মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর প্রকোপ সারা দেশে বৃদ্ধি এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলে আঘাত হানা সাম্প্রতিক বন্যায় বিপুল মানুষ দুর্বিষহ অবস্থায় নিপতিত হয়েছে। অথচ সরকারের এ নিয়ে তেমন কোনো মাথাব্যথা রয়েছে বলে মনে হয় না। একথা বলার কারণ- গত বছরের ধারাবাহিকতায় ডেঙ্গুর প্রকোপ এবার ভয়াবহ হতে পারে বলে আগেই সরকারকে সতর্ক করেছিলেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। কিন্তু সরকার এতে কর্ণপাত করেনি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। এবার ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু। সরকারি যেসব প্রতিষ্ঠান মশার প্রজনন ধ্বংস এবং নিধনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সেসব প্রতিষ্ঠান জনস্বাস্থ্যবিদদের পরামর্শ উপেক্ষা করায় এর খেসারত দিতে হচ্ছে আমজনতাকে।
আমাদের স্মরণে থাকার কথা, ২০০০ সালে দেশে এডিশ মশাবাহিত ডেঙ্গুজ্বর রাজধানী ঢাকায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। এরপর ২০১৯ সালে ডেঙ্গু মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে। আর চলতি বছর এ রোগ যে ইতোমধ্যে ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে, তার প্রমাণ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যাতেই স্পষ্ট। কারো কষ্ট হওয়ার কথা নয় যে, ডেঙ্গু আগস্টে এসে জনস্বাস্থ্যের জন্য কতটা হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে।
অন্য দিকে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে সারা বিশ্বে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়ে গেছে। এর সবচেয়ে বেশি শিকার যেসব দেশ; সেই তালিকায় বাংলাদেশ প্রথম দিকে অবস্থান করছে। আবহাওয়া বিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশে ঝড়, বন্যা, অতি বৃষ্টি, অনাবৃষ্টি বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি দায়ী। যদিও বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার জন্য দায়ী শিল্পোন্নত দেশগুলো। অথচ আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার বিশ্বের উন্নয়নশীল এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলো। এ যেন একের অপরাধে অন্যকে সাজা খাটা।
বন্যাদুর্গত এলাকায় পুনর্বাসের অভাব
সম্প্রতি চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার হয়ে তিন পার্বত্য জেলা প্রবল বৃষ্টিতে হঠাৎ বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে। বন্যা-উত্তর দেখা যাচ্ছে- চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও পার্বত্য এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। প্রবল বৃষ্টির ক্ষতচিহ্ন এখনো রয়ে গেছে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং তিন পার্বত্য জেলা বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে। বিস্তীর্ণ এই জনপদের বেশিরভাগ মানুষ সাম্প্রতকি বন্যায় চরম দুর্ভোগে পড়েন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো তাদের এ দুর্ভোগ লাঘবে সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা নেই বললে চলে। সাম্পতিক বন্যায় কেমন ক্ষতি হয়েছে, এর একটি নমুনা পাওয়া যায় দুটি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে তৈরি করা প্রতিবেদনে। প্রতিষ্ঠান দুটি হলো জাতিসংঘ এবং বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। জাতিসঙ্ঘ বাংলাদেশ কার্যালয় ও বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি থেকে প্রকাশ করা আলাদা দু’টি প্রতিবেদনে বন্যার ক্ষয়ক্ষতির একটি বিবরণ পাওয়া যায়। দুটি প্রতিবেদনে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
বন্যার বিষয়ে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে- পাহাড়ি ঢলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বান্দরবান জেলায়। সেখানকার ১৮টি ইউনিয়নে বেশি ক্ষতি হয়েছে। এ জেলার নীলগিরি ও থানচি সড়ক বন্ধ হয়ে যায়। পাহাড়ধসে ওই সড়কেও ধস নামে। ফলে বান্দরবানের সাথে অন্যান্য জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়। জেলা শহরের ৮০ শতাংশ এলাকা ১৫-২০ ফুট পানির নিচে তলিয়ে গিয়েছিল।
ভারী বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম শহরের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা হাঁটুপানিতে তলিয়ে যায়। সাধারণত যেখানে আগস্টে সব মিলিয়ে চট্টগ্রামে ৫৩০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়, সেখানে মাত্র এক সপ্তাহে ৫৪৭ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। বন্দরনগরী চট্টগ্রামের চকবাজার, বাকলিয়া, আগ্রাবাদ এলাকায় দীর্ঘ সময় ও উচ্চতায় পানি জমে থাকে। আর্থিকভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ও চাক্তাই এলাকার বাসিন্দারা। দেশের অন্যতম পাইকারি ওই বাজারে প্রায় পাঁচ হাজার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। নিত্যপণ্যের এসব পাইকারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পাশাপাশি পণ্য নষ্ট হওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এতে দীর্ঘ সময় ধরে পানি জমে থাকায় শহরের সব নদী ও খাল বর্জ্যে ভরে ওঠে। কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন এলাকায় কয়েক দফা হঠাৎ করে বন্যাকবলিত হয়। এতে পাহাড়ধস ও পানি জমে থাকায় অনেক ক্ষতি হয়েছে। জেলার প্রায় তিন লাখ মানুষ ভোগান্তির শিকার হন। আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে হয় জেলার ৩৩ হাজার অধিবাসীকে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ ওই পর্যটন শহরের ৪৬ কিলোমিটার সড়ক নষ্ট হয়েছে। ফলে এখনো সেখানে ধসের ঝুঁকি ও যাতায়াতে সমস্যা হচ্ছে।
পাহাড়ি ওই বৃষ্টিতে সৃষ্ট সাম্প্রতিক বন্যায় সেখানে যে ভূমিধসের শঙ্কা তৈরি হয়েছে, তাতে এখনো সাড়ে তিন লাখ মানুষ ঝুঁঁকিতে রয়েছেন। ১৬ আগস্ট প্রকাশ করা জাতিসঙ্ঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- মোট ২৪ লাখ মানুষ বন্যাকবলিত হয়েছিলেন। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ১২ লাখ। ভারী বৃষ্টিতে এত ক্ষয়ক্ষতি ও মৃত্যুর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাধারণত বাংলা ভাদ্র ও আশ্বিন মাস অর্থাৎ ইংরেজি বছরের সেপ্টেম্বরে উপকূলে অতি জোয়ারে বন্যা হয়ে থাকে। ওই এলাকার নিম্নাঞ্চলের বাড়িঘর ও ফসলের ক্ষতি হয়। প্রায় প্রতি বছর এটি সাধারণ ঘটনা। কিন্তু এবার এর আগে অতিবৃষ্টি শুরু হয়েছে। এর মধ্যে যতটা বৃষ্টি হয়েছে, তাতে চট্টগ্রাম-কক্সবাজারসহ উপকূলীয় এলাকার নদ-নদীর পানি বেড়ে গেছে।
বন্যাদুর্গত জনপদে এখনো ঝুঁকিতে থাকা সাড়ে তিন লাখ মানুষ অস্থায়ী জায়গায় আছেন। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্তদের খাদ্য, চিকিৎসা ও পানি-সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি বাড়িঘর মেরামতের দরকার রয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে এখনো কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। অথচ তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে দ্রুত পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করা জরুরি। অন্যদিকে পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বড় অংশ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরে এখনো অনেক দুর্গম এলাকায় সড়ক ঠিক হয়নি। এতে স্থানীয়রা উৎপাদিত পণ্য বাজারে বিক্রি করতে পারছেন না। ফলে খাদ্যসহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি সড়কগুলো দ্রুত মেরামত করা উচিত। কিন্তু এসব কাজ দ্রুত শুরু করার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ফলে বন্যাদুর্গত মানুষজন বিপর্যস্ত জীবনযাপন করছেন এখনো। কবে নাগাদ তারা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবেন তা বলা মুশকিল।
ডেঙ্গু শনাক্ত লাখ ছুঁই ছুঁই, প্রাণহানির দীর্ঘ সারি
চলতি বছরের জুন থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ দিন দিন বেড়েই চলেছে। ঢাকার বাইরে এখন ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি। এবার ২০ আগস্ট পর্যন্ত ৯৯ হাজার ৯৯৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে রাজধানীতে ৪৮ হাজার ৪৫৬ জন এবং ঢাকার বাইরে ৫১ হাজার ৫৩৮ জন। দেশে ইতোমধ্যে ডেঙ্গু রোগে মৃত্যুর পুরনো রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। চলতি বছর শুধু আগস্টের প্রথম ২০ দিনে মৃত্যু হয়েছে ২২৫ জনের। এবার এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুজ্বরে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৭৬ জনে। মৃত ৪৭৬ জনের মধ্যে নারী ২৭২ জন এবং পুরুষ ২০৪ জন। মোট মৃত্যুর মধ্যে ঢাকার বাইরে মারা গেছেন ১১৯ জন এবং রাজধানীতে ৩৫৭ জন। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ২৮১ জনের মৃত্যু হয়েছিল গত বছর। ২০১৯ সালে মৃত্যু হয় ১৭৯ জনের। ২০২০ সালে ৭ জন ও ২০২১ সালে মারা যান ১০৫ জন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৫৬৬ জন এবং মারা গেছেন ৬ জন। ফেব্রুয়ারিতে আক্রান্ত ১৬৬ জন এবং মারা গেছেন ৩ জন। মার্চ মাসে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১১১ জন। এপ্রিলে হাসপাতালে ভর্তি হন ১৪৩ জন এবং মারা গেছেন ২ জন। মে মাসে হাসপাতালে ভর্তি হন এক হাজার ৩৬ জন এবং মারা গেছেন ২ জন। জুন মাসে ৫ হাজার ৯৫৬ জন এবং মারা গেছেন ৩৪ জন। জুলাইতে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৪৩ হাজার ৮৫৪ জন এবং মারা গেছেন ২০৪ জন। আগস্টের ১ তারিখ থেকে ২০ তারিখ এই ২০ দিনে ৪৮ হাজার ১৬২ জন শনাক্ত এবং প্রাণহানি ২২৫ জনের। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা আরো বেশি হবে। কারণ, অনেক ডেঙ্গু রোগী বাসায় থেকে চিকিৎসা নেন, তাদের হিসেব স্বাস্থ্য অধিদফতরের খাতায় নেই।
সমন্বিত উদ্যোগের অভাব
মশা নিধনে কার্যকর ও সমন্বিত উদ্যোগের অভাবকে এবার ডেঙ্গুর বিস্তারের কারণ হিসেবে মনে করেন অনেক জনস্বাস্থ্যবিদ। তাদের মতে, মশা নিধন একটি সমন্বিত উদ্যোগ। এতে জনসম্পৃক্ততা দরকার। লক্ষণীয়, ডেঙ্গুর প্রকোপ সবচেয়ে বেশি রাজধানী ঢাকায়। কিন্তু রাজধানীবাসীকে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন সম্পৃক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ ব্যর্থতার পাশাপাশি দুই সিটি থেকে যে ওষুধ দেয়া হচ্ছে মশা নিধনে তা কতটুকু কার্যকর, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। মশা নিধনে জনসম্পৃক্ততার বিষয়টি খুব তাৎপর্যপূর্ণ। অথচ দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ দায় নিচ্ছে না। আবার সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোও নিজে থেকে এগিয়ে আসছে না। আসলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ও সাধারণ মানুষের মেলবন্ধনের অভাবে ডেঙ্গু প্রতিরোধ দিন দিন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। তাই এ দুয়ের সম্মিলন দরকার বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া রাজধানীতে মহল্লাভিত্তিক সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার অভাব ডেঙ্গু বিস্তারের আরেকটি কারণ বলে মনে করেন চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্যবিদরা। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা, থাইল্যান্ড এবং নিকারাগুয়ায় শহরাঞ্চলের বাসায় বাসায় গিয়ে ডেঙ্গু রোগীর তালাশ করা এবং তাকে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার উদাহরণ আছে। কিন্তু আমাদের দেশে এমন কথা চিন্তাও করা যায় না। উল্টো ঢাকায় শিশুমেয়ের ডেঙ্গু চিকিৎসা করাতে গিয়ে বাবাকে গ্রেফতারের মতো অমানবিক ঘটনাও ঘটেছে।
পরিশেষে এ কথা বলা যায়, যেহেতু ডেঙ্গু এখন শুধু রাজধানীর সমস্যা নয়; সারা দেশের সমস্যা। এটি শুধু বছরের নির্দিষ্ট কিছু সময়ের সমস্যাও এখন আর নেই। তাই এখন থেকে বছরব্যাপী এবং দেশব্যাপী উদ্যোগ নিতে হবে। তা হলে হয়তোবা দেশে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক
আপনার মন্তব্য লিখুন