post

বাইয়াত ও জামায়াত বিভ্রান্তি ও সমাধান

রেদওয়ান রাওয়াহা

১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআন মাজিদে তাঁর বান্দাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, তোমরা সম্মিলিতভাবে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। (সূরা আলে ইমরান-১০৩) এই আয়াতটা বুঝতে হলে আমাদেরকে তৎকালীন মুসলমানদের ইসলামপূর্ব জীবনাচরণকে বুঝতে হবে। ইসলাম আবির্ভাবের পূর্বে আরবের অধিবাসীরা সর্বক্ষণ পরস্পর পরস্পরের সাথে হানাহানি, কাটাকাটি ও যুদ্ধ-বিগ্রহ করে কাটিয়ে দিতো। কোনো না কোনো দ্বন্দ্ব, কোনো না কোনো সংঘাত তাদের মধ্যে লেগেই থাকতো।

উক্ত আয়াতটি মাদানি আয়াত। এই আয়াত যখন অবতীর্ণ হয়েছে, ঠিক এর সামান্য কয়েক বছর আগেও মদিনার অধিবাসীরা একে অপরের রক্ত-পিপাসু ও প্রাণ-সংহারকারী শত্রু ছিলো। এমনকি ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে সামান্যতম জ্ঞান রাখেন, এমন সকল ব্যক্তিগণ আওস এবং খাযরাজ গোত্রের কথা অবশ্যই জানেন। ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্ট সম্প্রদায় ইহুদিদের চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রে আওস এবং খাযরাজ নামক ভ্রাতৃপ্রতিম দুই গোত্র নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে এতো ভয়াবহভাবে লিপ্ত ছিলো যে, তারা এক-দুই বছর নয়, ১২০ বছর যাবৎ পরস্পর গৃহযুদ্ধে লিপ্ত ছিলো। যার মধ্যে সর্বপ্রথম যুদ্ধ ছিলো ‘সুমাইর’ আর সর্বশেষ যুদ্ধ ছিলো ‘বুআস’। এই দীর্ঘ ভ্রাতৃঘাতী ও আত্মঘাতী যুদ্ধে লেগে থাকার দরুন তারা নিজেদের যোগ্যতাসম্পন্ন সকল প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দকে হারিয়ে ফেলে। এটি ছিল তৎকালীন আরবের চিত্র এবং পুরো আরব জাহানের অবস্থা। এরপর এই লোকগুলোই যখন ইসলামের আলোয় অবগাহন করলো, তখনই তারা হয়ে গেলো পরস্পরের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু। হয়ে গেলো তাঁরা পরস্পর ভাইয়ের চাইতেও বেশি কিছু। মিটে গেলো মদিনার আওস ও খাযরাজ গোত্রের শতবর্ষব্যাপী চলা সেই অনৈক্য আর যুদ্ধ-জিঘাংসা। তাই তো জগদ্বাসীর রব মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা মুমিনদেরকে ঐক্যবদ্ধ থাকার নির্দেশনা প্রদান করার পরেই সেই বিভীষিকাময় পরিস্থিতি উত্তরণের নিয়ামত স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, “এবং তোমাদের প্রতি আল্লাহর নিয়ামাত স্মরণ করো, যখন তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু, তিনি তোমাদের অন্তরে প্রীতির সঞ্চার করলেন। ফলে তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহে পরস্পর ভাই ভাই হয়ে গেলে। তোমরা অগ্নি-গহ্বরের প্রান্তে ছিলে, অতঃপর আল্লাহ তোমাদেরকে তা থেকে রক্ষা করলেন। এভাবে আল্লাহ নিজের নিদর্শনাবলি তোমাদের কাছে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন যাতে তোমরা সঠিক পথ প্রাপ্ত হও।” (সূরা আলে ইমরান-১০৩)। এরপর এক আয়াত পরেই আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আর তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যাদের নিকট স্পষ্ট প্রমাণ আসার পরও বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে ও পরস্পর মতভেদে লিপ্ত রয়েছে; তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। (সূরা আলে ইমরান-১০৫)

ইসলামই মুসলমানদের মূল জামায়াত

উক্ত ঘটনা এবং উল্লিখিত আয়াতগুলোর আলোকে বুঝা যায় যে, মুসলমানদের মধ্যে মূলত একটা জামায়াতই থাকবে, সেটা হচ্ছে ইসলাম। আর সবাই মিলে এই ইসলাম নামক জামায়াতের অধীনেই সংঘবদ্ধ থাকবে। এর বাহিরে নিত্য-নতুন ফিরকা সৃষ্টি করে মুসলমানদেরকে দলে দলে বিভক্ত আর বিচ্ছিন্ন করা কোনো ক্রমেই জায়েজ নেই। এবং এই আয়াতের প্রেক্ষাপট, শিক্ষা, মূলভাব; সবকিছুই হচ্ছে এটা। এই ইসলামের বাহিরে যে বা যারা থাকবে, তারাই জাহিলিয়াতের মৃত্যুবরণ করবে। এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি কী? দেখতে পাচ্ছি, মুসলমানদেরকে ইসলাম থেকে মানুষের মনগড়া মতবাদের দিকে নিয়ে যাচ্ছে মুসলিম নামধারী নানাবিধ ব্যক্তি ও সংগঠন। যারা দ্বীন ছেড়ে এভাবে মানবীয় মতাদর্শের পেছনে ছুটে চলে, তাঁরা তো নিশ্চয়ই জাহিলিয়াতের পেছনেই ছুটছে। আর এই অবস্থায় মৃত্যু বরণ করা মানে তো জাহিলিয়াতের ওপরই মৃত্যু বরণ করা। কারণ, রাসূল সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি জামায়াতবদ্ধতা (ইসলাম) থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো, সে জাহিলিয়াতের ওপরই মৃত্যুবরণ করলো। (মুসলিম-১৮৪৮)

জাহিলিয়াতের পরিচয় 

এখন আসি জাহিলিয়াত প্রসঙ্গে। জাহিলিয়াত কী? জাহিলিয়াতের সংজ্ঞায় উম্মাহর কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব, গত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলিমে-দ্বীন, ইমাম সাঈয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘জাহিলিয়াত শব্দটি ইসলামের বিপরীত শব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ইসলাম হচ্ছে পুরোপুরি জ্ঞানের পথ। কারণ, ইসলামের পথ দেখিয়েছেন আল্লাহ নিজেই। আর আল্লাহ সমস্ত বিষয়ের পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখেন। অপর দিকে ইসলামের বাইরের যে কোনো পথই জাহিলিয়াতের পথ। ইসলামপূর্ব যুগকে জাহিলিয়াতের যুগ বলার কারণ হচ্ছে এই যে, সে যুগে জ্ঞান ছাড়াই নিছক ধারণা, কল্পনা, আন্দাজ, অনুমান বা মানসিক কামনা-বাসনার ভিত্তিতে মানুষেরা নিজেদের জন্য জীবন চলার পথ (বিধিবিধান) তৈরি করে নিয়েছিলো। যেখানেই যে যুগেই মানুষেরা এ কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করবে, তাকে অবশ্যই জাহিলিয়াতের কর্মপদ্ধতি বলা হবে।’ (তাফহিমুল কুরআন, সূরা মায়েদা, টীকা-৮৩)

অন্যদিকে জাহিলিয়াতের পরিচয়ে মুসলিম উম্মাহর অন্যতম এক শ্রেষ্ঠ-রত্ন ইমাম ইবনে কাসির রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ্, তাঁর রাসূলগণ ও দ্বীনের আইন-কানুন সম্পর্কে অজ্ঞতা, বংশ নিয়ে গর্ব-অহংকার প্রভৃতি যে সকল অবস্থার ওপর আরবের লোকেরা ইসলামপূর্ব যুগে ব্যাপৃত ছিলো, সে সকল অবস্থাকেই জাহিলিয়াত নামে অভিহিত করা হয়।’

ইমাম ইবনে কাসিরের শিক্ষক, শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘যার হকের জ্ঞান নেই, সে এক প্রকার জাহিলিয়াতে নিমজ্জিত। যদি কেউ হক সম্পর্কে জেনে কিংবা না জেনে হকের পরিপন্থী কথা বলে, তবে সেও জাহিল।’

প্রখ্যাত তাবেয়ি, ইমাম হাসান বসরী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর দেওয়া বিধানের বিপরীত বিধান প্রদান করাটাই জাহিলিয়াত।’ গত শতাব্দীর আরেকজন বিপ্লবী মুজাহিদ, মুফাক্কিরে ইসলাম, উস্তাদ শহীদ সাইয়্যেদ কুতুব রাহিমাহুল্লাহ জাহিলিয়াত প্রসঙ্গে বলেন, ‘আল্লাহর সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহাত্মক আচরণই জাহিলিয়াত।’ (ইসলামী সমাজ বিপ্লবের ধারা, পৃষ্ঠা: ২২-২৩)। এরপর তিনি আরেকটু খোলাসা করে বলেন- যে আকিদা-বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা, ইবাদাত-বন্দেগি ও রীতিনীতি এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর সমীপে আত্মসমর্পণের ভিত্তিতে রচিত হয় না, সেটাই জাহিলিয়াত। (ইসলামী সমাজ বিপ্লবের ধারা, পৃষ্ঠা: ১০৪)। উপরিউক্ত আলোচনা থেকে আমরা যা শিখতে পারি, তা হলো-

১. আল্লাহ যা দিয়েছেন ও রাসূলুল্লাহ সা. যা নিয়ে এসেছেন, তার বিপরীত কোনো কাজ করা, কোনো আইন বা বিধান প্রদান করাটাই হচ্ছে জাহিলিয়াত। সেটা ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান, সমাজ-পরিবার ও রাষ্ট্রে; যেখানেই হোক না কেন।

২. আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিধান সামনে থাকার পরও ইসলাম ও ইসলামী ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ছিন্ন করে মানুষের মনগড়া মতবাদ প্রতিষ্ঠার-আন্দোলনে শামিল হওয়াটা জাহিলিয়াত।

৩. একমাত্র ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো নির্দিষ্ট দলকেই কেবল দ্বীন মনে করাটাও প্রকারান্তরে জাহিলিয়াত। সেটা যদি ইসলামী দল হয়, তবুও। কিন্তু এর বিপরীতে কোনো নির্দিষ্ট দল না করাটা অবশ্যই জাহিলিয়াত নয়। মুসলিম উম্মাহর সকল আলিম, ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী সকল সংগঠন; কেউই কখনো বলে না যে, নির্দিষ্ট কোনো দল বা সংগঠন না করলে জাহিলিয়াতের মৃত্যু হবে। তবে হ্যাঁ, বাতিল মতাদর্শের দলগুলো ব্যতীত!

ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠনগুলো কী বলে? 

এবার আসুন, ইসলাম-প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিবেদিত কাফেলাগুলো কী বলে? তারা কেউ কি তাদের নির্দিষ্ট সংগঠন না করলে জাহিলিয়াতের মৃত্যু হবে, তা বলে? নাহ, হুকুমাতে ইলাহী প্রতিষ্ঠার কাজে রত কোনো আন্দোলন বা সংগঠনই এমনটি বলে না। অন্তত আমি দেখিনি। তাহলে তারা কী বলে? তারা বলে, ইসলাম ছেড়ে বাতিল মতাদর্শের পেছনে ছুটে চলা, বাতিল মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করাটা জাহিলিয়াত। শুধু জাহিলিয়াতই নয়, বরং তারচেয়েও কঠিন কিছু। স্বয়ং আল্লাহ নিজেই বলেছেন তাঁর কাছে ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো কিছুই গ্রহণযোগ্য হবে না। (সূরা আলে ইমরান : ৮৫)। এবং যে বা যারা আল্লাহর বিধান ছাড়া ভিন্ন কিছু দিয়ে ফায়সালা করে, শাসন করে তারা জালিম-ফাসিক-কাফির। (সূরা মায়েদা : ৪৪-৪৭)

আমরা যদি ইকামাতে দ্বীনের কাফেলা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্র এবং ছাত্র অঙ্গনে কাজ করা ইসলামী ছাত্রশিবিরের সংবিধানের দিকে তাকাই, তাহলেও দেখবো যে তাঁরা সকল মানুষকে আল্লাহ প্রদত্ত দীনকে পরিপূর্ণভাবে অনুসরণের আহ্বান জানায়। বিশেষত যারা ইসলাম ছেড়ে জাহিলি জীবনপদ্ধতিতে নিবেদিত হয়ে আছে। যেমন, আমরা এখন দুনিয়ার দিকে দিকে দেখতে পাচ্ছি মানুষ আল্লাহর দেওয়া নির্ভেজাল দ্বীন ছেড়ে জাহিলি জীবনব্যবস্থার পেছনে ছুটছে। জাহিলি জীবন ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে দুনিয়াব্যাপী গড়ে তোলা হয়েছে এবং হচ্ছে খোদাহীন এক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা। মুসলমানগণও উম্মাহ চেতনা বাদ দিয়ে ভাষা, বর্ণ, গোত্র ও সীমানার সঙ্কীর্ণতায় আবদ্ধ হয়ে জাহিলি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র গড়ে তুলছে। সে রাষ্ট্রগুলোতে আবার আল্লাহর দেওয়া ও রাসূলের আনীত দ্বীন উপেক্ষিত। এখানে রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে, সমাজ থেকে নামাজকে, ইবাদাত থেকে সাকাফাতকে (সংস্কৃতি) আলাদা করা হয়েছে। এখনো নিয়মিতই হচ্ছে তা।

শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর সত্যিকারের গোলাম হিসেবে গড়ে ওঠার কথা থাকলেও সেটা না হয়ে বরং মানুষ মানুষের গোলাম এবং প্রবৃত্তির দাস হয়ে গড়ে উঠছে। মানুষকে মানুষের গোলামি সর্বোপরি মানুষকে নিজ উদগ্র নফসের গোলামি থেকে মুক্তি দেওয়ার মতো শিক্ষাব্যবস্থা তো অন্তত ৯০% মুসলমানের এই দেশে থাকার কথা। কিন্তু না, আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায়ও সেটা নেই। উল্টো শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে পৌত্তলিকতা-নাস্তিকতা-ধর্মহীনতার সবক দেওয়া হচ্ছে আমাদের মুসলিম ছাত্রছাত্রীদেরকে। এই শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে একজন ছাত্র মাস্টার্স শেষ করার পরেও কুরআন শিখতে পারছে না। মনবতার মহান শিক্ষক রাহমাতাল্লিল আলামিন মুহাম্মাদ সা.-কে জানতে পারছে না। আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম অন্তত সকালের মক্তবে কুরআনটা শুদ্ধভাবে শিখতে পারলেও এখন তা-ও পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েরা এখন সকালে ঘুম থেকে ওঠে চোখ কচলাতে কচলাতে ভোরের মক্তবে যায় না, বা যেতে পারে না। তারা কিন্ডারগার্ডেন-প্রাইভেট- কোচিংগুলোতে ছুটে চলে। যার ফলশ্রুতিতে মুসলিম ঘরের সন্তানেরাই ইসলামকে বাদ দিয়ে মানুষের মনগড়া তন্ত্র-মন্ত্র ও মতবাদের পেছনে ছুটছে হন্য হয়ে। সে লক্ষ্যে তারা নানানভাবে নানা-পদ্ধতিতে কাজ করছে। আন্দোলন ও সংগঠন প্রতিষ্ঠা করছে। এসব সংগঠনগুলোয় আবার মুসলিম নামধারী ব্যক্তিরাই যুক্ত হচ্ছে। যুক্ত হয়ে মুসলিম ভূমিগুলোতে সেসব জাহিলিয়াতের প্রচার-প্রসারও ঘটাচ্ছে। এসবকে আবার লুফে নিচ্ছে-অনুসরণ করছে অন্য আরেক দল মুসলমানের সন্তানেরাই।

প্রতিটি দেশে ও জনপদে এই যখন অবস্থা মুসলমানদের, তখন এসব থেকে মুসলমানদেরকে ফিরিয়ে এনে দ্বীনের ওপর, আল্লাহর দেওয়া আল-ইসলাম নামক জামায়াতের ওপর ঐক্যবদ্ধ করার জন্যই দেশে দেশে চালু হয়েছে আধুনিক ইসলামী আন্দোলনগুলো। তারা মানুষকে এক আল্লাহর অনুগত ও তাঁর রাসূলের অনুসরণকারী বানাবার জন্য গড়ে তুলছে সংগঠন। সেসব সংগঠন স্পষ্টভাবেই মানুষকে মানুষের গোলামি ছেড়ে আল্লাহর গোলামির ওপর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছে। আমরা যদি সরাসরি ছাত্রশিবিরের সংবিধানের দিকেই খেয়াল করি, তাহলে দেখবো যে, ছাত্রশিবির বলেছে; “আমরা ইসলামী বিপ্লব সাধনের প্রচেষ্টায় তৎপর ছাত্রগণ নিজেদেরকে একটি সংগঠনে সংঘবদ্ধ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছি যে-

এক. আল্লাহর আনুগত্য এবং রাসূল সা.-এর অনুসরণই আমাদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হবে। আমরা সকল প্রকার আনুগত্য ও দাসত্ব পরিত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহর আনুগত্য ও দাসত্ব অবলম্বন করবো। সর্বপ্রকার মত, পথ ও বিধান ত্যাগ করে একমাত্র রাসূল সা.-এর আদর্শ জীবন ও পদাঙ্ক অনুসরণ করবো। আমাদের এ আনুগত্য ও অনুসরণ জীবনের কোনো একটি বিভাগের জন্য হবে না, বরং জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগে পরিব্যাপ্ত হবে।

দুই. আমরা আমাদের জীবনকে ইসলামের আলোকে উদ্ভাসিত করে তুলবো এবং মানবসমাজকে আল্লাহর আনুগত্য ও রাসূল সা.-এর অনুসরণের দিকে ডাকব। আমাদের সংগ্রাম, সার্বিক প্রচেষ্টা একমাত্র এ উদ্দেশ্যেই নিয়োজিত থাকবে, যেনো পৃথিবীর বুকে আল্লাহর বাণী সর্বোচ্চ মর্যাদা লাভ করে, রাসূল সা.-এর প্রদর্শিত বিধান পৃথিবীর বুকে সঠিক অর্থে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মানবজাতি ইসলামের ভিত্তিতে তাদের সামগ্রিক জীবন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। 

তিন. বিশ্বব্যাপী ইসলামী বিপ্লবের পদক্ষেপ হিসেবে আমরা সর্বপ্রথম বাংলাদেশে ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য আমাদের সমস্ত শক্তি ও সামর্থ্য নিয়োজিত করবো। (সংবিধান : পৃষ্ঠা-০৫)

এরপর সংবিধানের দুই নং ধারাতেও তারা ঘোষণা করেছে যে, আল্লাহ প্রদত্ত রাসূল সা. প্রদর্শিত বিধান অনুযায়ী মানুষের সার্বিক জীবনের পুনর্বিন্যাস সাধন করে আল্লাহর সন্তোষ অর্জন করাই তাদের লক্ষ্য। জাহিলি জীবন-ব্যবস্থাকে উৎখাত করে যারা আল্লাহ প্রদত্ত নির্ভেজাল জীবন বিধান ‘দ্বীন-ইসলাম’ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশ নিতে চায়, তাদেরকেই তারা তাদের সংগঠনে সংঘবদ্ধ করে। (ধারা নং-০৩) এমনকি জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্রের তিন নং ধারাতেও তাঁরা ঘোষণা দিয়েছে যে, আল্লাহর সন্তোষ অর্জনই তাঁদের টার্গেট। 

