post

অ্যালকোহল নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা

শাহরিয়ার ফয়সাল

১২ এপ্রিল ২০২২

সম্প্রতি সরকার অ্যালকোহল নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২২ প্রণয়ন করেছে যা চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি মাসে গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে। এর পূর্বে ১৪ নভেম্বর ২০১৮ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। প্রত্যেকটি আইনের মূল উদ্দেশ্য হিসেবে সরকার যে বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছে তা হলো মাদকদ্রব্যের অবাধ ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং শাস্তির বিধান করা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এ আইনটি প্রণয়নের ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশের অধিক মুসলিম অধ্যুষিত দেশে ইসলাম এবং মুসলিম সেন্টিমেন্টের কোনো বিষয়ই বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। বরং এই বিধিমালা অধ্যয়ন করে এটি আরো পরিষ্কার হয় যে এ আইন আগামীর প্রজন্ম এবং দেশকে নিশ্চিত এক বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে ফেলে দিবে। কুরআন এবং সুন্নাহের আলোকে নতুন প্রণীত এ নীতিমালার একটি তাত্ত্বিক পর্যালোচনা এ লেখায় তুলে ধরা হলো।

ইসলামের দৃষ্টিতে মাদক

মাদকদ্রব্যের আরবি প্রতিশব্দ ‘খমর’। এর অর্থ- সমাচ্ছন্ন করা, ঢেকে দেয়া। যে বস্তু ব্যবহারে নেশার উদ্রেক হয়, মানুষের মস্তিষ্ক বিকল হয়, স্বাভাবিক জ্ঞান হারিয়ে যায় তাকেই মাদক বলা হয়। মানবতা সুরক্ষার জন্য ইসলামে মাদক সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ, অপবিত্র ও হারাম।

মাদক হলো এমন একটি দ্রব্য, যা ব্যবহার করলে শারীরিক ও মানসিক উত্তেজনা তৈরি হয়। ফলে স্বাভাবিক চিন্তা বাধাগ্রস্ত হয় এবং শরীরে অবসাদের সৃষ্টি করে। 

মনোবিজ্ঞানীদের ভাষ্যমতে, মাদক সেবনের ফলে শরীর, মন ও মস্তিষ্কে অনাকাক্সিক্ষত পরিবর্তন ঘটে। মাদকদ্রব্য একবার সেবন করলে আবারো সেবনের কৌতূহল জাগে এবং মাদকসেবক নিয়মিত তা গ্রহণ করে। এভাবেই এক পর্যায়ে তা নেশায় পরিণত হয় এবং মাদক সেবনকারী নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। আর একবার নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়লে মাদক গ্রহণকারী ব্যক্তির মধ্যে কিছু পরিবর্তন দেখা যায়, যা স্বাভাবিক নয়।

কুরআন-হাদিস ও ফিকহের দৃষ্টিতে মাদক গ্রহণ ও তার কুফল

মাদক এমন একটি পদার্থ, যা একটি মানুষের বিবেক-বুদ্ধি ও দৈহিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি সাধন করে, ক্ষতি সাধন করে তার দ্বীন ও দুনিয়ার। মদ মানুষকে আল্লাহর স্মরণ তথা নামাজ কালাম থেকে বিমুখ করে তার চরিত্র ও নৈতিকতা ধ্বংস করে দেয় এবং তাকে নিয়ে যায় পাপাচারের দিকে।

মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে মদকে হারাম ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ বলেন- ‘তারা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বল, এ দুটোয় রয়েছে বড় পাপ ও মানুষের জন্য উপকার। আর এর পাপ তার উপকারিতার চেয়ে অধিক বড়।’ (সূরা বাকারা : ২১৯)

‘হে ঈমানদারগণ! মদ, জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্য-নির্ধারক শরসমূহ এ সমস্তই শয়তানের কার্যকলাপ। অতএব এগুলো থেকে বেঁচে থাক, যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হও। শয়তান তো চায়, মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের পরস্পরের মাঝে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চারিত করে দিতে এবং আল্লাহর স্মরণ ও সালাত থেকে তোমাদেরকে বিরত রাখতে। অতএব তোমরা কি এসব থেকে বিরত থাকবে?’ (সূরা মায়েদাহ : ৯০-৯১)

রাসূলে করিম সা. ইরশাদ করেছেন : ‘তোমরা মদপান থেকে বেঁচে থাকো। কারণ এটি যাবতীয় অপকর্মের চাবি।’ (মুস্তাদরাকে হাকেম খণ্ড ৪, পৃ. ১৪৫; মুনজিরি হাদিস ৩৪৮৭, পৃ. ৪৫৫)। 

কুরআন কারিমে বর্ণিত হারুত ও মারুত এই মাদকের নেশায় মাতাল হয়েই জোহরার ইশারায় হত্যা, ব্যভিচারসহ নানান অপরাধে লিপ্ত হয়েছিল (সূরা বাকারা : ১০২; তাফসিরে আজিজি ও তাফসিরে মাআরিফুল কুরআন)।

হজরত আয়েশা রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘যে সকল পানীয় নেশা সৃষ্টি করে, তা হারাম।’ (বুখারি, প্রথম খণ্ড-২৪১)।  

রাসূল সা. ১০ ব্যক্তির প্রতি অভিসম্পাত করেছেন যারা মদের সাথে সম্পর্ক রাখে। আর তারা হচ্ছে- ১. যে লোক মদের নির্যাস বের করে; ২. মদ প্রস্তুত করে; ৩. মদ পান করে; ৪. যে মদ পান করায়; ৫. মদের আমদানি করে; ৬. যার জন্য আমদানি করা হয়; ৭. মদের ক্রেতা; ৮. মদের বিক্রেতা, ৯. মদের সরবরাহকারী ও ১০. মদের লভ্যাংশ ভোগকারী। (তিরমিজি, মিশকাত-২৭৭)

রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মদপান, তা ক্রয়-বিক্রয় ও এর বিনিময় হারাম করেছেন।’ (মুসনাদে আবি হানিফা)

মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ তোমরা যখন নেশাগ্রস্ত থাক, তখন নামাজের ধারে কাছেও যেও না, যতক্ষণ না বুঝতে পারো তোমরা যা বলছো তা।’ (সূরা নিসা : ৪৩)

সুতরাং কুরআন এবং হাদিসের আলোকে এ কথা পরিষ্কার যে, মদ্যপান ইসলামে সম্পূর্ণ হারাম। কিয়ামত পর্যন্ত এটিকে হালাল করা কোনো মুসলমানের জন্য জায়েজ নেই। আর যারা আইন দিয়ে এটিকে বৈধ করবে তারা মহান আল্লাহর আইনের বিরুদ্ধে যেন যুদ্ধ ঘোষণা করল।

মাদক গ্রহণকারী ব্যক্তি সমাজ পচনের কারিগর

মাদকাসক্ত যে নিজেই মাদকের ক্ষতিগ্রস্ততার শিকার হয় বিষয়টি এমন নয়, মাদকসেবীর সাথে সাথে পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী, স্বাস্থ্যকর্মী তথা সামগ্রিক সমাজব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। জৈবিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, শারীরবৃত্তীয় ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত ইস্যুতে মাদকের অপব্যবহার সমাজের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। সামাজিকভাবে একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি সকলের কাছে নিকৃষ্ট মানের হয়ে থাকে। এই মরণনেশা মাদকের কবলে কেবল তরুণরা নয় তরুণীদেরও মাদকাসক্তি গ্রাস করে ফেলেছে। যার ফলে বর্তমান সময়ে যুবকের মাদকাসক্তির কারণে সমাজে বিভিন্ন অপরাধ চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, নির্যাতন, পারিবারিক অশান্তি ও খুন খারাবিও ঘটে চলেছে। যে ঘরে কোনো সন্তান মাদক নেয়, সেই ঘরে শুধু সেই সন্তানই আক্রান্ত হয় না; পুরো পরিবার আক্রান্ত হয়। শান্তি বিনষ্ট হয়। আত্মীয়-স্বজনও আক্রান্ত হয়। বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুসারে দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা প্রায় ২ কোটি এর মধ্যে দেড় কোটি নিয়মিত। দেশে গড়ে প্রতিদিন অন্তত ২০ কোটি টাকার মাদক সেবন করে। তাছাড়া সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ফলে বাংলাদেশে বর্তমানে মেয়েদের মাদক গ্রহণের পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি পাচ্ছে যা পারিবারিক স্বাভাবিক সম্পর্ক বিনষ্ট করছে এবং ডিভোর্স ও সিঙ্গেল মাদার কনসেপ্ট বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

জার্মানির সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট ফর মেন্টাল হেল্থ-এর ফাল্ক কিফার বলেন, অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে মাদকসেবী প্রতিবন্ধী ও অসুস্থ হয়ে জীবনের মূল্যবান বছরগুলো হারিয়ে ফেলে। লিভার সিরোসিস থেকে শুরু করে কর্মক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেন অনেকে।

ডব্লিউএইচওর রিপোর্ট বলছে, ২০১২ সালে বিশ্বব্যাপী মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে ৩.৩ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। এছাড়া ২০০টি নানা ধরনের অসুখ-বিসুখ হতে পারে অতিরিক্ত অ্যালকোহলের কারণে।

বাংলাদেশে মাদকসেবনের ক্ষতিকর প্রভাবসমূহ

ভৌগোলিক দিক থেকে বাংলাদেশে মাদকের প্রবেশ খুবই সহজলভ্য। আন্তর্জাতিক মাদক উৎপাদনকৃত এলাকা গোল্ডেন ক্রিসেন্ট (পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরাক) বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। পাশাপাশি গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল (মিয়ানমার, লাউস, এবং থাইল্যান্ড) বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থান করায় বাংলাদেশ সবসময়ই মাদকের ঝুঁকির মধ্যে অবস্থান করে থাকে।

বিগত দিনে দেশের জাতীয় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, আন্তর্জাতিক ও বেসরকারি সংস্থাসমূহের রিপোর্টের আলোকে বাংলাদেশে মাদকের ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে।

বাংলাদেশের মাদক পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে দেশে ৬৮ লাখ মানুষ মাকদাসক্ত। এদের মধ্যে ৮৪ ভাগ পুরুষ, ১৬ ভাগ নারী। দেশজুড়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ নানাভাবে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মতে দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৪৭ লাখ। যার মধ্যে ৯০ শতাংশ কিশোর-তরুণ হিসেবে পরিচিত। (দৈনিক প্রথম আলো, ২১ শে মে/২০১৬)

গত পাঁচ বছরে মাদক উদ্ধারের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৯-২০ সাল পর্যন্ত ইয়াবা, হেরোইন, কোকেন, আফিম, গাঁজা, ফেনসিডিল, বিদেশি মদ, বিয়ার ও ইনজেকটিং ড্রাগের ব্যবহার ক্রমশই বেড়েছে। এ ১২ বছরে শুধু এই নয়টি মাদক যে পরিমাণে উদ্ধার হয়েছে প্রচলিত দাম অনুযায়ী টাকার অঙ্কে তার পরিমাণ দাঁড়ায় আনুমানিক ১৪ হাজার ৩১৩ কোটি ৭৯ লাখ ৬২ হাজার ১৩০ টাকা।

দ্য ফিন্যানসিয়াল এক্সপ্রেসে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় ৭.৫ মিলিয়ন মানুষ মাদকাসক্ত। মোট মাদকাসক্তদের ৪৮ শতাংশ শিক্ষিত এবং ৪০ শতাংশ অশিক্ষিত। মাদকাসক্তদের প্রায় ৫৭ শতাংশ যৌন অপরাধী, যাদের ৭ শতাংশ হলো এইচআইভি ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত। সারা দেশে প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার মাদক ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা পরিচালনা করছে, যাদের মধ্যে ২৭ হাজার ৩০০ জন মহিলা। ২০১৯ সালে গড়ে প্রতিদিন ১১৪ জন রোগী সরকারি ও বেসরকারি পুনর্বাসন কেন্দ্রে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ১০৪ এবং ২০১৭ সালে ৬৯। আরো অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে ২০১৯ সালে মহিলা মাদকসেবীদের সংখ্যা চারগুণ বেড়েছে। (১৩ জানুয়ারি, ২০২০-এ দ্য ফিন্যানসিয়াল এক্সপ্রেস)

২০১৩ সালের ১৬ আগস্টে ১৪ বছর বয়সী ঐশীর হাতে তার পিতা পুলিশ অফিসার মাহফুজুর রহমান এবং মাতা স্বপ্না রহমানের নির্মম ও রোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এ হত্যাকাণ্ডের পর দেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল ঐশী ৮ বছর বয়স থেকেই অ্যালকোহল এবং মাদকের সাথে জড়িত ছিল। 

সম্প্রতি আলোচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজুরের মৃত্যু তদন্ত করতে গিয়ে পাওয়া যায় এলএসডি মাদক। পুলিশের তথ্য মতে, হাফিজ তার বন্ধুদের প্ররোচনায় এই ভয়ঙ্কর মাদক গ্রহণ করে এবং নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। অথচ অভিযুক্ত সকলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। 

২০১০ সালের ২২ নভেম্বর কুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের ছাত্র তৎকালীন কুয়েট ছাত্রলীগ সভাপতি আহসানুল্লাহ ভূইয়া মেহেদী কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারায় এক বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে অতিরিক্ত মদ্যপানে মারা যায় তার সাথে আরো ২ জন মৃত্যুবরণ করে।  

চলতি বছরের ৩রা জানুয়ারি রুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র মাসরুর মুহিত অতিরিক্ত মদ্যপানে মৃত্যুবরণ করেন। 

এমন হাজারো ঘটনা নিয়মিত ঘটে চলছে আমার এই সোনার বাংলাদেশে। যার প্রতিকারের বিষয়ে চিন্তা করাটা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব ছিল। কিন্তু সরকার মদ্য পানকে আরো বৈধতা প্রদানের জন্য একটি বিস্তারিত নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। যা জাতি ধ্বংসের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ছাড়া আর কিছুই নয়। 


অ্যালকোহল নিয়ন্ত্রণ বিধিমালার সারাংশ

সম্প্রতি সরকার অবাধে অ্যালকোহল গ্রহণকে নিয়ন্ত্রণের নামে অ্যালকোহল নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২০২২ প্রণয়ন করেছে। উক্ত নীতিমালায় বর্ণিত সকল বিষয় ইসলামের সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। উক্ত প্রণীত নীতিমালায় যা রয়েছে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে তুলে ধরা হলো- 

অ্যালকোহল নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০২২ অনুযায়ী লাইসেন্স, পারমিট ও পাস নিতে পারলেই অ্যালকোহল আমদানি-রফতানি, উৎপাদন-প্রক্রিয়াজাতকরণ, সরবরাহ, বিপণন ও ক্রয়-বিক্রয় এবং সংরক্ষণ ও পান করা বৈধ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। (অত্র বিধিমালার দ্বিতীয় অধ্যায়ের ধারা নং ০৩)

কোনো এলাকায় যদি কমপক্ষে ১০০ জন মদের পারমিটধারী থাকে তবে ওই এলাকায় মদ বিক্রির লাইসেন্স দেওয়া যাবে। আর ২০০ জন পারমিটধারী হলে দেওয়া হবে বার প্রতিষ্ঠার লাইসেন্স। এই আইনে বলা হয়েছে যে, কেউ ২১ বছর বয়স প্রাপ্ত হলেই মদ্য পানের জন্য লাইসেন্স করতে পারবে। (অত্র বিধিমালার দ্বিতীয় অধ্যায়ের ধারা নং ০৮ ও ০৯ )

এছাড়া খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে স্যাক্রামেন্টাল ওয়াইন (আঙ্গুরের নির্যাস থেকে তৈরি এক ধরনের মদ) ব্যবহারের জন্য বিশেষ পারমিট দেওয়া যাবে। (অত্র বিধিমালার দ্বিতীয় অধ্যায়ের ধারা নং ০৮, ০৯ ও ১৫)

বিধিমালায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য চোলাই মদের মহালের সংখ্যা ও অবস্থান নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। মদপানের অনুমতি পাবেন চা বাগানের শ্রমিকরাও। 

দেশী মদপানের অনুমোদন ফি নির্ধারণ করা হয়েছে মাত্র ১৫০ টাকা। বিদেশি মদপানের অনুমোদন ফি তিন হাজার টাকা। বিধিমালায় ‘অন শপ’-এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যে স্থান থেকে বিদেশী নাগরিক বা পারমিটধারী দেশীয় নাগরিক বিলাতি মদ বা বিদেশি মদ বা অ্যালকোহল জাতীয় পানীয় কিনে ওই স্থানে বসে পান করতে পারবেন। (অত্র বিধিমালার তফসিল ১-এর টেবিল নং ১)

অনুমোদন নিয়ে রেল, সড়ক, নৌ ও আকাশপথের যে কোনো একটি বা একাধিক পথে অ্যালকোহল বহন বা পরিবহন করা যাবে। বিধি অনুযায়ী অ্যালকোহলের প্রতিটি বোতল, মোড়ক বা পাত্রের গায়ে ‘মদ্যপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’ এবং ‘আইনের বিধান ব্যতীত মদ্যপান দণ্ডনীয় অপরাধ’ লালকালিতে লেখা থাকবে। এছাড়াও এ বিধিমালার আলোকে লাইসেন্স নিয়ে যে কোন দোকানে অ্যালকোহল ব্যবহারের জন্য অনুমোদন পাবে। বিনোদনমূলক স্থানে ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার স্থানেও অনুমতি নিয়ে মদ্যপান করতে পারবে। (অত্র বিধিমালার দ্বিতীয় অধ্যায়ের ধারা নং ০৬ ও ০৭)

অ্যালকোহল নিয়ন্ত্রণ নীতিমালার আলোকে দেশী বা বিদেশী মদের উৎপাদন, বিক্রয় এবং লাইসেন্স গ্রহণের ফি নিম্নরূপ-

১. দেশী বা বিদেশী মদের উৎপাদন লাইসেন্স গ্রহণ ৫ লক্ষ টাকা

২. বিদেশী মদ আমদানির জন্য ১ লক্ষ টাকা

৩. বিলাতি মদের রফতানির জন্য ১০ হাজার টাকা

৪. মদ খুচরা বিক্রয়ের জন্য লাইসেন্স ফি-

      ক) মহানগর এলাকায় (অফ শপে) ১ লক্ষ টাকা

      খ) পৌর এলাকায় (অফ শপে) ৫০ হাজার টাকা

      গ) অন্যান্য এলাকায় (অফ শপে) ৪০ হাজার টাকা

৫. বিনোদন কেন্দ্র, বিমানবন্দর, হোটেল, রেস্তোরাঁসহ যে সকল স্থানে মদ খুচরা বিক্রি করা যাবে তার লাইসেন্স ফি-

ক) মহানগর এলাকায় (অফ শপে) ১ লক্ষ টাকা

খ) পৌর এলাকায় (অফ শপে) ১ লক্ষ টাকা

গ) অন্যান্য এলাকায় (অফ শপে) ৫০ হাজার টাকা


অ্যালকোহল নীতিমালার অসঙ্গতি

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মদকে স্পষ্টভাবে হারাম ঘোষণা করেছেন। বর্তমান অ্যালকোহল নীতিমালার মাধ্যমে সুস্পষ্ট হারাম একটা জিনিসকে হালাল তথা বৈধতা প্রদানের চেষ্টা করা হয়েছে। তবে বর্তমান আইন প্রণেতাদের দাবি এই আইনের মাধ্যমে নাকি মাদক ব্যবহারের প্রসারতা অনেক কমে আসবে।

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এ দেশে পবিত্র কুরআনের সুস্পষ্ট বিধানকে লঙ্ঘন করে মদ্য পানের একটি বৈধ পন্থা সরকার করে দিলো।

মাদক নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮ তে মদের ব্যবসার লাইসেন্স গ্রহণের ব্যাপারে কী কী প্রয়োজন তা উল্লেখ করা হয়নি যা এ নীতিমালাতে পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে। ফলে এখন মদের লাইসেন্স প্রাপ্তি এবং এ ব্যাপারে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও অনেক বৃদ্ধি পাবে।

এ নীতিমালায় মদের লাইসেন্স প্রাপ্তি এবং বিক্রয় অত্যধিক সহজ করে দেয়া হয়েছে। ফলে খুব অল্প খরচেই যে কোনো স্থানে যে কেউ মদ্য পানের সুযোগ পেয়ে যাবে। ২১ বছরের ঊর্ধ্বে যে কোনো যুবক যুবতী লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারবে। আর এ ক্ষেত্রে শুধু সহকারী অধ্যাপক ক্যাটাগরির একজন ডাক্তারের সুপারিশ হলেই মদ্যপানের লাইসেন্স পেয়ে যাবে।

দেশী বা বিদেশী মদের উৎপাদনকে অত্যধিক সহজ করা হয়েছে। যে কোনো রেস্তোরাঁ বা হোটেল মালিকগণ মাত্র ৫ লক্ষ টাকা খরচ করলেই পেয়ে যাবে উৎপাদনের অনুমোদন।

এ নীতিমালার আলোকে যে কোন স্থানেই যত্রতত্র মদের দোকান খুলে বসতে পারবে বা মদের সংগ্রহ প্রকাশ্যেই রাখতে পারবে।

মদ্যপান করে কোনো ফৌজদারি অপরাধ সংঘটিত হলে তার শাস্তির ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপের কথা উল্লেখ নাই উক্ত নীতিমালায়।


অ্যালকোহল নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২০২২ এর ভয়াবহ দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব

১. অ্যালকোহল নীতিমালা অত্যন্ত সহজলভ্য হওয়ার কারণে তরুণদের একটি বড় অংশ এর প্রতি ঝুঁকে যাবে। যা দেশের সামগ্রিক পরিবেশের ক্ষেত্রে ভয়াবহ বার্তা দেয়।

২. মাদকাসক্তি মানুষের মস্তিষ্ককে বিকৃত করে দেয় ফলে সামাজিক বন্ধন অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। ইউরোপের ২৬টি দেশের উপর চালানো একটি জরিপে দেখা গিয়ে সেখানে ৪২ শতাংশ সন্তান তাদের পিতা মাতার বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের মাধ্যমে জন্মগ্রহণ করে। অর্থাৎ তারা তাদের মায়ের পরিচয়ে বড় হয়। এ নীতিমালা আমাদের মুসলিম সাংস্কৃতিকে সমূলে ধ্বংস করার এক নীলনকশা। 

৩. খারাপ জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ সহজাত। যুবকেরা তাদের যৌবনের উন্মাদনায় আর অসৎ সঙ্গে মিশে সহজ লভ্য হয়ে যাওয়া এ মদ পান করাটা খুবই স্বাভাবিক। যা তাদের আল্লাহমুখিতা এবং ধর্মীয় চেতনা থেকে অনেক দূরে নিয়ে যাবে। যা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অশনিসঙ্কেত।

৪. এ নীতিমালার কারণে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতেও মদ বা অ্যালকোহল উৎপাদন ও বিপণন খুবই সহজলভ্য হয়ে যাবে। যার ফলে আমাদের যুবসমাজ এক চূড়ান্ত অবক্ষয়ের দিকে এগোবে। ফলে নানা ধরনের সামাজিক অপরাধ আরো বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। 

৫. যে কোনো ধরনের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মদ্যপান নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হবে। ফলে অশ্লীলতা একটি স্বভাবিত অবস্থায় পরিণত হবে। সম্পূর্ণ পশ্চিমা সংস্কৃতির রঙ্গে সেজে উঠবে এ মুসলিম দেশটি।

৬. ইসলামী আকিদা চর্চা থেকে যুবসমাজকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার জন্য এটি একটি নীলনকশা। 


বর্তমান নীতিমালা বাতিলের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান ও জনগণের করণীয়

অ্যালকোহল নিয়ন্ত্রণ বিধিমালার নামে যে আইন করা হয়েছে তার জন্য বর্তমান সরকার ও জনগণের করণীয় হলো-

- অবিলম্বে এই আইনকে বাতিল করতে হবে। 

- সকল প্রকার মাদকের উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, আমদানি-রফতানি, বিপণন, ক্রয়-বিক্রয়সহ এর সকল প্রকার ব্যবহার আইন করে নিষিদ্ধ করতে হবে।

- মাদক চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।

- দেশের সকল মুসলিমদের এ ব্যাপারে সোচ্চার হতে হবে। 

- প্রত্যেক মুসলমানদের সন্তান, ভাইবোন ও আত্মীয় স্বজনদেরকে নৈতিক ও ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করার ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।

পরিশেষে বলা যায়, এই নীতিমালা সম্পূর্ণ কুরআন এবং সুন্নাহ বিরোধী। সুতরাং অচিরেই এই আইনের বিরুদ্ধে সকলকে সোচ্চার ভূমিকা পালন করতে হবে। তা না হলে আমাদের আগামী প্রজন্ম সম্পূর্ণ অনিরাপদ হয়ে যাবে।

লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির