post

দুস্থ ও অসহায়ের প্রতি রাসূল সা.

এইচ. এম. মুশফিকুর রহমান

২৬ জুলাই ২০২৩

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম ছিলেন মানবদরদি ব্যক্তিত্ব। সমাজের বঞ্চিত, শোষিত, অত্যাচারিত ও অসহায় মানুষের জন্য তাঁর অন্তর ছিল সদা ব্যাকুল। আত্মীয়-অনাত্মীয় সব অভাবী মানুষের পাশে তাঁকে দেখা যেত। তিনি বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেন। সম্ভাব্য সব উপায়ে তিনি তাদের বিপদমুক্ত করার চেষ্টা চালাতেন। অত্যাচারী মনিবের হাত থেকে ক্রীতদাসদের মুক্তির জন্য তিনি অকাতরে অর্থ ব্যয় করতেন। ঋণভারে যাদের নাভিশ্বাস অবস্থা দেখা দিত তাদের ঋণমুক্ত করার জন্য তিনি সাহায্যের হাত বাড়াতেন। কারো অসুখের খবর পেলে তিনি তার কাছে হাজির হতেন, তাকে সান্ত¡না দিতেন এবং তার চিকিৎসার বন্দোবস্ত করতেন। একজন ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করেছিলেন, কিন্তু সেই অর্থের সিংহভাগ তিনি পরার্থে বিলিয়ে দিয়েছেন। কোনো অভাবী মানুষ হাত পেতে তাঁর নিকট থেকে খালি হাতে ফিরে যেত না। অভুক্তকে আহার করিয়ে তিনি দারুণ তৃপ্তি পেতেন।

দুস্থ, অসহায় ও গরিবদের সাহায্য করা রাসূল সা. এর অন্যতম গুণাবলি ছিল। রাসূল সা. সর্বপ্রথম যখন ওহির সংবাদ এবং ভয় পাওয়ার কথা খাদিজা রাদিআল্লাহু আনহাকে জানান, তখন তিনি তাঁর বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “আল্লাহর কসম, আল্লাহ আপনাকে কখনো লাঞ্ছিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সদাচরণ করেন, অসহায় দুস্থদের দায়িত্ব বহন করেন, নিঃস্বকে সহযোগিতা করেন, মেহমানের আপ্যায়ন করেন এবং হক পথের দুর্দশাগ্রস্তকে সাহায্য করেন।” (বুখারি : ৩)।

রাসূল সা. ছিলেন নিঃস্ব, অসহায় ও ইয়াতিম। পবিত্র কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তাআলা তাঁর সর্বোত্তম উপমা দিয়ে বলেছেন, “তিনি কি আপনাকে ইয়াতিম রূপে পাননি? অতঃপর তিনি আশ্রয় দিয়েছেন। তিনি আপনাকে পেয়েছেন পথহারা, অতঃপর পথপ্রদর্শন করেছেন। তিনি আপনাকে পেয়েছেন নিঃস্ব, অতঃপর অভাবমুক্ত করেছেন। সুতরাং আপনি ইয়াতিমের প্রতি কঠোর হবেন না। সওয়ালকারীকে ধমক দেবেন না এবং আপনার পালনকর্তার নিয়ামতের কথা প্রকাশ করুন।’’ (সূরা দোহা : ৬-১১)

এ আয়াতগুলোতে উঠে এসেছে মানবতার সেবার প্রতি উদ্বুদ্ধকারী নসিহতগুলো। যেভাবে আল্লাহ তাআলা বিশ্বনবীকে তাঁর অসহায়ত্বের সময় আশ্রয় দিয়েছিলেন এবং তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন এবং মানুষের অসহায়ত্বের সময় করণীয় কী হবে তা বর্ণনাও করেছেন। আল্লাহ তাআলা দুঃস্থ মানবতার সেবায় নিজেদের আত্মনিয়োগ করতে নসিহত পেশ করে বলেন, “তারা আল্লাহর প্রেমে অভাবগ্রস্ত, এতিম ও বন্দীকে আহার্য দান করে। তাঁরা বলে,  কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমরা তোমাদেরকে আহার্য দান করি এবং তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা কামনা করি না।’’ (সূরা দাহর : ৮-৯)।

এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা অসহায়, ইয়াতিম, মিসকিন এবং বন্দীদের খাবার দান করাকে মুমিনের অন্যতম গুণ বা বৈশিষ্ট্য হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। অসহায়দের পাশে না দাঁড়ানো, তাদের খোঁজ-খবর না রাখা, তাদের বিপদে এগিয়ে না আসা; এগুলো কোনো মুমিনের  বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। বরং মুমিনগণ থাকবে দুস্থ মানবতার সেবায় সদা তৎপর। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের উদ্দেশ্যে বলেন, “মুমিন তারাই যারা অসার কাজ-কর্ম বা কথা-বার্তা থেকে বিরত থাকে এবং যারা জাকাত প্রদানে সক্রিয় হয়।’’ (সূরা মুমিনুন : ৩-৪)। দুস্থদের সহযোগিতার বিধান জারি করে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন, “জাকাত হলো  কেবল ফকির, মিসকিন, জাকাত আদায়কারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন তাদের হক এবং তা দাস-মুক্তিতে ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জিহাদকারীদের জন্য এবং মুসাফিরদের জন্য, এই হলো আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।” (সূরা তাওবা : ৬০)।

মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে গরিব-মিসকিন ও অসহায়কে অবজ্ঞার চোখে দেখা। এরা অভাব-অনটনে যেমন জর্জরিত, তেমনি সম্পদশালীর কাছেও অবহেলিত। এদের পক্ষে কথা বলার কোনো মানুষ নেই। নেই তাদের মানসিক কষ্টগুলোকে ভাগাভাগি করে নেওয়ার মতো কোনো সুজনও। সামাজিকভাবে  যেহেতু এরা মর্যাদাহীন, তাই ব্যক্তির কাছেও মূল্যহীন। মানুষের ভালোবাসা থেকে এরা নিদারুণভাবে বঞ্চিত। অথচ আল্লাহ তাআলা ও তাঁর হাবিব বিশ্বমানবতার নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এই শ্রেণির  লোকদের গুরুত্ব অনেক বেশি। আমাদের প্রাণপ্রিয় রাসূল সা. ছিলেন একেবারেই এতিম। এতিম ছিলেন বলেই তিনি বুঝতেন এতিম ও অসহায়দের কষ্ট। তাদের সকল কষ্টই তিনি অনুভব করতেন একান্ত হৃদয় দিয়ে এবং সবসময় তাদের কষ্ট দূর করার জন্য তিনি ব্যাকুল থাকতেন। 

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামের সময়ে এক ঈদে নামাজ শেষে ঘরে ফিরছেন তিনি। তখন দেখলেন মাঠের এক কোণে বসে কাঁদছে একটি তুলতুলে কোমল শিশু। এই খুশির দিনেও কান্না! অবাক হলেন রাসূল সা.। তাঁর হৃদয়ে বেদনার ঢেউ আছড়ে পড়লো। তিনি ছেলেটির কাছে গিয়ে কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। শিশুটি বললো, আমার আব্বা-আম্মা নেই। কেউ আমাকে আদর করে না। কেউ আমাকে ভালোবাসে না। আমি কোথায় যাবো? ছেলেটির কথা শুনে গুমরে কেঁদে উঠলো নবীজীর কোমল হৃদয়। জেগে উঠলো তাঁর মর্মবেদনা। তিনি পরম আদরে শিশুটিকে বাড়ি নিয়ে গেলেন। ছেলেটিকে বললেন, আজ থেকে আমরাই তোমার পিতা-মাতা। আমরাই তোমার অভিভাবক। কী, খুশি তো! তাঁর কথা শুনে ছেলেটির চোখে মুখে বয়ে গেল আনন্দের বন্যা। এই ছিল এতিমের প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালোবাসার এক বিরল দৃষ্টান্ত!