আবার বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের মহীরুহ, জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর জাগরণী সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা উস্তাদ মওদূদী রাহিমাহুল্লাহ কেন সংগঠন গড়ে তুলেছেন, সে বিষয়ে তিনি বলেন- “মুসলমানগণ যেনো দ্বীন-ইসলামকে নিজেদের প্রকৃত জীবনবিধানে পরিণত করে। দ্বীনকে যেনো সার্বিক জীবনে সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। কথা ও কাজের মাধ্যমে দুনিয়ার সামনে যেনো দ্বীনের যথার্থ সাক্ষ্য দান করে। যেসব কথা ও কাজে ইসলামের বিরোধিতা এবং ভুল প্রতিনিধিত্ব হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তা থেকে যেনো মুসলমানগণ বিরত থাকেন। মুসলিমগণ নিজেদের কাজকে ইসলামের মানদণ্ডে যেনো যাচাই করে দেখে। তারা যেনো দ্বীন ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করা, যথার্থরূপে তার সত্যতার সাক্ষ্য দান করা এবং চূড়ান্তরূপে সত্যকে প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে ইসলামের প্রতি দুনিয়ার মানুষকে আহ্বান জানানোর জন্য নিজেদের যাবতীয় চেষ্টা-সাধনাকে নিয়োজিত করে।” (সত্যের সাক্ষ্য, পৃষ্ঠা-২৪)

এই হচ্ছে তাঁর সংগঠন প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্যের সারমর্ম। কিন্তু তিনি কি নিজের প্রতিষ্ঠিত দলকেই একমাত্র হক মনে করতেন? চলুন, সরাসরি তাঁর লেখা থেকেই বিষয়টা জেনে নিই। তিনি বলেন- “আমরা নিজেদের জামায়াত সম্পর্কেও কোনোরূপ গোঁড়ামি করিনি অথবা কখনো এমন কথা বলিনি যে, সত্য কেবল আমাদের জামায়াতেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। আমরা পুরোপরি দায়িত্ব সচেতন হয়েই এ কাজের জন্য মাথা তুলে দাঁড়িয়েছি এবং আপনাদেরকেও আপনাদের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। এখন আপনারা আমাদের সাথে উঠে দাঁড়াবেন, না নিজেরাই স্বতন্ত্রভাবে দায়িত্ব পালন করবেন কিংবা অন্য কোনো দায়িত্ব পালনকারীর সাথে মিলে কাজ করবেন, তা আপনাদেরই বিবেচ্য।” (সত্যের সাক্ষ্য, পৃষ্ঠা-৩৩)

তাহলে আমরা দেখতে পেলাম যে, মাওলানা তাঁর প্রতিষ্ঠিত দলকেই কেবল হকের ঝাণ্ডাবাহী সাব্যস্ত করেননি। অন্যান্য দ্বীনি জামায়াতগুলোকেও হক থেকে বিচ্যুত করেননি।

মুসলমানের নিকট ইসলামের দাবি যা, ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের নিকট সংগঠনের দাবিও তা-

ইমাম হাসান আল-বান্না বলেন, “ইখওয়ানুল মুসলিমিন তার সকল পদক্ষেপ ও পরিকল্পনায় ইসলামী সীমারেখার পরিপূর্ণ অনুসারী। এটি যে ইসলামের ওপর ঈমান পোষণ করে, তা রাষ্ট্রকেও ততোটাই জরুরি স্বীকৃতি দেয় যতোটা তাবলিগ ও নসিহতকে দেয়। ... যারা মনে করেন ইসলামের শিক্ষা জীবনের আধ্যাত্মিক দিক অথবা ব্যক্তিগত ইবাদতের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ, জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই, তারা কঠিন ভ্রান্তির মাঝে নিমজ্জিত। ইসলাম যেমন আকিদা বিশ্বাসের নাম তেমন ইবাদতের নাম। দেশ, জাতি, দ্বীন, রাষ্ট্রব্যবস্থা, আধ্যাত্মিকতা ও বাস্তব কর্মের নাম। ইসলাম একদিকে কুরআন অপরদিকে তরবারিরও নাম।” (বই : ইসলামের পুনর্জাগরণে ইখওয়ানুল মুসলিমুনের ভূমিকা)

অন্যদিকে উস্তাদ মওদূদী বলেন, “প্রকৃতপক্ষে একজন মুসলমানের কাছে ইসলাম যা দাবি করে, জামায়াতর রুকনদের কাছে আমাদের দাবি তারচেয়ে বেশি কিছু নয়। আমরা ইসলামের মূল দাবির ব্যাপারে না অণু পরিমাণ কিছু বাড়াতে চাই আর না তা থেকে কিছু মাত্র কমাতে চাই। আমরা কোনোরূপ কাটছাঁট না করে প্রতিটি মানুষের সামনে পূর্ণ ইসলামকেই পেশ করে থাকি এবং তাদেরকে এই মর্মে আহবান জানাই যে, এই দ্বীনকে বুঝে-শুনে সচেতনভাবে গ্রহণ করুন। এর দাবিগুলো ভেবে-চিন্তে ঠিকমত আদায় করুন এবং নিজেদের চিন্তা, কল্পনা, কথা ও কাজ থেকে এর নির্দেশ ও ভাবধারা বিরোধী যাবতীয় বস্তুকে বের করে দিন ও নিজেদের সমগ্র জীবন দ্বারা ইসলামের সত্যতার সাক্ষ্য দান করুন।” (সত্যের সাক্ষ্য, পৃষ্ঠা-২৯)

তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, যে দীনকে আল্লাহ ঐক্যবদ্ধভাবে আঁকড়ে ধরতে বলেছেন, মুসলিমগণ সে দ্বীন-ইসলাম ছেড়ে বৈরাগ্যবাদ, সেক্যুলারিজম, ন্যাশনালিজম, লিবারেলিজম, কমিউনিজম-সহ ইত্যাদি মানবরচিত জাহিলিয়াতের বিধানের দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে যাওয়ার কারণেই সেসব থেকে ফিরিয়ে এনে আল্লাহর দ্বীনের পতাকাতলে সমবেত করার মহান উদ্দেশ্যেই ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠনগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কারণ, উক্ত মতাদর্শগুলো তো ইসলাম বহির্ভূত। এ ব্যাপারে কোনো আলিমেরই দ্বিমত থাকার কথা নয়। মুসলিমগণ এসব তন্ত্র-মন্ত্রগুলোর ওপর থাকা অবস্থায় মারা গেলে নিশ্চয় জাহিলিয়াতের ওপরই মৃত্যুবরণ করবে। মুসলমানদেরকে এসব জাহিলিয়াত থেকে ফেরানোর মহৎ কাজটাই আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে ইসলামী সংগঠনগুলো। তাদের উছিলায় অগণিত পথহারা মানুষ দ্বীনের দিশা পেয়েছে ও পাচ্ছে, আলহামদুলিল্লাহ! অতএব আমাদের উপরিউক্ত আলোচনার দুটো পয়েন্ট থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা গেলো যে, ইসলামী আন্দোলনগুলো মানুষকে তাদের নিজস্ব সংগঠনই করতে হবে, সেটা বলে না। এবং কেবল তারাই হকের নিশানাবরদার তা-ও বলে না। তারা ¯্রফে মানুষকে আল্লাহর দ্বীনের ছায়াতলে এসে সমবেত হবার কথা বলে, এবং দ্বীন কায়েম করতে বলে। যেভাবে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর কালামে পাকে বলেছেন, ‘তোমরা দ্বীন প্রতিষ্ঠা করো এবং এতে মতভেদ করো না।’ (সূরা শু’রা : ১৩)

দ্বীন কায়েম-বাইয়াতবিহীন মৃত্যু ও সংগঠন 

ইসলাম নামক জামায়াতকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা জামায়াতবদ্ধভাবে আঁকড়ে ধরতে বলেছেন যেভাবে, সেভাবেই তিনি দ্বীনকে কায়েম করতেও বলেছেন। কিন্তু আজকে মুসলিমদের অবস্থা কী? তাঁরা কি দীন কায়েম করছে, নাকি দিকে দিকে সেক্যুলারিজম-ন্যাশনালিজম ও পাশ্চাত্যের ধর্মহীন ডেমোক্র্যাসি কায়েম করছে? আমরা তো দেখতে পাচ্ছি যে, মুসলিমরা পাশ্চাত্য সমাজ-সভ্যতার প্রভাবে দ্বীনে হককে জবাই করে লা-দ্বীনি ব্যবস্থাকেই কায়েম করে যাচ্ছে। এখন লা-দ্বীনি ব্যবস্থার মূলোৎপাটন করে তদস্থলে দ্বীনে হককে কায়েম করতে জোরালো দাওয়াত ও তালিম-তরবিয়াতের পাশাপাশি অবশ্যই শক্তিশালী সাংগঠনিক পদ্ধতিও দরকার। আল্লাহর রাসূল তো কোথাও একসাথে তিনজনও গেলে একজনকে আমীর (সাংগঠনিক পদ্ধতি) বানিয়ে নিতে বলেছেন। সেখানে আল্লাহর দ্বীন কায়েমের জন্য কি সংগঠন ও সাংগঠনিক পদ্ধতির প্রয়োজন নেই? কুরআনুল কারিমও তো আমাদের জানাচ্ছে, ‘এমন একটি দল অবশ্যই থাকতে হবে, যারা মানুষকে সৎ-কাজের আদেশ দেবে এবং অসৎ-অনৈসলামিক কাজ থেকে বাধা প্রদান করবে।’ (সূরা আলে ইমরান : ১০৪)

এছাড়াও বাইয়াতবদ্ধতার বিষয়টা তো আছেই। কুরআনের পর সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও প্রসিদ্ধ যে দুটো গ্রন্থ, সেগুলো হচ্ছে বুখারি-মুসলিম। সহীহ মুসলিমে আছে, ‘যে ব্যক্তি বাইয়াতবিহীন মৃত্যু বরণ করলো সে জাহিলিয়াতের মৃত্যুই বরণ করলো।’ (মুসলিম-৪৮৯৯, মুসনাদে আহমাদ-৫৫৫১, ৬৪২৩) এছাড়াও সাহাবায়ে আজমাইন রাসূল সা.-এর কাছে নানান বিষয়ে বাইয়াতবদ্ধ হতেন। আল্লাহ তায়ালা দ্বীন-প্রতিষ্ঠার নেতৃত্ব দেওয়ার জন্যই নবী-রাসূলদেরকে পাঠিয়েছেন। এখন তো আমাদের মাঝে রাসূল সা. নেই। আল্লাহর পক্ষ থেকে আর নবী-রাসূল আসবেও না। আবার এদিকে ইসলামী হুকুমতও নেই। তাহলে আজকে আমরা বাইয়াত নেবো কার কাছে? আমরা কি বাইয়াতবিহীন ভাবেই থাকবো? বাইয়াতহীন জাহিলিয়াতের মৃত্যুকেই হেসে হেসে বরণ করে নেবো?  রাসূল সা.-কে যদি আল্লাহ ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রেরণ করে থাকেন, তাহলে আজকে যাঁরা রাসূল সা.-এর রেখে যাওয়া দ্বীন ইসলাম ও ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠায় লড়াইরত; সেই লড়াইরত সংগঠনের আমীরের কাছে বাইয়াত নেওয়াটাই কি যুক্তিযুক্ত নয়? বাইয়াতহীন থাকার চাইতে তো ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠারত কোনো সংগঠনের অধীনে দ্বীনের ওপর চলা ও দ্বীন কায়েমের ব্যাপারে বাইয়াতবদ্ধ হওয়া কিছুটা হলেও তো উত্তম। তাই তো খিলাফত ও খলিফা না থাকায় ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা সেই বাইয়াতটা ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠায় লড়াইরত সংগঠনের নেতৃত্বের হাতেই নেয়। 

ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা যখন দ্বীন কায়েমে লড়াইরত সংগঠনের অধীনে বাইয়াতবদ্ধ হয়, তখন কেউ কেউ এটা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও তাঁরা কিন্তু মতপার্থক্যের ঊর্ধ্বে উঠেই বলেন যে, বাইয়াত হতে হবে ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্র-প্রধানের কাছে। কিন্তু এখন তো ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা তথা খিলাফত কায়েম নেই। তাই ইসলামী হুকুমত কায়েমের দায়িত্ব কার? মানুষ যেনো খলিফার অধীনেই বাইয়াত নিতে পারে সেজন্য খিলাফত তথা ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েমের আন্দোলন কে করবে? দ্বীন কায়েম করা যেহেতু কুরআনেরই নির্দেশ, সেহেতু এটা যে মুসলিমদের ওপরই ফরজ; সে বিষয়ে তো দ্বিমত থাকারই কথা না। কিন্তু এর জন্য সংগঠন করা কি ফরজ? এ বিষয়ে আলিমগণ দ্বীনের প্রসিদ্ধ মূলনীতি- ‘যে কাজ আবশ্যক, সে কাজের ভূমিকাও আবশ্যক। আর যে কাজ হারাম, সে কাজের ভূমিকাও হারাম-এর আলোকে বলে থাকেন; যেহেতু দ্বীন কায়েম এবং ইসলামী হুকুমত কায়েম করা ফরজ, সেহেতু দ্বীন কায়েমের জন্য আন্দোলন ও সংগঠন গড়ে তোলাও ফরজ। তবে এটা কি ফরজে আইন (সবার জন্যই ফরজ) নাকি ফরজে কিফায়া (সব মুসলমানদের পক্ষ থেকে একটা অংশ করা) এ বিষয়ে কথা থাকতে পারে, হতে পারে আলোচনা। তবে তা যে ফরজ, এতোটুকুন তো নিশ্চিত। কিন্তু ব্যক্তি-স্বার্থে দলাদলি সৃষ্টি করে মুসলমানদের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি করা বৈধ নয়। আর ইসলামবহির্ভূত কোনো মানব-রচিত মতাদর্শকে কেন্দ্র করে সংগঠন-সংস্থা গড়া তোলা, যেগুলো ইসলামী জামায়াত থেকে মানুষকে সরিয়ে নিয়ে যায়; সেটা তো নির্দ্বিধায়ই হারাম। 

যাঁরা ইসলামী হুকুমত চান তাঁরা দলে দলে বিভক্তি কেন? : 

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, যাঁরা ইসলামী হুকুমত কায়েম করতে চান; তাঁরা কেন এতোটা দলে বিভক্ত? এতো এতো সংগঠন কি উম্মাহর জন্য ক্ষতিকর নয়? এখানে আমরা যদি একটা বিষয় খেয়াল করি, তাহলে দেখবো যে একটা ঘরে একাধিক রুম থাকতেই পারে। এটাই ঘরের মূল বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্য। যিনি যে রুমেই আশ্রয় গ্রহণ করুক না কেন; সবাই-ই মূলত একটা ঘরের মধ্যেই আছেন। সবার শেকড় ওই ঘরটাই। বাহিরে ঝড়-বৃষ্টি হলে ঘরের সবাইকে-ই কিন্তু রক্ষা করে। ঘরের মধ্যে যিনিই আশ্রয় গ্রহণ করুক না কেন, তিনিই নিরাপত্তা পান। ঘরের সব রুমের সৌন্দর্যও কিন্তু এক না। সব রুমে সব কিছু থাকেও না। একেক রুমে একেকটা। সবার সব রুম মিলিয়েই একটা ঘর, একটা দালান। হুবহু একটা বাড়িতেও অনেকগুলো ঘর থাকে। আবার একটা গ্রামের মধ্যেও অনেকগুলো বাড়ি থাকে। সকল-বাড়ি মিলেই কিন্তু একটা গ্রাম। তদ্রƒপ আমরা এসব সংগঠনকেও এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পারি। ইসলামকে ধারণ করে, ইসলামী হুকুমত কায়েমের জন্য কাজ করে, এমন প্রত্যেকটা সংগঠন, প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠান, প্রত্যেকটা ব্যক্তিকেই যদি এই দৃষ্টিতে দেখতে পারি; তাহলে বিষয়টা খুব সুন্দরভাবেই নেওয়া যায়। কারণ, সবার জন্য সব কাজ না। সবাই সব কিছু করবে না। একেকজন করবে একেকটা, একেকজন করবে একেক পদ্ধতিতে। কিন্তু কথা হচ্ছে সবার প্রতি সবার শ্রদ্ধাবোধ-মুহাব্বত থাকতে হবে। যেভাবে একই ঘরের অধিবাসীগণের মধ্যে একের প্রতি অন্যের থাকে। 

এই প্রসঙ্গে ইমাম মওদূদী রহিমাহুল্লাহ বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে যেহেতু ইসলামী জীবন-ব্যবস্থাটাই ছিন্নভিন্ন হয়ে আছে এবং এখন শুধু ইসলামী জীবন-ব্যবস্থা পরিচালনার প্রশ্ন নয় বরং নতুন করে প্রতিষ্ঠার-প্রশ্নই দেখা দিয়েছে, তাই এমন পরিস্থিতিতে গোটা উম্মতের জন্য আল-জামায়াত (একটি মাত্র দল) গঠন করা সম্ভব নয়। তাই প্রাথমিক পর্যায়ে এই উদ্দেশ্যে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন দলের কাজ করা ছাড়া উপায় নেই। এই দলগুলো যদি আত্মপূজা ও বাড়াবাড়ি থেকে মুক্ত থাকে এবং নিষ্ঠার সাথে ইসলামী উদ্দেশ্য ও ইসলামী পন্থাতেই কাজ করে যায়, তাহলে শেষ পর্যন্ত এগুলো একত্রীভূত হবেই। কারণ, সত্য পথের পথিকেরা বেশিক্ষণ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে পারে না, সত্যই তাদের একসূত্রে আবদ্ধ করে ফেলে। কেননা সত্যের প্রকৃতিই হচ্ছে ঐক্য, সংহতি ও একাত্মবোধের প্রেরণা দান করা। অনৈক্য ও বিভেদ কেবল তখনই দেখা দিতে পারে, যখন সত্যের সঙ্গে কিছুটা অসত্যের সংমিশ্রণ ঘটে, অথবা উপরে সত্যের প্রদর্শনী থাকলেও ভেতরে অসত্যই কাজ করতে থাকে। (সত্যের সাক্ষ্য : ২৮-২৯)

মহান আল্লাহর কাছে নিবেদন, আমরা মুসলিমরা যেনো দ্বীনে হকের ওপর অটল থেকে, তাঁরই জমিনে তাঁর বিধানকে কায়েম দেখে কিংবা সে পথে জিহাদ করতে করতেই তাঁর দরবারে সত্যের সাক্ষ্য হিসেবে উপস্থিত হতে পারি। তাবৎ দুনিয়ার সকল বাতিল মতাদর্শের মগজকে চূর্ণবিচূর্ণ করার কাজে যেনো আমরা মুসলিমগণ একে অপরের সহযাত্রী ও সহযোদ্ধা হতে পারি। ইবলিসের মন্ত্রণা, দুনিয়ার মোহ, বিরোধী শক্তির অপতৎপরতা যেনো আমাদের চিন্তাজগৎকে দ্বীন কায়েমের প্রেরণা থেকে দূরে সরাতে না পারে। কায়মনোবাক্যে কেবল এটুকুই ফরিয়াদ রব্বে রাহিমের কাছে। আ-মি-ন!

লেখক : গবেষক, কলামিস্ট ও ব্লগার

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির