এখন টক অফ দ্যা কান্ট্রি হলো বাংলাদেশের উপর আমেরিকার ভিসানীতি ইস্যু। আলোচনার মূখ্য বিষয় হচ্ছে এতে দেশের কী কী ক্ষতি হতে পারে? এই পরিস্থিতি কি আওয়ামী লীগ সরকার সামলাতে পারবে? তাহলে কি সামনের নির্বাচন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সংঘটিত হবে? বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে উপরিউক্ত বিষয়গুলো নিয়ে দেশের ভেতর ও বাহির, সর্বত্রই চলছে তুমুল আলোচনা। পত্র-পত্রিকা, টিভি-টকশো এমনকি চায়ের কাপেও ধোঁয়া উঠেছে এসব নিয়ে। উল্লেখ্য যে, ২০২৩ সালের শেষে বা ২০২৪ সালের শুরুর দিকে বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।
একদিকে আওয়ামী লীগ চাইছে ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন ব্যবস্থা নিজেদের করায়ত্তে রেখে পুনরায় ক্ষমতায় সমাসীন হতে আর বিরোধী দলগুলো অতীতের অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের এমন নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে প্রত্যাখ্যান করে নির্দলীয় দল-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ফ্রি এন্ড ফেয়ার লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির মাধ্যমে নির্বাচন প্রক্রিয়া অনুষ্ঠানের ব্যাপারে দৃঢ় মত প্রকাশ করে আসছে। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ নিরপেক্ষভাবে আদৌ অনুষ্ঠিত হবে নাকি দেশ সংঘাতের দিকে যাচ্ছে এই নিয়ে মানুষের জল্পনা-কল্পনা ও আশঙ্কার শেষ নেই। আমেরিকার সাথে আওয়ামী সরকারের দীর্ঘদিন ধরে নানা বিষয় নিয়ে দূরত্ব তৈরি হয়েছিলো, এবারের ভিসা নীতিমালার মাধ্যমে তা আরো প্রকাশ্যে এলো। এই নীতি কার্যকর হলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হবে শেখ হাসিনা ও তার দলের দুর্নীতিবাজ সাঙ্গ পাঙ্গরা। কারণ, তারা গত এক-দেড় দশকে কাড়ি কাড়ি টাকা বিদেশে পাচার করেছে, বাড়ি-গাড়িসহ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে দেশ এবং দেশের বাহিরে। আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে তাদের একনায়কতন্ত্র, দুর্নীতি ও দলীয়করণের কারণে দেশের মানুষ অতিষ্ঠ। নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হরণ, আইনের শাসন ভূলুন্ঠিতকরণ ও মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সরকার উন্নয়নের নামে দেশে কিছু ব্রীজ কালভার্টসহ কাঠামোগত কিছু উন্নয়ন জাতির সামনে বারবার উপস্থাপন করলেও প্রকৃত পক্ষে সরকারের সর্বমহলে দুর্নীতির কারণে দেশ তলাবাহীন ঝুড়িতে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক ঘোষিত বাজেটে তা আরো স্পষ্ট হয়েছে। দেশের মানুষ এখন মাথা পিছু ঋণে জর্জরিত। এই ঋণ অনাগত ভবিষ্যৎ নাগরিকদের স্কন্ধেও চেপেছে। ডলার সঙ্কট ও অব্যবস্থাপনার কারণে বিদ্যুত কেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে বিদ্যুত বিভ্রাটের কারণে জনজীবন অতিষ্ট হয়ে উঠেছে। এরমধ্যে সামনে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতিও চলছে। এহেন অবস্থায় আওয়ামী লীগ সরকার একদিকে দেশের বিরোধীদল সমূহের চাপের মুখে অন্যদিকে আমেরিকাসহ এর মিত্র দেশসমূহের চাপের মুখেও। আওয়ামী লীগ এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করে কি নির্বাচনী বৈতরণী পার করতে পারবে? এহেন প্রশ্ন সর্ব মহলের।
আমেরিকার সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক সব-সময় ভালো ছিলো। সম্পর্কের ক্ষেত্রে মাঝেমধ্যে হেরফের হলেও তা পুনরায় বহাল তবিয়তেই তার পূর্বরূপে ফিরে এসেছে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর সেই সুসম্পর্ক ধীরে ধীরে দুঃসম্পর্কে পরিণত হয়েছে। আমারিকাতে বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টরের প্রায় ২০% পণ্য রপ্তানি হয়। যেটি বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টরের বড় বাজার। বাংলাদেশের সাথে আমেরিকা যে সম্পর্ক, সেটি শুধু বাংলাদেশের প্রয়োজনে নয়, বরং আমেরিকার প্রয়োজনে তারা বাংলাদেশকে ব্যবহার করে সময়ের ব্যবধানে পরিস্থিতি এবং সুযোগ বুঝে চীনকে ঘায়েল করতে চায়। এছাড়াও বাংলাদেশকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে তাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব বলয় তৈরি করতে চায়। এমনকি কুটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে আমেরিকা সময়ের ব্যবধানে ভারতকেও তাদের হাতের মুঠোয় আনতে ভুল করবেনা। প্রয়োজনে ভারতকে খন্ড বিখন্ড করবে, তবে চীনকে শায়েস্তা করতে হলে ভারত ও বাংলাদেশকে আমেরিকার খুব প্রয়োজন। তাই মানবাধিকারসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে আমেরিকা জোর আওয়াজ তুলছে, যেন বাংলাদেশের নাগরিকদের কাছে তাদের একটা গ্রহণযোগ্য অবস্থান তৈরি করতে পারে। মাঠে আলোচনা যাই থাকুক না কেন, বাংলাদেশের সাথে হাসিনার শাসনামলের তিক্ত সম্পর্কের কারণে চাপে রেখে এই দেশকে তাদের করায়ত্বে রাখতে চায়। সে কারণে শেখ হাসিনার সরকার যথেষ্ট চাপে আছেন বলে তার বর্তমানের কাজকারবারে মনে হয়। আর এই সুযোগটি দীর্ঘদিন ধরে সরকারি জুলুম নির্যাতনের শিকার বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো সর্বোচ্চ চেষ্টা-প্রচেষ্টা দিয়ে গ্রহণ করতে চায়। বিরোধী দল মনে করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হবে শতভাগ। আর এটা যে শুধু বিরোধী দলগুলোরই অনুমান, তা নয়; বরং এমনটাই হবে তা শতভাগ নিশ্চিত। যার কারণে সেই ভয় থেকেই আওয়ামী লীগ সরকার প্রশাসনকে দেশের আইন শৃক্সক্ষলা রক্ষার কাজে নিয়োগ করার পরিবর্তে বিরোধী মতের লোকদের দমনে সর্বশক্তি দিয়ে নিয়োগ করছে।
ভারত হলো আওয়ামী লীগের সবচেয়ে নিকটতম বন্ধু। ভারতের কাছে দেশের স্বকীয়তা বিকিয়ে দিয়ে যে কোনো মূল্যে তারা বারবার ক্ষমতায় থাকতে চায়। আর ভারত বাংলাদেশকে সবসময় পরাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই দেখতে চায়। যাতে তারা তাদের আখের গোছাতে পারে। এবং তাদের সাম্রাজ্যবাদিতার খায়েশ মেটাতে পারে। ১৯৭১ সালে ভারত বাংলাদেশকে পকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহযোগিতা করেছিলো, সেই সহযোগিতার রেশ ধরে ভারত মাঝেমধ্যে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছে বলে প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে থাকে। সেই অবস্থান থেকে তারা বরাবর চায় বাংলাদেশ যেন তাদের করদ রাজ্য হিসেবে সার্বক্ষণিক তাদের তাবেদারি করে। আবার অন্যদিকে বাংলাদেশ হচ্ছে ভারতের অন্যতম বাজার। আওয়ামী লীগ সরকার ছাড়া পূর্ববর্তী সরকার যারাই ছিলো তাদের সাথে ভারতের কিছুটা বৈরি সম্পর্ক ছিল। এমনকি হাসিনার বাবা শেখ মুজিবের সাথেও ছিল। তবে বর্তমান আওয়ামী অপশক্তির অবৈধ সরকার তাদের ক্ষমতায় থাকার প্রয়োজনে ভারতকে স্বামী- স্ত্রীর সম্পর্কের মতো বলে দাবি করেছে। অথচ দেশের সিংহ ভাগ মানুষ ভারত বিরোধী। তারা চায় ভারত প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, প্রভূত্ববাদি বা তাবেদারির সম্পর্ক নয়। যদিও-বা ভারত ছলে-বলে কৌশলে তাদের মিশন বাস্তবায়ন করে চলছে তো চলছেই। এক্ষেত্রে তাদের মিশন বাস্তবায়নের অন্যতম প্রধান সহযোগী শক্তি হলো আওয়ামী লীগ ।
বাংলাদেশের সাথে আমেরিকার নানায় ইস্যুতে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়ে আসছিলো। এর মধ্যে বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের ওপর ভয়াবহ-জুলুমনির্যাতন, গুম, খুন, ক্রসফায়ার, অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার ও মিথ্যা মামলা, মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ নানা ইস্যুতে আমেরিকা এখন সোচ্চার। এই অবস্থায় বিরোধী মতের ওপরে অন্যায়ভাবে নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করা এবং সামনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমেরিকার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আগামী জাতীয় নির্বাচন যদি ফ্রি ফেয়ার এন্ড ক্রেডিবল না হয়, তাহলে তারা বাংলাদেশের ওপরে ভিসা নীতি প্রয়োগ করবে। যুক্তরাষ্ট্রের দপ্তর থেকে বলা হয়েছে- “বাংলাদেশে আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হতে বাধা দিলে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে। বুধবার এক টুইটবার্তায় প্রথমে এমন হুশিয়ারি দেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিংকেন। এর পর দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও বিষয়টি নিশ্চিত করে। এর আওতায় বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে তার জন্য দায়ী ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ দেওয়া হবে।” (যুগান্তর ২৫ মে, ২০২৩) এই ভিসানীতি চালু হলে দেশের বারোটা বাজতে পারে। গার্মেন্স সেক্টরে বড় ধরনের নেগেটিভ প্রভাব পড়বে। দেশ রেমিটেন্স হারাবে। আগে পরে শান্তি মিশনে নিয়োজিত সেনাবাহিনী ও পুলিশেকে জাতিসংঘের মধ্যমে প্রত্যাহার করে নিতে পারে। তাই স্যাংশানের ভয় উভয় বাহিনীও যথেষ্ট সতর্কভাবে সামনে এগুচ্ছে বলে মনে হচ্ছে ইদানীং। জামায়াতের ব্যাপারে যেসব পুলিশ কর্মকর্তা অতি-উৎসাহী ছিল, তাদেরও ইদানীং দেখা যাচ্ছে বক্তব্যের সুর পরিবর্তন হচ্ছে ধীরে ধীরে। আওয়ামী লীগ বর্তমান আমেরিকার এই হস্তক্ষেপকে মেনে না নিলেও তারা স্বীকার করে নিয়েছে যে, আমেরিকা চাইলে ক্ষমতার রদ বদল করতে পারে। শেখ হাসিনা গত এপ্রিলে তার অবৈধ সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, আমেরিকা চাইলে যে কোনো দেশেই ক্ষমতা ‘উল্টে-পাল্টে’ দিতে পারে। এ মাসে লন্ডনে তিনি বিবিসির সাথে এক সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেন “আমেরিকা আমাকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না।” (বিবিসি ২৮/০৫/২৩) তাই বলা চলে আমেরিকার ভিসানীতি শেখ হাসিনার ভীতকে নাড়িয়ে দিয়েছে। সেকারণে আওয়ামী লীগের টপ টু বটম আবোল তাবোল বকছে। গত ক’দিন আগে শেখ হাসিনা তার বক্তব্য বলেন, “বিশ ঘণ্টা প্লেনে জার্নি করে, আটলান্টিক পার হয়ে, ঐ আমেরিকায় না গেলে কিচ্ছু আসে যায় না। পৃথিবীতে আরো অনেক মহাসাগর আছে, অনেক মহাদেশ আছে। সেই মহাদেশের সাথে মহাসাগরেই আমরা যাতায়াত করবো আর বন্ধুত্ব করবো।” (০৩ জুন-২৩ বিবিসি)
এই যখন অবস্থা, তখন আওয়ামী লীগ আমেরিকা বিরোধী জোট দেশসমূহের সাথে যে কোনো মূল্যে মিত্রতা বাড়াতে চায়। যদিও-বা তা ভারতের জন্য হবে তিক্ততার। ভারতকে হাসিনা সরকার কতটুকু বোঝাতে সামর্থ্য হবে যে, তোমাদের জন্যই আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় যাওয়া দরকার। শেখ হাসিনার হাতে অবশ্য এছাড়া (ভারতকে ধর্ণা দিয়ে বোঝানো) আর কোনো বিকল্প নাই। তাই আওয়ামী লীগ বিশেষ করে চীন রাশিয়ার সাথে খাতির বাড়িয়ে আসন্ন নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে চায়। পাশাপাশি দেশকে জঙ্গি-রাষ্ট্র হিসেবে বিদেশে উপস্থাপন, নিজে ক্ষমতায় থেকে নিজের করায়ত্তে নির্বাচন, দিনের ভোট রাতে সম্পন্ন করার মত সব কুটকৌশল প্রয়োগের ক্ষেত্রে একচুলও ভুল করবে না। তবে তা কতটুকু সফল হবে তা সময়েই বলে দেবে। সেটিও যদি সম্ভব না হয়, তবে তারা নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য মরণ কামড় দিতেও ভুল করবে না। তাই ভিন্ন কোনো অপশক্তির হাতে তারা দেশের ক্ষমতা তুলে দিতে পারে বলে বিভিন্ন মহলে চাউর হচ্ছে। সে যাই হোক, শেষ ভালো যার সব ভালো তার। যদিও আওয়ামী লীগ তার মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অপরাজনীতির জন্যে বাংলাদেশের আপামর জনতার কাছে কস্মিনকালেও ক্ষমা পাবে না। তবে শেষটা যদি ভালো করে, সে ক্ষেত্রে পাপের ভার কিছুটা হলেও কমবে বৈকি!
লেখক : বিশিষ্ট কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
আপনার মন্তব্য লিখুন