আলহামদুলিল্লাহ, ইন্নাল হামদা লিল্লাহ অসসালাতু ওয়াস সালামু আলা রাসূলিল্লাহ। লাকাদ কানা লাকুম ফি রাসূলিল্লাহি উসওয়াতুন হাসানা। (সূরা আহজাব : ২১) মনে রাখতে হবে, ‘We can never reach our goal until and unless we follow the footprints of Prophet Muhammad sallallahu alaihi wasallam.’ ইসলামী আন্দোলনকে কুরআন সুন্নাহর পথে ঠিকমতো পরিচালনা করতে হবে। সিরাত্বল মুস্তাকিমের রেললাইন থেকে একবিন্দু ডানে বামে যাওয়া যাবে না। চোখ-কান খোলা রেখে ইসলামী আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। অন্যথায় কাল কেয়ামতে কঠিন জবাবদিহি করতে হবে আমাদের। সেদিন কেউ রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসবে না। আসবে শুধুমাত্র কুরআন মাজিদ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল কুরআনু হুজ্জাতুল লাকা আও আলাইকা।’ অর্থাৎ ‘কুরআন হয় তোমার পক্ষের সাক্ষ্য হবে, না হয় তোমার বিপক্ষের সাক্ষ্য হবে।’
প্রকৃতপক্ষে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হচ্ছেন আমাদের মূল আদর্শ। তাঁকে অনুসরণ করতে হবে। তিনিই আমাদের রোল মডেল। তাঁকে দেখেই পথ চলতে হবে আমাদের। সাঈদী সাহেবসহ অন্যান্য ইসলামী ব্যক্তিত্বকে ততটুকুই অনুসরণ করা যাবে, যতটুকু তাঁরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুসরণ ও অনুকরণ করে গেছেন; এর বেশি নয়। আমাদেরকে সে জন্যই কুরআন, হাদিস, নবীর ইতিহাস ও সাহাবিদের জীবনী পড়তে হবে। যাঁরা ইসলামী আন্দোলনের পথিকৃৎ, তাদের জীবনী ভালোভাবে জানতে হবে এবং সেভাবে অনুসরণ ও অনুকরণ করতে হবে।
আল্লামা সাঈদী রাহিমাহুল্লাহ আল কুরআন প্রতিষ্ঠার জন্য সারাজীবন দেশে-বিদেশে তাফসির করে গেছেন। তাঁর আলোচনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কুরআনের আইন চালু করার কাজে নিয়োজিত হয়েছেন তাঁর অগণিত ভক্তকুল। বাংলাদেশে কুরআনের রাজ কায়েম করার জন্য তিনি জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করেন এবং সাংগঠনিকভাবে লোক তৈরি করার কাজে নিয়োজিত হন। অসংখ্য ভক্তকে মাল এবং জানের কুরবানি পেশ করার উপযোগী মুজাহিদ হিসেবে গড়ে তোলেন তিনি। এখন তিনি আর আমাদের মাঝে নেই। তাঁর রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজকে সমাপ্ত করার জন্য অবিরতভাবে কাজ করে যেতে হবে আমাদের।
কেবল কবর জিয়ারত করার উদ্দেশ্যে সফর করা ইসলামে নিষিদ্ধ। নেকির নিয়তে সফর করার জন্য পৃথিবীর মাত্র তিনটি মসজিদে যাওয়ার অনুমতি আছে- বায়তুল্লাহ, মসজিদে নববী এবং মসজিদে আকসা। এছাড়া আর কোথাও নেকির নিয়তে সফর করা নিষিদ্ধ। কিন্তু ইসলাম না জানার কারণে কবরকেন্দ্রিক বিভিন্ন ইসলামবিরোধী কাজে জড়িয়ে পড়ছেন অনেকেই। আল্লামা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী জীবিত থাকতে শিরক ও বিদআতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন। যতদিন পর্যন্ত বাংলাদেশে কুরআনের আইন চালু না হবে, ততদিন পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে। তাঁর ভক্তদের দু’টি কাজ করার উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি-
এক. কুরআন মাজিদকে বুঝে বুঝে পড়তে হবে, অপরকে শেখাতে হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তি উত্তম, যে নিজে কুরআন শিক্ষা করে এবং অপরকে শিক্ষা দেয়।’ এই কাজে নিয়োজিত হতে পারলেই কেবল তাঁকে প্রকৃত সম্মান দেওয়া হবে।
দুই. কুরআনের রাজ কায়েম করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং জান-মালের বিনিময়ে কাজ চালিয়ে যেতে হবে। বিড়ালের মতো দীর্ঘদিন বাঁচার চাইতে সিংহের মতো এক ঘণ্টা বাঁচাই যথেষ্ট। তাই সাহস নিয়ে বাতিলের বিরুদ্ধে আমাদের সকলকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের মধ্যে সুখ্যাতি বজায় রাখার দোয়া করে ইবরাহিম আলাইহিস সালাম আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেছিলেন, ‘হে আল্লাহ! আমাকে এমন সুন্দর সৎকর্মের তাওফিক দান করুন, যা কিয়ামত পর্যন্ত মানবজাতি অনুসরণ করে এবং আমাকে উৎকৃষ্ট আলোচনা ও সদগুণাবলি দ্বারা স্মরণ করে।’ (ইবনে কাসীর, রূহুল মা’আনি) আল্লাহ তাঁর দোয়া মঞ্জুর করেছেন। ফলে ইহুদি, খ্রিস্টান এমনকি মক্কার মুশরিকরা পর্যন্ত ইবরাহিমি মিল্লাতকে ভালোবাসে এবং নিজেদেরকে এর অনুসারী বলে দাবি করে; যদিও তাদের ধর্মমত ইবরাহিমি মিল্লাতের বিপরীতে কুফর ও শিরকে পরিপূর্ণ!
হাদিসে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এই দোয়া বর্ণিত হয়েছে- ‘হে আল্লাহ! আমাকে আমার দৃষ্টিতে ক্ষুদ্র এবং মানুষের দৃষ্টিতে মহান করে দিন।’ এখানে অন্যদের দৃষ্টিতে মহান করে দেওয়ার অর্থ হলো- মানুষ সৎকর্মে তাঁর ভক্ত হয়ে যেন তাঁকে অনুসরণ করে। ইবনে আরাবি বলেন, ‘আলোচ্য হাদিস থেকে প্রমাণিত হয়- যে সৎকর্মের কারণে মানুষের মধ্যে প্রশংসা হয়, সেই সৎকর্ম অন্বেষণ করা জায়েজ।’
আল্লামা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী রাহিমাহুল্লাহ ছিলেন ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ এক দাঈ, একজন বিচক্ষণ রাহবার এবং একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মুফাসসিরে কুরআন। তাঁর মৃত্যুতে আমরা শোকাহত। ইসলামের দৃষ্টিতে তিনদিনের বেশি শোক পালন করা নিষিদ্ধ। অন্য ভাষায় বলা যায়- হারাম। তাই শোক প্রকাশ না করে তাঁর জন্য দোয়া করা এবং তিনি যে কাজ রেখে গেছেন, তা ভালোভাবে করাটাই বর্তমান সময়ের দাবি। দ্বীনের কাজে তাঁর অবদানের কথা উল্লেখ করে আল্লাহর কাছে দোয়া করাটাই তাঁর জন্য সর্বোচ্চ ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। তাঁর কবরের পাশে গিয়ে শিরক ও বিদআতের মতো ভয়াবহ গুনাহর কাজ করা হারাম। এসব কাজ থেকে অনেক অনেক দূরে থাকতে হবে।
সাঈদী সাহেবের রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজগুলো বাস্তবায়নের জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে প্রচেষ্টা চালাতে হবে। হাত গুটিয়ে বসে থাকার কোনো সুযোগ নেই। জন্ম নিলে মৃত্যু অনিবার্য। কিন্তু তিনি যেভাবে দ্বীন কায়েমের শপথের ওপর অবিচল থেকে মৃত্যুবরণ করেছেন, তা আমাদের নিকট অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আমৃত্যু তিনি ইসলামী কল্যাণরাষ্ট্রের জন্য কঠোর পরিশ্রম করে গেছেন। তিনি নিজেই নসিহত করে গেছেন, ‘মানুষের মৃত্যুটা স্বাভাবিক, বেঁচে থাকাটা অস্বাভাবিক। যতক্ষণ বেঁচে আছি, ততক্ষণ যেন ঈমানের সাথে, আমলের সাথে বেঁচে থাকতে পারি; সেজন্য আল্লাহর নিকট ধরনা দিতে হবে, ইসলামের খেদমত করার তাওফিক কামনা করতে হবে এবং শাহাদাতের তামান্না নিয়ে চলতে হবে।’
আল্লামা সাঈদী রাহিমাহুল্লাহ বাংলাদেশকে দুর্নীতিমুক্ত করার জন্য কুরআনের আইনের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করেছিলেন। দুর্নীতিমুক্ত দেশ তখনই হবে, যখন কুরআনের শাসন এবং রাসূলের সুন্নাহ প্রতিষ্ঠিত হবে। প্রধানত ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠিত না থাকা, আল্লাহর ভয় ও তাঁর কাছে জবাবদিহিতার অভাব, অতিরিক্ত ভোগবাদী মানসিকতা ও নৈতিক মূল্যবোধের সংকট ইত্যাদি কারণে দুর্নীতি দেখা দেয়। বাংলাদেশকে অতিসত্বর একটি দুর্নীতিমুক্ত দেশ হিসেবে গড়া অপরিহার্য। এদেশের সকল সেক্টর আজ দুর্নীতিতে সয়লাব। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ধনী হওয়ার মানসিকতাই এর জন্য দায়ী।
সাঈদী সাহেব বাংলাদেশের টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত প্রতিটি জেলায় এবং অধিকাংশ উপজেলায় মাহফিল করেছেন। কুরআনের আইনের পক্ষের প্রার্থীদের বিজয়ী করে সংসদে পাঠানোর জন্য তিনি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে গেছেন নিরন্তর। একই দিনে সাত-আটটা পর্যন্ত সমাবেশ করে বাংলাদেশের জনগণকে জাগিয়ে তোলার কাজ করতেন তিনি। তাঁর সেই ঐতিহাসিক পরিশ্রম ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে ইন শা আল্লাহ।
উপসংহারে বলতে চাই- এ সকল মনীষীর কবরে যাতে কোনো বিদাত অনুষ্ঠিত না হয়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। সুন্নতি পদ্ধতিতে দোয়া করতে হবে মৃত ব্যক্তিদের জন্য। বাড়িতে বসেই দোয়া করা যথেষ্ট হবে। আল্লামা সাঈদী রাহিমাহুল্লাহ শিরক ও বিদআতের বিরুদ্ধে সারাজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। আজকে স্বয়ং তাঁর কবরেই যেন শিরক-বিদআত সংঘটিত না হয়, সেটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের সকলের। এ ব্যাপারে আল্লামা সাঈদী বেঁচে থাকতেই সকলকে সতর্ক করেছেন। তাঁর সেই কথাটি দিয়েই আমার লেখা শেষ করছি। আল্লামা সাঈদী রাহিমাহুল্লাহর জীবিতকালীন নির্দেশ- ‘আমার কবর জিয়ারতকালে কবর স্পর্শ করবেন না, দেওয়ালে চুমু খাবেন না ও কান্নাকাটি করবেন না। আমি আমার সারাজীবন শিরক ও বিদআতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছি। সুতরাং আমার কবরকে কেন্দ্র করে এ জাতীয় কিছু করা হলে যারা করবেন, তারাই আল্লাহর কাছে দায়ী হবেন ও দায়ী থাকবেন।’
লেখক : ভারপ্রাপ্ত আমীরে জামায়াত
আপনার মন্তব্য লিখুন