post

আওয়ামী দুঃশাসনে বিচারব্যবস্থা প্রেক্ষিত শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা রাহিমাহুল্লাহ

নূরুল ইসলাম

০১ আগস্ট ২০২৩

২০১০ সালের শুরুর দিকে দেশব্যাপী আওয়ামী সরকারের অপকর্মের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সমাবেশের আয়োজন করতে থাকে। এরই অংশ হিসেবে ৯ই ফেব্রুয়ারি খুলনার বাবরি চত্বরে জামায়াতে ইসলামীর বিশাল বিভাগীয় সমাবেশ ছিলো। সমাবেশ শেষে সন্ধ্যায় খুলনার রয়েল হোটেলে শিবিরের সদস্যদের সাথে জামায়াতে ইসলামীর সকল জাতীয় নেতৃবৃন্দের মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। ঐদিনই আমার শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইয়ের সাথে প্রথম এবং শেষ সাক্ষাৎ হয়। সে সময় নেতৃবৃন্দের বক্তব্য সদস্যদের উপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। বিশেষ করে কাদের মোল্লা ভাইয়ের সাবলীল বক্তব্য, হাসিমাখা মুখ এবং সাধারণ চলাফেরা আমাকে বেশ মুগ্ধ করেছিলো। উল্লেখ্য, সেদিনই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারুক হত্যাকাণ্ডের নাটক সাজিয়ে দেশব্যাপী সকল ক্যাম্পাস থেকে শিবিরকে উৎখাতের নীলনকশা শুরু হয়। দেশে বিরোধী মত দমনের কাজ আওয়ামী লীগ শক্ত হাতেই শুরু করেছিলো। যার প্রথম টার্গেট হয় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রশিবির।

ডিসেম্বর ২০১২ সালের কথা বলছি, তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথমবর্ষের ছাত্র। সারাদেশে তৎকালীন আমীরে জামায়াতসহ জাতীয় সকল নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবিতে জামায়াতে ইসলামীর ডাকে চলছে ব্যাপক প্রতিবাদ, সভা-সমাবেশ এবং মিছিল। এদিকে সরকারও খুব দ্রুত গতিতে নিজস্ব বিচারপতি নিয়োগ দিয়ে তড়িঘড়ি করে বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করে। তারা সমান্তরালভাবে ২টি তথাকথিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। দায়িত্বশীলরা যখন বুঝতে পেরেছিলেন যে, আইনের মাধ্যমে সরকারের পাতানো প্রহসনের বিচারপ্রক্রিয়ায় সুবিচার পাওয়া আদৌ সম্ভব নয়। ঠিক এমনই সময়ে ২০১৩ সালের শুরুতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীলদের মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী তীব্র আন্দোলন শুরু করে। এতে আওয়ামী সরকারও পুলিশের মাধ্যমে ব্যাপক দমন-পীড়ন, নির্যাতন ও গণগ্রেফতার চালাতে থাকে। পাশাপাশি নির্বিচারে চালাতে থাকে মিছিলে গুলিবর্ষণ। প্রথমে তারা বিচারকার্য শুরু করে জামায়াতের ‘থিংক ট্যাংক’ খ্যাত আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইয়ের। আন্দোলনের তীব্রতার কারণে ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ সালে ট্রাইব্যুনাল-২ কাদের মোল্লা ভাইয়ের ফাঁসির রায় ঘোষণা না দিয়ে যাবজ্জীবন রায় ঘোষণা করে। কিন্তু এখান থেকেই শুরু হয় ভারতের ‘র’-এর প্রেসক্রিপশনে ইসলামী আন্দোলনকে উৎখাতের ভিন্ন নীলনকশা।

রায় ঘোষণার দিন তারা শাহবাগের মোড়ে কিছু বামদলের নেতা ও নাস্তিক ব্লগারদের বসিয়ে দেয়। তৈরি করে তথাকথিত গণজাগরণ মঞ্চ। তারা সেখানে ইসলামবিদ্বেষী ও কুরুচিপূর্ণ স্লোগান দিতে থাকে। আর সরকারি পৃষ্ঠ-পোষকতায় খিচুড়ি-বিরিয়ানি রান্না করে ভোজন উৎসব চলতে থাকে। সারা রাত ছেলে-মেয়েদের অশ্লীল মেলামেশা আর মাদক গ্রহণও চলতে থাকে অবাধে। যার রিপোর্ট তৎকালীন পত্রিকাগুলোতে এসেছে একাধিকবার। এ যেন সরকারি খরচে পিকনিক আর উৎসবের মহা আয়োজন। অন্যদিকে তথাকথিত ইসলামবিদ্বেষী সুশীলসমাজ ও হলুদ মিডিয়া রাতদিন এটাকে ব্যাপক কভারেজ দিতে থাকে। সেখান থেকে তারা দাবি তোলে আব্দুল কাদের মোল্লাসহ সকল জামায়াত নেতাদের ফাঁসি দিতে হবে। যেন মামার বাড়ির আবদার! তাদের এ অযৌক্তিক দাবির প্রেক্ষিতে ১৭ই ফেব্রুয়ারি সংসদ রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামি পক্ষকে আপিলের সমান সুযোগ রেখে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস আইন, ১৯৭৩ সংশোধন করে। মূলত ১৯৭৩ সালের এই আইনটি শেখ মুজিবুর রহমান করেছিলেন ১৯৫ জন পাকিস্তানি সেনাদের বিচারের জন্য। এর আগে এই আইন অনুযায়ী শুধু আসামি পক্ষই আপিলের সুযোগ পেতো। কিন্তু এই আইন সংশোধনের উদ্দেশ্য ছিলো আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইয়ের ফাঁসির রায় নিশ্চিত করা। প্রচলিত আইনের নিয়মে একবার যে আইনে কোনো ব্যক্তির বিচার শুরু হয় সে আইনের অধীনেই সে মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে। যেমন: কিছুদিন আগে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট সংশোধন হলেও আইনমন্ত্রী বলেছেন যে, পূর্বে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের পূর্বের আইনেই বিচার করা হবে। এছাড়া পৃথিবীর যেসকল দেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে যেমন: নুরেমবার্গ ও টোকিও ট্রাইব্যুনাল ইত্যাদি কোনো আইনেই এ জাতীয় বিধান লক্ষ্য করা যায়নি। এ সকল নজির আদালতের সামনে আনা হলেও সরকারের পাতানো আদালত সব শুনেও কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।

আপিল শুনানি শেষে ১৭ই সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোটের আপিল বিভাগ কাদের মোল্লা ভাইয়ের ফাঁসির আদেশ দেয়। তাদের প্রসিকিউশনের তৈরি করা কশাই কাদের নামে কাদের মোল্লা ভাইয়ের বিচার করে ৮ই ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল তার নামে মৃত্যুর পরোয়ানা জারি করে। ঐদিনই তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। অনেক নাটকীয়তার পর ১২ই ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখ রাত ১০:০১মি: এ ফ্যাসিবাদী সরকার দ্বীনের এই মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর করে।

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দ্বীনকে বিজয়ী করার প্রত্যয়ে যারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, তাদের পথ চলা নিঃসন্দেহে বর্ণনাতীত কঠিন। এ কাঠিন্যের মাপকাঠি দিয়ে মহান প্রভু তার অতি প্রিয় বান্দাদেরকে বাছাই করে নেন। পথ চলতে চলতে যখন নানা মোহ ও ভীতির আশঙ্কা আমাদের পথ আগলে দেয়। তখন হৃদয়ের মাঝে অমর হয়ে থাকা শহীদের স্মৃতি, আমাদের মনে আশার দ্বীপ শিখা জ্বালায়। শহীদরা মুসলিম মিল্লাতের জীবন, মিল্লাতের গৌরব, দুর্যোগের রাহবার। হতাশাগ্রস্ত মুসাফিরের জন্য তারা ধ্রুবতারা। তারা জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে সাক্ষী হয়ে আছেন আমাদের জন্য। অন্যদিকে সেই নাস্তিক শাহবাগীরা পতিত হয়েছে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে।

শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা রহ.-এর পরিচয় :

ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলার আমিরাবাদ গ্রামের মরহুম সানাউল্লা মোল্লার ছেলে আব্দুল কাদের মোল্লা রহ. ১৯৪৮ সালের ২ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। আব্দুল কাদের মোল্লা রহ. ১৯৬১ সালে আমিরাবাদ ফজলুল হক ইনস্টিটিউশনে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। ১৯৬৬ সালে ফরিদপুরের সরকারি রাজেন্দ্র কলেজে বিএসসি প্রথমবর্ষে পড়ার সময় ছাত্র ইউনিয়ন ছেড়ে ইসলামী ছাত্রসংঘে যোগদান করেন।

এরপর তিনি ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবের শাসনকালেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থিত উদয়ন হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। এরপর ১৯৭৪ সালে তিনি সরকারি প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ফাউন্ডেশনে চাকরি নেন। এ সময় তার বিরুদ্ধে দেশের কোথাও কোনো মামলা হয়নি।

১৯৮০ সালে বাংলাদেশে সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত ফুয়াদ আবদুল হামিদ আল খতিবের ব্যক্তিগত উদ্যোগে ও আর্থিক সহায়তায় দেশে মুসলমান ছেলেমেয়েদের আন্তর্জাতিক মানের একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে গুলশান ১ নম্বর মার্কেটের দক্ষিণ পাশে ‘মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুল’ নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮০ সালে তিনি দৈনিক সংগ্রামের নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ঢাকা মহানগর জামায়াতের কর্মপরিষদের সদস্য এবং পরবর্তীতে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল পদে দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি জামায়াতের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল পদে নিয়োজিত হন। তিনি ১৯৮৬ ও ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফরিদপুর-৪ (সদরপুর-চরভদ্রাসন) আসনে জামায়াতে ইসলামী থেকে নির্বাচন করেন। শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা রহ. ১৯৯৫ সালে কেয়ারটেকার সরকার আন্দোলনে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে সর্বদলীয় লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য হিসেবে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন।

১৯৬৪ সালে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশগ্রহণ এবং বামপন্থীদের সাথে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন। ১৯৮৫ সালের ২২ এপ্রিল স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখায় ঢাকার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৯৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমদের সাথে একই দিনে তিনি গ্রেফতার হন।

বিবাহ : শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার শ্বশুর দিনাজপুর নিবাসী মীর নাতেক আলী প্রথম শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি বই এবং পত্রিকা পড়তে পছন্দ করতেন। তৎকালীন জনপ্রিয় পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত আব্দুল কাদের মোল্লার লেখা “মেরাজ একটি বৈজ্ঞানিক সত্য” শিরোনামের আর্টিকেল মীর নাতেক আলীর মনোযোগ আকর্ষণ করে। ঘটনাক্রমে আব্দুল কাদের মোল্লার সাথে মেয়ের বিয়ের প্রস্তাবে বিনাবাক্যে রাজি হন। শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা রহ. ১৯৭৭ সালের ৮ অক্টোবর বেগম সানোয়ার জাহানের সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন।

শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা রহ.-এর জ্ঞান পিপাসা :

বই পড়া ছিলো তার নিয়মিত অভ্যাস। তার স্ত্রীর ভাষ্যমতে, তিনি শত ব্যস্ততার মাঝেও নিয়মিত বই পড়তেন। জ্ঞানপিপাসু এই মানুষটি জ্ঞানার্জনে ছিলেন অবিচল। ছোটবেলা থেকেই তিনি বই কিনতেন, নিজের লাইব্রেরি ছিল তার সেই সদরপুরের জীবন থেকেই। ইসলামি আদর্শে বিশ্বাসী মানুষটি শুধু ইসলামি বই-পুস্তকের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন তা নয়, বরং তিনি সকল কুরআন, হাদিস, ইসলামি সাহিত্যের পাশাপাশি অন্যান্য ধর্ম, মতাদর্শ, দর্শন, বিজ্ঞানের বই পড়তেন। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার সময়ে গাড়িতে তিনি বই পড়তেন। আন্তর্জাতিক রাজনীতির উপরে ইংরেজিতে লেখা বই উনি নিয়মিত সময় করে পড়তেন। আন্তর্জাতিক নানা পত্র-পত্রিকার আর্টিকেল প্রিন্ট করে রাতে শোয়ার সময়ও পড়তেন।

বিচারের নামে এক্সট্রা-জুডিশিয়াল কিলিং :

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার তড়িৎগতিতে করার জন্য ২০১২ সালের ২২ই মার্চ এই সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ গঠন করে। শুরুতে এই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ছিলেন এ টি এম ফজলে কবীর। সাথে অন্য ২ জন সদস্য হলেন হাইকোর্টের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও প্রথম ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার বিচারপতি মোহাম্মদ শাহিনুল ইসলাম। এরা সকলেই ছিলেন আওয়ামী লীগ অনুগত বিচারক। ১১ ডিসেম্বর ২০১২ তারিখে ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারপতি নিজামুল হক স্কাইপি কেলেঙ্কারির কারণে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এই নিজামুল হক নাসিম ১৯৯২ সালে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত গণআদালতের মাধ্যমে অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে প্রদত্ত প্রতীকী রায়ের দাবিতে সমাবেশে অংশ নিয়েছিলো। এরপর ট্রাইব্যুনাল-১ এ এ টি এম ফজলে কবীরকে চেয়ারম্যান করা হয়। পাশাপাশি ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান করা হয় ওবায়দুল হাসানকে (বর্তমান প্রধান বিচারপতি)। সাথে বিচারপতি মোহাম্মদ শাহিনুল ইসলাম ও হাইকোর্টের বিচারপতি মুজিবুর রহমান মিয়াকে নিয়ে ট্রাইব্যুনাল-২ বিচারকার্য শুরু করে। এই ট্রাইব্যুনালই শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা, শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, শহীদ মাওলানা আব্দুস সুবহান, শহীদ মীর কাশেম আলী মিন্টু, শহীদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় দেয়। ট্রাইব্যুনাল-২ থেকেই মূলত ফাঁসির রায় দেওয়া শুরু হয়।

কে এই ওবায়দুল হাসান!

বর্তমান প্রধান বিচারপতি ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর সাবেক চেয়ারম্যান ওবায়দুল হাসানও বাকশাল ছাত্রলীগের ঢাবি শাখার সাবেক নেতা ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে অনার্স এবং মাস্টার্স ডিগ্রি নেন ও পরে এলএলবি করেন। তাঁর পিতা ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা এবং সাবেক সংসদ সদস্য। তাঁর ছোট ভাই ছিলেন শেখ হাসিনার একান্ত সচিব। ওবায়দুল হাসান ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন। পরবর্তীতে বিএনপি সরকার তাকে বরখাস্ত করে। ২০০৯ সালের ৩০ জুন ওবায়দুল হাসানসহ চিহ্নিত আওয়ামী লীগ ও সাবেক ছাত্রলীগের ১০ জনকে হাইকোর্ট বিভাগে নিয়োগ দেয় শেখ হাসিনার সরকার। এছাড়া আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে পরবর্তী সিরিয়ালে যারা রয়েছেন, তাদের প্রায় সকলেই ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের সাবেক নেতা।

ওবায়দুল হাসানের পর প্রধান বিচারপতির সিরিয়ালে রাখা হয়েছে ঢাবি ছাত্রলীগের সাবেক নেতা এনায়েতুর রহিমকে। তিনিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে স্নাতকোত্তর করেন এবং পরে এলএলবি করেন। তার পিতা আব্দুর রহিম দিনাজপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন। তাঁর ভাই ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলো। এনায়েতুর রহিম ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন। ২০০৫ সালে তিনি আওয়ামী লীগের হয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক নির্বাচিত হন। এনায়েতুর রহিম ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যানও ছিলেন। জামায়াতে ইসলামের আমীর শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির আদেশ দেন এই বিচারক।

এমন চিহ্নিত, দলীয় ও আওয়ামী আদর্শের লোকেদের কাজ থেকে ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা করাটাই অবান্তর। ক্ষমতার জোরে উপর মহলকে খুশি করার জন্য তাঁরা পবিত্র বিচারালয়কে কলুষিত করে এই ফরমায়েশি রায় দিয়েছে। শুধু তাই নয় আসামি পক্ষের সাক্ষীর জেরাও ঠিকমত শোনা হয়নি, সাক্ষীকে (সুখরঞ্জন বালি) কোর্ট থেকে গুম করে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্কাইপি কেলেঙ্কারি, রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী আদালতে হাজির না করে জবানবন্দিকে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা, গণমাধ্যমের অনুপ্রবেশ নিষিদ্ধকরণ, বিদেশি আইনজীবীদের আসতে বাধা দেওয়া, সুবিধামতো আইন পরিবর্তন ইত্যাদি নানা ধরনের অসঙ্গতিতে পরিপূর্ণ ছিলো পুরো বিচারপ্রক্রিয়া।

শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যে ৬টি ভিত্তিহীন অভিযোগের ভিত্তিতে বিচার অনুষ্ঠিত হয় :

ট্রাইব্যুনাল-২ প্রথম রায়ে আব্দুল কাদের মোল্লাকে একটি অভিযোগে যাবজ্জীবন, একটি অভিযোগে খালাস এবং বাকি ৪টি অভিযোগে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি প্রদান করে। অভিযোগগুলো ও তার সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ তৎকালীন পত্রপত্রিকা এবং রায়ের কপি থেকে তুলে ধরা হলো-

অভিযোগ-১ : প্রথম চার্জটি হলো মিরপুরের মুক্তিযোদ্ধা পল্লবকে গুলি করে হত্যা করা। এই চার্জে রাষ্ট্রপক্ষের ২য় সাক্ষী সৈয়দ শহিদুল হক মামা ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য প্রদান করেন। তিনি বলেন যে, তিনি শুনেছেন কাদের মোল্লার নির্দেশে আক্তার গুন্ডা পল্লবকে ঠাটারি বাজার থেকে ধরে এনে মিরপুরে হত্যা করে। কিন্তু তিনি কার কাছ থেকে শুনেছেন এ ব্যাপারে সঠিক কোনো উত্তর দিতে পারেননি। বরঞ্চ তিনি বলেন, ‘‘আমি জনতার কাছ থেকে শুনেছি’’। রাষ্ট্রপক্ষের অপর সাক্ষী সৈয়দ আব্দুল কাইয়ুম বলেছেন যে, তিনিও শুনেছেন যে, মিরপুর বাংলা কলেজের একজন ছাত্রকে কাদের মোল্লার নির্দেশে হত্যা করা হয়। কাদের মোল্লার পক্ষের সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী শাহেরা, তিনি শহীদ পল্লবের ভাবী। তিনি বলেন, তিনি কখনও শহীদ পল্লবের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে কাদের মোল্লার নাম শুনেননি। শুধু তাই নয় তদন্তকারী কর্মকর্তা তার কোনো প্রকার জবানবন্দি গ্রহণ না করে কাদের মোল্লার নাম জড়িয়ে ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি জমা দেন। এই চার্জের অন্যতম সাক্ষী শহিদুল হক মামা, যিনি ১ ও ২ নং চার্জের সাক্ষী, ২০/০৪/২০১২ইং তারিখে বিটিভিতে প্রচারিত ‘রণাঙ্গনের দিনগুলি’ নামক এক অনুষ্ঠানে উক্ত চার্জের ঘটনাগুলো বর্ণনা করেন। কিন্তু সে বর্ণনায় আসামির নাম জড়িয়ে কোন ঘটনার উল্লেখ করেননি। অথচ ট্রাইব্যুনাল উপরোক্ত চার্জে জনাব আব্দুল কাদের মোল্লাকে ১৫ বছরে কারাদণ্ড প্রদান করেন।

অভিযোগ-২ : শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে কবি মেহেরুন্নেসা হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। এই চার্জে সাক্ষ্য দিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের ২ নম্বর সাক্ষী সৈয়দ শহিদুল হক মামা, রাষ্ট্রপক্ষের ৪ নম্বর সাক্ষী কবি কাজী রোজী, রাষ্ট্রপক্ষের ১০ নম্বর সাক্ষী সৈয়দ আব্দুল কাইয়ুম। উক্ত সাক্ষীদের কেউই জনাব আব্দুল কাদের মোল্লার এই ঘটনাটি দেখেননি এবং তারা কার কাছ থেকে শুনেছেন তাও ট্রাইব্যুনালে বলতে পারেননি।

রাষ্ট্রপক্ষের-২ নং সাক্ষী বলেন, তিনি শুনেছেন কবি মেহেরুন্নেসাকে কাদের মোল্লার নির্দেশে হত্যা করা হয় কিন্তু তিনি কার মাধ্যমে শুনেছেন, কীভাবে শুনেছেন- তার জবাব দিতে পারেননি। রাষ্ট্রপক্ষের ৪নং সাক্ষী কবি কাজী রোজী বলেন, তিনি শুনেছেন কাদের মোল্লার নেতৃত্বে বিহারিরা কবি মেহেরুন্নেসাকে হত্যা করে। কিন্তু কাদের মোল্লা কবি মেহেরুন্নেসাকে হত্যা করেছেন কিনা তিনি তা শুনেননি। অপরদিকে তার ২০১১ সালের জুন মাসে প্রকাশিত ‘শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা’ নামক বইয়ে তিনি শহীদ কবি মেহেরুন্নেসার মৃত্যুর ব্যাপারে বিশদভাবে লিখেন। কিন্তু তিনি তার বইয়ে কাদের মোল্লার নাম কোথাও উল্লেখ করেননি। রাষ্ট্রপক্ষের ১০নং সাক্ষী বলেন কবি মেহেরুন্নেসাকে হত্যা করেছে বিহারিরা এবং এই হত্যার ব্যাপারে তিনি কোনো ভাবেই কাদের মোল্লাকে জড়িত করেননি। এই চার্জে প্রসিকিউশন তাদের মামলা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে। তা সত্ত্বেও জনাব আব্দুল কাদের মোল্লাকে ট্রাইব্যুনাল ১৫ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করে।

অভিযোগ-৩ : ৩য় চার্জে আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আইনজীবী এবং বুদ্ধিজীবী খন্দকার আবু তালেব হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। এই চার্জে সাক্ষ্য দিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের ৫ নন্বর সাক্ষী খন্দকার আবুল আহসান এবং রাষ্ট্রপক্ষের ১০ নম্বর সাক্ষী সৈয়দ আব্দুল কাউয়ুম। তাঁরা উভয়ে শোনা সাক্ষী এবং তাঁরা কেউ সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারেননি যে আব্দুল কাদের মোল্লা জড়িত। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের তত্ত্বাবধানে মিরপুরের জল্লাদখানায় সংরক্ষিত শহীদদের জীবনী এবং শহীদ পরিবারের বিভিন্নজনের জবানবন্দী সংরক্ষণ করা হয়েছে তা আসামি পক্ষ সংগ্রহ করে বিচার চলাকালে ট্রাইব্যুনালে জমা দেয়। উক্ত জবানবন্দীতে দেখা যায় রাষ্ট্রপক্ষের ৪ নম্বর সাক্ষী কাজী রোজী তার লেখা বই ‘শহীদ কবি মেহেরুন্নেছা’তে খন্দকার আবু তালেব হত্যার জন্য বিহারি হালিমকে দায়ী করেন। সেখানে তিনি কেন আব্দুল কাদের মোল্লার নাম উল্লেখ করেননি জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, “আব্দুল কাদের মোল্লার ভয়ে তার নাম উল্লেখ করা হয়নি।” আইনজীবীগণ প্রশ্ন করেন, “আপনার বই প্রকাশ হয়েছে ২০১১ সালে। আর আব্দুল কাদের মোল্লা গ্রেফতার হন ২০১০ সালে তাহলে তিনি কিভাবে আপনাকে ভীতি প্রদর্শন করেন?” রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী কাজী রোজি এর কোনো জবাব দিতে পারেননি। অথচ ট্রাইব্যুনাল শুধুমাত্র শোনা সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে জনাব আব্দুল কাদের মোল্লাকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করে।

অভিযোগ-৪ : ১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর আব্দুল কাদের মোল্লা রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে কেরানীগঞ্জের ভাওয়াল খানবাড়ি এবং ঘাটারচরে শতাধিক গ্রামবাসীকে হত্যা করেন। রায়ে বলা হয়, প্রসিকিউশন এই অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। তাই এই রায়ে ট্রাইব্যুনাল আব্দুল কাদের মোল্লাকে খালাস দেন। প্রসিকিউশন যে অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে প্রমাণই করতে পারেনি সেই অভিযোগে আপিল বিভাগ যাবজ্জীবন রায় প্রদান করেন। যা বিচারব্যবস্থার ইতিহাসে লজ্জাজনক বিষয়।

অভিযোগ-৫ : পঞ্চম চার্জে পল্লবীর আলোবদি গ্রামে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়েছে জনাব আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে। এই চার্জে সাক্ষ্য দিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের ৬ নম্বর সাক্ষী শফিউদ্দিন মোল্লা এবং রাষ্ট্রপক্ষের-৯ নম্বর সাক্ষী আমির হোসেন মোল্লা। রাষ্ট্রপক্ষের ৬ নম্বর সাক্ষী তার প্রদত্ত জবানবন্দিতে বলেছেন, ঘটনার আগে তার পুরো পরিবার প্রাণভয়ে সাভারস্থ সারুলিয়া গ্রামে চলে যায়। তিনি না গিয়ে ঘটনার দিন পার্শ্ববর্তী ঝোপ থেকে জনাব আব্দুল কাদের মোল্লাকে গুলি করতে দেখেছেন। অপরদিকে তার আপন ছোট ভাই (আব্দুল কাদের মোল্লার পক্ষের ৫নং সাক্ষী) আলতাফ উদ্দিন মোল্লা ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন যে, ঘটনার পূর্বে তাদের পুরো পরিবার পালিয়ে গিয়েছিল সাভারস্থ সারুলিয়া গ্রামে এবং তার বড় ভাই শফিউদ্দিন মোল্লাও তাদের সাথে পালিয়ে গিয়েছিলেন। সুতরাং তার ঘটনা দেখার কোনো প্রশ্নই আসে না এবং তিনি মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছেন। রাষ্ট্রপক্ষের ৯ নম্বর সাক্ষী আমির হোসেন মোল্লা মিরপুর এলাকার লাটভাই হিসেবে পরিচিত। তিনি ১৩ ডিসেম্বর ২০০১ইং তারিখে অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয়েছিলেন। শুধু তাই নয় ১৫/০৫/২০১২ইং তারিখে হাইকোর্টের বর্তমান একজন বিচারপতির জায়গা দখলের অভিযোগে সম্প্রতি কারা ভোগ করেন। এ ছাড়াও তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, ভূমিদখল এবং অবৈধ অস্ত্র রাখার দায়ে শতাধিক মামলা বিচারাধীন আছে। তিনি ২৫/০১/২০০৮ইং তারিখে পল্লবী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। যে মামলায় তিনি অভিযোগ করেছিলেন নিজামী, মুজাহিদ এবং কাদের মোল্লা আলোবদি গ্রাম আক্রমণ করে এবং ঘটনার সময় সে দুয়ারী পাড়াস্থ এক ডোবায় আশ্রয় নেয় যা আলোবদি গ্রাম থেকে ৪ মাইল দূরে অবস্থিত। অথচ ২৬/০৮/২০১২ইং তারিখে তিনি ট্রাইব্যুনালে এসে বলেন ঘটনার সময় তিনি আলোবদি গ্রামে ছিলেন এবং ঘটনার সময় তিনি আব্দুল কাদের মোল্লাকে গুলি করতে দেখেছেন।

উপরোক্ত বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে প্রসিকিউশনের সাক্ষীগণ ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থে ট্রাইব্যুনালের সামনে অসত্য সাক্ষ্য দিয়েছেন। কিন্তু তারপরও মাননীয় ট্রাইব্যুনাল উক্ত অভিযোগে জনাব আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন।

অভিযোগ-৬ : ষষ্ঠ চার্জে প্রসিকিউশন জনাব আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে হযরত আলী লস্কর এবং তার পরিবারকে হত্যার ব্যাপারে অভিযোগ আনেন, যার একমাত্র সাক্ষী হল রাষ্ট্রপক্ষের-৩ নম্বর সাক্ষী মোমেনা বেগম। তিনি বলেন যে, কাদের মোল্লাকে তিনি দেখেননি। জনৈক কামাল ও আক্কাস মোল্লার কাছ থেকে শুনেছেন যে তার বাবাকে কাদের মোল্লা হত্যা করেছে।

একই সাক্ষী মোমেনা বেগম তাদের পরিবারের সদস্যদের হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনা বিষয়ে ২০০৭ সালে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে জবানবন্দী দিয়েছেন। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেছেন, ঘটনার দুই দিন আগে তিনি শ্বশুরবাড়ি চলে যাওয়ায় প্রাণে বেঁচে যান। কোর্টে বলেন, ঘটনাস্থলে তিনি উপস্থিত ছিলেন আর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত বক্তব্যে দেখা যায় তিনি ঘটনার দুই দিন আগে শ্বশুরবাড়ি চলে যান। অথচ ট্রাইব্যুনাল উক্ত অভিযোগে মাত্র একজন সাক্ষীর মুখ থেকে শুনে জনাব আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন। এই অভিযোগেই পরবর্তীতে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তাকে ফাঁসির আদেশ দেয়।

জনাব আব্দুল কাদের মোল্লার পক্ষ থেকে তার সাক্ষী-২ সুশীল চন্দ্র মন্ডল ও সাক্ষী-৩ মোসলেম উদ্দিন আহমেদ (যিনি ফরিদপুরে একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক ছিলেন) ট্রাইব্যুনালে এসে বলেন যে, জনাব আব্দুল কাদের মোল্লা স্বাধীনতার পুরো সময় ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত ফরিদপুরের সদরপুর গ্রামে ছিলেন এবং সেখানকার ধলা মিয়া পীর সাহেবের বাড়িতে থেকে তার সন্তানদের পড়াতেন। আব্দুল কাদের মোল্লার পক্ষের ৬ নম্বর সাক্ষী জনাব হাফেজ এম লোকমান (যিনি ১৯৭১ সালে শহীদুল্লাহ হলের ইমাম ছিলেন। উক্ত হলে জনাব আব্দুল কাদের মোল্লা থাকতেন) বলেন যে, ৭ই মার্চের পর তিনি জনাব আব্দুল কাদের মোল্লাকে হল ছেড়ে বাড়ি চলে যেতে দেখেছিলেন এবং কাদের মোল্লা ১৯৭২ সালের শেষের দিকে বাড়ি থেকে আবার প্রত্যাবর্তন করেছিলেন।

এরপরও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ট্রাইব্যুনালে প্রদত্ত রায়ের সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে বিচারের নামে প্রহসনের নজির সৃষ্টি করেছে। আব্দুল কাদের মোল্লার আপিলের রায় প্রদানকারী পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চে প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন নেতৃত্ব দিলেও মূল রায়টি লিখেছেন বিতর্কিত বিচারক এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। এছাড়া অন্য তিনজন বিচারপতি হলেন- আব্দুল ওয়াহাব মিয়া, এসকে সিনহা ও সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। উল্লেখ্য বিচারপতি আব্দুল ওয়াহাব মিয়া সকল রায়ের বিরুদ্ধেই ভিন্ন মত দেন। তিনি ৫টি অভিযোগ থেকেই আব্দুল কাদের মোল্লাকে সম্পূর্ণ খালাস দেন। যে অভিযোগে (৬ষ্ঠ অভিযোগ) তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় বিচারপতি আব্দুল ওয়াহাব মিয়া সেই অভিযোগ থেকেও আব্দুল কাদের মোল্লাকে খালাস দেন।

আপিল বিভাগের এই বেঞ্চের ২ জন বিচারকের (এসকে সিনহা ও এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী) ব্যাপারে আব্দুল কাদের মোল্লার আইনজীবীদের প্রবল আপত্তি থাকা সত্ত্বেও আদালত তা অগ্রাহ্য করেন। এই দুইজন সরাসরি আওয়ামী দালাল এবং র’য়ের এজেন্ট। যা স্কাইপি কেলেঙ্কারি ও অবসরের পর তাদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রমাণিত।

এটা আমাদের কাছে স্পষ্ট যে, বাংলাদেশ থেকে ইসলামী আন্দোলনকে স্তব্ধ করে ফেলার জন্য এই ফ্যাসিস্ট সরকার শুরুতেই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে টার্গেট করে নেতৃত্বশূন্য করার পাঁয়তারা করেছে। তারা মনে করেছিল এর মাধ্যমে এই আন্দোলন দমে যাবে। কিন্তু ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা দুনিয়ার কোনো প্রাপ্তি নয় বরং আখেরাতকে পাবার জন্যই সবকিছু ত্যাগ করে থাকে তাই তাদের রোখবার সাহস কারো নাই। আমরা শহীদের উত্তরসূরি হিসেবে এই জমিনে কালিমা প্রচার করে যাবোই। আমাদের সাবেক রাহবারদের প্রতি যে যুলুম এই ইসলামবিদ্বেষীরা করেছে তার যথাযথ জবাব দেওয়ার জন্য আমাদের সচেষ্ট হতে হবে। তাদের জন্য Transitional Justice নিশ্চিত করতে আমাদের মেধা এবং কলমকে কাজে লাগাতে হবে। প্রহসনের এই বিচারের বিরুদ্ধে আমাদের প্রচুর গবেষণাপত্র, আর্টিকেল এবং ডকুমেন্টারি তৈরি করে বিশ্বের মানুষের কাছে তাদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, ছাত্র সংবাদ

আপনার মন্তব্য লিখুন

Md.Moslim Mia

- 8 months ago

আল্লাহ তায়ালা জান্নাতের মেহমান হিসেবে কবুল করুন আমীন।

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির