মৃত্যুর পরের জীবনের বর্ণনা দিয়ে উপন্যাস লিখেছেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিমান কথাশিল্পী বিভ‚তিভ‚ষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। উপন্যাসের নাম ‘দেবযান’। জ্যোতিষতত্ত্ব ও উদ্ভিদতত্ত্বের পর তৃতীয় যে বিষয়টি নিয়ে তিনি প্রবলভাবে আগ্রহী ছিলেন, সেটি হলো, পরলোকতত্ত¡। প্রবল আগ্রহের কারণেই তিনি এ বিষয়ে পড়াশুনা করেছেন বিস্তর। পরলোক সম্পর্কিত কোনো বই বা প্রবন্ধ যখনই যেখানে তিনি পেয়েছেন, পড়ে ফেলেছেন। সম্ভবত এই কৌতূহল তাঁর নেশায় পরিণত হয়েছিল।
ধর্মবিশ্বাসের দিক থেকে বিভ‚তিভ‚ষণ যে নাস্তিক ছিলেন না, সেটি মোটামুটি নিশ্চিত। তবে তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের মৃত্যুর পরও তার আত্মার অস্তিত্ব থাকে। সে আত্মার সঙ্গে এই পৃথিবীর যোগাযোগ থাকে এবং কেউ কেউ আবার জন্মান্তর গ্রহণ করে। তিনি পরকাল বিশ্বাসকে দেখতেন একটা নির্মোহ জায়গা থেকে দাঁড়িয়ে। ব্যাপারটা অনেকটা এমন, ‘পরকাল বলে যদি কিছু না থাকে তো নেই। কিন্তু যদি মৃত্যুর পর গিয়ে দেখি পরকাল আছে, তখন?’ সেই জায়গা থেকে বিবেচনা করলে কি তাঁকে অজ্ঞেয়বাদী বলা যায়?
মজার ব্যাপার হলো, জ্যোতিষতত্ত¡ সম্পর্কিত ব্যাপক অধ্যয়নই মূলত তাঁর ¯্রষ্টা এবং পরলোকে বিশ্বাসের কোর্টে বল খানিকটা ঠেলে দিয়ে রেখেছিল। এই অনন্ত বিশ্বের রহস্য উপলব্ধি করতে গিয়ে যতই তিনি এর গভীরে প্রবেশ করেছেন, ততই তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছে, এই ধারণাতীত বিপুল বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা কে? কেউ একজন নিশ্চয়ই আছে, যাঁর ইচ্ছায় ও নির্দেশে সীমাহীন পরিধিহীন বিশাল নীহারিকা, এই লক্ষ লক্ষ নক্ষত্র, কোটি কোটি তারকাপুঞ্জ চলছে অথচ তাদের মাঝে ব্যবধান যোজন যোজন!
এ কারণেই বিভ‚তিভ‚ষণ তাঁর আশপাশের লোকদের সঙ্গে আলাপ করার সময় বারবার পরকাল, ঈশ্বর; এই প্রসঙ্গগুলো সামনে নিয়ে আসতেন। তাঁর সমসাময়িক গজেন্দ্রকুমার মিত্র লিখেছেন, ‘বিভ‚তিবাবু আমাদের কাছে যে পরিমাণ উৎসাহ সহকারে বিভিন্ন পুথিপত্র নজিরের সাহায্যে পরলোকের অস্তিত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা করতেন, তাতে মনে হয় তার নিজের মনে পরকাল না থাকার ব্যাপারে একটু সন্দেহের বীজ কোথাও থেকেই গিয়েছিল।’ মূলত তাঁর পরলোক বিশ্বাসেরই একটি জলজ্যান্ত দলিলের নাম ‘দেবযান’।
২.
বিভ‚তিভ‚ষণের ‘দেবযান’ লেখার প্রায় ৬৮ বছর পর তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে উপন্যাস রচনা করেন বাংলা কথাসাহিত্যের আরেক দিকপাল হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর লেখা উপন্যাসের নাম ‘মেঘের উপর বাড়ি’। এই উপন্যাসে মৃত্যুর পরবর্তী অবস্থার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। বিস্ময়কর তথ্যটি হলো, হুমায়ূন আহমেদ এই উপন্যাসটি লেখেন তাঁর মৃত্যুর মাত্র কয়েক মাস পূর্বে। উপন্যাসের ভাষা উত্তম পুরুষে লেখা। গল্পের মৃত ব্যক্তি একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এবং তার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলায়।
উপন্যাসের মূল চরিত্র হিসেবে হুমায়ূন আহমেদ কি তাহলে নিজেকেই কল্পনা করেছিলেন? মৃত্যুর মাত্র কয়েক মাস পূর্বে মৃত্যু পরবর্তী জীবন নিয়ে এমন একটি উপন্যাস লেখার পিছনে লজিক কি, জানি না। তবে কি তিনি বুঝে ফেলেছিলেন, সময় ঘনিয়ে আসছে? ‘মৃত্যুর পরে আরেকটি জীবন আছে’ তাঁর এ বিশ্বাসের খানিকটা ছাপ তিনি এ উপন্যাসে রেখে গেছেন। যদিও আত্মার ঘোরাফেরা করা, মানুষের কথা বুঝতে পারার যে বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, পরকালের ব্যাপারে ইসলামের বক্তব্য তেমন নয়।
এ উপন্যাস প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতার এক ফাঁকে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর স্রষ্টায় বিশ্বাসের ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে। প্রকৃতির মধ্যে কিছু নিদর্শন তো আছেই। তোমাকে একটা যুক্তি দিই, শোনো। তুমি মঙ্গল গ্রহে গিয়েছ। সেখানে গিয়ে তুমি দেখলে পাহাড়, পর্বত, পাথর। পাথর দেখে তুমি বলবে, “বহুকাল থেকে, সেই আদিকাল থেকে পাথরগুলো এভাবেই আছে।” হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ তুমি দেখতে পেলে একটা নাইকন ক্যামেরা। তুমি সেটা হাতে নেবে। তখন তোমাকে বলতেই হবে, এর একজন স্রষ্টা আছে।
ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে তুমি এ কথা ভাবতে পারবে না যে, শূন্য থেকে এটা আপনা-আপনি এসে হাজির হয়েছে। কারণ, এটা একটা জটিল যন্ত্র। এবার আরেকটু এগিয়ে গেলে। কোত্থেকে একটা খরগোশ বেরিয়ে এসে তোমার দিকে তাকাল। নাইকন ক্যামেরা কী করে? ছবি তোলে। খরগোশ কী করে? অনেক কাজই করে। খরগোশের একটা কাজ হলো দেখা। এই খরগোশের চোখ নাইকন ক্যামেরার চেয়ে হাজার গুণ বেশি জটিল। নাইকন ক্যামেরাটা দেখে তোমার যদি মনে হয় যে এর একটা নির্মাতা থাকা দরকার, তাহলে খরগোশের বেলায় এটা তোমার মনে হবে না কেন?’
সেই সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেন, ‘মানুষের সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ে একটা বৈজ্ঞানিক যুক্তি ছিল এ রকম। অণু-পরমাণুতে ধাক্কাধাক্কির ফলে একটা জটিল অণুর জন্ম হয়েছে। একসময় এটা এত দূর জটিল হয়ে উঠছে, সেটা একেবারে নিজের মতো আরেকটা জিনিস তৈরি করতে শুরু করেছে। তারপর তৈরি হলো মানুষ। অসম্ভব ধীমান একটি প্রাণী। একটা গোলাপ ফুল দেখে যে মানুষ তারিফ করতে পারে, একটা পরম শৃঙ্খলা ছাড়া শুধু ধাক্কাধাক্কি করে কি এটা সম্ভব হতে পারে? এবং এটা কি বিশ্বাসযোগ্য যে, অণু-পরমাণুর ধাক্কাধাক্কির ফলে আমরা গোলাপ ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারি? এই পৃথিবীর সবকিছু পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র মেনে চলে। প্রোটন হবে ইলেকট্রনের চেয়ে ১,৮৩৬ গুণ বড়। সমস্ত তত্ত¡, সংখ্যা ধ্রæব। এই ধ্রুবত্ব কে নির্ধারণ করেছে?’
৩.
বিভ‚তিভ‚ষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং হুমায়ূন আহমেদের সময়কে ছাড়িয়ে আরেকটু পিছনে যেতে চাই। ইংরেজ জীববিজ্ঞানী হার্বার্ট স্পেনসার ছিলেন একজন বিখ্যাত নাস্তিক। ধর্ম সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুশাসন থেকে মুক্ত না হলে সামাজিক নীতিগুলি কখনই বিশুদ্ধ নীতি হয়ে উঠতে পারে না ও নিত্যপরিবর্তনশীল সমাজের প্রয়োজনও মেটাতে পারে না।’ ধর্মের একটি অদ্ভুত সংজ্ঞাও দিয়েছিলেন স্পেনসার, ‘ধর্ম হলো একটি আনুমানিক ধারণা, যা এই বিশ্বজগৎকে বুদ্ধিগম্য করে তোলে।’ তার মতে, বিজ্ঞান চলে জ্ঞাত (known)-কে নিয়ে, ধর্ম চলে অজ্ঞাত বা অজ্ঞেয় (the unknown and unknowable)-কে নিয়ে। বিজ্ঞান আলোচনা করে প্রত্যক্ষগোচর (positive)-কে, সুনির্দিষ্ট জ্ঞানকে। কিন্তু ধর্ম চলে যায় অজ্ঞাত অন্ধকারাচ্ছন্ন পটভ‚মিতে। যেখানে বিচারাধীন শ্রদ্ধাই ক্রিয়া করে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এই আপাদমস্তক নাস্তিক মানুষটি, যিনি সারাজীবন বলে এসেছেন, ‘স্রষ্টা বলে কেউ নেই’, যিনি বিজ্ঞানের পাশে ধর্মকে রেখে প্রবল চপেটাঘাত করে আনন্দ পেয়েছেন, শেষ জীবনে গিয়ে তিনি বলে বসলেন, ‘স্রষ্টা বলে কেউ থেকে থাকলে আমি তাঁর কাছে ক্ষমা চাই।’
৪.
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশী সাংবাদিক ও কলামিস্ট তাসের মাহমুদ খান। জীবনের ৬৬ বছর অবিশ্বাস, সংশয় ও নাস্তিকতার বেড়াজালে কাটিয়ে শেষলগ্নে পৌঁছেছেন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। অবস্থা এতটা সঙ্গিন হয়ে পড়ল যে, তাকে লাইফ সাপোর্টে নিতে হলো। খানিকটা সুস্থ হওয়ার পর একদিন এক নার্স এসে বললেন, ‘মিস্টার খান, আপনি লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় যখন ঘোরের মধ্যে ছিলেন, তখন কখনও জোরে জোরে আবার কখনও বিড়বিড় করে আপনাকে ধর্মগ্রন্থ কুরআন পাঠ করতে শুনেছি।’
তিনি যে কুরআন থেকেই পাঠ করেছেন, নার্স তা স্পষ্ট বুঝতে পারার কারণ হলো, তিনি কুরআনের ওই সূরাগুলো আগে থেকেই জানতেন। এমনকি আরবি ভাষাও জানা ছিল সেই নার্সের। এই কথাগুলো শোনার পর অবিশ্বাসী তাসের মাহমুদ খান আকাশ থেকে পড়লেন। যার গোটা জীবনটাই কেটেছে নাস্তিকতা আর সংশয়বাদের অন্ধকারে, তার মুখে কুরআন উচ্চারিত হওয়াটা সত্যিই বিস্ময়কর। ঘটনাটি তার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করল। এতটাই যে, শেষ জীবনে এসে তিনি বিশ্বাসীদের তালিকায় নাম লেখালেন, পারলেন না সত্যের হাতছানিকে উপেক্ষা করতে। সৃষ্টিকর্তা, পরকাল এক মহাসত্যের নাম। কেবল দুর্ভাগারাই এই মহাসত্যকে সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হয়।
লেখক : কলামিস্ট ও ব্লগার
আপনার মন্তব্য লিখুন