রাসূল সা. এতিমের প্রতিপালন জান্নাতে যাওয়ার একটি সহজ উপায় বলে ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, “যে ব্যক্তি কোনো এতিমকে আপন মাতা-পিতার সঙ্গে নিজেদের (পারিবারিক) খাবারের আয়োজনে বসায় এবং (তাকে এই পরিমাণ আহার্য দান করে যে) সে পরিতৃপ্ত হয়ে আহার করে, তাহলে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে।’’ (মুসনাদে আহমাদ : ১৮২৫২)। তিনি ইরশাদ করেছেন, “মুসলিমদের ওই বাড়িই সর্বোত্তম, যে বাড়িতে এতিম আছে এবং তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা হয়। আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট ওই বাড়ি, যে বাড়িতে এতিম আছে অথচ তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা হয়। অতঃপর তিনি তাঁর অঙ্গুলির মাধ্যমে বলেন, ‘আমি ও এতিম প্রতিপালনকারী জান্নাতে এমনভাবে অবস্থান করব।’’ (ইবনে মাজাহ : ৩৬৭৯)।

অসহায়দের প্রয়োজনে পাশে দাঁড়ানোকে ইবাদত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।  কেউ সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তা না করলে পরকালে শাস্তি পেতে হবে। এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “কিসে  তোমাদের দোজখে নিক্ষেপ করেছে? তারা বলবে, আমরা মুমিনদের দলভুক্ত ছিলাম না, আমরা অভাবগ্রস্তকে আহার্য দান করতাম না।” “সূরা মুদ্দাসসির : ৪২-৪৪)। হাদিসে এসেছে, রাসূল সা. বলেছেন, “মহান আল্লাহ কেয়ামতের দিন বলবেন, ‘হে আদম সন্তান! আমি অসুস্থ ছিলাম, তুমি আমাকে দেখাশুনা করোনি।’ সে বলবে, ‘হে আমার রব! কীভাবে আমি আপনাকে দেখাশুনা করব, আপনি তো সৃষ্টিকুলের রব?’ তিনি বলবেন, ‘তুমি কি জানতে না  যে, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল? অথচ তুমি তাকে দেখাশুনা করোনি। তুমি কি জানতে না যে, তুমি যদি তাকে দেখাশুনা করতে, তাহলে অবশ্যই তুমি আমাকে তার কাছে পেতে? হে আদম সন্তান! আমি তোমার কাছে খাবার চেয়েছিলাম, তুমি আমাকে খাওয়াওনি।’ সে বলবে, ‘হে আমার রব! আমি আপনাকে কীভাবে খাওয়াব, আপনি তো সৃষ্টিকুলের রব?’ আল্লাহ বলবেন, ‘তোমার কি জানা ছিল না যে, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাবার চেয়েছিল, কিন্তু তাকে তুমি খাবার দাওনি? তোমার কি জানা ছিল না যে, যদি তাকে খাওয়াতে, তাহলে অবশ্যই তা আমার কাছে পেতে? হে আদম সন্তান! তোমার কাছে আমি পানি পান করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে পানি পান করাওনি।’ বান্দা বলবে, ‘হে আমার রব! আপনাকে কীভাবে পানি পান করাবো, আপনি তো সকল সৃষ্টির রব?’ তিনি বলবেন, ‘আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে পানি চেয়েছিল, তুমি তাকে পানি পান করাওনি। তুমি কি জানতে না যে, যদি তাকে পানি পান করাতে, তাহলে তা অবশ্যই আমার কাছে পেতে!” (মুসলিম : ২৫৬৯)।

