ইদানীং বিশ্বের তিন পরাশক্তি আমেরিকা, চীন ও ভারতের উপর্যুপরি তৎপরতা তাদের নিজ নিজ দেশের স্বার্থে পরিচালিত হলেও আমরা বাংলাদেশীরা যেমন উৎসুক, তেমন আতঙ্কিতও বটে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোতে তারই একটি প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত লক্ষ করা যায়। গত ২২ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাবু নরেন্দ্র মোদি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমন্ত্রণে তার বহু আকাক্সিক্ষত যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন। এ সফরকে ঐতিহাসিক বলে উল্লেখ করেছে ভারত। হোয়াইট হাউজও মোদি বাবুর এ সফরকে দু’দেশের সম্পর্ক আরো শক্তিশালী এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে নিরাপদ ও মুক্ত রাখতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেছে।
সফরের প্রাক্কালে উভয় দেশের সর্বোচ্চ গোয়েন্দা প্রধানদের কূটনৈতিক তৎপরতাও ছিল লক্ষণীয়। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা প্রধান জ্যাক সুলিভ্যান ইতোমধ্যে ভারতের গোয়েন্দা প্রধান অজিত দোভালের সাথে বিশেষ বৈঠকে মিলিত হয়েছেন। উক্ত বৈঠকে উভয় দেশের এবং আন্তর্জাতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট অনধিক ৫৬টি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে মিডিয়ার মাধ্যমে জানা গেছে। ভারতের ইকোনমিকস টাইমের দীপংকর রায় চৌধুরীর বিশেষ প্রতিবেদনসহ দ্য টেলিগ্রাফ, ডিপ্লোম্যাট, ইন্ডিয়া টুডে, হিন্দুস্তান টাইমস, বাংলাদেশের প্রথম আলো এবং বাংলাদেশ প্রতিদিন ঐ গোয়েন্দা বৈঠকের সারসংক্ষেপ প্রকাশ করেছে। উক্ত প্রতিবেদনসমূহে এমন কিছু তথ্য প্রকাশ পেয়েছে; যা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্র ছাড়াও খোদ বাংলাদেশের জন্য যেমন উদ্বেগজনক, তেমনি বিস্ময়কর।
যেমন বাংলাদেশের পত্রিকা প্রথম আলো ভারতের ইকোনমিকস টাইমের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে, ‘মোদির আমেরিকা সফরে জো বাইডেনের সাথে বাংলাদেশের শেখ হাসিনার হয়ে সুপারিশ করবে, যাতে আমেরিকা বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে হাসিনা সরকারের প্রতি সহনীয় ভূমিকা পালন করে।’ আবার কোনো কোনো মিডিয়া বলেছে, ‘গোয়েন্দাদের ৯০ মিনিটের বৈঠকেও এই বিষয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি।’ কিছুদিন পূর্বে ভারতের এক কূটনৈতিক বিশ্লেষক জিন্দাল স্কুল অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের অধ্যাপক শ্রীরাধাদত্ত স্পষ্ট বলেছিলেন, ‘ভারত সরকার আওয়ামী লীগের হয়ে আমেরিকার কাছে কোনো দেন-দরবার করবে না।’ বিবিসিকে দেওয়া এক বক্তব্যে বাংলাদেশে র্যাবের ওপর আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর সুরাহা করতে বাংলাদেশ সরকার ভারতের কাছে আমেরিকাকে বোঝানোর জন্য যে অনুরোধ করেছিল, শ্রী রাধাদত্ত তা অস্বীকার করেননি। (সূত্র : দৈনিক নয়া দিগন্ত; ২৯ মে ২০২৩)
অপরদিকে ভারতের আনন্দ বাজার বলেছে ভিন্ন কথা। মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ তুলবে মোদি। ভারত বলতে চায়- প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাংলাদেশের গুরুত্ব যথেষ্ট। সেখানে এমন কিছু করা বাঞ্ছনীয় নয়, যাতে সে দেশে মৌলবাদী, কট্টরপন্থী ও সন্ত্রাসবাদীদের কাছে ইতিবাচক বার্তা না যায়। পত্রিকাটি বলেছে, ‘বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সে দেশের ওপর আমেরিকার ক্রমবর্ধমান চাপ নিয়ে শেখ হাসিনা সরকার নয়াদিল্লির কাছে ঘরোয়াভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।’ পত্রিকাটি আরো বলেছে, ‘ভারতের জাতীয় গোয়েন্দা প্রধান অজিত দোভালের দফতর থেকে ঢাকাকে জানানো হয়েছে- ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের বর্তমান প্রশাসনের গুরুত্বের দিকটি প্রধানমন্ত্রী মোদি ওয়াশিংটন সফরে তুলে ধরবেন।’ নয়াদিল্লি এটাও বলতে চায়- ‘ওয়াশিংটনকে সেদেশে এমন কিছু করা উচিত হবে না, যাতে আওয়ামী লীগ সরকার চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ে।’ (সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন; ১১ জুন ২০২৩)
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ইতোমধ্যে চীন সফর করেছেন। মার্কিন ও চীনাদের মধ্যে দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছর পর এমন একটি কূটনৈতিক সফর সংঘটিত হলো, যা বিশ্ববাসীর কাছে উৎসুকের কারণও বটে। মার্কিন-ভারত উচ্চপর্যায়ের গোয়েন্দা বৈঠক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কূটনৈতিক সফর এবং এর পরপরই মোদি-বাইডেন দুই পরাশক্তির ঐতিহাসিক আলোচনা বর্তমান বিশ্বরাজনীতির অভাবনীয় দৃশ্যপট রচনা করতে যাচ্ছে বলে বিশ্ববাসী মনে করছে। বৈশ্বিক রাজনীতিতে উক্ত নাট্যমঞ্চের অভিনয় পর্বে যাই ঘটুক না কেন, এশিয়া প্যাসিফিকের ছোট্ট অথচ ভৌগোলিক অবস্থানগত গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপরাষ্ট্র বাংলাদেশের আগামী দ্বাদশ পার্লামেন্ট নির্বাচনের প্রাক্কালে এমন ঘটনাপ্রবাহে এদেশের সরকারি দল, বিরোধীদল রাজনৈতিক তথা আপামর জনসাধারণের মধ্যে নানারূপ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণসহ উৎকণ্ঠা এবং উদ্বিগ্নতার অন্ত নেই। এমনকি ঘুম হারাম হয়েছে পার্শ্ববর্তী ভারত রাষ্ট্রের মিডিয়া বিশ্লেষক কূটনীতিকদেরও।
বাংলাদেশের উৎকণ্ঠা-উদ্বিগ্নতার মূল কারণ হলো আগামী জানুয়ারি ২০২৪-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এবারের নির্বাচনে এমন এক গুমোট রাজনৈতিক আবহ তৈরি হয়েছে, যা দেশের অভ্যন্তরীণ পরিমণ্ডল ছাপিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নানাবিধ বিতর্ক-বৈরিতা এবং বিপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এ বিপত্তির মূল কার্যক্রমে যত না দায়ী আন্তর্জাতিক তৎপরতা, তারচেয়ে বেশি দায়ী বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নেতৃত্বের স্বৈরাচারী মানসিকতা, প্রগলভতা, একদেশদর্শিতা, জাতি বিভাজ্যতা এবং ক্ষমতালিপ্সায় বিদেশী প্রভু তোষণে সীমাহীন দাস মনোবৃত্তির পরিচয় দেওয়া। ওপরের আলোচনায় দেশি-বিদেশি কূটনীতিক, রাজনীতিক এবং বিভিন্ন মতাদর্শের মিডিয়া মন্তব্যে এবং বিশ্লেষণে তারই একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত বহন করে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- নির্বাচন হবে বাংলাদেশে, আর মাথাব্যথা বিদেশীদের; বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের। তাদেরই অন্তর্জ্বালা সমধিক। কারণটা কী? কারণ মূলত দুটো। প্রথম কারণ, ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নেহরু ডকট্রিনের প্রতিপাদ্য বিষয়ের অন্যতমটি ছিল- ১৯৪৭ সালে পাক-ভারত পার্টিশনের পর মিস্টার নেহরু বলেছিলেন, ‘কয়েক বছরের মধ্যে পাকিস্তান আবার ভারতের মধ্যে লীন হয়ে যাবে এবং মহাভারতে সবাই একীভূত হবে।’ ওই থিওরি অনুযায়ী ১৯৭১ সালে ভারত তৎকালীন পাকিস্তানকে ভারতের মধ্যে লীন করতে না পারলেও তার একটি অংশকে বিচ্ছিন্ন করতে সক্ষম হওয়ার গৌরবের আনন্দ মনে মনে অনুভব করে আসছে। সেই মানসিক বিজয়ের ধারাবাহিকতায় তৎকালীন পাকিস্তানের পূর্ব অংশ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের এত মাথাব্যথা।
বাংলাদেশের ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহ তাদের মাথাব্যথা ছিল বলে আজও বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ পেয়ে আসছে। ২০০৭-০৮ সালে বাংলাদেশের সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠায় এবং ২০০৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে তারা মাথা ঘামিয়েছে বলে কথিত আছে। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনেও প্রকাশ্যে মাথা ঘামিয়েছে তারা। এবার আবার ২০২৩ অথবা ২০২৪ সালের নির্বাচনেও তারা প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে মাথা ঘামাবে বলে ইতোমধ্যে দৌড়-ঝাঁপ শুরু করেছে। আর ওই সকল নির্বাচনে ভারত অতীতে যুক্তরাষ্ট্রের মানসিক সহায়তা পেত সাবলীলভাবে। কারণ চীন-রাশিয়ার যুগ্ম অক্ষশক্তির মোকাবিলায় ভারতের কাছে কিছু পাওয়ার অভিপ্রায়ে বাংলাদেশের বিষয়টা এযাবৎ ভারতের চোখ দিয়ে দেখার অভিনয় করে এসেছে।
তাই এতদিন ভারত বাংলাদেশের সকল পর্যায়ের রাজনৈতিক বিষয়ের এমনকি রাষ্ট্রীয় নির্বাচনে কোন ব্যক্তি বা শক্তি ক্ষমতায় থাকলে তাদের ওই নেহরুর ডকট্রিনের স্বার্থ বজায় থাকবে, সে লক্ষ্যে লাগামহীন হস্তক্ষেপ করে এসেছে। আর এ ব্যাপারে ভারত যতটা না দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী হয়ে গেছে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। এরা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য প্রকাশ্যে এবং নির্লজ্জভাবে ভারতকে স্বামীজীর প্রভুত্বে অধিষ্ঠিত রেখে কাকুতি-মিনতি ও দেন-দরবার করে দাসানুদাসের ভূমিকা পালন করছে। এদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারত সফরে গিয়ে ভারত সরকারের কাছে মিনতি করে এসেছেন, যেন এবারের নির্বাচনে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে তারা সর্বাত্মক সহযোগিতা করে। কী নির্লজ্জ দাস মনোবৃত্তির রাষ্ট্রীয় দৃষ্টান্ত!
ইতোমধ্যে সংঘটিত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বিশ্বরাজনীতির অন্যান্য সংবেদনশীল জায়গাগুলোতে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের আনুগত্য করেনি। এতে যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছে। ভূতাত্ত্বিক রাজনীতিতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় নিয়ে এবারের জাতীয় নির্বাচনে বাংলাদেশকে ভারতের চোখে না দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তাই ভারত বাংলাদেশের ব্যাপারে যতই নাক গলাক না কেন, যুক্তরাষ্ট্র সুকৌশলে তাদেরকে এড়িয়ে বাংলাদেশে ইতোমধ্যে স্যাংশন থেরাপি, ভিসা থেরাপির কূটনৈতিক কৌশল অবলম্বন করেছে।
এতে করে ভারত অতি সম্প্রতি আওয়ামী লীগের দেওয়া উপাধি ‘ভারত-আওয়ামী লীগ স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক’ কোনো রকমে বজায় রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সফরের প্রাক্কালে দোভাল-সুলিভ্যান বৈঠক, মোদি-বাইডেন সাক্ষাৎ ইত্যাদির চেষ্টা করেছে। এর মাধ্যমে তারা যুক্তরাষ্ট্রকে কিভাবে বুঝিয়ে এবারের মতো বাংলাদেশের ওপর তাদের স্বামিত্ব-প্রভুত্ব বজায় রাখতে পারে, সেই কসরত করার নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর সেই নিরন্তর চেষ্টার ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশকে সান্ত¡না দেওয়ার জন্য বিভিন্ন সময়ে জাঁদরেল জাঁদরেল কূটনীতিক পাঠিয়ে, পত্র-পত্রিকায় বিশ্লেষকদের দ্বারা বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করছে- ‘আমরা ভারত তোমাদের আছি এবং থাকব এবং বাইডেনের সাথে সম্মুখ সাক্ষাতে এটাই বুঝাব যে, যদি বাংলাদেশে হাসিনার সরকার এবারেও ক্ষমতায় না আসে, তবে বাংলাদেশ এক ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীদের ভূমিক্ষেত্রে পরিণত হবে। সেটি হবে এ অঞ্চল তথা ভারতের জন্য অশনিসংকেতস্বরূপ।’
সদম্ভঘোষিত তথাকথিত চতুর ভারত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে এটাও বোঝাতে সক্ষম হবে- আমেরিকা যদি বাংলাদেশের ওই রূপ থেরাপি ধারা অব্যাহত রাখে, তবে আওয়ামী লীগের শেখ হাসিনা সরকার চিরশত্রু উদীয়মান পরাশক্তি চীনের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে। ভারতের আনন্দবাজার, হিন্দুস্তান টাইমস, দি ইকোনমিক্স ইতোমধ্যে প্রকাশিত দোভাল দফতরের ওই রূপ বক্তব্য-বিবৃতি মিডিয়া জগতে প্রকাশ করেছে। এতে একদিকে মোদি চাতুর্যের প্রগলভতাকে প্রকাশ করতে চেয়েছে, অপরদিকে হাসিনা সরকারকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার গদিনশিন চেয়ার ঠিক রেখে বাংলাদেশে ইতোমধ্যে যে ধারার কার্যক্রম চালিয়ে সফল হয়েছে, সেই ধারা অব্যাহত রাখার ইন্ধন জুগিয়েছে।
বিধি তো বাম হতে সময় লাগে না! চতুর মোদি তার চিন্তায় বোকা বাইডেনকে যে মানসিকতায় ট্রিটমেন্ট করার ফন্দি এঁটেছিল, বাইডেন তো সেই রূপ হাঁদাগঙ্গারাম বোকা ন্যাকা নন! তিনি তো এখনো বিশ্বরাজত্বে একক সিপাহসালারের দাবিদার। ইতোমধ্যে বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা সম্মেলনের এনএসসি কমিউনিকেশনের পরিচালক অ্যাডমিরাল জন কারবি বলে দিয়েছেন, ‘বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে ভারতের অবস্থান কী হবে, সে বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো মন্তব্য নেই। এ নিয়ে ভারতের অবস্থান একান্তই তাদের নিজস্ব। ভারত সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের কথা বলতেই পারে। তবে আমরা যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে বাংলাদেশে অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আমাদের আকাক্সক্ষা স্পষ্ট করে দিয়েছি। আমাদের ভিসানীতিতে এমন ব্যক্তিদের ভ্রমণ সীমিত করার উদ্যোগ নিয়েছি, যারা বাংলাদেশের নির্বাচনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তাই আমি শুধু আমাদের কথাই বলতে পারি।’ (সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন; ২২ জুন ২০২৩)
এ বিষয়ে পাঠক অনুভব করতে পারেন-বাংলাদেশে মোদি বাবুদের পরিকল্পনা কী আর মিস্টার বাইডেনের প্রশাসনের লক্ষ্য কী? এরপরও বলতেই হয়-মোদি বাবুদের যুক্তিতে বাইডেন প্রশাসন যা বোঝে, তারা তা বুঝুক। কিন্তু আমরা সাধারণ চিন্তার লোকেরা যা বুঝি, তা হলো-মোদি বাবুরা কোন যুক্তিতে, কোন চিন্তায়, কোন অভিপ্রায়ে এ কথা বলতে পারেন- ‘শেখ হাসিনা ক্ষমতায় না থাকলে বাংলাদেশে উগ্র মৌলবাদ, উগ্র সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দিয়ে এ অঞ্চলকে ভয়াবহ অরণ্যে পরিণত করবে?’ মোদি বাবু তার নিজের আয়নায় কি দেখতে পান না- বীভৎস ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীরা তো তার দেশেই অবস্থান করছে? গুজরাট দাঙ্গার বিভীষিকা এখনো উপমহাদেশের মানুষের মন থেকে মুছে যায়নি, যে রক্তক্ষয়ী সন্ত্রাসী দাঙ্গার ভিডিও ক্লিপ স্বয়ং মোদি বাবুই নিষিদ্ধ করে জনসমক্ষে প্রচারে বাধা সৃষ্টি করে রেখেছেন।
আর উগ্র মৌলবাদ? মোদিজির রাষ্ট্রই এর সূতিকাগার। ভারতীয় আরএসএস গোষ্ঠী, রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ, শিবসেনা-সন্ত্রাসবাদ; এরা কারা? সেদেশে সংখ্যালঘুদের ঘুম হারাম করেছে এরা। দেশ থেকে বিতাড়নের ব্যবস্থাপত্র পেশ করেছে। কথায় কথায় দাঙ্গা বাধিয়ে হাজার হাজার সংখ্যালঘু মা-বোন, যুবতী-যুবক, শিশু-বৃদ্ধকে রাস্তায় ধরে, মসজিদে, বাজারে তরবারি দিয়ে, বন্দুক দিয়ে হত্যা করে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। ধর্মনিরপেক্ষতার কালো চাদর গায়ে দিয়ে তারা ভারতে ‘এক হিন্দু এক রাষ্ট্র’ করার মহাপরিকল্পনা চালাচ্ছে। এরা তো সন্ত্রাসী মৌলবাদী উগ্র জঙ্গিবাদীদের গডফাদার! এরপরও তারা কোন লজ্জায় বেহায়ার মতো বলেছে- ‘বাংলাদেশে শেখ হাসিনা না থাকলে মৌলবাদী সন্ত্রাসবাদীর উত্থান ঘটবে?’ হায় লজ্জা, হায় শরম! ছি ছি মোদি বাবু! একটু নিজের চেহারা নিজের আয়নায় দেখলেন না?
আর যদি না দেখতে চান, তবে এবারের সফরে হোয়াইট হাউজের দেয়ালের ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখবেন, যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার সংস্থা আপনার গুজরাট দাঙ্গায় নিষিদ্ধ ব্লুপ্রিন্ট হাউজের রাস্তায় টাঙিয়ে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারে- আসল সন্ত্রাসী মৌলবাদী আর রক্তপিপাসু জঙ্গি কারা। এরপরও কথা হলো- মোদি বাবু! আপনি একটি গণতান্ত্রিক এবং কথিত অসম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের কর্ণধার হয়ে কী করে বাংলাদেশের ১৭ কোটি জনগণকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের শেখ হাসিনাকে নিয়ে চিন্তা করতে পারেন? শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ তো ক্ষমতায় রয়েছে অবৈধভাবে ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ১৪ বছর। এর পূর্বে একবার ১৯৯৬-তে ছিল পাঁচ বছর। মোট ১৯ বছর। বঙ্গবন্ধুর রাজত্বের কথাটা না হয় জমা করলাম না! তিনি তো আমাদের অবিসংবাদিত নেতা। তাহলে আওয়ামী লীগের হাসিনা দেশ চালাচ্ছেন মাত্র ১৯ বছর; তা আবার বিনা ভোটে, মধ্যরাতের কারচুপির ভোটে, সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়কদের রেটিফাই করে দেওয়ার চুক্তিতে বন্দুকের নলের ভয় দেখিয়ে ভোটার খেদানো গড়পেটা বাক্স ভরাটের ভোটে।
কিন্তু বাংলাদেশে তো এরা ছাড়াও জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে বিএনপি-জামায়াত সরকার, প্রেসিডেন্ট জিয়া সরকার, হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদের সরকাররাষ্ট্র পরিচালনা করেছে প্রায় ২৪ বছর। কই! ওই ২৪ বছরে তো বাংলাদেশে ভারতের গুজরাটি ভয়াবহতার নমুনা সৃষ্টি হয়নি, সংখ্যালঘু খেদানোর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অবতারণা হয়নি। আর মৌলবাদী? আসল মৌলবাদী তো আপনার রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ, এসএসআর এরাই! তবে আপনি কোন মুখে কোন লজ্জায় বাংলাদেশীদের মৌলবাদী, সন্ত্রাসী, জঙ্গিবাদী বলেন? এটা একটা মুখরোচক ধুয়া, যা আপনাদের নেহরু ডকট্রিনের আধিপত্যবাদ বিস্তারে বাংলাদেশের ১৭ কোটি জনগণের ওপর স্টিমরোলার চালানোর জন্য।
আপনি শতকরা ১৫ থেকে ২০ ভাগ ভোটের অধিকারী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসাতে চান, যার পরিসংখ্যান আপনার দেশের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। আপনার দৃষ্টিতে বোকা(!) বাইডেন আপনাদের শিয়াল পন্ডিতের কেচোগন্ডুসের সমীকরণ বুঝে ফেলেছে। তাই আমেরিকা বুদ্ধিমত্তার সাথে বারবার বলছে, ‘ভারত-বাংলাদেশে তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বজায় রেখে তারা কী করবে, সেটা তাদের নিজস্ব বিষয়।’ কিন্তু বাংলাদেশে এবার অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আমেরিকা তাদের অবস্থান সুস্পষ্ট করেছে, এখনো করছে। এতে তাদের কোনো ব্যত্যয় ঘটবে না।
এরপরের কথা হলো- ভারত আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রসমূহের আধিপত্য বিস্তারের খায়েশ নিয়ে অতি চালাকি করে বলতে পেরেছে, ‘আমেরিকা যদি বাংলাদেশের নির্বাচনের প্রাক্কালে স্যাংশন থেরাপির মতো চাপ অব্যাহত রাখে, তবে আওয়ামী লীগের হাসিনা সরকার চীনের দিকে ঝুঁকতে পারে।’ বাহ! কত বড়ো উচ্চমার্গের আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মেগাথিওরি! ভারত মনে করছে- বোকা আমেরিকা এ কথা শুনলেই আঁতকে উঠবে এবং চীনের ভয়ে বাংলাদেশকে ভারতের পেটে ঢুকিয়ে রাখার অব্যাহত ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে। তাই নাকি! ভারতের মতো একটি সার্বভৌম আধুনিক বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র আরেকটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের ব্যাপারে এমন মন্তব্য কী করে করতে পারে! বাংলাদেশ সিকিম না ভুটান? নাকি হায়দ্রাবাদ? নাকি গুজরাট?
স্বাধীন বাংলাদেশ স্বাধীন সত্তা নিয়ে বেঁচে থাকতে চায় এবং থাকবে ইন শা আল্লাহ। বাংলাদেশকে কখন ভারতের সাথে বন্ধুত্ব রাখতে হবে, কখন চীনের সাথে সম্পর্ক রাখতে হবে; সেটা তো বাংলাদেশের নিজস্ব ব্যাপার। এ ব্যাপারে ভারতের প্রেসক্রিপশন দেওয়ার কী আছে? বিশ্ববাসী জানে-চীনের সাথে ভারতের জাত-শত্রুতা। আবার পাকিস্তানের সাথেও জন্ম-শত্রুতা তাদের। অপরপক্ষে চীনের সাথে পাকিস্তানের অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব। ইদানীং পাকিস্তানের ইমরান খানের সরকারের ব্যাপারে তো চীন কিছুই করতে পারল না! আমেরিকা তো ঠিকই ইমরানকে গদিচ্যুত করে শরিফগংদের ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের ব্যাপারে তবে ভারতের এত মাথাব্যথা কেন? মাথাব্যথার তো একটাই কারণ- যা আগেও বলেছি, পুনর্বার বলছি। বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের সকল অযাচিত বচন-বাচনের অর্থই হলো- এদেশকে কোনোক্রমে ভারতের আশ্রিত ভেবে মনের গহীনে সন্ত্রাসবাদ আর ঘৃণ্য আধিপত্যবাদের নেহরু ডকট্রিনের বীজ লুকিয়ে রেখে সিকিম-ভুটানের পর্যায়ে পদানত করা।
প্রসঙ্গত বলতেই হয়- ভারতীয় আধিপত্যবাদ বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারকে বহাল রাখতে যে নিরন্তর প্রচেষ্টা-প্রপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছে, এক্ষেত্রে চীন ভারতের চিরশত্রু হলেও বাংলাদেশের ব্যাপারে আমেরিকার আধিপত্যবাদী নীতিকে মোটেই বরদাস্ত করতে পারছে না তারা। তাই বাংলাদেশের ক্ষেত্রে চীনের আপাতত এই নীতি। এখানে পার্থক্য হলো- ভারতের পলিসি বাংলাদেশকে গ্রাস করে ফেলা, আর চীনের পলিসি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ‘নো ইন্ডিয়া, নো আমেরিকা’ নীতি। চীন চায়- ভূ-রাজনীতিতে ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপরাষ্ট্রটি ভারত-আমেরিকা থেকে আধিপত্যমুক্ত হয়ে স্বাধীনচেতা পররাষ্ট্র পলিসিতে অগ্রসর হোক। সেই সাথে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং উন্নয়নে চীনের ‘ওয়ান ওয়ে নীতি’তে সহযোগী থাকুক।
এখন আসা যাক তথাকথিত মহাশক্তিধর যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়ে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকা পাকিস্তানের পক্ষে এবং ভারতের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। আমেরিকার পলিসি ছিল- মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত তৎকালীন পাকিস্তানের পূর্ব অংশ বর্তমান বাংলাদেশীরা স্বাধীন হোকবা না হোক; ভারতের যুদ্ধবাদী নীতিতে পাকিস্তান যেন ভারতের আগ্রাসনের শিকার হয়ে দ্বিখন্ডিত না হয়ে যায়। তারা যেন পাকিস্তানের কোনো অংশের ওপর ভৌগোলিক রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। আমেরিকার এটাও চিন্তা ছিল- রাশিয়া যেহেতু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিচ্ছে, সেহেতু তারা যেন ওই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। এ অঞ্চলে ওই সময় চীন যেহেতু পাকিস্তানের সহযোগী হিসেবে বিবেচিত ছিল, সেহেতু চীনকেও গুডবুকে রাখার চেষ্টা করা।
তাহলে সমীকরণে দেখা যাচ্ছে- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত-রাশিয়া এক মিত্র বলয়ে অবস্থান করছিল। আর আমেরিকা-চীন কেউ প্রত্যক্ষ এবং কেউ পরোক্ষভাবে অবস্থান নিয়েছিল পাকিস্তান বলয়ে। এখানে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পলিসি ছিল- তৎকালীন পাকিস্তানের পূর্বাংশ স্বাধীন হোক আর না হোক; ভারত-রাশিয়ার আগ্রাসনে পাকিস্তান যেন দ্বিখন্ডিত হয়ে না যায়। অপরপক্ষে ভারতের মনস্তাত্ত্বিক কূটকৌশল ছিল চিরশত্রু পাকিস্তানকে দ্বিখন্ডিত করার মাধ্যমে তার পূর্বাংশকে বিচ্ছিন্ন করে একদিকে পাকিস্তানকে দুর্বল বিড়োালের ভূমিকায় পর্যবসিত করা, অপরদিকে বাংলাদেশের ওপর প্রভুত্ব করার সুযোগ গ্রহণ।
এই সমীকরণের জটে পাকিস্তানের পূর্বাংশ অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ ছিল ক্ষমতাধরদের রাজনৈতিক প্লে-গ্রাউন্ড। খেলোয়াড় একপক্ষে ছিল ভারত-রাশিয়া মিত্রবলয়, অপরপক্ষে আমেরিকা-চীন-পাকিস্তান মিত্র নয়, সহযোগী বলয়। ‘মিত্র নয়’ এজন্য বললাম- রাশিয়া যে উদ্যম-উদ্যোগ নিয়ে ভারতকে সহযোগিতা করেছে, আমেরিকা-চীন অন্তত ততটুকু উদ্যোগ-উৎসাহ নিয়ে পাকিস্তানকে সহযোগিতা করতে সচেষ্ট থাকেনি। কারণ আমেরিকার সপ্তম নৌবহর তখন সপ্ত মহাসাগরে ঘুরপাক খাচ্ছিল।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ৫২ বছর পরে এসে আজ আমরা দেখছি- বিশ্বরাজনীতিতে এশিয়া প্যাসিফিকের কথিত ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল বাংলাদেশকে নিয়ে বিশ্ব মোড়লিপনায় ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো ওইরূপ একটি ভয়ানক ক্রীড়াচক্রের ফাঁদ পেতেছে। তার প্লে গ্রাউন্ড বানিয়েছে বাংলাদেশকে। একদিকে সেন্টার মিডিলে খেলছে ভারত। তাদের নেপথ্যে আছে রাশিয়া-চীন। অপরদিকে ব্যাকিং ফরওয়ার্ডে খেলছে আমেরিকা-জাপান। নেপথ্যে ইউরোপিয়ান রাষ্ট্রসমূহসহ অন্যান্য সহযোগী রাষ্ট্র।
এ নিবন্ধ যখন লিখছি, তখন জানা গেল- যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউজে মোদি-বাইডেন গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক শেষ হয়ে গেছে। বৈঠকের বিষয়বস্তু দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে বিশ্বব্যাপী মিডিয়ায় আলোচনার ঝড় বইছে। সুনামি চলছে বাংলাদেশ ভারতের মিডিয়াতে, পত্র-পত্রিকায়। প্রকাশ পাচ্ছে শত মত, শত বিশ্লেষণ, শত প্রতিবেদন। কোনটি ঠিক, কোনটি বেঠিক; তা ভবিষ্যৎ বলে দেবে। এখন আমাদের চিন্তা- বাংলাদেশের কী হবে? আমরা কি শখ করে বিশ্বরাজনীতির এ মরণ খেলায় জড়িয়ে পড়ব? নাকি বিশ্বের আধিপত্যবাদী ক্ষমতাধরগণ আমাদেরকে যে কূটনীতির খেলায় জড়িয়ে নিতে চাচ্ছে, সেখানেই আটকা পড়ে থাকব?
পূর্বেই উল্লেখ করেছি- এ খেলায় জাড়ানো, না জাড়ানোর অভিসন্দ্বে আমরা নিজেরাই শতভাগ দায়ী থাকব; যদি আমরা ক্ষমতার লোভে জনগণকে বাদ দিয়ে, জনমতকে উপেক্ষা করে দেশকে এককভাবে চালানোর স্বেচ্ছাচারী মানসিকতা পোষণ করি। আমরা কেউ তাকিয়ে আছি- ভারত আমাদেরকে ক্ষমতা পাইয়ে দেবে। আবার কেউ বলছি- আমেরিকা এ যাত্রার মতো ভারতকে ঠেকিয়ে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের নেতৃত্বের উচ্চাভিলাষকে প্রশমিত করে একটা সর্বজনগ্রাহ্য নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক, শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে জনগণের সরকার কায়েম করে দেবে। কোনটা হবে জানি না। তবে এতটুকু আঁচ করা যায়- কেউ কারও কোনো দিন ভালোকিছু করে দিতে পারে না।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পরাশক্তি আমেরিকার সদিচ্ছা থাকলেও পাকিস্তানের পক্ষে সপ্তম নৌবহর মহাসাগরে চলতে চলতে সময়মতো পৌঁছাবার সুযোগ হয়নি। সাম্প্রতিক মহাশক্তিধর পরাশক্তি আমেরিকাসহ ন্যাটোশক্তিসমূহ স্বাধীন সার্বভৌম ইউক্রেনকে রক্ষা করতে পারেনি। ইউক্রেনের ছিন্নভিন্ন দশা। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে বিশ্বের ক্ষমতাধরগণ প্রতিপক্ষ আরেক পরাশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে কিংবা দখলদারিত্ব থেকে হটিয়ে দিয়ে এসব দেশকে মুক্ত করে দেওয়ার অঙ্গীকার করেও সফল হতে পারেনি। শুধু নিজেদের স্বার্থ নিয়েই থেকেছে; যার জ্বলন্ত প্রমাণ আফগানিস্তান, সিরিয়া, ফিলিস্তিন ইত্যাদি রাষ্ট্রসমূহ। এসব হতভাগ্য দেশসমূহ কেবল ক্ষমতাধর পরাশক্তিসমূহের রাজনৈতিক এবং দখলদারিত্বের খেলায় ক্রীড়া-কৌতুকের ‘পে গ্রাউন্ড’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। দুনিয়ার ইতিহাস তাই সাক্ষ্য দেয়।
সুচতুর মোদিজি দেশে ফিরে তার পরামর্শক চক্র-অমিত-শংকর-পিনাক-দোভালদের দারুণ রুদ্ধ দুয়ারে আমেরিকা সফরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাবে, নাকি তাদের রাজনৈতিক মনোকুঞ্জে পুঞ্জীভূত নেহরু ডকট্রিনের মনস্তাত্ত্বিক সূত্রাবলি কার্যকর করতে বাংলাদেশকে নিয়ে নতুন কোন খেলা খেলবে; সেটা তাদের বিষয়। কিন্তু আমাদের চিন্তা একটাই- বাংলাদেশের কী হবে? আমরা কি শখ করে বিশ্বরাজনীতির এ মরণ খেলায় নিজেদের জড়িয়ে পরাশক্তিধরদের রাজনৈতিক ক্রীড়া-কৌতুকের ‘প্লে-গ্রাউন্ড’ হিসেবে ব্যবহৃত হতে যাচ্ছি, নাকি আমাদের সমস্যা জাতির স্বার্থে আমরাই মিটিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ রচনা করব; সেটাই এখন ১৭ কোটি মানুষের প্রধান ভাবনার বিষয়।
লেখক : বিশিষ্ট কলামিস্ট ও সাবেক সংসদ সদস্য
আপনার মন্তব্য লিখুন