post

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটে ওষ্ঠাগত জনজীবন

মুহাম্মদ হাফিজুর রহমান

২৫ মে ২০২৩

আমরা স্বপ্ন তাড়িত জাতি, স্বপ্নে ভর করে আমরা মহাদেশ পড়ি দেই। যদিও এখন কোনো কোনো মহাদেশে যেতে নিষেধ আছে। মহাসাগরে নতুন বসতি গড়ার আকাঙ্ক্ষায় আমরা বাহবা দেই। স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট রাজনীতিতে আমরা অনেক কিছু পার করে এসেছি, বিনা ভোটে ১৫৩ জন সংসদ সদস্য জিতিয়ে আনা এবং দিনের ভোট আগের রাতেই সেরে ফেলার স্মার্ট পলিটিক্স আমাদের মতো কেউ এখনো আত্মস্থ করতে পারেনি। তীব্র গরমে রাজনীতির এসব গরম আলোচনাই মূখ্য হওয়ার কথা ছিলে কিন্তু সবকিছু বাদ দিয়ে আলোচনায় বিদ্যুৎ, গ্যাস আর পানি সংকট। জীবনের পারদ ওঠানামায় আজ আমরা অতিষ্ঠ, ত্যক্ত-বিরক্ত। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অতি আবশ্যকীয় পাঁচটি মৌলিক অধিকার- খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এবং চিকিৎসা। এর সবগুলোর সাথে গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং পানির সম্পর্ক বিদ্যমান। বিদ্যুৎ-বিহীন জীবন যাপনের কথা কল্পনা করা যায় না। বাসা, বাড়ি, অফিস, কল কারখানার উৎপাদন, কৃষি, খাদ্য প্রক্রিয়ারণ, চিকিৎসা সকল কাজেই অতি-আবশ্যক উপাদান বিদ্যুৎ। এই লেখা যখন লিখছি তখন এক দিকে প্রচণ্ড গরম অপর দিকে তীব্র বিদ্যুৎ সংকট। সীমাহীন বিদ্যুৎ সংকটে নাগরিক জীবন অতিষ্ঠ। প্রচণ্ড গরমে রাতের বেশির ভাগ সময় বিদ্যুৎ থাকছে না। গৃহস্থালি কাজে যারা গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল, তারা গ্যাস সংকটের কারণে সঠিক সময়ে খাবার তৈরি করতে পারছেন না। শিল্প এবং বিদ্যু উৎপাদনের বড় একটি অংশ গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। দীর্ঘদিন যাবৎ গ্যাস সংকট শুধু বেড়েই চলছে। গ্রামেগঞ্জে পানির বিভিন্ন প্রাকৃতিক উৎস থাকলেও নগর জীবনে পানি সরবরাহ করে ওয়াসা এবং জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। তারাও মানুষের প্রয়োজন মাফিক পানি সরবরাহ করতে পারছে না বিদ্যুৎ সংকটের কারণে। নানামুখী সংকটে মানুষের জীবন নিয়ে টিকে থাকাই যেন দায় হয়ে পড়েছে। এমনিতে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি যেন জাতীয় অর্থনীতির একটি আবশ্যকীয় নিয়ম হয়ে গিয়েছে। প্রতিদিন শুধু অতি প্রয়োজনীয় জীবন ধারণকারী দ্রব্যের মূল্য বেড়েই চলছে। এ সকল সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব যারা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন, তাদের ওপর। তাদের ভাব, ভাষা, বক্তব্য আর চাহনিতে যে অভিব্যক্তি প্রকাশিত হয়, তাতে বোঝার উপায় নেই যে আসলে দেশে কোনো সংকট আছে। ক্ষমতাসীনদের বক্তব্য অনুযায়ী পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দেশটির তালিকাতেই যেন বাংলাদেশের অবস্থান। অথচ সংকটমুক্ত একটি বিষয়ও আবিস্কার করা যাবে না। বিদ্যুৎ সংকটের সমস্যা সমাধান কতদিনে হবে, অথবা আদৌ হবে কি না, তার কোনো সদুত্তর এই মূহুর্তে রাষ্ট্রের কর্তা ব্যক্তিরা দিতে পারছেন না। একটি সংকটের সাথে আরেকটি সংকট জড়িত। বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধের কারণ কয়লা নেই। কয়লা নেই কেন, আমদানী করা যাচ্ছে না। কেন আমদানী করা যাচ্ছে না, ডলার নেই। গ্যাস নির্ভর বিদুৎ কারখানা গুলোতেও উৎপাদন বন্ধ হওয়ার উপক্রম। গ্যাস সংকটের কথা আমরা শুনে আসছি অনেকদিন থেকেই। একদিকে গ্যাসের মজুদ কমে যাওয়া, অপরদিকে দীর্ঘদিন যাবৎ ডলার সংকটের কারণে গ্যাস উত্তোলনের ফি ও ক্রয়কৃত গ্যাসের মূল্য  বকেয়া পড়েছে। সর্বত্র সংকট আর সমস্যা। এর মাঝেই আমাদের বসবাস। 

আধুনিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বর্তমান পৃথিবীর সব কিছু একটির সাথে অপরটি ওৎপ্রতোভাবে জড়িত। একটি সমস্যা শুরু হলে সেটি দ্রুত সমাধান না করলে তার সাথে আরো অনেক সমস্যা এবং সংকট বাড়তেই থাকে। দীর্ঘদিন যাবৎ ডলার সংকটের কথা বলা হলেও সরকারের তরফে তা শুধু অস্বীকারই করা হয়নি, বরং বাস্তবের চেয়ে রিজার্ভকে আরো বড়করে দেখানো হয়েছে। ব্যবসায়ীরা অনেকদিন যাবৎ চাহিদামতো এল সি খুলতে পারছে না। এর প্রভাব পড়ছে আমদানী এবং রপ্তানী বাণিজ্যে। এমনকি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানীতেও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। কয়েকটি বড় শিল্পগ্রুপ ব্যতীত অন্যরা চাহিদামতো এল সি খুলতে পারছে না। তাদেরকে বলা হয় ওপেন মার্কেট থেকে ডলার ক্রয় করার জন্য। ডলারের বাজারে তারল্য সংকট দীর্ঘদিনের। ওপেন মার্কেট হতে ডলার কিনতে গেলে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যে ডলার কেনার কারণে পণ্য মূলে বেড়ে যাচ্ছে, এর পাশাপাশি কিছু ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার বিষয়টি তো আছেই। এতোদিন সংকট ছিলো শুধু বেসরকারীভাবে। ব্যবসায়ীরা প্রয়োজনমতো এল সির বিপরীতে ডলার পেতো না। এখন এই সমস্যা সংকট সরকারের অভ্যন্তরে প্রকট আকার ধারণ করেছে। সরকার নিজেই এখন কয়লা, গ্যাস এবং ফার্নেস অয়েল আনতে পারছে না। বিদ্যুৎ উৎপাদনে অতি প্রয়োজনীয় একটি উপাদান হচ্ছে ফার্নেস অয়েল। একটি জাতীয় দৈনিকের তথ্যমতে ‘মজুদকৃত (০৮ জুনের রিপোর্ট) ফার্নেস অয়েলে আর মাত্র দশ দিন চলতে পারে। সরকার যদি অতি দ্রুত ফার্নেস অয়েল আমদানী না করে তবে এটির সংকটের কারণেও বিদ্যুৎ সংকট আরো বাড়বে।’ এরপর তড়িঘড়ি করে সরকার আপাত কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে, কিন্তু সেই ব্যবস্থা কতদিন স্থায়ী হবে, সরকারই ভালো বলতে পারবে।  বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট এবং সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের দেওয়া তথ্যে রয়েছে অনেক গড়মিল। এখানে একটি বিষয় বলে রাখা ভালো। রাষ্ট্রীয় যে কোনো বিষয়ে তথ্য পাওয়ার জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সূত্র হওয়ার কথা ছিল সরকারের ওয়েবসাইট এবং কর্তা ব্যক্তিদের বক্তব্য। কিন্তু সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের বক্তব্য এবং ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যের ওপর শতভাগ নির্ভর করা যাচ্ছে না। যাচ্ছে না এ কারণে যে, ক্ষমতা চর্চার দুর্বলতাগুলো সরকার প্রকাশ করতে চায় না। জনগণকে এক ধরনের বিভ্রান্তির মধ্যে রেখেই তারা ক্ষমতা চর্চা করতে চায়। আর এটি জনসমর্থনহীন সকল সরকারের একটি স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য।  

তীব্র গরমে যখন বিদ্যুতের চাহিদা বেশি তখন সরবরাহ বৃদ্ধির পরিবর্তে গত ৫ জুন বন্ধ হয়ে যায় পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং ৯ জুন বন্ধ হয়ে যায় বাঁশখালী তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ সকল খবরের মাঝে আরো একটি দুসংবাদ আসে যে, পানি প্রবাহের অভাবে রাঙামাটির কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি যে কোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। যদিও বর্ষাকাল আসন্ন এবং ইতোমধ্যে দু’একদিন বৃষ্টি হয়েছে। এতে আশা করা যায় এ বছরে হয়তো রাঙামাটির কাপ্তাই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সংকট উৎরে যাবে। পায়রা তাপ ও বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে ও চীনের যৌথ উদ্যোগে। ২০১৪ সালে এই কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশ সরকারের বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের সাথে চায়না পাওয়ার কোম্পানী লিমিটেডের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৬ সালে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মান ও স্থাপন কাজ শুরু হয়। পটুয়াখালী জেলার ধনখালী গ্রামে ১০০০ একর জমির ওপর নির্মিত হয়েছে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। এর অদূরেই রয়েছে পায়রা নদী বন্দর। নদী বন্দর হতে অতি দ্রুত কয়লা খালাস করা যাবে এ প্রত্যাশা নিয়ে এটি এখানে স্থাপন করা হয়। একইভাবে সমুদ্র বন্দরের কাছাকাছি স্থাপন করা হয় বাঁশখালী তাপ  বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র। এগুলো বন্ধ করার সময় আবার কবে নাগাদ এটি চালু হবে তা কর্তৃপক্ষ বলতে পারেননি। সরকারের মন্ত্রীরা বলেছেন, অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিদ্যুৎ সংকটের সমাধান হবে। শেষ পর্যন্ত ১০ জুন-২০২৩ শনিবার ২৬ হাজার ৬২০ মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে বন্দরের পশুর নদের হাড়বাড়িয়া এলাকায় জাহাজটি নোঙর করেছে। কয়লা সংকটের কারণে এর আগে রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ২৪ এপ্রিল থেকে প্রায় একমাস বন্ধ ছিলো। গত ১৬ মে বাংলাদেশী পতাকাবাহী জাহাজ এমভি বসুন্ধরা ইমপ্রেসে ৩০ হাজার মেট্রিক টন ও ২৯ মে এমভি বসুন্ধরা ম্যাজেস্টি জাহাজে ৩০ হাজার ৫০০  মেট্রিক টন কয়লা মোংলা বন্দর হয়ে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে নিয়ে আসার পর সেটি আবার চালু করা হয়। চীন থেকে কয়লা আসার পর পায়রা এবং বাঁশখালী তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি আবার চালু করা হয়েছে। পায়রা, রামপাল এবং বাঁশখালীর জন্য যে পরিমাণ কয়লা আমদানী করা হয়েছে তা দিয়ে আপাত সমস্যা মোকাবিলা করা গেলেও বেশি দিন চলবে না। এরপর আবার দ্রুত কয়লা আমদানী করতে না পারলে বিদ্যুৎ সংকট আরো বাড়তে থাকবে। বড় পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে দেশীয় কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উপৎপাদন করা হয়। এর বাইরে বাকী তিনটি তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র চলে আমদানী করা কয়লা দিয়ে। 

যদিও তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ক্ষতিকর দিক নিয়ে পরিবেশবাদী এবং পরিবেশ বিশেষজ্ঞগণ শুরু থেকেই বিরোধিতা করে আসছেন। বাঁশখালী তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি স্থাপন করার সময় মাত্র ১৫০ টি পরিবারের বসত ভিটা এবং কৃষি জমি অধিগ্রহণ করার কথা থাকলেও প্রায় সাত হাজার পরিবার এর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। বঙ্গোপসাগরের কূলঘেঁষে বাঁশখালীর গন্ডামারা এলাকায় স্থাপিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি এস আলম গ্রুপ ও চীনের সেপকো থ্রির যৌথ মালিকানাধীন কোম্পানী। বেসরকারী বিনিয়োগে এটিই প্রথম তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ ছাড়া রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে বিস্তর লেখালেখি ও প্রতিবাদ হয়েছে। সুন্দরবন ও সমুদ্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার নানান দিক তুলে ধরা হয়েছে। যদি এ দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সাথে জড়িত প্রকৌশলীরা বলেছেন, এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে সুপার ক্রিটিক্যাল পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। সুপার ক্রিটিক্যাল পদ্ধতিতে নির্মিত তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র সাধারণ তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ব্যতিক্রম। এতে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হওয়ার কোনো আশংকা নেই। এই নিবন্ধে এটি আলোচনার বিষয় নয়। মূল প্রতিপাদ্য বিষয় কয়লা নেই, কয়লার অভাবে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আবার কয়লা এনে সাময়িকভাবে চালু করা হচ্ছে। এভাবে জোড়াতালি দিয়ে একটি দেশের জাতীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন প্রক্রিয় চলতে পারে কিনা? অথচ আমরা আমেরিকা, কানাডা এবং সিঙ্গাপুরকে টেক্কা দিতে চাচ্ছি। সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে কেন আমেরিকা যাবো, সে প্রশ্ন তুলি, কানাডার গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলি, সিঙ্গাপুরের উন্নয়নকে ছাড়িয়ে যাওয়ার বাগাড়ম্বর করি। এসব দেশে বছরে কতবার লোডশেডিং হয়? গত ৭ এপ্রিল ২০২৩-এ ঝড়ের কবলে বিদ্যুৎ লাইন ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় একটি প্রদেশে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছিলো এবং বেশ কয়েকবছর আগে কানাডায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় ২৪ ঘন্টা সম পরিমাণ সময় বিদ্যুৎ ছিলো না। আমাদের বোধগম্য নয়, এ সকল উন্নত দেশগুলোকে কী কী সূচকে আমরা ছাড়িয়ে গিয়ে নিজেরা এখন স্মার্ট রাষ্ট্রের তালিকায় আছি?

আমদানী করা কয়লার মজুদ শেষ হওয়ার আগে দ্রুত আবার আমদানী করতে না পারলে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো আবার বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। কয়লা সংকটের কারণ এটি নয় যে বিশ^ বাজারে কয়লা নেই। বরং সমস্যা আমাদের অভ্যন্তরীণ। আমাদের হাতে আমদানী করার মতো পর্যাপ্ত ডলার নেই। সিপিডির ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্জের একটি বক্তব্য বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়েছে। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে  ‘সরকারের হাতে খরচ করার মতো টাকাও নেই, ডলারও নেই।’। এতেদিন সরকার আমাদের বুঝ দেবার চেষ্টা করেছে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সব কিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় কয়লা, তেল পেট্রোল পাওয়া যাচ্ছে না ইত্যাদি। এখন কারো বুঝতে বাকী নেই যে, আন্তর্জাতিক বাজারের সংকট নয়, সংকট আমাদের নিজস্ব। মেগা প্রকল্প করতে গিয়ে যে মেগা দুর্নীতি হয়েছে তাতে দেশের অর্থনীতির মহাসর্বনাশ করা হয়েছে। বালিশ কাণ্ড, পর্দা কাণ্ডসহ নানান কাণ্ডে কী পরিমাণ যে দুর্নীতি হয়েছে তার সঠিক হিসেব আসলে কারো কাছে নেই। সরকারি দলের ছোটো খাটো হোমরা চোমরারাও এখন হাজার কোটি টাকার মালিক। সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের একটি জেলা পর্যায়ের নেতা দুই হাজার কোটি টাকা পাচার করে গ্রেফতার হয়েছে। এ একটি ঘটনা প্রমাণ করে কী পরিমাণ দুর্নীতি দেশে হয়েছে আর কী পরিমাণ অর্থ দেশ থেকে পাচার হয়ে বিদেশী বিভিন্ন ব্যাংকে জমা হয়েছে। তাদের এই চুরি, দুর্নীতি আর অসততার বলি আজ বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ।

প্রধানমন্ত্রী অবশ্য তার বেশ কয়েকটি বক্তৃতায় বলেছেন, বিদ্যুৎ সংকট বেশিদিন থাকবে না। তার এ বক্তব্যের রহস্য কী? তা তিনিই বলতে পারবেন। তার বক্তব্যের সূত্র ধরে যা ধারণা করা যায় যে, বর্ষা শুরু হলে বিদ্যুতের চাহিদা কিছুটা কমবে। প্রচণ্ড দাবদাহও কমে আসবে। সাধারণ মানুষ বিদ্যুৎ সংকটে তেমন বেশি কষ্ট পাবে না। অপর দিকে তিনি হয়তো রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু হওয়ার বিষয়ে আশাবাদী। রূপপুর পরমাণু কেন্দ্রের সাথে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানী ও কর্মকর্তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, আগামী ডিসেম্বরে এটি উৎপাদনে যেতে পারবে এবং ২০২৪ সাল নাগাদ এটি জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। এ পরমাণু কেন্দ্রটির পরিকল্পনা ও স্থাপন কাজ শুরু হয় গত শতকের ষাটের দশকে। ১৯৬১ সালে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ১৯৬২-১৯৬৮ সালে রূপপুরকে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে স্থান হিসেবে নির্বাচন এবং প্রকল্পের জন্য ২৬০ একর ও আবাসিক এলাকার জন্য ৩২ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ১৯৬৯-১৯৭০  সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এ প্রকল্পের কাজ স্থগিত রাখে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সাত বছর পর ১৯৭৭ সালে একনেক কর্তৃক পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পটি পুনরায় অনুমোদন হয়। বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার এবং রাশান ফেডারেশন সরকারের মধ্যে ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এবং একই বছরের নভেম্বরে জাতীয়সংসদে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গৃহীত হয়। ২০১১ সালে বাংলাদেশ এবং রাশান ফেডারেশন সরকারের মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন সংক্রান্ত আন্তঃরাষ্ট্রীয় সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেন। রূপপুর পরমাণু কেন্দ্রের বিষয়ে পরিবেশবাদিদেরও ব্যাপক আপত্তি আছে। এর মূল পরমাণু চুল্লি তৈরি হয়েছে রাশিয়ায়, আমাদের দেশে এর প্রটেকশনের কোনো প্রযুক্তি নেই। এটি সম্পূর্ণ বিদেশ নির্ভর একটি প্রকল্প। এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, ক্ষতির দিকটি মাথায় রেখে সর্বোচ্চ প্রটেকশন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পারমাণবিক দুর্ঘটনার ঝুঁকির বিষয়টি চিন্তা করলে আঁতকে ওঠার মতো বিষয়।  কোনো পারমাণবিক প্রযুক্তিই শতভাগ নিরাপদ নয়, তার ওপর বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ ও পারমাণবিক প্রযুক্তিতে নিজস্ব সক্ষমতাহীন একটি দেশের জনগণকে বড় ঝুঁকির মধ্যে রাখা। যেখানে আমাদের দেশে সামান্য মার্কেট, ভবন এবং কারখানায় অগ্নিকান্ডের মতো দুর্ঘটনা আমরা রোধ করতে পারি না। সেখানে চেরনোবিল, থ্রি মাইল আইল্যান্ড কিংবা সর্বশেষ ফুকুশিমার মতো বড় বড় দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে।  প্রযুক্তির দিক দিয়ে শীর্ষে অবস্থানকারী দেশগুলোর কথা জানি। যারা আমাদের চেয়ে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির দিক দিয়ে অনেক দক্ষ এবং উন্নত। তারা  নিজস্ব দক্ষতার ওপর নির্ভর করে  পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছিল। কিন্তু এই বড় বড় দুর্ঘটনা আমাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, এটি কতো বড় আশঙ্কার বিষয়। প্রযুক্তির ব্যবহার যত বাড়তে থাকে বিপর্যয় এবং বিপদের শঙ্কাও ততো বাড়তে থাকে। মহান রবের কাছে প্রার্থনা তিনি যেন আমাদেরকে সকল প্রকার ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করেন।

বিদ্যুৎ নিয়ে সবচেয়ে মজার যে বিষয়টি ঘুরেফিরে আলোচনায় আসে সেটি হলো, আমাদের এমপি মন্ত্রীরা অনেকেই বলেছেন, আমার প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করছি। জাতীয় সংসদে আলোচনা হয়, ফেরী করে বিদ্যুৎ বিক্রি করা হবে, কিন্তু কোনো ক্রেতা পাওয়া যাবে না। অথচ আমরা ক্রেতারা বিদ্যুৎ ব্যবহারের আগেই মূল্য পরিশোধ করছি। সরকারের তরফে এমন কথাও বলা হয়েছিলো, ব্যবহারের পর উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ নেপালে রপ্তানী করা হবে। এর এক বছর পরই এ বছর শুনছি সরকার নেপাল হতে বিদ্যুৎ কিনবে। ইতোমধ্যে ভারতের ঝাড়খন্ডে নির্মিত আদানী বিদুৎ কেন্দ্র হতে বিদ্যুৎ আমদানীর একটি কথা শোনা গেলেও তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। বাংলাদেশের কর্মকর্তারা আভাস দিয়েছিলেন, এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহের দিকে গোড্ডার ১৬০০ মেগাওয়াট থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশে আসতে পারে কিন্তু সেটি আসেনি। এর আগেও আরও তিন দফা বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য তারিখ নির্ধারণ করা হলেও নির্ধারিত তারিখে বিদ্যুৎ পাওয়া যায়নি। এ সংক্রান্ত বিবিসির এক রিপোর্টে বলা হয়েছে  ‘দু’দেশ মিলিয়ে এই যে মোট ১৩৪ কিলোমিটার লম্বা ট্রান্সমিশন লাইন, সেটার কাজ এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি বলেই বিদ্যুৎ সরবরাহে কিছুটা দেরির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি এটাও বলা হচ্ছে, একাজ বেশি বাকি আছে বাংলাদেশ অংশেই।’ বাংলাদেশ বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে। আদানি পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে আমদানি করা গেলে আমদানীকৃত বিদ্যুতের পরিমাণ দাড়াবে ২৭০০ মেগাওয়াট।

বনানীর ১৮ নম্বর সড়কে নাকি কখনো লোড শেডিং হয় না। এ সংক্রান্ত একটি সংবাদের কিয়দংশ দৈনিক মানব জমিনের সৌজন্যে পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি ‘‘ঢাকাসহ সারা দেশে চলছে তীব্র লোডশেডিং। ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিংয়ে ত্রাহি অবস্থা। এই অবস্থার ব্যতিক্রম বনানীর ১৮ নম্বর সড়ক এলাকা। এই সড়কের পাশের বাসিন্দারা ভাগ্যবানও বটে। লোডশেডিংয়ের ভোগান্তির ছিটেফোঁটাও নেই এখানে। ২৪ ঘণ্টাই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ থাকে। এজন্য এ সড়কে অবস্থিত বাড়িগুলোর জেনারেটরও চালাতে হয় না। ইউপিএস-আইপিএসে’র প্রয়োজনও পড়ছে না কারো। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়ায় এই সড়ক এলাকার বাসিন্দারাও খুশি। কিন্তু কেন এই সড়কটি ব্যতিক্রম তা জানতে সরজমিন এলাকায় গিয়ে জানা যায় এই সড়কে অবস্থিত একটি ভবনের বাসিন্দা প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহি চৌধুরী। দেশের সব সড়ক বনানীর ১৮ নম্বর নয়। এটা তারা বুঝতে পারেন কিনা, জানি না। বনানীর ১৮ নম্বর সড়কটি একটি ভাগ্যবান সড়কই বলা যায়। দৈনিক জাতীয় দৈনিকে একজন লিখেছেন ‘দেশের সব সড়ক যদি ১৮ নম্বর হতো’। এটি জনগণের দুঃখ  আর আক্ষেপের বহিঃপ্রকাশ।

বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটের কারণে শিল্প উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। যার প্রভাব সর্বত্র। অর্থনীতির ভঙুর অবস্থা কতদিনে কাটিয়ে ওঠা যাবে বলা মুশকিল। তসবিহর দানার মতো একটির সাথে আর একটি সমস্যা শুরু যুক্ত হচ্ছে। উন্নয়নের ডুগডুগির আওয়াজে আমাদের কান যখন ঝালাপালা তখন দেখছি যে সব কিছু নাই, নাই-এর মহাসাগরে আমরা ভাসছি। বিদ্যুৎ নেই, পানি নেই, গ্যাস নেই, ব্যাংকে টাকা নেই, রিজার্ভ নেই। এমনি পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক জীবন নিয়ে বসবাস করা প্রতিটি নাগরিকের দায় হয়ে পড়েছে। হাসপাতালে শিশু রোগীর পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। তীব্র তাপদাহের শিশুরা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। মে মাসের শুরু থেকে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে যে মারাত্মক সংকট ছিল, তা কিছুটা সামাল দেয়া হয়েছে। বালির বাধ দিয়ে কি প্রচণ্ড শক্তিতে ধেয়ে আসা ঢেউ মোকাবিলা করা সম্ভব? সমস্যা শুধু বিদ্যুৎ, গ্যাস আর পানির নয়। ইতিহাসের ভয়াবহ দুর্নীতি, লুটপাট আর অর্থ পাচারের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে ফাঁপা করে ফেলা হয়েছে। যা সিপিডর একজন ফেলো তার বক্তব্যে প্রকাশ করেছেন। মেগা উন্নয়নে মেগা দুর্নীতির কারণে অর্থনীতি এখন কাচের ঘরের মধ্যে বাস করছে। যে কোনো আঘাতে যা ভেঙে গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে যেতে পারে। জনগণের কাছে যাদের জবাবদিহীতার অনুভূতি থাকে না। বুলেট, লাঠি টিয়ারসেল, গায়েবী মামলা আর নির্যাতনে যারা প্রতিবাদি জনতার আওয়াজকে দাবিয়ে দিতে অতি বেশি পারঙ্গম, তাদের কাছে জনগনের প্রয়োজন আর চাহিদাগুলো নস্যিই মনে হয়। জনগণের কাছে জবাবদিহীর কোনো তাগিদ যারা অনুভব করে না, জনগণের দুঃখ প্রতিবাদের ভাষাকে যারা সরকারের উৎখাতের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখে। ভিআইপির যাতায়াতের জন্য রাস্তা বন্ধ রাখায় যে দেশে একটি অসুস্থ শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। সেই দৃশ্য ভিডিও করার কারণে যখন একটি কিশোরকে আবার রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দিয়ে জেলে পুরে রাখা হয় এমন একটি সমাজ এবং রাষ্ট্রেই আমাদের বসবাস!

লেখক : বিশিষ্ট কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির