খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনে এক দুঃসহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। বেশ কিছুকাল ধরে দেশে প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের মূল্য লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইতঃপূর্বে কোভিডের ভয়াবহ সংক্রমণ বিশ্ব অর্থনীতির মূলে আঘাত হেনেছিল। এর প্রভাব পড়েছিল বিশ্বের পণ্যবাজারে। তৎপরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ছাড়াও কখনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কখনও অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য স্বাভাবিক রাখা যায়নি। পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি মানুষকে বিপদে ফেলে দিয়েছে। অতিকষ্টে দিনাতিপাত করছে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তের মানুষ।
একথা সত্য-দেশের একটি শ্রেণীর মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে, বেড়েছে মাথাপিছু আয়। তবে তাদের সংখ্যা তেমন বেশি নয়। বর্তমান দ্রব্যমূল্য দেশের অধিকাংশ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার অনেক বাইরে চলে গেছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার কর্তৃক গৃহীত কোনো পদক্ষেপই তেমন কাজে আসছে না। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের জিনিসপত্রের দাম বাড়বে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু দুঃখের বিষয়- আন্তর্জাতিক বাজারে যেসব জিনিসের দাম কমে, বাংলাদেশের বাজারের ওপর তার প্রভাব পড়ে না। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঘটে এর উলটোটা। এভাবে চলতে থাকলে দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ কী হবে, তা সহজেই অনুমেয়। ক্রমাগত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে দেশের কোটি কোটি মানুষ দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হবে। ধনী-দরিদ্রের আয় বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পাবে, যা কোনোমতেই কাম্য নয়।
বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশে চালের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধির কারণে ভাতপ্রিয় বাঙালিরা বিপাকে পড়েছে। ইতোমধ্যে বেশ জোরেশোরেই ভাতের বিকল্প খাদ্যের চিন্তা-ভাবনা শুরু করেছে তারা। এ নিয়ে অনেক আগে পত্র-পত্রিকায় ব্যাপক লেখালেখি, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচার-প্রচারণা, সভা-সেমিনার এমনকি শোভাযাত্রা পর্যন্ত হয়েছে। আলু দিয়ে তৈরি নিত্যনতুন রেসিপির বাহারি সব খাবারের মেলাও বসেছে দেশের কোথাও কোথাও। কিন্তু বাস্তবে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে ভাতের বদলে আলুর মতো বিকল্প খাদ্য গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেনি।
সে সময়ে আলুর বাম্পার ফলন হওয়ায় কম মূল্যে দীর্ঘ সময় আলু প্রাপ্তির যে সম্ভাবনা ছিল, বাস্তবে তা হয়নি। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিপুল পরিমাণ আলু পচে যাওয়ায় এবং অধিক মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের মারপ্যাঁচে পড়ে মূল্যবৃদ্ধি ঘটে পণ্যটির। ফলে ভাতের বদলে আলু খাওয়ার বাসনাও মানুষের মনে স্তিমিত হয়ে আসে। হিমাগারে সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রতিবছর প্রচুর আলু পচে যায়। এজন্য এর মূল্যও দীর্ঘদিন স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হয় না। তবে বর্তমানে আলুর মূল্যবৃদ্ধির একটা ব্যত্যয় ঘটেছে। দীর্ঘদিন যাবৎ প্রায় ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে আলু।
আলুর পাশাপাশি আরও দু’টি পণ্যের মূল্য মানুষকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় এ দু’টি পণ্য হলো পেঁয়াজ এবং ডিম। ডিমের দাম এখন ডজন প্রতি ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকা, যা একমাস পূর্বেও অনেক কম ছিল। দেশি পেঁয়াজ প্রায় একশত টাকা কেজি। খোলা চিনির দাম অনেকদিন ধরে ১৪০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। এক মাস পূর্বে সরকার আলু, দেশি পেঁয়াজ ও ডিম; এই তিন পণ্যের দাম বেঁধে দিয়েছিল। বেঁধে দেওয়া এ দাম কার্যকর হওয়ার পর থেকেই জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর অভিযান চালাচ্ছে বাজারে। সরকারের নানামুখী তৎপরতার পরও এই এক মাসে আলুর দাম যেখানে ছিল, সেখানেই আছে। আর কমার বদলে উলটো বেড়েছে ডিম ও পেঁয়াজের দাম।
সরকার শুধু দেশী পেঁয়াজের দাম নির্ধারণ করে দিলেও এ সময়ের মধ্যে দেশী পেঁয়াজের সঙ্গে আমদানি করা পেঁয়াজের দামও বেড়েছে। ফলে বেঁধে দেওয়া দামে এসব নিত্যপণ্য কেনার কোনো সুযোগ পাননি ভোক্তারা। আলু, পেঁয়াজ ও ডিমের বাইরে চিনি, সয়াবিন তেল ও তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) সিলিন্ডারের নির্ধারিত দর রয়েছে। এর মধ্যে শুধু সয়াবিন তেল নির্ধারিত দামে পাওয়া যাচ্ছে বাজারে। চিনি ও এলপিজি সিলিন্ডার সরকার কর্তৃক নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। বাংলাদেশের দ্রব্যমূল্য ক্রমাগত বৃদ্ধির প্রধান কারণগুলো এখানে আলোকপাত যেতে পারে-
চাহিদার তুলনায় যোগান অপ্রতুল : বাংলাদেশের জনসংখ্যা অনুসারে খাদ্যশস্য, বিদ্যুৎ, গ্যাস ইত্যাদির চাহিদা অনেক বেশি হলেও যোগান সে তুলনায় কম। তাই ক্রেতাদের মধ্যে দ্রব্য ক্রয়ের প্রতিযোগিতার ফলে অনিবার্যভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ঘটেছে।
বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধি : বাংলাদেশ মূলত একটি আমদানিনির্ভর দেশ। বেশির ভাগ পণ্যই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় আমাদের। যেসব দেশ থেকে বাংলাদেশ পণ্য আমদানি করে, তাদের পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে আমাদের দেশেও দ্রব্যমূল্য ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে জ্বালানি তেল, ভোজ্যতেল, গম, বিদেশি ফলমূল, সুতা, কাপড়, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রমাগত।
চোরাচালান : একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী অতিরিক্ত মুনাফা লাভের আশায় চোরাইপথে মালামাল পাচার করে থাকে। ফলে দেখা দেয় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের কৃত্রিম সংকট। এতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়।
অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি : মজুদদার, আড়তদার, মুনাফালোভী, ফটকাবাজ, চোরাকারবারি ইত্যাদি অসাধু ব্যবসায়ীদের বড়ো ভূমিকা রয়েছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে। ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কিনে মজুদ করে রাখে এবং বাজারে কৃত্রিম পণ্যের সংকট সৃষ্টি করে। পরে ক্রেতাদের মধ্যে দ্রব্য কেনার ছড়াছড়ি শুরু হলে অনেক বেশি দামে বিক্রি করে এবং অর্জন করে প্রচুর মুনাফা। বিশেষত ব্যবসায়ীরা বিশেষ বিশেষ দিনে; যেমন পবিত্র মাহে রমজান, দুর্গাপূজা, বড়োদিন, ঈদ, বাংলা নববর্ষ ইত্যাদি অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে নিত্যপণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয়।
চাঁদাবাজি ও দুর্নীতি : রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও প্রশাসনের দুর্নীতির কারণে আমাদের দেশের পরিবহন সেক্টরের সাথে একশ্রেণীর চাঁদাবাজ, মাস্তান চক্র গড়ে উঠেছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এ সকল চাঁদাবাজরা পরিবহন সেক্টরে বিপুল চাঁদাবাজি করার কারণে দ্রব্যমূল্যের উপর বাড়তি চাপ পড়ছে, যা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করছে পরবর্তীতে।
অনুন্নত পরিবহন ব্যবস্থা : বাংলাদেশের রাস্তাঘাটের বেহাল দশা এবং অনুন্নত পরিবহনের কারণে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে মালামাল পৌঁছাতে নির্দিষ্ট খরচের তুলনায় অনেক বেশি খরচ হয়। এই বাড়তি খরচ দ্রব্যমূল্যের সাথে যোগ করেন ব্যবসায়ীগণ। এর ফলে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায় এবং চাপ পড়ে সাধারণ মানুষের ওপর।
ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট : ‘সিন্ডিকেট’ শব্দটা বাংলাদেশে খুবই পরিচিত। ব্যবসায়ীরা সকলে একজোট হয়ে সাধারণ মানুষকে শোষণ করে মুনাফার পাহাড় গড়ে তোলার জন্য দ্রব্যমূল্য বাড়ায়। এক্ষেত্রে সাধারণ ভোক্তাদের কিছুই করার থাকে না বাড়তি দামে দ্রব্য ক্রয় করা ছাড়া।
সরকারি নজরদারির অভাব : সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন দফতর ও অধিদফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যেভাবে নিয়মিত বাজার মনিটরিং করার কথা, সেভাবে করেন না তারা। বরং সরকারের কিছু কিছু পদক্ষেপ দ্রব্যমূল্য না কমিয়ে বরং বাড়াতে উৎসাহিত করে।
জমির উর্বরতা হ্রাস : যুগের পর যুগ ধরে আমাদের জমিগুলোকে সনাতনী পদ্ধতিতে চাষ করা হচ্ছে। তাই হ্রাস পাচ্ছে জমির উর্বরতা। দিন দিন কমে যাচ্ছে উৎপাদন। তাই মাথাপিছু জাতীয় আয়ও হ্রাস পাচ্ছে।
মোটাদাগে কারণগুলো এরকমই। কিন্তু এর মধ্যে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয় রয়েছে, যা পত্র-পত্রিকায় হরহামেশায় প্রকাশ হয়ে থাকে। সেখানেই ক্ষোভের মাত্রা বেশি। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে- এটা বলা এক ধরনের নিষ্ঠুর উপহাস! সিপিডির তথ্যমতে- গুঁড়াদুধের মূল্য ইউরোপের তুলনায় বাংলাদেশে বেশি। অথচ তাদের তুলনায় আমাদের মাসিক আয় অনেক কম। দাম বাড়ার কারণ হিসেবে দেশে বাজার ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলার অভাব, চাহিদা-যোগান সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকাসহ বাজার তদারকি ও আইন প্রয়োগে দুর্বলতাকে দায়ী করা হয়।
অন্যদিকে, দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে কয়েকটি কারণের কথা বলা হয় সরকারের পক্ষ থেকে। সেগুলো হলো- ‘মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে’, ‘বিশ্ববাজারে দাম বেড়েছে।’ আবার কেউ কেউ বলছেন- ‘বিএনপি সমর্থিত ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে!’ এ ব্যাপারে কয়েকজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মন্তব্য করেন-
‘আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে আমাদের এখানে জিনিসপত্রের দাম ২-৩ গুণ বেড়েছে এটা সত্য। মূলত সিন্ডিকেটের কারণেই এই দাম বেড়েছে। আর দাম বাড়লেও সরকার তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না। প্রতিযোগিতা আইন ২০১২ কার্যকর করতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। তারা কেন এ আইনের ব্যবহার করছে না, তাদের উদ্দেশ্য কী; তা পরিষ্কার নয়।
প্রতিযোগিতা আইন ২০১২-এর শুরুতেই বলা হয়েছে, “দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে ব্যবসা-বাণিজ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ উৎসাহিত করবার, নিশ্চিত ও বজায় রাখবার উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্রমূলক যোগসাজশ মনোপলি ও ওলিগপলি অবস্থা, জোটবদ্ধতা অথবা কর্তৃত্বময় অবস্থানের অপব্যবহার সংক্রান্ত প্রতিযোগিতা বিরোধী কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ বা নির্মূলের লক্ষ্যে আইন প্রণয়ন করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়।” দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে- এই প্রেক্ষাপটে সরকার যে জিডিপি বেড়েছে বলে দাবি করে, সেই সঙ্গে জিনিসপত্রের দাম বাড়লে সে দাবি মিথ্যা হয়ে যায়।
কোনো সমস্যা সমাধান করার জন্য তা আগে স্বীকার করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের মূল সমস্যা হলো- তারা কোনো সমস্যা স্বীকার করতে চায় না। তারা মনে করে- সমস্যা স্বীকার করলে বোধ হয় সেটি তাদের ব্যর্থতার কারণে হয়েছে বলে প্রতীয়মান হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কারণে যাদের সুবিধা হয়, লাভ হয়; তারা সবাই সরকারের ঘনিষ্ঠ। তাই সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না।
বাংলাদেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে বলে যে বুলিটি আওড়ানো হয়, সেটি মূলত কেবল ধনীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এ আয় বৃদ্ধি কখনো গড় আয় হতে পারে না। যারা নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ, তাদের আয় বাড়েনি। বরং নতুন করে দারিদ্র্যসীমার মধ্যে প্রবেশ করেছে মানুষ। জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে বলে উল্লেখ করেছেন অর্থনীতিবিদগণ। তাঁদের মতে, ‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষখাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা এমনকি চিকিৎসা খাতেও তাদের বাজেট কমিয়েছে। সরকার উন্নয়নের গল্প বলে এক ধরনের প্রতারণা করছে জনগণের সঙ্গে।’
আন্তর্জাতিক বাজার থেকে যারা আমদানি করে, তাদের সংখ্যা কিছুটা কম হওয়ায় একচেটিয়াভাবে প্রভাব বিস্তার করে তারা। ফলে সরবরাহ প্রক্রিয়া সাবলীলভাবে কাজ করে না। অনেক সময় তারা পণ্য মজুদ করে রাখে। ফলে মাত্রাভেদে মূল্য বৃদ্ধি পায় পণ্যের। বাজার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সরকারের অনেক দুর্বলতা রয়েছে। সেখানে তদারকির যথেষ্ট অভাব আছে এবং সরকারের পক্ষ থেকে আইনের প্রয়োগ সঠিকভাবে হচ্ছে না। এর ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সাধারণ ভোক্তাদের।
আমাদের আয় বাড়ছে; এ কথার মধ্যে অসত্যতা হলো- সবার আয় একভাবে বাড়েনি। কয়েক বছর ধরেই দেশে আয়ের বৈষম্য বাড়ছে। নিম্ন আয়ের মানুষের আয় বাড়েনি বরং বিভিন্ন সময় নানা কারণে অনেকের আয় কমেছে। শ্রমজীবী এবং নিম্ন আয়ের মানুষ যেসব পণ্য ভোগ করেন, সেগুলোর মূল্যস্ফীতি ১২-১৪ গুণ। অথচ তাদের তো আয় বাড়েনি! এই মূল্যস্ফীতি কিন্তু আগের মূল্যস্ফীতির সঙ্গে যোগ হয়।
মানুষের জীবনযাত্রার মান ঠিক রাখতে হলে মূল্যস্তরকে স্থিতিশীল রাখতে হবে। আয় বাড়িয়ে এটা ঠিক রাখা সম্ভব নয়। কারণ শুধু সরকারি চাকরিজীবীদের আয় বাড়ালেই হবে না; যারা বেসরকারিভাবে বিভিন্ন পেশায় আছেন, তাদের তো আয় বাড়ে না! এই জায়গাগুলোতে আমাদের অবশ্যই নজর দিতে হবে। আয় বৈষম্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। সঠিকভাবে বাজার তদারকি করতে হবে এবং ঠিক রাখতে হবে মূল্যস্তর। তবেই মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে।
গত সেপ্টেম্বর মাসে ‘বাংলাদেশ মার্কেট মনিটর: মে-জুলাই’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে ডব্লিউএএফপি। সেখানে সংস্থাটি প্রবাসী আয় কমে যাওয়া এবং রিজার্ভ সংকটে (বৈদেশিক মুদ্রা) কারণে বাংলাদেশে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে বলে উল্লেখ করে। একই সঙ্গে সার, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় চাল ও সবজির মতো খাদ্যপণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে বলেও ওই প্রতিবেদনে বলা হয়। গত আগস্টে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৫ শতাংশ কমেছে এবং টাকার মান এ যাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে বলে জানানো হয়।
খাবার কিনতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে বলে উল্লেখ করা হয় ডব্লিউএএফপির প্রতিবেদনে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে বাকিতে খাবার কিনতে যাওয়া মানুষের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। এমন মানুষের সংখ্যা চলতি বছরের মে মাসে ছিল ৩২ শতাংশ। আগস্টে তা বেড়ে ৪৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বাকিতে খাবার কিনতে যাওয়া মানুষের সংখ্যা সিলেটে ৫৩ শতাংশ ও চট্টগ্রামে ৫৮ শতাংশ। এসকল মানুষ সরকারি ও বেসরকারিভাবে খুব বেশি সহায়তাও পাননি। মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ আগস্ট মাসে সহায়তা পেয়েছেন। প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতি ১০ পরিবারের তিনটি পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছে না। আর দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় এ হার জনসংখ্যার অর্ধেক। দেশের ৭৪ শতাংশ মানুষ কম পরিমাণে ও সস্তা খাবার কিনছেন। সামগ্রিকভাবে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার পরিমাণ কমেছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক সাজ্জাদ জহির বলেন, ‘দেশে যে অভাবী মানুষ বেড়েছে, তা রাস্তায় বেরোলেই বোঝা যায়। একটি বড়ো অংশের মানুষ যে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছেন, তা সবার আগে স্বীকার করে নিতে হবে। “দেশে বিপুল পরিমাণে খাদ্য মজুদ আছে, উৎপাদন ভালো হয়েছে”- এসব কথা বললেই দরিদ্র মানুষের পেটে খাবার যাওয়া নিশ্চিত হয় না। এজন্য বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।’
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
আপনার মন্তব্য লিখুন