আল কুরআন তামাম দুনিয়ার বুকে সবচেয়ে দামি। কুরআনের সংস্পর্শে এসে মানুষ অনেক দামি হয়েছে। হজরত ওমরের মতো অবিশ্বাসী ব্যক্তিও ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে কুরআনের সৈনিক হয়ে নিজের জীবনকে আল্লাহর রঙে রঙিন করেছেন, দ্বীনের ঝাণ্ডা হাতে তুলে নিয়ে দ্বীনকে বিজয়ী করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। আবার হজরত বেলালের মতো কৃষ্ণকায় গোলাম মর্যাদার আসনে সমাসীন হয়েছেন।
আল-কুরআনের মূল আলোচ্য বিষয় হলো মানুষ। মানুষকে মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। আর প্রতিনিধিত্ব করার জন্য দিয়েছেন নির্ভুল গাইড আল-কুরআন। যুগে যুগে বিভিন্ন গোত্র-সম্প্রদায়ের নিকট আল্লাহ তায়ালা নবী-রাসূল বা বার্তাবাহক পাঠিয়েছিলেন। আর সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নিকট পাঠান আল কুরআন। আল-কুরআন নাযিল হওয়ার পর আল্লাহ তায়ালা সকল মতাদর্শের পদ্ধতিকে রহিত করে মানব সম্প্রদায়কে মুহাম্মদ (সা.) প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। আবার সৃষ্টি জগতের মাঝে শুধু মানুষকে আল্লাহ ভালো-মন্দ বিচার বিবেচনার মাধ্যমে নিজের পছন্দসই পথে পরিচালিত হওয়ার স্বাধীনতা দিয়েছেন। তাই প্রত্যেক নবীই তার কওমকে আল্লাহর নির্দেশ পালনের জন্য আহবান জানাতেন এবং তাঁর অনুসরণ না করার পরিণতি সম্পর্কে ওয়াকিফহাল করতেন। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, “রাসূল (সা.) তোমাদের জন্য যা নিয়ে এসেছেন তা গ্রহণ করো এবং যা নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাক। আর আল্লাহ তায়ালাকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।” (সূরা হাশর ৭)।
এসব আহ্বান যাদের কাছে অসহ্য মনে হয়েছে তারাই কুরআনের বিরুদ্ধে নানাভাবে নিজেদের অবস্থান জানান দিয়েছে। তারা নানা ধরনের বাধা প্রদানের মাধ্যমে তাদের গাত্রদাহের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। আল্লাহদ্রোহীরা যুগে যুগে কুরআনের প্রচার-প্রসারকে বন্ধ করে দেয়ার জন্য নানা ছুঁতোয় গণ্ডগোল পাকিয়েছে। কিন্তু আল্লাহর সিদ্ধান্ত হচ্ছে তিনি যে কোনো মূল্যে তিনি তাঁর দ্বীনের আওয়াজকে বুলন্দ করবেন। আল্লাহ বলেন, “এরা (কাফেররা) তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়, অথচ আল্লাহর ফয়সালা হলো তিনি তাঁর নূরকে প্রজ্বলিত করবেন।” (সূরা সফ : ৮) নবী আগমনের পূর্বে অন্ধকারের কালো থাবায় অস্থির মানবতা যখন গুমরে কাঁদছিল, ঠিক তখন নবী মুহাম্মদ (সা.) মহাগ্রন্থ আল কুরআনের নির্দেশনা নিয়ে মানবতার দুয়ারে হাজির হলেন। প্রতিটি যুগে ফেরাউন-নমরুদের উত্তরসূরীরা ক্ষমতা হারানোর ভয়ে নবীদের ওপর নির্যাতনে সর্বশক্তি প্রয়োগ করত। নবী করীম (সা.)-এর ব্যাপারেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। শত প্রতিকূলতার পরও একদল সাহসী আল্লাহর গোলাম নবীর আহবানে সাড়া দিয়ে ইসলামের অগ্রযাত্রাকে সামনের দিকে দুর্বার গতিতে এগিয়ে নেন। এসব মানুষ ইতিহাসে সোনার মানুষ হিসেবে কেয়ামত পর্যন্ত মানবতার মাঝে অনুরণিত হবেন। আল কুরআনই ছিল তাদের জীবনের অনন্য গাইডলাইন। কুরআনের অগ্রযাত্রায় ভীত হয়ে নানাভাবে এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছে। ফলে কুরআনপ্রেমীদের হৃদয় আহত হয়েছে। ১৯৮৫ সালের ১০ এপ্রিল কুরআন বাজেয়াপ্ত করার ঘৃণ্য আবেদন করে মামলা হয় কলকাতা হাইকোর্টে। এ ঘটনায় বিক্ষোভের ঢেউ আছড়ে পড়ে সারা মুসলিম জাহানে। বাংলাদেশেও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। কুরআনের মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে হাসিমুখে জীবন দেন অনেকে। এখনো কুরআনের মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন থেমে নেই, থেমে নেই বাধাও। মর্যাদা রক্ষার তাগিদে জীবন বিসর্জন দিচ্ছেন অনেকে। কুরআনের অবমাননার প্রতিবাদ চলবে ততদিন, যতদিন আল্লাহর গোলামরা বেঁচে থাকবে। আর মানুষ এর মান রক্ষায় ব্যর্থ হলেও আল্লাহ নিজেই এর রক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন- “নিশ্চয়ই কুরআন আমিই নাজিল করেছি, আর উহার হেফাযতের দায়িত্ব আমারই।” (সূরা হিজর-৯)। আমাদের দেশে ঐতিহাসিক ১১ মে কুরআনের মর্যাদা রক্ষা ও ঈমানী চেতনায় উদ্ভাসিত হওয়ার অনন্য দিন। ঐতিহাসিক ঘটনা এই দিনে কুরআনের কর্মীদের কানে ভেসে আসে আবগাপ্লুত সেই গান-
‘আমি আমার এ দু’টি আঁখি কী করে ধরে রাখি অঝোরে কান্না বেরিয়ে আসে যখন মাসের পরে মাস পেরিয়ে ১১ মে আসে।’
ঐতিহাসিক ১১ মে, কুরআন দিবস। ১৯৮৫ সালের এই দিনে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঈদগাহ ময়দানে সংঘটিত হয় এক পৈশাচিক, নারকীয় হত্যাকাণ্ড। ১৯৮৫ সালের ১০ এপ্রিল ভারতের দু’জন উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদী নাগরিক পদ্মপল চোপরা ও শীতল সিং কুরআনের সকল আরবি কপি ও অনুবাদ বাজেয়াপ্ত করার আবেদন জানিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে একটি রিট করে। তারা মহাগ্রন্থ আল কুরআনের সূরা বাকারার ১৯১ নম্বর আয়াত ও সূরা তাওবার ৩১ নম্বর আয়াতের রেফারেন্স দিয়ে মামলা দায়ের করেছিল। তাদের বক্তব্য ছিল, ‘কুরআন যেহেতু কাফের মুশরিকদের বিরুদ্ধে লড়াই করা ও তাদের হত্যা করার কথা বলেছে, সেহেতু কুরআন একটি সাম্প্রদায়িক উসকানিদাতা গ্রন্থ।’ তাই একে বাজেয়াপ্ত করার দাবি তুলে মামলা দায়ের করে এই দুই পাপিষ্ঠ। ভারতীয় সংবিধানের ২২৩ নং ধারা সিআরপিসি ১১৫ (ক) ও ২৯৯ (ক) উদ্ধৃতি দিয়ে তারা কুরআনকে ভারতীয় সংবিধানবিরোধী বলে উল্লেখ করে। এর ফলে এ গ্রন্থ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্ম দিতে পারে। বিচারপতি পদ্ম খস্তগিড় কোনো প্রকার বিচার বিশ্লেষণ ছাড়া উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে মামলা গ্রহণ করেন। যদিও ভারতীয় সংবিধানে ওহি সম্পর্কে ধারণা দেয়া আছে। তিনি ১২ এপ্রিল এ বিষয়ে তিন সপ্তাহের মধ্যে অ্যাফিডেভিট প্রদানের জন্য রাজ্য সরকারের প্রতি নির্দেশ দেন। কুরআনকে বাজেয়াপ্ত করার মামলার খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে কলকাতাসহ সারা বিশ্বে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ভারতের প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমাদের দেশে সবখানে এ খবর ছড়িয়ে পড়ে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো।
১০ মে জুমার নামাজ শেষে বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে হাজার হাজার ইসলামী ছাত্র-জনতার মিছিল ও সমাবেশ মিলিত হলে লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে পুলিশ। কী ভয়াবহ দুঃসাহস! সরাসরি কুরআনের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান? সারা দেশের মতো চাঁপাইনবাবঞ্জের ঈদগাহ ময়দানে আয়োজন করা হয় এক প্রতিবাদ সমাবেশের। ঘটনার দিন বেলা ১১টার সময় সমাবেশের আহবায়ক চাঁপাইনবাবগঞ্জ আলিয়া মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা হোসাইন আহমদকে এসপি অফিসে ডেকে সমাবেশ বন্ধ করার জন্য চাপ দেওয়া হয়। কিন্তু ইসলামী জনতা দলে দলে আসতে থাকে ঈদগাহ ময়দানের দিকে। উপায় না দেখে ঈদগাহ ময়দানে ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন। ‘শুধুমাত্র দোয়া করে জনতাকে শান্ত করে চলে যাব’ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সেই আবেদনও শুনেনি ম্যাজিস্ট্রেট ওয়াহিদুজ্জামান মোল্লা। এসময় ওয়াহিদুজ্জামান মোল্লা সেই সুযোগ না দিয়ে অকথ্য ভাষায় আগত কুরআনপ্রেমিকদের গালি দিতে থাকেন। এসময় ইসলামী জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়লে ম্যাজিস্ট্রেট ওয়াহিদুজ্জামান মোল্লার নির্দেশে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ শুরু করে পুলিশ। পুলিশের গুলিতে প্রথমেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে দশম শ্রেণির ছাত্রশিবিরকর্মী আব্দুল মতিন। হাসপাতালে নেয়ার পর কর্তব্যরত ডাক্তার তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় শীষ মোহাম্মদ, রশিদুল হক, অষ্টম শ্রেণির ছাত্র সেলিম, সাহাবুদ্দীন, কৃষক আলতাফুর রহমান সবুর, রিকশাচালক মোক্তার হোসেন ও রেলশ্রমিক নজরুল ইসলাম শহীদ হন। আহত হন অর্ধশতাধিক মানুষ। চাঁপাইনবাবগঞ্জের হাসপাতালে তিল ধারণের ঠাঁই না থাকায় আহতদের চিকিৎসার জন্য রাজশাহীতে পাঠানো হয়। ন্যক্কারজনকভাবে রাজশাহী নেওয়ার পথেও আহতদের ওপর পুনরায় আক্রমণ চালানো হয়। বাড়ি বাড়ি তল্লাশির নামে হয়রানি করা হয়। নতুন করে পুলিশি নির্যাতনের পাশাপাশি মামলা দায়ের করা হয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জবাসী পরদিন ১২ মে সকল বাধা উপেক্ষা করে কারফিউ ভেঙে জুমার নামাজের পর নৃশংস হত্যা বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে শোককে শক্তিতে পরিণত করতে রাজপথে নেমে পড়ে। এদিকে সারা বাংলাদেশে এমন নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানানো হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের এমন ঘটনা সারা বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। ১৩ মে প্রশাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালন করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কুরআনপ্রেমিক মানুষ। মুসলমানরা বিশ্বব্যাপী এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণের প্রতিবাদে ফেটে পড়লে ভারত সরকার তটস্থ হয়ে হাইকোর্ট রায়টি প্রত্যাহারের নির্দেশ দিলে ১৩ মে কলকাতা হাইকোর্টে বিচারপতি বিসি বাসকের আদালতে স্থানান্তরিত করে এটি খারিজ করে দেয়া হয়। কুরআনের অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা যেখানে সকল মুসলমানের কর্তব্য সেখানে ইসলামী জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করে ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় রচনা করেছিল বাংলাদেশের কিছু মুসলমান নামধারী পুলিশ। বর্বরোচিত সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার তো হয়ইনি, উল্টো হয়রানি করা হয়েছিল মুসলিম জনতাকে। আজও এ ঘটনার কোনো বিচার হয়নি। শহীদের রক্তে যারা হোলি খেলে আনন্দে আত্মহারা হয়েছিল, তাদের বিচার যদি দুনিয়ার আদালতে না হয় আখেরাতের আদালতে হবে- এই ভেবে সান্ত্বনা খোঁজেন শহীদের স্বজনরা।
কুরআনের চ্যালেঞ্জ
নানা মুনির নানা মত। তাই এ ধরাতে কেউ কারো কথা মানতে বাধ্য নয়। তাই মানুষের মতবাদ দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠাও সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন সর্বজনগ্রাহ্য আইন। যেখানে সবার জন্য সমান অধিকারের নিশ্চয়তা রয়েছে। মুহাম্মদ (সা.)-এর পূর্বে যে সকল নবী ও রাসূলের কাছে ওহী নাযিল করা হয়েছিল পরবর্তী অনুসারীরা নিজেদের স্বার্থ ও পছন্দ মাফিক তা কাটছাঁট করে মানুষের সামনে উপস্থাপন করেছে। কিন্তু কুরআন নাযিলের পর এর পরিবর্তনের জন্য ইসলামবিদ্বেষী চক্র যারপরনাই চেষ্টা করেছে, কিন্তু সফল হয়নি। ১৪ শ’ বছর পর্যন্ত চেষ্টা করেও এর কোনো কূল কিনারা তারা করতে পারেনি। আল্লাহ তা’য়ালা এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘তারা কি দাবি করে যে কুরআন (আপনার) বানানো? তোমরা যদি তোমাদের দাবিতে সত্যবাদী হও তাহলে একটি সূরা অন্তত তৈরি করে নিয়ে এসো। আর এ ব্যাপারে আল্লাহ ব্যতীত যাদের প্রয়োজন বোধ কর, সাধ্যমতো তাদেরও ডেকে আন।” (সূরা ইউনুস : ৩৮)। “আপনি ঘোষণা করে দিন, জগতের সমগ্র মানব ও জিন জাতি মিলেও যদি এ ধরনের একখানা কুরআন তৈরির চেষ্টা করে, তাহলেও তা পারবে না, যদিওবা তারা পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করে।” (সূরা বনী ইসরাইল : ৩৮)। “তারা নাকি বলে যে কুরআন রাসূলের তৈরি করা। আপনি বলুন, তোমরা যদি সত্যবাদী হও, তাহলে এ ধরনের ১০টি সূরা নিয়ে এসো। আর এ ব্যাপারে আল্লাহ ব্যতীত যাদের সাহায্য বোধ কর, সাধ্যমতো তাদেরকে ডেকে নাও।” (সূরা হুদ : ১৩)। “এটি এমন একটি কিতাব যাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই, আর আল্লাহভীরুদের জন্য পথ প্রদর্শনকারী।” (সূরা বাকারা : ২)। উল্লিখিত বর্ণনা ও ইতিহাসের নিরিখে আমরা স্পষ্ট যে- কুরআনের উদাহরণ কেবল কুরআনই। একে চ্যালেঞ্জ করা নির্ঘাত বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। একে ধ্বংস করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। কুরআনের অনুসারীরা কিয়ামত পর্যন্ত এর সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। কুরআন এক মিরাকল গ্রন্থ। সমাজ, রাষ্ট্রব্যবস্থায় এর পূর্ণ বাস্তবায়নের মাধ্যমেই কেবল প্রকৃত সুখ, সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
কুরআনের মর্যাদা ও আমরা
একটি আত্মা যখন পৃথিবীতে মানুষ হিসেবে জন্মলাভ করে, তখন আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবেই তা সৃষ্টি হয়। এরপর যখন সে মানুষ মুসলমান বা পরওয়ারদিগারের আত্মসমর্পণকারী হিসেবে নিজের অবস্থান নিশ্চিত করতে পারে, তখন সে সৌভাগ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত হয়। আবার যখন সে কুরআনের কর্মী হতে পারে, তখন সে হয়ে যায় সোনায় সোহাগা। কারণ কুরআনের সমাজ যারা প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তারা শুধু নিজেরাই দুনিয়া ও আখেরাতে সফলকাম হতে চায় না, অন্যদেরকেও এ সফলপথের সন্ধান দিতে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যায়। যারা কুরআনের মর্যাদা রক্ষা করার ঐতিহাসিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, আল্লাহর দায়িত্ব হয়ে যায় যে তিনি তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেবেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, দুনিয়ার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে কুরআনের বিরুদ্ধে ভূমিকা পালন করতেও মুসলমান নামধারী ব্যক্তিরা কুণ্ঠা বোধ করছে না। কুরআনের মর্যাদাকে আমরা আলমিরার ফ্রেমে বন্দী করে রেখেছি। এর বাস্তবায়নে আমরা না সমাজে না রাষ্ট্রে সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করছি। এখন অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়- আল্লাহ, রাসূল ও কুরআনের আওয়াজকে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য ইসলামবিদ্বেষীরা যতই পরিকল্পনা গ্রহণ করুক না কেন, এতে মুসলমানদের কোনো কিছু আসে যায় না। ভাবখানা এমন যে হযরত মূসা (আ.)-এর সময় যেমন তার উম্মতের জন্য মান্না-সালওয়া নামক এক ধরনের বিশেষ খাবার নাযিল হতো, তেমনি মুসলমানরা কুরআনের রাজ কায়েমের চেষ্টা না করলেও নামমাত্র মুসলমান থাকলেই আল্লাহ তাঁর যমিনে তাঁর সমাজ প্রতিষ্ঠা করে দেবেন! মূলত এ ধরনের নীরবতা প্রমাণ করে- শয়তানী অপশক্তি মুসলমানদের বড় একটি অংশকে বিভ্রান্ত করে কুরআনের সমাজ প্রতিষ্ঠা ও কুরআনের চেতনার লালন থেকে দূরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। যার কারণে বেশির ভাগ মুসলমানের দেশে কুরআন নিয়ে, আল্লাহ ও রাসূল নিয়ে কুৎসা রটনা করলেও এর কোনো প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে ওঠে না। অথবা ঠুনকো বাধা-বিপত্তির কাছে খোদাদ্রোহীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ বন্ধ হয়ে যায়। এমন দুর্বলমনা নিস্তেজ আত্মভোলা মুসলমানদের দিয়ে আদৌ কি কুরআনের সমাজ গঠন করা সম্ভব হবে? যারা কুরআনের সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অকাতরে জীবন দিচ্ছেন, তারা যদি কিয়ামতের ময়দানে আমাদের দায়িত্বের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেন তাহলে কি আমরা কোনো সদুত্তর দিতে সক্ষম হব? তাই মাঝে মাঝে সে গানের কথা মনে পড়লে চমকে উঠি-
‘‘আল কুরআনকে ভালোবেসে প্রাণ দিয়েছিল যারা
আজকে দেখো সামনে এসে, রক্তমাখা শহীদি বেশে ফের দাঁড়িয়েছে তাঁরা।’’
১১ মে কুরআন দিবস ঘোষণার দাবি
আমাদের দেশে নানা ধরনের দিবস পালন করা হয় জনসচেতনতা তৈরির জন্য, বিশেষ বিষয়কে স্মরণীয় করে রাখার জন্য। কিন্তু দিবসগুলোর অধিকাংশই অর্থহীন ও চরিত্রবিধ্বংসী উৎসবে পরিণত হয়। যুবক-যুবতীরা নিজেদের ধর্ম, বিবেক, অর্জিত শিক্ষা, সমাজ-কৃষ্টি, আদব-কায়দা, মনুষ্যত্ববোধ বিকিয়ে দিয়ে উন্মাদনায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিশেষ করে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, থার্টিফার্স্ট নাইট, নিউ ইয়ার, পয়লা বৈশাখে কী না হয়! আবেগ, সঙ্গদোষে বল্গাহীন স্রোতের তোড়ে নিজেদের যারা মুহূর্তে ভাসিয়ে দেয়, সে জাতি দিয়ে হয়তো অনেক কিছু করা সম্ভব; কিন্তু এমন উলঙ্গ কর্মযজ্ঞ অব্যাহত থাকলে কালান্তরে একাটি আত্মবিশ্বাসহীন, ভঙ্গুর জাতির ভিত্তি যে নির্মিত হবে, তা হলফ না করে বললেও পারিপার্শি¦কতা থেকে সহজে অনুমেয়। যে কারণে সমাজে এমন কিছু অঘটন ক্রমে ঘটেই চলছে যে সমাজ সে তুলনায় ‘অ্যান্টিভাইরাস’ সাপ্লাই করতে পারছে না। দুরারোগ্য ব্যাধি সংক্রমিত হয়ে এখন আমাদের সভ্যতা লাইফ সাপোর্টে আছে বললে ভুল হবে না। এ উদ্বেগ নিশ্চয়ই শুধু আমার নয়, হাজার-লক্ষ হৃদয়ের। কিন্তু যার যার অবস্থান থেকে যদি কোনো উদ্যোগ নেয়া না যায়, তাহলে কি হৃদয়ে যন্ত্রণা বৃদ্ধি বৈ এ উদ্বেগের কোনো সার্থকতা থাকতে পারে? তাই ঐতিহাসিক ১১ মে কুরআন দিবসকে আমরা সমাজের জন্য একটি ‘অ্যান্টিবায়োটিক’ হিসেবে চালু করতে চাই। যে জাতি কুরআনের সম্মান রক্ষায় জীবন দিতে পারে, সে জাতি দিকভ্রান্ত হতে পারে না। সরকারের উচিত হবে অতিসত্বর ১১ মেকে কুরআন দিবস হিসেবে ঘোষণা করা, জাতীয় দিবস হিসেবে ঘটা করে পালন করা। কুরআনের মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে যারা গুলি চালিয়েছিল তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা, কোন মহল কুরআনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে দেশে যেন গণ্ডগোল পাকাতে না পারে সে ব্যবস্থা করা। এ দাবির পক্ষে বুলন্দ আওয়াজ তোলা সকল মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব। বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধদের এককালে সাংঘাতিক ধরনের আধিপত্য থাকলেও ইসলামের মহান সেনানায়কদের নিরবচ্ছিন্ন অবিশ্রান্ত প্রচেষ্টার ফলে এ অঞ্চলে ইসলামের ভিত সুদৃঢ়ভাবে গ্রথিত হতে থাকে। কালের পরিক্রমায় মুসলিম শাসনের সফলতার কারণে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা অনেকে ধর্মীয় পরিচয় বিসর্জন দিয়ে ইসলামকে ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করতে না পারলেও ইসলামকে মৌন সমর্থন দিতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতো। এই অঞ্চলে মসজিদ, মক্তব ও ওয়াজ মাহফিল, জিকির আজকারের মাঝে ইসলাম সীমাবদ্ধ থাকলেও এ দেশে ইসলাম এখন জাতীয় জীবনে ভূমিকা রাখতে পারবে বলে অনেকেই মনে করেন। এর অনুসারীরা মনে করে এ দেশে অদূর ভবিষ্যতে ইসলামী কল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। এ লক্ষ্যেই এর অনুসারীরা দেশব্যাপী অবিরাম কাজ করে চলছে। যখন এ দেশে ইসলামী সংগঠনগুলো বাংলাদেশে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলতো, তখন স্যাকুলাররা মনে করত এ দাবি উত্থাপনকারীরা পাগলের প্রলাপ বকছে। কালান্তরে আজ প্রতীয়মান হতে চলছে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি এখন শুধু দাবি নয়, অচিরেই তা বাস্তবে রূপান্তরিত হবে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশে ইসলামপন্থী দলগুলোর ওপর সেক্যুলার সরকাররা তেমন কোনো বৈরী মনোভাব পোষণ না করলেও বর্তমানে জুলুম নির্যাতনের এক ভয়াল ছোবলে ইসলামপ্রেমীদের হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত করেই চলছে। কারণ সেক্যুলাররা এখন ইসলামপন্থীদের উত্থানে সাংঘাতিক তটস্থ। ক্ষমতালিপ্সুরা কুরআনের আন্দোলনকে তাদের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করেই আদর্শিক লড়াইয়ের পরিবর্তে যুলুম-নির্যাতনকে ক্ষমতায় টিকে থাকার পথ হিসেবে বাছাই করে নিয়েছে। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ দায়ী ইলাল্লাহ বদিউজ্জামান সাইয়্যেদ নুরসী, শহীদ হাসান আল বান্না, সাইয়্যেদ কুতুব শহীদ, সাইয়্যেদ আহমদ বেরলভী, শাহ ইসমাইল শহীদ, শায়খ আহমেদ সরহিন্দ, সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদী, শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা, শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী তাঁরা সবাই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নদ্রষ্টা। নির্যাতন, মামলা, কারাগারের অন্ধকার কুঠুরি, জালিম সরকারের ফাঁসির মঞ্চ তাঁদের নির্ভীকতা এবং অবিচলতার কাছে হার মেনেছে। পরাজিত হয়েছে সকল ষড়যন্ত্র। যখনই কুরআনের বিরুদ্ধে, ইসলামী আইনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছে, তখনই দ্বীনের এই মুজাহিদরা তাঁদের বক্তব্য ও লেখনীর মাধ্যমে ঈমানদারদের তাওহিদি চেতনাকে উজ্জীবিত করেছেন, তৈরি করেছেন প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের দেয়াল। এখনও দিকে দিকে নাস্তিক্যবাদীরা কুরআনের সম্মানকে ভূলুণ্ঠিত করার জন্য নানা ফন্দি-ফিকিরে ব্যস্ত। যেখানেই কুরআনের সম্মান লঙ্ঘন করার ঘৃণ্য চেষ্টা হবে, সেখানেই ইস্পাত কঠিন প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। ভেঙে দিতে হবে ইসলামবিদ্বেষীদের বিষদাঁত। কুরআনের সমাজ প্রতিষ্ঠার কাজে যারা বাধা দিতে চায়, কুরআনের পাখি আল্লামা সাঈদীকে যারা উদ্ভট অভিযোগে অপমানিত করতে চেয়েছিল, কুরআনের কর্মীদের যারা নিঃশেষ করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে ঈমানদারদের সংগ্রাম কি থেমে থাকতে পারে? কুরআন দিবসে এই হোক সবার প্রতিজ্ঞা। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
লেখক : সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি
আপনার মন্তব্য লিখুন