কে এক ধরনের বৈদ্যুতিক তরঙ্গ সৃষ্টি হয়। এই তরঙ্গের মাঝে ওঠা-নামা, কম-বেশির বিষয় রয়েছে। বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় এ সবের নানান নাম রয়েছে। তবে সব থেকে ব্যালান্স ও সামঞ্জস্যপূর্ণ তরঙ্গ যেই প্রহরে কাজ করে সে প্রহরের তরঙ্গকে বলা হয় Delta Wave আর ঐ ঘুমকে বলা হয় Delta sleep। এই ঘুম শরীর, স্বাস্থ্য, দেহ, মন এবং স্মরণশক্তির জন্য অত্যন্ত কার্যকরী। 

অধুনা বিশ্বের যান্ত্রিক ব্যস্ততায় রাসূল সা.-এর নিদ্রাভ্যাসের পরিপালন আমাদের ও আগামী প্রজন্মের মননের চাষ ও মানসের উৎকর্ষে সর্বাধিক নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করবে। এমন সুচারু, সুসামঞ্জস্য ও সমন্বিত নিদ্রা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রাসূল সা. একটি জাতির উন্নত মনন গঠনের কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন এবং তাতে পূর্ণমাত্রায় সফল হয়েছিলেন।

  মানুষের মানসকে বিকশিত ও মননকে উৎকর্ষ করতে সর্বাধিক প্রভাবিত করে তার চিন্তাভ্যাস। উপযুক্ত তিনটি প্যাটার্ন বা অভ্যাসকে নির্দিষ্ট রেখায় পরিচালিত করতে যে অভ্যাস নেপথ্যে থেকে সর্বাধিনায়কের ভূমিকা পালন করে তা হলো তার চিন্তাভ্যাস। তাই মনন বা মানসকে শুদ্ধ করার আগে চাই চিন্তার পরিশুদ্ধির পরিকল্পনা। নতুবা যেকোনো মুহূর্তে সে একমাত্রিক, একরৈখিক বা পক্ষপাত দোষে দুষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। কারণ কারো চিন্তার মাপকাঠি যদি সঠিক হয়, তবে তার লাইনচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। অর্থাৎ মনন চাষের গোড়ার কথা হচ্ছে চিন্তার চাষ। চিন্তার আঙ্গিক, পরিধি, পরিসীমা ও আয়তন নির্ধারণ। আমি কী চিন্তা করব? কতটুকু করব? কীভাবে করব? কতদূর করব? কেন করব? এর লাভ বা ক্ষতি কী হতে পারে? ইত্যাদি বিষয়গুলোকে যদি আমরা প্রথমেই পরিশুদ্ধ, পরিশীলিত, নিয়ন্ত্রিত করতে পারি তাহলেই আমাদের চিন্তা সঠিক পথে চলবে, তা মানস গঠন সহায়ক হবে। মনে রাখতে হবে আল্লাহ বান্দাকে কখনই তার সাধ্যাতীত চাপ প্রয়োগে অতিষ্ঠ করেন না।

সুতরাং রাসূল সা. তাঁর সাধ, সাধ্য, আকাক্সক্ষা, বাস্তবতা ইত্যাদির আলোকেই তিনি চিন্তামানসকে ধারণ করেছেন, তাঁর অনুসারী ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য মাপকাঠি নিরূপণ করে দিয়েছেন। যাতে কেউ বাহুল্যকষ্টে নিপতিত না হয়। অযাচিত পরিশ্রম যেন কাউকে অবসন্ন করতে না পারে। কারণ আমাদের বিবেচনায় সমগ্র বিশ্বের সমূহ শিক্ষার আদি ধারণা হলো- কেউ কারো মতো নয়। কেউ কারো বাধার সৃষ্টি করবে না। যদিও সবার উপাদান ও উপকরণ এক। বিষয়টিকে আরো স্পষ্ট করতে বলতে চাই- গ্রহ, নক্ষত্র, গ্রহাণুপঞ্জ বা আরো যা কিছু আছে তাদের সকলের স্বতন্ত্র পথ ও পদ্ধতি আছে। তাই চলাচলে কেউ কারো বিঘœ হয়ে দাঁড়ায় না। আল্লাহ বলেন- “সূর্যের পক্ষে সম্ভব নয় চন্দ্রের নাগাল পাওয়া। এবং রাত্রির পক্ষে সম্ভব নয় দিনকে অতিক্রম করা। আর প্রত্যেকে নিজ নিজ কক্ষপথে পরিভ্রমণ করে।” (৩৬ : ৪০)। তাদের কারো সাথে কারো সাক্ষাৎ হয় না। কেউ তার নিজের রাস্তা ছেড়ে অন্যের রাস্তায় চলাচল শুরু করে না। কেউ তার পথ হতে চ্যুত হয় না। অর্থাৎ সবাই তার নির্ধারিত পথ তথা সীমানা তথা হুদুদকে মেনে চলে। তাই কোনো দুর্ঘটনা বা দৈবপাক পরিলক্ষিত হয় না। একই পৃথিবীর মানুষও যদি যার যার সীমানা তথা হুদুদ মেনে চলে তাহলে সেখানেও কোনো বিদ্বেষ সৃষ্টি হবে না। হতে পারে না। এটিই প্রাকৃতিক নিয়ম।

সেজন্যই আপন মননকে পরিশুদ্ধ করতে স্বীয় হুদুদ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন এবং পরিশীলিত চিন্তাই একজন মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে। রাসূল সা. পৃথিবীর মানুষের মানবদেহের চিকিৎসক ছিলেন না। বরং তিনি ছিলেন মনের চিকিৎসক। মানসিকতা পরিশোধনের মহান শিক্ষক। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আল-কুরআনে স্পষ্টরূপে এরশাদ করেন- “তিনিই নিরক্ষরদের মধ্য হতে রাসূল প্রেরণ করেন যিনি তেলাওয়াত করেন তাদের সামনে তার আয়াত। তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন। আর তাদেরকে শিক্ষা দেন কিতাব ও হিদায়াত”। ( সূরা জমুয়া : ০২)। মানবজাতির মহান শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হওয়ার অর্থ হলো তিনি ছিলেন মানবজাতির মনো-শিক্ষক। কারণ প্রথাগত অক্ষর-জ্ঞান তাঁর ছিল না।

তিনি সর্বতোভাবে চেষ্টা করেছেন মানবের মননকে পরিশুদ্ধ করতে। প্রতিটি মানুষের ধারণক্ষমতা যেহেতু আলাদা। তাই প্রত্যেককে দিয়েছেন আলাদা আলাদা ব্যবস্থাপনা। যেমন কেউ এসে জিজ্ঞেস করেছেন- ইসলামের সর্বোত্তম আমল কী? তিনি তাকে বলেছেন- অপরকে বা অভুক্তকে খাদ্য খাওয়ানো। একই প্রশ্নের জবাবে অন্যকে বলেছেন- পরিচিত অপরিচিত সকলকে সালাম দেওয়া। একই প্রশ্নের জবাব দুই রকম হলো কী করে? হলো এই জন্য যে উত্তরদাতা জানতেন কার কোন চিকিৎসা প্রয়োজন। যার যার শূন্যতা পূরণে প্রদত্ত হয়েছে মহানবীর যথোচিত জবাব।

আবার এক ব্যক্তি এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামকে বলেন, আপনি আমাকে এমন আমলের সংবাদ দিন যা আমাকে সহজেই জান্নাতে নিয়ে যাবে। তিনি তাঁকে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর পরামর্শ দিয়েছেন। আবার কেউ জিহাদের ডাকে সাড়া দিয়ে জিহাদে যেতে চাইলে তিনি তাকে তার বাবা-মার খেদমতের নসিহত দিয়েছেন। এটিই মূলত মনো-চিকিৎসা। যার ক্ষত যেখানে তিনি ঔষধ দিয়েছেন সেখানে।

আদি ও সর্ব প্রাচীন আদর্শের নতুন প্রচারে নিমগ্ন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামকে নানা তির্যক প্রশ্নবাণে নিপিষ্ট করতে চাইতো তদানীন্তন জনগোষ্ঠী। অযাচিত ও অনর্থক বিষয়ে এলোমেলো প্রশ্ন করতে থাকলে মহানবী তাঁর মোকাবিলা করেন যথাযথ সতর্কতায়। যেমন কিয়ামত কবে হবে? এ প্রশ্ন তাদের সকলের এবং বারংবারের। রাসূল সা. তাদের প্রশ্নের সরাসরি জবাব দিয়ে বিতর্ক জমাতে চাননি। বরং কিয়ামাতের আবহ, পরিবেশ এবং প্রস্তুতির প্রসঙ্গ এনে মননের যুৎসই চিকিৎসা করতে চেয়েছেন অভিনব পন্থায়। সূরা নাবার পুরোটা জুড়ে রয়েছে এর নান্দনিক ও চিত্তাকর্ষক বর্ণনা। সূরার শুরু হয়েছে এভাবে- ‘তারা জানতে চায় মহাসংবাদ তথা কিয়ামাত সম্পর্কে। এ নিয়ে তাদের রয়েছে মতানৈক্য। তবে শিগগির তারা জানতে পারবে। অবশ্যই তারা জানতে পারবে।’(৭৮: ১-৫)। এরপর বলা হয়েছে তাদের সৃষ্টিতত্ত্ব। আনা হয়েছে নিদ্রা ও রাত্রির প্রসঙ্গ। আসমান, জমিন, সূর্যের প্রসঙ্গ। এবারে শুরু করা হয়েছে কিয়ামাতের আলামতের বর্ণনা। শেষত পাপীদের জন্য জাহান্নাম আর পুণ্যবানদের জন্য জান্নাতের অনবদ্য বর্ণনা।

আয়াতের ধারাবাহিক মূর্ছনায় মনে হয় যেন কিয়ামতের দিন-তারিখ বলা হয়ে গেছে। আয়াতের প্রতিবেশে যেন সবাই কিয়ামতের ময়দানে উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু না, আয়াতে তা করা হয়নি। আয়াতে সকলের মননকে সচকিত করা হয়েছে- জান্নাত পেতে কিংবা জাহান্নাম থেকে বাঁচতে তোমার প্রস্তুতি কী? যদি তোমার প্রস্তুতি না থাকে তবে দিন-তারিখ জেনে লাভ কী? এ আয়াতগুলোতে অত্যন্ত কৌশলে অবিশ^াসী মস্তিষ্কে আঘাত করা হয়েছে। যা সৃজনশীল মনন সৃষ্টির সহায়ক হয়েছে।

 রাসূল সা.-এর শুদ্ধি ও সংস্কার জগদ্বাসীর মন জয় করেছিল। তৎপ্রতি সকলকে আকৃষ্ট করেছিল। আজও তাঁর সংস্কার সকলকে ভাবায়। বিস্ময়াভিভূত করে। এর নেপথ্য কারণ খুঁজতে গিয়ে ঐতিহাসিকরা হয়রান হয়ে যান। আমরা মনে করি সকল আকর্ষণ, বিস্ময় কিংবা দৃষ্টি প্রক্ষেপের গোড়ার কথা হলো তাঁর মনন সংস্কার। আমরা আরো দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি রাসূল সা. মননের সংস্কারক হিসেবে অদ্বিতীয়। মানসের কর্ষণকারী হিসেবে অত্যন্ত বিচক্ষণ ও দক্ষ। মনন বুঝে যুৎসই দাওয়া প্রদানে অব্যর্থ ও অবিকল্প। মন, মনন, মানস ও অন্তরের সংস্কারে তাঁর জীবনও ছিল অনুকরণীয়, সুমহান।

মহান আল্লাহর দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা- “আর হে নবী নিশ্চয়ই তুমি মহান চরিত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত।” ( সূরা কলম : ০৪)। তিনি তাঁর সর্বোত্তম আদর্শ সম্পর্কে বলেন- “নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূলের মধ্যেই রয়েছে তোমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ।” ( সূরা আহযাব : ২১)। তিনি আমাদের মননের সর্বোৎকৃষ্ট সংস্কারক ছিলেন বলেই তিনি আমাদের আদর্শিক নমুনা। তাই প্রভু সমীপে তব কায়োমনো আবেদন- মুমিন অন্তরের সকল ভালোবাসা নিঃসৃত হোক মনন সংস্কারক রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি অসীম শ্রদ্ধায়, নিখাদ আন্তরিকতায়। সাল্লি আলা মুহাম্মদ। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম॥

লেখক : প্রফেসর আরবি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির