post

শহীদ মালেকের প্রিয় ক্যাম্পাসের বর্তমান পরিস্থিতি

ড. মোহাম্মদ আব্দুর রব

০৫ জুলাই ২০২৩

শহীদ আব্দুল মালেক ইসলামী শিক্ষা আন্দোলনের একজন অগ্রনায়ক ও বীর সেনানী। শহীদ আব্দুল মালেক শুধু কোনো ব্যক্তির নাম নয়, বরং একটি আন্দোলনের নাম। যে নাম ইসলামী আন্দোলনের প্রতিটি কর্মীর হৃদয়ের মণিকোঠায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। যিনি আজ প্রেরণার সুউচ্চ মিনার হয়ে প্রেরণার প্রতীক হয়ে আছেন লাখো যুবকের হৃদয়ে। আজ তিনি পৃথিবীতে নেই, তবে উদ্ভাসিত হয়ে আছেন হাজারো নক্ষত্রের মাঝে। আজও ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার দাবিতে লেখালেখি, টকশো, সভা-সমাবেশ ও সেমিনার হয় কিন্তু শহীদ আব্দুল মালেকের মতো সেই যুক্তিপূর্ণ, প্রাঞ্জল ও হৃদয়গ্রাহী বক্তব্য শোনা যায় না। নাস্তিক্যবাদীদের অসার যুক্তি নাকচ করে ইসলামী শিক্ষার গুরুত্ব ও মহত্ত্ব ঘোষণা দেওয়ার মতো দার্শনিক চিন্তক আজ বিরল। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় নাস্তিক্যবাদী ধর্মহীন শিক্ষার যে সয়লাভ তা তার মতো দার্শনিক ও ইসলামী চিন্তকের অনুপস্থিতির ফল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও সেক্যুলার গোষ্ঠীর উদ্ভব ও প্রতিষ্ঠা লাভ এবং ইসলামবিরোধী পরিবেশ ও মনন তৈরিতে সেক্যুলার-ধর্মহীন শিক্ষাব্যবস্থা অনেকাংশে দায়ী।

শহীদ আব্দুল মালেক শুধু ইসলামী আন্দোলনের অনুকরণীয় একজন আদর্শিক ব্যক্তিত্বই ছিলেন না, তিনি ছিলেন ধ্যানে-জ্ঞানে, চিন্তা-চেতনায় সৃজনশীল দর্শন ও আধুনিক চিন্তার অধিকারী। ধর্মহীন বস্তুবাদী শিক্ষায় আধুনিক উপায়-উপকরণে উৎকর্ষতা লাভ করতে পারে কিন্তু মনের খোরাক, মানসিক শান্তি ও  নৈতিক গুণাবলি সম্পন্ন চারিত্রিক  বৈশিষ্ট্য তৈরির জন্য ইসলামী শিক্ষার মধ্যেই তিনি সমাধান দেখেছেন। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও তিনি বস্তুবাদী শিক্ষাব্যবস্থার অসারতা বুঝতে পেরেছিলেন এবং ইসলামী শিক্ষার মধ্যে নৈতিক, আদর্শ ও উন্নত জাতি গড়ার উপাদান দেখেছিলেন।

১৯৬৯ সালে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার পক্ষে কথা বলতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামবিদ্বেষী সেক্যুলারপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের হামলায় মারাত্মকভাবে আহত হয়ে ১৫ আগস্ট শাহাদাত বরণ করেন ইসলামী শিক্ষা আন্দোলনের অগ্রপথিক শহীদ আব্দুল মালেক। শহীদ আব্দুল মালেক নূর খান শিক্ষানীতির সমর্থন করে একটি সর্বজনীন ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার পক্ষে জনমত তৈরি করেন, শিক্ষানীতি সমর্থন করে বক্তব্য দিতে গিয়ে দেশের ভবিষ্যত নির্ধারণীর ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন। তিনি ছাত্রসমাজকে উপলব্ধি করাতে সক্ষম হয়েছিলেন- শিক্ষাব্যবস্থা হচ্ছে একটি দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে আলোকিত করার প্রধান মাধ্যম, জাতীয় আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের রূপকার, জাতীয় উন্নতি ও অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি, চিন্তা ও দর্শনে বিভাজন দূর করে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রতীক। নাগরিক জীবনের সব ধরনের আর্থসামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের শক্তি হিসেবেও কাজ করে শিক্ষাব্যবস্থা।

মূলত, দেশের মানুষকে ধর্মীয় ও আদর্শবাদী চেতনায় উজ্জীবিত করতে শিক্ষাব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ-জীবনের সর্বক্ষেত্রে শান্তি ও শৃঙ্খলা স্থাপনে শিক্ষাব্যবস্থা জনগণের মধ্যে শক্তি জোগায়। শিক্ষাব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে একটি দেশের জাতীয় সত্তার কাঠামো। শহীদ আব্দুল মালেক সে সময়ে জাতির বৃহত্তর কল্যাণকে সামনে রেখে সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থার অবশ্যম্ভাবী পরিণতিকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন- সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ কিংবা আধুনিকতা দ্বারা প্ররোচিত হয়ে নৈতিকতাহীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তিত হলে সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের সাথে সাথে স্বকীয় ভাষা-সংস্কৃতিরও নির্বাসন হবে।

শিক্ষা হচ্ছে মানুষ গড়ার মাধ্যম কিন্তু সে শিক্ষায় ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা না থাকলে তা মানুষের বদলে পশুর জন্ম দেয়। আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে একটি দেশের গোটা জাতীয় সত্তার কাঠামো। কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামী আদর্শ, দর্শন ও চিন্তার উপস্থিতি না থাকায় আমাদের জাতীয় জীবনে সৃষ্টি হয়েছে বিরাট আদর্শিক শূন্যতা, নৈতিক দুর্বলতা, ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব, আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অদক্ষ জনশক্তি। আগামী প্রজন্মের মধ্যে সততা ও যোগ্যতার তীব্র অভাব দেখা দিয়েছে। নাগরিক জীবনে হতাশা, জাতীয় উন্নতিতে স্থবিরতা, দুর্নীতি, জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে অশান্তি, বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতা ইত্যাদি নানা সঙ্কট তৈরি হয়েছে। সমাজ ও দেশের এসব বাস্তবতা উপলব্ধি করে এবং ভবিষ্যতে এর সুদূরপ্রসারী আরো নেতিবাচক প্রভাবের কথা চিন্তা করে দেশের সামগ্রিক স্বার্থে সেদিন শহীদ আব্দুল মালেক ইসলামী শিক্ষার পক্ষে তাঁর যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন।

দেহ, মন ও আত্মার সমন্বিত ভারসাম্যপূর্ণ উন্নতির নামকে তিনি শিক্ষা হিসেবে অভিহিত করেছেন। এ তিনের উৎকর্ষ সাধনের জন্য যে শিক্ষা, সে শিক্ষাই হচ্ছে প্রকৃত শিক্ষা। শরীর, মন ও আত্মার সমন্বিত অগ্রগতি কোনো ধর্মীয় আদর্শ ছাড়া উজ্জীবিত হতে পারে না। ইসলামের দৃষ্টিতে চিরন্তন-শাশ্বত নৈতিক মূল্যমানের ভিত্তিতে সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দ নির্ধারণের ক্ষমতা অর্জন, পরিবেশ মোকাবেলার জন্য বৈজ্ঞানিক কলাকৌশল ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনের সমন্বিত ব্যবস্থাপনার নামই শিক্ষা। কেননা, ইসলামী শিক্ষার ভিত্তি হলো তাওহিদ, রিসালাত ও আখেরাত। যা একদল উচ্চ নৈতিকতা সম্পন্ন সৎ, যোগ্য, নির্লোভ, ও দেশপ্রেমিক মানুষ তৈরি করে। মানুষের ধর্মীয় ও  বৈষয়িক জীবনকে আল্লাহর রঙে রঙিন করে, মানুষকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর অনুগত বানিয়ে থাকে। ফলে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে তথাকথিত সেক্যুলার ও তাগুতি শক্তির বিরুদ্ধে মানুষের যুদ্ধ চলে। কেননা তাগুতি শক্তি কখনো জমিনে ইসলামের বিজয় পছন্দ করে না, তাই তারা সবসময় সমাজে ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় দিয়ে, প্রসার ঘটিয়ে ইসলামী তাহজিব ও তমদ্দুনকে দুর্বল করে সমাজ থেকে ইসলামকে উৎখাত করতে চায়। এমতাবস্থায় ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি যাবতীয় শয়তানি ও তাগুতি শক্তির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সর্বদা পৃথিবীকে আল্লাহর নির্দেশমতো সুন্দরভাবে আবাদ করতে চায়। ফলে পৃথিবীর জীবনপদ্ধতি অনেক সুন্দর ও স্বাচ্ছন্দ্যময় হয়। শহীদ আব্দুল মালেক ছিলেন সেই সত্য-সুন্দরের সারথি।

বর্তমান বাংলাদেশের সঙ্কটাপন্ন পরিস্থিতির কার্যকর সমাধান খুঁজতে গেলে আমরা দেখি রাষ্ট্র ও জাতিকে গড়ে তোলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রশ্নের জবাব না দিয়েই যেনতেনভাবে দেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার প্রয়াস চালানো হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হচ্ছে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা কোন নীতির ভিত্তিতে প্রণয়ন করা হবে? কী রকম শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম গড়ে উঠবে? আজ থেকে ৪৫ বছর আগে আব্দুল মালেক নিজের জীবন দিয়ে এ প্রশ্নটিকে যেমন শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে গেছেন, তেমনি ধর্মহীন শিক্ষাব্যবস্থার অসারতা তুলে ধরে শিক্ষানীতি হিসেবে ইসলামী আদর্শ অনুসরণের দাবি সংবলিত অখণ্ড যুক্তিও তিনি উপস্থাপন করে গেছেন।

‘ইসলামাইজেশন অব নলেজ’ পরিভাষাটি এখন বিশ্বব্যাপী একটি আলোচিত বিষয়। অধুনাকালের এ পরিভাষাটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যিনি প্রথম যুক্তিসহ উপস্থাপন করেছিলেন- সে দার্শনিকের নাম আব্দুল মালেক। তিনি উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, শুধুমাত্র মুখে মুখে ইসলামী রাষ্ট্র কিংবা সমাজব্যবস্থা কায়েমের স্লোগান দিলেই ইসলামী আদর্শের প্রতিষ্ঠা করা যায় না। ইসলামী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য ইসলামের আদর্শিক চেতনাসম্পন্ন সৎ, দক্ষ ও যোগ্য নেতৃত্ব প্রয়োজন। সৎ, যোগ্য নেতৃত্ব আপনা আপনি তৈরি হবে না কিংবা আসমান থেকে আসবে না। মাটির পৃথিবীতেই যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি করতে হবে। আর এর জন্য ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আব্দুল মালেক সে সময়ে জাতির বৃহত্তর কল্যাণকে সামনে রেখে secular শিক্ষাব্যবস্থার অবশ্যম্ভাবী পরিণতির কথা উপলব্ধি করেছিলেন। একজন মেধাবী শিক্ষার্থী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ভোগবাদ, সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ কিংবা আধুনিকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা দ্বারা প্ররোচিত হয়ে One set of cultural values সম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তিত হলে পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের সাথে সাথে বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির নির্বাসন হবে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তা তাদের স্বকীয়তা হারাবে। শক্তিশালী ভাষা ও সংস্কৃতি দুর্বল ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তার করবে। তাঁর মতে, শিক্ষাব্যবস্থাকে দ্বীন ও দুনিয়ার প্রয়োজন পূর্ণ করার যোগ্য হতে হবে। দ্বীন ও দুনিয়া কথাটি দ্বারা সাধারণত ধর্মীয় ও পার্থিব বলে দু’টি পৃথক দিক মনে করা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইসলামের দৃষ্টিতে দ্বীন ও দুনিয়া দু’টি সামঞ্জস্যহীন পৃথক সত্তা নয়। ইসলামকে বলা হয়ে থাকে পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ইসলামে ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সকল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বিধান রয়েছে। অন্যান্য ধর্মে যেহেতু জীবনের সকল দিক ও বিভাগের উপযোগী পূর্ণাঙ্গ বিধান নেই, সেহেতু সে সব ধর্মের অনুসারীদের ধর্মীয় শিক্ষার সাথে তাদের পার্থিব শিক্ষার যোগাযোগ নেই। তারা পার্থিব প্রয়োজন পূরণ করার জন্য যে শিক্ষার ব্যবস্থা কওে, তা সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ ও ধর্মের প্রভাবমুক্ত। তারা ধর্মকে ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে বিশ্বাস করে এবং ব্যক্তিগতভাবে ধর্মীয় প্রয়োজন পূরণ করার উদ্দেশ্যে তারা ওই ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার সাথে ধর্মীয় শিক্ষার পরিশিষ্ট জুড়ে দেয়। কিন্তু ইসলামে সে সুযোগ নেই। একজন মুসলিমের জীবনের সকল স্তরে ইসলামের বিধান অনুযায়ী চলতে হয়, তাই তার শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় এবং পার্থিব দুই বিভাগেরই সমন্বয় থাকতে হবে। সেক্যুলার ও তাগুতি শক্তি সেদিন তাঁর এই যুক্তির উত্তর দিতে পারেনি, তাই তারা জিঘাংসার আশ্রয় নেয় এবং একজন উদীয়মান ইসলামী দার্শনিক, চিন্তক ও সংগঠককে শহীদ করে দেয়।

বাংলাদেশের শিক্ষা-আন্দোলনের ইতিহাসে শহীদ আব্দুল মালেক একাই একটি চিরভাস্বর অধ্যায় এবং এক আলোর মশাল, এক অনাগত বিপ্লবের অগ্রিম সুসংবাদ। তাঁর শাহাদাতের মধ্য দিয়ে নতুন মাত্রা যুক্ত হলো এদেশের ইসলামী শিক্ষা আন্দোলনে। যুগ যুগ ধরে এদেশের অগণিত ছাত্র-জনতা ও আগামী প্রজন্ম শহীদ আব্দুল মালেকের চিন্তা, দর্শন ও আদর্শকে লালন করে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করবে। শহীদ আব্দুল মালেকের চিন্তা, দর্শন ও আদর্শকে ছাত্রসমাজের কাছে তুলে ধরা এবং তাঁর আত্মত্যাগ থেকে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের অনুপ্রাণিত করার জন্য ছাত্রসমাজ তাঁর শাহাদাতের দিনটিকে ‘ইসলামী শিক্ষা দিবস’ হিসেবে প্রতি বছর পালন করা আসছে।

শহীদ আব্দুল মালেক বাংলার জমিনে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর প্রিয় প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী ও বস্তুবাদী শিক্ষার সমন্বয়ে একটি আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার স্বপ্ন বুনেছিলেন। তিনি স্বপ্ন বুনেছিলেন- দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হবে উচ্চতর ইসলামী শিক্ষার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। এখান থেকে জন্ম নেবে ইমাম ইবনে তাইমিয়া, ইমাম গাজালি, ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ, জাবির ইবনে হাইয়ান, আল কিন্দি, মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল খারেজমি, আল বেরুনি, আল ফারাবি, ওমর খৈয়াম, ইবনে খালদুন, আল ইদ্রিসীর মতো বিশ্ববরেণ্য জ্যোতির্বিদ, দার্শনিক, চিকিৎসক, পদার্থবিদ, গণিতবিদ, রসায়নবিদ, ভূগোলবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, ইতিহাসবিদ। তবে দার্শনিক শহীদ আব্দুল মালেক বুঝতেন এ মিশন নিয়ে কাজ করলে কেউ পথ করে দেয় না, বরং বাধা-প্রতিবন্ধকতাগুলো মাড়িয়ে নিজেদেরকেই পথ করে নিতে হয়। তাই তো তিনি লিখেছেন- “সব বাধাকে তুচ্ছ করে গাঢ় তমসার বুক চিরে যেদিন আমরা পথ করে নিতে পারবো, সেদিন আমরা পৌঁছাবো এ দুর্গম পথের শেষ মঞ্জিলে।” এর পাশাপাশি তিনি আল্লাহর দ্বীন বিজয়ের কাজে সফলতার জন্য তরুণ-যুবকদের পরিশুদ্ধ চরিত্রের দিকেও গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “যেদিন আমাদের চরিত্র হবে হজরত ইউসুফের মতো সেই দিনই, কেবল সেই দিনই আসবে সাফল্য।” আজকে তরুণ-যুবকদের বড় একটি অংশ হারাম রিলেশনশিপ তথা অবৈধ সম্পর্ক মেইনটেইন করাকে স্মার্টনেস মনে করে। মনে করে প্রগতিশীল হবার উপায়। এসব ভুল কাজের পেছনে তারা নিজেদের সবটুকু এমনভাবে উজাড় করে দিচ্ছে যে, কেবল ঢাকার স্কুলগুলোতেই ৮০% শিক্ষার্থী শারীরিক সম্পর্কে জড়িত। এমন একটা চিত্র দেখলে বা শুনলে সচেতন-বিবেকবান কোন্ ব্যক্তির শরীর কাঁপুনি দিয়ে ওঠবে না?

যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে শহীদ আব্দুল মালেক ভাই ভেবেছেন- তা হবে উচ্চতর ইসলামী শিক্ষার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র; কিন্তু আজকে শহীদের সে প্রিয় ক্যাম্পাস বর্তমানে ইসলামবিরোধী সেক্যুলার গোষ্ঠীর আখড়ায় পরিণত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামকে মুছে দেওয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে জনবিচ্ছিন্ন তথাকথিত প্রগতিশীল সেক্যুলার ও নাস্তিক্যবাদী গোষ্ঠী। ইসলাম-ধর্মীয় পোশাক ও মূল্যবোধের কারণে ছাত্র-ছাত্রীরা এখনো ঢাবিতে হেনস্তার শিকার হচ্ছে, যার সর্বশেষ নজির আমরা দেখতে পাই রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মামুন আল মোস্তফাসহ কতিপয় শিক্ষক কর্তৃক বোরকা ও নিকাব পরিধান করার কারণে ছাত্রীদের ভাইভা বোর্ডে অপমান-অপদস্থ করে বের করে দেওয়ার ঘটনার মধ্যে। নামাজ পড়া, দাড়ি রাখা ও কুরআন মাজিদ রাখার অপরাধে আবাসিক হলগুলো থেকে ধর্মপ্রাণ ছাত্র-ছাত্রীদের নির্যাতন করে বের করে দেওয়া হয়। কখনো কখনো ছাত্রশিবিরের তকমা দিয়ে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া হয়। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ হওয়া সত্ত্বেও ঢাবিতে দু’য়েকটি বিভাগ ছাড়া অন্য বিভাগগুলোতে ধর্মীয় শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। দীর্ঘ কয়েক বছর মাদরাসার শিক্ষার্থীদের বাংলা, ইংরেজি, অর্থনীতি, সাংবাদিকতা, আন্তর্জাতিক সম্পর্কসহ বেশ কয়েকটি বিভাগে ভর্তির ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধ জারি করে রাখে। বর্তমানে সে বিধি-নিষেধ আর না থাকলেও ঢাবি প্রশাসন যে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে মাদরাসার শিক্ষার্থীদের প্রতি বৈষম্য করেছে তা অনুমেয়। এছাড়া সরকারদলীয় ক্যাডার বাহিনী ছাত্রলীগ কর্তৃক সাধারণ শিক্ষার্থীদের মারধর, হলে সিট বাণিজ্য, হিংসা-জিঘাংসা, মাদক কারবার ও চাঁদাবাজি তো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।

 এত প্রতিকূল পরিবেশ সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামপ্রিয় শিক্ষার্থীদের পরিমাণ দিনদিন বাড়ছে। মাদরাসার শিক্ষার্থীরা অধিক সংখ্যায় ঢাবিতে উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হচ্ছে। আগের থেকে দাড়ি-পাঞ্জাবি, হিজাব ও নিকাব পরিধান করা শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বাড়ছে। ইসলামী অনুশাসন মেনে চলার প্রবণতা বর্তমান শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি, আলহামদুল্লিাহ। শহীদ আব্দুল মালেক যে স্বপ্নের বীজ বুনেছিলেন তাঁর প্রিয় ক্যাম্পাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে; সকল বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও তাঁর সেই স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করে এর ফসল তোলার জন্য ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা নিরন্তর কর্মপ্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা আজ ঈমানের অনিবার্য দাবি। এ দেশের ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শহীদ আব্দুল মালেক একটি প্রেরণার বাতিঘর, যেখান থেকে আলোকিত হচ্ছে অগণিত ইসলামপ্রিয় জনতা। শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তাঁর চিন্তা-দর্শন আগামী প্রজন্মের জন্য দিকনির্দেশনা হয়ে থাকবে, ইনশাআল্লাহ।

লেখক: বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, প্রফেসর (অব:),

ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির