যাদের ছেলেবেলা কেটেছে গ্রামে তাদের মনোজগতে গ্রামীণ জীবনের যে চিত্র আঁকা রয়েছে, গেঁথে আছে; এক কথায় তা চির অমলিন। এখনো হৃদয়ে ভেসে ওঠে সাদামাটা সহজ-সরল, নিখাদ সেই জীবনের গল্পগাঁথা। যেখানে বক্রতা নেই। প্রতারণা, ভণ্ডামি আর চালাকি যেখানে অনুপস্থিত। জীবন-জীবিকার তাগিদে গ্রামের পাট চুকিয়ে যারা শহরবাসী, ডেরা বেঁধেছে নগরে, তাদের মনের গহিনে অটুট রয়েছে গ্রামীণ জনপদের অম্ল-মধুর স্মৃতি। যাকে সাহিত্যের ভাষায় বলা হয় নস্টালজিয়া।
ফেলে আসা গ্রামের কথা মনে হলে গ্রামছাড়া মানুষের হৃদয়ে আজও শিহরণ জাগে। রোমাঞ্চিত হন তারা। এ এক অন্য রকম উপলব্ধি, যা কবিতা, গল্প উপন্যাসের উপজীব্য। তাই তো দেখা যায়, আবহমান বাংলার চিরায়ত জীবনচিত্র একটা সময় ছিল বাংলা সাহিত্যের প্রধান উপজীব্য। একচেটিয়া। গত শতাব্দীতে বাংলা সাহিত্যে বিভিন্ন শাখা; কবিতা, গল্প কী উপন্যাসে সেই নিবিড় পল্লী সমাজের মনোজ্ঞ বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়েছে। ফেলে আসা গ্রামের ছবি আঁকতে গিয়ে জসীমউদ্দীন তার তুমুল জনপ্রিয় ও বহুল পঠিত ‘নিমন্ত্রণ’ কবিতায় লিখেছেন, ‘তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে আমদের ছোট গাঁয়/ গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়/ মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি/ মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি/ মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভায়ের স্নেহের ছায়/ তুমি যাবে ভাই-যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়’। কালজয়ী কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র পল্লী সমাজ উপন্যাসে গ্রামীণ জীবনের নিখুঁত বয়ান তুলে ধরেছেন। আর নিসর্গের কবি জীবনানন্দ রূপসী বাংলার রূপে ছিলেন বিভোর, যেমনি করে একজন শুদ্ধ প্রেমিক তার অনন্য সাধারণ প্রেমিকার অপার সৌন্দর্য ঐশ্বর্যে সর্বদা মুগ্ধ থাকেন। এ মুগ্ধতার সূত্র ধরে তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে এই বাংলায় চিরকাল থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন : ‘তোমরা যেখানে সাধ চ’লে যাও- আমি এই বাংলার পারে র’য়ে যাব/ দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে/ দেখিব খয়েরী ডানা শালিকের, সন্ধ্যায় হিম হ’য়ে আসে/ ধবল রোমের নিচে তাহার হলুদ ঠ্যাং ঘাসে অন্ধকারে’। জীবনানন্দ রূপসী বাংলার সৌন্দর্যের বিমুগ্ধ রূপকার। পৃথিবীর রূপ খুঁজতে তিনি মোটেই আগ্রহী নন। বাংলার প্রতি অগাধ ভালোবাসায় অনায়াসে তিনি বলতে পারেন : ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি/ তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর/ অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে/ চেয়ে দেখি ছাতার মতন বড় পাতাটির নিচে ব’সে আছে/ ভোরের দোয়েল পাখি- চারিদিকে/ চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ/ জাম-বট-কাঁঠালের-হিজলের-অশ্বত্থের ক’রে আছে চুপ/ ফণীমনসার ঝোপে শটিবনে তাহাদের ছায়া পড়িয়াছে/ মধুকর ডিঙা থেকে না জানি সে কবে চাঁদ চম্পার কাছে/ এমনই হিজল-বট-তমালের নীল ছায়া বাংলার অপরূপ রূপ দেখেছিল’। আর সমকালীন বাংলা কবিতার অন্যতম কবি আল মাহমুদ অন্য ব্যঞ্জনায় গ্রামে ফেরার তাড়া থেকে ‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’ কবিতায় লেখেন, ‘কুয়াশার শাদা পর্দা দোলাতে দোলাতে আবার আমি ঘরে ফিরবো/ শিশিরে আমার পাজামা ভিজে যাবে/ চোখের পাতায় শীতের বিন্দু জমতে জমতে নির্লজ্জের মতোন হঠাৎ লাল সূর্য উঠে আসবে/ পরাজিতের মতো আমার মুখের উপর রোদ নামলে, সামনে দেখবো পরিচিত নদী/ ছড়ানো ছিটানো ঘরবাড়ি, গ্রাম/ জলার দিকে বকের ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে/ তারপর দারুণ ভয়ের মতো ভেসে উঠবে আমাদের আটচালা/ কলার ছোট বাগান।’ কবিতাটি পাঠে ভিন্ন এক দ্যোতনায় দুলে ওঠে মন।
উপরে বর্ণিত সব কবিতায় শব্দে নির্মিত শরীরে ছড়িয়ে আছে এক প্রগাঢ় ভালোবাসা, কিন্তু সে ভালোবাসা কোনো নির্বস্তুক বায়বীয় কল্পনাবিলাস নয়। যে বাংলাদেশকে ভালোবাসেন এ সব কবি-কথাসাহিত্যিক, সে বাংলাদেশ শরীরী হয়ে ওঠে শুধু প্রকৃতিতে নয়, ইতিহাসেও। এ কথা ঠিক যে, সেই ইতিহাসের গায়ে আছে উপকথার আবরণ, কখনো বা অতিকথাও, কিন্তু সেই উপকথা, রূপকথা, আর অতিকথার মানুষজন নিয়েই জেগে ওঠে এক বাংলাদেশ, সে বাংলাদেশে নেই কোনো নাগরিক আকাশরেখা, তা শুধু ভরে থাকে আম কাঁঠালের গন্ধে, হিজলের ছায়ায়, সেখানে আজো যেন সপ্তডিঙা মধুকরের যাওয়া-আসা। তবে সাহিত্যে যে গ্রামবাংলার যাপিত জীবনের সন্ধান মেলে, খুঁজে পাওয়া যায়, তা বিগত যৌবনা। তার শরীরে ভাটার টান পড়েছে। এমন পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়নে কারো কারো মন খারাপ করে। কিন্তু বাস্তব বড় নির্মম, নির্দয়। এখানে ভাবাবেগের জায়গা কোথায়?
এটি অসত্য নয়, গ্রামীণ জনপদে অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাঝেও আবহমান বাংলার ছায়া-সুনিবিড় শান্তির নীড় কিছুটা হলেও জেগে আছে বটে; তবে তাতে চিড় শুধু নয়, রীতিমতো বড় আকারে ফাটল ধরেছে। এ কথায় সন্দেহের অবকাশ কম। বিষয়টি বর্তমানে প্রায় ধ্রুব সত্য। সংশয়ী মন দ্বিধাগ্রস্ত হলেও না মেনে উপায় নেই, গ্রামীণ পরিবেশ এবং সেখানকার বাসিন্দাদের অন্তরাত্মা আমূল না বদলালেও খানিকটা পাল্টেছে এবং বেঁকেছে; এটি নিশ্চিত করে বলা যায়। এ বদলানো ইতিবাচক নয়, নেতিবাচক। শুধু মনে অনুভব করাই নয়, সাদা চোখে তাকালেও তা সহজে দৃশ্যমান। এ বাস্তবতা কবুল না করা আর নিরেট সত্য অস্বীকার সমার্থক।
বৈষয়িক উন্নতির সাথে সাথে জটিল-কুটিল আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে গ্রামের মানুষজনও। নিকট অতীতের ঐতিহ্যগত সরল জীবন সেই ঘূর্ণাবর্তে নিমজ্জমান। হলফ করে বলা যায়, প্রযুক্তির ছোঁয়া এর জন্য বহুলাংশে দায়ী। তবে এটিই পুরো সত্য নয়; আংশিক। গোলকায়নের এ যুগে গ্রামীণ জীবনেও আছড়ে পড়েছে বৈশ্বিক ঢেউ। সেই ঢেউয়ের তোড়ে প্রবলভাবে প্রভাবিত গ্রামের মানুষের যাপিত জীবন। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় চাওয়া-পাওয়ার প্রকৃতি গেছে বদলে।
গত চার দশকের ব্যবধানে চেতনার ভিত্তিভূমি অল্পে তুষ্ট থাকার মানসিকতা, মানে অনাড়ম্বর জীবনে সবার অলক্ষ্যে আমূল পরিবর্তন এসেছে। তাদের চলন-বলনই তা বলে দেয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলেও লোপ পেয়েছে সরলতা। উল্টো দানা বেঁধেছে অর্থ উপার্জনের তীব্র বাসনা। কিন্তু তাদের জানা নেই যে, শুধু কামনা-বাসনা থাকলেই সম্পদ অর্জন সম্ভব নয়। আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে চাই যোগ্যতা-দক্ষতা।
সম্পদ কুক্ষিগত করতে সমকালীন যে বিদ্যাবুদ্ধি জরুরি; তাতে ঘাটতি রয়েছে তাদের। প্রযুক্তির বদৌলতে অন্যের জৌলুশপূর্ণ জীবন দেখে আত্মগ্লানিতে ভোগার এ বোধ ভোঁতা। ইন্টারনেট, ডিশ, স্মার্টফোনের মাধ্যমে যে আড়ম্বরপূর্ণ জীবন দেখে ধাঁধায় পড়েছে তারা, তার অভিঘাতে অবধারিতভাবে নিজেকে বঞ্চিত ভাবাই স্বাভাবিক। না পাওয়ার বেদনায়-যাতনায় মনে জন্ম নিয়েছে অন্যের প্রতি ঈর্ষা ও ঘৃণা। ফলে জ্যামিতিক হারে বেড়েছে সামাজিক অস্থিরতা। সেই বিষবাষ্পে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে সম্পর্কের বাঁধন। প্রতিক্রিয়ায় গ্রামীণ নিস্তরঙ্গ জীবনকে গ্রাস করছে হিংসার সংস্কৃতি। ফলে জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে হাঙ্গামা। এর জনক প্রযুক্তি। এ দৃষ্টিকোণ থেকে প্রযুক্তি এখানে অভিশাপ হয়ে হাজির। এ থেকে মুক্তি সুদূরপরাহত।
মূলত গ্রামের মানুষ বৈষয়িক যোগ্যতা অর্জন না করেও ভোগী জীবনের প্রত্যাশী। সেই কাক্সিক্ষত ভোগের উপাদান করায়ত্ত করতে অন্যকে ঠকিয়ে যেনতেনভাবে হাতিয়ে নিতে চায় অর্থ। নীতিনৈতিকতা সেখানে অনুপস্থিত। অবান্তর বটে। যেন ফালতু বিষয়। অবশিষ্ট থাকে শুধু আকাক্সক্ষা পূরণের তীব্র বাসনা। অবশ্য এ উপসর্গ গ্রামে অনুপ্রবেশ করেছে লুটেরা অর্থনীতির হাত ধরে। এর জন্য বর্তমান দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতিই দায়ী।
রাজনীতির করাল গ্রাসে গ্রামীণ জীবনও বহুধাবিভক্ত। কায়েমি স্বার্থ ঠাণ্ডা মাথায় নিজেদের স্বার্থ টিকিয়ে রাখতে পাকাপোক্ত ব্যবস্থায় মত্ত। এতে অবশ্য গোষ্ঠীস্বার্থ শতভাগ সংরক্ষণ করতে পারছে শাসকশ্রেণি। যাতে সারা দেশে লুটেরা অর্থনীতির সুবিধা ষোলোআনা ঝোলায় তোলা যায়। ভোগে কোনো টান না পড়ে। ফলে গ্রামেও গড়ে উঠেছে রাজনৈতিক টাউট-বাটপাড়। গ্রামীণ জনপদে এই শ্রেণিটিই বিষবাষ্প ছড়াতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। যেহেতু বাংলাদেশ এখনো আক্ষরিক অর্থে একটি বৃহদায়তন গ্রাম; সেহেতু গ্রামীণ মানুষের চৈতন্যের পরিবর্তন সামগ্রিক অর্থে বাংলাদেশের পরিবর্তন। এ পরিবর্তন ইতিবাচক হলে সাদরে গ্রহণ করতে কোনো দোষ নেই। সঙ্কোচেরও কিছু নেই। কিন্তু পরিবর্তনটা মোটাদাগে নেতিবাচক। ফলে এটি জনমানসের বিকৃতি ছাড়া আর কিছু নয়। এতে করে আগে যেখানে জমিজমা নিয়ে গ্রামে রক্তারক্তি, হাঙ্গামার ঘটনা ঘটত। চর দখলে লাঠিয়াল বাহিনীর প্রয়োজন পড়ত। এখন তা নেই। কিন্তু রাজনৈতিক লাঠিয়ালদের দাপটে সবার ত্রাহি অবস্থা।
অন্যকে দেখানোর প্রবণতা গ্রামীণ সমাজে মহামারী হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে করে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াই কালবৈশাখীর গতি পেয়েছে।
বিপজ্জনক এ প্রবণতা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ; ঐতিহ্যগত সাদামাটা জীবনে ফেরা। সেই পথে চলার শক্তি জোগাবে জ্ঞানের চর্চার ক্ষেত্রটির সাধারণীকরণ। সবাই যাতে জ্ঞানচর্চায় উদ্বুদ্ধ হয় এমন আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করা। তবে কাজটি সহজ নয়।
লেখক : সাংবাদিক
আপনার মন্তব্য লিখুন