এ বছরের শেষে অথবা নতুন বছরের শুরুতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ক্ষমতার পালাবদল দেশের ইতিহাসে বড়ো একটি টার্নিং পয়েন্ট। বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের বাড়াবাড়ি ও বিরোধীদলের সরকারবিরোধী কঠোর অবস্থান এবং পশ্চিমা দুনিয়ার কূটনৈতিক তৎপরতার কারণে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এই সময়টিকে বিশেষভাবে বিশ্লেষণ করছেন। এহেন জটিল অবস্থার সমীকরণ খুঁজতে গেলে গত দুই-এক মাসের রাজনৈতিক ও পারিপাশ্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করতে হবে। দেশের এমন রাজনৈতিক সংঘাতময় মুহূর্তে আমেরিকান অ্যাম্বাসেডর পিটার হাস এখন সরকারি ও বেসরকারি দলের অন্যতম সমঝোতাকারী হিসেবে ভূমিকা রাখছেন বলে অনেকে মনে করেন।
এ কারণে সরকারি দল ও বিএনপি আলাদা আলাদাভাবে পিটার হাসের সাথে বৈঠক করেছে। সাথে বিভিন্ন দলের সমর্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও ব্যক্ত করছেন তাদের মতামত। তবে তার এমন তৎপরতা আওয়ামী লীগ ভালোভাবে নেয়নি। তাই তাদের তরফ থেকে ১৪ জন বাংলাদেশী নাগরিক যৌথভাবে ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্র দফতরে অভিযোগ দাখিল করেছেন। অভিযোগে পিটার ডি হাসের সাম্প্রতিক কার্যক্রম দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিঘ্ণ সৃষ্টি করছে এবং ভুল বোঝাবুঝি তৈরি করছে বলেও অভিযোগ করেছেন তারা। (সূত্র : বাংলা ইনসাইডার ও অন্যান্য পত্রিকা)
আওয়ামী লীগ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর দোহাই দিয়ে বিগত দুই নির্বাচনে জাতিকে ভেল্কি দেখিয়েছে। দিনের ভোট রাতে সম্পন্ন করার মাধ্যমে বিনাভোটের সরকার হিসেবে দেশে-বিদেশে বদনাম কুড়িয়েছে তারা। দেশের রাজনীতির এই কঠিন মুহূর্তে সকল রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের সুযোগ আওয়ামী লীগের সামনে থাকা সত্ত্বেও সংবিধানের দোহাই দিয়ে সংবিধানমাফিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে বুলি আওড়াচ্ছে। অথচ দেশের সিংহভাগ মানুষ মনে করে- আওয়ামী লীগের অধীনে কখনো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। ফলে সংকটের শেকড় যে অনেক গভীরে এখনও, তা সহজেই অনুমেয়।
কতিপয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং নির্ভরযোগ্য কিছু মিডিয়া মারফত জানা গেছে- সরকারপ্রধান নিজে ব্যক্তিগতভাবে পারিবারিক নানা সমস্যায় (ছেলে-মেয়ে) জর্জরিত আছেন। ঠিক সেই সময়ে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট চরমে। বলতে গেলে এই সময়টি হাসিনা সরকারের জন্য খুবই নাজুক। এরপরেও তারা ক্ষমতা সহজে ছেড়ে দিতে চাইছে না। গত দুই মাসের বৈদেশিক রেমিট্যান্স আয় তলানিতে। প্রায় সকল এলসি বন্ধ। আমদানি-রফতানির সাংঘাতিক দশা। আমেরিকার পক্ষ থেকে সরকারের অনেক ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের ওপর স্যাংশান দেওয়ার পরে গার্মেন্টস খাত থেকে বৈদেশিক রেমিট্যান্স আহরণ প্রায় অর্ধেকেরও বেশি কমে গেছে। এখন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এতটা ভঙ্গুর যে, নতুন মেয়াদে যে সরকার, দল বা জোটই ক্ষমতায় আসুক না কেন; তাদের পক্ষে দেশ পরিচালনা করা কষ্টসাধ্য হবে।
তবে কেউ কেউ মনে করেন- হাসিনা সরকারের দলীয় আমলা ও নেতাদের দীর্ঘদিনের দুর্নীতির কারণে দেশের অর্থনীতির চাকা যখন অচল, ঠিক এই মুহূর্তে এসে তারা সেইফ এক্সিট খুঁজছে। দেশের কয়েকটি জাতীয় পত্রিকা অর্থনীতির দুরবস্থার কথা প্রকাশ করেছে ইতোমধ্যেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের সকল নিয়মনীতি ভঙ্গ করে সরকারপন্থী নেতা/ব্যবসায়ীরা হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে নিচ্ছে। সরকারও গোপনে লোন নিচ্ছে, যা ব্যাংকগুলো প্রকাশ করতে পারছে না। দেশে নিত্যপণ্য উৎপাদন ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমদানি না বাড়ার কারণে চরম মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে, যা সামনের দিনগুলোতে আরো ভয়াবহ হতে পারে। বলতে গেলে দেশের অর্থনীতিতে এক চরম হযবরল অবস্থা চলছে।
এহেন অবস্থায় নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি না করে দেশকে আরও গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে সরকার। ফলে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের সহজ পথগুলোও বন্ধ হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া গৃহবন্দি। মরণব্যাধিসহ অনেকগুলো জটিল রোগে তিনি আক্রান্ত। বারবার তাঁর দল, পরিবার ও চিকিৎসকরা উপযুক্ত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার কথা কথা বললেও সরকার কর্ণপাত করেনি। বরং আইনের মারপ্যাঁচ দেখিয়ে তাদের তরফ থেকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক তাঁর বিদেশে যাওয়ার সুযোগ নেই বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন।
সরকারি বিভিন্ন সংস্থার গুম-খুন, বিরোধীদলের ওপর নির্যাতন, গ্রেফতার, হয়রানি ও মিথ্যা মামলায় হাজার হাজার নেতাকর্মীর গ্রেফতারের প্রতিবাদে বিরোধীদলগুলো এখন মুখর। এই পরিস্থিতিতে বিএনপিও কিছুটা কূটনৈতিক সাপোর্ট পেয়ে রাজপথে সরব হয়েছে। আবার অন্যদিকে আওয়ামী লীগও শান্তি সমাবেশের নাম দিয়ে সমাবেশ আয়োজন করে তাদের জনবলকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করছে। দলীয় নেতা-কর্মীদের চাঙ্গা রাখার অংশ হিসেবে দীর্ঘদিন দেশে অনুপস্থিত থাকা শেখ হাসিনার পুত্র সজিব ওয়াজেদ জয়ের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে গত ২৯ সেপ্টেম্বর একটি ছবি পোস্ট করা হয়েছিল। ছবিটিতে ভার্জিনিয়ার একটি গলফ ক্লাবে মায়ের জন্মদিন পালনের কথা উল্লেখ রয়েছে।
তবে কয়েকজন আইটি এক্সপার্ট ছবির ফ্যাক্ট চেক করে বলেছেন- ছবিটি ফেইক। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের অনেকে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে দাবি করেছে- যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘হাইটেক অ্যান্ড টেকনোলজি’ বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে সজিব ওয়াজেদ যোগদান করেছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও একইভাবে ‘খেলা হবে’, ‘তলে তলে আপস হয়ে গেছে’, ‘তাদের মুরব্বিদের সাথে রফাদফা হয়ে গেছে’ বলে দলের জনসমাবেশ নিজ দলের লোকদের উজ্জীবিত করতে চেষ্টা করছেন।
তবে ঘটনা যা-ই ঘটুক না কেন, রাজনৈতিক এই ডামাডোলে বিরোধীদলগুলো এই সরকারের অধীনে আর কোনো জাতীয় নির্বাচনে যাবে না বলেই নিশ্চিত বলা চলে। এহেন অবস্থায় আওয়ামী লীগেরও সেইফ এক্সিট ছাড়া আর কোনো পথ নেই। তারা ভালোভাবেই জানে- দেশের মানুষ ভালো নেই। কাঠামোগত কিছু উন্নয়নের বুলি আওড়িয়ে আর জামায়াত বিএনপিকে দোষারোপ করে বেশিদিন পার পাওয়া যাবে না।
তৃতীয় কোনো পক্ষ বা কারো চাপিয়ে দেওয়া সরকার যদি দেশে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে সেটাও দেশের জনগণ বা কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য সুখকর হবে না। দেশ এমনিতেই মহাসংকটে আবর্তে নিপতিত, আবার তৃতীয় পক্ষ ক্ষমতার হাল ধরলে দেশের জন্য হবে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা; যা দেশের জন্য দীর্ঘস্থায়ী কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে না। তাই সরকার ও বিরোধীদলগুলো মিলে জনরায়ের মাধ্যমে তাদের নেতা নির্বাচিত করতে পারলেই সবচেয়ে ভালো হতো। যদিও এখন আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকারের অবস্থা হয়েছে ‘চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী’ প্রবাদের মতো।
সম্প্রতি সেনাবাহিনী প্রধানের একটি বক্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি ৪ সেপ্টেম্বর একটি সেনা ক্যাম্প পরিদর্শনকালে বলেন, ‘দেশ ও জনগণের কেউ ক্ষতি করলে, তার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যেতে হলে অবশ্যই যাব; যদিও এটি আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য নয়। আমরা সবকিছুর শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই। তবে কেউ মরণ কামড় দিলে আমরাও প্রতিহত করব।’ (সূত্র : দৈনিক সমকাল) এর মধ্যে স্বল্প সময়ের জন্য আমেরিকা ও ভারত সফর করেছেন তিনি।
যেহেতু আওয়ামী সরকারের অপরাধের ফিরিস্তি লম্বা, তাই সহজে যে তারা জাতির কাছে ক্ষমা পাচ্ছে না; তা ভালো করেই জানে। ফলে দেশে একটি কেওয়াজ লাগানোর পাঁয়তারা করছে তারা। সেটি নাইন-এলিভেনের চেয়েও কঠিন হবে হয়তো। আগেরবার লগি-বৈঠার কেওয়াজ ছিল, এবার হয়তো ভিন্ন কায়দায় কেওয়াজ লাগাবে; যা কোনোভাবেই কোনো দেশপ্রেমিক দল বা ব্যক্তি প্রত্যাশা করতে পারে না। যদি সত্যিই নাইন-এলিভেনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে, তাহলে অকার্যকর ও ব্যর্থ এক রাষ্ট্রে পরিণত হবে বাংলাদেশ।
লেখক : সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি
Email : [email protected]
আপনার মন্তব্য লিখুন