রাসূল সা. এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল দানশীলতা। তিনি এতটাই দানশীল ছিলেন যে, কেউ তাঁর কাছে কিছু চাইলে তিনি তাকে ফিরিয়ে দিতে পারতেন না। এক হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, সাহল ইবনে সাদ রা. বলেন, এক নারী রাসূলের কাছে একটি ‘বুরদাহ’ নিয়ে এলেন। সাহল রা. লোকজনকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা কি জানেন ‘বুরদাহ’ কী? তাঁরা বলেন, তা চাদর। সাহল রা. বলেন, এটি এমন চাদর যা ঝালরসহ বোনা। এরপর ওই নারী বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমি আপনাকে এটি পরার জন্য দিলাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চাদরখানা এমনভাবে গ্রহণ করেন, যেন তাঁর চাদরটি দরকার ছিল। এরপর তিনি চাদরটি পরলেন। সাহাবিদের মধ্যে এক ব্যক্তি সেটি তাঁর দেহে দেখে বলল, হে আল্লাহর রাসূল, এটা কতই না সুন্দর! আপনি এটি আমাকে দিয়ে দিন। নবী সা. বলেন, ‘হ্যাঁ’ (দিয়ে দেব)। নবী. উঠে চলে গেলে অন্য সাহাবিরা তাঁকে দোষারোপ করে বলেন, তুমি ভালো কাজ করোনি। এটি তাঁর প্রয়োজন ছিল বলেই তিনি চাদরখানা এমনভাবে গ্রহণ করেছেন। এর পরও তুমি সেটা চাইলে। অথচ তুমি অবশ্যই জানো যে তাঁর কাছে কোনো জিনিস চাওয়া হলে তিনি কাউকে কখনো বিমুখ করেন না। তখন সেই ব্যক্তি বলল, যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটি পরেছেন, তখন তাঁর বরকত লাভের জন্যই আমি এ কাজ করেছি, যাতে এ চাদরে আমার কাফন হয়।’’ (বুখারি : ৬০৩৬)।

ওপরের হাদিসের ভাষ্য দ্বারা বোঝা যায়, চাদরটি রাসূল সা. এর খুবই পছন্দ হয়েছিল এবং তা তাঁর প্রয়োজনও ছিল। কিন্তু এরপরও তিনি তা ওই সাহাবিকে দিয়ে দিয়েছেন। তাঁর দান-সদকার হাত এতটাই লম্বা ছিল যে, তা যে কাউকেই বিস্মিত করত। আনাস রা. বলেন, জনৈক লোক নবী সা. এর কাছে এলো। তিনি তাকে এত বেশি ছাগল দিলেন, যাতে দুই উপত্যকার মাঝামাঝি স্থান পরিপূর্ণ হয়ে যাবে। এরপর ওই ব্যক্তি তার গোত্রের কাছে গিয়ে তাদের বলল, হে আমার জাতি ভাইয়েরা, তোমরা ইসলাম গ্রহণ করো। কারণ মুহাম্মদ সা. অভাবের আশঙ্কা না করে দান করতেই থাকেন।’’ (মুসলিম : ৫৯১৪)। আল্লাহ তাআলা মানবজাতির পরিচয় তুলে ধরেছেন এভাবে, “তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি, মানুষের কল্যাণের জন্য  তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে।’’ (সূরা আলে ইমরান : ১১০)

অভুক্ত ব্যক্তিকে আহার্য দেওয়ার ফজিলত বর্ণনা করতে গিয়ে রাসূল সা. বলেছেন, “মানুষের কল্যাণ-সংশ্লিষ্ট যত কাজ আছে, তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম হচ্ছে দরিদ্র ও ক্ষুধার্তকে খাবার দান করা।’’ (বুখারি : ১২)

একদিন রাসূল সা. জোহরের নামাজের পর সাহাবায়ে কেরামদের জিজ্ঞেস করলেন, আজ তোমাদের মধ্যে কে রোজা রেখেছে? আবু বকর সিদ্দিক রাদিআল্লাহু আনহু উত্তর দিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আজ আমি রোজা  রেখেছি। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, আজ তোমাদের মধ্যে কে গরিব-মিসকিনকে সদাকা করেছে? আবু বকর রা. উত্তর দিলেন, ইয়া নবী, আমি আজ গরিব-মিসকিনকে সদাকা করেছি। নবীজি আবার প্রশ্ন করলেন, আজ তোমাদের মধ্যে কে অসুস্থ ব্যক্তিকে  দেখতে গিয়েছিলে? 

আবু বকর রা. দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল সা., আজ আমি একজন অসুস্থ ভাইকে দেখতে গিয়েছিলাম। রাসূল সা. আবার প্রশ্ন করলেন, আজ তোমাদের মধ্যে কে জানাজায় অংশগ্রহণ করেছে? আবু বকর রা. জবাব দিলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমি জানাজায় অংশগ্রহণ করেছি। রাসূল সা. পঞ্চমবার প্রশ্ন করলেন, আজ তোমাদের মধ্যে কে মুসলিম ভাইয়ের মধ্যে সমঝোতা করেছে? আবু বকর রা. উত্তর দিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি সমঝোতা করে দিয়েছি। অতঃপর রাসূল সা. বললেন, যে লোক এই ভালো আমলগুলো করবে, তার প্রতিদান জান্নাত ছাড়া আর কিছু নয়।” (মুসলিম : ১০২৮)।

ক্ষুধার্তকে খাবার দান করে আল্লাহর বিশেষ সাহায্য লাভ করা যায়। রাসূল সা. বলেন, “যে ব্যক্তি কোনো গরিবের চলার পথ সহজ করে দেয়, দুনিয়া-আখিরাতে আল্লাহ তার চলার পথ সহজ করে দেবেন।’’ (আবু দাউদ : ২৫৯৪)।

আল্লাহ তাআলা বলেন, “নিশ্চয়ই মুমিনরা আল্লাহর প্রতি তাদের ভালোবাসার খাতিরে ক্ষুধার্ত এতিম, মিসকিন ও কয়েদিদের খাবার দান করে। যার কারণে মহান আল্লাহ তাদের কিয়ামতের সেই ভয়াবহ দিনের অনিষ্ঠ থেকে রক্ষা করবেন। শুধু তাই নয়; বরং তাদের দান করবেন আনন্দ ও সজীবতা। তাদের ধৈর্যশীলতার জন্য দেবেন জান্নাতের রেশমি পোশাক। জান্নাতে তারা উচ্চ আসনে হেলান দিয়ে বসবে।” (সূরা দাহার : ৮-২২)।

ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান করলে মহান আল্লাহ খুশি হন। একদা এক ব্যক্তি মহানবীর কাছে এসে বললেন, আমি ক্ষুধায় কাতর হয়ে গেছি। আল্লাহর নবী ত্বরিত তাঁর এক স্ত্রীর নিকট খবর পাঠালেন। তখন খবর আসলো বাড়িতে পানি ব্যতীত কিছুই নেই। অতঃপর তিনি অন্য স্ত্রীর নিকট খবর পাঠালেন তিনিও জানালেন আল্লাহর কসম বাড়িতে পানি ব্যতীত কিছুই নেই। এমনকি তিনি সকল স্ত্রীর নিকটেই খবর পাঠালেন এবং সকলে একই কথা বলল। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবিদের মাঝে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলেন কে এই রাতে এই ক্ষুধার্তকে মেহমান হিসেবে গ্রহণ করবে?

সাহাবিদের মধ্যে আবু তালহা আনসারি রা. বললেন, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আমি এ ক্ষুধার্তকে মেহমান হিসেবে গ্রহণ করলাম। অতঃপর আবু তালহা রাদিআল্লাহু আনহু ক্ষুধার্ত ব্যক্তিটিকে সাথে নিয়ে তাঁর বাড়িতে গেলেন। তাঁর স্ত্রীকে বললেন, তোমার নিকট কোনো খাবার আছে কি? রাসূল সা. এর ক্ষুধার্ত মেহমানের আপ্যায়ন করো। তাঁর স্ত্রী বললেন, ঘরে কেবল বাচ্চাদের স্বল্প খাবার আছে। আবু তালহা তাঁর স্ত্রীকে বললেন, তাতেই চলবে। তুমি বাচ্চাদেরকে কোনো জিনিস দ্বারা ভুলিয়ে তাদেরকে ঘুম পাড়িয়ে দিবে আর মেহমান যখন আমাদের ঘরে প্রবেশ করবে তখন তুমি বাতি নিভিয়ে দেবে এবং তাঁকে বুঝাবে যে আমরাও খাবার খাচ্ছি। অতঃপর তাঁরা পরিকল্পনা মতো তাই করলেন এবং দু’জনে উপবাসে রাত কাটিয়ে দিলেন। পরদিন সকাল বেলা আবু তালহা রা. যখন নবীজি কাছে গেলেন, তখন তিনি তাঁকে কাছে ডেকে বললেন, জিবরাঈল আ. এসে আমাকে খবর দিয়েছেন তোমরা কাল রাতে ওই ক্ষুধার্ত  মেহমানের সাথে যে আচরণ করেছ তাতে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা আশ্চর্য হয়েছেন অথবা তিনি হেসেছেন।”  (বুখারি : ৪৮৮৯)

অভাবের ভয়ে বিধবা ও মিসকিনদের অবহেলা করা উচিত নয়। যারা তাদের পুনর্বাসনের চেষ্টা করে, তারা অফুরন্ত কল্যাণ লাভ করে। রাসূল সা. বলেছেন, যে লোক বিধবা ও মিসকিনদের ভরণ-পোষণের ব্যাপারে চেষ্টা করে, সে আল্লাহর পথে জিহাদকারীর মতো অথবা সে ওই ব্যক্তির মতো, যে দিনে সিয়াম পালন করে ও রাতে (ইবাদতে) দণ্ডায়মান থাকে।’’ (বুখারি : ৬০০৬)

সমাজে এতিম, অক্ষম ও প্রতিবন্ধীদের রাসূল সা. রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিপালনের ব্যবস্থা করেন। বায়তুলমাল থেকে তাদের সহায়তা প্রদানের ঘোষণা দিয়ে বলেন, “যদি কেউ সম্পদ  রেখে মারা যায় তাহলে সে সম্পদ তার উত্তরাধিকারীর। আর যদি কেউ সহায়হীন এতিম ও বিধবা রেখে মারা যায় তাহলে তার ব্যবস্থাকারী আমি স্বয়ং।” (তিরমিজি : ২/২৯)

নবীজির নির্দেশনায় তাঁর প্রিয় আনসার সাহাবিরা মুহাজির সাহাবিদের অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান প্রদানের যে নজির স্থাপন করেছেন পৃথিবীর ইতিহাসে তা বিরল। মদিনার আনসার সাহাবিরা মক্কা থেকে আগত মুহাজির সাহাবিদেরকে নিজের ধনসম্পদ এমনকি নিজেদের বাসস্থান পর্যন্ত প্রদান করেন। মসজিদে নববীর একটি স্থানে রাসূল সা. পরিজনহারা সহায়-সম্বলহীন মানুষের বসবাস ও পানাহারের জন্য সুফফা নামের একটি ছাউনি স্থাপন করেন। আশ্রয়হীন লোকজন সেখানে আশ্রয় নিত। রাসূল সা. নিজ তত্ত্বাবধানে তাদের খাদ্য, বস্ত্র ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় বন্দোবস্ত করতেন। রাসূল সা. তাঁর দস্তরখানায় বসিয়ে তাদের খাওয়াতেন। বায়তুলমাল থেকে যথাসম্ভব তাদের সাহায্য করতেন।

আজ আমাদের আশপাশে কত অভুক্ত, কত দুস্থ, কত অসহায়, কত দরিদ্র, কত দিনমজুর, কত আবালবৃদ্ধবনিতা হাহাকার করছে, নীরবে-নিভৃতে রোদন করছে, তার খবর আমরা রাখি না। অথচ দুস্থ, দরিদ্র ও অসহায় মানুষের সেবা করতে মানবতার নবী আমাদের হাতে-কলমে শিক্ষা দিয়ে  গেছেন। আমাদের উচিত, রাসূলের শিক্ষার আলোকে দুস্থ, অসহায় ও হতদরিদ্রদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের মুখে খাবার তুলে দেওয়া ও তাদের দুঃখ লাঘবে প্রাণপণ চেষ্টা করা।

লেখক : প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির