post

বিনা দোষে কারাবাস ও ভুল বিচারের সংস্কৃতি

লাবিব আহসান

২০ এপ্রিল ২০২৩

কিছু কিছু মানুষের জীবন-গল্প কল্পনাকেও হার মানায়। নুরজালাল মোল্লার গল্পটা তেমনই। ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১২ তারিখ। মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার বুনাগাতি গ্রামের ছোট্ট বালক নুরজালাল তার অপর দুই সঙ্গীসহ দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দরের রেলস্টেশনে নামে। ট্রেনে ট্রেনে পণ্য ফেরি করে বেড়ানোই ছিল তাদের পেশা। সেই সুবাদে শৈশবের সোনাঝরা দিনগুলোতেই তাদের ছুটতে হতো দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। কিন্তু উত্তর জনপদের এই জেলাটি যে নুরজালালের জীবনে দুঃস্বপ্ন হয়ে আবির্ভূত হবে, তা সম্ভবত সে ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেনি।

হিলি স্থলবন্দর রেলস্টেশনে নেমে কাগজ কুড়াতে কুড়াতে না বুঝেই নো-ম্যান্স ল্যান্ডের দিকে চলে যায় ৩ বালক। দৃশ্যটি চোখে পড়ে সেখানে দায়িত্বরত এক বিডিআর সদস্যের। তিনি ডাকেন তিনজনকেই। নুরজালালের সঙ্গে থাকা সঙ্গীদ্বয় সঙ্গে সঙ্গে যেতে পারলেও কাগজের ভারী বস্তা নিয়ে যেতে কিছুটা দেরি হয় তার। এই ছোট্ট অপরাধটিই কাল হয়ে দাঁড়ায় নুরজালালের জীবনে। সেই বিডিআর সদস্য শুরু করেন বেধড়ক মারপিট। এরপর তাদের তিনজনের নামে দিনাজপুরের হাকিমপুর থানায় মামলা দায়ের করেন বিডিআর সদস্যরা। মামলার জিআর নাম্বার ৭৩২/০৪।

তিন বালকই আহত থাকার কারণে হাকিমপুর থানার তৎকালীন ওসি তাদেরকে রাখতে চাইলেন না। কিন্তু বিডিআরের হাবিলদার আব্বাস আলী কিছু ঔষধ দিয়ে থানাতেই রেখে যান তাদের। পরদিন ওই তিন বালককে আদালতে সোপর্দ করে পুলিশ। আদালত তাদের কারাগারে পাঠালে কারা-কর্তৃপক্ষ শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে ওই দিনই কারা-হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়। সেখানে দীর্ঘ ১৩ মাস চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠে তারা। মামলায় দুই বালকের বয়স উল্লেখ থাকায় তারা জজ কোর্টে কিশোর আইনে জামিন নিয়ে বের হয়ে যায়, কেবল থেকে যায় নুরজালাল।

সঙ্গীদ্বয়ের মুক্তির প্রায় সাত মাস পর আদালতে তোলা হয় তাকে। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! বয়স জটিলতার কারণে জামিন না-মঞ্জুর হয়ে যায় নুরজালালের। একপর্যায়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জামিনপ্রাপ্ত তার দুই সঙ্গীকে সাক্ষী বানিয়ে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে চার্জশিট দেয় আদালতে। এরপর দীর্ঘ তিন বছর হাজতি হিসেবে কারাগারে থাকে নুরজালাল। তিন বছরের মাথায় দিনাজপুর জজকোর্ট এই মামলায় বালক নুরজালালের যাবজ্জীবন সাজার রায় ঘোষণা করেন। জেলসুপারের মাধ্যমে উচ্চ আদালতে আপিল করলেও বয়স জটিলতার কারণে সাজা বহাল থাকে তার।

যেদিন নুরজালালের বিভীষিকাময় বন্দিজীবনের সূচনা হয়েছিল, সেদিন তার বয়স ছিল ৯ বছর। বর্তমানে সে আছে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে। ইতোমধ্যেই কেটে গেছে তার জীবনের মূল্যবান ২০টি বছর। কারাগারে যাওয়ার আগেই তার মা মৃত্যুবরণ করেন। আর বাবা মারা যান তার কারাগারে যাবার পর। চার্জশিটে নুরজালালের বয়স ১৮ বছর উল্লেখ করেছিলেন তদন্ত কর্মকর্তা। আবার ২০০৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর যখন তাকে দিনাজপুর কারাগারে গ্রহণ করা হয়, তখন তার বয়স ১৯ বছর উল্লেখ ছিল। এ ধরনের বয়স জটিলতার কারণেই আদালত তার সাজা বহাল রাখে। (তথ্যসূত্র : দৈনিক নয়া দিগন্ত; ৭ মার্চ ২০২৩)

২.

‘স্যার, আমি জাহালম। আমি আবু সালেক না, আমি নির্দোষ।’ এটি সাম্প্রতিক অতীতের তুমুল আলোচিত একটি আকুতি। আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে যে লোকটি বিচারকের কাছে এই আকুতি পেশ করেছিলেন, তার নাম জাহালম। ২০১৪ সালে তার গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের ঠিকানায় দুদকের একটি চিঠি যায়। সেই চিঠিতে ১৮ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে নয়টায় জাহালমকে হাজির হতে বলে দুদক। জাহালম তখন নরসিংদীর ঘোড়াশালের বাংলাদেশ জুট মিলে শ্রমিকের কাজ করছেন। চিঠিতে বলা হয় ভুয়া ভাউচার তৈরি করে সোনালি ব্যাংকের ১৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত আবু সালেক নামের এক লোক, যাঁর সোনালি ব্যাংক ক্যান্টনমেন্ট শাখায় হিসাব রয়েছে। আবু সালেকের ১০টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ভুয়া ঠিকানাগুলোর একটিতেও জাহালমের গ্রামের বাড়ির কথা নেই। রয়েছে পাশের আরেকটি গ্রামের একটি ভুয়া ঠিকানা। কিন্তু সেটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় জাহালমের জীবনে। বড়ো ভাইকে নিয়ে দুদকের ঢাকা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হাজির হওয়ার পর জাহালমকেই আবু সালেক বলে চিহ্নিত করে দুদক। কারণ তার চেহারার সঙ্গে আবু সালেকের চেহারার কিছুটা মিল আছে মাত্র। কী আজব এক দেশ!

২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি নরসিংদীর ঘোড়াশালের মিল থেকে গ্রেফতার হন জাহালম। তার পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসে। অনেক কাকুতি-মিনতি করেন, ‘স্যার, আমি জাহালম। আবু সালেক না। আমি নির্দোষ।’ কিন্তু কেউ শোনে না তার আকুতি। তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কারাগারে। সম্পূর্ণ নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও বুকফাটা আর্তনাদে তাকে মেনে নিতে হয় বন্দিত্ব। ব্যাংক, দুদক, পুলিশ ও আদালত, সবার কাছেই জাহালম হয়ে ওঠেন ‘আবু সালেক’ নামের ধুরন্ধর ব্যাংক জালিয়াত। এই চারটি পক্ষের ভুলের কারণে তিনি হারিয়ে ফেলেন জীবনের মূল্যবান তিনটি বছর।

পরিবারের উপার্জনক্ষম মানুষটির অনুপস্থিতিতে অনেকটাই পথে বসতে হয় তার বৃদ্ধা মা এবং অসহায় স্ত্রীকে। যেদিন মামলার শুনানি থাকত, সেদিন জাহালমকে দেখার জন্য টাঙ্গাইল থেকে ঢাকার আদালতে যেতে হতো তাঁর বড় ভাই শাহানূরকে। প্রায় শুনানির তারিখেই তিনি অন্যের কাছ থেকে টাকা ধার করে আনতেন। সেই টাকা নিয়ে ছুটে যেতেন ভাই জাহালমের কাছে। এভাবে অনেকের কাছ থেকে সুদের টাকা নিতে হয়েছে। এনজিও থেকেও নিতে হয়েছে ঋণ। আদালতের বারান্দায় ঘুরে ঘুরে একসময় চরম হতাশ হয়ে পড়েন শাহানূর মিয়া। 

অবশেষে ভাইকে মুক্ত করতে তিনি দ্বারস্থ হন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের। খুলে বলেন সব ঘটনা। সব শুনে অনুসন্ধানে নামে মানবাধিকার কমিশন। তাদের তদন্তেই বেরিয়ে আসে, আবু সালেক আর জাহালম একই ব্যক্তি নন। আদালতকে এ কথাটি জানানোর দায়িত্ব নেয় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। অতঃপর বিনা দোষে এক হাজার ৯২ দিন কারাভোগের পর জাহালম ফিরে আসেন মুক্ত বাতাসে। কিন্তু তার জীবনের এই মূল্যবান সময়গুলো ফিরিয়ে দেবে; এমন সাধ্য কার? তার পরিবারের বিনিদ্র রজনীগুলোর মাশুল কি দিয়ে দেওয়া সম্ভব? (তথ্যসূত্র : দৈনিক প্রথম আলো; ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯)

৩.

সাতক্ষীরার দুজন পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে ছিলেন ওয়ায়দুর রহমান, যিনি আবেদ আলী হিসেবেই বেশি পরিচিত। ২০০৬ সালে ওই মামলায় তিনিসহ আরও দুজন আসামিকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয় আদালত।   

হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের রায় বাতিল করে ২০১১ সালে আবেদ আলীকে খালাস দেয়। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ পুনরায় সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করলে পরবর্তী চার বছর ধরে চলতে থাকে মামলার শুনানি। ২০১৮ সালের অক্টোবরে আদালত আপিল বিভাগের রায় বহাল রাখে। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই মানুষটির! যেদিন খালাসের রায়ের কপি কারাগারে গিয়ে পৌঁছায়, তার কিছুক্ষণ আগেই মারা যান আবেদ আলী। মৃত্যুর আগে নির্দোষ হবার স্বীকৃতি পেলেও একদিনের জন্যও আর ফিরতে পারলেন না পরিবারের কাছে। (তথ্যসূত্র : বিবিসি বাংলা; ২৭ জানুয়ারি ২০২১)

অনেকটা একই রকম ঘটনা ঘটে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাবুল মিয়ার জীবনে। ১৯৯২ সালে ডাকাতির অভিযোগে গ্রেফতার হন তিনি। সে সময় তার বয়স চলছিল ১৮ বছর। ২০১৭ সালে যখন তিনি বেকসুর প্রমাণিত হয়ে খালাস পান, তখন তার বয়স গিয়ে পৌঁছেছে ৪৩-এর কোঠায়। জীবনে কৈশোরের একাংশ, তারুণ্য এবং যৌবনের একটা বড়ো অংশই তার কেটে গেছে জেলে। সবচেয়ে বিস্ময়কর তথ্যটি হলো, বাবুল মিয়া যে মামলায় ২৫ বছর কারাভোগ করেছেন, সেই মামলায় দোষী প্রমাণিত হলেও তার সর্বোচ্চ শাস্তি হতো ১০ বছর। কারামুক্তির পর তিনি প্রশ্ন রেখেছিলেন, ‘আমার যৌবনের ২৫ বছর ফিরিয়ে দেবে কে?’ (তথ্যসূত্র : বিবিসি বাংলা; ২৭ জানুয়ারি ২০২১)

কেবল স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে বিনা দোষে ভুল বিচারের শিকার হয়ে কারাভোগের ফিরিস্তি যদি তুলে ধরা হয়, তাহলে সেই তালিকাটি দীর্ঘ হয়ে উঠবে নিঃসন্দেহে। এমন অগণন নুরজালাল, জাহালম, আবেদ আলী কিংবা বাবুল মিয়ারা হারিয়ে ফেলেছেন তাদের জীবনের স্বর্ণ-সময়গুলো। যমুনার পানি পদ্মা-মেঘনা হয়ে পড়েছে বঙ্গোপসাগরে, কত ছোটো ছোটো শিশু-কিশোর তাদের  শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য পেরিয়ে পা দিয়েছে যৌবনে, নুরজালালরা তখনো থেকে গেছে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে! তাদের অভিমানমাখা দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে উঠেছে কারাগারের আকাশ-বাতাস। এই নির্দোষ মানুষগুলোর কাছে কি জবাব দেবে জাতি?

লেখক : কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির