আল্লাহর ঘর বায়তুল্লাহ শরিফ ও বিশ্বনবী সা. কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মসজিদে নববীতে সালাত আদায়সহ মহানবী সা.-এর রওয়াজা মুবারক জিয়ারতের আকাঙক্ষা ছিলো বহুদিনের। অর্থনৈতিক টানাপড়েনের কারণে মনের সে আশা মনের মধ্যেই গুমরে ফিরছিল। সকল বাধা বিপত্তি ও অভাব অনটনকে পিছনে ঠেলে দিয়ে দু’বছর পূর্বে পাসপোর্ট করে স্থানীয় একটি হজ সাব-এজেন্সির কাছে হজ নিবন্ধনের জন্য ২০২১ সালে টাকা জমা দিলাম। এক্ষেত্রে গমনের সকল আশায় প্রচণ্ড আঘাত হানলো কোভিড-১৯ এর করোনা মহামারী আর সৌদি সরকারের বয়সসীমা নির্ধারণ। এই বছর সরকার হজ গমনেচ্ছুকদের জন্য যে টাকা নির্ধারণ করেছে তা সাধারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণির পক্ষে মক্কা মদিনা সফর শুধু দুরূহই নয় বরং দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বহু কষ্টে যে কয়টি টাকা সংগ্রহ করেছিলাম তা যদি এ অভাব অনটনের সংসারে খরচ করি তাহলে আল্লাহর রাসূল সা.-এর দেশ সফরের আশা বাস্তবায়ন করতে পারবো বলে আস্থা অর্জন করতে পারছি না। অগত্যা ওমরাহ পালনের জন্য সিদ্ধান্ত নিয়ে হিজাযের উদ্দেশ্যে যাত্রার পরিকল্পনা গ্রহণ করলাম।
৮ই মার্চ ২০২৩ তারিখের রাত্রে হজ সাব- এজেন্সির পরিচালক আরিফুল হক লিটন সাহেবের বাস প্রায় দু’ডজন ওমরাহ যাত্রীদেরকে নিয়ে সলঙ্গা হাইস্কুল ফিল্ডে উপস্থিত আমরা এলাকার কয়েকজন। প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড় ও অন্যান্য সামগ্রীর লাগেজ নিয়ে সেখানে অপেক্ষা করছিলাম। মক্কা মদিনার মুসাফিরদের নিয়ে বাসটি রাত প্রায় ৯ টায় ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। রাত প্রায় পৌনে ১ টার দিকে বাসটি আসকোনা হাজী ক্যাম্পে পৌঁছলে জানা গেল ক্যাম্প বন্ধ এ কারণে যে, আগামীকাল সরকারের একটি প্রোগ্রাম রয়েছে। এ অবস্থায় মুসাফিরদেরকে আলাদাভাবে আবাসিক ভবন ভাড়া করে রাত্রি যাপন করতে হলো। এক্ষেত্রে যে কথাটি বলা বিশেষ প্রয়োজন তা হলো বেসরকারি হজ এজেন্সির সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরকে সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ প্রশিক্ষণ ও মক্কা মদিনায় তাদের কর্মতৎপরতার ওপর নজরদারি বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে বলে আমি মনে করি। এ দেশ থেকে যে সমস্ত লোক মক্কা মদিনায় গমন করেন তারা প্রায়ই বয়স্ক ও অশিক্ষিত লোকজনই বেশি। তাদেরকে যথাযথ শিক্ষা দেওয়াসহ সেবার মান বৃদ্ধির প্রয়োজন অবশ্যই রয়েছে। তা ছাড়া জিয়ারাহ প্রোগ্রামসমূহ কুরআন হাদিস ও ইতিহাস সম্পর্কিত গভীর জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তিদেরকে মুয়াল্লিম নিয়োগ করা খুবই জরুরি। অভিজ্ঞ ও নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিগণ ছাড়া মুয়াল্লিমের দায়িত্ব পালন গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। যাহোক সলঙ্গা থেকে আরিফুল হক লিটন সাহেব আমাদের সাথে না গিয়ে আবুল কালাম নামক কম বয়সী একজন লোককে মুয়াল্লিম করে পাঠালেন। আমরা তার পরিচালনায় ওমরাহ পালনে রওয়ানা হলাম। আমাদের ঢাকা থেকে সরাসরি জেদ্দা বা মদিনা বিমানবন্দরে না নিয়ে গিয়ে ওমানের মাসকাত হয়ে জেদ্দা যাবার ব্যবস্থা করা হলো। এতে যে বিপত্তিটা দেখা দিলো তা হলো সারা রাত্রির কখনো ঘুমানোর সুযোগ ছিলো না। ঢাকা থেকে ওমানের সালাম এয়ারের বিমানে মাসকাত পৌঁছলে প্রায় তিন ঘণ্টা সময়ব্যাপী মাসকাত বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন, চেকিংসহ অন্যান্য কর্মকা- চললো। গভীর রাত্রে সালাম এয়ারের বিমানে জেদ্দার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। মাসকাতেই এশার কসর সালাত আদায় শেষে ইহরামের কাপড় পরে তালবিয়া পাঠ শুরু করেছিলাম। জেদ্দা বিমানবন্দরে অবতরণের পর ইমিগ্রেশনসহ আমাদের যাবতীয় রেকর্ডপত্র পরীক্ষার কাজ চললো। আমাদের সহযাত্রী শাহজাদপুর কৈজুরীর খোকন নামক এক যুবক তার অসুস্থ মা-সহ ওমরায় গিয়েছিল কিন্তু তার মায়ের পাসপোর্ট সঠিক হলেও তার পাসপোর্টে ত্রুটি ধরা পড়লো। এটা নিছক পাসপোর্ট অফিসের ত্রুটি ভিন্ন কিছু নয়। খোকন তার মা-সহ জেদ্দায় রয়ে গেলেন আমাদের সাথে মক্কায় যেতে পারলেন না। পরদিন অবশ্য তিনি আমাদের সাথে মিলিত হয়েছিলেন। ওমরার উদ্দেশ্যে এসেছেন বলে কর্তৃপক্ষ মেহেরবানি করে মক্কা মদিনা প্রবেশে অনুমতি দিয়েছেন।
জেদ্দা এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে বাসযোগে মক্কার উদ্দেশে রওয়ানা হলাম। জেদ্দা সিটির ঝলমলে আলোকোজ্জ্বল রাস্তাঘাট পেরিয়ে টিপটিপ আলোকসজ্জিত পথ বেয়ে দ্রুতগতিতে সৌদি আরবের এয়ারকন্ডিশন বাস হেরেম শরিফের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। শেষ রাতের নাতিশীতোষ্ণ হাওয়ায় শরীর শান্ত শীতলের আবহে অবগাহন করতে লাগলো। কেন যেন মনে হতে লাগলো যে, নিজ বাড়িতে ফিরে যাচ্ছি। অনেক দূর থেকে কাবার পার্শ্বে মক্কা টাওয়ার থেকে কাবা দর্শনের অপেক্ষায় অধীর হয়ে পড়লাম। আমরা প্রথমে এজেন্সি কর্তৃক নির্ধারিত ইব্রাহিম খলিল স্ট্রিটের ফিলিস্তিন লেনের সামনে হোটেল মারজানে উঠে লাগেজ রেখে সকালের নাস্তা সেরে কাবা তাওয়াফের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। বাদশাহ ফাহাদ গেট পার হতেই কালো কাপড়ে মোড়ানো কাবাগৃহ চোখের সামনে ভেসে উঠলো। পবিত্র কাবার চতুর্দিকে মানুষ যেভাবে তাওয়াফ করছে তাতে প্রবেশ অত্যন্ত কষ্টসাধ্য বলে মনে হলো। হজ মওসুম ছাড়া ওমরাতেই যদি এ অবস্থা হয় তাহলে হজে মানুষ কিভাবে তাওয়াফ করে? হাজরে আসওয়াদ বরাবর দাঁড়িয়ে কাবা প্রদক্ষিণের নির্ধারিত দোয়া পাঠ করে তাওয়াফ শুরু করলাম। এমন অবস্থা যে নিচের দিকে তাকানোর কোনো সুযোগ তো নেই-ই এদিক সেদিক লক্ষ্য করারও কোনো সাধ্য নেই। কাবা সাত চক্কর তাওয়াফ শেষ করে সাফা মারওয়া সাঈ করে হোটেলে ফিরে আসার পথে মাথা মু-ন করে ইহরাম শেষ করলাম। পরদিন অনেকেই সিদ্ধান্ত নিলাম আয়েশা মসজিদে গিয়ে আবার ইহরাম বেঁধে ওমরার নিয়ত করে আরেক বার কাবাঘর তাওয়াফ ও সাফা মারওয়া সাঈ করে আরেকটি ওমরাহ সম্পন্ন করবো। সিদ্ধান্ত মোতাবেক মাইক্রো ভাড়া করে আয়েশা মসজিদে গেলাম এবং সমস্ত কাজ সম্পন্ন হলো। বাস ভাড়া প্রত্যেকের দশ রিয়াল করে নির্ধাতি হয় কিন্তু আমার ভাংতি রিয়াল না থাকায় আমি ১০০ রিয়ালের নোট প্রদান করি। মুয়াল্লিম সাহেবের সবার কাছে রিয়াল সংগ্রহ করে আমাকে ৯০ রিয়াল ফেরত দেওয়ার কথা কিন্তু দু’দিন চলে গেলেও আমি আমার প্রাপ্য অর্থ ফেরত না পাওয়ায় বারবার তাগিদ দিতে থাকি। এক পর্যায়ে উভয়ের মধ্যে কিছু তিক্ত কথা কাটাকাটি হয় এতে তারাশ থেকে ওমরায় আগত জনৈক রাজনৈতিক ব্যক্তি মুয়াল্লিম সাহেবের পক্ষ নিয়ে কিছু কড়া কথা শুনিয়ে যান আমাকে। এ ঘটনায় আমার মন খুবই খারাপ হয়ে যায়। পরদিন বেশ কিছু লোক মুয়াল্লিম সাহেবকে সাথে নিয়ে গাড়ি ভাড়া করে তায়েফে গেলে আমি না গিয়ে হোটেলে অবস্থান ও হেরেমে সালাত আদায় করলাম। এটা আমার জীবনের বড় ভুল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
আমরা কয়েকজন একদিন দাহিয়্যায়ে কালবী তার কন্যা সন্তানদেরকে জীবন্ত কবর দিয়েছিল তা দেখতে গেলাম। মুয়াল্লিম সাহেব হোটেলে থেকে দিকনির্দেশনা দিলেন কিন্তু আমরা বহু চেষ্টা করেও ঐ স্থান চিহ্নিত করতে পারলাম না। হজ এজেন্সির প্যাকেজের মধ্যে মক্কার পার্শ্ববর্তী চারটি ঐতিহাসিক স্থান দেখানোর কার্যসূচি রয়েছে। যে দিন এ প্রোগ্রাম শুরু করে সেদিন বিকাল পাঁচটায় এজেন্সির বাসে চড়ে সূর্যাস্তের কিছু পূর্বে ওহুদ প্রান্তরে উপস্থিত হলাম। সেখানে আরেকজন মুয়াল্লিম সাহেব- এখানে আল্লাহর রাসূলের দান্দান শহীদ হয়েছিল এবং হযরত হামযা রা.-সহ ৭০ জন সাহাবি শহীদ হয়েছিলেন এ বক্তৃতা দিয়ে শেষ করলেন। আমার একান্ত ইচ্ছা ছিলো ওহুদ যুদ্ধের বাস্তব চিত্র আমাদের সামনে উপস্থাপন করা কিন্তু তা হলো না। ওহুদ প্রান্তরের মসজিদে আসরের সালাত আদায় করে ওহুদ সফর খুবই সংক্ষিপ্ত করে বাস মসজিদে কিবলাতাইনের দিকে রওয়ানা হতে হল। আল্লাহর রাসূল সা. মদিনায় হিজরতের পর বায়তুল মুকাদ্দাস অর্থাৎ মসজিদুল আকসার দিকে মুখ করে সালাত আদায় করতেন। ১৭ মাস পর এ মসজিদে সালাত আদায়ের সময় আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ আসলো তুমি কাবার দিকে মুখ ফিরাও। মহানবী সা. সালাত আদায় অবস্থায়ই বায়তুল্লাহর দিকে মুখ ফিরিয়ে অবশিষ্ট সালাত সম্পন্ন করেছিলেন। পবিত্র কুরআনুল কারিমের নাজিলকৃত আয়াতের সাক্ষীস্বরূপ দু’কিবলা বা কিবলাতাইন মসজিদ হিসেবে এ মসজিদটি দাঁড়িয়ে রয়েছে। আসর সালাতের পর এ মসজিদে উপস্থিত হলে মুয়াল্লিম সাহেব সবাইকে দু’ রাকাত নফল সালাত আদায়ের পরামর্শ দিলেন কিন্তু আসর সালাত পড়ে আর কোন নফল সালাত নেই যার কারণে আমি পড়লাম না। ঘটনাক্রমে মসজিদের মধ্যেই ইমাম সাহেবের সাথে দেখা হয়ে গেলে আমি তাকে এ সংক্রান্ত মাসয়ালা জিজ্ঞাসা করলে তিনি বিশুদ্ধ আরবিতে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিলেন যে, লা ইয়াজুযু সালাতা বা’আদা সালাতিল আসরে অর্থাৎ আসর সালাতের পরে আর কোনো (নফল) সালাত জায়েজ নেই। তিনি হাতের ইশারায় আমাকে দেখিয়ে দিলেন যে উত্তর দিকের মিহরাবটা ছিল প্রথম কিবলা এবং দক্ষিণের মিহরাব বর্তমান কিবলা। মসজিদে কিবলাতাইনের পর আমাদের বাসটি জামে মসজিদে খন্দকের নিকট দিয়ে মসজিদুল কোবার দিকে এগিয়ে চললো। যাবার পথে মুয়াল্লিম সাহেব হাতের ইশারায় জানালেন যে, ঐখানে খন্দক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। বাসটি মসজিদে কোবার আঙিনায় যখন পৌঁছলো তখন মাগরিবের সালাতের জামায়াত শেষ হয়ে গেছে। আমরা কয়েকজন মিলে মসজিদের এক জায়গায় জামায়াতে সালাত আদায় করলাম। এটা সেই মসজিদে কোবা মহানবী সা. ও আবু বকর সিদ্দিক রা. মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনার উপকণ্ঠে কোবা পল্লীতে এসে দু’সপ্তাহ অপেক্ষা করছিলেন এবং সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। যে মসজিদে সালাত আদায় করলে একটি ওমরার সাওয়াব পাওয়া যায় বলে মহানবী সা. উল্লেখ করেছেন। যাহোক মসজিদে কোবা সফর করেই হজ এজেন্সির জিয়ারাহ প্যাকেজ সমাপ্ত হলো বলে আমাদেরকে জানানো হলো।
আমরা কয়েকজন সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আমরা ঐতিহাসিক বদর প্রান্তর সফর করবো। আল্লাহর রাসূল সা. দ্বিতীয় হিজরির রমজান মাসে যেখানে মক্কার দুর্ধর্ষ কাফিরদের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্তসূচক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন এবং জয়লাভ করেছিলেন। ঐ যুদ্ধেই ইসলামের কট্টর দুশমন আবু জাহল, উতবা, শায়বাসহ ৭০ জন মুশরিক নেতা নিহত হয়েছিল। একটি মাইক্রো ভাড়া করে ২০ তারিখ সকাল ৮টার দিকে বদর অভিমুখে রওয়ানা হলাম। পথিমধ্যে দুটি কূপের পানি পান করলাম ও অজুর কাজ সেরে নিলাম। ঐ কূপ দুটির একটিতে মহানবী সা. তাঁর সেনাবাহিনীসহ পানি পান করেছিলেন। মদিনা থেকে বদরের দূরত্ব ১৫৮ কিলোমিটার। এই দীর্ঘ পথে দেখলাম গগনচুম্বী পাহাড় কেটে সরকার মনোরম বাসলাইন তৈরি করেছে। রাস্তার দুদিকে শুধু আকাশছোঁয়া পাহাড়ের সারি। বিশ্বনবী সা. এ দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে বদর প্রান্তরে বাতিল শক্তির মুখোমুখি হয়েছিলেন। পথিমধ্যে আরেকটি কূপ এ স্থানে পানির অভাবে সাহাবিগণ পিপাসার্ত হয়ে পড়েছিলেন। মহানবী সা. সাহাবিগণকে পানির সন্ধান করতে নির্দেশ দিলেন। সাহাবিগণ একটি গর্তে সামান্য কিছু পানি দেখতে পেলেন যা লবণাক্ত ও দুর্গন্ধযুক্ত। মহানবী সা. ঐ গর্তে কুলি কিংবা থুথু নিক্ষেপ করলে ঐ কূপ সুপেয় পানিতে ভরে যায় যা কিয়ামত পর্যন্ত মানুষ ব্যবহার করতে পারবে। ঐ কূপকে বিড়ে শিফা বলা হয়। আমরা সে কূপের পানি পান করলাম। কূপের মধ্যে উঁকি দিয়ে দেখলাম কূপের মধ্যে পাইপ দিয়ে পানি উত্তোলন করা হচ্ছে।
বদরে পৌঁছে দেখতে পেলাম স্বল্প দূরে যেখানে কাফির বাহিনী সৈন্য সমাবেশ করে টিলা পার হয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। অপরদিক মহানবী সা. মুসলিম যোদ্ধাদেরকে নিয়ে যে স্থানে ব্যূহ রচনা করে কাফির বাহিনীকে সমুচিত জবাব দিয়েছিলেন, যে পাহাড়ে হযরত জিবরাইল (আ) তাঁর ফিরিস্তা বাহিনী নিয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রে নেমে এসেছিলেন এবং তাঁর সওয়ারির ধূলি উড়িয়ে এসেছিলেন যার কারণে তাঁর পোশাকের আস্তরণে ধূলিমলিন হয়েছিল সে পাহাড়ের অবয়ব ধুলায় ধূসরিত রয়েছে। বদর যুদ্ধে যে ১৪ জন সাহাবি শাহাদাতবরণ করেছেন তাদের একটি নাম তালিকা একটি ব্ল্যাকবোর্ডে সংরক্ষিত দেখলাম এবং তাদেরকে যে স্থানে সমাধিস্থ করা হয়েছে সে স্থানে দাঁড়িয়ে আমরা দোয়া করলাম। অপরদিকে আবু জাহলসহ ৭০ জন বিখ্যাত কুরাইশ সর্দার নিহত হয়েছে তাদেরকে যে কূপে নিক্ষেপ করা হয়েছিল সে স্থানটি চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে। বদর প্রান্তর সফর করে মদিনায় ফিরে সবাই দেশে ফেরার বিষয় চিন্তা করতে লাগলো।
প্রাকৃতিক দৃশ্য : সৌদি আরব মূলত পাহাড় পর্বত বেষ্টিত একটি মরুময় দেশ। জানা যায় যে, এদেশে আট হাজারের মত বিশাল বিশাল পাহাড় রয়েছে। মাঝে মাঝে কিছু পাহাড়ি ঝরনা, আরব সাগর, লোহিত সাগর বেষ্টিত এ উপদ্বীপটিতে শীতকালে মাঝে মাঝে বৃষ্টিপাতের কারণে কাঁটাযুক্ত বৃক্ষ ও ঘাস জন্মে যেমন খেজুর গাছ ও বাবলা বৃক্ষ। পাহাড়ের গায়ে গায়ে যে কাঁটাযুক্ত ঘাসসহ তৃণলতা জন্মে তা খেয়েই উট, দুম্বা ও বকরি লালিত পালিত হয়।
বর্তমানে সৌদি সরকারের প্রচেষ্টায় অনেক ঘনপাতা যুক্ত বৃক্ষ, সবজি ও শস্য উৎপাদিত হচ্ছে। মক্কা থেকে আয়েশা মসজিদে যেতে এবং জেদ্দা যেতে দেখা গেল বাংলাদেশের মতো বাস লাইনের দু-ধার দিয়ে ঘনপাতাযুক্ত বৃক্ষের সারি। জেদ্দা নগরীর বিভিন্ন জায়গায়ও দেখলাম লেক তৈরি করা হয়েছে। লোহিত সাগরের তীরে জেদ্দায় সাগর তীর ঘেঁষে ছোট্ট একটা পার্ক তৈরি করা হয়েছে। সেখানে একটা মসজিদও রয়েছে। লোহিত সাগরের পাহাড়সম ঢেউ তীরে এসে আছড়ে পড়ছে। তীর থেকে অনেক দূরে দেখলাম দুটি জলজাহাজ তীরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বিকালের সূর্য লাল হয়ে সাগর বক্ষে অস্তাচলের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্য সাগরের পানিতে যেন আত্মগোপন করলো। এ দৃশ্য খুবই মনোমুগ্ধকর। মসজিদে মাগরিবের সালাতের আজান পড়লে আমরাও অজু করে মসজিদে প্রবেশ করলাম।
পরিবেশ : মক্কা ও মদিনায় রাত্রি দিন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যখনই রাস্তার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করা যায় তখনই দেখা যায় কাবা ঘর ও মসজিদে নববীমুখী জনস্রােত যা মানসপটে অন্যরকম অনুভূতি সৃষ্টি করে। এতে যে সচেতন মানুষকে আখেরাতমুখী করতে সহায়তা করে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পুরুষ, নারী, শিশু-কিশোর যুবক, বৃদ্ধ সবাই নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে যাতায়াত করছে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার পরিস্থিতি কখনো সৃষ্টি হয়েছে বলে শোনা যায়নি। সমগ্র সৌদি আরব জুড়ে যে কত রাস্তাঘাট, ব্রিজ, ওভারব্রিজ, ফ্লাইওভার নির্মিত হয়েছে তার একমাত্র হিসেব সরকারের দফতরেই হয়তো রয়েছে। ঐ দেশে যত জনসংখ্যা আমার মনে হয় তার চেয়ে যান্ত্রিক যানবাহনের সংখ্যা কম নেই। জানা যায় যে, বাড়ির প্রত্যেক সদস্যের জন্যই গাড়ি রয়েছে কিন্তু রোড এক্সিডেন্ট হয় বলে কোনো খবর তেমন নেই। রাস্তার ওপর মানুষ তো দূরের কথা একটা পাখি উড়ে পড়লেও বাস, জিপ ও মাইক্রো থেমে যায়। মসজিদসহ সমস্ত রাস্তাঘাট সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা হচ্ছে। আর এ কাজে যারা ব্যস্ত রয়েছে তাদের অধিকাংশই বাংলাদেশী যুবক। এসব কাজে এদেরকে নিয়োজিত দেখে ভালোই লাগলো কিন্তু মনে এজন্য ব্যথা পেলাম যে আমাদের দেশে বেকার সংখ্যা কত প্রকট যে, এ নিম্ন শ্রেণির কাজের জন্য সুদূর বাংলা থেকে বিদেশে তাদেরকে আসতে হয়েছে। জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে দেখলাম অনেক পুরাতন কবর রয়েছে কিন্তু কোনো কবরেই নাম ফলক নেই। পাহারারত পুলিশকে জিজ্ঞাসা করলে তারা শুধু বলে আল্লাহ আ’লাম অর্থাৎ (কার কবর) তা আল্লাহ জানে।
ঢাকার জাফর আহমদ নামক একজন ইমাম, শাহজাদপুর এলাকার একজন ব্যবসায়ী যার নাম খোকা, আমাদের এলাকার একজন বৃদ্ধ ও আমি এ চারজন মক্কা ও মদিনায় একসাথেই ছিলাম। একসাথে অবস্থানের কারণে সবার মধ্যে গভীর আন্তরিকতার সৃষ্টি হয়ে গেলো। মাওলানা জাফর সাহেব আমাকে কিছু হাদিয়াও দিলেন কিন্তু আমি কিছু দিতে পারলাম না।
এবার দেশে ফেরার প্রস্তুতির পর্ব। সবার একান্ত ইচ্ছা জমজমের সুপেয় ও বরকতের পানি সাথে নিয়ে আসা কিন্তু জেদ্দা বন্দর থেকে সাড়ে আট রিয়ালের বিনিময়ে ৫ লিটার পানি ছাড়া ওমানের সালাম এয়ার কোম্পানি কোনো পানি বিমানে উঠাবে না। এ জন্য সবার মনেই একটা আফসোস। যাহোক মাওলানা জাফর আহমদ সাহেব আমার লাগেজটা তৈরি ও দেশে ফেরার অন্যান্য প্রস্তুতির ব্যাপারে খুবই সহযোগিতা করলেন এ জন্য আমি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ।
ফেরার সময় আবার সেই জেদ্দায় ইমিগ্রেশন ও চেকিং। এরপর রাত ২.১৫ টায় মাসকাত যাত্রা। বিমানটি যখন মাসকাত বিমানবন্দরে ল্যান্ড করলো তখন ফজরের ওয়াক্ত চলে গেছে। আমরা অজু করে ফজরের সালাত আদায় করে মাসকাত বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনের প্রোগ্রামে ঢুকলাম। সবকিছু সেরে বিমানে উঠলে সকাল ১০টায় ওমানের মাসকাত এয়ারপোর্ট থেকে বিমানটি উড়াল দিলো। ২৩ মার্চ ২০২৩ ইং তারিখ বেলা ৩ টা ১৫ মিনিটে বিমানটি ঢাকা বিমানবন্দরে ল্যান্ড করলো।
লেখক : সদস্য, দারুল ইসলাম ট্রাস্ট, দরগাহ রোড, সিরাজগঞ্জ
আপনার মন্তব্য লিখুন