post

পলাশীর যুদ্ধ ভিন্ন আলোয় দেখা

লাবিব আহসান

১৩ জুন ২০২৩

সম্রাট শাহজাহান তাজমহল নির্মাণ করেছিলেন স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার অনন্য নজরানা স্থাপনের উদ্দেশ্যে। ২০,০০০ শ্রমিকের দিন-রাত নিরলস পরিশ্রম সত্ত্বেও এটি নির্মাণে সময় লেগেছিল প্রায় ২১ বছর। ১৬৫৩ সালে পরিপূর্ণরূপে নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয়েছিল। মূল কাঠামোর নির্মাণকাজ ১০ বছরের মধ্যে শেষ হয়ে গেলেও বাকি এক যুগ ব্যয় হয়েছিল মার্বেল পাথরের কাজ এবং তাজমহল কমপ্লেক্সের অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করতে।

মালামাল পরিবহনের জন্য নিয়োজিত ছিল ১,০০০ হাতি। আগ্রা হতে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রাজস্থানের মাকরান থেকে আনা হয়েছিল সাদা মার্বেল পাথর। এ ছাড়া তাজমহলের মোজাইকের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল মহামূল্যবান এবং অপেক্ষাকৃত কম মূল্যবান ২৯ ধরনের পাথর; যেগুলো আনা হয়েছিল সুদূর শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, তিব্বত, আরব এবং ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে।

মুঘলদের নির্মাণ করে যাওয়া স্থাপত্যকর্মসমূহ আজও ভারতের বুকে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, তাজমহল এবং অন্যান্য ব্যয়বহুল প্রজেক্ট হাতে নেওয়ার ফলে সম্রাট শাহজাহানের আমলের শেষের দিকে মুঘল রাজকোষ অনেকটা শূন্য হয়ে পড়েছিল। শুধু তা-ই নয়, তাজমহলের শ্রমিকদের খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে গিয়ে সাম্রাজ্যের কোনো কোনো জায়গায় সৃষ্টি হয়েছিল কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ।

রাজকোষের অতিরিক্ত খরচ পোষাতে জনগণের উৎপাদিত পণ্যের ওপর রাজস্ব আদায়ের হার দেড়গুণ বৃদ্ধি করা হয়েছিল। ফলে সাধারণ মানুষের জীবন হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। ইউরোপের সাম্রাজ্যগুলো যে সময় প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার দিকে ছুটছিল, মুঘল শাসকরা তখন ব্যস্ত ছিলেন স্থাপত্য নির্মাণ করে নিজেদের ইতিহাসের অংশ করার তাড়নায়। রাজ্য রক্ষার্থে ছিল না তাদের কোনো প্রস্তুতি কিংবা মনোযোগ; যার মাশুল গুণতে হয়েছে পলাশীর প্রান্তরে স্বাধীনতা হারিয়ে।

অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন, মুঘলদের স্থাপত্য নির্মাণের সঙ্গে পলাশীর প্রান্তরে স্বাধীনতা হারানোর কী সম্পর্ক? সম্পর্ক আছে বৈকি! পূর্বসূরিদের করে যাওয়া ভুলের কিছুটা মাশুল উত্তর-পুরুষদেরও গুণতে হয়। ভারত শাসকদের এই ভুল জায়গায় মনোনিবেশের দরুন ইউরোপীয় দেশগুলোর তুলনায় কয়েকগুণ বেশি রাজস্ব আসা সত্ত্বেও ভারতীয় উপমহাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষতা আসেনি। অথচ প্রযুক্তিগত এই উৎকর্ষই ইউরোপীয় শক্তিগুলোর জন্য খুলে দিয়েছিল ভারতসহ পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তের দ্বার।

ইংরেজ বাহিনীর বিজয়ের একটি বড়ো কারণ ছিল তাদের রণকৌশল এবং আধুনিক ও হালকা অস্ত্র। মুঘল আমলে ভারতীয় উপমহাদেশে স্থাপত্যশিল্পের বিপুল প্রসার ঘটলেও ইউরোপীয় শক্তিগুলোর সামনে স্বাধীনভাবে দাঁড়িয়ে থাকার মতো রাজনৈতিক শক্তি গড়ে ওঠেনি। ইউরোপীয় যে সামরিক নেতৃত্ব ভারতীয় উপমহাদেশে এসেছিল, তারা বিদ্যমান শাসকদের চেয়ে অনেক বেশি কৌশলী এবং বিচক্ষণ নেতৃত্বের প্রমাণ দিয়েছিল।

ইতিহাসের নির্মোহ বিশ্লেষণকে সামনে আনলে দেখা যায়, মীর জাফরদের নির্লজ্জ বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের পরাধীনতাকে ত্বরান্বিত করলেও তৎকালীন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা ভারতবর্ষের পরাজয়ের মঞ্চ সাজিয়েই রেখেছিল। ফলে তারা বিশ্বাসঘাতকতা না করলেও পরাধীনতা ছিল অবশ্যম্ভাবী; যা এড়ানোর কোনো প্রস্তুতি এই উপমহাদেশের ছিল না। ইংরেজরা যদি ইউরোপে নেপোলিয়ানকে হারাতে না পারত, তবে এই উপমহাদেশে ফরাসিদের ঠেকাতে পারার মতো কোনো শক্তি ছিল না। সেক্ষেত্রে আমরা হয়তো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে না গিয়ে ফরাসি বাণিজ্য কোম্পানিরই রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে যেতাম। এই পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য ভারতীয় শাসকদের খেয়ালিপনাই দায়ী।

২.

ব্রিটিশদের হাতে উপমহাদেশের পরাজয় বরণের আরেকটি বড়ো কারণ ছিল শাসকদের জনবিচ্ছিন্নতা। মুঘল সম্রাটগণ থেকে শুরু করে নবাব সিরাজ; এঁদের প্রত্যেকেই ছিলেন জনবিচ্ছিন্ন শাসক। মুঘল আমলে প্রজাদের সাথে শাসকদের কার্যত কোনো সম্পর্কই ছিল না। প্রজাদের নিকট থেকে শাসকদের হয়ে খাজনা আদায় করতেন স্থানীয় জমিদার আর তালুকদাররা। শাসকদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে না ওঠার দরুন ক্ষমতার মসনদে কে এলো আর কে গেল; সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই ছিল না জনসাধারণের। 

রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় প্রজাদের গুরুত্বহীন করে তোলার ফলাফল উপমহাদেশের শাসকরা কড়ায়-গণ্ডায় বুঝে পায়। নির্মমভাবে পতন হয় দুনিয়ার অন্যতম পরাক্রমশালী সাম্রাজ্য মুঘলদের। জনবিচ্ছিন্নতার খেসারত দেন বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব সিরাজউদ্দৌলাও। জীবনের নিদারুণ সংকটের সময় জনগণকে পাশে পাননি তিনি। নিজের ভালো সময়ে যে শাসক জনগণকে পাশে রাখার প্রয়োজন অনুভব করেননি, খারাপ সময়ে সেই জনগণ তাঁর পাশে দাঁড়ানোর দায় অনুভব করবে কেন?

পরবর্তী সময়ে লর্ড ক্লাইভের ভাষ্যেও উঠে এসেছিল সেই সময়ের নির্মম বাস্তবতাটি। ক্লাইভ তার ব্যক্তিগত ডায়েরিতে লিখেছিল, ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে যখন গ্রেফতার করে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন অসংখ্য মানুষ হাঁ করে নীরব দর্শকের মতো সেই দৃশ্য উপভোগ করেছিল। শুধু তাই নয়, পিঠে ছুরিকাঘাত করার পূর্বে নবাবকে কাঁটাওয়ালা সিংহাসন ও ছেঁড়া জুতা দিয়ে যখন অপমান করা হচ্ছিল, তখন শত শত মানুষ সেই কৌতুকে ব্যাপক বিনোদিত হয়েছিল। তারা যদি একটি করেও ঢিল ছুড়ত, তাহলে আমরা মাটির সঙ্গে মিশে যেতাম।’

এর পরের দৃশ্য আরও করুণ। নবাব সিরাজকে হত্যা করার পর তাঁর মৃতদেহ হাতির পিঠে তুলে সমগ্র মুর্শিদাবাদ ঘোরানো হলো। কিন্তু সাধারণ জনতা এর প্রতিবাদ করা তো দূরে থাকুক, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করল কেবল। এমনকি বক্সারের যুদ্ধের পরে যখন ইংরেজরা শাসনক্ষমতা নিয়ে নেয়, তখনও প্রজাদের দিক থেকে কোনো প্রতিরোধ আসেনি। আজ এই দৃশ্য আমাদের কাছে অস্বাভাবিক মনে হলেও তখনকার বাস্তবতায় এটিই ছিল স্বাভাবিক। এহেন পরিস্থিতি তৈরির দায় শাসকদের নিজেরই। 

এ ছাড়া আরও একটি কার্যকারণ কাজ করেছিল সে সময়। রাজকোষকে বিপুল খাজনার জোগান দিতে বাধ্য করার মধ্য দিয়ে শাসকরা প্রজাদের মধ্যে একটি ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছিলেন। ফলে যখন বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার শাসনক্ষমতায় সিরাজউদ্দৌলার পরিবর্তে ইংরেজরা এলো, তখনও প্রজারা ভয়ের সংস্কৃতি থেকেই তাদেরকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। কাজেই বলা যায়, নবাব সিরাজ যে গর্তে পতিত হয়েছিলেন, তার কিয়দংশ তাঁর নিজেরই খননকৃত।

৩.

পলাশীর রাজনৈতিক ইতিহাস বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে বহুলচর্চিত আলাপচারিতার বাইরে এসে কথা বলতে খুব কম ইতিহাসবিদকেই দেখি আমরা। অধিকাংশ ইতিহাসবেত্তা মীর জাফরদের বিশ্বাসঘাতকতাকেই পলাশীর পরাজয়ের একমাত্র কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। তাঁরা কখনোই অন্যান্য কারণগুলো খতিয়ে দেখার প্রয়াস পান না। কিন্তু আজকের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে সামনে রেখে পলাশীর পরাজয়ের অন্যান্য কারণগুলো নিয়েও ভাবতে হবে আমাদের। বক্ষ্যমাণ রাজনৈতিক সংকট মোকাবেলায় পলাশীকে সামনে রাখা ভীষণ জরুরি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য সবচেয়ে বড়ো হুমকি রাষ্ট্রটির নাম ভারত। বছর কতেক আগে ভারতের একজন এমপি হিন্দু নিপীড়নের মিথ্যে অভিযোগ এনে হুমকি দিয়েছিল বাংলাদেশ দখল করার জন্য সৈন্য পাঠানোর। এখানে তারা ভারতের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এ ছাড়াও বিভিন্ন ইস্যুতে আমরা লক্ষ করেছি, তাদের আচরণ বন্ধুসুলভ নয়, প্রভুসুলভ। 

পলাশীর পরাজয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল রাজ্য রক্ষার প্রশ্নে পূর্ববর্তী শাসকদের ঔদাসীন্য। তারা তাদের সকল শক্তি, মনোযোগ অপচয় করেছিলেন অপ্রয়োজনীয় কাজে। প্রতিরক্ষা এবং প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে তাদের কোনো পরিকল্পনা না থাকার খেসারত দিতে হয়েছে পলাশীর প্রান্তরে। এই পশ্চাৎপদতাই উপমহাদেশের পরাধীনতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রেখেছিল। পলাশীতে তা বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র। সুতরাং এখন আমাদের প্রধান কাজই হলো সার্বভৌমত্ব রক্ষার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রাখা।

পলাশীর পরাজয়ের অন্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, শাসকের জনবিচ্ছিন্নতা এবং ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি। শাসক জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে জনগণ সেই রাষ্ট্রে নিজেদের অপ্রাসঙ্গিক ভাবতে শুরু করে দেয়। ভয়ের সংস্কৃতি বিদ্যমান থাকায় তারা প্রতিবাদ করারও সাহস করে উঠতে পারে না। ফলে একটি রাষ্ট্রের দাঁড়িয়ে থাকার ভিত নড়বড়ে হয়ে যায়। দীর্ঘমেয়াদে এমন পরিস্থিতি বিরাজ করলে রাষ্ট্র হয়ে পড়ে অকার্যকর। এটাই মোটাদাগে সবচেয়ে বড়ো ক্ষতি। জাতিগতভাবে আমাদের পলাশী থেকে শিক্ষা নিতে হবে। আর সেটা না পারলে প্রস্তুতি নিতে হবে দীর্ঘস্থায়ী পরাধীনতা বরণ করার।


লেখক : কলামিস্ট

গ্রন্থসহায়িকা- 

১. এবনে গোলাম সামাদ- আত্মপরিচয়ের সন্ধানে।

২. শ্রী বিহারীলাল সরকার- ইংরেজের জয় : আরকট অবরোধ ও পলাশী।

৩. তপনমোহন চট্টোপাধ্যায়- পলাশীর যুদ্ধ।

৪. প্রতিভা রঞ্জন মৈত্র- মুর্শিদাবাদের ইতিহাস।

৫. দৈনিক নয়া দিগন্ত- ১২ অক্টোবর ২০১৮।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির