post

আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা

গাজী নজরুল ইসলাম

১১ জুন ২০২৩

বাংলাদেশে বর্তমানে মহাজোট নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের সরকার ক্ষমতায়। আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা পরবর্তী একবার ১৯৭২ থেকে ৭৫ সাল পর্যন্ত মরহুম প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে এবং ১৯৯৬ থেকে ২০০০, ২০০৯ থেকে ২০১৩, ২০১৪ থেকে ২০১৮ এবং বর্তমানে ২০১৯-২০২৩, পর্যায়ক্রমে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন থাকে। সে ধারাবাহিকতায় বর্তমান সময়েও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মহাজোটের নেতৃত্ব দিয়ে ক্ষমতাসীন হয়ে দেশ পরিচালনা করছে। ১৯৭৫ পরবর্তী ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত টানা ২১ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বাইরে শুধু ছিল না, ঐ সুদীর্ঘ সময়ে অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব থেকেও বঞ্চিত ছিল। এ সময় আওয়ামী লীগ চলেছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে।

মরহুম প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কিন্তু শুধু আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন না, স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন এবং তৎপরবর্তী সময়ে তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি দলীয় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না, ছিলেন জনগণের প্রধানমন্ত্রী। দলীয় রাষ্ট্রপ্রধান নয়, থাকতে চেয়েছিলেন জনগণের রাষ্ট্রপতি হয়ে। কিন্তু আওয়ামী লীগাররাই তাকে শেষ পর্যায়ে জনগণের রাষ্ট্রপতি থেকে নিছক দলীয় রাষ্ট্রপতি বানিয়ে ফেলে, জাতির নেতা ও পিতা থেকে দলীয় নেতা ও পিতায় রূপান্তর করে। প্রখ্যাত সাংবাদিক ‘এ লিগ্যাসি অব ব্লাড’ এর লেখক অ্যান্থনি ম্যাসকার্নহাস তাঁর বইতে লিখেছেন  ‘তিনি জাতির বা দেশের প্রেসিডেন্ট না হয়ে তিনি আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্টে পরিণত হলেন।’ (ভাষান্তর- বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, অনুবাদক- মোহাম্মাদ শাজাহান)

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জনগণের প্রতি ভালোবাসা ছিল প্রগাঢ়। যে কেউ তার কাছে আসত আর তিনি অবলীলাক্রমে সবকিছু দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করতেন। যদিও সকল প্রতিশ্রুতি স্মরণে রাখা কিংবা পালন করা তার পক্ষে সম্ভব হতো না। রাষ্ট্রীয় কিংবা জাতীয় কোন সমস্যা সৃষ্টি হলে চাই তা রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক তিনি সাথে সাথে তা সমাধানের নির্দেশ দিয়ে দিতেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলগণ তা পালনে হয় পারঙ্গম ছিলেন না নয়তো বাস্তবায়নে বিভিন্ন জটিলতার কারণে ব্যর্থ হতেন। আর সে ব্যর্থতার দায়-দায়িত্ব এসে পড়তো উচ্চ হৃদয় প্রসারিত এ মহান ব্যক্তিটির উপর। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, স্বাধীনতা পরবর্তী এশিয়ার বিখ্যাত আদমজী জুট মিলের কর্মচারীদের বকেয়া পরিশোধ কল্পে বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিকভাবে সকল কর্মচারীদের এক মাসের বেতনের সমান বকেয়া আদায়ের নির্দেশ দিলেন। কিন্তু দেখা গেল সকল বাহ্যিক প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও নির্ধারিত সময়ে কর্মচারীদের পাওনা পরিশোধ সম্ভব হলো না। হাজার হাজার কর্মচারী ক্ষ্যাপা পাগলের মতো হয়ে রোষে ফেটে পড়ে আন্দোলনে, ভাঙচুর তছনছ শুরু করলো। বঙ্গবন্ধু শুনে ক্ষুব্ধ হলেন এবং পরবর্তী নির্দেশনা দিলেন, অবশ্য এর মধ্যে যা ঘটবার তা ঘটে গেল। এ উপলক্ষে আদমজীর এক তরুণ অফিসার মনের দুঃখে মন্তব্য করেছিলেন  ‘বঙ্গবন্ধু বৃষ্টি হওয়ার জন্য নির্দেশ দিতেন কিন্তু বৃষ্টি কেন হয় না তা তিনি বুঝতে চান না। খোদা আমাদের সহায় হন।’ (প্রাগুক্ত, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, অনুবাদক- মোহাম্মদ শাজাহান)

বঙ্গবন্ধু সদ্য স্বাধীন দেশে প্রধানমন্ত্রী হবেন, না রাষ্ট্রপতি হবেন, এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলেন। অর্থ সম্পদে তিনি নির্লোভ থাকলেও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার ব্যাপারে তার পরিবারের লোকজন এবং তাকে পরিবেষ্টনকারী দলীয় বলয়ের মোসাহেবগণ যারপরনাই প্ররোচনা দিতেন। যার কারণে তিনি প্রথমত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জনগণের প্রিয় প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাভার গ্রহণ করেন। এ ব্যাপারে ‘এ লিগ্যাসি অব ব্লাড’ এর লেখক অ্যান্থনি ম্যাসকার্নহাস তার বইতে লিখেছেন “তার পরিবারের লোকজন আর তার নির্বোধ চাটুকার উপদেষ্টাগণ তাকে দেশের সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণের জন্য প্ররোচিত করলেন। যত বেশি ক্ষমতা তার হাতে থাকবে তত বেশি অনুগ্রহ আর সম্পদের ফোয়ারা বইতে থাকবে চাটুকারদের মাথার উপরে।’ (বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, প্রাগুক্ত)

ঙ্গবন্ধু মাঝে মধ্যে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতেন। সদ্য স্বাধীন দেশে পাক হানাদার বাহিনীর সহযোগিতাকারীদের প্রাধান্যে দেশ নাকি ভেসে যাচ্ছিল। পাশে থাকা উপদেষ্টাগণ পরামর্শ দিলেন ‘কলাবরেটর অ্যাক্ট’ করে সব শালাদের ধরতে হবে, শাস্তি দিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয়ে গেল ‘কলাবরেটর অ্যাক্ট’, ২৪ শে জানুয়ারি ১৯৭২ সালে আইনটি পাস হলো। উদ্দেশ্য ছিল, ১৯৭১ সালের ৯ মাসব্যাপী পাক হানাদারদের হত্যাযজ্ঞে যারা সক্রিয় সহযোগিতা করেছিল তাদের শাস্তি প্রদান করা। শুরু হলো আইনি কার্যক্রম। দেখা গেল এ আইন বাস্তবায়নে দেশে প্রভূত গোলযোগ এবং সাধারণ মানুষ গণহয়রানির শিকার হতে লাগলো। বহু সক্রিয় হানাদার বাহিনীর দালাল গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হলো। অন্যদিকে বহু নির্দোষ ব্যক্তিও ক্ষমতাসীনদের ব্যক্তিগত রোষানলে পড়ে সর্বস্ব হারাতে বসল। এ বিষয়ে “এ লিগ্যাসি অব ব্লাড’ এর লেখক জনাব অ্যান্থনি ম্যাসকার্নহাস তার ঐ মৌলিক বইতে প্রতিপাদ্য বিষয় তুলে ধরেছেন  ‘কোর্টে দালালির অভিযোগে রাজাকার আলবদর ইত্যাদির বিচার ও দণ্ডাদেশ দেওয়া হতো। সে কোর্টের হাকিম নিয়োজিত হয়েছিল রাজাকারদের সর্দার। বিষয়টি ন্যায়বিচারের অভিনয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সরকার শেষ পর্যন্ত এ অভিযানের সমাপ্তি টানলেন। কিন্তু ততক্ষণে দেশের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা চরমে পৌঁছে গেছে।” (প্রাগুক্ত, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ)

স্বাধীনতা পরবর্তীতে ১৯৭২ সালের গ্রীষ্মকাল। দেশে হঠাৎ চাল-ডালের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেল। যুদ্ধের ফলশ্রুতির কথা বলে বঙ্গবন্ধু ঘটনা সামাল দেয়ার প্রচেষ্টা চালালেও পরিস্থিতি কোন রকমেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছিল না। অর্থলোলুপ মোসাহেব আর লুটেরা ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে তেল, নুন, সাবান থেকে শুরু করে সকল নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বুভুক্ষু মানুষের নাগালের বাইরে চলে যেতে লাগল।

বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নিয়ে মজুদদার আর চোরাচালানিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করলেন। “এ লিগ্যাসি অব ব্লাড” এর লেখক জনাব অ্যান্থনি ম্যাসকার্নহাস তার ঐ মৌলিক বইতে বিষয়টি এভাবে প্রক্ষেপণ করেছেন : ‘এবার এলো মজুধদার আর চোরাচালানিদের বিরুদ্ধে অভিযান। ব্যবস্থা নেওয়া হলো। বিভিন্ন ধরনের লোক দেখানো গোছের। কাজ হলো না কিছুই। রুই কাতলারা দিব্যি রয়ে গেলেন। কিন্তু চুনোপটুটি কেবল আটকা পড়লো অভিযানের ফলে। অবশ্য ঐ রুই কাতলারাও শাসকচক্র আওয়ামী লীগেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলো।” (প্রাগুক্ত, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ ৩৩, ৩৪ পৃষ্ঠা)

দেশের যখন এমনিতর অবস্থা, ক্ষমতা কুক্ষিগত, সরকারের সিদ্ধান্তহীনতা, চাটুকারদের অর্থ ভোগের আকাশচুম্বী লিপ্সা, কলাবরেটর অ্যাকশন অকার্যকর, দেশে অরাজকতা, নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যের অগ্নিমূল্য জনগণের নাভিশ্বাস, চোরাচালানি ও লুটেরাদের বেপরোয়া ভোগ আর লুণ্ঠন, দলীয় ক্যাডারদের সম্পদ সম্ভোগের বেসামাল প্রতিযোগিতা ঠিক এমনি এক মুহূর্তে ১৯৭২ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর ঢাকার পল্টন ময়দানে লক্ষাধিক জনতার এক অপ্রতিরোধ্য প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হলো। কার বিরুদ্ধে? মুক্তি আন্দোলনের মহান নেতা সাধারণ মানুষের আশা আকাক্সক্ষার কণ্ঠস্বর জনগণের প্রিয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে। এ প্রতিবাদ সমাবেশে নেতৃত্ব দিয়ে কঠোর ভাষায় প্রতিবাদী বক্তব্য দিলেন মুক্তি সংগ্রামের সংগ্রামী ছাত্র সংগঠক, প্রাক্তন মুক্তিসেনা, স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনকারীদের অন্যতম ছাত্রনেতা শেখ মুজিবের এককালের সবচাইতে বিশ্বস্ত অনুগামীদের একজন জনাব আ. স. ম আব্দুর রব।

“জনাব অ্যান্থনি ম্যাসকার্নহাস তার ঐ বই “এ লিগ্যাসি অব ব্লাড” এ বিষয়টি এভাবে বর্ণনা দিয়েছেন: “জনতার উদ্দেশ্যে রব বলেছেন, দেশের স্বাধীনতার পর একটা লোককেও না খেয়ে মরতে দেওয়া হবে না বলে শেখ মুজিব আশা দিয়েছিলেন। আজ খেতে না পেয়ে প্রচুর লোক মৃত্যু বরণ করছে। রোষান্বিত জনতার আবেগে অনুপ্রাণিত হয়ে রব তাদের অভিযোগের প্রতিধ্বনি তুলছিলো। ঐ অভিযোগ নামায় প্রধান প্রধান বিষয়বস্তু ছিল খাদ্যদ্রব্য সহ অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম জনগণের ধোরাছোঁয়ার বাইরে, চতুর্দিকে কেবল ঘাটতি, বাজার সুবিধা ভোগীদের হাতে, স্বজনপ্রীতি, সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতি, বেকারত্বের পাহাড়, গুম, ধর-পাকড়, পুলিশের অত্যাচার, দায়িত্বহীন সরকার, সংবাদপত্রের মুখ বন্ধ ইত্যাদি। রব ঘোষণা করলো ‘আওয়ামী লীগাররা পাকিস্তানিদের চাইতে অনেক বেশি জঘন্য আর দুর্নীতিবাজ।’ মুজিবের উদ্দেশ্যে রব বলেন, আপনি আমাদের বেপরোয়া ধর-পাকড় করছেন আর উৎপীড়ন এর সকল যন্ত্রপাতি আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছেন। আপনি আপনার বক্তৃতায় অস্ত্রের কথা বলেছেন। আপনি কি কোনদিন বন্দুক চালিয়ে দেখেছেন? আমরা জানি সত্যিকার অস্ত্র কিভাবে চালাতে হয়। রব মুজিবের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন,  ‘সেনাবাহিনী জনগণের উপর গুলি চালাবে না। কিন্তু আপনি যদি তাদের উপর চাপ সৃষ্টি করেন তাহলে তারা আপনার এবং শাসক গোষ্ঠীর উপর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।” (বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, প্রাগুক্ত- ৩১, ৩২ পৃষ্ঠা)

বাস্তবতার ঢাকা যেন উল্টো দিকে ঘুরে গেল। আঠারো মাস আগে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে যিনি শোষণ আর নির্যাতনের বাণ ছুড়েছিলেন, সে অভিযোগের বাণ আজ তারই দিকে বুমেরাং হয়ে ফিরে এলো। বঙ্গবন্ধুর জন্য এ অবস্থা সত্যিই দুঃখজনক। কিন্তু দৃঢ়চেতা শেখ সাহেবের মাঝে কোন অনুশোচনা বাসা বাঁধতে পারল না। তিনি প্রত্যয় নিয়ে ঘোষণা করলেন, “আমি জনগণের সাথে আছি এবং থাকব।” প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে তিনি নিজ সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে কতিপয়কে চোরাকারবারি, স্বজনপ্রীতি আর দুর্নীতিতে অভিযুক্ত করে বরখাস্ত করলেন। তিনি আরো ঘোষণা করলেন, “আমি কাউকে ছাড় দেবো না। যেকোনো অপরাধীর বিরুদ্ধে আমি কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।” দলীয় চাটুকার, প্রশাসন আর দুর্নীতিবাজ সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে এমনিতর কঠোর ব্যবস্থা নিতে দেখে জনগণের মধ্যে আশার সঞ্চার হলো। কিন্তু আশার সঞ্চার হলে কি হবে, তৎকালীন এক বাঙালি সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর এহেন সিদ্ধান্তে রুঢ় মন্তব্য করলেন, মন্তব্যটা আমরা “এ লিগ্যাসি অব ব্লাড” এর লেখক জনাব অ্যান্থনি ম্যাসকার্নহাসের লেখা থেকে উদ্ধৃতি করছি। “একজন বাঙালি সাংবাদিক আমাকে বললো নেতা সব ঠিক করে ফেলবেন! এবার তাহলে তামাশাটাই দেখ। এটা হবে তার একটা প্রতিশ্রুতি। পরবর্তী ঘটনাবলিই মুজিব পতনের নব অধ্যায়ের সূচনা করলো। শুরু হলো রাজনৈতিক চমৎকারিত্ব প্রদর্শনের পালা। তিনি একের পর এক জনগণের মৌলিক অধিকারসমূহ খর্ব করতে শুরু করলেন। সাংবিধানিক নিয়ম-কানুন, আইনের শাসন, বাকস্বাধীনতা, মতামতের অধিকার, সুযোগের সমতা ইত্যাদি সবই বিলুপ্ত হয়ে গেল। কায়েম হলো দুঃশাসনের চরম পরাকাষ্ঠা।” (প্রাগুক্ত, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, ৩২ পৃষ্ঠা)

একদিকে রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার চরম অরাজকতা, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তিবলয়ের ত্রিমাত্রিক বিভাজন এবং রাজশক্তি বিরোধী পক্ষের উপর শায়েস্তা করার কঠিনতম রাষ্ট্রীয় খড়গ, অপরদিকে দেশে বুভুক্ষু জনগণের নিদারুণ হতাশা, দলীয় আমলা, উপদেষ্টা, এমপি এবং মোসাহেবদের ক্ষমতা ও সম্পদ কুক্ষিগত করার অসম্ভব পাঁয়তারা, সরলমনা শেখ মুজিবকে ভুল এবং চাটুকারী পরামর্শে বিপথগামী করার চক্রান্ত, মুক্তিযুদ্ধের জনপ্রিয় নেতৃত্বের যেমন জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, জেনারেল ওসমানী প্রমুখ ব্যক্তিদের রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সতর্ক দুরে অবস্থান এবং প্রতিবাদী জনতার মুখপাত্র হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের জনপ্রিয় সংগঠক আ. স. ম আব্দুর রবের সূক্ষ্মদর্শী ও সুপরিকল্পিত শাণিত ঘোষণা বঙ্গবন্ধুকে অসহায়ত্বের দিকে ঠেলে দিয়ে পাগলপারা করে তুলেছিল। তিনি যেন তাঁর দলীয় আওয়ামী লীগের দ্বারাই দ্রুত এবং অবধারিতভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ছিলেন। যা থেকে যেন একটা মহামানবের পতনের সুর ‘রণিরণি’ বেজে উঠছিল। প্রখ্যাত সাংবাদিক, সাহিত্যিক মি. অ্যান্থনি ম্যাসকার্নহাস তার সুবিখ্যাত “এ লিগ্যাসি অব ব্লাড” গ্রন্থে বিষয়টি এভাবে স্মৃতিচারণে বিধৃত করেছেন, “মুজিব চতুর্দিক থেকে কেবলই জনগণের দুর্দশার কথাই শুনছিলেন। জিজ্ঞাসা করা হলে তাঁর চাটুকারেরা বেমালুম অস্বীকার করে বলত, এ সবই দুষ্টলোক আর রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের অংশবিশেষ। এভাবে পুরাকালের গ্রিকদেবতাদের মতো ওরা তাকে পাগল বানিয়ে দিলো।’ (বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, প্রাগুক্ত, ৩৫ পৃষ্ঠা)

এ যাবৎ আমরা আওয়ামী শাসনামলের প্রাথমিক স্তর ১৯৭১ থেকে ৭৫ এর কিয়দংশের একটা ছোট্ট চালচিত্র অবলোকন করালাম মাত্র। এভাবে এগিয়ে গেল ১৯৭৫ এর করুণ ও হৃদয়বিদারক রাষ্ট্রীয় পটপরিবর্তন। শুরু হলো ১৯৭৫ পরবর্তী সুদীর্ঘ একটানা ২১ বছরের আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে অন্তর্ধানের ইতিহাস। অবিসংবাদিত নেতা মরহুম প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এখানেই জনগণের মুজিব থেকে আওয়ামী লীগের মুজিবে পরিণত করা হয়েছিল। জনগণের প্রাণপ্রিয় প্রধানমন্ত্রীকে আওয়ামী লীগাররাই তাদের দলীয় প্রধানমন্ত্রীতে রূপান্তরিত করেছিল, বাংলাদেশের জনপ্রিয় রাষ্ট্রপতিকে আওয়ামী লীগের একাংশের রাষ্ট্রপতিতে রূপান্তর ঘটিয়ে এক অবিস্মরণীয় নেতাকে মি. অ্যান্থনি ম্যাসকার্নহাস এর ভাষায় “পুরাকালের গ্রিকদেবতাদের মতো ওরা তাকে পাগল বানিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিলো।”

আওয়ামী লীগের ক্ষমতা হারানোর সুদীর্ঘ একুশ বছরে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তাদের হৃত গৌরব বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ফিরে পাবার নিরন্তর প্রচেষ্টা চালায়। তারা যেমন ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত সময়ের দুঃশাসনের চিত্র জনগণের মন থেকে মুছে ফেলার কোশেশ করে, তেমনি নতুন নতুন পরিকল্পনা, নতুন নতুন প্রোগ্রাম নিয়ে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালায়। এ সময়ে তাদের গুরুত্বপূর্ণ এবং মুখোরোচক কিছু সেøাগান ছিল। যেমন- (এক) ভোট আর ভাতের অধিকার আদায় (দুই) বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার নিষ্পন্ন করা। ২১ বছরের মধ্যে ১৯৭৫ থেকে ৮০ এবং ১৯৮০ থেকে ৯০ এই পনেরো বছর মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের নেতৃত্বে দেশ পরিচালিত হয়েছিল এবং তারা সেনা অফিসার ছিলেন বিধায় ঐ সময়টাকে “সেনাদের শাসন” হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। আওয়ামী লীগ ঐ সেনা শাসনকে সামরিক শাসনের জাঁতাকল হিসেবে উল্লেখ করে দেশে নির্ভেজাল গণতন্ত্র চালু করার ও মুখোরোচক সেøাগান চালু করে এবং জননেত্রী শেখ হাসিনাকে ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’ আখ্যা দিয়ে জনগণের কাছে তাকে নির্ভেজাল গণতান্ত্রিক নেত্রীর অবয়বে দাঁড় করিয়ে গণতন্ত্রীমনা জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালাতে থাকে। সাথে সাথে জাতীয় নির্বাচনসমূহ যাতে করে কোনো ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে না হয় এবং তা তত্ত্বাবধায়ক সরকার অথবা কেয়ারটেকার সরকারের মাধ্যমে হয় সে পরিকল্পনাও গ্রহণ করতে থাকে। সেনা শাসক জনাব এইচ এম এরশাদ সাহেব সুদীর্ঘ একটানা ১০ বছর ক্ষমতায় থাকাকালীন আওয়ামী লীগ ঐ সেনা শাসনকে দেশের আর সব রাজনৈতিক দলের প্রচেষ্টার মত সরিয়ে দিয়ে নির্ভেজাল গণতান্ত্রিক সরকার কায়েমেরও চেষ্টা চালায়। এ সময়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম ক্ষমতাসীন সরকারের নেতৃত্ব ছাড়া ভিন্ন প্রক্রিয়ায় নির্বাচনপদ্ধতি চালুর অভিপ্রায়ে ‘কেয়ারটেকার’ সরকার পদ্ধতির ফর্মুলা পেশ করেন।

ঐ ফর্মুলা দেশব্যাপী বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। আওয়ামী লীগ ও ঐ ফর্মুলায় পেশকৃত পদ্ধতি গ্রহণ করে জামায়াতে ইসলামীর সাথে জোটবদ্ধ হয়ে যুগপৎ আন্দোলনে সেনাশাসক এইচ এম এরশাদ সাহেবকে গদি ছাড়াবার চেষ্টা চালায়। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিসহ অন্যান্য আরো গণতন্ত্রমনা দলগুলো এ আন্দোলনে শরিক হয়। একদা জামায়াতের প্রণীত ‘কেয়ারটেকার’ ফর্মুলাটি দেশে তৎকালীন এরশাদ সরকার বিরোধী সকল রাজনৈতিক দল এবং আপামর জনগণের কাছে একটি জনপ্রিয় সেøাগানে পরিণত হয়- যা ছিল “এই মুহূর্তে দরকার কেয়ারটেকার সরকার।” এ আন্দোলনে আওয়ামী লীগ অন্যান্য রাজনৈতিক দলসহ জামায়াতে ইসলামীর সাথেও  ‘কেয়ারটেকার’ সরকার কায়েম আন্দোলন সফল করার জন্য দফায় দফায় বৈঠক, আলোচনা, বক্তৃতা, বিবৃতি রাজপথে পদাচারণায় মুখর হয়ে ওঠে। কেয়ারটেকার আন্দোলন সফল হয়। এবং এরশাদ সাহেব পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়ে কেয়ারটেকার সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ১৯৯১ সালে সর্বপ্রথম মাননীয় বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক অথবা কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়। ঐ নির্বাচনে বিএনপি জামায়াত জোট সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না আসতে পারলেও ঐ নির্বাচনে সূক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ এনে সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।

এরপর ১৯৯৬ সালে বিচারপতি হাবিবুর রহমান সাহেবের নেতৃত্বে বাংলাদেশে দ্বিতীয়বারের মত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তাদের পূর্ব অনুসৃত নীতিমালা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী অংশগ্রহণ করে স্লোগান তোলে ভোট আর ভাতের অধিকারের কথা, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের কথা। সাথে সাথে একটি নতুন কৌশল অবলম্বন করে তাদের অতীত কার্যকলাপের জন্য জনগণের কাছে করজোড়ে ক্ষমা চায়, এবং একবারের জন্য হলেও ক্ষমতায় যেতে ভোট ভিক্ষার আবেদন করে। এবারের ভোটে আওয়ামী লীগ সমর্থিত জোট বিজয়ী হয়, এবং আওয়ামী লীগ সুদীর্ঘ একুশ বছর পর দেশে সরকার গঠন করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ফিরে পায়।

১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল। সম্ভবত আওয়ামী লীগের তথা মাননীয় শেখ হাসিনার জন্য সৌভাগ্যের প্রসূতির শাসনামল। এ সময়কালে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়ায় হাত দেয় এবং তা ত্বরান্বিত করে। আওয়ামী লীগ মনে করে তাদের মুখোরোচক সেøাগান সমূহের মধ্যে ভোট আর ভাতের অধিকার আদায়ে জামায়াত ও অন্যান্য দলের সাথে জামায়াত উদ্ভাবিত কেয়াটেকার আন্দোলন করে ভোটের অধিকার আদায় করেছি। ক্ষমতায় গিয়ে তো জনগণের ভাতের অধিকার নিশ্চিত করা হবে। তবে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সেøাগান শেখ মুজিব হত্যার বিচার। যেহেতু এটা তার দলীয় সেøাগান এবং নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি, সেহেতু এ বিচারপ্রক্রিয়া যেকোনো মূল্যে হোক সম্পন্ন করতে হবে। এ বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ঐ আমলে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নমূলক অনেক কার্যক্রম, কথামালা, বক্তৃতা, বিবৃতি প্রদান করে। চট্টগ্রামের এক জনসভায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেন, “চট্টগ্রামের জনগণ কি শাড়ি, চুড়ি পরে বসে আছে? আর যদি আমাদের একটা লাশ পড়ে, তবে প্রতিপক্ষের দশটি লাশ ফেলতে হবে।” রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে, সরকার প্রধান হয়ে, রাষ্ট্রের সমস্ত শক্তির উৎসসমূহকে হাতের কব্জায় রেখে নিরীহ জনগণের প্রতি এমন হুমকিকে বিদগ্ধজন কিভাবে নেবেন সেটা অবশ্যই বিবেচনা এবং চিন্তা-বিশ্লেষণের দাবি রাখে। বঙ্গবন্ধুর হত্যা প্রক্রিয়ায় বিচার চললো, প্রতিপক্ষের লাশ ফেলার হুমকি দেওয়া হলো, জেল জুলুম নির্যাতন চললো, সরকারি সম্পদ কোষাগার লুণ্ঠন হলো, প্রশাসন দলীয়করণ হলো, জনগণ বোধ করি আওয়ামী প্রশাসনের এহেন কার্যক্রম পছন্দ করেনি। দীর্ঘ ২১ বছর ক্ষমতায় না থাকার বেদনা আওয়ামী লীগ ভুলে গেলেও জনগণ বোধ হয় অতীত দুঃশাসনের কথা আবার স্মৃতিরপটে জাগরূক করে তুললো। আসলো ২০০১ এর সাধারণ নির্বাচন। মাননীয় বিচারপতি লতিফুর রহমান সাহেবের অধীনে অষ্টম এবং তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনে জনগণ আবার মুখ ফিরিয়ে নিলো আওয়ামী লীগ থেকে। ক্ষমতার মসনদে বসলো বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন জোট সরকার।

২০০১-২০০৬। বেগম জিয়া প্রধানমন্ত্রী। সংসদে শেখ হাসিনা বিরোধী দলীয় নেতা। সংসদের প্রথম প্রহরেই আওয়ামী লীগ বললো “সরকারকে এক মুহূর্ত শান্তিতে থাকতে দেওয়া হবে না।” চললো সংসদ বয়কট- অধিবেশন বয়কট, হরতাল আন্দোলন ঘেরাও, কাওরানবাজারে বাসে আগুন দিয়ে মানুষ পোড়ানো খুন হত্যা ধর্ষণ চোরাগুপ্ত আক্রমণ ইত্যাদি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থেকে প্রায়শই একটা কথা বলে থাকেন বিএনপি- জামায়াত আগুন দিয়ে মানুষ পোড়ায়। ওদের আর ভোট দিবেন না, ক্ষমতায় আসতে দেবেন না ইত্যাদি। অথচ ২০০১ থেকে ২০০৬ মেয়াদে বিএনপি- জামায়াতের শাসনামলে সহিংস এবং নাশকতা করতে যেয়ে আওয়ামী লীগ নেতা মীর্জা আযমের নেতৃত্বে একদল আওয়ামী লীগার ঢাকার বাণিজ্যবহুল এলাকা কাওরানবাজারে বাসে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে সাধারণ যাত্রীদের নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। এ ঘটনা বোধ করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভুলে গেছেন। এখন কথায় কথায় আগুন দিয়ে মানুষ পোড়ানোর কথা, লুটপাটের কথা আত্মসাতের কথা বলা হয়। অতীত ইতিহাসের আয়নায় আওয়ামী লীগ তাদের স্বচেহারা যদি নিরিখ দিয়ে অবলোকন করে তাহলে দেখা যাবে আগুন দিয়ে মানুষ পোড়ানোর রাজনীতি আওয়ামী লীগই প্রথম শুরু করেছিল। শুধু তাই নয় আওয়ামী লীগ নেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে প্রায়শই বলতে শুনি : আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দেশে উন্নতি হয় আর বিএনপি- জামায়াত জোট ক্ষমতায় গেলে দেশ রসাতলে যায়। লুটপাট হয়, আত্মসাৎ হয়, মানুষ খুন হয়, গুম হয়, প্রতিপক্ষের উপর হামলা হয়, মামলা হয়, দলীয়করণ হয়। কথাটা মাননীয় শেখ হাসিনা প্রায়শই বলে থাকেন। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন এমনতর ঘটনা যে কোন আমলে একবারেই ঘটেনি তা নয়, তবে এ নিবন্ধের প্রথম দিকে এবং ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত আওয়ামী শাসনামলের যে যৎকিঞ্চিৎ বর্ণনা এসেছে তাতে কি ঐ রূপ ঘটনাসমূহ লক্ষ্য করা গিয়েছিল? আবার ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ এবং ২০১৪ থেকে ২০১৮ এবং সেখান থেকে বর্তমান সময়েও কি ঐরূপ ঘটনা সমূহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে নাকি?

হায়রে নেত্রীবচন। নেতা নেত্রীদের বচন-বাচন, বাস্তব অবাস্তবতা এবং সত্য মিথ্যার নিরিখে একটু সমঝ করে বলা প্রয়োজন। গোয়েবলস যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন সে নিরিখে কথা বললে ইতিহাসও ক্ষমা করবে না, প্রজন্মও ক্ষমা করবে না। শুধু কেবল ক্ষমতার জোরে গলাবাজি করেই বাজিমাৎ করা যাবে। বিদগ্ধ নিপীড়িত শিকলবন্দি অসহায় জনগণকে বাজিমাৎ করা যাবে না।

শেষ হলো বেগম জিয়ার বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের ক্ষমতার পঞ্চবর্ষ ২০০১ থেকে ২০০৬ বাংলাদেশের ইতিহাসে এবার এক নব্য রাজনীতির অধ্যায় শুরু হলো। বিএনপি জামায়াত জোট সরকার সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় তাদের ক্ষমতা ছেড়ে দিলো মাননীয় রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমদের কাছে। তৎসময়কার সংবিধান অনুযায়ী তিনি নিজে প্রধান হয়ে অথবা অন্য কাউকে প্রধান করে কেয়ারটেকার সরকার গঠন করে ৬০ দিনের মধ্যে দেশে একটি সফল পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারতেন। কিন্তু বাদ সাধল আওয়ামী দলীয় ২০০৬ সালের ২৮ শে অক্টোবর দেশব্যাপী তাণ্ডব নৃসংশতা, হত্যাযজ্ঞ, অরাজকতা অবরোধের বিভীষিকা। ঢাকায় সাপের মতো পিটিয়ে পিটিয়ে আওয়ামী যুব ছাত্র ক্যাডাররা জামায়াত শিবিরের প্রায় অর্ধশত নিরীহ জনতা ছাত্রের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করল। উপজেলায় উপজেলায় অবরোধ করে ভীতিকর বিশৃংখল উচ্ছৃঙ্খল ক্যাডারদের তাণ্ডবের মাধ্যমে আগুন লাগিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ করে সারাদেশে অরাজকতার সৃষ্টি করল। আইন শৃংখলায় চরম অবনতি ঘটলো। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সারাদেশে উচ্ছৃঙ্খল অরাজকতার প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনীর উৎসাহী একটি অংশ মাননীয় মুরব্বি রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমদকে অব্যাহতি দিয়ে জনাব ফখরুদ্দীন আহমদকে বশংবদ কেয়ারটেকার সরকারপ্রধান বানিয়ে অলক্ষ্যে তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদ ঘুঁটি চালের সকল শক্তি হাতের মুঠোয় রেখে আপৎকালীন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব হাতে নিয়ে অনেক অযুহাত আশ্বাসের ফুলঝুরি ছড়িয়ে ‘শান্তির স্বপ্নের’ সঙ্গী বাংলাদেশের অলীক স্বপ্ন দেখিয়ে দাপুটে ক্ষমতাধরের আসনে বসে দেশ পরিচালনায় মহারাবণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। তার এ অগণতান্ত্রিক, অনাকাক্সিক্ষত ক্ষমতা লিপ্সু ভূমিকাকে সর্বাত্মক সমর্থন দিলেন শেখ হাসিনা এবং তার দল। সেনাপ্রধান মইন উ আহমদের পরিচালনায় ফখরুদ্দীন সাহেবের যে উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয়েছিল সে পরিষদের শপথ অনুষ্ঠানে অবজারভার হয়ে অন্যান্যদের তো হাজির ছিলেন শেখ হাসিনা, তার সাথী সাগরেদসহ শপথ অনুষ্ঠানে মাননীয় শেখ হাসিনাকে বেশ হাসোজ্জ্বল এবং সমর্থিত মনের বহিঃপ্রকাশ দেখা যাচ্ছিল এবং আবেগ উচ্ছ্বাস ভরে উক্তি করেছিলেন, “এ সরকার আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ফসল।” পরবর্তীতে এই ফসলি-গ্রুপের সাথে গোপন আঁতাত করে তিনি চিকিৎসার অজুহাতে বিদেশে যাওয়ার সময় এয়ারপোর্টের ভিআইপি লাউঞ্জে উচ্ছ্বাস úূর্ণ মনোব্যঞ্জনার পুনঃ উচ্চারণ করেছিলেন, “সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমাদেরই আন্দোলনের ফসল। তারা যে সব কার্যক্রম পরিচালনা করছে আমরা ক্ষমতায় গেলে তাদের ভুলত্রুটিগুলো রেটিফাই করে দিব। এটা অলক্ষ্যে কিংবা সরাসরি সেনা শাসনকে সমর্থন করার শামিল। এখানে বোঝা যায় শেখ হাসিনার সাথে সেনা সমর্থিত সরকারের একটি গোপন আঁতাত হয়ে গেছে। পরবর্তীতে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার চলে যাওয়ার সময় যেকোনো মূল্যে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসানোর ব্যবস্থা করে যাবেন। তাই, তাদের দেশের প্রতি ভৌতিক এবং চাপানো কৃতকর্মের জবাবদিহিতা করতে হবে না। ইতিহাস সাক্ষী। হলোও তাই। পরবর্তী ২০০৯ এর নির্বাচনে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতার মসনদে বিজেতার আসনেই বসিয়ে দিয়ে অলক্ষ্যে চুপিসারে বিদায় নিলো কারচুপির ষড়যন্ত্রকারী সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

ঠিক অনুরূপ দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল জাতির জীবনে ১৯৭৫ পরবর্তী মরহুম প্রেসিডেন্ট মেজর জিয়ার মৃত্যুর পর তৎকালীন সেনাপ্রধান এইচ এম এরশাদ যখন ক্ষমতায় সমাসীন তখন মাননীয় শেখ হাসিনা মুচকি হেসে বলেছিলেন “সেনা শাসনে আমি অখুশি নই।” অথচ এখন ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনাকে বলতে শুনি বাংলাদেশে সেনাশাসন চিরতরে বন্ধ করতে হবে। সেনারা যাতে চিরজীবনে আর ক্ষমতায় না আসতে পারে সেদিকে আমাদের সতর্ক দৃষ্টি জাগরূক রাখতে হবে। তিনি অতীতে পাকিস্তানের দুঃশাসনের বিরুদ্ধেও কথা বলেছেন। অথচ এখন বাংলাদেশের জনগণ মনেপ্রাণে অনুভব করে এবং বলে এদেশে পাক হানাদাররা যে দুঃশাসন চালিয়েছিল বর্তমানে জনগণ তার চেয়েও অধিক দুঃশাসনের মধ্যে আছে। অতীতে সেনারা যে দুঃশাসন চালিয়েছেন বর্তমানে বাংলাদেশের জনগণ তার চেয়ে অধিক দুঃশাসনের মধ্যে দিনাতিপাত করছে। তাই যদি হয় তবে প্রধানমন্ত্রীর এহেন বক্তব্য তার বাচনিক চরিত্রের সাথে সাংঘর্ষিক। নিজের শাসনামলের সময়কার জনগণ অতীতের সকল দুঃশাসনের জাঁতাকলের চাইতে পিষ্ট হবেন আর এর দায় দায়িত্ব অপরের কাঁধে চাপাবেন এটা তো হয় জনগণকে কলুর বলদ বানানোর শামিল, নয়তো নিজের ত্রুটি অন্যায় অন্যের কাঁধে চাপাবার বাহানা। 

এতো গেল দুঃশাসনের একদিক। অপরদিক হলো প্রশাসনসহ সবকিছু দলীয়করণ, আত্মীয়করণ করে নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় টিকে থাকার অপকৌশল। আর তা হলো ভোট আর ভাতের অধিকার আদায়ের কথা বলে জনগণকে অভুক্ত রেখে ভোটাধিকারকে চিরতরে বঞ্চিত করা। ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচন, একেবারেই ভোটারবিহীন নির্বাচন। ১৫৩ সিটে ডিক্লেয়ার্ড এমপি, নো-ভোট। বাকি সিটগুলোতে ছেঁড়া কাটা ব্যালটে, অনির্বাচিত ভোট। বাংলাদেশ দেখল সারা দুনিয়া দেখল এ ভোট অগ্রহণযোগ্য। সবচেয়ে কাছের বিশ্ব ভারত বললো নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার নির্বাচন। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একই সুরে সুর মিলিয়ে মনের গহিনে কুচিন্তা লুকিয়ে রেখে বাহানা করে বললেন নিয়ম রক্ষার নির্বাচনের পরপরই আলোচনা সাপেক্ষে আমরা সকলের অংশগ্রহণে আর একটা নির্বাচন করে নিতে পারব। কিন্তু ২০১৪ থেকে ২০১৮, পাঁচ বছর প্রায় অতিক্রান্ত হতে গেল সেই সময় আর এলো না। এটা নিছক রাষ্ট্রীয় প্রতারণা, ক্ষমতার ধাপ্পাবাজি, দলীয় ধোঁকাবাজি, আর ব্যক্তিগত ফাঁকিবাজি। কোটি কোটি জনগণের সাথে যারা এমন আচরণ করে তারা আর যাই হোক রাজনীতিবিদ নয়। বুনো জঙ্গলের হিং¯্র জানোয়ারের মত দানবীয় পশু কিংবা তার চাইতেও অধম (বালহুম আদল)। এ অধমদের সমাজ বন্য সমাজ পাশবিক সমাজ। তাইতো এ সমাজে দেখা যায় মানুষরূপী দলীয় বেদলীয় ক্যাডাররা প্রকাশ্যে স্ত্রী লিঙ্গের সাথে বেশ্যাবৃত্তি করে। মায়ামুখ কচিকাঁচা কিশোর কিশোরীর উপর পাশবিক হামলা চালায়। শুধু তাই নয় নিজের জঘন্য লালসা নিবৃত্ত করে আবার খুনও করে। এ কাজ তারা করে রাস্তাঘাটে, মাঠে, পার্কে, স্কুলে-কলেজে, ভার্সিটিতে, চলন্ত বাসে, হোটেলে হোস্টেলে, গোপনে ও প্রকাশ্যে, যেন হজরত লুত আলাইহিস সালামের অভিশপ্ত জমানা। শুধু তাই নয়, তারা লুটতরাজ করে প্রকাশ্যে গোপনে। ভিন্নমতের লোকেদের ছেলেদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হায়েনার মত, যে কোনো কারণে অকারণে হাতুড়ি, শাবল, দা, কিরিচ, লাঠি, পিস্তল দিয়ে আঘাত করে সাপ মারা বন্য কায়দায় রাস্তা ঘাটে মাঠে বাটে তাদেরই অধিপত্য আর কারো নয়। রাতের অন্ধকারে কিংবা প্রকাশ্য দিবালোকে ঠগ-বর্গীদের মত প্রতিপক্ষদের গলা চেপে মুখ চেপে, ধরে নিয়ে খুন করে ঐ কোথা কোনো ভূতুড়ে বাদাবনে নদীগর্ভে ফেলে দিয়ে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা লাশটি ডোবায় নর্দমায় নদীতে ভেসে ওঠে ৭ দিন পর। হতভাগ্য লাশের আত্মীয় স্বজনের করুণ আর্তনাদে দিগ্বিদিক হাহাকার। চাকরি বাকরি, অফিস আদালতে ঐসব মাস্তানদের একচ্ছত্র অধিকার। ভোটের বাজারে তাদেরই একক জয়জয়কার। আর কারো না, আর কেউ না শুধু তারাই যারা প্রশাসনযন্ত্রকে ভাড়াটে বানিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকতে গোপন চুক্তির ধোঁকাবাজির পসরা পাতিয়ে অনুষ্ঠিত করেছে ২০০৯ এর জাতীয় নির্বাচন, তেমনিই ২০১৪ এর পার্লামেন্ট নির্বাচন, তেমনই ২০১৮ সালের নিশিরাতের ব্যালট কাটার বিশ^কে হতবাক করার মধ্যরাতের নির্বাচন।

বর্তমানে দেশে চলছে ২০১৮ সালের সর্বকালের সর্বযুগের ধোঁকাবাজির ব্যালট ডাকাতির অবৈধ নির্বাচনে গদ্দিনশিন তথাকথিত উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে চলা গণতন্ত্রহীন, মানবতাহীন, দুঃশাসনের এক বেপরোয়া অবৈধ সরকার। অবৈধ পন্থায় ক্ষমতার সিড়িঁতে মজা-মৌজে আরোহণ করে এ সরকার একতরফাভাবে চালিয়ে যাচ্ছে অতীতের দুঃশাসনের কশাঘাতী তলোয়ার।

সবশেষে মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় সৈনিক আদর্শবাদী ঈমানদার মুক্তিযোদ্ধা মরহুম মেজর (অব:) এম এ জলিলের একটি ডকুমেন্টারি আলেখ্য যা এখান থেকে ৩৫ বছর আগে লেখা হলেও বর্তমান দেশ-জাতির প্রেক্ষাপটে সমভাবে প্রযোজ্য ‘অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা’ বইয়ের একটি কোটেশন দিয়ে শেষ করছি: “আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা লাভের প্রায় ১৭ বছর পরেও (বর্তমানে ৫১ বছর) আমাদের কোনো অভাব দূরতো হলোই না বরং যতদিন যাচ্ছে ততই যেন জাতি হিসেবে আমরা মর্যাদাহীন হয়ে পড়ছি, নিস্তেজ হয়ে পড়ছি, বুক ভরা আশা স্বপ্ন আজ রূপান্তরিত হয়েছে গ্লানি ও হতাশায়। সম্মান, জাতীয়তাবোধ, মর্যাদাবোধ, সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ এসব কিছু এখন বিধ্বস্ত। এক কথায় বিবেক আজ বিভ্রান্ত। সুবিধেবাদ এবং অযোগ্যতার মহড়ায় গোটা জাতি আজ নীরব নিশ্চল অসহায় জিম্মি।” 


লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক সংসদ সদস্য

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির