post

যে পথে ছিলো আলোর পরশ

মঞ্জুরুল ইসলাম

০৭ এপ্রিল ২০২৩

প্রত্যন্ত গ্রামে আমার জন্ম। বেড়ে উঠা সেখানেই। যেখানেই যাই না কেন- হৃদয়ে সবসময় দোলা দেয় আমার গ্রামটি। এ যেন আমার কাছে সবচেয়ে সেরা ঠিকানা। আমার গ্রামে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিলো না। পাশের গ্রামে মোটামোটি ভালো মানের একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিলো। তবে পরিবার থেকে মাদরাসায় পড়ানোর আগ্রহ ছিলো বেশি। ফলে সেই প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার ব্যাপারে তেমন কোনো গুরুত্ব দেইনি। পরবর্তীতে আমাদের গ্রামেই ইসলামী শিক্ষার প্রসারের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা হয় মাদরাসা। সেখানে কিছু দিন যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তবে সেই মাদরাসা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। নানা কারণেই প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায়। 

এরপর স্কুলে আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হাতেখড়ি এবং একটু বড় হয়ে। কারণ এখনকার মতো খুব ছোট থেকে স্কুলে যাওয়ার মত পরিবেশ ও সুযোগ তখন ছিলো না আমাদের। 

দিনের গুরুত্বপূর্ণ সময় কাটতো বন্ধুদের সাথে। বাল্যবন্ধুরা সবাই কাছের আত্মীয় ছিলো। গ্রামে শিক্ষার তেমন উল্লেখযোগ্য পরিবেশ ছিলো না, বর্তমানেও আমাদের গ্রাম শিক্ষার দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে। গ্রামের বন্ধুদের সাথে খেলাধুলায় দিন কেটে যেত। কত রকমের যে খেলাধুলা সেটা বলে শেষ করা যাবে না। যে খেলাধুলা এখন নেই বললেই চলে। 

বিকেল বেলায় গ্রামের মাঠে দল বেধে ঘোরাঘুরি, এক সাথে ঘুড়ি উড়ানো বা গোল্লাছুট ছিলো নিয়মিত খেলার অংশ। বয়স বাড়ার সাথে সাথে খেলাধুলার ধরন পরিবর্তন হয়। ক্রিকেট হয়ে উঠে প্রিয় খেলা।

গ্রামে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিলো না বলে কিছু মানুষের প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠা হয় ব্র্যাক স্কুল। সেখানে থেকে শুরু হয় শিক্ষাজীবন। দলগতভাবে বসার বিষয়টা এখনও খুব মনে পড়ে। আমি একটা দলের প্রধান ছিলাম এটা ছিলো অন্যরকম আনন্দের। আমার দলের সবাই আমার কথা মতো চলবে প্রতিদিনের পড়া প্রস্তুত করে আনবে। কেউ  যদি পড়া না পারতো তাকে শাসন করার এখতিয়ার ছিলো।

স্কুলে কালচারাল সেশন ছিলো গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত সাপ্তাহিকভাবে এই সেশন চলমান ছিলো। ব্র্যাক স্কুলের শিক্ষা কারিকুলাম বেশ চমৎকার ছিলো। তবে ইসলামী শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা ছিলো না। ইসলাম বা নৈতিক শিক্ষার যুক্ত হলে এটা ভালো প্রতিষ্ঠান হওয়ার সুযোগ ছিলো। 

পরিবার থেকে ইসলামী অনুশাসন মেনে চলার ব্যাপারে উৎসাহ দেওয়া হতো। স্কুলে যাওয়া শুরু হয়নি এমন বয়স থেকে নামাজ পড়ার ব্যাপারে বেশ কড়া নির্দেশ ছিলো। টেলিভিশন দেখা নিয়ে বেশ কড়া শাসন ছিলো, যদিও তখন এত টেলিভিশন গ্রামে ছিলো না। সারা গ্রামে মাত্র দুই চারটা টেলিভিশন ছিলো হয়তো। মানুষ দল বেধে টেলিভিশন দেখতো। পোশাক পরিচ্ছদের বিষয়েও আমাদের পরিবার থেকে উন্নত রুচির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। হাফপ্যান্টের পরিবর্তে লুঙ্গি পরতাম আমরা। কারণ হ্যাফপান্টে ফরজ তরক হয়। কুরআন পড়া শেখার তাগিদ ছিলো বেশ। 

কুরআন শেখা শুরু হয় বড় ভাইয়ের কাছ থেকে। খুব ছোটবেলা থেকেই মসজিদে গিয়ে আজান দিতাম, প্রত্যেক বছর আমাদের বাড়িতে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন হতো। সেখানে ইসলামী সংগীত পরিবেশন করতাম আমি। বাবার ইচ্ছেও ছিলো তার সকল সন্তান যেন ইসলামী শিক্ষা গ্রহণ করে, তাই তিনি অনেক পরিশ্রম করে হলেও আমাদের সে সুযোগ করে দিয়েছেন। 

পরিবারে ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে ইসলামের অনুশাসন মেনে চলার সুন্দর পরিবেশ সবসময় ছিলো। তবে ইসলামী আন্দোলনের জন্য নিবেদিত হয়ে কাজ করার বা ইসলামী আন্দোলনকে বুঝে নিজেকে গঠন করার সুযোগ তেমন ছিলো না। আমাদের পরিবারের বড় ভাই শিবিরের প্রথম কর্মী। গ্রামে কিছু মানুষকে দেখেছি সংগঠনকে ভালোবাসতে। তাদের সেই ভালোবাসায় যুক্তির চেয়ে আবেগ ছিলো বেশি। তবে আন্তরিকতার কমতি ছিলো না। আন্তরিকতাপূর্ণ ভালোবাসা নিয়ে যারা আন্দোলনমুখী ছিলেন তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য কুরবান আলী চাচা, আক্তার ফুফা। 

সঠিকভাবে আন্দোলনের প্রাথমিক দাওয়াত পাই আমার বড় ভাইয়ের মাধ্যমে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা পাশের গ্রামের আব্দুল গাফ্ফার চাচা সপ্তাহে এক দিন গান শেখাতেন। মনে পড়ে প্রথমে শিখেছিলাম কবি মতিউর রহমান মল্লিকের লেখা গান-

এসো না আল্লাহর নামে গান গাই, 

এসো না মনও প্রাণ জুড়াই 

আল্লাহ আকবার, বল আল্লাহ আকবার....

বড় ভাই বাইসাইকেলে করে গান শিখতে নিয়ে যেতে। আমি ৫ম শ্রেণিতে পড়া অবস্থান দেখতাম ছাত্রশিবিরের জেলার দায়িত্বশীল ভাইয়েরা আমাদের বাড়িতে আসতেন। কিন্তু বুঝতাম না এই সকল ভাইয়েরা সংগঠনের দায়িত্বশীল। 

যাহোক, আমি ৫ম শ্রেণিতে ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার পর বাড়ি থেকে সিদ্ধান্ত হলো মাদরাসাতে ভর্তি হওয়ার। একদম নতুন অঙ্গনে ভর্তি হলাম। নিজ বাড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে নানা বাড়ি। সেখান থেকে মাদরাসায় পড়াশোনা শুরু। ভর্তি হলাম মাদরাসার ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে। সেখানে আমার নতুন অভিভাবক হলেন নানা। নানাও ছিলেন ধর্মীয় অনুশাসন পালনে আন্তরিক। ফজরের নামাজে নানা আমাকে প্রতিদিন ডেকে দিতেন। না উঠতে পারলে একটু রেগে যেতেন। তবে নামাজের গুরুত্ব বুঝাতেন আমাকে। 

৬ষ্ঠ শ্রেণি ছিলো আমার জন্য খুব চ্যালেঞ্জিং। কারণ আরবি তেমন পারতাম না। কিছু ক্লাসের বন্ধু ছিলো নিবেদিত। তারা খুব হেল্প করতো। তাদের কাছ থেকে প্রতিদিন সহযোগিতা পেতাম। তাদের মুখে একটি গান নিয়মিত শুনতাম-

বাড়ি থেকে মা আমাকে দিয়েছে চিঠি

বাড়ি যেতে হবে, পিঠা খেতে হবে

তবু যাওয়া হবে না যে- কিযে আমি করি, করি....

যার মর্ম তখন বুঝে উঠতে পারিনি। এখন বুঝছি এটা ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের একটি প্রিয় গান। ইউনিয়ন সভাপতি শামসুল ভাইয়ের তৎপরতায় প্রথম আমি ছাত্রশিবিরের ব্যক্তিগত রিপোর্ট রাখি। ইউনিয়ন সভাপতি ভাই নিজে তার বাইসাইকেলে করে বাসা থেকে প্রোগ্রাম নিয়ে যেতেন। এসব কিছু বুঝার আগে ছাত্রশিবিরের ৫ দফা কর্মসূচি মুখস্থ ও কর্মপদ্ধতি বই নোট করি। দাওয়াতি দশকে গ্রুপভিত্তিক নিজ ইউনিয়নের প্রত্যেক ছাত্রের নিকট দাওয়াত দেওয়া শিখি এই প্রিয় কাফেলার ভাইদের কাছ থেকে। 

আমি যখন ৮ম শ্রেণিতে পড়ি তখন নিজ বাড়ি থেকে মাদরাসায় যেতাম। আবারও আমার গ্রামের মানুষদের কাছাকাছি থাকার সুযোগ পেয়ে যাই। এসময় এক চাচাকে দেখতাম আন্দোলনের শপথের জনশক্তি হওয়ার জন্য অনেক প্রচেষ্টা করতে। আল্লাহ তায়ালা হয়তো সেই চাচাকে শপথের জনশক্তি হিসাবে কবুল করেনি। তবে তার পরিচর্যা করা অনেক ভাই পরবর্তীতে দ্বীনি আন্দোলনের দায়িত্বশীল হয়েছেন। সেই চাচা আমার কাছে খুব প্রিয় ছিলো। 

ইসলামী আন্দোলনের জন্য শপথ বা বাইয়াত গ্রহণ খুব গুরুত্বপূর্ণ। অনেক বিষয়কে সামনে রেখে শপথ নেওয়া হয়। কুরআন, সুন্নাহ ও রাসূল সা.-এর জীবন পর্যালোচনা করলে বাইয়াতের যে বিষয় সামনে আসে তাহলো- 

১. ঈমানী বাইয়াত তথা ইসলাম গ্রহণ করার বাইয়াত।

২. কুরআন-সুন্নাহ মেনে চলার বা নানান বিষয়ভিত্তিক আমলের বাইয়াত। 

৩. ইসলামি হুকুমাত প্রতিষ্ঠার জন্যে ময়দান প্রস্তুত করার বাইয়াত। 

৪. রাষ্ট্রপ্রধান বা খিলাফতের বাইয়াত। 

৫. জিহাদের বাইয়াত।

ইসলামী আন্দোলনের জনশক্তিরা কুরআন-সুন্নাহ মেনে চলার বাইয়াত এবং ইসলামী হুকুমাত প্রতিষ্ঠার জন্যে ময়দান প্রস্তুত করার বাইয়াত গ্রহণ করে। ইসলামি হুকুমাত প্রতিষ্ঠা হলে তখনই রাষ্ট্রপ্রধান বা খিলাফতের বাইয়াতের বিষয় আসে।

বাইয়াত বা শপথ গ্রহণের এত গুরুত্ব। এই শপথের প্রস্তুতি গ্রহণের ক্ষেত্রে আমার মাদরাসার শেখ ফরিদ ভাই ও তৎকালীন থানা সভাপতি শাহনুর ভাই সব সময় আমার হৃদয় জুড়ে অবস্থান করেন। আমাকে কাছ থেকে অনুপ্রেরণা দিয়ে গড়ে তুলেছিলো শেখ ফরিদ ভাই।

আমার ক্লাস কখন শেষ হবে তার জন্য অপেক্ষা করতেন শাহনুর ভাই। ক্লাস শেষে মোটরসাইকেলে চেপে ঘুরতে বেরিয়ে যেতাম। বিভিন্ন দিকে ঘুরে বিকেলে বসে যেতাম কোনো এক খোলা জায়গায়। ভাইয়ের এক দিনের নাসিহা আমার হৃদয়ে এখনও ভাসে। বিকেল বেলা প্রাইমারি স্কুলের মাঠে বসে দীর্ঘ কথা বললেন, তার মধ্যে অন্যতম কথা ছিলো আরশের নিচে ছায়া সংক্রান্ত হাদিসটি। “রাসূল সা. বলেছেন, সাত শ্রেণির মানুষকে আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিনে তার নিজের ছায়ায় আশ্রয় দিবেন। আর সেদিন আল্লাহর ছায়া ব্যতিত আর কারো ছায়া থাকবে না।” এই হাদিস বলতে গিয়ে ৬ নম্বর শ্রেণির কথা বিভিন্নভাবে বুঝিয়ে ছিলেন শাহনুর ভাই। তিনি সূরা আলে ইমরান থেকে রেফারেন্স দিয়েছিলেন ১৪ নম্বর আয়াতটি। যার অর্থ : “সে ব্যক্তি, যাকে কোনো উচ্চ বংশীয় সুন্দরী যুবতী কু-কাজ করার জন্য আহবান জানায়। এর উত্তরে সে বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি”। এই আয়াতটিই চারিত্রিক স্খলন থেকে রক্ষা করেছে আমাদের মতো অনেক তরুণকে। 

প্রিয় ভাইদের নিবিড় সাহচার্য আমাকে এই আন্দোলনের শপথের জনশক্তি হওয়ার সুযোগ করে দিলো। ইসলামী আন্দোলনের সঠিক চেতনা ও গুরুত্ব বুঝেছিলাম ভাইদের কাছ থেকে। 

তারপরও কেউ থাকে অনুপ্রেরণার মূল কেন্দ্র। সেই মূল কেন্দ্র ছিলেন আমার শ্রদ্ধেয় বাবা। আমার আদর্শ ও সাহসের পাওয়ার হাউজ। সব সময় অভয় দিয়ে পাশে থাকতেন তিনি। এই আন্দোলনে সঠিক ও সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করার জন্য যত ধরনের অনুপ্রেরণা দরকার তার সবটুকু পেয়েছি আমার বাবার কাছ থেকে। তার ত্যাগের কারণেই আমার দায়িত্ব পালন সহজ হয়েছে। আল্লাহর রহমত, সাহায্য ও মা-বাবার দোয়া হলো আমার পথ চলার শক্তি।  

লেখক : সম্পাদক, ছাত্র সংবাদ

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির